ইশকে ইলাহী পর্ব-০৬: আল্লামা শিবলি রহ.-এর ঘটনাসমূহ

মূল

মাহবুবুলওলামা হযরত মাওলানা পীর
জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী মুজাদ্দেদী

অনুবাদ ও সম্পাদনা
শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী

আল্লামা শিবলি রহ.- এর ঘটনাসমূহ

আব্বাসীয় খেলাফতকালে ইসলামী হুকুমতের সীমানা কয়েক লাখ বর্গমাইল পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছিল। বিভিন্ন এলাকার গভর্ণর নিজেদের বুদ্ধিমত্তা ও ক্ষমতা ব্যবহার করে নিজেদের এলাকার প্রশাসনিক কার্যক্রম চালাচ্ছিল। অধিকাংশ অঞ্চল থেকে ন্যায়-নীতি ও নিষ্ঠার সংবাদই কেন্দ্রে আসছিল। তবে কিছু এলাকার আইন-শৃঙ্খলাব্যবস্থা ও অবকাঠামোগত অবস্থান আরো উন্নত করার প্রয়োজন দেখা দিল। তাই সমকালীন খলিফা ভাবলেন, সকল গভর্ণরকে কেন্দ্রে ডেকে আনা যায় এবং যারা বেশি ভালো করেছে তাদেরকে কেন্দ্রের পক্ষ থেকে পুরস্কার দেয়া যায়। এতে করে যারা ভালো করে নি, তাদের সংশোধন হবে এবং ভালো করার প্রেরণাও পাবে। এই চিন্তা করে তিনি শাহি-ফরমান জারি করলেন। কয়েক দিনের মধ্যেই শাহি-ফরমান সব অঞ্চলে পৌঁছে গেল। অবশেষে নির্ধারিত দিনে সকল গভর্ণর কেন্দ্রে চলে আসল। কোনো কোনো গর্ভণরকে এর জন্য হাজার মাইলও সফর করতে হয়েছিল। যাই হোক, খলিফা তাদের জন্য একটি বিশেষ বৈঠকের আয়োজন করলেন। সেখানে কিছু কিছু গভর্ণরকে পুরস্কৃত করলেন এবং অন্যদেরকে উপদেশ শুনিয়ে দিলেন। সভাশেষে খলিফা প্রত্যেককে নিজের কক্ষ থেকে একটি করে শাহি -পোশাক হাদিয়া দিলেন। পরের দিন সকলের জন্য বিশেষ দাওাতের আয়োজন করা হল। সকলেই রকমারি শাহি খাবার ও ফলমূল খেয়ে খুব খুশি হল। খাবার পর্ব শেষ হওয়ার পর মতবিনিময় ও খোশগল্পের আসর বসল। আসর বেশ জমে ওঠল। ঠিক সেই মুহূর্তে একজন গভর্ণরের হাঁচির বেগ দেখা দিল। সে যথেষ্ট চেষ্টা করছিল হাঁচিটাকে দমিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু পারল না। অবশেষে হাঁচি তো দিল, এক সঙ্গে দু’তিনটা দিল। ফলে কয়েক মুহূর্তের জন্য আসরের চেহারা পাল্টে গেল। সরব আসর কিছুক্ষণের জন্য নীরব হয়ে গেল। সকল গভর্ণর বেচারা হাঁচিদাতা গভর্ণরের দিকে তাকিয়ে রইল। বেচারা অনুভব করল সবাই তার প্রতি ত্যক্ত-বিরক্ত। বেচারার হাঁচির কারণে মনে হয় যেন তাকে সকলে মিলে দৃষ্টি দ্বারা চিবিয়ে খাবে। কিন্তু কী আর করা; হাঁচি তো কারো ইচ্ছায় আসে না। যাই হোক, অবশেষে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে এই বিরক্তিকর পরিস্থিতি সকলেই কাটিয়ে ওঠল এবং পুনরায় সকলে খলিফার দিকে মনোযোগী হল। ঠিক এ মুহূর্তটাকে হাঁচিদাতা সুযোগ মনে করে নিজের পরিহিত শাহি-পোশাকের এক কোনা দিয়ে যেই মাত্র নাক পরিস্কার করতে গেল, ঠিক তখনি খলিফা তার প্রতি তাকালেন। এটা দেখে খলিফা খুব চটে গেলেন। শাহি-পোশাকের এহেন অবমাননা তিনি মেনে নিতে পারলেন না। রাগে-ক্ষোভে সকলের সামনে ফেটে পড়লেন। হাঁচিদাতা বেচারা গভর্ণরকে নিদারুণ বকাঝকা করলেন এবং তার থেকে শাহি-পোশাকটা কেড়ে নিয়ে তাকে দরবার থেকে বের করে দিলেন। এতে নিমিষে সভার সব আনন্দ উবে গেল। উপস্থিত সকল গভর্ণর মহাচিন্তায় পড়ে গেল। প্রত্যেকেই ভয় পেয়ে গেল যে, খলিফা রাগের মাথায় তাদের অবস্থাও অনুরূপ বেহাল করে দেন কি না। ব্যবস্থাপনামন্ত্রী পরিস্থিতি অনুমান করতে পেরে খলিফাকে পরামর্শ দিল, আপনি সভা আজকের জন্য মুলতবি করে দিন। অবশেষে সভা সমাপ্তির ঘোষণা দিয়ে দেয়া হল। প্রত্যেকে নিজেদের বিশ্রামস্থলে চলে গেল। দরবারে রয়ে গেলেন শুধু খলিফা এবং তার মন্ত্রী। উভয়ে এই অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির কথা ভেবে বিমর্ষ মনে বসে রইলেন। ইত্যবসরে দারোয়ান এসে জানাল, নাহাবন্দ অঞ্চলের গভর্ণর খলিফার সঙ্গে সাক্ষাত লাভের অনুমতি চায়। খলিফা অনুমতি দিয়ে দিলেন। গভর্ণর ভেতরে এসে খলিফাকে সালাম দিলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, ‘হাঁচি আসা কারো ইচ্ছাধীন না ইচ্ছাবহির্ভূত?’

গভর্ণরের প্রশ্নে খলিফা অন্য কিছু আচঁ করলেন, তাই তিনি ঝাঁঝের সঙ্গে বললেন, ‘এজাতীয় প্রশ্ন কেন করছেন? যান নিজের কাজ করুন।’

কিন্তু গভর্ণরও আরেকটি প্রশ্ন করে বসলেন যে, ‘যে লোকটিকে শাহি পোশাক দিয়ে নাক পরিস্কার করার অপরাধে সকলের সামনে লাঞ্চিত করা হয়েছে। তার কাছ থেকে শাহি-পোশাক খুলে নেয়া হয়েছে। তাকে মজলিস থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। এত বড় শাস্তি দেয়র প্রয়োজন আসলেই কী ছিল? আরো কম শাস্তি দিলেও চলত না?’

এই প্রশ্ন শোনে খলিফা ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ‘আপনার প্রশ্ন থেকে জবাবদীহিতা তলবের গন্ধ আসছে।  আপনাকে সতর্ক করে দিচ্ছি, আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলবেন না। অন্যথায় পস্তাতে হবে।’

খলিফার সতর্কবাণী শুনে গভর্ণর আরো গাম্ভীর্যপূর্ণ ভাষায় বললেন, ‘বাদশাহ সালামত! একটা কথা আমি বুঝেছি। আপনি এক ব্যক্তিকে শাহি-পোশাক উপহার দিয়েছেন। সে আপনার উপহারের অবমূল্যায়ন করেছে। তাই আপনি তাকে এই পরিমাণ লাঞ্ছিত করলেন! এতে আমার মনে একটা বষিয় তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। তাহল এই, আমার প্রাণপ্রিয় প্রভু আমার গায়ে মানবতার পোশাক পরিয়ে এই দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন। যেন আমি তাঁর দেয়া পোশাকটির অবমূল্যায়ন না করি। যদি করি তাহলে তিনি হাশরের দিন আমাকে লাঞ্ছিত করবেন।’

এই বলে উক্ত গভর্ণর নিজের পরিহিত শাহি-পোশাকটা খুলে বাদশাহর সিংহাসনের দিকে নিক্ষেপ করে দিলেন এবং বললেন, ‘আমার জন্য উচিত হবে, আমি প্রথমে মানবতার পোশাকের মূল্যায়ন করব, যাতে কেয়ামত দিবসের লাঞ্চনা থেকে বাঁচতে পারি।’

এই বলে তিনি শাহি-মর্যাদাকে লাথি মেরে বের হয়ে পড়লেন। বের হয়ে চিন্তা করতে লাগলেন কী করা যায়! তখনি তিনি মনে মনে স্থির করে নিলেন যে, জুনাইদ বোগদাদীর কাছে যেয়ে বাতেনি নেয়ামত হাসিল করবেন।

এই চিন্তা করে তিনি কয়েক দিনের সফর সৈহ্য করে বাগদাদে হযরত জুনাইদ বোগদাদী রহ.-এর খেদমতে পৌঁছলেন। তাঁর কাছে আরজ করলেন, ‘আপনার নিকট যে বাতেনি নেয়ামত আছে, তা আমাকে দান করুন। আপনি ইচ্ছা করলে তা আমাকে ফ্রী দিতে পারেন কিংবা যে মূল্য নির্ধারণ করবেন, পরিশোধ করার জন্য আমি প্রস্তুত আছি।’

জুনাইদ বোগদাদী রহ. উত্তর দিলেন, ‘মূল্য চাইলে দিতে পারবে না। ফ্রী দিলে তুমি তার কদর করবে না।’

গভর্ণর জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাহলে কী করতে পারি? আপনি যা বলবেন তা-ই করার জন্য আমি প্রস্তুত আছি।’

জুনাইদ বোগদাদী রহ. উত্তর দিলেন, ‘এখানে কিছুু দিন অবস্থান কর। তারপর অন্তরের আয়না পরিস্কার হয়ে গেলে কাম্য-নেয়ামত দিয়ে দেয়া হবে।’

এভাবে কয়েক মাস অতিবাহিত হওয়ার পর একদিন জুনাইদ বোগদাদী রহ. তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ এর আগে তুমি কী কাজ করতে?’

উত্তর দিলেন, ‘এর আগে আমি অমুক এলাকার গভর্ণর ছিলাম।’

এটা শুনে জুনাইদ বোগদাদী রহ. বললেন, ‘ ও আচ্ছা। তাহলে যাও, বাগদাদ শহরে গন্ধকের দোকান খুলে বসো।’

নির্দেশ মাফিক তিনি দোকান খুলে বসে পড়লেন। এখন এক দিকে গন্ধকের দুর্গন্ধ, অপর দিকে কাস্টমারদের সঙ্গে দরাদরি করার ঝামেলা, কাস্টমারও তো সব আর এক রকম হয় না…যার কারণে তার নিদারুণ কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু কী আর করা! এভাবে তার এক বছর কেটে গেল। এক বছর পর তিনি বোগদাদী রহ.-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘হযরত! এক বছর হয়ে গেছে!’

হযরত উত্তর দিলেন, ‘ও… তাহলে তুমি দিনগুলোর হিসাবও রেখেছ! যাও, আরো এক বছর দোকান কর।’

তিনি চলে গেলেন। আরো এক বছর দোকান চালালেন। কিন্তু তবিয়ত তার আগের মত নেই। আরো পরিশীলিত হয়ে উঠেছে। যার কারণে তিনি এবার হিসাব রাখেন নি। তাই জুনাইদ বোগদাদী রহ. এক দিন তাকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, ‘ গভর্ণর সাহেব, আরো এক বছর তো চলে গেল।’

তিনি উত্তর দিলেন, ‘হযরত! এবার হিসাব রাখি নি তো!’

এবার জুনাইদ বোগদাদী রহ. তার হাতে ভিক্ষার একটা ঝুলি ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘যাও, বাগদাদ শহরে গিয়ে ভিক্ষা কর।’

এটা শুনে তিনি অবাক-নয়নে তাকিয়ে রইলেন। জুনাইদ বোগদাদী রহ. বললেন, ‘যে নেয়ামতের সন্ধানে তুমি এখানে এসেছ তা পেতে হলে যা বললাম তা করতে হবে। অন্যথায় যেখান থেকে এসেছ সেখানে ফিরে যাও। এখানে তোমার কাজ নেই।’

কী আর করা! গভর্ণর সাহেব সঙ্গে সঙ্গে ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিয়ে নিলেন। বাগদাদে চলে গেলেন। যেখানে কিছুলোকের সমাগম দেখতেন, সেখানে হাত পেতে দিয়ে বলতেন, ‘আল্লাহর ওয়াস্তে কিছু দেন।’ কিন্তু কারো কাছ থেকে কিছু পেতেন না। কারণ, তাকে তো ভিক্ষুকের মত লাগত না। ভিক্ষুকের চেহারা আর গভর্ণরের চেহারা তো একরকম হয় না। যার কারণে অনেক সময় মানুষের কাছে বিভিন্নরকমের তিরস্কারও শুনতে হত। বলত, ‘কাম চোর কোথাকার; চেহারা তো বেশ নাদুসনুদুস। ভিক্ষা করে খাও কেন? কাম কাজ করে খেতে পার না?’ এতসব তিরস্কার শুনেও সব তিনি হজম করে নিতেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এভাবে তিনি একবছর ভিক্ষা করলেন। দ্বারে দ্বারে ঘুরতেন। কিন্তু কোনো কা্না-কড়িও পেতেন না।

আত্মাকে সংশোধন করার এটাও একটা পদ্ধতি ছিল। হযরত জুনাইদ বোগদাদী রহ, তার দেমাগ থেকে গভর্ণরগিরির ভূত ছাড়াতে চেয়েছিলেন। তাকে অহঙ্কার থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন। অবশেষে তিনি ভিক্ষার হাত পেতে বুঝতে সক্ষম হলেন যে, ‘আসলে আমার কোনো যোগ্যতা নেই। ভিক্ষার হাত পাততে হলে মাখলুকের কাছে নয়; খালেকের কাছে পাততে হবে।’

অবশেষে একবছর পর একদিন হযরত জুনাইদ বোগদাদী রহ. তাকে ডেকে পাঠালেন। এবার হযরতের কথার মাঝে আগের সেই শাসন নেই; আছে তার প্রতি সম্মান। তাই ভাষাও পাল্টে গেল। ‘তুমি’ থেকে ‘আপনি’তে চলে আসলেন। বললেন, ‘গভর্ণর সাহেব! আপনার নাম কী?’

উত্তর দিলেন, ‘ফকিরের নাম আবুবকর শিবলি।’

হযরত এবার মায়াঝরা কণ্ঠে বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আজ থেকে আপনি আমাদের মাহফিলে বসবেন।’

যেন দীর্ঘ তিনবছর মুজাহাদা করানোর পর হযরত নিজের মাহফিলে বসার অনুমতি দিলেন। কিন্তু শিবলি রহ.-এর অন্তর তো মুজাহাদার উত্তাপে আগে থেকেই পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল। যার ফলে হযরতের একেকটি কথা দ্বারা তাঁর বুক নুরানি হয়ে উঠছিল এবং চেহারায় তা উদ্ভাসিত হয়ে প্রকাশ পাচ্ছিল। তাঁর অন্তর্দৃষ্টির তেজও বৃদ্ধি পাচ্ছিল। কয়েক মাসের মধ্যে অবস্থা এতটাই চমৎকারভাবে পাল্টে গেল যে, তাঁর অন্তর আল্লাহর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠল। অবশেষে হযরত একদিন তাঁকে ডেকে বললেন, ‘শিবলি! আপনি যখন নাহাবন্দ-অঞ্চলের গভর্ণর ছিলেন, তখন হয়ত আপনি কারো ওপর জুলুমও করেছিলেন। এজন্য যারা আপনার হাতে মজলুম হয়েছে, আপনার হাতে যাদের হক নষ্ট হয়েছে, তাদের একটা তালিকা তৈরি করুন।’

শেষ পর্যন্ত তিনি মাত্র দিন দিনে মোটামোটি দীর্ঘ তালিকা তৈরি করে ফেললেন। হযরত বললেন, ‘শিবলি! আধ্যাত্মিকতার নিসবত ততক্ষণ পর্যন্ত ভাগ্যে জুটে না, যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দার হক পূরণ করা হয় না। সুতরাং যান, তালিকা অনুপাতে সেই সব মানুষের কাছ থেকে মাফ নিয়ে আসেন।’

শিবলি রহ. চলে গেলেন নাহাবন্ধ অঞ্চলে। সেখানে প্রত্যেকের ঠিকানা খুঁজে বের করে করে ক্ষমা চাইতে লাগলেন। অনেকে তো সহজেই ক্ষমা করে দিল। কিন্তু এমনও হয়েছে যে, অনেকে বলত, আপনি গভর্ণর থাকাবস্থায় আমাদেরকে বেশ কষ্ট দিয়েছেন। সুতরাং ক্ষমা করব না। ক্ষমা পেতে হলে এত সময় পর্যন্ত রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কেউ কেউ বলত, আমার ঘর নির্মাণের কাজ করে দিন, তারপর ক্ষমা করব। শিবলি রহ. প্রত্যেকের কথা শুনতেন এবং তাদের ইচ্ছা পূরণ করে ক্ষমা নিয়ে ছাড়তেন। এভাবে ক্ষমাপ্রার্থনার কাজে নাহাবন্দে কেটে গেল দু’বছর। তারপর আসলেন বাগদাদে। সুতরাং তাঁর খানকাহি-জিন্দেগির মোট সময় হল পাঁচ বছর। এই দীর্ঘ বছরে তিনি মুজাহাদা ও সাধনার চাক্কিতে নফসকে এমনভাবে পেষণ করেছিলেন যে, নফস প্রায় মরে গেল। নফস থেকে ‘আমি’ বের হয়ে গেল। অন্তরজগতে ‘তুমিই তুমি’ ঢুকে গেল। ফলে আল্লাহর রহমতের মাঝে জোশ চলে এল। একদিন জুনাইদ বোগদাদি রহ. তাঁকে আধ্যাত্মিক নেসবতের খেলাফত দিয়ে দিলেন। এরপ কী হল! তাঁর দৃষ্টির ধরণ পাল্টে গেল। পায়ের গতির মোড় ঘুরে গেল। চিন্তার পদ্ধতি বদলে গেল। গাফলতির চাদর খসে পড়ল। আল্লাহর মারেফতে বুকটা ভরে নূরের খাযানা হয়ে উঠল। তিনি হয়ে গেলেন ‘আরিফবিল্লাহ’ তথা আল্লাহর মারেফত লাভে ধন্যব্যক্তি। ইশকে ইলাহী দ্বারা অন্ত তাঁর আলোকিত হয়ে উঠল। তাঁরই জীবনের কয়েকটি ঘটনা নিম্নে পেশ করা হল–

০১. একবার তিনি একাকী বসে আল্লাহর যিকিরে মশগুল ছিলেন। ইত্যবসরে জনৈক যুবক-সালেক (আত্মশুদ্ধিতে প্রচেষ্টারত মুরিদ) এসে বলল, ‘হযরত! আমাকে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক করিয়ে দিন।’

তিনি উত্তর দিলেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে…?’ তখন তাঁর যবান থেকে ‘আল্লাহ’ শব্দটা এতটাই মহব্বতের সঙ্গে বের হল যে, উক্ত যুবকের অন্তর যেন ইশকের তীরে ছিদ্র হয়ে গেল এবং সেখানেই পড়ে মারা গেল। তাঁকে গ্রেফতার করা হল। আদালতে নেয়ার পর বিচারক তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘শিবলি! আপনি যুবকটাকে মেরে ফেললেন!’

তিনি উত্তর দিলেন, ‘মোটেই না। বরং যুবকটি এসে আমাকে বলল, আমাকে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক করিয়ে দিন। উত্তরে আমি শুধু বলেছিলাম, আল্লাহর সঙ্গে…? আর সে ইশকের সাগর থেকে উথ্থিত, আমার যবানে উচ্চারিত এই ‘আল্লাহ’ শব্দের উত্তাপ সহ্য করতে পারে নি। সুতরাং আমার কী দোষ?’

বিচারক শিবলি রহ.-এর মুখ থেকে ‘আল্লাহ’ শব্দটা শোনামাত্র তাঁর হৃদয়জগতেও যেন তুফান শুরু হল। তাই তিনি শিবলি রহ.-কে সসম্মানে মুক্তি দিয়ে দিলেন।

০২. তাঁর অভ্যাস ছিল, কেউ যদিক তাঁর সামনে আল্লাহর নাম নিত, তিনি তাকে মিষ্টিমুখ করাতেন। এক ব্যক্তি এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, যে ব্যক্তির মুখে আমার মাহবুবের নামা উচ্চারিত হবে, তাকে মিষ্টি খাওয়াব না তো কী করব! সুবহানাল্লাহ।

০৩. একদিন লোকেরা দেখতে পেল, শিবলি রহ. অত্যন্ত রাগতভঙ্গিতে তরাবারি হাতে নিয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন। জিজ্ঞেসা করা হল, ‘শিবলি! কী ব্যাপার’

তিনি উত্তর দিলেন, ‘আমি জানতে পেরেছি, লোকেরা আমার মাহবুবের নাম গাফলতির সঙ্গে নেয়। আর আমার মতে আমার প্রিয়তমের নাম গাফলতির সঙ্গে নেয়া কুফরির ন্যায়।’

০৪. একদিন তিনি কোথাও যাচ্ছিলেন। পোলাপান তাঁর পেছনে লেগে গেল এবং তাঁকে পাগল মনে করে তাঁর সঙ্গে এটা সেটা করতে লাগল। তিনি সেদিকে ভ্রুক্ষেপই করছিলেন না। এরই মধ্যে একটি ছেলে তাঁকে কংকর মেরে দিল। গিয়ে পড়ল তাঁর পায়ের নলীতে। যার কারণে সেখান থেকে রক্ত বের হতে লাগল। এক পথচারী একান্ড দেখে দুষ্টু ছেলেদেরকে বকাঝকা করে তাড়িয়ে দিল এবং তাঁর প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশপূর্বক রক্ত মুছে দেয়ার উদ্দেশে যেই মাত্র এগিয়ে গেল, তখন লোকটি দেখতে পেল, তার পা থেকে রক্তের ফোটা মাটিতে পড়ছিল, তা দ্বারা ‘আল্লাহ’ শব্দ অংকিত হয়ে যাচ্ছিল।

সুবহানাল্লাহ! ইশকেইলাহি রক্তের সঙ্গে কিভাবে মিশে গেলে এমনটি হতে পারে!

০৫. একবার ঈদের দিন তিনি কালো কাপড় পরে বসে রইলেন। লোকেরা জিজ্ঞেস করল, ‘এটা কেন?’

তিনি বললেন, ‘মানুষ নিজের প্রভুকে ভুলে বসে আছে। তাদের অন্তর গুনাহর আধিক্যের কারণে আমার কাপড়টার মতই কালো হয়ে গেছে।’

০৬. একবার তিনি অযু করে নামাযের উদ্দেশ্যে মসজিদে যাচ্ছিলেন। তখন তাঁর অন্তরে আল্লাহর পক্ষ থেকে ইলহাম হল, ‘শিবলি! তুমি এমন গোস্তাখিপূর্ণ অযু করে আমার ঘরের দিকে যাচ্ছ?’

এই ইলহাম পেয়ে তিনি পুনরায় অযু করার উদ্দেশ্যে বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয়ার উদ্দেশে যে-ই ঘুরে দাঁড়ালেন, তখনি আবার ইলহাম হল ‘শিবলি! তুমি আমার দরজা ছেড়ে চলে যাচ্ছ!’

এই অবস্থা দেখে তিনি ওয়াজদের হালতে (আল্লাহপ্রেমের উন্মত্ততা) এসে চিৎকার বলে ওঠলেন, ‘ওগো আল্লাহ!’

আর তখনি পুনরায় ইলহাম হল, ‘শিবলি! তুমি আমাকে তোমার জোশ দেখাচ্ছ?’

এবার তিনি একেবারে নীরব হয়ে গেলেন। ঠিক তখনি ইলহাম হল, ‘শিবলি! তুমি আমাকে তোমার ধৈর্য্যক্ষমতা দেখাচ্ছ?’

এবার তিনি কোনো দিশা না পেয়ে ভিক্ষুকের মত মাওলার দরবারে হাত তুলে দিলেন। অঝোরধারায় কান্না শুরু করে দিলেন।

মূলত আল্লাহতায়ালা তাঁর এই বিনয়টাই দেখতে চেয়েছিলেন।

০৭. একবার তাঁর অন্তরে ইলহাম হল, ‘শিবলি! তুমি যদি চাও, আমি তোমার দোষ মানুষের কাছে প্রকাশ করে দেই, যাতে করে তোমাকে কেউ বদনজর দিতে না পারে।’

শিবলি রহ.ও সেদিন প্রেমচাতুরিতে ডুবে ছিলেন, তাই তিনি নিবেদন করলেন, ‘আল্লাহজী! আপনি কী চান, আমি আপনার রহমত খুলে খুলে মানুষের কাছে প্রকাশ করি? যাতে করে মানুষ আশার সাগরে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে আপনাকে আর সিজদা করবে না।’

সঙ্গে সঙ্গে ইলহাম হল, ‘শিবলি! তুমি আমারটা বলো না, আমি তোমারটা বলব না।’

উপরোক্ত ঘটনাগুলো দ্বারা অনুমান করা যায়, যাঁরা নিজের নফসকে সাধনার চুলায় জ্বালিয়ে ‘খাঁটিসোনা’ করে নিয়েছে, তাঁদের অন্তরে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা কী পরিমাণ হয়!

আরো পড়ুন– ইশকে ইলাহী পর্ব-০৭