ইশকে রাসূল–৩: মহান আল্লাহর সবচে’ প্রিয় তিনি

ইশকে রাসূল
ইশকে রাসূল

মূল: মাহবুবুলওলামা হযরত মাওলানা পীর জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী মুজাদ্দেদী দা: বা:

অধ্যায়-৩

ইশকে রাসূূল বা নবীপ্রেমের কারণসমূহ

عِبَارَاتُنَا شَتَّى وَحُسْنُكَ وَاحِدٌ ** وَكُلٌّ إِلَى ذَاكَ الجَمَالِ يُشِيرُ

‘আমাদের ভাষা বিভিন্নরূপ হলেও আপনার সৌন্দর্য একই। আর এসকল শব্দ আর ভাষা কেবল আপনার কমনীয়তার প্রতিই ইঙ্গিত করে।’

মানুষের জন্মগত স্বভাব হচ্ছে সে অন্যের বৈশিষ্ট্য-গুণাবলী, পরিপূর্ণতা, সৌন্দর্য ও কমনীয়তা প্রভৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাকে ভালবাসতে শুরু করে।

নবী করিম-কে মহান আল্লাহ এমন উন্নত মর্যাদা দান করেছেন যে, তাঁর প্রতিটি সৌন্দর্য ও গুণ সর্বোচ্চ পর্যায়ের। যার কোনো তুলনা হতে পারে না। যার কারণে প্রতিটি মুমিন বিনা দ্বিধায় নবী করিম কে ভালবেসে থাকে। নিচে ইশকে রাসুলের কিছু কারণ বা উপাদান পেশ করা হল।

১. মহান আল্লাহর সবচে’ প্রিয় তিনি

———————————————————————————

নবী করিম -কে ভালবাসার প্রথম এবং সর্বপ্রধান কারণ হচ্ছে, তিনি স্বয়ং আল্লাহ তাআলার প্রিয়তম। আল্লাহ তাআলা তাঁকে সবচে’ বেশি ভালোবাসেন। যখন আল্লাহ তাআলা নিজেই তাঁকে সর্বাধিক ভালবাসেন তখন সাধারণ মুমিনগন তাঁকে ভালবাসবে না কেন?

নবী করিম -এর পরিপূর্ণতা, সৌন্দর্য ও কমনীয়তার সবচে’ বড় সাক্ষী খোদ কুরআন মাজিদ। তাঁর পবিত্র সত্তা যেন পবিত্র কুরআনের আমলি-তাফসির বা জীবন্ত ব্যাখ্যা। জাত ও সিফাত (আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী) সম্বলিত আয়াতসমূহের ব্যাখ্যা হচ্ছে, তাঁর আকিদা ও বিশ্বাসসমূহ । তাঁর দৈনন্দিনের আমলগুলো ছিল আহকামের আয়াতসমূহের জীবন্ত-ব্যাখ্যা। কুদরতের বিবরণ সম্বলিত আয়াতসমূহ হচ্ছে, তাঁর দলিল ও প্রমাণ। আল্লাহমুখিতা বিষয়ক আয়াতসমূহের জীবন্ত ব্যাখ্যা ছিল তাঁর নির্জনতার মহূর্তগুলো। তারবিয়াত সংক্রান্ত আয়াতগুলোর সপ্রাণ-ব্যাখ্যা ছিল তাঁর  দীপ্তিমান সময়গুলো। তাঁর রাগ ও প্রতিপত্তি প্রকাশ ছিল আল্লাহর আযাব ও গজব সম্বলিত আয়াতসমূহের প্রাণবন্ত নমুনা। আল্লাহর রহমত-প্রকাশক আয়াতসমূহের সুশোভিত-ব্যাখ্যা দেদীপ্যমান হয়ে উঠত তাঁর সুকুমার সৌন্দর্যে। তাঁর ফানা ফিল্লাহ হওয়া ছিল, আল্লাহ ছাড়া অন্য সব কিছু অস্বীকার সংক্রান্ত আয়াতের অতিশয় সুন্দর ব্যাখ্যা। তাঁর বাকা-বিল্লাহ ছিল, আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ সংক্রান্ত আয়াতগুলোর অনুপম স্বাক্ষর। রহমতের আয়াতগুলোর নিদর্শন ছিল, তাঁর আশা ও আকাঙ্খা। আযাবের আয়াতগুলোর উদাহরণ ছিল, তাঁর ভয় ও ভীতি। এক কথায়, তিনি যেন ছিলেন জীবন্ত-কুরআন। কুরআন দেদীপ্যমান হয়ে ওঠত তাঁর মুবারক সত্তায়। তাই পবিত্র কুরআনের জ্ঞান বিষয়ক বিস্ময়ের যেমন সীমা নেই তেমনি নবী করিম – এর সিরাত এর আমলী বিস্ময়ের কোনো পরিসীমা নেই। অতএব এই মহান বরকতময় সত্তার সাথে ভালবাসা সৃষ্টি হওয়া একটি সহজাত দাবী। মহান আল্লাহ  তার প্রিয় নবী -কে এমন সুমহান মর্যাদা দান করেছেন যার প্রমাণ পবিত্র কুরআনের স্থানে স্থানে বিদ্যমান। সেগুলো থেকে অল্প কিছু এখানে তুলে ধরা হল–

দলিল-১ 

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা যখন অন্যান্য নবীর সাথে কথপোকথন করেছেন, তখন তিনি তাদের স্বনামে সম্বোধন করেছেন। যেমন ইয়া আদামু, ইয়া নূহ, ইয়া যাকারিয়্যা, ইয়া ইবরাহিম, ইয়া দাউদু, ইয়া মুসা, ইয়া ঈসা …। কিন্তু তাঁর প্রিয় পাত্র হযরত মহাম্মাদ ﷺ-কে সম্বোধনকালে তাঁর নাম ধরে ডাকেন নি; বরং প্রয়োজনকালে তার বিশেষ বিশেষ গুণ ও অবস্থা সম্বলিত শব্দ দিয়ে সম্বোধন করেছেন। যেমন-يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ (হে নবী!) يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ (হে রাসূল!) يَا أَيُّهَا الْمُزَّمِّلُ (হে বস্ত্রাবৃত!) يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ (হে চাদরাবৃত!) ইত্যাদি। এর দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়, তিনি তাঁর মাহবুব নবী করিম -কে কেমন অপরিসীম ও অগাধ ভালবাসতেন। সম্মান দিতেন। এসবই পরম করুণাময়ের বিশেষ কৃপা ও অনুগ্রহ। এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন,

إِنَّ أَوْلَى النَّاسِ بِإِبْرَاهِيمَ لَلَّذِينَ اتَّبَعُوهُ وَهَـذَا النَّبِيُّ وَالَّذِينَ آمَنُواْ وَاللّهُ وَلِيُّ الْمُؤْمِنِينَ

‘মানুষদের মধ্যে যারা ইবরাহিম আ.-এর অনুসরণ করেছিল তারা, আর এই নবী এবং যারা এ নবীর প্রতি ঈমান এনেছে তারা ইবরাহিম আ.-এর ঘনিষ্ঠতম।’

এই আয়াতেও সাইয়্যিদুনা ইবরাহিম আ.-এর প্রকৃত নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ নবী করিম -এর আসল নাম বাদ রেখে তাঁর গুণবাচক নাম ব্যবহার করা হয়েছে। আল্লামা সাখাবী রহ. এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন।

দলিল-২

আল্লাহ তাআলা বলেন,

لَا تَجْعَلُوا دُعَاء الرَّسُولِ بَيْنَكُمْ كَدُعَاء بَعْضِكُم بَعْضًا

‘তোমরা তোমাদের রাসুলকে সেভাবে সম্বোধন করো না যেভাবে তোমরা একে অপরকে সম্বোধন করে থাকো…।’

এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের স্পষ্টভাবে নিষেধ করে দিয়েছেন। তোমরা নিজেদের মাঝে যেভাবে নাম ধরে ডেকে থাকো সেভাবে তোমাদের প্রিয় রাসুল কে ডেকো না। সম্বোধন করো না। এর দ্বারা প্রমাণ হয় যে, নবী করিম -এর নাম ধরে ডাকা চরম বেয়াদবি। সীমাহীন ধৃষ্টতা। তাই সব সময় সম্মানসূচক শব্দ দ্বারা তাঁকে সম্বোধন করতে হবে। যেমন- ইয়া রাসুলাল্লাহ ইয়া নাবিয়্যাল্লাহ সেই সাথে সাথে কঠোরভাবে হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়েছে যে, নবী করিম ﷺ-এর সাথে সামান্যতম বেয়াদবি বা ধৃষ্টতা প্রদর্শন করলে তার সমস্ত আমল ধ্বংস করে দেয়া হবে। তাই আল্লাহ তাআলা স্বয়ং তার প্রিয় রাসুলের সম্মান ও মর্যাদার প্রতি লক্ষ রেখে কখনও তাকে নাম ধরে সম্বোধন করেন নি। সাথে মুমিনদেরও তা থেকে নিষেধ করেছেন। সুবহানাল্লাহ!!

দলিল-৩

বিভিন্ন জাতি-সম্প্রদায় তাদের নিজ নিজ নবীদের বিরুদ্ধে নানা ধরণের অহেতুক অভিযোগ উত্থাপন করেছে। এমনকি আখেরি নবীর বিরুদ্ধেও কিছু হতভাগা অভিযোগের আঙ্গুল উত্তোলন করেছে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, পূর্ববর্তী নবীদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের জবাবে আল্লাহ তাআলা সে সব নবীর মুখ দিয়েই দিয়ে নিয়েছেন। যেমন হযরত হুদ আ.-এর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের জবাব আল্লাহ পাক তার মুখ দিয়েই এভাবে দিয়েছেন,

  يَا قَوْمِ لَيْسَ بِي سَفَاهَةٌ

‘হে আমার সম্প্রদায়! আমি বোকা-অজ্ঞ নই।’

হযরত নুহ আ.-এর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের জবাবে তিনি বলেছেন,

  يَا قَوْمِ لَيْسَ بِي ضَلَالَةٌ

‘হে আমার সম্প্রদায়! আমি পথ ভ্রষ্ট নই।’

কিন্তু নবী করিম ﷺ-কে যখন কতিপয় হতভাগা মজনুন (পাগল) বলে আখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে তখন স্বয়ং আল্লাহ পাক তার জবাব দিয়ে বলেন,

وَمَا صَاحِبُكُم بِمَجْنُونٍ

‘তোমাদের সঙ্গী মাজনুন (পাগল) নন।’

সেই সাথে নবী করিম ﷺ-কে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন,

مَا أَنتَ بِنِعْمَةِ رَبِّكَ بِمَجْنُونٍ

‘আপনার পালনকর্তার অনুগ্রহে আপনি উম্মাদ নন।’

বরং আরো বলেন,

وَإِنَّكَ لَعَلى خُلُقٍ عَظِيمٍ

‘আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।’

শুধু এতটুকুতেই ক্ষান্ত না হয়ে তিনি আরো বলেন,

وَإِنَّ لَكَ لَأَجْرًا غَيْرَ مَمْنُونٍ

‘আপনার জন্যে অবশ্যই রয়েছে অশেষ পুরস্কার।’

এরপরেও আল্লাহর মত মহান সত্তার গোস্বা প্রশমিত হয় নি, তাই আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে এ পর্যন্ত বলে ফেলেন যে,

وَلَا تُطِعْ كُلَّ حَلَّافٍ مَّهِينٍ. هَمَّازٍ مَّشَّاءٍ بِنَمِيمٍ. مَّنَّاعٍ لِّلْخَيْرِ مُعْتَدٍ أَثِيمٍ .عُتُلٍّ بَعْدَ ذَٰلِكَ زَنِيمٍ

‘যে অধিক শপথ করে, যে লাঞ্ছিত, আপনি তার আনুগত্য করবেন না। যে পশ্চাতে নিন্দা করে একের কথা অপরের নিকট লাগিয়ে ফিরে। যে ভাল কাজে বাধা দেয়, সে সীমালংঘন করে, সে পাপিষ্ঠ, কঠোর স্বভাব, তদুপরি কুখ্যাত…।’

দলিল-৪

নবীগণ থেকে অঙ্গীকার নেয়ার কথা আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন। সেখানে তিনি হযরত মুহাম্মাদ -এর কথা সর্বাগ্রে উল্লেখ করেছেন এভাবে–

وَإِذْ أَخَذْنَا مِنَ النَّبِيِّينَ مِيثَاقَهُمْ وَمِنكَ وَمِن نُّوحٍ وَإِبْرَاهِيمَ

আর আমি প্রতিশ্রুতি নিয়েছি নবীদের থেকে। আপনার কাছ থেকে, নুহ থেকে ইবরাহিম থেকে ..।

হযরত উমর ফারুক রাযি. এই আয়াত শোনামাত্রই তার মাঝে বিশেষ অবস্থার সৃষ্টি হয়। নিজেকে সামলে নেয়ার পর বলেন, ‘হে আল্লাহ পাকের একান্ত প্রিয় পাত্র! আপনার মর্যাদা কত সুমহান! আপনার অবস্থান কত উঁচুতে!! আল্লাহ পাক নবীদের আলোচনাকালে সর্বপ্রথম আপনার কথা উল্লেখ করেছেন।’

দলিল-৫

আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে নিজের এবং নিজের প্রিয় রাসুল -এর আলোচনার সময় উভয়ের মাঝে অত্যন্ত চমৎকার ভঙ্গিতে ‘হরফে আ’তফ–ওয়াও’ উল্লেখ করে বলেছেন,

وَمَن يُطِعْ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ فَازَ فَوْزًا عَظِيمًا

‘যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করে, সে অবশ্যই মহা সাফল্য অর্জন করবে।’

দলিল-৬

 মহান আল্লাহ পাক নবী করিম -এর আনুগত্যকে স্বয়ং তার আনুগত্যের মর্যাদা দান করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে,

مَّن يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ

‘যে ব্যক্তি রাসুলের আনুগত্য করল সে যেন আল্লাহর আনুগত্য করল।’

দলিল-৭

যে সব মানুষ রাসুল -এর  হাতে বায়াত গ্রহণ করেছে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে তাদের বায়াতকে স্বয়ং আল্লাহর হাতে বায়াতের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন,

إِنَّ الَّذِينَ يُبَايِعُونَكَ إِنَّمَا يُبَايِعُونَ اللَّهَ يَدُ اللَّهِ فَوْقَ أَيْدِيهِمْ

‘(হে রাসুল) নিশ্চয় যারা আপনার হাতে বায়াত গ্রহণ করে নিশ্চয় তারা আল্লাহর হাতেই বায়াত করে। আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর রয়েছে …।’

দলিল-৮

আল্লাহ পাক বলেন,

وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ

‘আমি আপনার আলোচনাকে সমুচ্চ করেছি।’

একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়। কালিমায়ে তাওহিদلا اله الا اللــــــــه محمد رســـــــــــول اللــــــــه   এর মধ্যে আল্লাহ এবং মুহাম্মাদ শব্দের মাঝে ব্যবধানকরী কোনো হরফ নেই। আরও বরং لا اله الا اللــــــــه এর মধ্যে যেমন ১২টি অক্ষর আছে তেমনি محمد رســـــــــــول اللــــــــه এর মাঝেও হুবহু ১২টি অক্ষর রয়েছে। আল্লাহ পাক আজানের মধ্যেও তার নামের সাথে মুহাম্মাদ নাম যোগ করে দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করেছেন। নামাজের মধ্যেও নবীর নামের আলোচনা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন। যদ্দরুণ-পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ তথা পৃথিবীর যেখানেই আজান-নামাজ হয় সেখানেই নবী করিম -এর আলোচনা হয়।

দলিল-৯

আল্লাহ তাআলা মহানবী -কে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসাবে প্রেরণ করেছেন। পবিত্র কুরআনে ঘোষণা হচ্ছে,

وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِّلْعَالَمِينَ

‘আমি আপনাকে গোটা বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি।’

عَالَمِينَ শব্দটি عَالَم-এর বহুবচন। এর দ্বারা মানব-দানব-জীব-জড়সহ সব কিছুকেই বুঝায়। সুতরাং বিশ্ববাসী বলতে আল্লাহ ছাড়া যা কিছু আছে, সবই এর অন্তর্ভুক্ত। নবী করিম বলেছেন,

إِنَّمَا أَنَا رَحْمَةٌ مُهْدَاةٌ

‘আমি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে প্রেরিত রহমত।’ (ইবনু আসাকির)

হযরত ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত নবী করিম বলেছেন,

إِنَّ اللَّهَ بَعَثَنِي رَحْمَةً مُهْدَاةً، بُعثْتُ بِرَفْعِ قَوْمٍ وَخَفْضِ آخَرِينَ

‘আল্লাহ তাআলা আমাকে অনুকরণীয় রহমত হিসেবে পাঠিয়েছেন। আমি প্রেরিত হয়েছি অনুসারীদের মর্যাদাবান করার জন্য আর নাফরমানদের অবনত করার জন্য।’ (মাআ’রিফুল কুরআন)

মোল্লা আলী কারী রহ. এই হাদিসের ব্যাখ্যায় লিখেছেন,

‘আমি আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে সেই বিশেষ রহমত, যা আল্লাহ পাক তোহফা হিসাবে পাঠিয়েছেন মানবজাতির জন্য। যারা আল্লাহ পাকের এই তোহফা (উপহার) গ্রহণ করবে তারা সফলতা লাভ করবে। আর যারা গ্রহণ করবে না তারা লাঞ্চিত হবে।’

নবী করিম -এর সাথে ঈমানদারদের আত্মিক সম্পর্ক স্থাপন হওয়া সহজাত চাহিদা। প্রত্যেক মুমিন তাদের জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে নবী করিম -এর রহমতের মুখাপেক্ষি। আল্লাহ পাক সেই রহমতের ছায়া আমাদের চিরস্থায়ীভাবে নসিব করুন। কবি বলেন,

أمى ودقيقه دان عالم

بے سايه وسا ئبان عالم

‘তিনি নিরক্ষর কিন্তু গোটা বিশ্ববাসীর মহান শিক্ষক। সকল সূক্ষ্ম বিষয় উদ্ধার করতে পারেন। তিনি আশ্রয়হীন ছিলেন। কিন্তু গোটা জাতির জন্য ছিলেন ছায়া হয়ে।’

দলিল-১০

আল্লাহ তাআলা বলেন,

إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ

‘নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি রহমত প্রেরণ করেন।’

এই পবিত্র আয়াতে إِنَّ শব্দটি তাগিদ প্রদানের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। আর مضارع-এর সিগা সার্বক্ষণিকের অর্থ প্রদান করে। তার অর্থ দাঁড়ায় আল্লাহ পাক এবং তার ফেরেশতারা সার্বক্ষণিক নবী করিম ﷺ-এর ওপর রহমত প্রেরণ করতেই আছেন। রুহুল বয়ান নামক তাফসিরগ্রন্থেও লেখক লিখেছেন,

‘নবী করিম -এর ওপর আল্লাহ পাকের রহমত প্রেরণের অর্থ হচ্ছে তাকে মাকামে মাহমুদ ও মাকামে শাফায়াত (প্রশংসিত স্থান এবং সুপারিশের অধিকার) প্রদান করা। আর ফেরেশতাগণের দরুদ প্রেরণের অর্থ হচ্ছে নবী করিম ﷺ-এর মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধি্র জন্য দোয়া করা। মুমিনের দরুদ পাঠের অর্থ তার উত্তম ও সুন্দর গুণাবলীর আলোচনা এবং প্রশংসা করা। সুতরাং নবী করিম -এর সর্বোচ্চ মর্যাদা আর অধিক সম্মানিত হওয়ার জন্য এর চেয়ে বড় আর কোনো প্রমাণ হতে পারে না যে, স্বয়ং মহান আল্লাহ সর্বদা তার ওপর রহমত প্রেরণ করে যাচ্ছেন এবং তিনি আল্লাহ পাকের সবচে’ প্রিয় পাত্র।’

অতএব, একথা দিবালোকের মত পরিস্কার যে, তিনি যখন আল্লাহ পাকের এত প্রিয় বান্দা তখন তার সাথে প্রত্যেক মুমিনের গাঢ় হৃদ্যিক ভালবাসা স্থাপন করা একান্ত আবশ্যকীয়। তিনি সমস্ত সৃষ্টি জগতের সর্দার। পূর্ববর্তী পরবর্তীদের নেতা এবং নবীকুল সম্রাট। হযরত আব্দুর রহমান জামী রহ কত সুন্দরইনা বলেছেন,

یَا صَاحِبَ الۡجَمَالِ وَیَا سَیِّدَالۡبَشَر
مِنۡ وَّجۡہِکَ الۡمُنِیۡرِ لَقَدۡ نُوِّرَ الۡقَمَرُ
لَا یُمۡکِنِ الثَّنَاءُ کَمَا کَانَ حَقَّہٗ
بعد از خُدا بزرگ تُو ئی قِصّۂ مُختصر

‘হে সৌন্দর্য্যের মূর্তপ্রতীক, হে মানব সম্রাট, তোমার নুরানী চেহারা থেকে চাঁদ নূর (আলো) গ্রহণ করে। তোমার যে পরিমাণ গুণগান ও প্রশংসা করা দরকার তা করা একদম সম্ভব। তবে অতি সংক্ষেপে চুড়ান্ত সার কথা হচ্ছে, আল্লাহর পরেই তোমার মর্যাদা। অর্থাৎ গোটা সৃষ্টিজীবের মধ্যে তুমি সর্বোত্তম।’

আরো পড়ুন– ইশকে রাসূল পর্ব-০৪