রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণ করুন এখন থেকেই…

রমজানের প্রস্তুতি
রমজানের প্রস্তুতি

রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণ করুন এখনই

শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী

হামদ ও সালাতের পর!

চমৎকার দৃষ্টান্ত

সম্মানিত হাজেরিন! অসংখ্য কল্যাণ, রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের হাতছানি দিয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হতে যাচ্ছে পবিত্র রমজান মাস। মাসটির অফুরন্ত কল্যাণ বুঝাতে গিয়ে চমৎকার দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন মুজাদ্দিদে আলফেছানি রহ.। তিনি বলেন, একটি বিশাল সমুদ্র। ওই সমুদ্র থেকে আঙ্গুলের ডগায় করে যদি এগার বারে এগার ফোঁটা পানি তোলা হয়। তাহলে এগার মাসের দৃষ্টান্ত হল, এগার ফোঁটা পানি। আর গোটা সমুদ্রটাই হচ্ছে রমজানের দৃষ্টান্ত। সুতরাং আমরা কল্পনাও করতে পারব না যে, এই মাসে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কী পরিমাণ কল্যাণ দিতে চান!

এটা আশা নয়; তামাশা 

মাসটি সম্পর্কে আমাদের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি হল, যেহেতু রহমতের মাস, মাগফিরাতের মাস, নাজাতের মাস সুতরাং কোনো না কোনোভাবে মাফ তো পেয়েই যাব! এই দৃষ্টিভঙ্গি ভুল নয় তবে পরিপূর্ণ নয়। কেননা, এই মাসে আল্লাহ অবশ্যই আমাদেরকে মাফ করতে চান। তবে বিনা শর্তে নয়। শর্ত হল, إِذَا اجْتَنَبَ الْكَبَائِرَ যখন আমরা মাসটিকে কবিরা গুনাহ থেকে মুক্ত রাখব তখনই তিনি আমাদেরকে মাফ করবেন। (মুসলিম ৩৪৯)

যদি কোনো ব্যক্তি রমজানেও কবিরা গুনাহয় ডুবে থাকে আর আল্লাহর রহমতের আশা করে তাহলে হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী রহ. বলেন, এর নাম রহমতের আশা নয়; বরং এটা রহমতের সঙ্গে তামাশা। রহমতের আশা করা নিষেধ নয়; তবে তামাশা করা নিষেধ।

এজন্য বলেছি, আমাদের লালিত দৃষ্টিভঙ্গি ভুল নয় তবে পরিপূর্ণ নয়।  একে শর্ত পূরণের মাধ্যমে পরিপূর্ণ করতে হবে।

ভোগের প্রস্তুতি নয়; ত্যাগের প্রস্তুতি নিন

আবার আমরা রমজানের প্রস্তুতি বলতে বুঝি, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। কাজেই খেজুর তেল পেঁয়াজ ইত্যাদি কিনে নাও! রমজানের জন্য খাদ্য মজুদ কর! ব্যাস! এটাই রমজানের প্রস্তুতি। এটাও ঠিক নয়। কেননা, রমজানের অন্যতম শিক্ষা তো হল, ভোগের প্রস্তুতি নয়; ত্যাগের প্রস্তুতি নেয়া। ‘সাওম’ তো বলা হয়, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি ত্যাগ করাকে। অথচ আমরা ত্যাগের প্রস্তুতি না নিয়ে ভোগের প্রস্তুতি নিয়ে থাকি!

দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টান

আমি আপনাদেরকে রমজান উপলক্ষে আগে ভাগে বাজার করে নেয়া থেকে নিষেধ করছি না। তবে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর কথা বলছি। এভাবে চিন্তা করবেন যে, বাজার-সদাই করতে গেলে অনেক সময়ের প্রয়োজন হয়। তাছাড়া আজকাল মার্কেটগুলোর যে অবস্থা…চোখের হেফাজত করা মুশকিল হয়। এজন্য রমজানের আগেই এই কাজ সেরে ফেলব, যাতে সময়ের হেফাজত হয় এবং মুবারক মাসে একটু বেশি ইবাদত করা যায়। অনুরূপভাবে যাতে চোখের হেফাজত হয় এবং মাসটিকে গুনাহ থেকে মুক্ত রাখা সহজ হয়।

রাসূলুল্লাহ রজব মাস আসলেই আমাদেরকে রিমাইন্ডার (Reminder) দিতেন যে, রমজান আসছে…। তিনি রজবের চাঁদ দেখলে দোয়া করতেন,اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي رَجَبٍ، وَشَعْبَانَ، وَبَلِّغْنَا رَمَضَانَ ‘হে আল্লাহ!  হে আল্লাহ! রজব ও শাবান মাস আমাদের জন্য বরকতময় করুন এবং আমাদেরকে রমজান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিন।’ (তাবরানি ৩৯৩৯)

সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে এসেছে, كانوا يدعون الله تعالى ستة أشهر أن يبلغهم رمضان ‘তাঁরা ছয় মাস আগ থেকেই আল্লাহর কাছে মাসটির জন্য দোয়া শুরু করে দিতেন।’ (লাতায়িফুল মাআরিফ ১৪৮)

কে কত বড় আল্লাহর ওলি

আমাদের শায়েখ মুরশিদ মাহবুবুল ওলামা হযরত মাওলানা পীর জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী মুজাদ্দেদী দা. বা. বলেন, আগেকার দিনে কে কত বড় আল্লাহর ওলি–এটা ওজন করা হত, কে কতটা রমজান পেয়েছেন। যিনি যত বেশি রমজান পেয়েছেন তাঁকে তত বড় আল্লাহর ওলি মনে করা হত। কেননা বেশি রমাজান পেয়েছেন মানে বেশি ইবাদত করেছেন। আর বেশি ইবাদত করেছেন মানে আল্লাহর বেশি পেয়ারা হয়েছেন। সুতরাং যিনি যত বেশি রমজান পেয়েছেন তিনি তত বড় আল্লাহর ওলি হয়েছেন।

রমজানের এপিঠ-ওপিঠ

সম্মানিত মুসল্লিয়ানে কেরাম! রমজান রহমতের। আবার রমজান কিন্তু গজবেরও। কারণ এই রমজানকে কেন্দ্র করেই জিবরাইল আলাইহিসসালামের একটা বদদোয়া আছে, যে বদদোয়ার সঙ্গে নবীজি -এর ‘আমীন’ আছে। স্থানটা ছিল মসজিদে নববি। নবীজি  ছিলেন মিম্ববের প্রথম ধাপে। জিবরাইল আলাইহিসসালাম বদদোয়া করে বসলেন, بَعُدَ مَنْ أَدْرَكَ رَمَضَانَ ، فَلَمْ يُغْفَرْ لَهُ ‘যে ব্যক্তি রমজান পেল অথচ নিজের গুনাহ মাফ করাতে পারল না, সে আল্লাহ তাআলার রহমত থেকে দূরে সরে যাক।’ আর আল্লাহর তাআলার রহমত-বঞ্চিত হওয়াটাকেই পরিভাষায় ‘গজব’ বা লানত বলা হয়। প্রতি উত্তরে নবীজি বললেন, ‘আমীন’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! কবুল করে নিন! (বাইহাকি, শুয়াবুল ঈমান ১৬৬৮)

অপর বর্ণনায় এসেছে, জিবরাইল আলাইহিসসালাম বলেছিলেন, رَغِمَ أَنْفُ عَبْدٍ دَخَلَ عَلَيْهِ رَمَضَانُ لَمْ يُغْفَرْ لَهُ ওই ব্যক্তি ধ্বংস হোক, যে রমযান পেয়েও নিজের গুনাহ মাফ করাতে পারল না। নবীজি বলেন, তখন আমি বললাম, আমীন। (আলআদাবুল মুফরাদ ৬৪৬)

একটু অন্তরটাকে নাড়া দিন। অনুভতিকে জাগ্রত করুন যে, যে বিষয়ে জিবরাইল আলাইহিসসালামের মত ফেরেশতা বদদোয়া করেছেন, নবীজি ‘আমীন’ বলেছেন। তাও আবার মসজিদে নববিতে! সে বিষয়টা কতটা নাজুক ও হৃদয়স্পর্শী হতে পারে। এমনিতে নবীজি ﷺ-এর নেকদোয়া কিংবা বদদোয়া আল্লাহ তাআলার কাছে মকবুল, সেখানে আবার যুক্ত হয়েছে মসজিদে নববি–যা দোয়া কবুলের অন্যতম স্থান হিসেবে আমরা সকলেই জানি। সুতরাং রমজান পাওয়ার পরেও যে ব্যক্তি গুনাহ মাফ করতে পারবে না; না জানি সে কত বড় বদ নসিব!

রমজানের প্রস্তুতি

এজন্য আমাদের আসন্ন রমজান যেন গজব কিংবা লানতের না হয়; বরং যেন রহমত মাগফিরাত ও নাজাতের হয়–এ লক্ষে আমাদেরকে আগেই কিছু প্রস্তুতি নেয়া দরকার। সে প্রস্তুতিগুলো কী কী হতে পারে, কিভাবে হতে পারে–তা আমাদেরকে আমাদের মাশায়েখগণ কোরআন-সুন্নাহর আলোকে চিহ্নিত করে দিয়েছেন। আমাদের কাজ হল, কেবল আমলে পরিণত করা। এখন সে প্রস্তুতিগুলোর মধ্য থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতি বা পরামর্শ আপনাদের সামনে তুলে ধরছি–ইনশা আল্লাহ।

আমি আপনাদের জন্য দোয়া করি, আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন যে, আল্লাহ তাআলা যেন সকলকে আমল করার তাওফিক দেন। আমিন। তাঁরই কাছে তাওফিক প্রার্থনা করছি, যাতে আমরা রমজানের মহা মূল্যবান মুহূর্তগুলোকে নেক আমালের মাধ্যমে কাজে লাগিয়ে উপকৃত হতে পারি। আরো প্রার্থনা, যাবতীয় গুনাহ থেকে যেন বিরত থাকার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারি। 

এক. তাওবা-ইস্তেগফারের অভ্যাস করুন

এখন থেকেই অধিকহারে তাওবা-ইস্তেগফারের অভ্যাস করুন। তাওবার মূল হল, লজ্জিত হওয়া। এমনকি সহিহ বুখারীর সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুল বারীতে এসেছে, মাশায়েখগণ এও বলেছেন, يَكْفِي فِي التَّوْبَةِ تَحَقُّقُ النَّدَمِ লজ্জিত হওয়াটা পাওয়া গেলেই চলবে, তাওবা হয়ে যাবে। হাদিসেও আছে, রাসূলুল্লাহ বলেছেন, النَّدَمُ تَوْبَةٌ লজ্জিত হওয়াটাই তাওবা। (সহিহ ইবন হিব্বান ২/৩৭৯)

সুতরাং অতীত গুনাহর ব্যাপারে এখন থেকে লজ্জিত হোন এবং তাওবা করেছি; এটা বুঝানোর জন্য অধিকহারে ইস্তেফার করুন। তাওবা করার সময় আল্লাহ তাআলার রহমতের আশা রাখুন। মনে রাখবেন, আমাদের গুনাহর চাইতে তাঁর রহমতের সংখ্যা আরো বেশি। আমরা যে পরিমাণে গুনাহ করতে পারি, তিনি এর চাইতে বেশি মাফ করতে পারেন।

সুতরাং নিজ তাওফিক অনুপাতে একটা স্ট্যান্ডার্ড সংখ্যা নির্ধারণ করে যেমন, প্রতিদিন কম পক্ষে ২০০, ৫০০, ১০০০ বার ইস্তেফার করার নিয়ত করুন। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ বলেন,  إِنِّي لَأَسْتَغْفِرُ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ كُلَّ يَوْمٍ مِائَةَ مَرَّةٍ আমি প্রতিদিন আল্লাহর কাছে তাওবা-ইস্তেগফার করি এক শত বার। (মুসনাদে আহমাদ ২/৪৫০)

যিনি সম্পূর্ণ নিস্পাপ, যাঁর জীবনে গুনাহর লেশমাত্রও ছিল না, তিনি যদি প্রতিদিন এক শত বার তাওবা-ইস্তেগফার করে থাকেন তাহলে আমাদের গুনাহয় থৈ থৈ করা এ জীবনে কী পরিমাণ তাওবা-ইস্তেগফার করা দরকার! আমরা তো জমিনের যে অংশেই পা রেখেছি, সেখানেই গুনাহর সাক্ষী রেখে দিয়েছি। সুতরাং এখন থেকে তাওবার মাঝে পড়ে থাকা আমাদের জন্য আরো অনেক বেশি দরকার।

কী জঘন্য চিন্তা!

সম্মানিত হাজেরিন! আমরা অনেকেই এভাবে চিন্তা করে বসে থাকি যে, ‘রমজান আসুক, তখন তাওবা করব। এর আগে ইচ্ছে মত যত পারি গুনাহ করে মজা লুটে নেই।’ কী জঘন্য চিন্তা! এর অর্থ হল, আল্লাহ তাআলার রহমতের আশাটাকে নিজের গুনাহ করার হাতিয়ার বানিয়ে ফেললাম। এটা আল্লাহর রহমতের সঙ্গে এক প্রকার তামাশা নয় কি? এর দ্বারা আল্লাহ তাআলার অহংকারে লাগে। এজন্য খবরদার, এমন চিন্তা করবেন না; বরং এখন থেকেই অধিকহারে তাওবা-ইস্তেগফার-কান্নাকাটি শুরু করে দিন। অন্যথায় দেখবেন, উক্ত নেগেটিভ চিন্তার কারণে যদি আল্লাহ তাআলার বড়ত্বে আঘাত লেগে যায় তাহলে তিনি রহমতের মাসে রহমতের পরিবেশেও আপনাকে তাওবা করার তাওফিক দিবেন না।

দুই. আনন্দিত হোন

রমজানের আগমণে আনন্দিত হওয়া; এটাও রমজানের প্রস্তুতিরই একটি অংশ। মুমিনের বৈশিষ্ট্য হল, নেক আমল সামনে আসলে খুশি হয়। আর মুনাফিক ভ্রূ কুচকিয়ে ফেলে, সে নারাজ হয়ে যায়। এজন্য দেখবেন, রমজান আসছে–একথা শুনে অনেকেই খুশি হচ্ছেন। আবার অনেকেই নারাজ হচ্ছেন। বিশেষ করে ফুডস বা রেস্টুরেন্ট ব্যবসা থাকলে তো আর কথাই নেই। ভীষণ মনে কষ্ট তার। ডায়বেটিস রোগীও নারাজ। আমি সবার কথা বলছি না। সমাজের কিছু মানুষের কথা বলছি। রোগীর মনঃকষ্ট রোগের কারণে, ব্যবসায়ীর মনঃকষ্ট ব্যবসার কারণে, ক্রেতা বা ভোক্তার মনঃকষ্ট রমজান আসলে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে এ নিয়ে। একেকজন একেক কারণে নারাজ। বলুন তো, আল্লাহর ভয় না থাকার অভাবে ব্যবসায়ীরা এ মাসকে শোষণের হাতিয়ার বানিয়ে নিচ্ছে; এতে রমজানের কী দোষ! দয়া করে এমনটি করবেন না। বরং রমজানের আগমণে আনন্দিত হোন। ঈমানের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। আল্লাহ তাআলা তো বলেছেন,

قُلْ بِفَضْلِ اللّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَلِكَ فَلْيَفْرَحُواْ هُوَ خَيْرٌ مِّمَّا يَجْمَعُونَ
আপনি বলুন! এটা আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর রহমতেই হয়েছে। সুতরাং এতে তারা যেন আনন্দিত হয়। তারা যা কিছু সঞ্চয় করে, এটা তার চেয়ে উত্তম। (সূরা ইউনুস ৫৮)
সুতরাং আমাদের যদি কিছু বাহ্যিক ক্ষতি হয়ও, তাহলেও আমাদের উচিত আল্লাহর ওই দয়া ও মেহেরবাণীর প্রাপ্তিতে আনন্দিত হওয়া, যা তিনি এ মাসে আমাদেরকে দান করবেন। কেননা, আমাদের নগদ লাভ থেকে, বাহ্যিক সঞ্চয় থেকে সেটা অনেক উত্তম যা তিনি তাঁর খাজানা থেকে আমাদেরকে এই মাসে দান করবেন। যার নাম রহমত। যার নাম মাগফিরাত। যার নাম নাজাত। আলহামদুলিল্লাহ, আমরা তো মুমিন। সুতরাং আমাদের উচিত খুশি হওয়া। এটাই আল্লাহর নির্দেশ– فَلْيَفْرَحُواْ তাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত, তারা যেন আনন্দিত হয়। এজন্য হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ বলেন,
مَا أَتَى عَلَى الْمُسْلِمِينَ شَهْرٌ خَيْرٌ لَهُمْ مِنْ رَمَضَانَ ، وَلا أَتَى عَلَى الْمُنَافِقِينَ شَهْرٌ شَرٌّ لَهُمْ مِنْ رَمَضَانَ وَذَلِكَ لِمَا يُعِّدُ الْمُؤْمِنُ فِيهِ مِنَ الْقُوَّةِ لِلْعِبَادَةِ وَمَا يُعِدُّ فِيهِ الْمُنَافِقُ مِنْ غَفَلاتِ النَّاسِ وَعَوَرَاتِهِمْ ، هُوَ غُنْمٌ لِلْمُؤْمِنِ يَغْتَنِمُهُ التَّاجِرُ
আল্লাহ তাআলার কসম! মুসলমানদের জন্য রমযানের চেয়ে উত্তম কোনো মাস আসে নি এবং মুনাফিকদের জন্য রমযান মাসের চেয়ে অধিক ক্ষতির মাসও আর আসে নি। কেননা মুমিনগণ এ মাসে (গোটা বছরের জন্য) ইবাদতের শক্তি ও পাথেয় সংগ্রহ করে। আর মুনাফিকরা তাতে মানুষের উদাসীনতা ও দোষত্রুটি অন্বেষণ করে। এ মাস মুমিনের জন্য গনীমত আর মুনাফিকের জন্য ক্ষতির কারণ। (মুসনাদে আহমদ ৮৩৬৮)
কারো যদি আনন্দিত হতে মনে না চায় তাহলে মনের বিপরীতে হলেও আনন্দিত হবেন। বলতে পারেন, সেটা কীভাবে? এভাবে যে, আনন্দিত হতে না পারার জন্য আল্লাহর কাছে তাওবা করবেন, লজ্জিত হবেন তাহলে ‘ইনশা-আল্লাহ’ আপনি আনন্দিত হয়েছেন বলে আল্লাহ গণ্য করে নিবেন।
তিন. পেছনের অনাদায়ী রোজা থেকে মুক্ত হোন
বিশেষত মা-বোনদের উদ্দেশ্যে বলছি। আমাদের জীবনেও থাকতে পারে। হয়ত বিগত বছরগুলোর কোনো রোজা হয়ত কোনো কারণে ক্বাযা হয়ে গিয়েছিল। যেগুলো এখন পর্যন্ত আদায় করা হয় নি। মা-বোনেরা এজাতীয় রোজাগুলোকে ‘ভাংতি রোজা বলে। এটা তাদের মাঝে প্রচলিত একটি বিশেষ পরিভাষা। যদি এমন কোনো রোজা থেকে যায় তাহলে সেগুলো রমজান আসার আগেই শাবান মাসের মধ্যে আদায় করে দায়মুক্ত হয়ে যান। সাহাবায়ে কেরামের জিন্দেগিতে এজাতীয় রোজা থাকলে তাঁরা শাবান মাসেই পূরণ করে দিতেন। যেমন, আয়েশা রাযি বলেন,
كَانَ يَكُونُ عَلَيَّ الصَّوْمُ مِنْ رَمَضَانَ فَمَا أَسْتَطِيعُ أَنْ أَقْضِيَهُ إِلا فِي شَعْبَانَ
আমার উপর বিগত রমজানের রোজা বাকি থাকলে শা‘বান মাসে ছাড়া আমি তা আদায় করতে পারতাম না। (বুখারী ১৮৪৯)
চার. রমজানের জরুরি ইলম শিখুন
রমজান আসার আগে রমজানের ফাযায়েল ও মাসাইলের ইলম শিখুন। কেননা আমলের আগে মাসাইলের ইলমের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এমনকি ইলম শেখা ছাড়া তো ঈমানও পরিপূর্ণভাবে শেখা হয় না। কিসের কারণে রোজা ভাঙ্গে কিংবা মাক্রুহ হয়ে যায় ইত্যাদি মাসআলা এখন থেকে শেখা শুরু করে দিন।
পরিবারের সদস্যদের রমজানের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে রোজার ফজিলতের হাদিস ও এর বিভিন্ন মাসআলা তুলে ধরে খাবারের টেবিলে বা অন্য কোনো সুযোগে প্রতিদিন কিছু সময় ঘরোয়া তালিম হতে পারে। কোনো সন্তান কোরআন তিলাওয়াত না জানলে অথবা তিলাওয়াত অশুদ্ধ থাকলে তাকে এ সুযোগে শুদ্ধ তিলাওয়াত শেখানোর ব্যবস্থা গ্রহণ মাতা-পিতার দায়িত্ব। এ জন্য রমজানের আগেই শিক্ষক ঠিক করে রাখা উচিত। অন্তত নামাজ পড়ার জন্য জরুরি পরিমাণ সুরা ও নামাজের মাসায়েল ভালোভাবে শেখানো রমজান আসার আগেই নিশ্চিত করা চাই। পরিবারের প্রত্যেক সদস্যই যেন রমজানে কোরআন তিলাওয়াতের অভ্যাস গড়ে তোলে, সে জন্য পরিবারপ্রধান তাদের উৎসাহিত করবেন। অনৈসলামিক টিভি প্রগ্রামমুক্ত পরিবার গঠনের সিদ্ধান্তও নিতে হবে রমজান থেকে। সন্তানরা যেন ফেসবুক বা টিভিতে অযথা সময় নষ্ট না করে ইবাদতে মনোযোগী হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
আমলের প্রস্তুতিও আমল

দেখুন, আমলের প্রস্তুতিও কিন্তু আমলই। যেমন এক হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ বলেন,

أَلَا أَدُلُّكُمْ عَلَى مَا يَمْحُو اللَّهُ بِهِ الْخَطَايَا ، وَيَرْفَعُ بِهِ الدَّرَجَاتِ ؟ قَالُوا بَلَى يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ : إِسْبَاغُ الْوُضُوءِ عَلَى الْمَكَارِهِ ، وَكَثْرَةُ الْخُطَا إِلَى الْمَسَاجِدِ ، وَانْتِظَارُ الصَّلَاةِ بَعْدَ الصَّلَاةِ

আমি কি তোমাদেরকে এমন কাজ বলে দেব না, যার দ্বারা আল্লাহ তাআলা গুনাহগুলো মিটিয়ে দিবেন এবং জান্নাতে মর্যাদা বাড়িয়ে দিবেন? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, অবশ্যই বলুন, হে আল্লাহর রাসূল! রাসূলুল্লাহ বলেন, কষ্টের সময় পূর্ণরূপে ওযূ করা, মসজিদের দিকে বেশী বেশী আসা-যাওয়া করা  এবং এক নামাযের পর দ্বিতীয় নামাযের অপেক্ষা করা। (মুসলিম ৪০২)

এখানে মূল আমল কিন্তু নামায। ওযু করা, মসজিদে যাওয়া এক নামাযের পর দ্বিতীয় নামাযের অপেক্ষা করা এগুলো হল, নামাযের প্রস্তুতি। অথচ রাসূলুল্লাহ এগুলোর জন্যও সাওয়াব নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এতে বুঝা গেল, আমলের প্রস্তুতিও আল্লাহ তাআলার দরবারে আমল হিসেবেই গণ্য হয়। এমনকি প্রস্তুতি পর্বেও আমলের সমান সাওয়াব পাওয়া যায়। যেমন রাসূলুল্লাহ বলেন, أَمَا إِنَّكُمْ فِي صَلاَةٍ مَا انْتَظَرْتُمُوهَا শোন! তোমরা যতক্ষণ সালাতের অপেক্ষায় ছিলে ততক্ষণ তোমরা সালাতেই ছিলে। (বুখারী ৫৫৬)
সুতরাং যদি আমরা রমজান আসার আগে রমজানের ফাযায়েল ও মাসাইলের ইলম শিখি তাহলে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে রমজানের রহমত দিয়ে দিবেন এবং রমজান আসার আগেই আমরা রমজানের ফজিলত পাওয়া শুরু করব–ইনশাআল্লাহ।
পাঁচ. রমজানে হালাল খানার ফিকির করুন
হাদিসে শরিফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ বলেছেন,
مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزّورِ وَالعَمَلَ بِهِ، فَلَيْسَ لِلهِ حَاجَةٌ فِي أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ
ব্যক্তি রোযা অবস্থায় মিথ্যাচারিতা ও মন্দ কাজ করা পরিত্যাগ করেনি তার পানাহার পরিত্যাগের কোনোই গুরুত্ব আল্লাহর কাছে নেই। আল্লাহ তাআলা তার পানাহার ত্যাগ করার কোনোই পরোয়া করেন না। (বুখারী ১৯০৩)
আমাদের জীবনের একটি বড় ধরণের মিথ্যাচারিতা ও মন্দ কাজের নাম হল, হারাম খাওয়া। অন্তত রমজানকে এ থেকে পবিত্র রাখি। এমনিতে হারাম তো সর্বাবস্থায় বর্জনীয়। কিন্তু কিছু মানুষ আছে এমন এরা হারামের মধ্যে যেন ‘সুপার গ্লু’র মত আটকে আছে। এদেরকে হারাম বর্জনের নসিহত যতই শোনান না কেন; কানে নিবে না। এদের প্রতি আমাদের মাশায়েখগণের একটা কাকুতিপূর্ণ নসিহত হল, আল্লাহর বান্দা, অন্ততে রমজানে সেভ জোনে থাকো। পরিবারকে হারাম থেকে পবিত্র রাখো। রমজানে রহমত কুড়াতে না পারলেও গজব আহবান করো না। এজন্য প্রয়োজনে রমজানে তোমার কত টাকা খরচ হতে, হিসাব করে ওই পরিমাণ টাকা কারো কাছ থেকে ঋণ নাও এবং ওই টাকাগুলো রমজানে পরিবারের জন্য খরচ কর। তবুও গুনাহ ও হারামমুক্ত রমজান কাটাও এবং নবীজি ও জিবরাইল আলাইহিসসালামের বদ দোয়া থেকে আত্মরক্ষা কর।
ছয়. আরো কিছু প্রস্তুতি
রমজান কোরআন নাজিলের মাস। এজন্য এ মাসের অন্যতম আমল হল, কোরআন তেলাওয়াত করা। আমরা অনেকেই ভাবছি, রমজান আসলে খুব তেলাওয়াত করব। আসলে এরকম সাধারণত হয়ে ওঠে না; বরং অভ্যাস থাকতে হয়। এজন্য আজ থেকে কিছু কিছু তেলাওয়াতের অভ্যাস করুন।
যে বদ অভ্যাস হঠাৎ ছেড়ে দেয়া কঠিন হবে বলে মনে করেন, তা দূর করার অনুশীলন এখন থেকেই শুরু করে দিন।
এখন থেকে কিছু জিকিরের, কিছু দোয়া ও কান্নাকাটির প্র্যাকটিস শুরু করে দিন। অন্যথায় পরে কষ্ট হবে।
আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রত্যেককে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
অনু লিখন; জুমা’র বয়ান।