করোনা ভ্যাকসিন গ্রহণ হালাল না হারাম?

জিজ্ঞাসা–১২৫৪: আসসলামুআলাইকুম। হযরত! আশাকরি আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন। আপনি আমার খুব পছন্দের একজন মানুষ। আপনাকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসি। আমার প্রশ্ন হলো, বর্তমানে কোভিড ১৯ ভ্যাকসিন গ্রহন করা বিষয়ে মুসলিমদের জন্য শরীয়াহ আইন কী? আমার ধারনণা হয় এটা হারাম এবং দাজ্জালের ফিৎনা, যদি এটা গ্রহন করি তাহলে ঈমান দূর্বল হতে পারে….আবার বাবা আদেশ করেছেন টীকা গ্রহন করার জন্য। এখন আমার করণীয় কি? আর আমি নিঃসন্তান, পেরেশানিতে আছি,আমার জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহ আপনার সন্মান আরও বাড়িয়ে দিক। জাজাকাল্লাহ।–শান্ত।

জবাব: وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

এক. রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

لِكُلِّ دَاءٍ دَوَاءٌ ، فَإِذَا أُصِيبَ دَوَاءُ الدَّاءِ بَرَأَ بِإِذْنِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ

প্রতিটি রোগের ঔষধ রয়েছে। সূতরাং রোগে যথাযথ ওষুধ প্রয়োগ করা হলে মহান ও মহিয়ান আল্লাহর হুকুমে রোগ নিরাময় হয়। (মুসলিম ২২০৪)

আর প্রাচীনকাল থেকেই ওষুধ প্রয়োগ বা চিকিৎসার দু’টি প্রচলিত পদ্ধতি রয়েছে–নিরাময়-পদ্ধতি, যা দেহে রোগ সংক্রমিত হওয়ার পর গ্রহণ করা হয় এবং প্রতিরোধ বা প্রতিষেধক-পদ্ধতি, যা সংক্রমিত হওয়ার আগে গ্রহণ করা হয়। করোনা ভ্যাকসিন মূলত চিকিৎসার দ্বিতীয় পদ্ধতি।

দুই. বিশেষ কোনো ওষুধ জায়েয হওয়া এবং না হওয়ার বিষয়টি মূলত দু’টি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। প্রথমত, ওষুধটি উৎপাদনের উপাদান কী? দ্বিতীয়ত, রোগীর জন্য এর প্রয়োজনীয়তা কী পরিমাণ?

তন্মধ্য থেকে ওষুধ উৎপাদনের উপাদান সম্পর্কে কথা হল, ওষুধ সাধারণত তিন ধরণের বস্তু থেকে তৈরি করা হয়।

১. জড় বা খনিজ পদার্থ যেমন, মাটি লোহা সোনা রূপা পাথর ইত্যাদি থেকে উৎপাদিত ওষুধ। এ থেকে উৎপাদিত সকল ওষুধ বৈধ।

২. উদ্ভিদ যেমন, গাছপালা তরুলতা ফুল-ফল ইত্যাদি থেকে উৎপাদিত ওষুধ। এক্ষেত্রে কথা হল, উদ্ভিদ যদি নেশা সৃষ্টিকারী না হয় তাহলে তা থেকে উৎপাদিত সকল ওষুধও বৈধ।

প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা সাধারণত এই দুই ধরণের বস্তু থেকেই ওষুধ তৈরি করে থাকে। সুতরাং বলা বাহুল্য যে, কোনো ভ্যাকসিনে যদি উক্ত দুই ধরণের বস্তু ব্যবহার করা হয় তাহলে তা গ্রহণ করা জায়েয।

৩. জীবজন্তুর বিভিন্ন অংশ যেমন, চামড়া হাড় গোশত চর্বি ইত্যাদি থেকে। মূলত জটিলতা হল, এই থেকে উৎপাদিত ওষুধ নিয়ে। কেননা, জীবজন্তুর মধ্যে কিছু আছে হালাল এবং কিছু আছে হারাম। যেগুলো হালাল সেগুলোর কিছু অংশ আবার হারামও আছে। অনুরূপভাবে যদি জন্তুটিকে ইসলামি শরিয়াহর নিয়ম অনুযায়ী জবাই করা না হয় তাহলে সেটিও মৃতজন্তুর অন্তর্ভুক্ত বিধায় হারাম। সুতরাং যদি শরিয়াহর নিয়ম অনুযায়ী জবাইকৃত জন্তুর হালাল অংশ যেমন চামড়া হাড় গোশত চর্বি থেকে ওষুধটি তৈরি করা হয় তাহলে ওই ওষুধ জায়েয হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যদি হারাম জন্তু কিংবা হালাল জন্তুর হারাম অংশ কিংবা ইসলামি শরিয়াহর নিয়ম অনুযায়ী জবাই করা হয় নি এমন জন্তুর কোনো অংশ দ্বারা ওষুধটি বানানো হয় তাহলে যেমনিভাবে ওই জন্তু সরাসরি খাওয়া হারাম, অনুরূপভাবে ওষুধ বানিয়ে খাওয়া কিংবা রগ ও গোশতের মাধ্যমে দেহের ভেতরে প্রবেশ করানোও নাজায়েজ। তবে দুটি সুরত এর ব্যতিক্রম–

১. যদি উক্ত জন্তুর অংশগুলো দ্বারা এমনভাবে ওষুধ তৈরি করা হয় যে, তার মূল প্রকৃতিই আর অবশিষ্ট থাকে না। তাহলে এই সুরতে ওষুধটিকে হারাম বলার অবকাশ থাকে না। কেননা, ইসলামি শরিয়াহর বিধান বস্তুর বর্তমান প্রকৃতি সম্পর্কে হয় বিধায় বস্তুর প্রকৃতি পরিবর্তন হয়ে গেলে বিধানও পরিবর্তন হয়ে যায়।

প্রশ্ন হল, বস্তুর প্রকৃতি পরিবর্তন হয়েছে–এটা বুঝার পদ্ধতি কী? এটি খুবই সূক্ষ্ম একটি বিষয়। ফকিহগণ এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন। যার সার এই যে, বস্তুর শ্রেণি ও প্রকৃতি তিনটি জিনিসের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। রং, গন্ধ এবং স্বাদ। যদি তিনটিরই পরিবর্তন ঘটে তাহলে বস্তুর প্রকৃতিতে পরিবর্তন এসেছে বলে ধরে নেয়া হবে।

সুতরাং যদি ভ্যাকসিন উৎপাদনে হারাম জন্তুজাত কিছু ব্যবহার করা হয়ও তাহলেও তার কেমিক্যালীয় পরিবর্তন এমনভাবে হয়ে গিয়েছে যে, তা গ্রহণ করা বৈধ হবে।

২. যদি তার প্রকৃতির পরিবর্তন নাও ঘটে তাহলেও যদি বিশেষজ্ঞদের মতে এটি গ্রহণ করা খুবই জরুরি হয় তখন এটি গ্রহণ করা নাজায়েয হবে না। কেননা, কুরআন মজিদের মধ্যেই প্রাণ বাঁচানোর প্রয়োজন পড়লে হারাম বস্তু ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,

إِنَّمَا حَرَّمَ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةَ وَالدَّمَ وَلَحْمَ الْخِنْزِيرِ وَمَا أُهِلَّ بِهِ لِغَيْرِ اللَّهِ فَمَنِ اضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍ وَلَا عَادٍ فَلَا إِثْمَ عَلَيْهِ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ

নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি হারাম করেছেন মৃত-জীব, রক্ত এবং শূকরের মাংস এবং সেই জন্তু যার প্রতি আল্লাহ ছাড়া অন্যের নাম নেয়া হয়েছে, তবে যে ব্যক্তি নিরুপায় হয়ে পড়ে কিন্তু সে নাফরমান ও সীমালঙ্ঘনকারী নয়, তার উপর কোন গুনাহ নেই, নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু। (সূরা বাকারা ১৭৩)

তিন. প্রিয় প্রশ্নকারী ভাই, উক্ত আলোচনার আলোকে যদি করোনা ভ্যাকসিনের বিধান নিয়ে চিন্তা করা হয় তাহলে বলা যায়, প্রথমত, এর মাঝে হারাম উপাদান আছে–এই নিশ্চয়তা নেই। হ্যাঁ, সোশ্যাল মিডিয়ায় এজাতীয় কিছু কথা দেখা যায়। কিন্তু কোনো ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির এজাতীয় স্বীকারোক্তি কিংবা কোনো অথেনটিক ল্যাবরেটরির নিরীক্ষা-রিপোর্ট এখন পর্যন্ত সামনে আসে নি। সুতরাং কেবল সন্দেহের ভিত্তিতে একে হারাম বলে দেয়ার সুযোগ নেই। বরং ব্রিটেনে উৎপাদিত ভ্যাকসিনের ব্যাপারে দাবী করা হয়েছে যে, এটি উদ্ভিদ থেকে আবিষ্কার করা হয়েছে। আর যদি হারাম উপাদান ব্যবহার করা হয়ও; তাহলেও বলা যায়, তার প্রকৃতি ও শ্রেণি সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে বিধায় যদি এটি ব্যবহারে দেহে কোনো ক্ষতি না হয় তাহলে ব্যবহার করা জায়েয হবে। আর করোনা ভ্যাকসিন তো ইতোমধ্যে বেশ কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে।

বাকি কথা হল, লাখো মানুষের মধ্যে দু’চার জনের দেহে যদি রোগ প্রতিরোধী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না করে; বরং পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সৃষ্ট করে তাহলে এটা গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা, অনেক সময় তো সাধারণ ওষুধেও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।

চার. সর্বোপরি এটা আমাদের বিশ্বাস যে, রোগ এবং নিরাময় উভয়টি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে। যদি কোনো ব্যক্তি আখেরাত-চেতনাকে সামনে রেখে উভয় অবস্থার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাহলে উভয়টিই আল্লাহ তাআলার নেয়ামত । একজন মুমিন অসুস্থ হলে সবর করে। আর সবর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমল। এমনকি আল্লাহ তাআলা বলেছেন,

إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ

নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন। (সূরা বাকারা ১৫৩)

অনুরূপভাবে একজন মুমিন রোগ নিরাময়ের উদ্দেশ্যে চিকিৎসাও গ্রহণ করে। কেননা, এটি রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর একটি সুন্নাহ। আর যে আমলই সুন্নাহ পালনের লক্ষে করবে, সে আমলেই সাওয়াব রয়েছে। এরপর যদি আল্লাহ তাআলা রোগ নিরাময় করেন তাহলে সে আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করে। আর শোকরও সবরের সমপর্যায়ের একটি আমল। যেমন রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

الطَّاعِمُ الشَّاكرُ لَهُ مثلُ أجرِ الصَّائمِ الصَّابرِ

শোকর আদায়কারী আহারকারীর জন্য রয়েছে ধৈর্যশীল রোযাদারের অনুরূপ প্রতিদান। (ইবনু মাজাহ ১৭৬৫ মুসনাদে আহমাদ ১৯০৩৬০)

পরিশেষে দোয়া করি, আল্লাহ তাআলা সকলকে সুস্থতা ও নিরাপত্তা দান করুন। আপনার পেরেশানি দূর করে দিন। আর আপনার প্রতি বিশেষ পরামর্শ হল, আপনি আপনার বাবার নির্দেশ মেনে করোনা ভ্যাকসিন দিয়ে দিন। আল্লাহ তাওফিকদাতা।

والله اعلم بالصواب
উত্তর দিয়েছেন
শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

six + thirteen =