যে ব্যক্তি বদঅভ্যাসের বেড়াজাল থেকে বের হতে চায়, তার প্রতি নসিহত

জিজ্ঞাসা–১১৫০: আআস্সালামুআলাইকুম। প্রিয় শায়েখ, আমি খুব কষ্টে জীবন যাপন করছি। কারণ আমার ভিতরে এমন কিছু বদ অভ্যাস আছে যেগুলো আমি মন থেকে চিরস্থায়ীভাবে ছাড়তে চাচ্ছি কিন্তু কোনোভাবেই আমি ঐ বদ অভ্যাসগুলো ছাড়তে পারছি না। আপনার কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, আমাকে এমন কিছু সহজ আমলের কথা বলে দিন, যেই আমলগুলো আমি সহজে পালন করতে পারি  এবং এই উসিলায় আমার সমস্ত বদ অভ্যাস চিরকালের জন্য দূর হয়ে যায়। আল্লাহ পাক আপনার সহায় হোন।–আবু সাঈদ।

জবাব: وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

প্রিয় প্রশ্নকারী ভাই, প্রথমে আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করি, আল্লাহ আমাদের সকলকে এজাতীয় বেড়াজাল থেকে মুক্তি দান করুন। আর আপনার করণীয় হল–

এক. একটু ভেবে দেখুন, আপনার বদঅভ্যাসগুলোর ধরণ কী, কোন্ কোন্ দরজা দিয়ে সেগুলো প্রবেশ করছে। ঘরের দরজা বন্ধ না করলে যেমন চোর ঢুকবে, তেমনি বদঅভ্যাসের দরজা বন্ধ না করলেও অনিচ্ছায় আপনি জড়িয়ে পড়বেন। সুতরাং দরজাগুলো যদি বন্ধ করতে পারেন, তাহলে বাঁচা সহজ হয়ে যাবে। আর এক্ষেত্রে ভাবলে দেখবেন, তালিকার প্রথমেই আসবে অসৎ সঙ্গ বা খারাপ বন্ধু। সুতরাং যে কোনো মূল্যে আপনাকে অসৎ সঙ্গ থেকে বাঁচতে হবে। এর পরেই আসবে, মোবাইল ও কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট। এগুলো ভাল কাজেও ব্যবহার করা যায়, আবার এগুলো দিয়ে গোনাহও হয়ে যায়। প্রয়োজনের কথা বলে এগুলো হাতে আসে, আর তা দিয়ে প্রযুক্তির তুলনায় গোনাহই বেশি প্রবেশ করে। সুতরাং বাস্তবেই যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে এগুলোর নিরাপদ ব্যবহার করবেন। বিশেষ করে কম্পিউটারের বাস্তব প্রয়োজন হলে সেটা বাড়ির এমন স্থানে স্থাপন করবেন যেন সকলের নযরে পড়ে, আর আপনি গোনাহ থেকে বাঁচতে পারেন।

দুই. এর পরেও যদি বদভ্যাসের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে না পারেন তাহলে চিকিৎসা একটাই–সত্যিকার অর্থে তাওবা করা। যখনই অনাকাংখিত অভ্যাসগুলো মাথা ছাড়া দিয়ে উঠবে এবং আল্লাহর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক দুর্বল করে দিবে তখনই তা তাওবার মাধ্যমে মেরামত করে নিবেন। এমনটি বার বার করতে থাকবেন। অন্যথায় -আল্লাহর কাছে পানাহ চাই- এই বদঅভ্যাসের উপর যদি মরণ চলে আসে তাহলে ভেবে দেখুন, কী হবে তখন?!

হাদিস শরিফে এসেছে, আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, হাদিসে কুদসি; রাসুলুল্লাহ ﷺ স্বীয় প্রতিপালক আল্লাহ রাব্বুল আলামীন থেকে বর্ণনা করেন, আল্লাহ তাআলা বলেন,

‏ أَذْنَبَ عَبْدٌ ذَنْبًا فَقَالَ اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي ذَنْبِي ‏.‏ فَقَالَ تَبَارَكَ وَتَعَالَى أَذْنَبَ عَبْدِي ذَنْبًا فَعَلِمَ أَنَّ لَهُ رَبًّا يَغْفِرُ الذَّنْبَ وَيَأْخُذُ بِالذَّنْبِ ‏.‏ ثُمَّ عَادَ فَأَذْنَبَ فَقَالَ أَىْ رَبِّ اغْفِرْ لِي ذَنْبِي ‏.‏ فَقَالَ تَبَارَكَ وَتَعَالَى عَبْدِي أَذْنَبَ ذَنْبًا فَعَلِمَ أَنَّ لَهُ رَبًّا يَغْفِرُ الذَّنْبَ وَيَأْخُذُ بِالذَّنْبِ ‏.‏ ثُمَّ عَادَ فَأَذْنَبَ فَقَالَ أَىْ رَبِّ اغْفِرْ لِي ذَنْبِي ‏.‏ فَقَالَ تَبَارَكَ وَتَعَالَى أَذْنَبَ عَبْدِي ذَنْبًا فَعَلِمَ أَنَّ لَهُ رَبًّا يَغْفِرُ الذَّنْبَ وَيَأْخُذُ بِالذَّنْبِ وَاعْمَلْ مَا شِئْتَ فَقَدْ غَفَرْتُ لَكَ ‏”‏ ‏.‏ قَالَ عَبْدُ الأَعْلَى لاَ أَدْرِي أَقَالَ فِي الثَّالِثَةِ أَوِ الرَّابِعَةِ ‏”‏ اعْمَلْ مَا شِئْتَ ‏

এক বান্দা গুনাহ করে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমার গুনাহ ক্ষমা করে দাও। তারপর আল্লাহ তাআলা বললেন, আমার বান্দা গুনাহ করেছে এবং সে জানে যে, তার একজন প্রতিপালক আছে, যিনি গুনাহ ক্ষমা করেন এবং গুনাহের কারণে পাকড়াও করেন। এ কথা বলার পর সে পুনরায় গুনাহ করল এবং বলল, হে আমার মনিব! আমার গুনাহ মাফ করে দাও। এরপর আল্লাহ তাআলা বললেন, আমার এক বান্দা গুনাহ করেছে এবং সে জানে যে, তার একজন প্রতিপালক আছে যিনি গুনাহ মাফ করেন এবং গুনাহের কারণে পাকড়াও করেন।

তারপর সে আবারও গুনাহ করে বলল, হে আমার রব! আমার গুনাহ ক্ষমা করে দাও। একথা শুনে আল্লাহ তাআলা আবারও বলেন, আমার বান্দা গুনাহ করেছে এবং সে জানে যে তার একজন মালিক আছে, যিনি বান্দার গুনাহ ক্ষমা করেন এবং গুনাহের কারণে পাকড়াও করেন। তারপর আল্লাহ তাআলা বলেন, হে বান্দা! এখন যা ইচ্ছা তুমি আমল কর। আমি তোমার গুনাহ মাফে করে দিয়েছি। বর্ননাকারী আবদুল আ’লা বলেন, “এখন যা ইচ্ছা তুমি আমল কর” কথাটি (আল্লাহ তাআলা) তৃতীয়বারের পর বলেছেন, না চতুর্থবারের পর বলেছেন, তা আমি জানি না। (সহিহ মুসলিম ৬৭৩২)

ইমাম নববী রহ. উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন,

هَذِهِ الْأَحَادِيثُ ظَاهِرَةٌ فِي الدَّلَالَةِ لَهَا ، وَأَنَّهُ لَوْ تَكَرَّرَ الذَّنْبُ مِائَةَ مَرَّةٍ أَوْ أَلْفَ مَرَّةٍ أَوْ أَكْثَرَ ، وَتَابَ فِي كُلِّ مَرَّةٍ ، قُبِلَتْ تَوْبَتُهُ ، وَسَقَطَتْ ذُنُوبُهُ

এ হাদিসগুলো স্পষ্টভাবে এই বার্তা দেয় যে, বান্দা যদি একটি গুনাহ শত বার, হাজার বার কিংবা এর চাইতেও বেশি করে আর প্রতিবারেই সে তাওবা করে, তাহলে তার তাওবা কবুল করা হয় এবং তার গুনাহগুলো অকেজো হয়ে যায়। (শরহু মুসলিম ১৭/২৩০)

তিন. প্রিয় প্রশ্নকারী ভাই, এছাড়া আমাদের কাছে এমন কোনো যাদুকরী আমল নেই যে, যার মাধ্যমে আপনি নিমিষেই আপনার বদঅভ্যাসগুলো থেকে বের হয়ে আসতে পারবেন। তবে হ্যাঁ, যেন বার বার তাওবা করার সুযোগ হয় এবং আপনার তাওবা আক্ষরিক অর্থেই তাওবা হয়; এ উদ্দেশ্যে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ আপনাকে দিচ্ছি–

?আল্লাহওয়ালাদের সোহবত গ্রহণ করুন। তাদের মজলিসে আসা যাওয়া করুন। এতে নফস নিয়ন্ত্রণ করা এবং তাওবার উপর অটল থাকা আপনার জন্য সহজ হবে।  আল্লাহ তাআলা বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ اتَّقُواْ اللّهَ وَكُونُواْ مَعَ الصَّادِقِينَ

হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক। (সূরা আত তাওবাহ ১১৯)

?অধিকহারে ইস্তেগফার করুন। প্রয়োজনে এর জন্য প্রত্যেক নামাজের পর একটা নিয়ম করে নিন। যেমন, প্রত্যেক নামাজের পর ৫০/১০০/২০০ বার أسْتَغْفِرُ اللهَ   অথবা أسْتَغْفِرُ اللهَ وَأتُوبُ إلَيهِ অথবা  اللَّهُمَّ اغْفِرْ لي পড়ার নিয়ম করে নিতে পারেন। কেননা, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

مَا أَصَرَّ مَنِ اسْتَغْفَرَ وَإِنْ عَادَ فِي الْيَوْمِ سَبْعِينَ مَرَّةً

যে ব্যক্তি দিনে সত্তরবার করে একই গুনাহ করার পরও আল্লাহর কাছে গুনাহের জন্য ক্ষমা চাইবে, (ইস্তেগফার করবে) সে যেন প্রকৃতপক্ষে গুনাহ বার বার করে নি। (তিরমিযী ৩৫৫৯)

?কখনো একাকী নিভৃতে থাকবেন না। কেননা একাকীত্ব গোনাহ চিন্তা করার কারণ হতে পারে। আর আপনার সময়কে উপকারী বিষয়ে ব্যয় করতে সচেষ্ট হোন। যেমন- সৎকাজ, কুরআন তিলাওয়াত, যিকির, নামাজ ইত্যাদি।

?প্রত্যেক নামাযের পর দৈনিক অন্তত পাঁচ বার কিছু সময়ের জন্য- দুই থেকে পাঁচ মিনিটের জন্য আল্লাহর সান্নিধ্যের মুরাকাবা করুন। মুরাকাবা এভাবে করবেন- চোখ বন্ধ করবেন। তারপর ভাববেন, ‘আমি যেখানেই থাকি না আল্লাহ আমার সাথে আছেন।’ অথবা এই আয়াতের বিষয়বস্তু নিয়ে চিন্তা করবেন- هُوَ مَعَكُمْ اَيْنَمَا كُنْتُمْ ‘তোমরা যেখানেই তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন।’

এভাবে নিয়মিত কিছুদিন করতে পারলে -ইনশা আল্লাহ- ধীরে ধীরে আল্লাহর সান্নিধ্যের সার্বক্ষণিক অনুভূতি অন্তরে বসে যাবে এবং বাজে চিন্তা থেকে বের হওয়া সহজ হয়ে যাবে।

আল্লাহ তাওফিকদাতা।

والله اعلم بالصواب
উত্তর দিয়েছেন
শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

one × one =