জিজ্ঞাসা–৩২১: রাসুল সা. কি গায়েব জানেন?– Ashrafi: [email protected]
জবাব:
এক- প্রিয় প্রশ্নকারী ভাই, আপনি এমন এক বিষয়ে প্রশ্ন করেছেন যা নিয়ে মুসলিম-সমাজে চরম বিরক্তিকর বিতর্ক চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। অথচ রাসূল ﷺ গায়েব জানেন কি না- এটি এমন এক প্রশ্ন যা জানা কোন মুসলমানের ঈমানি-কর্তব্য নয়। কেয়ামতের দিন কোন মুসলিমকে এ প্রশ্নের জবাবও দিতে হবে না। আর নিজ কর্তব্যভুক্ত নয়; এমন অহেতুক বিষয় নিয়ে ঝগড়া-ফ্যাসাদ তো দূরের কথা আলোচনা করাও ইসলাম পসন্দ করে না। রাসূল্লাহ ﷺ তো বলেছেন, من حُسنِ إسلام المرءِ تركُهُ ما لا يعنيه একজন ব্যক্তির ইসলামের পরিপূর্ণতার একটি লক্ষণ হল যে, তার জন্য জরুরী নয় এমন কাজ সে ত্যাগ করে। (জামে তিরমিযী : ২২৩৯)
আমাদের ঈমানের পরিপূর্ণতা তো এর মাঝে যে, তিনি গায়েব জানুক আর নাই জানুক তাঁর প্রতি আমাদের ভক্তি, সম্মান, শ্রদ্ধা, ভালবাসা আর আনুগত্য থাকবে সর্ব তুঙ্গে। তিনি তো বলে দিয়েছেন, لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ، حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَতোমাদের মধ্যে কেউ মু’মিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার কাছে তার পিতা, তার সন্তানাদি এবং সকল মানুষ হতে বেশী প্রিয় না হবো। (বুখারি: ১৬)
দুই- বিতর্ক না করে বরং কোরআনের আয়াতগুলোর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করাটাই হল ঈমানি-কর্তব্য। কেননা, বিতর্কের পরিস্থিতিতে কোরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ স্বয়ং আল্লাহর। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
فَإِن تَنَٰزَعۡتُمۡ فِي شَيۡءٖ فَرُدُّوهُ إِلَى ٱللَّهِ وَٱلرَّسُولِ إِن كُنتُمۡ تُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِۚ ذَٰلِكَ خَيۡرٞ وَأَحۡسَنُ تَأۡوِيلًا
যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর-যদি তোমরা আল্লাহ ও কেয়ামত দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম। (সূরা নিসা: ৫৯)
যারা এই নির্দেশ লংঘন করে বিতর্কের মধ্যে পড়ে থাকে, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَالَّذِينَ يُحَاجُّونَ فِي اللَّهِ مِن بَعْدِ مَا اسْتُجِيبَ لَهُ حُجَّتُهُمْ دَاحِضَةٌ عِندَ رَبِّهِمْ وَعَلَيْهِمْ غَضَبٌ وَلَهُمْ عَذَابٌ شَدِيدٌ
আল্লাহর দ্বীন মেনে নেয়ার পর যারা সে সম্পর্কে বিতর্কে প্রবৃত্ত হয়, তাদের বিতর্ক তাদের পালনকর্তার কাছে বাতিল, তাদের প্রতি আল্লাহর গযব এবং তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর আযাব। (আশ শুরা: ১৬)
তিন- এবার দেখা যাক, রাসুল ﷺ গায়েব জানেন কিনা-এসম্পর্কে পবিত্র কোরআন কী বলে। এ বিষয়ে আমরা যে আয়াতগুলো জানি সেগুলো থেকে কিছু আপনার কাছে তুলে ধরছি–
১. আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَلَا أَقُولُ لَكُمْ عِندِي خَزَائِنُ اللَّهِ وَلَا أَعْلَمُ الْغَيْبَ وَلَا أَقُولُ إِنِّي مَلَكٌ وَلَا أَقُولُ لِلَّذِينَ تَزْدَرِي أَعْيُنُكُمْ لَن يُؤْتِيَهُمُ اللَّهُ خَيْرًا ۖ اللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا فِي أَنفُسِهِمْ ۖ إِنِّي إِذًا لَّمِنَ الظَّالِمِينَ
আর আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ভান্ডার রয়েছে এবং একথাও বলি না যে, আমি গায়বী খবরও জানি; একথাও বলি না যে, আমি একজন ফেরেশতা; আর তোমাদের দৃষ্টিতে যারা লাঞ্ছিত আল্লাহ তাদের কোন কল্যাণ দান করবেন না। তাদের মনের কথা আল্লাহ ভাল করেই জানেন। সুতরাং এমন কথা বললে আমি অন্যায় কারী হব। (হুদ: ৩১)
২. অন্যত্র তিনি বলেন,
قُل لَّا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ ۚ وَلَوْ كُنتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ ۚ إِنْ أَنَا إِلَّا نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ
আপনি বলে দিন, আমি আমার নিজের কল্যাণ সাধনের এবং অকল্যাণ সাধনের মালিক নই, কিন্তু যা আল্লাহ চান। আর আমি যদি গায়বের কথা জেনে নিতে পারতাম, তাহলে কল্যাণের প্রাচুর্য বানিয়ে নিতাম, আর কোনো অনিষ্ট আমাকে স্পর্শ করতো না। আমি তো শুধুমাত্র একজন ভীতি প্রদর্শক ও সুসংবাদদাতা ঈমানদারদের জন্য। (আল আ’রাফ: ১৮৮)
৩. তিনি আরো বলেন,
وَيَقُولُونَ لَوْلَا أُنزِلَ عَلَيْهِ آيَةٌ مِّن رَّبِّهِ ۖ فَقُلْ إِنَّمَا الْغَيْبُ لِلَّهِ فَانتَظِرُوا إِنِّي مَعَكُم مِّنَ الْمُنتَظِرِينَ
বস্তুতঃ তারা বলে, তাঁর কাছে তাঁর পরওয়ারদেগারের পক্ষ থেকে কোন নির্দেশ এল না কেন? বলে দিন, গায়েবের কথা আল্লাহই জানেন। আমিও তোমাদের সাথে অপেক্ষায় রইলাম। (ইউনুস: ২০)
৪. আরো বলেন,
قُل لَّا يَعْلَمُ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللَّهُ ۚ وَمَا يَشْعُرُونَ أَيَّانَ يُبْعَثُونَ
বলুন, আল্লাহ ব্যতীত নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে কেউ গায়বের খবর জানে না এবং তারা জানে না যে, তারা কখন পুনরুজ্জীবিত হবে। (আন নামল: ৬৫)
৫. আরো বলেন,
وَعِندَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ ۚ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ ۚ وَمَا تَسْقُطُ مِن وَرَقَةٍ إِلَّا يَعْلَمُهَا وَلَا حَبَّةٍ فِي ظُلُمَاتِ الْأَرْضِ وَلَا رَطْبٍ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُّبِينٍ
তাঁর কাছেই অদৃশ্য জগতের চাবি রয়েছে। এ গুলো তিনি ব্যতীত কেউ জানে না। স্থলে ও জলে যা আছে, তিনিই জানেন। কোন পাতা ঝরে না; কিন্তু তিনি তা জানেন। কোন শস্য কণা মৃত্তিকার অন্ধকার অংশে পতিত হয় না এবং কোন আর্দ্র ও শুস্ক দ্রব্য পতিত হয় না; কিন্তু তা সব প্রকাশ্য গ্রন্থে রয়েছে। (আল আনআ’ম: ৫৯)
প্রিয় প্রশ্নকারী ভাই, এভাবে কোরআনের আরো বহু আয়াত পেশ করা যাবে। যেগুলো থেকে এটা স্পষ্ট যে রাসূল ﷺ গায়েব জানতেন না। বরং গায়েবের বিষয়ে তিনি যা বলতেন, তা তিনি ওহীর মাধ্যমে বলতেন। পবিত্র কোরআনও এটাই বলে- وَمَا يَنطِقُ عَنِ الْهَوَى إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى“আর তিনি নিজ ইচ্ছায় কিছু বলেন না, যতক্ষণ না তাঁর নিকট ওহী নাযিল হয়”। (সূরা আন-নাজম: ৩-৪)
আর এটাকেই অনেকে গায়েব হিসেবে মনে করে বসে এবং এ নিয়ে বিতর্ক শুরু করে। আশ্চর্য! এটা যদি গায়েব হয় তাহলে ওহী কোনটা? তাছাড়া এজাতীয় গায়েব তো রাসূল ﷺ এর আগে জিব্রাইল আ.ই জানতেন।
সুতরাং এ বিষয়ে বিতর্ক না করে বরং কোরআনের আয়াতগুলোর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করাই হবে মুমিনের ঈমানি দায়িত্ব।
উত্তর দিয়েছেন
মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী
আরো পড়ুন:
- কিয়াম করা জায়েজ আছে কি না?
- মিলাদ-কিয়াম বিদআত কেন?
- প্রচলিত নিয়মে মিলাদ কি শরিয়তসম্মত?
- মাজারে গিয়ে মাথা নত করা যাবে কিনা?
- হুজুর সা. নুরের তৈরি না মাটির তৈরি?
- আজমীর শরীফ ও মাযারে শিরনির মান্নত
- বাবা-মা ভণ্ড পীরের মুরিদ; সন্তানের করণীয় কি?
- ফাতেহা দোয়াজ দাহম ও ফাতেহা ইয়াজদাহম কি?
- শনির দশা থেকে মুক্তির উপায় বিষয়ে ইসলাম কী বলে?