জিজ্ঞাসা–৩৫৪: রোজা ভঙ্গের সমস্ত কারণগুলি (খুঁটিনাটি)জানালে উপকৃত হব।–Intaj Ali: intajali1988@gmail.com
জবাব: আল্লাহ তাআলা নিম্নোক্ত আয়াতে রোযা-ভঙ্গকারী বিষয়গুলোর মূলনীতি উল্লেখ করেছেন:
فَالآنَ بَاشِرُوهُنَّ وَابْتَغُوا مَا كَتَبَ اللَّهُ لَكُمْ وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمْ الْخَيْطُ الأَبْيَضُ مِنْ الْخَيْطِ الأَسْوَدِ مِنْ الْفَجْرِ ثُمَّ أَتِمُّوا الصِّيَامَ إِلَى اللَّيْلِ
“এখন তোমরা নিজ স্ত্রীদের সাথে সহবাস কর এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা কিছু লিখে রেখেছেন তা (সন্তান) তালাশ কর। আর পানাহার কর যতক্ষণ না কালো সুতা থেকে ভোরের শুভ্র সুতা পরিস্কার ফুটে উঠে…”(সূরা বাকারা: ১৮৭)
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা রোযা-ভঙ্গকারী প্রধান বিষয়গুলো উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হচ্ছে- পানাহার ও সহবাস। আর রোযা রোযা-ভঙ্গকারী অন্য বিষয়গুলো নবী ﷺ তাঁর হাদিসে উল্লেখ করেছেন।
রোযা-ভঙ্গকারী বিষয়গুলো দুই প্রকার :
এক. যে বিষয়গুলোর কারণে কাযা ও কাফফারা উভয়টি জরুরি–যেমন,
—: সহবাস; এটি সবচেয়ে বড় রোযা-ভঙ্গকারী বিষয় ও এতে লিপ্ত হলে সবচেয়ে বেশি গুনাহ হয়। যে ব্যক্তি রমযানের দিনের বেলা স্বেচ্ছায় স্ত্রী সহবাস করবে; এতে করে বীর্যপাত হোক কিংবা না হোক। তার উপর তওবা করা, কাযা ও কাফফারা করা উভয়টি জরুরি। এর দলিল হচ্ছে,
একটি দীর্ঘ হাদীসে আছে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নিকট এসে বলল, আমি রোযা অবস্থায় স্ত্রী সহবাস করেছি। রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে কাফফারা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। (সহীহ বুখারী ৬৭০৯; জামে তিরমিযী ৭২৪; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৭৪৫৭; মুসনাদে আহমদ ২/২৪১)
মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ ঐ ব্যক্তিকে (যে স্ত্রীসহবাসে লিপ্ত হয়েছিল) কাফফারা আদায়ের সাথে কাযা আদায়েরও আদেশ করেছিলেন।(মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৭৪৬১)
—: ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার; এর দলিল হচ্ছে,
হাদীস শরীফে আছে, এক ব্যক্তি রমযানে রোযা রেখে (ইচ্ছাকৃতভাবে) পানাহার করল। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে আদেশ করলেন, যেন একটি দাস আযাদ করে বা দুই মাস রোযা রাখে বা ষাটজন মিসকীনকে খানা খাওয়ায়। (সুনানে দারাকুতনী ২/১৯১)
ইমাম যুহরী রহ. বলেন, ‘রমযানে রোযা রেখে যে ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করবে তার হুকুম ইচ্ছাকৃতভাবে দিনে সহবাসকারীর অনুরূপ।’ অর্থাৎ তাকে কাযা ও কাফফারা উভয়টি আদায় করতে হবে। (মাবসূত, সারাখসী ৩/৭৩; আলবাহরুর রায়েক ২/২৭৬)
উক্ত দু’টি বিষয় ছাড়া অন্য পদ্ধতিতে রোযা ভাঙ্গলে কাফফারা দিতে হয় না, হ্যাঁ কাযা অর্থাৎ এক রোযার পরিবর্তে এক রোযা আদায় করতে হয়। (মাবসুত সারাখসি ৩/৭২)
আর কাফফারা আদায়ের নিয়ম জানার জন্য পড়ুন-জিজ্ঞাসা নং–২৮০
দুই. যে বিষয়গুলোর কারণে শুধু কাযা করতে হয়। এখন আমরা সেগুলো সংক্ষেপে পেশ করছি–
—: যা কিছু পানাহারের স্থলাভিষিক্ত। এটি দুইটি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে। ১. যদি রোযাদারের শরীরে রক্ত পুশ করা হয়। যেমন- আহত হয়ে রক্তক্ষরণের কারণে কারো শরীরে যদি রক্ত পুশ করা হয়; তাহলে সে ব্যক্তির রোযা ভেঙ্গে যাবে। যেহেতু পানাহারের উদ্দেশ্য হচ্ছে— রক্ত তৈরী। ২. খাদ্যের বিকল্প হিসেবে ইনজেকশন পুশ করা। কারণ এমন ইনজেকশন নিলে পানাহারের প্রয়োজন হয় না। তবে, যেসব ইনজেকশন পানাহারের স্থলাভিষিক্ত নয়; বরং চিকিৎসার জন্য দেয়া হয়, উদাহরণতঃ ইনসুলিন, পেনেসিলিন কিংবা শরীর চাঙ্গা করার জন্য দেয়া হয় কিংবা টীকা হিসেবে দেয়া হয় এগুলো রোযা ভঙ্গ করবে না; চাই এসব ইনজেকশন মাংশপেশীতে দেয়া হোক কিংবা শিরাতে দেয়া হোক। (শাইখ মুহাম্মদ বিন ইব্রাহিম এর ফতোয়াসমগ্র ৪/১৮৯) তবে, সাবধানতা স্বরূপ এসব ইনজেকশন রাতে নেয়া যেতে পারে।
—: অযু বা গোসলের সময় রোযার কথা স্মরণ থাকা অবস্থায় অনিচ্ছাকৃতভাবে গলার ভেতর পানি চলে গেলে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
সুফিয়ান সাওরী রহ. বলেন, ‘রোযা অবস্থায় কুলি করতে গিয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে গলার ভেতর পানি চলে গেলে রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং তা কাযা করতে হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক: ৭৩৮০)
—: যা সাধারণত আহারযোগ্য নয় বা কোনো উপকারে আসে না, তা খেলেও রোযা ভেঙ্গে যাবে। আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রাযি. ও ইকরিমা রহ. বলেন, ‘(পেটে) কোনো কিছু প্রবেশ করলে রোযা ভেঙ্গে যায়। কোনো কিছু বের হওয়ার দ্বারা রোযা ভাঙ্গে না।’ (সহীহ বুখারী ১/২৬০)
—: দাঁত থেকে রক্ত বের হয়ে যদি তা থুথুর সাথে ভেতরে চলে যায় তবে রক্তের পরিমাণ থুথুর সমান বা বেশি হলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। (আলবাহরুর রায়েক ২/২৭৩; রদ্দুল মুহতার ২/৩৯৬)
—: হস্তমৈথুনে বীর্যপাত হলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। আর এটা যে ভয়াবহ গুনাহের কাজ তা বলাই বাহুল্য।
—: মুখে বমি চলে আসার পর ইচ্ছাকৃতভাবে গিলে ফেললে রোযা ভেঙ্গে যাবে। যদিও তা পরিমাণে অল্প হয়। (আলবাহরুর রায়েক ২/২৭৪; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪১৫)
—: রোযা অবস্থায় হায়েয বা নেফাস শুরু হলে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
আবু সাঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীসে আছে, নবী করীম ﷺ ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আযহায় মহিলাদের লক্ষ্য করে বললেন-
أليس إذا حاضت لم تصل ولم تصم قلن بلى، قال : فذلك من نقصان دينها.
মহিলারা তো ঋতুস্রাবের সময় রোযা রাখতে পারে না এবং নামাযও পড়তে পারে না। এটা তোমাদের দ্বীনের অসম্পূর্ণতা। (সহীহ বুখারী ১/৪৪; শরহু মুখতাসারিত তহাবী ২/৪৪০; আননুতাফ ফিলফাতাওয়া ১০০)
—: পেটের এমন ক্ষতে ওষুধ লাগালে রোযা ভেঙ্গে যাবে, যা দিয়ে ওষুধ পেটের ভেতর চলে যায়। বিশেষ প্রয়োজনে এমন ক্ষতে ওষুধ লাগালে পরে সে রোযার কাযা করে নিতে হবে। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০৪; রদ্দুল মুহতার ২/৪০২)
—: নাকে ওষুধ বা পানি দিলে তা যদি গলার ভেতরে চলে যায় তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
—: মলদ্বারের ভেতর ওষুধ বা পানি ইত্যাদি গেলে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রাযি. থেকে বর্ণিত-
ذكر عنده الوضوء من الطعام، قال الأعمش مرة والحجامة للصائم، فقال : إنما الوضوء مما يخرج وليس مما يدخل، وإنما الفطر مما دخل وليس مما خرج.
শরীর থেকে (কোনো কিছু) বের হলে অযু করতে হয়, প্রবেশ করলে নয়। পক্ষান্তরে রোযা এর উল্টো। রোযার ক্ষেত্রে (কোনো কিছু শরীরে) প্রবেশ করলে রোযা ভেঙ্গে যায়, বের হলে নয় (তবে বীর্যপাতের প্রসঙ্গটি ভিন্ন)। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০৪; রদ্দুল মুহতার ২/৪০২)
—: সুবহে সাদিকের পর সাহরীর সময় আছে ভেবে পানাহার বা স্ত্রীসঙ্গম করলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। তেমনি ইফতারির সময় হয়ে গেছে ভেবে সূর্যাস্তের পূর্বে ইফতার করে নিলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে।(আদ্দুররুল মুখতার ২/৪০৫; আলবাহরুর রায়েক ২/২৯১)
—: রোযা রাখা অবস্থায় ভুলবশত পানাহার করে রোযা নষ্ট হয়ে গেছে ভেবে ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে।
—: অনিচ্ছাকৃত বমি হওয়ার কারণে রোযা নষ্ট হয়ে গেছে মনে করে রোযা ভেঙ্গে ফেললে কাযা করতে হবে।
আলী ইবনে হানযালা তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি রোযার মাসে ওমর রাযি.-এর নিকট ছিলেন। তার নিকট পানীয় পেশ করা হল। উপস্থিত লোকদের কেউ কেউ সূর্য ডুবে গেছে ভেবে তা পান করে ফেলল। এরপর মুয়াযযিন আওয়াজ দিল, আমীরুল মুমিনীন! সূর্য এখনো ডুবেনি। তখন ওমর রাযি. বললেন, ‘যারা ইফতারি করে ফেলেছে তারা একটি রোযা কাযা করবে। আর যারা ইফতারি করেনি তারা সূর্যাস্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।’(মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/১৫০)
—: ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। হাদীস শরীফে এসেছে,مَنْ ذَرَعَهُ الْقَيْءُ فَلَيْسَ عَلَيْهِ قَضَاءٌ ، وَمَنْ اسْتَقَاءَ عَمْدًا فَلْيَقْضِ রোযা অবস্থায় (অনিচ্ছাকৃত) বমি হলে কাযা করতে হয় না। আর ইচ্ছাকৃত বমি করলে সে যেন তা কাযা করে নেয়। (জামে তিরমিযী ৭২০)
মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী