আল্লাহ সর্ব প্রথম কী সৃষ্টি করেছেন?

জিজ্ঞাসা–১৪২১: আল্লাহ সর্বপ্রথম কী সৃষ্টি করেন? সু-স্পষ্ট দলিলসহ বলুন।–মো: তানহা রহমান, খোকসা, কুষ্টিয়া।

জবাব:

এক. আল্লাহ সর্ব প্রথম কী সৃষ্টি করেছেন, এ নিয়ে আলেমদের মাঝে মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, কলম প্রথম সৃষ্টি। প্রখ্যাত মুফাসসির ইবনে জারীর তাবারী, ইবনুল জাওযী ও ইবনুল আরাবী রাহিমাহুমুল্লাহ এ মতের সমর্থক ছিলেন। আরেক দল আলেমের মতে সর্বপ্রথম সৃষ্টি হচ্ছে আরশ। আল্লামা ইবনে তাইমিয়া, ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুমাল্লাহ এবং অন্যান্য আলেম থেকে এধরণের মত পাওয়া যায়। আবার কেউ কেউ পানি সর্বপ্রথম সৃষ্টি বলে মত প্রকাশ করেছেন। এই মতটি আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাযি. ও অন্যান্য সালাফ থেকে বর্ণিত আছে। আল্লামা বদরুদ্দীন আলআইনী এ মতকে প্রধান্য দিয়েছেন।

যারা বলেছেন, কলম প্রথম সৃষ্টি। তারা নিম্নের সহিহ হাদিসগুলো দিয়ে দলিল গ্রহণ করেছেন।

. আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

إنَّ أولَ شيءٍ خلقَهُ اللهُ تعالى القلمُ ، و أمرَهُ أنْ يكتبَ كلَّ شيءٍ يكونُ

নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম যে জিনিসটি সৃষ্টি করেছেন, তা হচ্ছে কলম। তারপর কলমকে কিয়ামত পর্যন্ত যা হবে তা লিখতে বললেন। (দারিমী ২৫৩ আবু ইয়ালা ২৩২৯ বায়হাকী ১৮১৫৮)

. উবাদা ইবন সামিত রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

إِنَّ أَوَّلَ مَا خَلَقَ اللَّهُ الْقَلَمَ فَقَالَ: لَهُ اكْتُبْ قَالَ: رَبِّ وَمَاذَا أَكْتُبُ قَالَ: اكْتُبْ مَقَادِيرَ كُلِّ شَيْءٍ حَتَّى تَقُومَ السَّاعَةُ

আল্লাহ্ তাআলা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করে তাকে বললেন, লিখ। কলম বলল, হে আমার প্রতিপালক! কী লিখব? আল্লাহ্ বললেন, কিয়ামত পর্যন্ত আগমণকারী প্রতিটি বস্তুর তাকদীর লিখ। (আবু দাউদ ৪৭০০ তিরমিজী ২১৫৫)

উল্লেখ্য, এখানে কলম মানে আমরা যে কলম দিয়ে লেখি তা নয়; বরং যে কলম দিয়ে লাওহে মাহফুয লেখা হয়েছে সেটি সর্বপ্রথম সৃষ্টি।

আর যারা বলেছেন, আল্লাহর প্রথম সৃষ্টি আরশ, তাদের দলীল হচ্ছে, ইমরান বিন হুসাইন রাযি. থেকে বর্ণিত হাদিস যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

كَانَ اللَّهُ وَلَمْ يَكُنْ شَيْءٌ غَيْرُهُ وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ وَكَتَبَ فِي الذِّكْرِ كُلَّ شَيْءٍ وَخَلَقَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضَ

আদিতে একমাত্র আল্লাহ-ই ছিলেন। তিনি ছাড়া আর কিছুই ছিলনা। তাঁর আরশ ছিল পানির উপর। তারপর তিনি প্রত্যেক জিনিস লাওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ করলেন এবং তিনি আসমান ও যমিন সৃষ্টি করলেন। (বুখারী ৩০১৯)

পক্ষান্তের যারা বলেছেন, আল্লাহর প্রথম সৃষ্টি পানি, তারা উপরের হাদিস থেকেই দলিল গ্রহণ করে বলেন, পানি সর্বপ্রথম সৃষ্টি। যেমন ইবনু হাজার আসকালানী রহ. বলেন,

بأن حديث عمران بن حصين رضي الله عنه يدل على أن الماء سابق على العرش

ইমরান বিন হুসাইন রাযি.-এর উক্ত হাদিস থেকে বোঝা যায়, পানি আরশের আগে সৃষ্ট। (ফাতহুল বারী ৬/২৮৯)

এছাড়াও তাদের দলীল হচ্ছে, আবূ রাযীন রাযি. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! أَيْنَ كَانَ رَبُّنَا قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ خَلْقَهُ ؟ আমাদের রব তাঁর মাখলূক সৃষ্টি করার আগে কোথায় ছিলেন? তিনি বললেন,

كَانَ فِي عَمَاءٍ مَا تَحْتَهُ هَوَاءٌ وَمَا فَوْقَهُ هَوَاءٌ ، وَخَلَقَ عَرْشَهُ عَلَى الْمَاءِ

তিনি ছিলেন তার নূরের মধ্যে। তার উপরেও বায়ূ ছিল না এর নিচেও বায়ূ ছিল না। তিনি তাঁর আরশ পানির উপর সৃষ্টি করেছেন। (তিরমিজী ৩০১৯ ইবনু মাজাহ ১৮২)

দুই. উপরোক্ত মতগুলো ছাড়াও আরো কিছু অনির্ভরযোগ্য মত প্রচলিত আছে। কিছু মত তো আছে ইসরাইলী বর্ণনানির্ভর। আবার কিছু মত আছে বানোয়াট। যেমন, এদের কারো কারো মতে আল্লাহ সর্বপ্রথম বুদ্ধি সৃষ্টি করেছেন। এক্ষেত্রে সবচে’ প্রসিদ্ধ মতটি হল, যে, আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম মুহাম্মাদ ﷺ-এর নূর সৃষ্টি করেছেন। এর দলিল হিসেবে তারা কিছু হাদিসও পেশ করে থাকেন। যেগুলো প্রকৃতপক্ষে হাদিসই নয়; বরং জাল বা বানোয়াট। যেমন তারা হাদিসের নামে নিন্মোক্ত কথাগুলো পেশ করে থাকেন।

أول ما خلق الله تعالى نوري

আল্লাহ্ তাআলা সর্বপ্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন।

অন্য শব্দে এসেছে,

أول ما خلق الله نور نبيك يا جابر

হে জাবের! সর্বপ্রথম আল্লাহ তোমার নবীর নূর সৃষ্টি করেছেন।

অথচ মুহাদ্দিসগণ এজাতীয় শব্দমালা দিয়ে গঠিত হাদিসগুলোকে মাওযু বা জাল বলেছেন। যেমন শায়েখ আবুল ফায়েয আহমাদ আলগুমারী বলেন,

هو حديث موضوع، لو ذكره بتمامه لما شك الواقف عليه في وضعه، وبقيته تقع في نحو ورقتين من القطع الكبير مشتملة على ألفاظ ركيكة ومعان منكرة

হাদিসটি জাল। যদি সম্পূর্ণ হাদিসটা উল্লেখ করা হয় তাহলে পাঠক এর জালিয়াতি সম্পর্কে কোনো সন্দেহ করবে না। হাদিসের অবশিষ্ট বক্তব্য দীর্ঘ প্রায় দুই পৃষ্ঠা, যাতে বহু নিস্তেজ শব্দ ও প্রত্যাখ্যাত অর্থ বিদ্যমান। (আল-মুগীর, বৈরুত, দারুর রায়িদ আল-আরাবী, ভূমিকা: পৃষ্ঠা ৬-৭)

জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহ. বলেন,

ليس له إسناد يعتمد عليه

হাদীসটির কোনো সনদ নেই যার উপর নির্ভর করা যায়। (আল হাবী ১/৩২৫)

والله أعلم بالصواب

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × five =