ওমরাহ করার ধারাবাহিক বিস্তারিত নিয়ম

জিজ্ঞাসা–১৭১১: মুহতারাম, কিছুদিনের মধ্যেই আমি উমরাহ করতে যাবো। এখন এ বিষয়ে যাবতীয় করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়গুলো জানতে চাচ্ছি।–আরাফাত রহমান।

জবাব: প্রিয় প্রশ্নাকারী দীনী ভাই, ওমরাহর কাজ চারটি–
১-মিকাত থেকে ওমরাহর ইহরাম বাঁধা।[ফরজ]
২- মক্কায় পৌঁছে খানায় কাবা তওয়াফ করা। [ফরজ]
৩-সাফা মারওয়ায় সায়ী করা। [ওয়াজিব]
৪-মাথার চুল মুন্ডানো বা কাটা। [ওয়াজিব]

এক: ইহরাম
যার সুন্নত পদ্ধতি এই যে, সাধারণ কাপড়-চোপড় ছেড়ে ফরয গোসলের মত গোসল করবে। সুগন্ধি থাকলে মাথা বা দাঁড়িতে লাগাবে। তারপর ইহারমের কাপড় পরিধান করবে। এরপর সুন্নত হিসেবে দুই রাকাত নামায আদায় করবে। নামাযের পর কিবলামুখি হয়ে ইহরাম বাঁধবে। ইচ্ছা করলে যাত্রার প্রাক্কালে ইহরাম করতে পারেন। তবে মীকাত থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়ার আগে ইহরাম করতে হবে। এরপর বলবেন:

لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ ، لَبَّيْكَ لا شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ ، إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ لا شَرِيكَ لَكَ

লাব্বাইকাল্লাহুম্মা লাব্বাইক। লাব্বাইকালা শারিকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক। লা শারিকা লাক।

(অর্থ- হে আল্লাহ! আমি আপনার দরবারে হাজির। আমি আপনার দরবারে হাজির। আমি আপনার দরবারে হাজির। আপনি নিরঙ্কুশ। আমি আপনার দরবারে হাজির। নিশ্চয় যাবতীয় প্রশংসা, যাবতীয় নেয়ামত আপনার-ই জন্য এবং রাজত্ব আপনার-ই জন্য। আপনি নিরঙ্কুশ।)

পুরুষ জোরে তালবিয়া পড়বে। আর নারী এতটুকু জোরে তালবিয়া পড়বে যাতে পাশের লোক শুনতে পায়। তবে পাশে যদি কোন বেগানা পুরুষ থাকে তাহলে মনে মনে তালবিয়া পড়বে।

ইহরামকারীর উচিত অধিক তালবিয়া পাঠ করা। বিশেষতঃ সময় ও অবস্থার পরিবর্তনগুলোতে। যেমন উঁচুতে উঠার সময়। নীচুতে নামার সময়। রাত বা দিনের আগমনকালে। তালবিয়া পাঠের পর আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত প্রার্থনা করা এবং জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা।

ওমরাহর ক্ষেত্রে ইহরামের শুরু থেকে তওয়াফ শুরু করার আগ পর্যন্ত তালবিয়া পড়া বিধান রয়েছে। তাওয়াফ শুরু করলে তালবিয়া পড়া ছেড়ে দিবে।

দুই: তাওয়াফ
মসজিদে হারামে প্রবেশের সময় ডান পা আগে দিবে এবং বলবে:

بِسْمِ اللهِ والصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلَى رَسُوْلِ اللهِ الَّلهُمَّ اغْفِرْ لِيْ ذُنُوْبِيْ وافْتَحْ لِى أَبْوَابَ رَحْمَتِكَ

(অর্থ- আল্লাহর নামে শুরু করছি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক। হে আল্লাহ! আমার সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিন। আমার জন্য আপনার রহমতের দুয়ারগুলো খুলে দিন।)

এরপর তাওয়াফ শুরু করার জন্য হাজারে আসওয়াদের দিকে এগিয়ে যাবে। ডান হাত দিয়ে হাজারে আসওয়াদ স্পর্শ করবে ও চুমু খাবে। যদি হাজারে আসওয়াদে চুমু খেতে না পারে হাত দিয়ে স্পর্শ করবে ও হাতে চুমু খাবে (স্পর্শ করার মানে হচ্ছে- হাত দিয়ে ছোঁয়া)। যদি হাত দিয়ে স্পর্শ করতে না পারে তাহলে হাজারে আসওয়াদের দিকে মুখ করে হাত দিয়ে ইশারা করবে এবং তাকবির (বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ) বলবে।

এরপর ডান দিক ধরে চলতে থাকবে। বায়তুল্লাহকে বাম দিকে রাখবে। যখন রুকনে ইয়ামেনীতে (হাজারে আসওয়াদের পর তৃতীয় কর্নার) পৌঁছবে তখন সে কর্নারটি চুমু ও তাকবীর ছাড়া শুধু স্পর্শ করবে। যদি স্পর্শ করা সম্ভব না হয় তাহলে তাওয়াফ চালিয়ে যাবে; ভিড় করবে না। রুকনে ইয়ামেনী ও হাজারে আসওয়াদের মাঝখানে এলে বলবে:

رَبَّنَا آَتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآَخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ

(অর্থ- হে আমাদের রব! আমাদিগকে দুনিয়াতেও কল্যাণ দান করুন এবং আখেরাতেও কল্যাণ দান করুন এবং আমাদিগকে দোযখের আযাব থেকে রক্ষা করুন।)

যখনই হাজারে আসওয়াদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করবে তখনই হাজারে আসওয়াদ অভিমুখী হয়ে তাকবীর বলবে। তাওয়াফের অন্য অংশে যা কিছু খুশি যিকির, দুআ ও কুরআন তেলাওয়াত করবে। বায়তুল্লাহতে তাওয়াফের বিধান দেয়া হয়েছে আল্লাহর যিকিরকে সমুন্নত করার জন্য। তাওয়াফের মধ্যে পুরুষকে দুইটি জিনিস করতে হয়।

১. তাওয়াফের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ইজতেবা করা। ইজতেবা মানে- ডান কাঁধ খালি রেখে চাদরের মাঝের অংশ বগলের নীচ দিয়ে এনে চাদরের পার্শ্ব বাম কাঁধের উপর ফেলে দেয়া। তওয়াফ শেষ করার পর চাদর পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিবে। কারণ ইজতেবা শুধু তওয়াফের মধ্যে করতে হয়।

২. তওয়াফের প্রথম তিন চক্করে রমল করা। রমল মানে হচ্ছে- ছোট ছোট পদক্ষেপে দ্রুত হাঁটা। আর বাকী চার চক্করে রমল নেই বিধায় স্বাভাবিক গতিতে হাঁটবে। সাত চক্কর তওয়াফ শেষ করার পর ডান কাঁধ ঢেকে নিয়ে মাকামে ইব্রাহিমে আসবে এবং পড়বে-

وَاتَّخِذُوا مِنْ مَقَامِإِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى

(অর্থ- আর তোমরা মাকামে ইব্রাহিমকে তথা ইব্রাহীমের দাঁড়ানোর জায়গাকে নামাযের জায়গা বানাও।) [সূরা বাকারা, আয়াত: ১২৫]

অতঃপর মাকামে ইব্রাহিমের পিছনে দুই রাকাত নামায (ওয়াজিব) আদায় করবে। যদি সেখানে সুযোগ না হয় তাহলে মসজিদে হারামে যেখানে সুযোগ হয় দুই রাকাত নামায পড়ে নিবে। প্রথম রাকাতে সূরা ফাতিহার পর সূরা কাফিরুন পড়বে। দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ফাতিহার পর সূরা ইখলাস পড়বে।

উক্ত দুই রাকাত আদায় করার পর সক্ষম হলে মুলতাযিমে আসবে। যা হাজরে আসওয়াদ ও কা’বার দরজার মাঝামাঝি স্থান। এটি দুআ কবুলের একটি স্থান। কিন্তু যদি ভীড় বেশি হয়, তাহলে ছেড়ে দিবে।

তারপর আবে যমযমের কাছে আসবে। কিবলামুখী হয়ে বিসমিল্লাহ বলে তিন শ্বাসে যমযমের পানি পান করবে। তারপর আলহামদুলিল্লাহ বলে দুআ পড়বে- “আল্লাহুম্মা ইন্নী আসআলুকা ইলমান নাফিয়া ওয়া রিযকান ওয়াসিআ ওয়াশিফাআম মিন কুল্লি দায়িন”।

যমযমের পানি পান করে হাজরে আসওয়াদের সামনে আসবে। সক্ষম হলে হাজরে আসওয়াদ চুমু খাবে। সক্ষম না হলে হাত দিয়ে ইশারা করে চুমু খেয়ে সাফা পাহাড়ের দিকে রওয়ানা হবে।

তিন: সায়ী
এরপর সায়ীস্থলে আসবে। যখন সাফা পাহাড়ের নিকটবর্তী হবে তখন পড়বে-

إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ

(অর্থ- নিঃসন্দেহে সাফা ও মারওয়া আল্লাহ তা’আলার নিদর্শনগুলোর অন্যতম)–(সূরা বাকারা ১৫৮)। এরপর বলবে: (نبدأ بما بدأ الله به) (অর্থ- আল্লাহ যা দিয়ে শুরু করেছেন আমরাও তা দিয়ে শুরু করছি)

অতঃপর সাফা পাহাড়ে উঠবে যাতে করে কাবা শরিফ দেখতে পায়। কাবা নজরে আসলে কাবাকে সামনে রেখে দুই হাত তুলে দুআ করবে। দুআর মধ্যে আল্লাহর প্রশংসা করবে এবং যা ইচ্ছা দুআ করবে।

যখন সবুজ কালার চিহ্নিত স্থানে পৌঁছবেন তখন যত জোরে সম্ভব দৌঁড়াবেন। কিন্তু কাউকে কষ্ট দিবেন না।  দ্বিতীয় সবুজ রঙ চিহ্নিত স্থান থেকে স্বাভাবিক গতি হাঁটবে। এভাবে মারওয়াতে পৌঁছবে। মারওয়ার উপরে উঠে কিবলামুখি হয়ে হাত তুলে দুআ করবে। সাফা পাহাড়ের উপর যা যা পড়েছে ও বলেছে এখানে তা তা পড়বে ও বলবে। এরপর মারওয়া থেকে নেমে সাফার উদ্দেশ্যে হেঁটে যাবে। স্বাভাবিকভাবে হাঁটার স্থানে হেঁটে পার হবে; আর দৌঁড়াবার স্থানে দৌঁড়ে পার হবে। সাফাতে পৌঁছার পর পূর্বে যা যা করেছে তা তা করবে। মারওয়ার উপরেও আগের মত তা তা করবে। এভাবে সাত চক্কর শেষ করবে। সাফা থেকে মারওয়া গেলে এক চক্কর। মারওয়া থেকে সাফাতে এলে এক চক্কর। আর সায়ীর মধ্যে যা খুশি যিকির, দুআ, কুরআন তেলাতেয়াত করতে পারবে।
জ্ঞাতব্যঃ
(إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ)- এই আয়াতটি শুধু সায়ীর শুরুতে সাফার নিকটবর্তী হলে পড়বে। সাফা-মারওয়াতে প্রতিবার আয়াতটি পড়বে না যেমনটি কিছু কিছু মানুষ করে থাকে।

চার: মাথা মুণ্ডন বা চুল ছোট করা
সাত চক্কর সায়ী শেষ করার পর পুরুষ হলে মাথা মুণ্ডন করবে অথবা মাথার চুল ছোট করবে। মুণ্ডন করলে মাথার সর্বাংশের চুল মুণ্ডন করতে হবে। অনুরূপভাবে চুল ছোট করলে মাথার সর্বাংশের চুল ছোট করতে হবে। আর মহিলারা চুলের গোছার নিচ থেকে কিছু অংশ কেটে ফেলবে।

এই আমলগুলোর মাধ্যমে উমরা সমাপ্ত হবে। অতএব, উমরার মধ্যে রয়েছে- ইহরাম, তওয়াফ, সায়ী, মাথা মুণ্ডণ বা মাথার চুল ছোট করা।

আমরা আল্লাহ তাআলার প্রার্থনা করছি তিনি যেন আমাদেরকে নেক আমল করার তাওফিক দেন। তিনি যেন আমাদের আমলগুলো কবুল করে নেন। নিশ্চয় তিনি নিকটবর্তী ও প্রার্থনা কবুলকারী।

والله أعلم بالصواب
উত্তর দিয়েছেন