ওয়াসওয়াসা ও তার প্রতিকার

জিজ্ঞাসা–৮৬৩: আমি অনেকদিন ধরেই শুচিবায়ুতে আক্রান্ত। প্রায় কয়েকমাস ধরে ওযু করতে গিয়ে অনেক সময় লাগাই। বেশিরভাগ সময় আমি ওযুর কারণে ফরজ জামাতে ঠিকমত পাই না। এই ওয়াসওয়াসা ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে। নামাজের মধ্যে অনেক বাজে জঘন্য কথা চিন্তায় আসত আল্লাহকে বা নবীকে নিয়ে বা কাবা ঘরকে নিয়ে। একসময় কুফরি চিন্তা আসত কুফরি চিন্তা এমন পর্যায়ে পৌছে গিয়েছিলো ইমান নিয়ে সন্দেহে পড়ে গিয়েছিলাম। নামাজে আরেক সমস্যার সৃষ্টি হয় মনে হতো যে বায়ু বের হয়ে যাচ্ছে এভাবে বার বার ওযু করে নামাজ পড়তাম কিন্তু এ ব্যাপারে জানলাম শব্দ বা গন্ধ না পাওয়া পর্যন্ত নামাজ না ছাড়তে তারপর এই ওয়াসওয়াসা চলে গেল। শিরকের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানতাম তাই যেহেতু এ বিষয়ে কম জ্ঞান ছিলো তাই নেটে থেকে শিরকের ব্যাপারে জানা শুরু করলাম। আমার এমন সমস্যার সৃষ্টি হলো প্রতিদিনি মনে হতো শিরকের যে উদাহরণসমুহ পড়েছি তারমধ্যে থেকে একটা বা আরো বেশি করতাম চিন্তায় শিরক মানে আমি জানি যে গুলো চিন্তা করলে শিরক হবে তাও তাই চিন্তা করতাম। যেমন : পীর মা শায়খ চেহারা মনে করে নামাজ পড়লে বা জিকির করলে নাকি শিরক। আমার চোখের সামনে কোন এক হুজুর চেহারা বেশে উঠত। এরকম আরো অনেক কিছু বলে শেষ করা যাবে না। এরকম কয়েকমাস ধরে শুরু হয়েছে। যেমন আল্লাহর গুণ কি মানুষকে দিলে নাকি শিরক হয়, আমি জানতে পেরেছি আর এরকম চিন্তা শুরু হয়ে গেছে। অনেকদিন ধরেই এমন কোন দিন নেই যে আমার মন শিরক করি নি। অথচ আমার মনে হয় এসব বিষয়ে আমি না জানলে হয়ত এরকম হতো না। যেমন আগে রাস্তায় মহিলা দেখলেই মাথা নিচু করে ফেলতাম বেশি লম্বা হওয়ার কারণে শুধু চোখ নিচু করে লাভ হয় না। আমার মাথা নিচু করে হাঠার অভ্যাস হয়ে গেছে কিন্তু ইদানিং এচিন্তায় মাথা নিচু করতে পারতেছিনা বা নিচু করলে মনে হচ্ছে শিরক করছি নাতো? বার বার শিরকের কারণে হতাশা আমাকে দুর্বল করে দিয়েছে এজন্য অন্যান্য গুনাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। যেখানে আমি জানি শিরক ছাড়া আমার কোন সমস্যা নেই শিরক বাদ বা শিরক ছাড়া আল্লাহর রহমতে আমার কোন বাজে অভ্যাস নেই বা কোন বাজে গুনাহ নেই শিরক ছাড়া সকল গুনাহ ত্যাগ করা আমার জন্য আল্লাহ অত্যন্ত সহজ করে দিয়েছেন আলহামদুলিল্লাহ। তবে এখন ইমান অত্যন্ত দুর্বল হয়ে গেছে যে শিরকের জন্য তওবা করতে পারি না অন্যান্য গুনাহের জন্য পারলেও শিরকের জন্য মন থেকে তওবা আসে না এবং আফসোস আসে না। একটু পরেই ভুলে যাই যে আমি এতো বড় গুনাহ করেছি। শিরক আমাকে দুর্বল ও হতাশ করে দিয়েছে। আমার লেখাটা পুরোটা পড়বেন এবং কি করণীয় আমাকে জানাবেন।–নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক।

জবাব:

এক. প্রিয় ভাই, আপনি আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হবেন না। কেননা, এটা ঈমানের লক্ষণ যে, আপনার মনে এই সব কথা আসলে আপনি উদ্বিগ্ন হন। আপনার কাছে এগুলো মন্দ চিন্তা বলে মনে হয়। ভেবে দেখুন, অন্তরে যদি ঈমান না থাকত তাহলে কি আপনি উদ্বিগ্ন হতেন না কিংবা একে মন্দ বলে মনে করতেন? বোঝা গেল যে, অন্তরে ঈমানের দৌলত রয়েছে।

হাদিসে এসেছে, একবার সাহাবায়ে কেরমের একদল রাসূলুল্লাহ -এর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, আমরা আমাদের অন্তরে কখনো কখনো এমন বিষয় অনুভব করি, যা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করা আমাদের কাছে খুব কঠিন মনে হয়। রাসূলুল্লাহ বললেন, সত্যিই কি তোমরা এরকম পেয়ে থাক? তাঁরা বললেন হ্যাঁ, আমরা এরকম অনুভব করে থাকি। রাসূলুল্লাহ বললেন, ذَاكَ صَرِيحُ الْإِيمَانِ এটি তোমাদের ঈমানের স্পষ্ট প্রমাণ। (মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, অনুচ্ছেদ: অন্তরের ওয়াসওয়াসা)

সুতরাং এইসব অনাহূত ভাবনা যখন আপনাকে বিরক্ত করবে তখন স্মরণ করুন যে, এটা ঈমানের আলামত। শয়তান তার উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করছে। তাকে বলে দিন, ঠিক আছে তুমি তোমারা মতো চেষ্টা কর, আমিও আমার মতো চেষ্টা করছি। এরপর নিজ কাজে মগ্ন হয়ে যান। এদিকে বেশি মনোযোগ দিবেন না। কেননা, এইসব অবাঞ্ছিত চিন্তাকে গুরুত্ব দিয়ে কীভাবে তা দূর করা যায় এ চিন্তায় পড়ে গেলে আপনি এখানেই আটকা পড়ে যাবেন। সামনে অগ্রসর হওয়া আর সম্ভব হবে না। এভাবে শয়তানের উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে যাবে।

যে কোনো ওয়াসওয়াসার প্রধান চিকিৎসা এটাই যে, একে গুরুত্ব না দেয়া। কী চিন্তা আসল, কী চিন্তা গেল-তা না ভেবে নিজের কাজে মশগুল থাকুন। কেননা, এটা মূলত শয়তানের কাজ। আল্লাহ তাআলা বলেন,

إِنَّمَا النَّجْوَىٰ مِنَ الشَّيْطَانِ لِيَحْزُنَ الَّذِينَ آمَنُوا وَلَيْسَ بِضَارِّهِمْ شَيْئًا إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ ۚ وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ

এই ওয়াসওয়াসা তো শয়তানের কাজ; মুমিনদেরকে দুঃখ দেয়ার দেয়ার জন্যে। তবে (এই ওয়াসওয়াসা সৃষ্টি করে) সে মুমিনদেরকে চুল পরিমাণ ক্ষতি করতে পারে না, আল্লাহর হুকুম ছাড়া। মুমিনদের উচিত আল্লাহর উপর ভরসা করা। (সূরা মুজাদালাহ ১০)

দুই. প্রিয় ভাই, আপনি তাওবা করতে পারছেন না; এর মাধ্যমে প্রকারন্তরে আপনি ইবলিসকে খুশি করছেন এবং আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করছেন। আপনার জন্য এটা ইবলিসের ফাঁদ। সুতরাং আপনি তার এই চক্রান্তকে নিশ্চিহ্ন করার একটাই উপায়–তাওবা এবং তাওবা। যে কোনো মূল্যে আপনাকে তাওবার দিকে অগ্রস্রর হতে হবেই।

আবারো বলছি, আপনি তাওবা না করার যে গুনাহয় লিপ্ত আছেন; এ থেকে মুক্তির একটাই পথ–তাওবা। এটা তো জানা কথা যে, আল্লাহ তাআলা তাওবার নির্দেশ কোরআন মজিদের বহু আয়াতে দিয়েছেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَّصُوحًا عَسَى رَبُّكُمْ أَن يُكَفِّرَ عَنكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيُدْخِلَكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ

হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে খালিছভাবে তাওবা কর। এতে আশা করা যায়, তোমাদের রব তোমাদের পাপরাশিকে মোচন করে দিবেন এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতে, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হবে নহর। (সূরা তাহরীম ৮)

স্বয়ং রাসুলুল্লাহ ; যিনি ছিলেন পরিপূর্ণ নিস্পাপ–তাওবা করতেন প্রতিদিন একশত বার। রাসুলুল্লাহ বলেন,

إِنَّهُ لَيُغَانُ عَلَى قَلْبِي وَإِنِّي لأَسْتَغْفِرُ اللَّهَ فِي كُلِّ يَوْمٍ مِائَةَ مَرَّةٍ ‏

কখনো কখনো আমার কলব পর্দাবৃত হয় (অর্থাৎ মানুষ হিসাবে দুনিয়ার কাজকর্মে লিপ্ত হওয়ার কারণে আল্লাহ্‌র যিকির হতে গাফিল হয়) এবং আমি আল্লাহ্‌র নিকট দৈনিক একশত বার ইস্তিগফার করে থাকি। (আবু দাউদ ১৫১৫)

ইমাম গাজালী রহ. তাঁর কিতাব ‘মিনহাজুল আবেদীনে’ লিখেছেন, অতপর হে! ইবাদতকারী তোমার উপর কর্তব্য হল তুমি আল্লাহর নিকট তাওবা কর । আর তাওবা করবে তুমি দুইটি কারণে–

. তাওবার কারণে আল্লাহ তোমাকে তার আনুগত্য করা সহজ করে দিবেন এবং তোমার নেক কাজ করার তাওফীক ও সৌভাগ্য লাভ হবে।

২. তোমাকে যে কারণে আল্লাহর নিকট তাওবা করতে হবে তা হল, যাতে আল্লাহ তোমার ইবাদত বন্দেগীগুলো কবুল করে নেন।

আমরা দোয়া করি, আল্লাহ আপনাকে, আমাদেরকে তাওবার তাওফিক দান করুন। নিশ্চয় তিনি তাওফিকদাতা।

প্রিয় ভাই, আপনি জিজ্ঞাসা নং–৬৯৭, জিজ্ঞাসা নং–২৫৫জিজ্ঞাসা নং–৫২৩ পড়ুন। ইনশা-আল্লাহ, উপকৃত হবেন।

والله اعلم بالصواب
উত্তর দিয়েছেন
শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

seven − five =