জিজ্ঞাসা–১২৩৯: আসসালামু আলাইকুম, দয়া করে উত্তর দিবেন। আমার এক মামাতো বোন মাদ্রাসায় পড়তো। কুরআন হাদীস সম্পর্কে জানতো। সে জানতো যে, কেউ রাসুল (সাঃ)-কে ইচ্ছাকৃতভাবে গালি দিলে গালিদাতা তওবা করলেও গালিদাতাকে হত্যা করা সরকারের দায়িত্ব। এ সম্পর্কে অবগত হওয়া সত্ত্বেও সে জেনেশুনে ইচ্ছাকৃতভাবে রাসুল (সাঃ)-কে মাঝে মাঝেই গালিগালাজ করতো এবং পরে অনুতপ্ত হয়ে তওবা করতো। তার পরিবারের লোকেরা তাকে নিষেধ করতো। আর এ বিষয়টি তার পরিবারের লোকেরা ছাড়া কেউ জানতো না। এখন সে খুবই লজ্জিত আবার তওবা করেছে। সে নিজেই সবকিছু আমাকে খুলে বলে। খুব কান্নাকাটি করে আমাকে সব কিছু খুলে বলে। সে জানতে চায় তার তওবা কবুল হবে কিনা? তওবার কারণে সে মৃত্যুদন্ড থেকে রেহাই পাবে কিনা? সে যে জানতো রাসুল সাঃ-কে গালি দিলে তওবা করলেও গালিদাতাকে হত্যা করতে হবে; সেটা সঠিক কিনা?–মাহমুদা আক্তার।
জবাব: وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
এক. কুরআন ও সুন্নাহর বক্তব্যের আলোকে আলেমগণ এবিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, যে ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে গালি দিবে, সে কাফির ও মুরতাদ হয়ে যাবে। ইবনু মুনজির রহ. বলেন,
أجمع عامة أهل العلم على أنَّ مَن سبَّ النبيَّ ﷺ عليه القتل
সর্বস্তরের উলামায়ে কেরামের ঐকমত্য হলো, নবী ﷺ-কে গালি দানকারীর একমাত্র শাস্তি হল, তাকে হত্যা করা। (তাফসিরে কুরতুবি ৮/২৮)
আল্লামা খাত্তাবি রহ. বলেন,
لا أعلم أحداً مِن المسلمين اختلف في وجوب قتله
নবী ﷺ-এর অবমাননাকারীর একমাত্র শাস্তি হল, তাকে হত্যা করা; এ ব্যাপারে কেউ দ্বিমত করেছেন বলে আমার জানা নেই। (মাআ’লিমুসসুনান ৩/২৯৫)
দুই. মৃত্যুদণ্ডের উক্ত সাজা তাওবা করলে মওকুফ হয়ে যায় কিনা; এ বিষয়ে ফকিহদের মাঝে মতবিরোধ আছে। শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেন,
قبول توبة من سب النبي ﷺ وقد ذكرنا أن المشهور عن مالك وأحمد أنه لا يستتاب ولا تسقط القتل عنه توبته وهو قول الليث بن سعد وذكر القاضي عياض أنه المشهور من قول السلف وجمهور العلماء وهو أحد الوجهين لأصحاب الشافعي وحكى مالك وأحمد أنه تقبل توبته وهو قول أبي حنيفة وأصحابه وهو المشهور من مذهب الشافعي بناء على قبول توبة المرتد
যে ব্যক্তি নবী ﷺ-কে গালি দিয়েছে তার তাওবা গ্রহণযোগ্য হওয়া প্রসঙ্গে। ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে, ইমাম মালিক রহ. ও ইমাম আহমাদ রহ.-এর প্রসিদ্ধ মত হল, তার কাছ থেকে তাওবা তলব করা হবে না এবং যদি তাওবা করেও তবুও তার হত্যাদণ্ড রহিত হবে না। লাইস ইবনু সা’দ রহ.-এর মতও এটাই। কাজী আ’য়ায রহ. উল্লেখ করেছেন, সালাফদের (পূর্বসূরি ফকিহ) ও অধিকাংশ আলেমদের প্রসিদ্ধ বক্তব্যও এটাই। শাফিঈ মাজহাবের ফকিহদেরও একটি মত এটাই। পক্ষান্তরে ইমাম মালিক রহ. ও ইমাম আহমাদ রহ. থেকে একটি মত বর্ণিত হয়েছে যে, তার তাওবা গ্রহণ করা হবে। আর এটাই ইমাম আবু হানিফা রহ. ও তাঁর অনুসারী ফকিহদের মত। ইমাম শাফিঈ রহ.-এর প্রসিদ্ধ মতও এটা। অন্যান্য সাধারণ মুরতাদের তাওবা কবুল করা হয়, এই হিসেবে। (আসসারিমুল মাসলুল, দারুল কুতুব আলইলমিয়্যা, বৈরুত, লেবানন পৃষ্ঠা ২২৫)
তিন. তবে বিষয়টি যদি বিচারকের কাছ পর্যন্ত না পৌঁছে, তাহলে শরিয়ত তাকে ও অন্যান্য মুসলিমকে এই সুযোগ দেয় যে, তার বিষয়টি গোপন রাখা হবে এবং সে আল্লাহর কাছে খুব করে অনুতপ্ত হয়ে তাওবা করে নিবে। পাশাপাশি অধিকহারে ইসতেগফার করবে, নেক আমল বাড়িয়ে দিবে, গুনাহগুলো বর্জন করবে এবং এমন আমলের প্রতি মনোযোগী হবে, যার মাধ্যমে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ-এর ভালোবাসা তার অন্তরে শনৈঃ শনৈঃ বৃদ্ধি পেতে থাকে। কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
وَإِنِّي لَغَفَّارٌ لِمَنْ تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا ثُمَّ اهْتَدَى
আর যে তাওবা করে, ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে অতঃপর সৎপথে অটল থাকে, আমি তার প্রতি অবশ্যই ক্ষমাশীল। (সুরা ত্বা-হা ৮২)
তিনি আরো বলেছেন,
ثُمَّ إِنَّ رَبَّكَ لِلَّذِينَ عَمِلُوا السُّوءَ بِجَهَالَةٍ ثُمَّ تَابُوا مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ وَأَصْلَحُوا إِنَّ رَبَّكَ مِنْ بَعْدِهَا لَغَفُورٌ رَحِيمٌ
অনন্তর যারা অজ্ঞতাবশতঃ মন্দ কাজ করে, অতঃপর তাওবা করে এবং নিজেকে সংশোধন করে নেয়, আপনার পালনকর্তা এসবের পরে তাদের জন্যে অবশ্যই ক্ষমাশীল, দয়ালু। (সুরা নাহল ১১৯)
হাদিস শরিফে এসেছে,
عن عبادة بن الصامت أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ قَالَ وَحَوْلَهُ عِصَابَةٌ مِنْ أَصْحَابِهِ: ( بَايِعُونِي عَلَى أَنْ لَا تُشْرِكُوا بِاللَّهِ شَيْئًا وَلَا تَسْرِقُوا وَلَا تَزْنُوا وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُمْ وَلَا تَأْتُوا بِبُهْتَانٍ تَفْتَرُونَهُ بَيْنَ أَيْدِيكُمْ وَأَرْجُلِكُمْ وَلَا تَعْصُوا فِي مَعْرُوفٍ ؛ فَمَنْ وَفَى مِنْكُمْ فَأَجْرُهُ عَلَى اللَّهِ ، وَمَنْ أَصَابَ مِنْ ذَلِكَ شَيْئًا فَعُوقِبَ فِي الدُّنْيَا فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَهُ ، وَمَنْ أَصَابَ مِنْ ذَلِكَ شَيْئًا ثُمَّ سَتَرَهُ اللَّهُ فَهُوَ إِلَى اللَّهِ ، إِنْ شَاءَ عَفَا عَنْهُ ، وَإِنْ شَاءَ عَاقَبَهُ ) فَبَايَعْنَاهُ عَلَى ذَلِك
উবাদাহ ইবনুস সামিত রাযি. বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসূল ﷺ-এর পাশে একজন সাহাবীর উপস্থিতিতে তিনি বলেন, তোমরা আমার নিকট এই মর্মে বায়‘আত গ্রহণ কর যে, আল্লাহর সঙ্গে কোন কিছুকে অংশীদার সাব্যস্ত করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, তোমাদের সন্তানদের হত্যা করবে না, কারো প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করবে না এবং সৎকাজে নাফরমানী করবে না। তোমাদের মধ্যে যে তা পূর্ণ করবে, তার পুরস্কার আল্লাহর নিকট রয়েছে। আর কেউ এর কোন একটিতে লিপ্ত হলো এবং দুনিয়াতে তার শাস্তি পেয়ে গেলে, তবে তা হবে তার জন্য কাফ্ফারা। আর কেউ এর কোন একটিতে লিপ্ত হয়ে পড়লে এবং আল্লাহ তা অপ্রকাশিত রাখলে, তবে তা আল্লাহর ইচ্ছাধীন। তিনি যদি চান, তাকে মার্জনা করবেন আর যদি চান, তাকে শাস্তি প্রদান করবেন। আমরা এর উপর বায়‘আত গ্রহণ করলাম। (সহিহ বুখারী ১৮, সহিহ মুসলিম ১৭০৯)
والله اعلم بالصواب
উত্তর দিয়েছেন
শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী