জিজ্ঞাসা–১৭৬৯: মুহতারাম, আশা করছি আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন। আলহামদুলিল্লাহ, আমার নাম মুহাম্মদ আসিফ, বয়স ২৪ বছর। পরিবারে আমার মা, এক ছোট ভাই এবং আমি একসাথে শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকি। আমার আব্বু সৌদিআরব প্রবাসী। শহরে ভাড়া থাকার প্রধান কারণ ছোট ভাইকে মাদ্রাসায় পড়াশুনা করানো (নূরানী ১ম শ্রেণীর ছাত্র) এবং আমার নিজের পড়াশুনা শহর কেন্দ্রিক হওয়ায়। আমি মার্কেটিং বিষয়ে অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ছি এবং পড়ালেখার পাশাপাশি একটা কোম্পানীতে দুই বছর যাবৎ মার্কেটিংয়ে জব করছি। এইখান থেকে মাসিক প্রায় তেরো হাজার টাকা সেলারি পাই। ঐ টাকা থেকে প্রতিমাসে বাসা ভাড়া বাবদ পাঁচ হাজার টাকা ব্যয় করি এবং বাকি টাকা আমি আমার ব্যাক্তিগত যাতায়াত, নাস্তা ও আনুসঙ্গিক খরচ হিসেবে কাজে লাগাই। ফ্যামিলীতে আমিই একমাত্র প্র্যাক্টিসিং মুসলিম। তাছাড়া আমার মা,বোন, খালাম্মারা সবাই দ্বীনের ক্ষেত্রে বড়ই উদাসীন।
করোনাকালীন দেশে ছুটিতে আসলে অপরিকল্পিত কিছু কাজের ঋণে জড়িয়ে যায়। সেই কারণে আব্বু তার বেতনের টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ এবং দুই-তিন মাস পরপর সংসারের খরচের জন্য কিছু টাকা দেশে পাঠায়। আব্বুর বেতনও ১৮-১৯ হাজার টাকার মতো। বেতন কিছুটা কম হলেও আম্মুর কিছুটা বদ মেজাজ থাকার কারণে দেশে এসে নিজে কিছু করতে সাহস করে না।
আমি আমার ব্যাক্তিগত জৈবিক চাহিদার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজের সাথে নিজের জুলুমের শিকার হয়ে মারাত্মক জগন্য গুনাহে লিপ্ত। এটার শুরু মোবাইলের খারাপ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে। যদিও কলেজে পড়া অবস্থায় দ্বীনে ফেরার পর থেকেই কোনো মেয়ের সাথে এখনও পর্যন্ত অনলাইন/অফলাইনে হারাম রিলেশনে জড়িত নই। নিজের গুনাহের কথা বুঝতে পেরে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে স্মার্টফোন ব্যাবহার থেকে যতটা সম্ভব নিজেকে দূরে রাখতে চেষ্টা করছি। কিন্তু তারপরেও একটা নির্দিষ্ট সময় (২৫-৩০ দিন) পরপর একই যেনায় লিপ্ত হয়ে যাই। পরক্ষণে আফসোস ও হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে আল্লাহর কাছে তওবা করি। কিন্তু পূর্বের ন্যায় ফের নিজেনিজে গুনাহে লিপ্ত হই। মাঝে মাঝে নফল রোজা রাখার মতো অভ্যাস করি কিন্তু তারপরেও শেষ পর্যন্ত গুনাহ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারছিনা।
নিজের লজ্জা ভেঙে আমি আমার মা-বাবাকে আমার বিয়ের কথা বলি। আম্মু আব্বু আমাকে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে বিয়ে থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাচ্ছেন। তাদের মতে আমি এখনও বিয়ের জন্য উপযুক্ত নই এবং বিয়ে পরবর্তী আহলিয়ার প্রয়োজনীয় সাংসারিক খরচ চালাতে ব্যার্থ হবো, ইত্যাদি ইত্যাদি। যদিও আমি শালীনতা বজায় রেখে একটা দীনদার মেয়ের কতটুকু চাহিদা থাকতে পারে তা জানিয়েছি। এমতবস্থায় তারা বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে আমাকে থামানোর চেষ্টা করছে। মাঝে মাঝে কথার এক পর্যায়ে আমাকে নিজের বিয়ে নিজে করে ফেলতে বলে। আমার পরিবার এমনিতে পরিপূর্ণ পর্দা সহিত দ্বীন পালন করেন না। বিশেষ করে আমার মায়ের ক্ষেত্রে বিষয়টা খুব বেশী। আম্মুকে খাছ পর্দার ব্যাপারে আমি নছিয়ত করলে কিংবা হক্কানী আলেমদের নছিয়ত শুনালে তিনি হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে মন্তব্য করেন তার পর্দার ব্যাপারে আমি মাথা ব্যাথা না করতে। উনার হিসাব উনি দিবে।
কিন্তু আমার একটা অভ্যাস, ঘরে বাহিরে চেনা অচেনা যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কোনো বিধান যদি জেনে শুনে মানতে অস্বীকার করে, নারাজ হয় অথবা এড়িয়ে যায়, আমি প্রথমে তাকে গুছিয়ে শালীনভাবে বুঝানোর চেষ্টা করি এবং পরবর্তীতে তার কোনো পরিবর্তন হয়নি দেখলে তার সাথে কথাবার্তা বন্ধ রাখা ও চলাফেরার দূরত্ব কমিয়ে দেই। আমার নিজের মা, খালা ও বোনদের সাথেও এমনটা করি। মায়ের ক্ষেত্রে বিষয়টা আমাকে খুব ভাবায় যদিও মা অনেক ক্ষেত্রে আমার সাথে কথার এক পর্যায়ে নিজের ও আমার ঈমান ছুটে যায় এমন কথা মুখ দিয়ে বের করে ফেলে। তাই উনাকে সমযত রাখার জন্য কথা বলিনা। এটা করা আমার উচিৎ হচ্ছে কিনা এবং সঠিকভাবে কি করা উচিৎ দয়াকরে এটাও জানাবেন।
আরেকটা বিষয় হলো, পরিবারে আমার মায়ের দ্বীনের প্রতি কিছুটা উদাসীনতার কারণে বিয়ের পর আমি আমার আহলিয়াকে এই ফ্যামিলিতে পরিপূর্ণ পর্দা সহিত রাখতে না পারার আশঙ্খা রয়েছে। আমার পড়াশুনা শেষ করতে আরো দুয়েক বছর সময় লাগবে। এখন ছাত্রবস্থায় আমি বিয়ে করলে আলাদা আলাদা ভাবে দুই জায়গাতে খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হবে।
অপরদিকে মারাত্মক আকারে গুনাহের কারণে নিজের ঈমান নিয়ে একেবারে খাদের কিনারায় অবস্থান করছি। নিজের ঈমান নিয়ে মৃত্যুবরণ করা আমার জন্য সময়ের সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠেছে।
#1 এমতবস্থায় আমি এখন কি করবো?
#2 কিভাবে নিজেকে গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে, নিজের পরিবারকে সাথে নিয়ে জীবনকে সুন্দর ভাবে পরিচালিত করতে পারি বিস্তারিত জানালে দুনিয়া ও আখিরাতের উভয়ে উপকৃত হব।–আমজাদ আসিফ।
জবাব: প্রিয় দীনী ভাই, ইসলাম জানিয়েছে, মা-বাবা যেমনই হোক, তাঁদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করা, মা-বাবাকে শ্রদ্ধা করা, ভালবাসা, তাঁদের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা, কথা শোনা, গুরুত্ব দেওয়া, বাধ্য হওয়া শরিয়তের দৃষ্টিতে ওয়াজিব। মায়ের পদতলে জান্নাত। বাবার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং বাবার অসন্তষ্টিতে আল্লাহর অসন্তষ্টি। মা-বাবার অবাধ্য হওয়া, তাদেরকে রাগান্বিত করা— হারাম এবং কবিরা গুনাহ; এমনকি সেটা যদি শুধু উফ্ উফ্ শব্দ উচ্চারণ করার মাধ্যমে হয় তবুও। কোরআন-হাদিসের অসংখ্য স্থানে এ বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, আল্লাহর বাণী:
وَقَضَى رَبُّكَ أَلا تَعْبُدُوا إِلا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلاهُمَا فَلا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلا كَرِيمًا وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا
তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে `উফ্’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং তাদের সাথে সম্মানসূচক কথা বল। আর মমতাবশে তাদের প্রতি নম্রতার পক্ষপুট অবনমিত কর এবং বল ‘হে আমার রব! তাঁদের প্রতি দয়া করুন যেভাবে শৈশবে তাঁরা আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন। (সূরা বনী ইসরাইল: ২৩-২৪)
সুতরাং আলোচ্য ক্ষেত্রে আপনি যা করবেন তাহল–
১. আপনার মুসিবত আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা। সুতরাং মায়ের সঙ্গে অসদাচারণ না করে ধৈর্য ধারণ করবেন। বেশি বেশি করে আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন, যেন তোমার তাঁর মন-মানসিকতার পরিবর্তন হয়। রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
عَجَبًا لِأَمْرِ الْمُؤْمِنِ إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ وَلَيْسَ ذَاكَ لِأَحَدٍ إِلَّا لِلْمُؤْمِنِ : إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ ، فَكَانَ خَيْرًا لَهُ ، وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ ، فَكَانَ خَيْرًا لَهُ
মুমিনের অবস্থা ভারি অদ্ভুত। তাঁর সমস্ত কাজই তাঁর জন্য কল্যাণকর। মুমিন ব্যাতিত অন্য কারো জন্য এ কল্যাণ লাভের ব্যাবস্থা নেই। তাঁরা আনন্দ (সুখ শান্তি) লাভ করলে শুকরিয়া জ্ঞাপন করে, তা তাঁর জন্য কল্যাণকর হয়, আর দুঃখকষ্টে আক্রান্ত হলে ধৈর্যধারণ করে, এও তাঁর জন্য কল্যাণকর হয়। (মুসলিম ৭২২৯)
২. পাশাপাশি অভিভাবককে যে কোনোভাবে বুঝিয়ে নিবেন। এক্ষেত্রে আপনার পরিবারের বিশ্বস্ত কিংবা আপনার পরিবারে প্রভাব রাখেন এমন তৃতীয় কোনো ব্যক্তির সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে। কেননা, আল্লাহ না করুন, এমনটি করতে না পারলে পারিবারিক মর্যাদা ও সামাজিক অবস্থান ক্ষুণ্ণ হতে পারে এবং এমন কিছু পরিণামের দুয়ার খুলে দিতে পারে, যা পরবর্তীতে তাদের বৈবাহিক-জীবনে অশান্তির বড় কারণ হবে।
দেখুন, আল্লাহ তাআলা বিয়ে দেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন অভিভাবকদের প্রতি। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وأَنْكِحوا الأيامى منكم
আর তোমরা তোমাদের মধ্যে অবিবাহিত নারী-পুরুষদের বিবাহ দাও। (সূরা নুর ৩২)
৩. উপরোক্ত পদক্ষেপ নেয়ার পরেও যদি পরিবারের লোকজন বিশেষ করে আপনার মা বিয়ের সম্মতি না দেয় তবে গুনাহয় জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থেকে আত্মরক্ষার স্বার্থে নিজ সিদ্ধান্তে পছন্দনীয় মেয়ের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে বিয়ে করে নিতে হবে। কেননা, ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে উপযুক্ত ছেলের এভাবে বিয়ে করায় কোনো দোষ নেই। তাছাড়া ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে বাবা-মায়ের বাধ্য থাকার বিষয়টি কেবল বৈধ কাজের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। সুতরাং যদি তাঁরা ফরযে আইন, ওয়াজিব কিংবা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা বর্জন করতে বলেন অথবা যদি তাঁরা কোনো হারাম কাজ করতে বলেন তাহলে সে ক্ষেত্রে তাঁদের আনুগত্য করা জায়েয হবে না। কেননা, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,
فَإِنْ أُمِرَ بِمَعْصِيَةٍ، فَلَا سَمْعَ وَلَا طَاعَةَ
অসৎকাজে আনুগত্য নয় ;আনুগত্য কেবলমাত্র সৎকাজের ক্ষেত্রেই হতে হবে। (বুখারী ৭১৪৫ মুসলিম ১৮৪০)
৪. বিয়ের কথা বললে আপনার প্রতি আপনার মায়ের রাগ করা ও অসৌজন্য আচরণের অন্যতম কারণ হল, দীন সম্পর্কে অজ্ঞতা ও দীনের প্রতি মহব্বতের ঘাটতি। এজন্য আপনি মমতাপূর্ণ নসিহতের মাধ্যমে অব্যাহত চেষ্টা ও দোয়া চালিয়ে যাবেন, দেখবেন, একদিন আপনি সফল হবেন এবং তাঁদের এই অপূর্ণতা দূরীভূত হবে। কেননা, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
مَا كَانَ الرِّفْقُ فِي شَيْءٍ إِلَّا زَانَهُ وَلَا نُزِعَ مِنْ شَيْءٍ إِلَّا شَانَهُ
যে বিষয়ে নম্রতা ও কোমলতা থাকে তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি হয়। যে বিষয়ে কোমলতা থাকে না, তা দোষণীয় হয়ে পড়ে। (মুসলিম ৪৬৯৮)
পরিশেষে, আমার এ লেখাটি আপনার পরিবারকে বিশেষ করে আপনার মাকে পড়ে শোনানোর অনুরোধ রইল। এতে তিনি সন্তানের মনোবেদনা কিছুটা হলেও অনধাবন করবেন বলে আশা করা যায়।
শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী