জিজ্ঞাসা–১৩৫৬: আমার এক জনের সাথে হারাম সম্পর্ক ছিল। কয়েক মাস হয়ে গেল তার সাথে সম্পর্ক শেষ। কিন্তু আমি তাকে ভুলতে পারছি না। ওর কথা মনে পড়লে খুব ডিপ্রেশনে ভুগি, অনেক হতাশ হই। মনে হয়, আমি আর বাঁচতেই পারব না ওকে ছাড়া। তাই নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা করে। আমি এখন কী করব? আমি নিজেকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। অনেক সময় ওর কথা মনে করে পাপের জগতে ঢুকে যাই (পর্ণগ্রাফিতে)। আমি আর হারাম সম্পর্কে জড়াতে চাই না। আর এই হতাশ, ডিপ্রেশন থেকে বাঁচতে চাই, ওই লোককে ভুলতে চাই। দয়া করে সাহায্য করুন।–নাম-ঠিকানা গোপন রাখতে চাই।
জবাব:
প্রিয় বোন, নিশ্চয় আপনার অজানা নয় যে, হারাম সম্পর্ক ও পর্ণগ্রাফি উভয়টাই ভয়াবহ কবিরা গুনাহ। তাই আমরা প্রথমেই আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করছি, তিনি যেন আপনার উপর তার নেয়ামতকে পরিপূর্ণ করে দেন। আপনার তাকওয়া ও লজ্জাশীলতা আরও বাড়িয়ে দেন। আমীন।
আর আপনার প্রতি আমাদের পরামর্শ হল–
এক. আপনার উচিত আর দেরি না করে আপনার অভিভাবকের কাছে আপনার বিয়ে করার সিদ্ধান্ত দৃঢ়ভাবে তুলে ধরা। কেননা, যে ব্যক্তির অবস্থা এমন তার চুপ থাকার সিদ্ধান্ত ভুল। প্রয়োজনে প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সরাসরি অথবা যথাযোগ্য কোন ব্যক্তির মাধ্যমে পরিবারের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করুন। নিজের ও পরিবারের কল্যাণের জন্য এটা আপনাকে যত দ্রুত সম্ভব করতেই হবে। কেননা, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
من وُلِدَ لَهُ وَلَدٌ فَلْيُحْسِنِ اسْمَهُ وَأَدَبَهُ فَإِذَا بَلَغَ فَلْيُزَوِّجْهُ فَإِنْ بَلَغَ وَلَمْ يُزَوِّجْهُ فَأَصَابَ إِثْمًا فَإِنَّمَا إثمه على أَبِيه
তোমাদের মাঝে যার কোন (পুত্র বা কন্যা) সন্তান জন্ম হয় সে যেন তার সুন্দর নাম রাখে এবং তাকে উত্তম আদব কায়দা শিক্ষা দেয়; যখন সে বালেগ অর্থাৎ সাবালক/সাবালিকা হয়, তখন যেন তার বিয়ে দেয়; যদি সে বালেগ হয় এবং তার বিয়ে না দেয় তাহলে, সে কোন পাপ করলে উক্ত পাপের দায়ভার তার পিতার উপর বর্তাবে। (বাইহাকি ৮১৪৫)
দুই. নিয়মিত নামাজ আদায় করুন এবং আল্লাহ্র কাছে মুনাজাত করে, তাঁকে স্মরণ করে, তাঁর কিতাব তেলাওয়াত করে স্বাদ অনুভব করুন। আল্লাহ্ তাআলা বলেন,
اتْلُ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِنَ الْكِتَابِ وَأَقِمِ الصَّلَاةَ إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاء وَالْمُنكَرِ وَلَذِكْرُ اللَّهِ أَكْبَرُ وَاللَّهُ يَعْلَمُ مَا تَصْنَعُونَ
আপনি আপনার প্রতি প্রত্যাদিষ্ট কিতাব পাঠ করুন এবং নামাজ কায়েম করুন। নিশ্চয় নামায অশ্লীল ও গর্হিত কার্য থেকে বিরত রাখে। আল্লাহর স্মরণ সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ জানেন তোমরা যা কর। (সূরা আনকাবুত ৪৫)
একবার সাহাবারা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলল, অমুক সাহাবী বিভিন্ন ধরনের খারাপ কাজে জড়িয়ে পড়েছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ জিজ্ঞেস করলেন, সে কি এখনো নামাজ পড়ে? সবাই বলল, হ্যাঁ, পড়ে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, সে যদি নামাজ পড়তে থাকে তাহলে নামাজ তাকে অবশ্যই একদিন খারাপ কাজ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। (মুসনাদে আহমাদ ২/৪৪৭)
তিন. যৌনসুড়সুড়ি জাগানিয়া কাণ্ডসমূহ থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে চলুন। বিশেষত ইন্টারনেটের অবাধ ও অবৈধ ব্যবহার থেকে নিজেকে দূরে রাখুন। নারীপুরুষের সহাবস্থান কিংবা ফ্রেন্ডশিপের নামে ছেলেদের সঙ্গে কথোপকথন এড়িয়ে চলুন। এক কথায়, পর্দার প্রতি পরিপূর্ণ যত্নশীল হোন। মনে রাখবেন, পৃথিবীর সবচে দীর্ঘতম সফর এক পা ওঠালেই শুরু হয়ে যায়। অনুরূপভাবে উক্ত কর্মকান্ডগুলোর মাধ্যমে শুরু হয় মূল ব্যভিচারের প্রতি সফর। ঈমানদারের কর্তব্য হল সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা ফেলা থেকে বিরত থাকা। এজন্যই আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিয়েছেন–
وَقُل لِّلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ
ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে। (সূরা নূর ৩১)
চার. মাসে অন্তত তিনদিন অর্থাৎ আরবি মাসের ১৩,১৪,১৫ রোজা রাখার চিন্তা করতে পারেন। অথবা প্রতি সপ্তাহে সোম ও বৃহস্পতিবার। কেননা রোজার মধ্যে প্রবৃত্তির টানে ছুটে যাওয়া থেকে যেমন সুরক্ষা রয়েছে, তেমনি রয়েছে আল্লাহর কাছে বড় প্রতিদান। মানুষের ইচ্ছাশক্তি দৃঢ় করা, ধৈর্য, সহনশীলতা, নফসের খাহেশ ও আনন্দদায়ক বিষয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দীক্ষাও রয়েছে রোজায়। তাই রোজা রাখার ব্যাপার মনস্থির করুন। আশা করা যায়, আল্লাহ আপনার বোঝা হালকা করবেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ ، مَنِ اسْتَطَاعَ الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ ، فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ ، وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ فَإِنَّهُ
হে যুবক সম্প্রদায় ! তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহ করার সামর্থ্য রাখে, তারা যেন বিবাহ করে। কেননা, বিবাহ তার দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং যৌনতাকে সংযমী করে এবং যাদের বিবাহ করার সামর্থ্য নাই, সে যেন রোযা পালন করে। কেননা, রোযা তার যৌনতাকে দমন করে। (বুখারী ৪৯৯৬)
চার. কখনো একাকী নিভৃতে থাকবেন না। কেননা একাকীত্ব গোনাহ চিন্তা করার কারণ হতে পারে। আর আপনার সময়কে উপকারী বিষয়ে ব্যয় করতে সচেষ্ট হোন। যেমন, অধিকহারে ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’র জিকির প্রতিদিনের অবসর সময়ের জন্য আবশ্যিক আমল করে নিতে পারেন। কেননা, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
مَنْ لَزِمَ الاِسْتِغْفَارَ جَعَلَ اللَّهُ لَهُ مِنْ كُلِّ ضِيقٍ مَخْرَجًا وَمِنْ كُلِّ هَمٍّ فَرَجًا وَرَزَقَهُ مِنْ حَيْثُ لاَ يَحْتَسِب
পাঁচ. প্রত্যেক নামাযের পর দৈনিক অন্তত পাঁচ বার কিছু সময়ের জন্য- দুই থেকে পাঁচ মিনিটের জন্য আল্লাহর সান্নিধ্যের মুরাকাবা করুন। মুরাকাবা এভাবে করবেন- চোখ বন্ধ করবেন। তারপর ভাববেন, ‘আমি যেখানেই থাকি না আল্লাহ আমার সাথে আছেন।’ অথবা এই আয়াতের বিষয়বস্তু নিয়ে চিন্তা করবেন- هُوَ مَعَكُمْ اَيْنَمَا كُنْتُمْ ‘তোমরা যেখানেই তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন।’
ছয়. ঘুমানোর সময় ইসলামী আদবগুলো মেনে চলুন। যেমন ঘুমানোর দোয়াগুলো পড়া, ডান পার্শ্বে কাত হয়ে শোয়া, পেটের উপর ভর দিয়ে না-ঘুমানো; যেহেতু এ সম্পর্কে নবী ﷺ-এর নিষেধ আছে।
এভাবে নিয়মিত কিছুদিন করতে পারলে -ইনশা আল্লাহ- ধীরে ধীরে আল্লাহর সান্নিধ্যের সার্বক্ষণিক অনুভূতি অন্তরে বসে যাবে এবং বাজে চিন্তা থেকে বের হওয়া সহজ হয়ে যাবে।
হে প্রিয় বোন, সর্বোপরি কোনো পাপের পথে পা বাড়াবার আগে একটু ভাবুন, আল্লাহ আমাকে দেখছেন।
শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী