জিজ্ঞাসা–১৩০৮: আমার বয়স ২৩। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩য় বর্ষে পড়ছি। আমার মেয়ের সাথে ৩ বছর যাবত ভালোবাসার সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের দুজনের পরিবার বিষয়টি সম্পর্কে অবগত। মেয়েটির পরিবার বিয়ের জন্য রাজি হলেও আমার পরিবার থেকে বলা হয়েছে পড়াশুনা শেষ করার পর বিয়ের ব্যবস্থা করবে, এর আগে আগে না। সম্প্রতি আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি দ্বীনের পথে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু হারাম সম্পর্কে থাকার দরুন ইবাদত করে কোনভাবেই শান্তি পাচ্ছি না। তাই আমার হাতে দুটি রাস্তা খোলা, হয় সম্পর্ক ভেঙে দেয়া নতুবা বিয়ে করে নেয়া। যেহেতু সম্পর্কের ব্যপারে দুজনের পরিবার জানে আর আমার পড়াশুনা শেষ হওয়ার মাত্র ১ বছর বাকী তাই শেষ সময়ে এসে সম্পর্ক ভেঙ্গে দিলে সেটা দুজনের জন্যই কষ্টকর হয়ে যাবে। তাই আমি বিয়ে করতে চাই, এক্ষেত্রে মেয়ে ও মেয়ের পরিবার রাজী হবে কিন্তু আমার পরিবার কোন ভাবেই রাজী হবে না। তাই বাসায় বিয়ের বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে ভয় পাচ্ছি। কিভাবে পরিবারকে হালাল সম্পর্কের গুরুত্ব বুঝিয়ে বিয়ের ব্যাপারে রাজী করানো যায়?–রাহাতুল আমিন।
জবাব: وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
এক. প্রিয় ভাই, আপনি কি আমাদের কাছে এজন্য মেইল করেছেন যে, আমরা আপনাকে গোপনে বিয়ে করার অনুমতি দিব?! অথচ অভিভাবকশূন্য এমন অসামাজিক ও অমানবিক বিয়ের অনুমতি দেয়ার অধিকার তো আমাদের নেই। কেননা, ইসলামের নির্দেশনা হলো, أعلنوا النكاح (মুসনাদে আহমাদ ৪/৫) ‘বিয়ে করবে ঘোষণা দিয়ে।’ দেখুন, আল্লাহ তাআলা বিয়ে দেয়ার জন্য অভিভাবকদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন: وأَنْكِحوا الأيامى منكم ‘আর তোমরা তোমাদের মধ্যে অবিবাহিত নারী-পুরুষদের বিবাহ দাও।’ (সূরা নুর ৩২)
নাকি আপনি চাচ্ছেন যে, আমরা আপনাকে বিবাহ-বহির্ভূত প্রেম বৈধ বলে ফতোয়া দিব?! কোন আলেমের পক্ষে এ ফতোয়া দেয়া সম্ভব নয়। কেননা, রাসূলুল্লাহ ﷺ এটাকে যেনা বা ব্যভিচার বলেছেন-
اَلْعَيْنَانِ زِنَاهُمَا النَّظْرُ وَالْاُذُنَانِ زِنَاهُمَا الْاِسْتِمَاعُ وَاللِّسَانُ زِنَاهُمَا الْككَلَامُ وَالْيَدُ زِنَاهُمَا الْبَطْشُ وَالرِّجْلُ زِنَاهُمَا الخُطَا وَالْقَلْبُ يَهْوِىْ وَيَتَمَنَّى وَيُصَدِّقُ ذَالِكَ الْفَرْجُ اَوْ يُكَذِّبُه
দুই চোখের ব্যভিচার হল হারাম দৃষ্টি দেয়া, দুই কানের ব্যভিচার হল পরনারীর কণ্ঠস্বর শোনা, জিহবার ব্যভিচার হল, [পরনারীর সাথে সুড়সুড়িমূলক] কথোপকথন। হাতের ব্যভিচার হল পরনারী স্পর্শ করা, পায়ের ব্যভিচার হল গুনাহর কাজের দিকে পা বাড়ান, অন্তরের ব্যভিচার হল কামনা-বাসনা আর গুপ্তাঙ্গঁ তা সত্য অথবা মিথ্যায় পরিণত করে। (সহীহ মুসলিম ২৬৫৭, মুসনাদে আহমাদ ৮৯৩২)
দুই. প্রিয় ভাই, আপনি হয়ত ভাবছেন, গোপনে বিয়ে করার মাধ্যমে আপনারা প্রশান্তি পাবেন?! আল্লাহ আপনাকে এমন ভাবনা থেকে দূরে রাখুন ও পবিত্র রাখুন। যদি আপনি এমনটি ভেবে থাকেন তাহলে মহা ভুলের মধ্যে আছেন। বরং ‘অভিভাবকশূন্য বিয়ে’ মানে পারিবারিক মর্যাদা, সামাজিক অবস্থান, চরিত্রের পবিত্রতা ও আমানতদারিতা, আপনাদের অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ সর্বোপরি আপনার দ্বীনদারির উপর কালো ও অতি বিশ্রি দাগ স্থায়ীভাবে বসে যাওয়া এবং এমন কিছু পরিণামের দুয়ার খোলা, যা পরবর্তীতে আপনাদের বৈবাহিক-জীবনে অশান্তির বড় কারণ হবে।
সুতরাং আপনি কিভাবে প্রত্যাশা করেন যে, আমরা আপনাকে ইজ্জত কলঙ্কিত করার অনুমতি দিব এবং বলব, ঠিক আছে গোপনে বিয়ে করে ফেলুন; অসুবিধা নেই!!
তিন. প্রিয় ভাই, আপনাদেরকে কষ্ট দেয়া কিংবা ফেতনায় ফেলে রাখা আমাদের উদ্দেশ্যে নয়; আমরা শুধু এ ব্যাপারে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছি যে, আপনারা যা করছেন এবং করতে চাচ্ছেন সেটা কত বড় জঘন্য! আপনারা হয়তো ভুলে গেছেন যে, ইসলামে ধৈর্য বা সবর নামক এক মহান ইবাদত আছে; যার বিনিময়ে রয়েছে রবের সন্তুষ্টি এবং রয়েছে জান্নাত। এজন্য দেরীতে বিয়ের যে পরীক্ষার মধ্যে আপনারা আছেন এ অবস্থায় আমরা আপনাদেরকে ধৈর্য রাখার উপদেশ দিচ্ছি। আপনাদের এ ভালবাসা যদি আপনাদেরকে আল্লাহর ভালবাসা থেকে বিমুখ না করে এবং কোন প্রকার হারাম কথা ও কাজের দিকে নিয়ে না যায় তাহলে নিশ্চিত থাকুন, আল্লাহ আপনাদেরকে এমনভাবে পুষিয়ে দিবেন; যার কল্পনাও বান্দা করতে সক্ষম নয়। إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُونَ أَجْرَهُم بِغَيْرِ حِسَابٍ যারা সবরকারী, তারাই নিজেদের পুরস্কার পায় অগণিত। (সূরা যুমার ১০)
প্রিয় ভাই, আমরা আপনার ব্যাপারে সুধারণা রাখব যে, আপনি এ ব্যাপারে এ হাদিসটির প্রতিপাদ্য হবেন না। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, مَا تَرَكْتُ بَعْدِي فِتْنَةً أَضَرَّ عَلَى الرِّجَالِ مِنْ النِّسَاءِ আমার পরবর্তীতে পুরুষের জন্য নারীর ফিতনার চেয়ে কঠিন কোন ফিতনা আমি রেখে যায় নি। (সহীহ বোখারী ৪৮০৮ ও সহীহ মুসলিম ৬৮৮১)
চার. পরিশেষে আমরা আপনাকে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হওয়ার উপদেশ দিচ্ছি এবং পারিবারিকভাবে তাড়াতাড়ি বিয়ে হওয়ার জোর প্রচেষ্টা ও দোয়া হেকমত, বুদ্ধিমত্তা ও শালীনতার সাথে চালাবার পরামর্শ দিচ্ছি। গুনাহ ত্যাগ, নেক আমলের মাধ্যমে আপনার রবের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার আহ্বান জানাচ্ছি।
আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন ঈমানকে আপনার কাছে প্রিয় করে দেন, সুশোভিত করে দেন। আপনাকে সুপথপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত করে নিন এবং আপনার অভিববাককে অতি দ্রুত সুমতি দান করুন।
আমরা আশা করব, রবের সন্তুষ্টির জন্য আপনারা ফিতনার গলিপথ চিহ্নিত করে সেটা বন্ধ করে দিবেন। শয়তানের রাস্তা বন্ধ করে দিবেন। অবৈধ সম্পর্ক ও অবৈধ যোগাযোগ অটুট রাখা থেকে বিরত থেকে আমাদের পরামর্শ ও উপদেশগুলো মেনে চলবেন।
পাঁচ. এতদসত্ত্বেও যদি আপনারা আলোচ্য উপদেশ ও পরামর্শকে উপেক্ষা করে এবং প্রশ্নোক্ত নেক সূরতের অন্যায় লালসায় তাড়িত হয়ে কমপক্ষে দু’জন সাক্ষীর উপস্থিতিতে বিয়ে করেই ফেলেন, তাহলে যদিও শরিয়তের দৃষ্টিতে বিশেষ বিবেচনায় বিয়ে শুদ্ধ হয়ে যাবে। তবে এই অসামাজিক অকৃতজ্ঞতাপূর্ণ ঘৃনিত কাজের জন্য আপনাদের লজ্জিত হওয়া এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিৎ।
।فى الدر المختار- ( و ) شرط ( حضور ) شاهدين ( حرين ) أو حر وحرتين ( مكلفين سامعين قولهما معا ) (الدر المختار ، كتاب النكاح،-3/9)
অর্থাৎ, বিবাহ সহীহ হওয়ার শর্ত হল শরীয়তের মুকাল্লাফ [যাদের উপর শরীয়তের বিধান আরোপিত হয়] এমন দুইজন আযাদ পুরুষ সাক্ষি বা একজন আযাদ পুরুষ ও দুইজন মহিলা সাক্ষী হতে হবে, যারা প্রস্তাবনা ও কবুল বলার উভয় বক্তব্য স্বকর্ণে উপস্থিত থেকে শুনতে পায়। (আদ দুররুল মুখতার-৩/৯, ফাতওয়ায়ে হিন্দিয়া-১/২৬৮)
আরব বিশ্বের বর্তমান সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম শায়খ মুহাম্মাদ সালেহ আলমুনাজ্জিদ অভিবাবক ছাড়া মেয়েদের বিবাহের ক্ষেত্রে বলেছেন,
المسألة اجتهادية .. . .فإنه إذا كان أهل بلد يعتمدون المذهب الحنفي كبلادكم وبلاد الهند وباكستان وغيرها ، فيصححون النكاح بلا ولي ، ويتناكحون على هذا،فإنهم يقرّون على أنكحتهم ، ولا يطالبون بفسخها
অর্থাৎ, এটি একটি ইজতিহাদি মাসআলা..সুতরাং যে সব দেশের মানুষেরা হানাফী মাজহাবের উপর নির্ভর করে, ওলী (অভিবাবক) ছাড়া বিবাহবে বৈধ মনে করে এবং এভাবে তাদের বিয়ে হয় যেমন, ভারত, (বাংলাদেশ) পাকিস্তান ইত্যাদি, তাহলে তাদের বিবাহের স্বীকৃতি দেয়া হবে । বাতিল করতে বলা হবে না।
শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী