জিজ্ঞাসা–১২৫৫: আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি। স্বামী যৌন মিলনে অক্ষম (দ্রুত বীর্যপাত) হলে, স্ত্রী কী চাইলে স্বামী থেকে আলাদা থাকতে পারবে বা স্বামী মিলনের জন্য ডাক দিলে সাড়া না দিতে। ইসলামে ত আছে স্বামী ডাকলে স্ত্রী সাড়া না দিলে তার উপর সারারাত অভিশাপ আসে, তার সলাত কবুল হয় না। এখন এজন্য কী স্ত্রীর গুনাহ হচ্ছে?উল্লেখ্য স্বামীর এ ব্যাপারে কোন খেয়াল নেই। তিনি শুধু নিজে তৃপ্ত হতে পারলেই হলো। তালাক চাওয়া হইছে, কিন্তু তালাকও দিচ্ছে না। এখন দুইটা সন্তানও আছে। বিস্তারিত পরামর্শ দিয়ে উপকৃত করুন।জাজাকাল্লাহু খইর।–নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক।
জবাব: وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
এক. স্বামী স্ত্রীর চাহিদা পূরণ করাও সদাচারণের অন্তর্ভুক্ত। এটা স্ত্রী হিসেবে তার অধিকার। এই অধিকার পূরণ করা সক্ষম স্বামীর ওপর ওয়াজিব। কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ ‘আর তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে সদাচারণ কর, (সূরা নিসা ১৯)
আল মাউসুয়া’তুল ফিকহিয়্যা (৩০/১২৭)-তে এসেছে,
من حقّ الزّوجة على زوجها أن يقوم بإعفافها ، وذلك بأن يطأها ، وقد ذهب جمهور الفقهاء – الحنفيّة والمالكيّة والحنابلة – إلى أنّه يجب على الزّوج أن يطأ زوجته
‘স্বামীর ওপর স্ত্রীর অধিকারের মধ্যে অন্যতম হল, স্বামী স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গমের মাধ্যমে তার পবিত্র জীবন যাপনের প্রতি যত্নশীল হবে। হানাফি, মালেকি ও হাম্বলি মাযহাবের অধিকাংশ ফকিহর মতে স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হওয়া স্বামীর জন্য ওয়াজিব।’
সঙ্গম কত দিন পর হতে হবে–এব্যাপারে ফকিহগণের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া রহ. বলেন,
يجب على الرجل أن يطأ زوجته بالمعروف ، وهو من أوكد حقها عليه ، أعظم من إطعامها ، والوطء الواجب قيل : إنه واجب في كل أربعة أشهر مرة ، وقيل : بقدر حاجتها وقدرته ، كما يطعمها بقدر حاجتها وقدرته ، وهذا أصح القولين
‘স্ত্রীর সঙ্গে ভালোভাবে সঙ্গমে লিপ্ত হওয়া ওয়াজিব। এটা স্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ অধিকার এবং ভরণপোষণের অন্যতম অংশ। কেউ কেউ বলেছেন, চার মাসে একবার ওয়াজিব। কারো কারো মতে এক্ষেত্রে ভরণপোষণের অন্যান্য বিষয়ের মত স্ত্রীর প্রয়োজন ও স্বামীর সক্ষমতাই মূল বিবেচ্য বিষয়। আর এটাই বিশুদ্ধ মত।’ (মাজমুউল ফাতাওয়া ৩২/২৭১)
দুই. যদি কোনো স্বামী তার স্ত্রীর এই অধিকার আদায়ে অক্ষম হয় তার শারীরিক কিংবা মানসিক সমস্যার কারণে; এক্ষেত্রে উক্ত স্ত্রীর প্রতি আমাদের পরামর্শ হল এই যে,
১. তিনি একজন ইমানদার স্ত্রী হিসেবে নিজের স্বামীর এই পরিস্থিতিতে তার সঙ্গ দিবেন। তাকে যেকোনোভাবে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাবেন। স্বামীকে সুস্থ করে তোলার ব্যাপারে সচেষ্ট হবেন। তিনি যখন অসুস্থ; স্ত্রীকে তো একটু কষ্ট করতে হবে, ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
وَاعْلَمْ أَنَّ النَّصْرَ مَعَ الصَّبْرِ، وَأَنْ الْفَرَجَ مَعَ الْكَرْبِ، وَأَنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرً
আরো জেনে রাখো, ধৈর্য্য ধারণের ফলে (আল্লাহর) সাহায্য লাভ করা যায়। কষ্টের পর স্বাচ্ছন্দ আসে। কঠিন অবস্থার পর স্বচ্ছলতা আসে। (ইমাম নববই-কৃত আলআরবাঈন-১৯)
২. আর যদি তার এই অনীহার কারণ হয়, স্ত্রীর প্রতি আগ্রহ অনুভব না করা। তাহলে তার জন্য সাজসজ্জা করে, তার সঙ্গে ভালবাসাপূর্ণ নিত্যনতুন রোমান্টিক আচরণ করে স্ত্রী তাকে নিজের প্রতি আগ্রহী করে তোলার চেষ্টা করতে পারেন। হতে পারে, আল্লাহ তাআলা এর মাধ্যমে স্ত্রীকে সফল করবেন। যদি আল্লাহর রহমত সঙ্গী হয় তাহলে হতে পারে স্ত্রী স্বামীকে মানসিক শান্তি দিলে স্বামীও স্ত্রীকে মানসিক শান্তি দিবেন, শারীরিক সুখও দিবেন। স্বামীর সামনে সাজসজ্জা ও সৌন্দর্য প্রদর্শন শুধু বৈধই নয় বরং স্ত্রীর কর্তব্য। হাদিস শরিফে এসেছে,
مَا اسْتَفَادَ الْمُؤْمِنُ بَعْدَ تَقْوَى اللَّهِ خَيْرًا لَهُ مِنْ زَوْجَةٍ صَالِحَةٍ، إِنْ أَمَرَهَا أَطَاعَتْهُ، وَإِنْ نَظَرَ إِلَيْهَا سَرَّتْهُ، وَإِنْ أَقْسَمَ عَلَيْهَا أَبَرَّتْهُ، وَإِنْ غَابَ عَنْهَا نَصَحَتْهُ فِي نَفْسِهَا وَمَالِهِ
কোনো মুমিন ব্যক্তি আল্লাহ্ভীতির পর উত্তম যা লাভ করে তা হলো পুণ্যময়ী স্ত্রী। স্বামী তাকে কোন নির্দেশ দিলে সে তা পালন করে; সে তার দিকে তাকালে (তার বাহ্যিক সাজসজ্জা ও চরিত্রের মাধুর্যতা) তাকে আনন্দিত করে এবং সে তাকে শপথ করে কিছু বললে সে তা পূর্ণ করে। আর স্বামীর অনুপস্থিতিতে সে তার সম্ভ্রম ও সম্পদের হেফাযত করে। (সুনান ইবন মাজাহ ১৮৫৭)
৩. সর্বোপরি আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে হবে। সুতরাং স্ত্রী দোয়া ও নামাযের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবেন। বিশেষ করে তিনি কোরআনে বর্ণিত এ দোয়াটি করতে পারেন; ইনশা-আল্লাহ আল্লাহ তাকে সুখী করবেন,
رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا
হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের জীবনসঙ্গীর পক্ষ থেকে এবং আমাদের সন্তানের পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে চোখের শীতলতা দান দান করুন এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্যে আদর্শস্বরূপ দান করুন।’ (সূরা ফুরকান ৭৪)
৪. উক্ত স্ত্রী অধিকহারে ইস্তেগফার পড়বেন। কেননা রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
مَنْ لَزِمَ الاِسْتِغْفَارَ جَعَلَ اللَّهُ لَهُ مِنْ كُلِّ ضِيقٍ مَخْرَجًا وَمِنْ كُلِّ هَمٍّ فَرَجًا وَرَزَقَهُ مِنْ حَيْثُ لاَ يَحْتَسِب
৫. ওলামায়ে কেরাম লিখেছেন, আল্লাহ তাআলার গুণবাচক নামসমূহের মধ্যে (اَلْوَدُوْدُ) ‘আল-ওয়াদুদু’ ( অর্থ-প্রকৃত বন্ধু) একটি। এ পবিত্র নামের আমলে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে যায়।
৬. কোনো কোনো আলেম বলেন, শুক্রবার অর্ধরাত অতিবাহিত হবার পর অজু করে নিম্নোক্ত দুআটি তিনবার পড়লে স্বামীর ভালবাসা পুনরায় তৈরি হয়।
فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُلْ حَسْبِيَ اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَهُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ
৭. আবু সাঈদ রাযি.থেকে বর্ণিত, জিবরীল আ. রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে এসে বললেন, ইয়া মুহাম্মদ! আপনি কি অসুস্থতা বোধ করছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তিনি (জিবরীল) বললেন,
بِاسْمِ اللَّهِ أَرْقِيكَ مِنْ كُلِّ شَىْءٍ يُؤْذِيكَ مِنْ شَرِّ كُلِّ نَفْسٍ أَوْ عَيْنِ حَاسِدٍ اللَّهُ يَشْفِيكَ بِاسْمِ اللَّهِ أَرْقِيكَ
অর্থাৎ, আল্লাহর নামে আপনাকে ঝাড়-ফুঁক করছি, সে সব জিনিস থেকে, যা আপনাকে কষ্ট দেয়, সব প্রাণের অনিষ্ট কিংবা হিংসুকের বদ নজর থেকে আল্লাহ আপনাকে শিফা দিন; আল্লাহর নামে আপনাকে ঝাড়-ফুঁক করছি। (মুসলিম ৫৫১২)
সুতরাং দোয়াটি পড়ে স্বামীকেকে বার বার ফুঁ দিন। ইনশা-আল্লাহ, আল্লাহ তাআলা তাকে ধীরে ধীরে সুস্থ করে দিবেন।
তিন. আর যদি উক্ত স্ত্রী মনে করেন যে, তিনি যথেষ্ট সবর করেছেন। আর পারছেন না বা পারবেন না। কিংবা যদি তার নিজের স্বামীর ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরাশ হন তাহলে স্বামীর উচিত, উত্তম পদ্ধতিতে তালাকের মাধ্যমে স্ত্রীকে মুক্ত করে দেয়া। যদি তিনি তা না করেন তাহলে ইসলাম স্ত্রীকে এই অধিকার দিয়েছে যে, তিনি তার কাছে তালাকের দাবী করতে পারেন। তখন এ দাবী করাটা স্ত্রীর জন্য অন্যায় হবে না। আর তখন পারিবারিক বা সামাজিকভাবে চাপ সৃষ্টি করে তার কাছ থেকে তালাক নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। অথবা টাকার বিনিময়ে তথা খোলা করে তালাক সম্পন্ন করে নিতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِلَّا أَن يَخَافَا أَلَّا يُقِيمَا حُدُودَ اللَّهِ ۖ فَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا يُقِيمَا حُدُودَ اللَّهِ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا فِيمَا افْتَدَتْ بِهِ ۗ تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ فَلَا تَعْتَدُوهَا ۚ وَمَن يَتَعَدَّ حُدُودَ اللَّهِ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ
সুতরাং তোমরা যদি আশঙ্কা কর যে, তারা আল্লাহর সীমারেখা কায়েম রাখতে পারবে না তাহলে স্ত্রী যা দিয়ে নিজেকে মুক্ত করে নেবে তাতে কোন সমস্যা নেই। এটা আল্লাহর সীমারেখা। সুতরাং তোমরা তা লঙ্ঘন করো না। আর যে আল্লাহর সীমারেখাসমূহ লঙ্ঘন করে, বস্তুত তারাই জালিম। (সূরা বাকারা ২২৯)
আমরা দোয়া করি, আল্লাহ যেন তাদের জীবনকে সুন্দর করে দেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমতাবান।