জিজ্ঞাসা–৪৯০: আসসালামু ‘আলাইকুম। কোনো দম্পতির একজন হেদায়েতপ্রাপ্ত হয়ে দ্বীনের পথে চলার এবং দ্বীনের নির্দেশনা মেনে দাম্পত্য জীবন সাজাতে চাওয়ার কারণে যদি আরেকজনের সাথে আদর্শিক দ্বন্দ্ব শুরু হয় এবং সে কারণে মনোমালিন্য হতে থাকে, সমালোচনামূলক/কষ্টদায়ক কথা শুনতে হয়, তখন কি করণীয়? সবরের সাথে বোঝানোর চেষ্টা, আলোচনার চেষ্টা, সতর্ক করা, অনুপ্রেরণা দেয়ার পরও যদি ইতিবাচক লক্ষণ দেখা না যায় বরং দ্বীনবিমুখ মানসিকতা প্রকাশ পেতেই থাকে, এ অবস্থায় দ্বীন বাঁচানোর স্বার্থে আপোষে বিচ্ছেদ করাই উত্তম নাকি দাঁতে দাঁত চেপে দিন পার করে দেয়া উচিত? এতে দ্বীনের ওপর দৃঢ় থাকার প্রচেষ্টা কি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না যেহেতু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পারিক দুর্বলতা কিছু থেকেই যায়? উল্লেখ্য, উভয় পক্ষের পরিবারই দ্বীনি সচেতনতাবঞ্চিত। যার ফলে যে এখন দ্বীনের পথে চলতে চাচ্ছে, সে মোটামুটি প্রতিকূল অবস্থায় আছে সবমিলিয়ে।– মির্জা রাশেদ কায়সার।
জবাব: وعليكم السلام ورحمة الله
এক: প্রিয় দীনি ভাই, সুখে, দুঃখে সারাজীবন একে-অপরের সঙ্গী থাকা – সেকথা ভেবেই তো মানুষ বিয়ে করে। সুতরাং এখনই তালাকের কথা ভাববেন না। তালাকের অধিকার স্বামীর আছে বলেই কি তালাক দিয়ে দিবে! এমনও তো হতে পারে, সমস্যা স্বামীর মাঝেও আছে। স্বামীর অন্যতম গুণ হল, সহনশীল হওয়া। পরিবারের দায়িত্ব পালন করা। ‘কামচোর’ না হওয়া। এ গুণগুলো স্বামীর মাঝে আছে কিনা, একটু মিলিয়ে দেখুন। যদি না থাকে তাহলে আমরা বলব, সুখের সোনালী খাঁচা ভেঙ্গে ফেলার জন্য কেবল স্ত্রীর মূর্খতা ও আমলহীনতা দায়ী নয়; বরং স্বামীর দায়িত্বহীনতা, মারমুখিতা, অসহনশীলতাও সমান দায়ী।
অনুরুপভাবে অনেক সময় ‘কমিউনিকেশন গ্যাপ’ বা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বোঝাবুঝির অভাবও সমস্যার বড় ‘কারণ’ হয়। স্ত্রীর মাঝে ‘দীনি-সমঝ’ না আসার নেপথ্যে তার সাথে স্বামীর খারাপ আচরণ কিংবা তার প্রতি স্বামীর অবহেলা কিংবা অন্য কোন কারণও এখানে থাকতে পারে। তাই স্বামীর প্রথম কর্তব্য হচ্ছে, যদি তার মাঝে এ জাতীয় দোষ থাকে তাহলে সেগুলো শোধরে নেয়া। এটা কারো অজানা নয় যে, স্ত্রীর সাথে ভাল আচরণ, স্ত্রীকে গুরুত্ব দেয়া, স্ত্রীর কাজের প্রশংসা করা, সন্তানদের যত্ন নেয়া এবং স্ত্রীর প্রয়োজন পূরণ করা ইত্যাদি প্রত্যেকটি স্বামীর প্রতি স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করে। যদি স্বামী এভাবে তাকে ‘শান্তি’ দিতে পারে তাহলে -ইনশাআল্লাহ- সেও স্বামীকে ধীরে ধীরে শান্তি দিবে, সুখও দিবে। তখন স্বামী যা বলবে, স্ত্রী তা শুনবে। স্বামীর প্রতি এটাই আল্লাহর প্রথম নির্দেশ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَعَاشِرُوهُنَّ بِٱلۡمَعۡرُوفِۚ “তোমরা তাদের সাথে সদাচরণের সঙ্গে জীবন যাপন কর। (সূরা নিসা ১৯ )
মূলতঃ এভাবে স্ত্রীকে অনুগত বানানো স্বামীর জন্য সবচেয়ে সহজ। কারণ কোন নারী যখন কোন পুরুষকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে সন্তুষ্ট হয় তার পছন্দ ও অভিপ্রায় অনুযায়ী বসবাস করতেও সন্তুষ্ট থাকে। এটা সকল স্ত্রীর স্বাভাবিক মনোবৃত্তি। সুতরাং এ মনোবৃত্তিকে কাজে লাগিয়ে স্বামী বুদ্ধিমত্তার সাথে নিজ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে যদি স্ত্রীকে অনুগত করতে পারে তাহলে এটাই হবে তার আসল সফলতা। আর এটাই প্রকৃত সমাধান। তালাক দেয়া প্রকৃত সমাধান নয়।
দুই: প্রশ্নে যা এসেছে সে আলোকে বোঝা যাচ্ছে, স্ত্রীর পরিবারের মত স্বামীর পরিবারও দীনের ব্যপারে উদাসীন। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে কেবল স্ত্রী কিংবা তার পরিবার দায়ী নয়; বরং স্বামীর পরিবারও দায়ী। তাহলে এর দায়ভার হিসাবে স্ত্রীকে ‘তালাক’ দেয়া কি তার প্রতি অবিচার হবে না? সুতরাং স্বামীকে আবারও বলছি, তালাকের চিন্তা না করে দীনের দাওয়াতের চিন্তা করুন। দয়া, কোমলতা, বুদ্ধিমত্তা, সহিষ্ণুতা ও ধীরস্থিরতার সঙ্গে অগ্রসর হোন। রাগ-রোষ বর্জন করে মমতাপূর্ণ হৃদয়, দরদপূর্ণ ভাষা দিয়ে স্ত্রীকে, পরিবারকে শোধরানোর চেষ্টা করুন। দেখবেন, ইনশাআল্লাহ, পরিবারের সাথে সাথে স্ত্রীও ধীরে ধীরে দীনদার হয়ে ওঠবে। প্রবাদ আছে, الصحبة متأثرة সৎ সঙ্গে স্বর্গে বাস। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا মুমিনগণ, তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহন্নাম থেকে বাঁচাও। (সূরা তাহরিম ৬)
তিন: প্রিয় দীনি ভাই, প্রশ্নের আলোকে যদি আমরা ধরে নেই, ‘দীনের প্রতি স্ত্রীর চরম উদাসীনতা ও অবজ্ঞাই উভয়ের মধ্যস্থিত সমস্যা ও বিরোধগুলোর প্রধান কারণ। এখানে স্বামীর মোটেও দোষ নেই। চেষ্টা, সদাচারণ, ধৈর্যধারণসহ ইত্যকার সব দায়িত্ব পালনে স্বামীর কোন ত্রুটি ছিল না। এরপরেও ইতিবাচক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।’ তাহলেও আমরা পেছনের কথার পুনরাবৃত্তি করব এবং বলব, মনে হয় বাস্তবতা তা নয়। কারণ, প্রকৃত দীনদার ও চৌকস স্বামীর ব্যর্থতার দৃষ্টান্ত সমাজে বিরল। বরং স্বামীর পরশে স্ত্রীর জীবন বদলে যাওয়ার ঘটনাই আমরা সমাজে বেশি দেখতে পাই।
আর যদি আমাদের ধারণা ভুল হয়; আমরা এটাই চাই যে, আমাদের ধারণা ভুল না হোক এবং যদি প্রশ্নের কথাগুলো বাস্তব হয়, তাহলে এমতাবস্থায় তারা দুইজন স্বামী-স্ত্রী হিসেবে থাকা সময় নষ্ট করা এবং সমস্যা ও পাপ-পঙ্কিলতাকে বাড়ানো ছাড়া আর কিছু নয়।
প্রশ্নের আলোকে তখন আমরা বলব, যদি স্বামী দেখেন যে, স্ত্রী স্বামীর জন্য নিজেকে সংশোধন করতে প্রস্তুত নয় তাহলে তার সামনে তালাক ছাড়া আর কোন রাস্তা নেই। আর তখন এটাই হবে সর্বশেষ সমাধান! এই সমাধানে স্ত্রী সন্তুষ্ট থাকা শর্ত নয়। তালাক কার্যকর হওয়ার ক্ষেত্রে তার সন্তুষ্টি ধর্তব্য নয়।
আমরা সমস্যাগুলোর সর্বশেষ সমাধান হিসেবে তালাককে উল্লেখ করেছি নিম্নোক্ত কারণগুলোর প্রেক্ষিতে যে কারণগুলো আপনার প্রশ্নের মধ্যে এসেছে-
১. স্ত্রীর মাঝে দীনি চেতনাবোধ না থাকা। ২. স্বামীর অব্যাহত চেষ্টার পরেও সংশোধন করা সম্ভবপর না হওয়া। ৩. দীর্ঘকাল ধরে দুই জনের মাঝে বিরোধ চলমান থাকা।
সুতরাং স্বামীকে আমরা বলব, আপনি তাকে সর্বশেষ সুযোগ দিন এবং তার নিজেকে ও নিজের অবস্থাকে শোধরানোর জন্য একটি সময় নির্দিষ্ট করুন। যদি তার পক্ষ থেকে কোন পরিবর্তন না ঘটে তাহলে তালাক দিতে আপনি দ্বিধা করবেন না এবং হারামে লিপ্ত হওয়া থেকে সতর্ক থাকুন।
তালাক কিভাবে দিলে শরিয়া’হ-সম্মত হবে; তা একজন যোগ্য আলেমের সঙ্গে পরামর্শ করে নিন।
শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী
আরো পড়ুন– ☞ তিন তালাকের বিধান ☞ এক সঙ্গে তিন তালাক দিয়েছে–এখন কী করবে? ☞ বাবা-মায়ের কথায় স্ত্রীকে তালাক দেয়া যাবে কিনা? ☞ ব্যভিচার থেকে তাওবা এবং ব্যভিচারীর শাস্তি ☞ আমার স্বামী ভাল মানুষ; কিন্তু নামাজ পড়ে না; কী করব? ☞ বিয়ে করা না করার সিদ্ধান্তহীনতায় আছি; কী করব? ☞ ছোট ছোট বিষয়ে মা বদদোয়া দেন; কী করব? ☞ ঘুমের ঘোরে স্ত্রীকে ‘তুই তালাক’ বললে তালাক হয় কিনা? ☞ বাবা-মা ভণ্ড পীরের মুরিদ; সন্তানের করণীয় কি? ☞ গোপন বিয়ে বাবা-মা মেনে নিচ্ছেন না; কী করব?