জিজ্ঞাসা–১৬৩৮: চেয়ারে বসে নামাজ পড়া চলবে?–Sabbir
জবাব:
এক. প্রিয় প্রশ্নকারী দীনি ভাই, কোরআন-সুন্নাহয় নামাযের যে পদ্ধতি ফরয করা হয়েছে চেয়ারে বসে নামায আদায় করার ক্ষেত্রে সেই ফরয আদায় করা সম্ভবই নয়। কেননা, নামাযের মাঝে সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কিয়াম, কিরাত, রুকু, সিজদা এবং কা‘দা তথা বৈঠক। বলা বাহুল্য যে, চেয়ারে বসে নামায আদায় করলে কিয়াম ও রুকু-সিজদার ফরয এবং তাশাহহুদের জন্য জমিনে বসার হুকুম আদায় হয় না। সুতরাং এই বাস্তবতার প্রতি খেয়াল করলে চেয়ারে বসে নামায আদায় করার কথা কল্পনাও করা যায় না।
দুই. কিন্তু প্রশ্ন হল, মাযূর তথা অক্ষম ও অসুস্থ ব্যক্তি কী করবে?
সংক্ষেপে এর উত্তর হল, যেহেতু শরিয়তের মূলনীতি হল, যে কোনো অসুস্ততার কারণেই কেউ মাযূর (অক্ষম) সাব্যস্ত হয় না। অনুরূপভাবে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি হল, যতটুকু ওযর (অক্ষমতা) ততটুকু ছাড়। এমন নয় যে, নামাযে দাঁড়ানোর সক্ষমতা নেই বলে এখন রুকু-সিজদাও মাফ; রুকু-সিজদা করতে পারে না বিধায় এখন কা‘দা (তাশাহহুদের জন্য জমিনে বসা)-ও মাফ। সুতরাং অসুস্থ হলেই চেয়ারে বসে নামায জায়েয হয়ে যাবে না। বরং অসুস্থতার ধরণ হিসেবে এর হুকুমও ভিন্ন হয়ে থাকে। যথাক্রমে–
১. এমন অসুস্থতা, যা সত্ত্বেও চেয়ারে বসে পড়লে নামায শুদ্ধই হবে না।
২. এমন অসুস্থতা, যার কারণে নামাযের আংশিক চেয়ারে বসে আদায় করলে নামায ফাসেদ হবে না।
৩. এমন অসুস্থতা, যার কারণে পুরো নামায চেয়ারে বসে পড়া জায়েয।
হাদীস শরীফে এসেছে, ইমরান ইবনে হুসাইন রাযি. বলেন,
كَانَتْ بِي بَوَاسِيرُ، فَسَأَلْتُ النّبِيّ ﷺ عَنِ الصّلاَةِ، فَقَالَ: صَلِّ قَائِمًا، فَإِنْ لَمْ تَسْتَطِعْ فَقَاعِدًا، فَإِنْ لَمْ تَسْتَطِعْ فَعَلَى جَنْبٍ
আমার অর্শরোগ ছিল। তাই আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ -কে আমি কীভাবে নামায পড়ব; সে ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলাম। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, তুমি দাঁড়িয়ে নামায আদায় করবে। দাঁড়িয়ে পড়তে সক্ষম না হলে বসে বসে পড়বে। বসেও সক্ষম না হলে কাত হয়ে শুয়ে আদায় করবে। (সহীহ বুখারী ১১১৭)
এ হাদীস স্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছে যে, কিয়াম করতে অক্ষম হওয়ার আগ পর্যন্ত নামাযে কিয়াম করা ফরয; তা বাদ দেওয়া যাবে না। তেমনি কা‘দা (বৈঠক)। তা আদায়ে অক্ষম হওয়ার আগ পর্যন্ত তা আদায় করার ফরয বিধান বহাল থাকবে। নামাযের অন্যান্য ফরয-ওয়াজিব আমলগুলোও এমনি। যখন যেটি আদায়ে অক্ষম হবে কেবল সেটিই তখন ছাড়া যাবে। (আততামহীদ ১/১৩৫)
তিন. এর বিস্তারিত উত্তর হল,
যাদের জন্য চেয়ারে বসে নামায পড়া নাজায়েয:
১. যে ব্যক্তি শরীয়তের দৃষ্টিতে মাযূর নয়, অর্থাৎ কিয়াম, রুকু-সিজদা করতে সক্ষম, তার জন্য জমিনে বা চেয়ারে বসে নামায আদায় করাই জায়েয নয়।
২. শুধু আরামের জন্য অথবা মামুলি কষ্টের বাহানায় চেয়ারে বসে নামায পড়লে নামায আদায় হবে না।
৩. যার পায়ে বা কোমরে ব্যথা। দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক নিয়মে রুকু-সিজদা করে নামায পড়লে শরীরে ব্যথা লাগে। কিন্তু তার ব্যথা এ পরিমাণের নয় যে, তা অনেক বেশি। যা সহ্যের বাইরে; বরং এ ব্যথা নিয়ে সে কিয়াম ও রুকু-সিজদা করে নামায পড়তে পারে তবে তার জন্যও চেয়ারে বসে নামায পড়ার কোনো সুযোগ নেই। এমন করলে নামায আদায় হবে না।
৪. যে কিছুটা অসুস্থ। কিন্তু তার অসুস্থতা এ পর্যায়ের নয় যে, সে কিয়াম ও রুকু-সিজদা করে নামায পড়তে সক্ষমই নয়, বা এভাবে নামায পড়লে তার রোগ বেড়ে যাবে কিংবা রোগ নিরাময় হতে বিলম্ব হবে–এমনও নয়। এমন অল্প অসুস্থতার অজুহাতে চেয়ারে বসে নামায পড়লে নামায আদায় হবে না।
৫. যে ব্যক্তি নামাযে কিয়াম তথা দাঁড়াতে সক্ষম। জমিনে সিজদাও করতে পারে। কিন্তু পা ভাঁজ করে তাশাহহুদের সুরতে বসতে পারে না। তবে পা ছড়িয়ে বা চারজানু হয়ে বা এক পা বিছিয়ে আরেক পা উঠিয়ে কিংবা এক পায়ের পাতা বিছিয়ে আরেক পা বের করে অথবা উভয় পা বের করে বা অন্য যে কোনো পদ্ধতিতে জমিনে বসতে পারে এবং জমিনে সিজদাও করতে পারে তার জন্যও চেয়ারে বসে নামায পড়া জায়েয নয়। সে যেভাবে সম্ভব বসেই জমিনে সিজদা করে নামায আদায় করবে এবং কিয়াম ও রুকুও যথানিয়মে আদায় করবে। পুরোপুরি সুন্নত তরিকায় তাশাহহুদের সুরতে বসতে না পারার অজুহাতে তার জন্য চেয়ারে বসে নামায পড়ার কোনো সুযোগ নেই। এমন ব্যক্তি জমিনে সিজদা না করে চেয়ারে বসে ইশারায় সিজদা করলে তার নামায সহীহ হবে না।
৬. যে ব্যক্তি নামাযে কিয়াম তথা দাঁড়িয়ে নামায আদায় করতে সক্ষম নয়, কিন্তু জমিনে বা সমতলে কোনো না কোনো পদ্ধতিতে বসতে পারে এবং জমিনে সিজদাও করতে পারে, তবে চেয়ারে বসে নামায শুরু করলে সিজদা ও কা‘দা (বৈঠক)-এর জন্য জমিনে নামতে সক্ষম নয় তার জন্যও চেয়ারে বসে নামায পড়া জায়েয নয়। এমন ব্যক্তি যেহেতু সমতলে বসে সিজদার ফরয আদায় করতে সক্ষম তাই শুরু থেকেই সে জমিনে বা সমতলে বসে যথানিয়মে সিজদা করে নামায আদায় করবে; নতুবা তার নামায আদায় হবে না।
৭. যে ব্যক্তি নামাযে কিয়াম তথা দাঁড়িয়ে নামায পড়তে সক্ষম, আবার জমিনে বা সমতলে বসতেও পারে এবং জমিনে সিজদাও করতে পারে, কিন্তু নামাযে দাঁড়ানো অবস্থা থেকে বসতে পারে না, তেমনি বসলে আবার দাঁড়াতে পারে না তার জন্যও চেয়ারে বসে পড়া জায়েয নয়। বরং সে পুরো নামায নিচে বসে আদায় করবে, যাতে যথানিয়মে জমিনে সিজদা করতে পারে; নতুবা তার নামায সহীহ হবে না।
নামাযের আংশিক চেয়ারে বসে আদায় করলে যাদের নামায ফাসেদ হবে না:
১. যে ব্যক্তি নামাযে কিয়াম তথা দাঁড়িয়ে নামায পড়তে সক্ষম নয়, কিন্তু জমিনে বা সমতলে কোনো না কোনোভাবে বসতে পারে এবং জমিনে সিজদাও করতে পারে। তার জন্য সিজদা ও কা‘দা (বৈঠক) জমিনে বসে যথানিয়মে আদায় করা জরুরি। এমন ব্যক্তি যদি সিজদার সময় চেয়ারে বসে ইশারায় সিজদা আদায় করে তবে তার নামায সহীহ হবে না; বরং এক্ষেত্রে সে পুরো নামাযই জমিনে বসে আদায় করবে। আর সে যদি এক্ষেত্রে সিজদা ও কা‘দা (বৈঠক) জমিনে বসে যথানিয়মে আদায় করে কিন্তু কিয়াম ও রুকুর সময় চেয়ারে বসে তবে তার নামায ফাসেদ না হলেও জমিনে বসে আদায় করতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও চেয়ারে বসার কারণে তার নামায মাকরূহ হবে।
আর এমন ব্যক্তি চেয়ারে বসে নামায শুরু করলে সিজদা ও কা‘দা (বৈঠক)-এর জন্য জমিনে নামতে না পারলে তার জন্য কিয়ামের সময় চেয়ারে বসাই নাজায়েয। বরং শুরু থেকেই তার জমিনে বসে নামায পড়া জরুরি; যা একটু আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।
২. যে ব্যক্তি কিয়াম করতে সক্ষম এবং দাঁড়ানো থেকে চেয়ারে বসতেও পারে, কিন্তু জমিনে কোনো পদ্ধতিতেই বসতে পারে না; এমন ব্যক্তির জন্য বিধান হল, সে যথা নিয়মে দাঁড়িয়ে নামায শুরু করবে। এরপর স্বাভাবিকভাবে রুকু করতে পারলে রুকুও করবে। তারপর অবশিষ্ট নামায চেয়ারে বসে পড়বে। কিন্তু এক্ষেত্রে কিয়াম করতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও তার জন্য শুরু থেকেই চেয়ারে বসে নামায পড়া সহীহ নয়।
৩. যে ব্যক্তি কিয়াম ও রুকু করতে সক্ষম এবং সরাসরি জমিনে বা সমতলে কোনো না কোনোভাবে বসতেও পারে, কিন্তু জমিনে সিজদা করতে পারে না, সে তো কিয়াম ও রুকু যথানিয়মেই আদায় করবে। এরপর জমিনে বসে যাবে। ইশারায় সিজদা আদায় করবে এবং তাশাহহুদ জমিনে বসেই আদায় করবে। এমন ব্যক্তি যেহেতু মাটিতে বা সমতলে বসতে পারে তাই তার জন্য জমিনে কা‘দা-এর পরীবর্তে চেয়ারে বসা মাকরূহ তাহরীমী। যা পরিহার করা কর্তব্য।
৪. যে ব্যক্তি নামাযে কিয়াম তথা দাঁড়াতে সক্ষম নয়, কিন্তু জমিনে বা সমতলে কোনো না কোনোভাবে বসতে পারে এবং জমিনে সিজদাও করতে পারে। সে যদি চেয়ারে বসে নামায আদায় করে এবং সিজদার জন্য চেয়ার থেকে নেমে মাটিতে সিজদা আদায় করে তবে এক্ষেত্রে তার সিজদা যথানিয়মে আদায় হলেও কা‘দা অর্থাৎ বৈঠক চেয়ারে আদায় করার কারণে নামায মাকরূহ তাহরীমী হবে; যা পরিহার করা কর্তব্য।
পুরো নামায যার জন্য চেয়ারে বসে পড়া জায়েয:
যে ব্যক্তি নামাযের কিয়াম, রুকু-সিজদা ও কা‘দা (তাশাহহুদের জন্য বসা) কোনোটিই স্বাভাবিকভাবে আদায় করতে সক্ষম নয়; বরং শুধু চেয়ারেই বসতে পারে কেবল এমন অসুস্থ ব্যক্তির জন্য পুরো নামায চেয়ারে বসে আদায় করা জায়েয।
কিন্তু এক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, এই ব্যক্তি যে কিয়াম, রুকু-সিজদা ও কা‘দা (বৈঠক) সবগুলোই যথানিয়মে স্বাভাবিকভাবে আদায় করতে সক্ষম নয় তা বাস্তবসম্মত ও সুপ্রমাণিত হতে হবে। এর জন্য ডাক্তারের পরামর্শের পাশাপাশি কোনো মুফতী সাহেবকে নিজের অবস্থা পুরোপুরি জানিয়ে তার থেকে মাসআলা নিয়ে সে অনুযায়ী আমল করবে। নতুবা নিজে নিজে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণে কখনো নামায নাও হতে পারে।
মোদ্দাকথা এই যে, যে ব্যক্তি দাঁড়িয়ে নামায আদায় করতে অক্ষম তার জন্য বিকল্প পদ্ধতি হল, যমিনে বসে তা আদায় করা। আর যে রুকু-সিজদা করতে অক্ষম তার জন্য বিকল্প পন্থা হল, ইশারায় রুকু-সিজদা আদায় করা। আর যে ব্যক্তি যমিনে বসতে অক্ষম তার জন্য যমিনে বসে কা‘দা আদায়ের বিকল্প হল চেয়ারে বসা। কেবল প্রথম ও দ্বিতীয় ওযরের কারণে চেয়ারে বসা জায়েয নয়।
উল্লেখ্য, যে ব্যক্তি যমিনে সিজদা করতে অক্ষম তার ব্যপারে হুকুম হল, সে ইশারায় সিজদা আদায় করবে। এমন মাযূর ব্যক্তি যদি বাস্তব ওযরেই চেয়ারে বসে নামায আদায় করে তাহলে সেও ইশারায়ই সিজদা করবে। সামনে তখতা বা টেবিল রেখে তাতে সিজদা করবে না। কেননা সিজদার জন্য সামনে টেবিল বা উঁচু বস্তু রাখা এবং তাতে সিজদা করার কোনো বিধান হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। অবশ্য এর দ্বারা যেহেতু ইশারার কাজ হয়ে যায় ফলে নামায আদায় হয়ে যাবে। উল্লেখ্য, ইশারায় সিজদা আদায় করার নিয়ম হল, রুকুর জন্য মাথা যতটুকু ঝোঁকাবে সিজদার জন্য তার চেয়ে একটু বেশি ঝোঁকানো।