দাম্পত্য সম্পর্ক খারাপ চলছে; স্ত্রীর প্রতি কিছু পরামর্শ

জিজ্ঞাসা–১৭৩৩: আমি ঠিকভাবে বুঝতেছিনা যে কেমন প্রশ্ন এখানে গ্রহণযোগ্য। আমার জীবনে একটা খুব বড় কষ্ট লেগে আছে। সেটি নিয়েই তাই প্রশ্ন করতে চাই! আমার স্বামী মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের। এখন সে ভার্সিটিতে পড়ে। নন মারহাম নিয়ে তার সেল্ফ কনট্রোল নেই। নামাজ পড়লেও বাজে কথা, বাজে সঙ্গ কিছুই এড়ায় না। আমি শুধরে দিতে গেলে তার বিরক্তি আসে। যত্ন দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি তবুও মানে না। বরং ওসব শুনলে রেগে যায়। আমাদের সম্পর্ক করে বিয়ে হয়েছে। জানিনা, তার ফল কিনা! সে ভালবাসে আমায়। কিন্তু খুব ছোটখাট বিষয়ে আমাকে খুব ঝাড়ে। কলিজা ভেদ করে যায় এমন কথা বলে। একটু ঝগড়া হলেই আমার আর খোঁজ নেয় না। বন্ধুদের সাথে সময় কাটায়। আমরা পড়াশোনার সুবাদে আলাদা জায়গায় থাকি। বিয়ের বয়স ১ বছর এবং লুকিয়ে বিয়ে।। তার জন্য দু’আ করে যাচ্ছি, কিন্তু তার পরিবর্তন নাই। জীবনটা খুব যাতনাময় লাগছে। একজন দ্বীনদার জীবনসঙ্গীর জীবনে খুব অভাববোধ করছি। কিভাবে আমি আমার স্বামীকে পরিপূর্ণ দ্বীনে ফেরাতে পারি? কী কী উপায়ে তার থেকে একটুকরা ভালবাসার জান্নাত শুধু পেতে পারি। বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছি একেবারে। শান্তির শ্বাস আর আমার আকাশজুড়ে নাই। তার প্রত্যেকটা কাজে যখন ফেতনা,নাজায়েজ, গায়ের মাহরামের সাথে মেলামেশার অগ্রাহ্যতা দেখি বুকটা চিরে মনে হয় রক্তক্ষরণ হয়। যদি পারেন আমার স্বামীকে দ্বীনদার করার আমল শিখিয়ে দিন। আল্লাহর হেদায়েতের চাদরে তাকে আবৃত করতে একজন স্ত্রী হয়ে কিভাবে ফেরাবো তাকে? আল্লাহর নামে এখনও প্রতিদিন সিজদাহ দিচ্ছে। অন্তত, আল্লাহর ভয় তো তার মধ্যে আছে। আল্লাহ আমার চেষ্টাকে যেন বিফল হতে না দেন তাই এরকম উপায় আমায় শিখিয়ে দিন। যেন আজীবন আমরা দ্বীনের পথে একসাথে হাঁটতে পারি! তাকে ভালবাসি আল্লাহর জন্য! খুব ভালবাসি!–নাম প্রকাশ করা হয় নি।

জবাব:

এক. প্রিয় বোন, ভালোবেসে হোক আর পারিবারিকভাবেই হোক একটি মেয়ের জীবনের পথচলার সঙ্গী হয়ে থাকে তার স্বামী। আর সে স্বামী ধীরে ধীরে আপনার চোখের সামনে দূরে হারিয়ে যাচ্ছে দেখে নিশ্চয় আপনি এক অব্যক্ত বেদনা দ্বারা প্রতিনিয়ত পিষ্ট হচ্ছেন। এজন্য প্রথমেই আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেন আপনার বেদনা মুছে দেন এবং আপনার ভালোবাসার মানুষটিকে যেন আপনার প্রতি পরিপূর্ণ আগ্রহী ও মনোযোগী করে দেন। আর আমরা আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে, স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক এই অনাবিল ভালোবাসা কিন্তু আল্লাহর সৃষ্টি; বান্দা/বান্দীর প্রতি তাঁর বিশেষ নেয়ামত। আল্লাহ বলেন,

وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُم مَّوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ

আর তাঁর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সংগিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে। (সূরা রুম ২১)

সুতরাং আপনার প্রতি আমাদের প্রধান উপদেশ এটাই যে, আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক আরো দৃঢ় করুন। কেননা, একমাত্র তিনিই পারবেন আপনার কষ্ট দূর করতে; আপনার পেরেশানিকে শান্তি দ্বারা ভরপুর করে দিতে।

দুই. পাশাপাশি আপনার প্রতি আমাদের আরো পরামর্শ হল–

১. আপনার স্বামীর জন্য একজন উপদেশদাতার প্রয়োজন। সুতরাং যদি সম্ভব হয়, আপনার পরিচিত কারো মাধ্যমে আপনার স্বামীকে একজন আমলধারী আলেমের শরণাপন্ন করান; যিনি আপনার স্বামীকে হেকমত ও প্রজ্ঞার সঙ্গে কিছু নসিহত করবেন। হতে পারে, এর মাধ্যমে তিনি নিজের ভুল বুঝতে সক্ষম হবেন।

২. আপনার স্বামী নিশ্চয় একটা ফেতনার ভেতরে পড়ে গিয়েছে। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

مَا تَرَكْتُ بَعْدِي فِتْنَةً أَضَرَّ عَلَى الرِّجَالِ مِنْ النِّسَاءِ

পুরুষের জন্য স্ত্রীজাতি অপেক্ষা অধিক ক্ষতিকর কোন ফিতনা আমি রেখে গেলাম না। (বুখারি ৪৮০৮)

আর আপনি যেহেতু তার সবচেয়ে কাছের কল্যাণকামী, সেহেতু এই ফেতনা থেকে উত্তরণের জন্য তার জন্য আল্লাহর কাছে অধিকহারে দোয়া করুন। কোরআনে বর্ণিত এ দোয়াটিও করতে পারেন; ইনশা-আল্লাহ আল্লাহ আপনার স্বামীকে আপনার চোখের শীতলতা বানিয়ে দিবেন।

رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا

হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের জীবনসঙ্গীর পক্ষ থেকে এবং আমাদের সন্তানের পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে চোখের শীতলতা দান দান করুন এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্যে আদর্শস্বরূপ দান করুন। (সূরা ফুরকান ৭৪)

৩. একটু ভেবে দেখুন তো, আপনার প্রতি আপনার স্বামী কর্তৃক স্থাপিত মুসিবতের পেছনে আপনিও কিছুটা দায়ী কিনা? কেননা, বিজ্ঞজনরা বলে থাকেন, যে স্ত্রীর যবান চলে বেশি, তার স্বামীর হাত চলে বেশি। যদি এমনটি হয় তাহলে যবান সংযত করার ব্যাপারে সর্বোচ্চ সচেষ্ট হোন। স্বামীর রাগ ওঠে এমন কথা ও কাজ যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন।

৪. অনেক সময় পুরুষ তার চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। সুতরাং তিনি বিশেষ কাজে আহবান করলে আপনার সম্মতি যেন থাকে। প্রয়োজনে কৃত্রিমভাবে হলেও আপনি এবিষয়ে আগ্রহ বেশি দেখাবেন। দেখবেন, এটাও তার রাগ প্রশমনে খুব দ্রুত কাজ করবে।

৫. আপনি অবশ্যই মুসিবতে আছেন। কিন্তু আপনার চাইতেও বেশি মুসিবতে আছে, এ দুনিয়ায় এমন স্ত্রীও আছে। এমন নরপশুও তো আছে, যে স্ত্রীর সঙ্গে কেবল খারাপ আচরণ করে না; বরং যৌতুকের দাবি নিয়ে স্ত্রীর পরিবারের জীবনকেও বিষিয়ে তোলে। মাতাল হয়ে এসে স্ত্রীর হাত পা ভেঙ্গে দেয়। এদের কথা ভাবুন, আপনার দুঃখ কিছুটা হলেও হালকা হবে। রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

عَجَبًا لِأَمْرِ الْمُؤْمِنِ إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ وَلَيْسَ ذَاكَ لِأَحَدٍ إِلَّا لِلْمُؤْمِنِ : إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ ، فَكَانَ خَيْرًا لَهُ ، وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ ، فَكَانَ خَيْرًا لَهُ

মুমিনের অবস্থা ভারি অদ্ভুত। তাঁর সমস্ত কাজই তাঁর জন্য কল্যাণকর। মুমিন ব্যাতিত অন্য কারো জন্য এ কল্যাণ লাভের ব্যাবস্থা নেই। তাঁরা আনন্দ (সুখ শান্তি) লাভ করলে শুকরিয়া জ্ঞাপন করে, তা তাঁর জন্য কল্যাণকর হয়, আর দুঃখকষ্টে আক্রান্ত হলে ধৈর্যধারণ করে, এও তাঁর জন্য কল্যাণকর হয়। (মুসলিম ৭২২৯)

৬. আপনার স্বামী যতই খারাপ হোক না কেন; নিশ্চয় তার মাঝে কিছু ভালো গুণও আছে। যেমন, আপনি বলেছেন যে, তিনি নামাযী। কিংবা অন্য কোনো গুণও তার মাঝে থাকতে পারে। সেগুলো দেখুন এবং সেগুলোর প্রশংসা করুন। প্রশংসা করার সময় নিজেকে বিশেষভাবে পরিপাটি রাখুন। এতে কিছুটা হলেও ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হওয়া ভালোবাসা পুনরজ্জীবিত হবে-ইন শা আল্লাহ।

৭. ওলামায়ে কেরাম লিখেছেন, আল্লাহ তাআলার গুণবাচক নামসমূহের মধ্যে (اَلْوَدُوْدُ) ‘আল-ওয়াদুদু’ ( অর্থ-প্রকৃত বন্ধু) একটি। এ পবিত্র নামের আমলে স্বামী-স্ত্রী অমিল ও দূরত্ব কমে যায়। সুতরাং অধিকহারে পড়ুন- ‘ইয়া ওয়াদুদু’।

৮. কোনো কোনো আলেম বলেন, শুক্রবার অর্ধরাত অতিবাহিত হবার পর অজু করে নিম্নোক্ত দুআটি তিনবার পড়লে স্বামীর ভালবাসা পুনরায় তৈরি হবে–

فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُلْ حَسْبِيَ اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَهُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ

প্রিয় বোন, যদি আপনি উক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে পারেন এবং পাশাপাশি আল্লাহর কাছেও দোয়াও অব্যাহত রাখেন তাহলে আমরা আশা করছি যে, তখন আল্লাহর রহমত আসবে। ফলে আপনার স্বামীর মনুষ্যত্ব জেগে উঠবে এবং তিনি আপনার প্রতি সদয় হবেন। তবে অনেক সময় দেখা যায়, দাম্পত্যজীবনের সমস্যাগুলো খুব দ্রুত সমাধানে আসে না। বরং ছেলে-মেয়ে বড় হতে হতে সমস্যা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে। সুতরাং আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন। বেশি হারে ইস্তেগফার পড়ুন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

مَنْ لَزِمَ الاِسْتِغْفَارَ جَعَلَ اللَّهُ لَهُ مِنْ كُلِّ ضِيقٍ مَخْرَجًا وَمِنْ كُلِّ هَمٍّ فَرَجًا وَرَزَقَهُ مِنْ حَيْثُ لاَ يَحْتَسِب

যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার করবে আল্লাহ তার সব সংকট থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন, সব দুঃশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের সংস্থান করে দেবেন। (আবূদাউদ ১৫২০)

পরিশেষে আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি, তিনি যেন আপনাদেরকে সুখময় দাম্পত্যজীবন দান করেন।

والله اعلم بالصواب