জিজ্ঞাসা–৩৬৫: আসালামুয়ালাইকুম ,আমার আম্মুর খুব বেশী রাগ ,খুব ছোট ব্যাপারে আমাকে বদ দুআ করে ,এখন আমি কি করবো? মসজিদ এ বেশি সময় থাকলে রাগ করে এখন আমি আম্মাকে কিভাবে বুঝাবো? আমার আম্মার জন্য দুআ করার অনুরোধ রইলো।–ফুয়াদ হাসান।
জবাব: وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
প্রশ্নকারী ভাই, মায়ের সাথে সদ্ব্যবহার করা, মায়ের আনুগত্য করা ওয়াজিব। ইসলাম জানিয়েছে, মায়ের পদতলে জান্নাত। মায়ের অবাধ্য হওয়া, মাকে রাগান্বিত করা— হারাম; এমনকি সেটা যদি শুধু উফ্ উফ্ শব্দ উচ্চারণ করার মাধ্যমে হয় তবুও। কোরআন-হাদিসের অসংখ্য স্থানে এ বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, আল্লাহর বাণী:
وَقَضَى رَبُّكَ أَلا تَعْبُدُوا إِلا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلاهُمَا فَلا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلا كَرِيمًا وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا
“তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে `উফ্’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং তাদের সাথে সম্মানসূচক কথা বল। আর মমতাবশে তাদের প্রতি নম্রতার পক্ষপুট অবনমিত কর এবং বল ‘হে আমার রব! তাঁদের প্রতি দয়া করুন যেভাবে শৈশবে তাঁরা আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন’।” (সূরা বনী ইসরাইল: ২৩-২৪)
এ ছাড়াও রয়েছে আরও অনেক দলিল ; এ পরিসরে সবগুলো উল্লেখ করা সম্ভব নয়। শুধু এটা মনে রাখবে, পিতামাতার সেবা ও সদ্ব্যবহারের জন্য তাঁদের মুসলমানও হওয়া জরুরী নয়। মহান আল্লাহ বলেন,
وَإِن جَاهَدَاكَ عَلى أَن تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا
‘‘পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়কে শরীক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে সহঅবস্থান করবে।” (সূরা লুকমান :১৫)
সুতরাং আলোচ্য ক্ষেত্রে তুমি যা করবে তাহল–
এক- মায়ের সঙ্গে অসদাচারণ না করে ধৈর্য ধারণ করবে। বেশি বেশি করে আল্লাহর কাছে দোয়া করবে, যেন তোমার মায়ের মন-মানসিকতার পরিবর্তন হয়।
দুই- মা যদি অন্যায় আদেশ করেন (যেমন, গুনাহর আদেশ করেন কিংবা ফরজ-ওয়াজিব ও সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ ইবাদতে বাঁধা দেন) এবং এর জন্য অন্যায়ভাবে রাগ করেন তাহলে হেকমতের সঙ্গে তাঁর অন্যায় আদেশ এড়িয়ে চলবে এবং তাঁকে সাথে সাথে নয়; বরং পরবর্তীতে মমতার সঙ্গে ইসলামের এই মূলনীতি বুঝিয়ে বলবে যে, ইসলামের শিক্ষা হল, لا طاعة لمخلوق في معصية الخالق অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি অবাধ্যতা যেখানে আসবে, সেখানে সৃষ্টির আনুগত্য করা যাবে না। কেননা, সৃষ্টির আনুগত্যের সীমারেখা বর্ণনা করতে গিয়ে রাসূল ﷺ বলেন, فَإِنْ أُمِرَ بِمَعْصِيَةٍ، فَلَا سَمْعَ وَلَا طَاعَةَ অর্থাৎ অসৎকাজে আনুগত্য নয় ;আনুগত্য কেবলমাত্র সৎকাজের ক্ষেত্রেই হতে হবে’’। (সহীহ বুখারী ৭১৪৫)
তিন- তুমি বলেছ, ‘মসজিদে বেশি সময় থাকলে তোমার মা রাগ করে’–এবিষয়ে আমার পরামর্শ হল, তুমি ফরজ ওয়াজিব ও সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহর ইবাদত ছাড়া নফল ইবাদত কিংবা ওয়াজ নসিহত শোনার জন্য মসজিদে বেশিক্ষণ অবস্থান করবে না। কেননা, তোমার নফল ইবাদতের চাইতে তোমার মায়ের বদদোয়া থেকে বেঁচে থাকা তোমার জন্য বেশি জরুরি। দেখ, এক দীর্ঘ হাদিসে এসেছে, মুয়াবিয়া আস-সুলামি রাযি. রাসূলুল্লাহ্ ﷺ-এর কাছে তিন বার অনুমতি প্রার্থনা করেছিলেন রাসূলুল্লাহ্ ﷺ-এর সঙ্গে জিহাদে শরিক হওয়ার জন্য। রাসূলুল্লাহ্ ﷺ প্রতিবারই জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোমার মা কি জীবিত?’ তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘হ্যাঁ’। তখন রাসূলুল্লাহ্ ﷺ প্রতিবারই তাঁকে বলেছিলেন, فَارْجِعْ إِلَيْهَا فَبَرَّهَا ‘ফিরে গিয়ে মায়ের সেবা কর’। অবশেষে তিনি তাঁকে বলেছিলেন, وَيْحَكَ الْزَمْ رِجْلَهَا فَثَمَّ الْجَنَّةُ ‘তোমার জন্য আফসোস! তুমি তার পায়ের কাছে পড়ে থাক। সেখানেই জান্নাত রয়েছে’। (ইবন মাজাহ ২৭৮১)
চার- ছোট্ট বিষয়েও তোমার প্রতি তোমার মায়ের রাগ করা ও বদদোয়া দেয়ার অন্যতম কারণ হল, দীন সম্পর্কে অজ্ঞতা ও দীনের প্রতি মহব্বতের ঘাটতি। এজন্য তুমি মমতাপূর্ণ নসিহতের মাধ্যমে অব্যাহত চেষ্টা ও দোয়া চালিয়ে যাও, দেখবে, একদিন তুমি সফল হবে এবং তাঁর এই অপূর্ণতা দূরীভূত হবে। তখন তিনি তোমার দীন পালনে বাঁধা দেয়া তো দূরের কথা; বরং সহায়ক ও অভিবাবক হবেন। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে তুমি কোন হক্কানি আলেমের ওয়াজ বা লেখনী তাঁকে শোনাতে পার। ইনশা-আল্লাহ এর সুফল তুমি অবশ্যই পাবে।
পাঁচ- আমাদের নবীজী ﷺ তো বলেছেন, আপন সন্তান তো দূরের কথা; এমন কি জীবজন্তু ও জড়পদার্থকেও বদদোয়া দেয়া যাবে না। তিনি বলেন,
ﻻَ ﺗَﺪْﻋُﻮﺍ ﻋَﻠَﻰ ﺃَﻧْﻔُﺴِﻜُﻢْ ﻭَﻻَ ﺗَﺪْﻋُﻮﺍ ﻋَﻠَﻰ ﺃَﻭْﻻَﺩِﻛُﻢْ ﻭَﻻَ ﺗَﺪْﻋُﻮﺍ ﻋَﻠَﻰ ﺃَﻣْﻮَﺍﻟِﻜُﻢْ ﻻَ ﺗُﻮَﺍﻓِﻘُﻮﺍ ﻣِﻦَ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺳَﺎﻋَﺔً ﻳُﺴْﺄَﻝُ ﻓِﻴﻬَﺎ ﻋَﻄَﺎﺀٌ ﻓَﻴَﺴْﺘَﺠِﻴﺐُ ﻟَﻜُﻢْ
”তোমরা নিজেদের বিরুদ্ধে, তোমাদের সন্তান-সন্তুতির এবং তোমাদের সম্পদের বিরুদ্ধে বদদোয়া করো না। কেননা, তোমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন মুহূর্তের জ্ঞানপ্রাপ্ত নও, যখন যা কিছুই চাওয়া হয় তিনি তোমাদের তা দিয়ে দেবেন।’’ (মুসলিম ৭৭০৫)
হাদীসটির ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী কারী রহ. বলেন, অর্থাৎ তোমরা কোনো মুহূর্তেই নিজের বিরুদ্ধে, নিজের সন্তান বা সম্পদের বিরুদ্ধে বদদোয়া করো না। কারণ, হতে পারে যে সময় তুমি দোয়া করছো, তা দিনের মধ্যে ওই সময় যখন যা-ই দোয়া করা হোক না কেন তা কবুল করা হয়। তোমরা তো এ সময় সম্পর্কে আল্লাহর পক্ষ থেকে জ্ঞানপ্রাপ্ত নও। (মিরআতুল মাফাতীহ ৭/৭০৩)
সুতরাং তোমার মাকে এভাবেও বুঝাতে পার যে, ‘মা! নিজের সন্তানের বিরুদ্ধে বদদোয়া করার অর্থ তো নিজেই নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া। কেননা, আপনার রাগের মাথায় উচ্চারণ করা কথাগুলো যদি সত্যে পরিণত তাহলে কেমন লাগবে? আপনি কি আপনার সন্তানের কষ্ট সহ্য করত পারবেন?’
পরিশেষে, আমার এ লেখাটি তোমার মাকে পড়ে শোনানোর অনুরোধ রইল। এতে তিনি সন্তানের মনোবেদনা কিছুটা হলেও অনধাবন করবেন বলে আশা করা যায়।
তোমার মত প্রত্যেক মায়ের সন্তানের জন্য, বিশেষতঃ তোমার জন্য দোয়া করি, আল্লাহ তোমাকে আদর্শ সন্তান এবং প্রত্যেক মাকে বিশেষতঃ তোমার মাকে আদর্শ মা হিসেবে কবুল করুন। আমীন।