শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী
الحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله وبعد:
সবচেয়ে দামী আমল: গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. বলতেন,
لَا أَعْدِلُ بِالسَّلَامَةِ شَيْئًا
গুনাহ থেকে নিরাপদ থাকার মত সমকক্ষ আমল আমি কোনোটিকে মনে করি না। (আদাবুদদুনয়া ওয়াদদীন ১/৯৮)
হাসান বসরী রহ. বলতেন,
مَا عَبَدَ الْعَابِدُونَ بِشَيْءٍ أَفْضَلَ مِنْ تَرْكِ مَا نَهَاهُمُ اللَّهُ عَنْه
আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয়গুলো থেকে বেঁচে থাকার চাইতে উত্তম কোন ইবাদত আর কোনো ইবাদতকারী করতে পারি নি। (জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম ২৯৬)
গুনাহ ত্যাগ করা ছাড়া আল্লাহর ওলি হওয়া যায় না
একারণেই সালাফগণ বলেছেন,
لايُوصِل إلى ولا يَةِ الله إلا بترك الْهَوَى
আল্লাহর ওলি হতে হলে গুনাহ ছাড়তেই হবে। এছাড়া বিকল্প নেই।
হাদিসে এসেছে, নবীজী ﷺ বলেন,
اتَّقِ المَحَارِمَ تَكُنْ أَعْبَدَ النَّاسِ
গুনাহ থেকে বেঁচে থাক সবচেয়ে বড় আল্লাহ্র অলি হতে পারবে। (তিরমযী ২৩০৫)
অপর হাদিসে এসেছে, আয়েশা রাযি. একদিন নবীজি ﷺ-কে বললেন, অনেকে রাত জেগে ইবাদত করে। আমরা মহিলারা একটু অলসপ্রকৃতির। রাত জেগে ইবাদত করতে পারি না। শুধু ঘুম আসে। পুরুষের তুলনায় মহিলাদের ঘুম বেশি। তো আমাদের শুধু ঘুম আসে। ফলে যারা রাত জেগে ইবাদত করে তাদের থেকে তো পিছনে পড়ে গেলাম। তখন আয়েশা রাযি.-কে নবীজী সান্ত্বনা ﷺ দিয়ে বললেন,
مَنْ سَرَّهُ أَنْ يَسْبِقَ الدَّائِبَ الْمُجْتَهِدَ فَلْيَكُفَّ عَنِ الذُّنُوبِ
যে ব্যক্তি খুব ইবাদতকারীর চাইতেও অগ্রসর হয়ে আনন্দ পেতে চায় তার জন্য উচিত হল, গুনাহসমূহ থেকে বেঁচে থাকা। অর্থাৎ যদি তুমি গুনাহ থেকে বেঁচে থাকো তাহলে রাত জেগে ইবাদতকারীর চাইতেও আগে বেড়ে যেতে পারবে। (মুসনাদ আবু ইয়া’লা ৪৯৫০)
গুনাহর ফাঁদ থেকে বেঁচে থাকার ৭০ টি কার্যকরী পরামর্শ
১. হিম্মত করুন
গুনাহর ফাঁদ থেকে বেঁচে থাকার জন্য আপনাকে হিম্মত করতে হবে। আল্লাহর উপর ভরসা করে এই আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে যে, ‘ইন শা আল্লাহ, আমি পারবো। আমার রবের সন্তুষ্টির জন্য দুনিয়ার এই চাকচিক্য থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবো।’ এই ভাবে প্রত্যয়ী হবেন, তাহলে বেঁচে থাকাটা সহজ হবে।
রাসূলুল্লাহ্ ﷺ বলেছেন,
الْمُؤْمِنُ الْقَوِيُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيفِ ، وَفِي كُلٍّ خَيْرٌ احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ ، وَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ وَلَا تَعْجَزْ
আল্লাহর কাছে শক্তিশালী মুমিন দুর্বল মুমিন থেকে অধিক উত্তম ও প্রিয়। তুমি ঐ জিনিসে যত্নবান হও, যাতে তোমার উপকার আছে এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা কর ও উৎসাহহীন হয়ো না। (মুসলিম ৪৮২২)
২ .নিয়ত করুন, গুনাহের সুযোগ পেলেও গুনাহ করবো না
মনে রাখতে হবে, গুনাহকালীন সময়ে আনন্দ ক্ষণস্থায়ী কিন্তু তার ক্ষতি ও করুণ পরিণতি দীর্ঘস্থায়ী। পাপের উন্মাদনা সাময়িক কিন্তু তার অনুতাপ হবে দীর্ঘ মেয়াদি। সুতরাং আজ থেকে নিয়ত করুন, গুনাহের সুযোগ পেলেও গুনাহ করবো না।
ومَن هَمَّ بسَيِّئَةٍ فَلَمْ يَعْمَلْها، كَتَبَها اللَّهُ له عِنْدَهُ حَسَنَةً كامِلَةً
আর সে যদি কোনো গুনাহ করার সংকল্প করে; কিন্তু সে তা কর্মে বাস্তবায়িত না করে তাহলে আল্লাহ তাআলা তাঁর কাছে একটি পূর্ণ নেকি লিপিবদ্ধ করে দেন। (মুসলিম ১৩১)
৩. কোনো গুনাহকে ছোট করে দেখবেন না
গুনাহ হল আমাদের শত্রু। শত্রুর ক্ষেত্রে যুদ্ধের কৌশল হল শত্রুকে কখনো ছোট করে দেখতে নাই।
হাদীসে এসেছে, নবীজী ﷺ বলেন,
إياكم ومُحَقَّراتِ الذنوبِ
তুমি ঐ সকল গুনাহ থেকে বেঁচে থাক যেগুলোকে ছোট বলে ধারণা করা হবে। (সহিহ আলজামি’ ২৬৮৬)
একটা জিনিস চিন্তা করে দেখুন, হাদিসে এসেছে, এক ব্যক্তি একটা বিড়ালকে বেঁধে রাখার কারণে জাহান্নামে চলে গেছে। একজন মুজাহিদ শুধু একটা রশি চুরি করার কারণে জাহান্নামে চলে গেছে। আরো এসেছে, একজন লোক আমল করতে করতে জান্নাতের পাড়ে চলে যায়, তারপর সে হঠাত একটা কথা বলে যার কারণে সে জাহান্নামের পাড়ে চলে আসে।
তাহলে বলুন, কোন গুনাহকে ছোট মনে করে দেখার কোন সুযোগ আছে?!
একজন মুমিন সগিরাকেও কবিরা গুনাহ মনে করে
কবি বলেন,
لاَ تَحْقِرَنَّ صَغِيْرَةً إِنَّ الْجِبَالَ مِنَ الْحَصَى
গুনাহকে ছোট মনে করো না। বড় পাহাড় ছোট ছোট পাথর দিয়েই তৈরি হয়।
৪. দোয়া করুন
দোয়া সকল মুসিবতের সবচে’ শক্তিমান প্রতিষেধক। সুতরাং যে ব্যক্তি তাওবা করতে চায়, তার উচিত ওই সত্তার দরবারে হাত তোলা যিনি প্রার্থনা শুনেন এবং মুসিবত দূর করেন। হতে পারে গুনাহ বর্জন এবং পবিত্র জীবন গঠন; এই দু’য়ের মাঝে দূরত্ব কেবল দু’টি প্রার্থনার হাত। প্রয়োজন কেবল কয় ফোঁটা চোখের পানি।
وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ
আর তোমাদের রব বলেছেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের জন্য সাড়া দেব। (সূরা গাফির ৬০)
৫. মাঝে মাঝে নির্জনে চোখের পানি দিবেন
গুনাহটা তো এই চোখ দ্বারাই বেশি হয় এবং নির্জনে বেশি হয়। সুতরাং নির্জনে কিছু চোখের পানিও দিতে হবে। এটা সাধারণ দোয়া থেকে স্পেশাল। রাসুলুল্লাহ ﷺ হাদিসে বলেছেন,
لا يلِجُ النَّارَ رجُلٌ بَكَى مِن خشيَةِ اللَّهِ حتَّى يَعودَ اللَّبنُ في الضَّرعِ
যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে কাঁদে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। দুধ স্তনে ফিরে যাওয়া যেমন অসম্ভব, তেমনি তার জাহান্নামে প্রবেশ করাও অসম্ভব। (জামি’ তিরমিযী ২৩১১)
গুনাহর কারণে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন। আর আল্লাহর অসন্তুষ্টির চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশের নামই হল, জাহান্নাম। আর সেই জাহান্নাম থেকে চোখের পানির উসিলায় যদি বেঁচে যেতে পারেন, এর অর্থ হল, আল্লাহ তাআলা আপনাকে হয় গুনাহটি থেকে বিশেষ রহমতে বাঁচিয়ে নিবেন কিংবা মউতের আগে হলেও এ থেকে তাওবার তাওফীক দিয়ে দিবেন।
৬. মুজাহাদা বা চেষ্টা চালান
এক দিনে কিংবা এক রাতে আপনি গুনাহ ছেড়ে দিয়ে পবিত্র হয়ে উঠবেন; এ ধারণা ভুল। বরং এর জন্য কষ্ট করতে হবে, প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালাতে হবে। আপনি গুনাহ ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে আন্তরিক; এটা তখনই বুঝা যাবে যখন এ ব্যাপারে আপনার চেষ্টা অব্যাহতভাবে পাওয়া যাবে। আল্লাহ বলেন,
وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللَّهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ
আর যারা আমার পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, তাদেরকে আমি অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব। আর নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সাথেই আছেন। (সূরা আনকাবুত ৬৯)
৭. ভাবুন, আমার উপর পাহারাদার আছে
মাঝে মধ্যে অন্তরে এই ভাবনা জাগিয়ে তুলুন যে, আমার উপর পাহারাদার আছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَكَانَ اللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ رَّقِيبًا
আল্লাহ সব বিষয়ের উপর দৃষ্টি রাখেন। (সূরা আহযাব ৫২)
ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল রহ. একজন কবির কাছে একটি কবিতা শুনে দরজা বন্ধ করে খুব কেঁদেছিলেন। কবিতাটি ছিল এই,
إِذَا مَا خَلَوْتَ الدَّهْرَ يَوْمًا فَلَا تَقُلْ
خَـلَـوْتُ وَلَـكِـنْ قُـلْ عَـلَـيَّ رَقِـيبُ
যদি তুমি দিনের কিছু সময় একাকী কাটাও, তখন একথা বলো না যে, আমি নির্জনে একাকী সময় কাটিয়েছি; বরং বলো, আমার পেছনে সদা সর্বদা একজন পাহারাদার ছিল।
৮. আল্লাহ তাআলাকে লজ্জা করতে শিখুন!
হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রহ. কথাটা এভাবে বলেছেন, গুনাহ থেকে বাঁচার একটি কৌশল হল, এই কথা চিন্তা করা গুনাহটি আমি আমার শায়খের সামনে মা-বাবার সামনে কিংবা যারা আমাকে ভালো মানুষ মনে করে তাদের সামনে করতে পারবো কিনা! তারপর চিন্তা করো, তারা তো এখানে নেই। কিন্তু আমার আল্লাহ তো আছেন। তিনি সকলের চেয়েও বড়। সুতরাং তাঁর সামনে গুনাহটি কীভাবে করবো?!
হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ ﷺ এটাই বলেন,
وَأَنْ تَسْتَحِيَ مِنَ اللهِ كَمَا تَسْتَحِي رَجُلاً صَالِحًا مِنْ قَوْمِكَ
আল্লাহকে লজ্জা কর, যেমন তুমি তোমার কওমের নেক মানুষকে লজ্জা করে থাকো। (বায়হাক্বী শু‘আবুল ঈমান ৭৭৩৮)
৯. ভাবুন, আল্লাহর সরাসরি প্রশ্নে কী উত্তর দিবো?
আজ আমি যে গুনাহগুলোতে লিপ্ত, কেয়ামতের দিন তো আল্লাহ আমাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করবেন যে, বান্দা! এ গুনাহটা কেন করলি? দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়ে তুমি মনে করেছিলে যে, তোমাকে কেউ দেখে নাই। আমিও কি দেখি নাই? তুমি কি মনে করেছ যে, আমার দেখা মাখলুকের চোখের চেয়ে দুর্বল? রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন,
مَا مِنْكُم أَحَدٍ إِلَّا سَيُكَلِّمُهُ رَبُّهُ لَيْسَ بَيْنَهُ وَبَيْنَهُ تُرْجُمَانٌ وَلَا حِجَابٌ يَحْجُبُهُ
তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যার সাথে তার রব কথাবার্তা বলবেন না। তার ও তার রবের মাঝে কোন দোভাষী এবং এমন কোন পর্দা থাকবে না, যা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। (সহীহ বুখারী ৬৯৩৫)
চিন্তা করুন, সে দিন তখন আমরা কী উত্তর দিবো?! সেদিন যদি আল্লাহ সরাসরি জিজ্ঞেস করেন, বান্দা! রাতের দুইটা বাজে কেন তুই অশ্লীলতার ভেতর ডুবে গিয়েছিলি? কেন তুই এমন জিনিসের চর্চা করেছিলি যে, যেখানে পৌত্তলিকতা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, অবৈধ প্রেম ও নগ্নতাসহ কত শত অপরাধের চর্চা ও শিক্ষা ছিল? তখন আমরা কী উত্তর দিবো?!
১০. আল্লাহ তাআলার সঙ্গ অনুভব করুন
সব সময় সর্বাবস্থায় ‘আল্লাহ আমার সঙ্গে আছেন’ এই কল্পনা ধরে রাখার চেষ্টা করুন।
মাহবুবুওলামা পীর যুলফিকার আহমদ নকশবন্দী বলেন, প্রত্যেক নামাযের পর দৈনিক অন্তত পাঁচ বার কিছু সময়ের জন্য- দুই থেকে পাঁচ মিনিটের জন্য আল্লাহর সান্নিধ্যের মুরাকাবা করলে এই অনুভূতি তৈরি হয়। মুরাকাবা এভাবে করবেন- চোখ বন্ধ করবেন। তারপর ভাববেন, ‘আমি যেখানেই থাকি না আল্লাহ আমার সাথে আছেন।’ অথবা এই আয়াতের বিষয়বস্তু নিয়ে চিন্তা করবেন- هُوَ مَعَكُمْ اَيْنَمَا كُنْتُمْ ‘তোমরা যেখানেই তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন।’
এভাবে নিয়মিত কিছুদিন করতে পারলে -ইন শা আল্লাহ- ধীরে ধীরে আল্লাহর সান্নিধ্যের সার্বক্ষণিক অনুভূতি অন্তরে বসে যাবে এবং গুনাহ থেকে চব্বিশ ঘণ্টার বাকি সময়গুলোতেও বেঁচে থাকতে পারবেন।
১১. নিজেকে নিজে বলুন, ‘আল্লাহকে ভয় কর’
যখন গুনাহ করতে মন চাইবে তখন নিজেকে নিজে বলবেন ‘আল্লাহকে ভয় কর’। অথবা নিজেকে বলবেন, ‘আমি আল্লাহকে ভয় করি।’
এ বিষয়ে আমরা অনেক হাদীস জানি। যেমন, প্রসিদ্ধ হাদীস আছে যে, আল্লাহর ভয়ে ভীত বান্দা কেয়ামতের দিন আরশের ছায়ায় স্থান পাবে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,
ورَجُلٌ دَعَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصِبٍ وجَمَالٍ فَقالَ: إنِّي أَخَافُ اللَّهَ
এবং এমন ব্যক্তি (আরশের নিচে ছায়া পাবে) যাকে অভিজাত সুন্দরী কোন রমণী প্রস্তাব দেয়া সত্ত্বেও সে বলে; আমি আল্লাহকে ভয় করি। (সহীহ বুখারী ১৪২৩)
এক্ষেত্রে বুখারীর ৩ জনের ঘটনাও সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। যারা গুহাতে আটকা পড়ে গিয়ছিল। যার মাঝে একজন এই বলে দোয়া করল, ওগো আল্লাহ, আমার এক চাচাত বোন ছিল। আমি তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। অর্থাৎ, যুবক ছিল এই যুগের যুবকদের মত একই রোগে রোগী !
তো সে দোয়া করতে যেয়ে আল্লাহর কাছে নিজের অপরাধ স্বীকার করে বলল যে, আমি তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। আমি তাকে কুপ্রস্তাব দিলাম। কিন্তু সে অস্বীকার করল। একবার সে অভাবে পড়ল। তাই আমার কাছে টাকা চাইতে আসল। আমি তাকে কুকর্মের বিনিময়ে ১২০ দিনার দিতে রাজি হলাম। আমিও অভাবে ছিলাম। কোন রকমে আমি টাকাটা জোগাড় করলাম। যখন আমি খারাপ কাজটা করার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়েছি। ঠিক তখনি আমার চাচাতো বোন বলে উঠল, ‘আল্লাহকে ভয় কর।’ ওগো আল্লাহ, তার এই কথার প্রভাবে আপনার ভয়ে আমি সেই কাজ থেকে সরে আসি। আর তার থেকে টাকাটাও আর ফেরত নেই নি। আমার এই কাজটা যদি আপনার জন্য হয়ে থাকে তাহলে পাথরটা একটু খুলে দেন। আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা পাথরটা একটু খুলে দিলেন ।
তাহলে বুঝা গেল এটা একটা নগদ চিকিৎসা ।
১২. গুনাহর পরিণতি নিয়ে ভাবুন
গুনাহর পরিণতি নিয়ে যত ভাববেন, বেঁচে থাকা তত সহজ হবে। আর গুনাহর পরিণতি হলো, দুশ্চিন্তা, বিষন্নতা, সংকট, আল্লাহ আর বান্দার মাঝে দূরত্ব তৈরি হওয়া ইত্যাদি।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَا قَدَّمَتْ لِغَدٍ وَاتَّقُوا اللهَ إِنَّ اللهَ خَبِيْرٌ بِمَا تَعْمَلُوْنَ، وَلَا تَكُوْنُوْا كَالَّذِيْنَ نَسُوْا اللهَ فَأَنْسَاهُمْ أَنْفُسَهُمْ أُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُوْنَ
হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আর প্রত্যেক ব্যক্তির উচিৎ এ বিষয়ে ভেবে দেখা যে, সে আগামী দিনের জন্য কি অগ্রিম প্রেরণ করছে? আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে সম্যক অবহিত। আর তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে। অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে আত্মভোলা করে দিয়েছেন। ওরা হলো অবাধ্য। (সূরা হাশর ১৮-১৯)।
১৩. গুনাহ ত্যাগ করার উপকারিতা নিয়ে ভাবুন
এটাও আপনাকে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার শক্তি জোগাবে। আর গুনাহ ত্যাগ করার উল্লেখযোগ্য উপকারিতা হলো, অন্তর পরিষ্কার হয়ে ওঠে, আল্লাহ তাআলার মহব্বত বাড়তে থাকে, সে জান্নাত লাভে ধন্য হয় ইত্যাদি।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى. فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى
আর যে ব্যক্তি নিজ প্রতিপালকের সামনে দাঁড়ানোর ভয় পোষণ করত এবং নিজেকে মন্দ চাহিদা হতে বিরত রাখত, জান্নাতই হবে তার ঠিকানা। (সূরা নাযিয়া’ত ৪০-৪১)
১৪. হৃদয়ে ঈমানের বীজ যত্ন করে রাখুন
কেননা, যখন এ-বীজ অঙ্কুরিত হয়ে বেড়ে ওঠে, তখন তা দুনিয়া-আখেরাত উভয় জাহানের কামিয়াবি নিয়ে আসে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
اَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِيْنَ آمَنُوْا اَنْ تَخْشَعَ قُلُوْبُهُمْ لِذِكْرِ اللهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ
যারা ঈমান আনে তাদের হৃদয় কি আল্লাহর স্মরণে ও যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে বিগলিত হওয়ার সময় কি আসে নি? (সূরা হাদীদ ১৬)
যখন নগ্ন ও অশ্লীল চিন্তা দ্বারা আপনি তাড়িত হবেন তখনই সঙ্গে সঙ্গে আয়াতটির বিষয়বস্তু সম্পর্কে চিন্তা করবেন। এরপর নিজেকে সম্বোধন করে বলুন, ‘ঈমানদারের কি এখনও আল্লাহকে ভয় করার সময় হয় নি?’
১৫. গুনাহর উপকরণ ও উদ্দীপক বিষয়গুলো থেকে দূরে থাকুন
কেননা, প্রতিটি গুনাহর নেপথ্যে এমন উপকরণ অবশ্যই থাকে, যা তাকে গুনাহর প্রতি উদ্দীপ্ত করে এবং তাকে ওই গুনাহর ফাঁদে ফেলে রাখে। সুতরাং এ থেকে দূরে থাকার উপায় হলো, এজাতীয় বিষয় এড়িয়ে চলা।
১৬. দুষ্টু বন্ধু ও সাথীর ব্যাপারে সতর্ক থাকুন
কেননা, কিছু যুবক আছে গুনাহ ছেড়ে দিয়ে পবিত্র জীবন সাজাতে চায়। কিন্তু কোনো দুষ্টু বন্ধু কিংবা সাথীর কারণে আবার ফেঁসে যায়। একারণেই হাদীস শরীফে এসেছে,
المرءُ على دينِ خليلِه فلينظرْ أحدُكم مَن يُخاللُ
মানুষ তার বন্ধুর রীতিনীতির অনুসারী হয়। কাজেই তোমাদের প্রত্যেকেই যেন লক্ষ্য করে, সে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে। (আবু দাউদ ৪৮৩৩)
১৭. ভাবুন, আমি শয়তানের সঙ্গী হয়ে যাচ্ছি না তো?
এই কথা চিন্তা করবেন যে, শয়তান আমাদের প্রধান শত্রু। আর গুনাহয় লিপ্ত থাকার অর্থ হল, আমি আমার সময় কাটালাম শয়তানের সঙ্গে। আর শয়তান কাউকে সঙ্গী বানিয়ে নিতে পারলে তাকে জাহান্নামে নিয়েই ছাড়বে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَن يَكُنِ ٱلشَّيْطَٰنُ لَهُۥ قَرِينًا فَسَآءَ قَرِينًا
আর শয়তান কারও সঙ্গী হলে সে সঙ্গী কত মন্দ! (সূরা নিসা ৩৮)
এও ভাবুন, শয়তান আমাদেরকে দিয়ে গোপন গুনাহ করিয়ে কোথা থেকে কোথায় নামিয়ে দিচ্ছে!
ইবনুল কাইইয়িম রহ. বলেন,
أجمع العارفون بالله ان ذنوب الخلوات هي أصل الانتكاسات، وأن عبادات الخفاء هي أعظم أسباب الثبات
সকল আউলিয়ায়ে কেরাম একমত যে, বান্দার গোপন গুনাহ দ্বীনের পথে তার পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ। আর বিপরীতে গোপন ইবাদত দ্বীনের পথে অবিচল থাকার অন্যতম উপায়। (মাউকিউ দুরারিস সুন্নিয়্যা ১/২৪৩)
ইবনু রজব রহ. তো আরো কঠিন কথা বলেন,
أَنَّ خَاتِمَةَ السُّوءِ تَكُونُ بِسَبَبِ دَسِيسَةٍ بَاطِنَةٍ لِلْعَبْدِ لَا يَطَّلِعُ عَلَيْهَا النَّاسُ
মৃত্যুর সময় অশুভ পরিণতির কারণ বান্দার গোপন গুনাহ; যা সম্পর্কে মানুষ জানত না। (জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম ১/১৭২)
সুতরাং ভাবুন, শয়তান আমাদেরকে দিয়ে গোপন গুনাহ করিয়ে কোথা থেকে কোথায় নামিয়ে দিচ্ছে!
১৮. মাসে অন্তত তিন দিন রোজা রাখুন
অর্থাৎ আরবি মাসের ১৩,১৪,১৫ রোজা রাখার চিন্তা করতে পারেন। অথবা প্রতি সপ্তাহে সোম ও বৃহস্পতিবার। কেননা রোজার মধ্যে প্রবৃত্তির টানে ছুটে যাওয়া থেকে যেমন সুরক্ষা রয়েছে, তেমনি রয়েছে আল্লাহর কাছে বড় প্রতিদান। মানুষের ইচ্ছাশক্তি দৃঢ় করা, ধৈর্য, সহনশীলতা, নফসের খাহেশ ও আনন্দদায়ক বিষয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দীক্ষাও রয়েছে রোজায়। তাই রোজা রাখার ব্যাপার মনস্থির করুন। আশা করা যায়, আল্লাহ আপনার বোঝা হালকা করবেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ ، مَنِ اسْتَطَاعَ الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ ، فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ ، وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ فَإِنَّهُ
হে যুবক সম্প্রদায় ! তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহ করার সামর্থ্য রাখে, তারা যেন বিবাহ করে। কেননা, বিবাহ তার দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং যৌনতাকে সংযমী করে এবং যাদের বিবাহ করার সামর্থ্য নাই, সে যেন রোযা পালন করে। কেননা, রোযা তার যৌনতাকে দমন করে। (বুখারী ৪৯৯৬)
১৯. বিবাহের ব্যাপারে সিরিয়াসলি চিন্তা করুন
গুনাহ যদি যৌবনতাড়িত হয় তাহলে বিবাহের ব্যাপারে সিরিয়াসলি চিন্তা করুন। প্রয়োজনে আপনার গার্জিয়ানকে এ ব্যাপারে খোলাখুলি বলে বিবাহের আগ্রহ ব্যক্ত করতেও কোনো সমস্যা নেই। এ ব্যাপারে দারিদ্র্যকে ভয় পাবেন না; আল্লাহ তার করুণায় অভাবমুক্ত করে দেবেন। কেননা, আল্লাহ বলেছেন,
وَأَنكِحُوا الْأَيَامَى مِنكُمْ وَالصَّالِحِينَ مِنْ عِبَادِكُمْ وَإِمَائِكُمْ إِن يَكُونُوا فُقَرَاء يُغْنِهِمُ اللَّهُ مِن فَضْلِهِ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ
আর তোমরা তোমাদের মধ্যকার অবিবাহিত নারী-পুরুষ ও সৎকর্মশীল দাস-দাসীদের বিবাহ দাও। তারা অভাবী হলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যবান ও মহাজ্ঞানী। (সূরা আন-নূর ৩২)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানিয়েছেন যে, সৎ উদ্দেশে যে ব্যক্তি বিয়ে করল আল্লাহ তাকে সাহায্য করবেন। (সুনান তিরমিযী ১৬৫৫)
২০. কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলার অভ্যাস করুন
কারণ, অল্লাহর নামে কাজ শুরুর অভ্যাস আপনাকে এ কথা ভাবতে বাধ্য করবে যে, আসলেই কি এই কাজ শুরুর পূর্বে আল্লাহর নাম নেওয়া সমীচীন!?
২১. আউজুবিল্লাহ পড়ুন
মনের মধ্যে গুনাহের চিন্তা জাগ্রত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্থের প্রতি খেয়াল করে কয়েক বার পড়ুন,
أَعُوْذُ بِاللّٰهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ
এর অর্থ, বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। একটু আওয়াজ করে পড়ুন। কমপক্ষে নিজে শুনতে পান এটুকু আওয়াজে পড়ুন। দেখবেন, এতে শয়তানের কুমন্ত্রণা কেটে যাবে, ইন শা আল্লাহ।
এর সাথে হাদিসে আসা আরেকটি দোয়াও পড়ুন,
آمَنْتُ بِاللّٰهِ وَرُسُلِهِ
আল্লাহ তাআলা এ মর্মে ঘোষণা করেন,
وَإِمَّا يَنزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللَّـهِ
আর যদি শয়তানের প্ররোচনা তোমাকে প্ররোচিত করে, তাহলে আল্লাহর কাছে (শয়তান থেকে) আশ্রয় প্রার্থনা করো। (সূরা আরাফ ২০০)
২২. হঠাৎ মৃত্যুর বিষয়টি স্মরণে রাখুন
মৃত্যু কি কাউকে কখনো ক্ষমা করেছে? বন্ধুত্বের বিচ্ছেদ ঘটায় নি? স্ত্রীদের বিধবা করে নি? সন্তানদের এতিম করে নি? সদা আন্দোলিত পাগুলো কি থামিয়ে দেয় নি?
সাহাবী আবু বাকরা রাযি.-এর মৃত্যুশয্যায় সন্তানগণ ডাক্তার নিয়ে আসতে চাইলে তিনি আনতে দেন নি। মৃত্যুর ফেরেশতা আসার পর তিনি উচ্চস্বরে সন্তানদের বলতে লাগলেন,
أين طبيبكم؟ ليردها إن كان صادقاً!
কোথায় তোমাদের ডাক্তার? সত্যবাদী হলে মৃত্যুদূত ফেরাও তো দেখি! (আলআলামুল আখীর ২৮)
সুতরাং প্রতিটি জীবনকেি এর মুখোমুখি হতে হতে হবে। আর আপনি কি চান, যখন এর মুখোমুখি হবেন, অশ্লীলতার মধ্যে ডুবে থাকবেন!? কিংবা মৃত্যু যখন হানা দিবে, তখন নামাযহীন অবস্থায় শুয়ে থাকবেন!?
আল্লাহ তাআলা বলেন,
حَتَّىٰ إِذَا جَاءَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ رَبِّ ارْجِعُونِ . لَعَلِّي أَعْمَلُ صَالِحًا فِيمَا تَرَكْتُ
অবশেষে যখন তাদের কারো মৃত্যু আসে, সে বলে, ‘হে আমার রব, আমাকে দুনিয়াতে ফেরত পাঠান, যাতে আমি সৎ কাজ করতে পারি যা আমি পূর্বে করিনি! (সূরা মুমিনূন ৯৯-১০০)
হাদীসে এসেছে, ইবনু ওমর রাযি. বলেন, জনৈক ব্যক্তি এসে রাসূল ﷺ-কে জিজ্ঞেস করল, কোন মুমিন উত্তম? তিনি বললেন, যে সর্বোত্তম চরিত্রবান। লোকটি বলল, কে সর্বাধিক জ্ঞানী? তিনি বললেন,
أَكْثَرُهُمْ لِلْمَوْتِ ذِكْرًا وَأَحْسَنُهُمْ لِمَا بَعْدَهُ اسْتِعْدَادًا أُولَئِكَ الأَكْيَاسُ
মৃত্যুকে সর্বাধিক স্মরণকারী এবং তার পরবর্তী জীবনের জন্য সর্বাঙ্গীন সুন্দর প্রস্তুতি গ্রহণকারী। তারাই হলো প্রকৃত জ্ঞানী। (ইবনু মাজাহ ৪২৫৯)
২৩. স্মরণ করুন, যখন আপনার মরদেহ গোসল দেয়া হবে
যখন লোকেরা গোসলের জন্য আপনার মরদেহটি খাটিয়ায় রাখবে, তখন আপনি নিশ্চল নিশ্চুপ ও নিথর মৃতদেহ বৈ কিছু নয়। আপনি নড়তেও পারবেন না, তারা আপনাকে নাড়াবে। তখন আপনার গুনাহগুলো আপনার কোনো উপকারে আসবে কি!?
২৪. স্মরণ করুন, অচিরেই আপনার জানাযা মানুষ কাঁধে করে নিয়ে যাবে
সুবহানাল্লাহ! তখন কোথায় থাকবে আপনার শক্তি!? আপনার যৌবন!? আপনার অহমিকা!? আপনার বন্ধুরাই বা তখন কোথায় থাকবে!? সে দিন যে নেক আমলগুলো আপনি করেছিলেন, সেগুলো ছাড়া আর কিছুই উপকারে আসবে কি!?
ওমর বিন আব্দুল আযীয জনৈক আলেমকে বলেন, আপনি আমাকে উপদেশ দিন। তিনি বললেন, আপনিই প্রথম খলীফা নন, যিনি মৃত্যুবরণ করবেন। খলীফা বললেন, আরও উপদেশ দিন। তিনি বললেন, আদম পর্যন্ত আপনার বাপ-দাদাদের এমন কেউ ছিলেন না যিনি মৃত্যুবরণ করে নি। এবার আপনার পালা। একথা শুনে খলীফা কেঁদে ফেলেন। তিনি প্রতি রাতে আলেম-ওলামাদের নিয়ে বৈঠক করতেন। যেখানে মৃত্যু, কেয়ামত ও আখেরাত নিয়ে আলোচনা হ’ত। তখন তারা এমনভাবে ক্রন্দন করতেন, যেন তাদের সামনেই জানাযা উপস্থিত হয়েছে। (ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন ৭/১৩৯)
২৫. স্মরণ করুন, যখন আপনাকে কবরে রেখে দেওয়া হবে
সে দিন আপনার কোনো প্রিয়জন সঙ্গে যাবে কি!? আপনার বন্ধুরাই বা কী করবে!? আপনার পরিবারও তো সে দিন আপনাকে রেখে চলে আসবে! হ্যাঁ, সে দিন আপনার সঙ্গে আপনার কবরে ঢুকবে কেবলই আপনার আমল। ভেবে দেখুন, কোন আমলগুলো আপনি নিজের সঙ্গে কবরে নামানোর জন্য প্রস্তুত করছেন? ফেসবুকিং, ইউটিউবিং, গেমিং, গ্যাম্বলিং না এর চেয়েও জঘন্য কোনো কিছু!?
কবি বলেন,
أَلاَ يَا سَاكِنَ الْقَصْرِ الْمُعَلَّى + سَتُدْفَنُ عَنْ قَرِيْبٍ فِى التُّرَابِ
قَلِيْلُ عُمْرُنَا فِي دَارِ دُنْيَا + وَمَرْجَعُنَا إِلَى بَيْتِ التُّرَابِ
শোনো, হে সুউচ্চ প্রাসাদে বসবাসকারী! সত্বর তুমি দাফন হবে মাটিতে। ইহকালে আমরা আমাদের জীবনের অল্প সময়ই কাটিয়ে থাকি। আর আমাদের প্রত্যাবর্তন স্থল হ’ল মাটির ঘরে (কবরে)।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
وعُدَّ نفسَك في أَهلِ القبورِ
তুমি নিজেকে কবরবাসীদের অন্তর্ভুক্ত মনে কর। (তিরমিযী ২৩৩৩)
রবী‘ বিন খায়ছাম রহ. বাড়ীতে কবর খুঁড়ে রাখেন। যেখানে তিনি দিনে একাধিকবার ঘুমাতেন। যাতে সর্বদা মৃত্যুর কথা মনে পড়ে। (ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন ৭/১৩৯)
২৬. মাঝে মাঝে কবর জেয়ারত করুন
উক্ত স্মরণ জিইয়ে রাখার জন্য মাঝে মাঝে কবর জেয়ারত করুন। এর দ্বারা দিল নরম হবে। গুনাহর প্রতি আকর্ষণ কমে যাবে। আমলের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাবে। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
فَإِنَّهَا تُرِقُّ الْقَلْبَ ، وَتُدْمِعُ الْعَيْنَ ، وَتُذَكِّرُ الآخِرَةَ
কবর জিয়ারত অন্তরকে নরম করে, চোখের পানি বের করে এবং আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। (মুসতাদরাক হাকিম ১৫৩২)
হযরত উসমান গণী রাযি. কবরস্থানে গিয়ে কাঁদতেন। যাতে দাড়ি ভিজে যেত। তাঁকে বলা হ’ল জান্নাত-জাহান্নামের কথা শুনে আপনি কাঁদেন না, অথচ কবরে এসে কাঁদেন? জবাবে তিনি বলেন,
إنَّ القبرَ أوَّلُ مَنازلِ الآخرةِ ، فإن نجا منهُ ، فما بعدَهُ أيسرُ منهُ ، وإن لم يَنجُ منهُ ، فما بعدَهُ أشدُّ منهُ
কবর হ’ল আখেরাতের প্রথম মনযিল। যদি কেউ এখানে মুক্তি পায়, তাহ’লে পরের মনযিলগুলি তার জন্য সহজ হয়ে যায়। আর এখানে মুক্তি না পেলে পরের মনযিলগুলি তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। (তিরমিযী ২৩০৮)
হাসান বসরী রহ. যখন কোন জানাযা পড়াতেন, তখন কবরের মধ্যে উঁকি মেরে জোরে জোরে বলতেন, কত বড়ই না উপদেশদাতা সে। যদি জীবিত অন্তরগুলি তার অনুগামী হতো! (ক্বাছরুল আমাল ১৪৫)
২৭. স্মরণ করুন, আপনার প্রতিটি আমল আল্লাহ তাআলার সামনে পেশ করা হবে
গুনাহের প্রবল ইচ্ছা দমনে উক্ত চিন্তা বেশ কাজে আসে। এ মর্মে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَاتَّقُوا يَوْمًا تُرْجَعُونَ فِيهِ إِلَى اللَّهِ
তোমরা সেদিনের ভয় কর, যেদিন তোমাদেরকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নেয়া হবে। (সূরা বাকারা ২৮১)
অন্যত্র তিনি বলেছেন,
يَوْمَئِذٍ تُعْرَضُونَ لَا تَخْفَىٰ مِنكُمْ خَافِيَةٌ
সেদিন উপস্থিত করা হবে তোমাদেরকে এবং তোমাদের কোনো গোপনই আর গোপন থাকবে না। (সূরা আল হাক্কাহ ১৮)
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহ. একদিন বাগদাদের বাজারে এলেন। অতঃপর এক বোঝা কাঠ খরিদ করে কাঁধে নিয়ে চলতে শুরু করলেন। অতঃপর যখন লোকেরা তাকে চিনে ফেলল, তখন ব্যবসায়ীরা ব্যবসা ছেড়ে, দোকানদাররা দোকান ছেড়ে, পথিকরা পথ চলা বন্ধ করে তাঁর কাছে ছুটে এল ও সালাম দিয়ে বলতে লাগল, আমরা আপনার বোঝা বহন করব। তখন তাঁর হাত কেঁপে উঠল, চেহারা লাল হয়ে গেল, দু’চক্ষু বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। অতঃপর তিনি বারবার বলতে থাকলেন,
نحن قوم مساكين ، لولا ستر الله لافتضحنا
আমরা মিসকীন। যদি আল্লাহ আমাদের পাপ ঢেকে না দেন, আমরা অবশ্যই সেদিন লাঞ্ছিত হবো। (হুলইয়াতাউল আউলিয়া ১/১৮১)
২৮. স্মরণ করুন, আপনার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো আপনার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিবে
যেকোনো গুনাহর করার আগে স্মরণ করুন, যে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো ব্যবহার করে আপনি গুনাহ করছেন, সেগুলো কেয়ামতের দিন সাক্ষী দিবে আপনারই বিরুদ্ধে। এজগতে নয়; বরং ওই জগতে সকলের সামনে আপনাকে লাঞ্ছিত করে ছাড়বে।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
الْيَوْمَ نَخْتِمُ عَلَىٰ أَفْوَاهِهِمْ وَتُكَلِّمُنَا أَيْدِيهِمْ وَتَشْهَدُ أَرْجُلُهُم بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ
আজ আমি তাদের মুখে সীল মোহর লাগিয়ে দেব, তাদের হাত আমার সঙ্গে কথা বলবে, আর তারা যা করত সে সম্পর্কে তাদের পাগুলো সাক্ষ্য দেবে। (সূরা ইয়াসিন ৬৫)
শুধু কি তাই! আমার শরীরের চামড়াও সাক্ষী দিবে আমার বিরুদ্ধে, যদি আমি তা আল্লাহর নাফরমানিতে ব্যবহার করি। সে দিন মানুষ নিজের শরীরের চামড়াকে বলবে,
وَقَالُوا لِجُلُودِهِمْ لِمَ شَهِدْتُمْ عَلَيْنَا
তারা তাদের চামড়াকে বলবে, তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছ কেন? সেগুলো উত্তর দিবে,
أَنْطَقَنَا اللَّهُ الَّذِي أَنْطَقَ كُلَّ شَيْءٍ
আল্লাহ আমাদেরকে বাকশক্তি দান করেছেন, যিনি বাকশক্তি দান করেছেন প্রতিটি জিনিসকে। (সূরা হা-মীম আসসাজদাহ ২১)
২৯. স্মরণ করুন, আপনার আমলগুলো লিপিবদ্ধ হচ্ছে
স্মরণ করুন, আপনার কথা ও কাজের প্রতিটি অংশ লিপিবদ্ধ করে নিচ্ছে দায়িত্ব পালনকারী ফেরেশতারা। তাদের কাছে আপনার কোনো কিছুই গোপন নয়। আপনার মরণ পর্যন্ত তারা আপনার পেছনে লেগে আছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَإِنَّ عَلَيْكُمْ لَحَافِظِينَ • كِرَامًا كَاتِبِينَ • يَعْلَمُونَ مَا تَفْعَلُونَ
অবশ্যই তোমাদের উপর নিযুক্ত আছে তত্ত্বাবধায়কগণ; সম্মানিত লেখকগণ (যারা লিপিবদ্ধ করছে তোমাদের কার্যকলাপ), তারা জানে তোমরা যা কর। (সূরা ইনফিতার ১০-১২)
৩০. পুলসিরাত পাড়ি দেয়ার কথা স্মরণ করুন
সকলকেই পুলসিরাত পার হয়ে জান্নাতের দিকে যেতে হবে। পুলসিরাত মানে জাহান্নামের ওপর স্থাপিত সেতু। যা তলোয়ারের চেয়ে ধারালো হবে এবং চুলের চেয়েও সূক্ষ্ম হবে। কাফির ও পাপাচারীরা সেখানে পদস্খলিত হয়ে নিচে পতিত হবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَإِن مِّنكُمْ إِلَّا وَارِدُهَا كَانَ عَلَىٰ رَبِّكَ حَتْمًا مَّقْضِيًّا
আর তোমাদের প্রত্যেককেই তা অতিক্রম করতে হবে, এটি তোমার রবের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। (সূরা মারইয়াম ৭১)
আল্লামা ক্বাসত্বালানী রহ. বলেন, ভেবে দেখুন, যখন আপনি পুলছিরাতের উপর উঠবেন এবং সেখান থেকে নীচের জাহান্নামের দিকে দৃষ্টি দিবেন। অতঃপর জ্বলন্ত আগুনের গর্জন, জাহান্নামের নিঃশ্বাস ও কৃষ্ণতা আপনার কর্ণকুহরে ধ্বনিত হতে থাকবে, তখন আপনার অবস্থা কেমন হবে? যদি আপনার কোনো পা পিছলে যায়, তবে আপিন এর প্রখরতা টের পাবেন এবং দ্বিতীয় পা উপরে ধরে রাখার কসরত করবেন। আপনার সামনেই অন্যরা পিছলে পড়ে যাবে এবং আগুনের তাপ অনুভব করবে। জাহান্নামের ফেরেশতারা তাদেরকে পাকড়াও করতে থাকবে, যারা পুলছিরাতের উল্টো কাঁটযুক্ত আংটা ও আঁককড়াতে বিদ্ধ হবে। আপনি সেটা দেখতে থাকবেন। তখন সেই দৃশ্যটা কত বিভীষিকাময় হবে? আরোহণের পথটা কতই না ভয়ংকর হবে এবং অতিক্রমটাও কতই না সঙ্কীর্ণতর হবে? আমরা আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা চাই, সাহায্য চাই এবং অনুগ্রহ কামনা করি। (ইরশাদুস সারী ৯/৩৩০)
৩১. স্মরণ করুন, যখন মীযান স্থাপন করা হবে
সে দিন হাশরের মাঠে আপনার ভালো ও মন্দ সব আমল ওজন করা হবে। মীযানের পাল্লা কিন্তু বাস্তবেই অনেক গুরুতর।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَنَضَعُ الْمَوَازِينَ الْقِسْطَ لِيَوْمِ الْقِيَامَةِ فَلَا تُظْلَمُ نَفْسٌ شَيْئًا وَإِن كَانَ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِّنْ خَرْدَلٍ أَتَيْنَا بِهَا وَكَفَىٰ بِنَا حَاسِبِينَ
আর কেয়ামত দিবসে আমি সুবিচারের মানদন্ড স্থাপন করব, অতঃপর কারো প্রতি এতটুকুও অন্যায় করা হবে না। আমল সরিষার দানা পরিমাণ হলেও তা আমি হাযির করব, হিসাব গ্রহণে আমিই যথেষ্ট। (সূরা ৪৭)
৩২. হাদিসে সাওবান মনে রাখবেন
হাদিসটি হুবহু মনে রাখার প্রয়োজন নেই। শুধু বিষয়বস্তুটা মনে রাখলেই চলবে। হাদিসটি এই, সাওবান রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
لأعلمنَّ أقوامًا من أمتي يأتون يومَ القيامةِ بحسناتٍ أمثالِ جبالِ تهامةَ بيضًا فيجعلُها اللهُ عزَّ وجلَّ هباءً منثورًا قال ثوبانُ يا رسولَ اللهِ صِفْهم لنا جَلِّهم لنا أن لا نكونَ منهم ونحنُ لا نعلمُ قال أما إنهم إخوانُكم ومن جِلدتِكم ويأخذون من الليلِ كما تأخذون ولكنَّهم أقوامٌ إذا خَلْوا بمحارمِ اللهِ انتهكُوها
আমি আমার উম্মতের কিছু লোক সম্পর্কে জানি যারা কেয়ামতের দিন তিহামা পাহাড় পরিমাণ শুভ্র নেক আমল নিয়ে হাজির হবে। (অর্থাৎ, হয়ত তাদের জীবনে নফল আছে। তাবলীগ আছে। তালীম আছে। দ্বীনের বহুমুখী খেদমত আছে।) কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাদের এত বিশাল বিশাল আমলকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করে একেবারে লাপাত্তা করে দিবেন। হাদিসটির বর্ণনাকারী সাওবান রাযি.-এটা শুনে বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রাসূল! তাদের পরিচয় পরিষ্কারভাবে আমাদের নিকট বর্ণনা করুন, যাতে অজ্ঞাতসারে আমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত না হই। রাসুলুল্লাহ ﷺ উত্তর দিলেন, তারা তোমাদেরই ভাই এবং তোমাদেরই সম্প্রদায়ভুক্ত। তোমাদের যেমন রাত আসে তাদের কাছেও রাত আসে। কিন্তু তারা এমন লোক যে, নির্জনে নিভৃতে আল্লাহর নাফরমানীতে লিপ্ত হয়। (ইবন মাজাহ ৪২৪৫)
সুতরাং ভাবুন, গোপন গুনাহ আমার আমল নষ্ট করে দিচ্ছে না তো? আমার তাবলীগ, আমার জিহাদ, আমার হজ, আমার ইতেকাফ, আমার সাদাকা অজগরের মত গিলে ফেলছে না তো?! এভাবে চিন্তা ধরে রাখতে পারলে ‘ইন শা আল্লাহ’ গুনাহ থেকে সহজে বের হয়ে আসতে পারবেন।
৩৩. ভাবুন, গুনাহর কারণে নবীজীর হাউজ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন না তো!?
যে হাউজের প্রশস্ততা এক মাসের পথের দূরত্বের সমপরিমাণ। এর পানি দুধের চেয়েও সাদা, মিশক আম্বরের চেয়েও অধিক খোশবুদার। এর পেয়ালা আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্ররাজির তুল্য। যে একবার এর শরবত পান করবে সে কখনো আর পিপাসার্ত হবে না। আর আপনার গুনাহ আপনাকে এ থেকে বঞ্চিত করে দিচ্ছে না তো!?
৩৪. মাঝে মাঝে জ্বলন্ত আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে ভাববেন…
মাঝে মাঝে গ্যাসের চুলার সামনে দাঁড়াবেন। আগুন দেখবেন। আল্লাহ বলেছেন,
أَفَرَأَيْتُمُ النَّارَ الَّتِي تُورُونَ
তোমরা যে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত কর, সে সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কি? (সূরা ওয়াকিয়া ৭১)
সুতরাং আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে ভাববেন, এই দুনিয়ার আগুনের ইন্ধন তো লাকড়ি, গ্যাস ইত্যাদি। এর উত্তাপ যদি এত বেশি হয় যে, আমি এক মিনিটও সইতে পারব না। তাহলে এই গুনাহর কারণে আমি যে নিজেকে ওই জাহান্নামের উপযুক্ত করে নিচ্ছি, وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ যে আগুনের ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, সেই আগুন আমি সৈহ্য করব কিভাবে! এভাবে চিন্তা করলে গুনাহর চিন্তা ধীরে ধীরে বিদায়, ইনশা আল্লাহ।
৩৫. দুনিয়ার তুচ্ছতা সম্পর্কে জানুন
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ
পার্থিব জীবন প্রতারণার উপকরণ ছাড়া কিছুই নয়। (সূরা হাদীদ ২০)
সুতরাং ভাবুন, এই তুচ্ছ দুনিয়ার পেছনে ঘোরে অসীম আখেরাত বরবাদ করে দিচ্ছেন না তো!? আপনার গুনাহ আপনাকে মহান জান্নাত থেকে বঞ্চিত করে দিচ্ছে না তো!?
৩৬. ভাবুন, আল্লাহ আমাকে দেখছেন
সুতরাং তিনি প্রতিনিয়ত আপনাকে পর্যবেক্ষণ করছেন। আপনার প্রতিটি পদক্ষেপ তিনি নজরে রাখছেন। আপনার দেখা, আপনার শোনা এমন কি আপনার অন্তরের চিন্তা সম্পর্কেও তিনি জানেন। আল্লাহর এক আরেফ কত চমৎকার করে বলেন,
فَاستَـحْيِ مِن نَظرِ الإِلَهِ وَقُل لَـهَا — إِنَّ الَّذِي خَلَقَ الظَّلَامَ يَـرَانِـي
লজ্জা কর রবের দৃষ্টিকে। নফসকে বল, যিনি অন্ধকার সৃষ্টি করেছেন, তিনি আমাকে দেখেন।
৩৭. একাকী নিভৃতে থাকবেন না
কেননা, একাকীত্ব গুনাহর চিন্তা করার কারণ হতে পারে। আপনার সময়কে উপকারী বিষয়ে ব্যয় করতে সচেষ্ট হোন। ঈমান ও ইসলামের পরিবেশে সময় ব্যয় করুন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
فَمَنْ أَرَادَ مِنْكُمْ بَحْبَحَةَ الْجَنَّةِ فَلْيَلْزَمُ الْجَمَاعَةَ، فَإِنَّ الشَّيْطَانَ مَعَ الْوَاحِدِ، وَهُوَ مِنَ الِاثْنَيْنِ أَبْعَدُ
তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি জান্নাতের মাঝখানে থাকতে ইচ্ছুক, সে যেন অবশ্যই জামাতবদ্ধ জীবন যাপন করে। কেননা শয়তান একাকী মানুষের সঙ্গী এবং দু’জন থেকে সে অপেক্ষাকৃত দূরে থাকে। (তিরমিযি ২২৫৪)
৩৮. গুনাহ ঢোকার দরজাগুলো বন্ধ করে দিন
একটু ভেবে দেখুন, কোন্ কোন্ পথে গুনাহ হয়ে যাচ্ছে। কোন্ কোন্ দরজা দিয়ে গুনাহ প্রবেশ করছে। ঘরের দরজা বন্ধ না করলে যেমন চোর ঢুকবে, তেমনি গুনাহর দরজা বন্ধ না করলেও অনিচ্ছায় আপনি গুনাহয় জড়িয়ে পড়বেন। সুতরাং গুনাহের দরজা যদি বন্ধ করতে পারেন, তাহলে গুনাহ থেকে বাঁচা সহজ হয়ে যাবে। আর যেসমস্ত পথে গুনাহ হয়ে যায় সেগুলো নিয়ে ভাবলে দেখবেন, তালিকার প্রথমেই আসবে মোবাইল ও কম্পিউটার। এর সাথে সাথে ইন্টারনেট। এগুলো ভাল কাজেও ব্যবহার করা যায়, আবার এগুলো দিয়ে গুনাহও হয়ে যায়। প্রয়োজনের কথা বলে এগুলো হাতে আসে, আর তা দিয়ে প্রযুক্তির তুলনায় গুনাহই বেশি প্রবেশ করে। সুতরাং বাস্তবেই যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে এগুলোর নিরাপদ ব্যবহার করবেন। বিশেষ করে কম্পিউটারের বাস্তব প্রয়োজন হলে সেটা বাড়ির এমন স্থানে স্থাপন করবেন যেন সকলের নযরে পড়ে, আর আপনি গুনাহ থেকে বাঁচতে পারেন।
৩৯. অধিকহারে ইস্তেগফার করুন
প্রয়োজনে এর জন্য প্রত্যেক নামাজের পর একটা নিয়ম করে নিন। যেমন, প্রত্যেক নামাজের পর ৫০/১০০/২০০ বার أسْتَغْفِرُ اللهَ অথবা أسْتَغْفِرُ اللهَ وَأتُوبُ إلَيهِ অথবা اللَّهُمَّ اغْفِرْ لي পড়ার নিয়ম করে নিতে পারেন। কেননা, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
مَا أَصَرَّ مَنِ اسْتَغْفَرَ وَإِنْ عَادَ فِي الْيَوْمِ سَبْعِينَ مَرَّةً
যে ব্যক্তি দিনে সত্তরবার করে একই গুনাহ করার পরও আল্লাহর কাছে গুনাহের জন্য ক্ষমা চাইবে, (ইস্তেগফার করবে) সে যেন প্রকৃতপক্ষে গুনাহ বার বার করে নি। (তিরমিযী ৩৫৫৯)
৪০. অধিকহারে তাওবা করুন
হাফেজ ইবনু তাইমিয়া রহ. লিখেছেন, এক ব্যক্তি তাঁর শায়েখকে বলল, আমার গুনাহ হয়ে যায় কী করব? শায়েখ বললেন, তাওবা করবে। লোকটি বলল, তাওবা করার পর যদি আবার গুনাহ হয়? শায়েখ বললেন, তাওবা করবে। লোকটি বলল, যদি আবারও গুনাহ হয়? শায়েখ বললেন, এবারও তাওবা করবে। লোকটি বলল, কত বার তাওবা করব? শায়েখ উত্তর দিলেন, إلى أن تُحْزِنَ الشيطان শয়তানকে পেরেশান করা পর্যন্ত তাওবা করতেই থাকবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَهُوَ الَّذِي يَقْبَلُ التَّوبَةَ عَنْ عِبَادِهِ وَيَعْفُو عَنِ السَّيِّئَاتِ
আর তিনিই তাঁর বান্দাদের তাওবা কবুল করেন ও পাপসমূহ মোচন করেন এবং তোমরা যা কর তিনি তা জানেন। (সূরা শূরা ২৫)
৪১. ঘুমানোর সময় ইসলামী আদবগুলো মেনে চলুন
যেমন ঘুমানোর দোয়াগুলো পড়া, ডান পার্শ্বে কাত হয়ে শোয়া, পেটের উপর ভর দিয়ে না-ঘুমানো; যেহেতু এ সম্পর্কে নবী ﷺ-এর নিষেধ আছে।
বিশেষ করে অজু করে এবং আয়াতুল কুরসি পড়ে ঘুমাবেন।
কেননা, এক দীর্ঘ হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় আয়াতুল কুরসি পড়বে, সে সকাল পর্যন্ত শয়তান থেকে পরিত্রাণ পাবে। (সহীহ ইবন হিব্বান ৭৯১)
৪২. বেশী করে আল্লাহর জিকির করুন
কেননা, জিকির শয়তান থেকে আত্মরক্ষার শক্তিশালী দুর্গ। আল্লাহ তাআলা বলেন,
اسْتَحْوَذَ عَلَيْهِمُ الشَّيْطَانُ فَأَنسَاهُمْ ذِكْرَ اللَّهِ أُوْلَئِكَ حِزْبُ الشَّيْطَانِ أَلَا إِنَّ حِزْبَ الشَّيْطَانِ هُمُ الْخَاسِرُونَ
শয়তান তাদেরকে বশীভূত করে নিয়েছে, অতঃপর আল্লাহর জিকির ভুলিয়ে দিয়েছে। তারা শয়তানের দল। সাবধান, শয়তানের দলই ক্ষতিগ্রস্ত। (সূরা মুজাদালাহ ১৯)
নিয়মিত জিকির করতে পারলে -ইন শা আল্লাহ- ধীরে ধীরে আল্লাহর সান্নিধ্যের সার্বক্ষণিক অনুভূতি অন্তরে বসে যাবে এবং গুনাহর চিন্তা থেকে বের হওয়া সহজ হয়ে যাবে।
৪৩. রাস্তাঘাটে চলাফেরার সময় জিকিরের গুরুত্ব দিন
আল্লাহ তাআলা বলেন,
اِنَّ الذِّيْنَ اتَّقَوْا اِذَا مَسَّهُمْ طَائِفٌ مِّنَ الشَّيْطَانِ تَذَكَّرُوْا فَاِذَا هُمْ مُّبْصِرُوْنَ
নিশ্চয় যারা আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে যখন তাদেরকে শয়তানের কোনো দল ঘিরে ধরে তখন তারা আল্লাহর জিকির করে। সুতরাং তাদের অনুভূতি ফিরে আসে।
আয়াতটিতে এ রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে যে, যখনই শয়তান আক্রমন করবে, অন্তরে কুমন্ত্রণা ঢেলে দিবে তখনই জিকিরের অস্ত্র ব্যবহার করে তা প্রতিহত করবে। এজন্য রাস্তাঘাটে চলাফেরার সময় জিকিরের প্রতি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। সম্ভব হলে তাসবীহ রাখবেন। অন্যথায় মনে-মনে জিকির করবেন। অলসতা গুনাহর অন্যতম ভূমিকা। সুতরাং জিকির দ্বারা অলসতা দূর করুন। জিকিরের আলো অন্তরে অপার্থিব প্রশান্তির জন্ম দেয়। তখন নিষিদ্ধস্থানে চোখও তুলতে মন চায় না।
৪৪. সময়ের মূল্য দিন
শাইখুল ইসলাম মুফতি তাকী উসমানী দা. বা. বলেন, সময়কে গুনাহর মধ্য দিয়ে কাটানোর ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। কখনও অবসর সময় কাটাবে না। যখনই নির্জনে থাকবে, অবসর থাকবে তখনই নিজেকে কোনো কাজে ব্যস্ত করে নিবে। কাজটি দুনিয়ার বৈধ কাজ হলেও অসুবিধা নেই। তবুও আল্লাহর নাফরমানির ভেতর সময় নষ্ট করো না। আর যদি কাজটি হয় ভাল বই পড়া, জিকির-মোরাকাবা করা, তেলাওয়াত করা তাহলে তো সবচে’ ভাল। তিনি বলেন, আমাদের শায়েখ ও মুর্শিদ ডা. আব্দুল হাই আরেফী রহ. বলতেন, ‘কাজের ভেতরে কাজ ঢুকিয়ে দাও। অবসর আছো তো কোনো কাজের প্রোগ্রাম করে নাও। হাতে একটি কাজ আছে তো আরেকটি কাজের প্রোগ্রাম বানিয়ে নাও।’
দেখুন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
نِعْمَتَانِ مَغْبُونٌ فِيهِمَا كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ الصِّحَّةُ وَالْفَرَاغُ
দুটো নিয়ামত এমন যে দুটোর বিষয়ে বহু লোক ধোঁকায় নিপতিত- স্বাস্থ্য এবং অবসর। (তিরমিযী ২৩০৭)
৪৫. আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা ঠিক রাখুন
অর্থাৎ বন্ধুত্ব ও শত্রুতা উভয়টিই আল্লাহর জন্য। সুতরাং মুমিনদের সাথে সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব রাখুন। আর কাফিরদের সাথে শত্রুতা রাখুন ও সম্পর্কচ্ছেদ করুন। কেননা, আমাদের অধিকাংশ গুনাহ হয় কাফিরদের অপসংস্কৃতি অনুসরণ করার কারণে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ
নিঃসন্দেহ তোমাদের বন্ধু হচ্ছেন কেবলমাত্র আল্লাহ্ এবং তাঁর রসূল, আর যারা ঈমান এনেছে, আর যারা নামায কায়েম করে, আর যাকাত আদায় করে, আর তারা রুকুকারী। (সূরা মায়িদা ৫৫)
রাসূল্লাহ ﷺ বলেছেন,
مَن أحبَّ للَّهِ وأبغضَ للَّهِ ، وأعطى للَّهِ ومنعَ للَّهِ فقدِ استَكْملَ الإيمانَ
যে আল্লাহর জন্য ভালবাসে, আল্লাহর জন্য ঘৃণা করে, আল্লাহর জন্য প্রদান করে এবং আল্লাহর জন্য প্রদান থেকে বিরত থাকে সে ঈমান পরিপূর্ণ করেছে। (আবু দাউদ ৪৬৮১)
৪৬. ইলম শিখুন
কেননা, ইলম আপনাকে সঠিক পথের দিশা দিবে। ভালো-মন্দের পার্থক্য শিখিয়ে দিবে। ইমাম রাযী রহ. দীনি ইলমকে বৃষ্টির সঙ্গে তুলনা করে এর ৫ টি অসাধারণ উপকারিতা তুলে ধরেছেন। তন্মধ্যে অন্যতম হলো, বৃষ্টির কারণে জমিন যেভাবে ফসল উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত হয়। তেমনি দীনি ইলম অর্জনের মধ্য দিয়ে মানুষের নৈতিক ও মানবিক গুণগুলো অর্জিত হয়। অনুরূপভাবে বৃষ্টি ব্যতীত যেমন জমিন থেকে ভালো ফসল উৎপন্ন হয় না, ঠিক দীনি জ্ঞান ব্যতীত মানুষও আল্লাহ তাআলার ইবাদাত-বন্দেগীতে লিপ্ত হতে সক্ষম হয় না। (তাফসীরে কাবীর ২/১৯৮)
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন,
مَن سلَكَ طريقًا يلتَمِسُ فيهِ علمًا ، سَهَّلَ اللَّهُ لَهُ طريقًا إلى الجنَّةِ
যে ব্যক্তি ইলম শিক্ষার জন্য কোনো পথ অবলম্বন করে আল্লাহ তার জান্নাতের পথ সহজ করে দেন। (সহীহ মুসলিম ২৬৯৯)
৪৭. প্রতি দিন সকালে ‘মুশারাতা’ তথা মনের সঙ্গে অঙ্গীকার করুন
অর্থাৎ সকালে ঘুম থেকে জেগে নফসের কাছে এ মর্মে অঙ্গীকার নেবে যে, আজ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো গুনাহ করবো না। আমার দায়িত্বে যত ফরয, ওয়াজিব এবং সুন্নাত আছে সব ঠিকমত আদায় করবো। আমার ওপর আল্লাহর যত হক আছে, বান্দার হক আছে সব পুরোপুরি আদায় করবো। হে নফস! মনে রেখ, ভুলক্রমে অঙ্গীকারের বিপরীত কোনো কাজ করলে তোমাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে।’ এই হলো প্রথম কাজ। ইমাম গাযালী রহ. এর নাম দিয়েছেন তিনি ‘মুশারাতা’ বা ‘আত্ম অঙ্গীকার’।
শাইখুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী বলেন, ইমাম গাযালী রহ. এর কথার সাথে একটু সংযোগ করে বলা যায়, এই ‘আত্ম অঙ্গীকারের’ পর আল্লাহর কাছে দোয়া করা, ‘হে আল্লাহ, আজ আমি গুনাহ করবো না বলে অঙ্গীকার করেছি। আমি সব ফরজ, ওয়াজিব আদায় করবো। শরীয়ত অনুযায়ী চলবো। হুকুল্লাহ এবং হুকুকুল ইবাদ সঠিকভাবে আদায় করবো। কিন্তু ইয়া মাবুদ, আপনার তাওফীক ছাড়া এই প্রতিজ্ঞার ওপর অটল থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যেহেতু আমি পণ করেছি, তাই আপনি আমাকে তাওফীক দিন। আমাকে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা থেকে রক্ষা করুন। পুরোপুরিভাবে এ প্রতিজ্ঞার ওপর অটল থাকার তাওফীক দান করুন।
৪৮. পুরো দিন নিজের আমলের ‘মুরাকাবা’ করুন
‘মুশারাতা’ তথা মনের সঙ্গে অঙ্গীকার করার পর নিজের কাজে বেরিয়ে যান। চাকরি করলে চাকরিতে, ব্যবসা করলে ব্যবসায়, দোকান করলে দোকানে চলে যান। সেখানে গিয়ে একটি কাজ করুন যে, প্রতিটি কাজ শুরু করার আগে একটু ভেবে দেখুন, এই কাজটি প্রতিজ্ঞার খেলাফ কি-না। এই শব্দ যা উচ্চারণ করছি তা প্রতিজ্ঞা পরিপন্থী কি-না। যদি প্রতিজ্ঞা পরিপন্থী মনে হয় তাহলে তা থেকে বাঁচার চেষ্টা করুন। এটাকে ইমাম গাযালী রহ. বলেছেন ‘মুরাকাবা’।
৪৯. শোয়ার আগে ‘মুহাসাবা’ করুন
মুশারাতা ও মুরাকাবা করার পর আরেকটি করতে হবে শোয়ার আগে, আর তা হলো ‘মুহাসাবা’ অর্থাৎ নফসকে বলবেন, তুমি সারাদিন গুনাহ করবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলে। প্রতিটি কাজ শরিয়তমত করবে। হুকুকুল্লাহ তথা আল্লাহর হক ও হুকুকুল ইবাদ তথা বান্দার হক ঠিক মত আদায় করবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলে। এখন বলো কোন কাজ তুমি প্রতিজ্ঞামত করেছ, আর কোন কাজ প্রতিজ্ঞামত কর নি? এভাবে সারাদিনের সকল কাজের হিসাব গ্রহণ করবেন। সকালে যখন বাড়ি ত্যাগ করলে তখন অমুক লোককে কি বলেছ? চাকরি ক্ষেত্রে গিয়ে নিজ দায়িত্ব কতটুকু পালন করেছ? ব্যবসা কীভাবে পরিচালনা করেছ? হালালভাবে না হারাম পদ্ধতিতে? যত লোকের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে তাদের হক কিভাবে আদায় করেছ? বিবি, বাচ্চার হক কিভাবে আদায় করেছ? ইমাম গাযালী রহ. বলেন, এভাবে যাবতীয় কাজের হিসাব নেয়াকে ‘মুহাসাবা’ বলা হয়।
মুহাসাবা’র ফলাফল যদি এই হয় যে, ‘সকালের প্রতিজ্ঞায় আপনি সফল’ তাহলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবেন। শুকরিয়া আদায় করলে আল্লাহ তাআলা তা বৃদ্ধি করে দেন।
কিন্তু ‘মুহাসাবা’র ফলাফল যদি এই দাঁড়ায় যে, অমুক স্থানে প্রতিজ্ঞার পরিপন্থী কাজ করেছেন, অমুক সময় প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছেন, পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন এবং স্বীয় কৃত প্রতিজ্ঞার ওপর অটল থাকতে পারেন নি, তাহলে তৎক্ষণাৎ তাওবা করুন, বলুন, ‘হে আল্লাহ! আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, কিন্তু শয়তানের প্ররোচনায়, প্রবৃত্তির তাড়নায় প্রতিজ্ঞার ওপর অটল থাকতে পারি নি। হে মাবুদ! আমি আপনার কাছে তাওবা করছি এবং ক্ষমা চাচ্ছি। আপনি আমার তাওবা কবুল করে আমার পাপ মাফ করে দিন। ভবিষ্যতে আমাকে প্রতিজ্ঞার ওপর অটল থাকার তাওফীক দান করুন।
৫০. মুআকাবা তথা নফসকে শাস্তি দিন
তাওবার সাথে সাথে নফসকে একটু শাস্তিও দিন। যেমন, নফসকে বলুন, তুমি প্রতিজ্ঞার খেলাফ কাজ করেছ, সুতরাং শাস্তি স্বরূপ তোমাকে আট রাকাত নফল সালাত আদায় করতে হবে। এ শাস্তিটা প্রভাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার সময়ই নির্ধারণ করুন। সুতরাং রাতে নফসকে বলবেন, তুমি নিজের সুখ-শান্তির জন্য, সামান্য আনন্দ উপভোগের জন্য আমাকে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গে লিপ্ত করেছ। অতএব এখন তোমাকে সাজা ভোগ করতে হবে। তোমার শাস্তি হলো, এখন শোয়ার আগে আট রাকাত নফল সালাত আদায় করো। তারপর বিছানায় যাও। এর আগে বিছানায় যাওয়া নিষেধ।
ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব রাযি. বলেতেন,
حاسبوا أنفسكم قبل أن تحاسبوا فإنه أهون لحسابكم وزنوا أنفسكم قبل أن توزنوا وتجهزوا للعرض الأكبر
আল্লাহর নিকট তোমাদের হিসাব দানের আগে তোমরা নিজেরা নিজেদের হিসাব গ্রহণ করো এবং (আল্লাহর নিকটে) ওযনের আগে নিজেরা নিজেদের ওযন করো। কেননা এটা করা তোমাদের জন্য তুলনামূলক সহজ। আর তোমরা সবচেয়ে বড় আরয বা হিসাবের জন্য পাথেয় জোগাড় করো।
৫১. পরকালের মুরাকাবা করুন
অর্থাৎ প্রতিদিন চোখ বন্ধ করে এই কথার ধ্যান করুন যে, এ দুনিয়ায় আমি চিরকাল থাকার জন্য আসিনি। অনেক বড় বড় রাজা-বাদশাহ ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিবর্গ এসেছিলেন, কিন্তু তারা আজ কবর জগতের বাসিন্দা। কেউ তাদের আজ খোঁজখবরটুকু নেয় না। যেই শরীর ও দেহ নিয়ে তারা গর্ব করেছিল মাটি ও পোকামাকড় তা খেয়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে। আমাকেও একদিন তাদের মতো হতে হবে। অতএব কী হবে এই দুনিয়ায় অহংকারী ও আত্মবিলাসী হয়ে অকারণে জুলুম-নির্যাতন করে মানুষকে কষ্ট দিয়ে, সর্বোপরি ঈমান-আমলকে ঠিক না করে সে পথের অভিযাত্রী হয়ে!
আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَلْتَنظُرْ نَفْسٌ مَّا قَدَّمَتْ لِغَدٍ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَاتَعْمَلُونَ
হে ঈমানদাররা তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমাদের প্রত্যেকেরই চিন্তা করা উচিত আগামীকালের জন্য (পরকালের জন্য) সে কী প্রেরণ করেছে। (সূরা হাশর ১৯)
৫২. অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের হিসাব নিন
মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করে নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের হিসাব নিন। মস্তিস্ক থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে পা’ পর্যন্ত হিসাব নিন। এটাও এক প্রকার মুহাসাবা। যেমন, নিজেকে জিজ্ঞেস করবেন, আল্লাহ যে মস্তিস্ক না দিলে আমি পাগল হতাম তা দিয়ে আমি কী চিন্তা করেছি! আল্লাহ যে চোখ না দিলে আমি অন্ধ হতাম তা দিয়ে আমি কী কী দেখে থাকি! আল্লাহ যে কান না দিলে আমি বধির হতাম তা দিয়ে আমি কী কী শুনে থাকি! আল্লাহ যে যবান না দিলে আমি বোবা হতাম তা দিয়ে আমি কী কী বলে থাকি!
এভাবে সর্ব শেষ পায়ের হিসাব নিন যে, আল্লাহ যে পা না দিলে আমি প্রতিবন্ধী হতাম তা দিয়ে আমি কী কী কাজ করে থাকি!
তারপর অঙ্গগুলোর কোনোটি থেকে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটে থাকলে প্রতিকার হিসাবে অঙ্গগুলোকে আল্লাহর আনুগত্যমূলক কাজে নিয়োজিত রাখবেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا
নিশ্চয়ই তোমার কর্ণ, চক্ষু ও বিবেক প্রতিটিই জিজ্ঞাসিত হবে। (সূরা বনী ইসরাঈল ৩৬)
তিনি আরো বলেছেন,
لَتُسْأَلُنَّ يَوْمَئِذٍ عَنِ النَّعِيمِ
অতঃপর তোমরা অবশ্যই সেদিন তোমাদেরকে দেওয়া নেয়ামতরাজি সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। (সূরা তাকাছুর ৮)
৫৩. ভাবুন, কেন আপনি এখনও জীবিত?
আল্লাহ আপনাকে সৃষ্টি করছেন কেন? কেন আপনি এখনও জীবিত? অশ্লীলানন্দ আর পাপাচারের মাঝে ডুবে থাকার জন্য? না, মোটেও নয়। বরং আল্লাহ তো বলেছেন,
أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا وَأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْجَعُونَ
তোমরা কি ভেবেছিলে যে, আমি তোমাদেরকে তামাশার বস্তু হিসেবে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনা হবে না? (সূরা মুমিনূন ১১৫)
আল্লাহ আপনাকে সৃষ্টি করছেন তার ইবাদত করার জন্য। আপনাকে জীবনও দিয়েছেন এই জন্য।
আল্লাহ বলেন,
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ
আমি জ্বিন ও মানবকে সৃষ্টি করেছি একমাত্র এ কারণে যে, তারা আমারই ইবাদত করবে। (সূরা যারিয়াত ৫৬)
الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا
যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন- ‘আমালের দিক দিয়ে তোমাদের মধ্যে কোন্ ব্যক্তি সর্বোত্তম? (সূরা মুলক ০২)
সুতরাং গুনাহ করার আগে ভেবে দেখুন, আপনি কী করছেন?
৫৪. মনে রাখবেন, আল্লাহ ছাড় দেন, ছেড়ে দেন না
সব সময় মনে রাখবেন, আল্লাহ তাঁর প্রতিটি বান্দাকেই পাপ থেকে ফিরে আসার সুযোগ দেন। নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ছাড় দিতে থাকেন। এই ছাড় পেয়ে যারা নিজেকে শুধরে নেয় এবং তাওবা করে, তিনি তাদের ক্ষমা করেন। আর যারা ছাড় পেয়ে পাপের মহাসাগরে ডুব দেয়, নির্দিষ্ট সময় পরেই তাদের পাকড়াও করেন। তখন আর আল্লাহর আজাব থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোনো সুযোগ তাদের থাকে না।
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন,
إنَّ اللهَ تبارَك وتعالَى يُملي ، – وربَّما قال : يمهلُ للظَّالِمِ ، حتَّى إذا أخذَه لم يُفلِتْهُ ، ثمَّ قرأ : وَكَذَلِكَ أَخْذُ رَبِّكَ إِذَا أَخَذَ الْقُرَى وَهِيَ ظَالِمَةٌ الآيةَ
বরকতময় আল্লাহ তাআলা যালিম-অত্যাচারীকে অবকাশ দেন অথবা সুযোগ দেন। অবশেষে তিনি যখন তাকে পাকড়াও করেন তখন আর রেহাই দেন না। তারপর রাসূলুল্লাহ ﷺ তিলাওয়াত করলেন (অনুবাদ):
“এরূপই তোমার প্রতিপালকের শাস্তি। তিনি জনপদসমূহকে শাস্তিদান করেন যখন তারা সীমালঙ্ঘন করে। নিশ্চয় তার শাস্তি মর্মস্তুদ, কঠিন” (সূরা হুদ ১০২)।
৫৫. ইসলামের সৌন্দর্য সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি সম্পর্কে জানুন
কেননা, ইসলামের সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্য যুগে যুগে মানুষকে মুগ্ধ করেছে এবং গুনাহ ত্যাগ করে ইবাদতের প্রতি ধাবিত করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَكِنَّ اللَّهَ حَبَّبَ إِلَيْكُمُ الْإِيمَانَ وَزَيَّنَهُ فِي قُلُوبِكُمْ وَكَرَّهَ إِلَيْكُمُ الْكُفْرَ وَالْفُسُوقَ وَالْعِصْيَانَ أُوْلَئِكَ هُمُ الرَّاشِدُونَ
আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ঈমানের মহব্বত সৃষ্টি করে দিয়েছেন এবং তা হৃদয়গ্রাহী করে দিয়েছেন। পক্ষান্তরে কুফর, পাপাচার ও নাফরমানীর প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তারাই সৎপথ অবলম্বনকারী। (সূরা হুজুরাত ৭)
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
غُضُّوْا اَبْصَارَكمُ وَاحْفَظُوْا فُرُوْجَكُمْ
তোমরা দৃষ্টি অবনত রাখো এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত কর। (আলজাওয়াবুলকাফী, পৃষ্ঠা : ২০৪)
হাফেজ ইবনুল কাইয়িম রহ. লিখেছেন, দৃষ্টি জৈবিকচাহিদার পিয়ন ও রাহবার হয়ে থাকে। দৃষ্টির সংরক্ষণ মূলতঃ লজ্জাস্থান ও যৌনচাহিদা পূরণের অবাধ সুযোগের সংরক্ষণ হয়ে থাকে। যে দৃষ্টিকে অবাধে বিচরণ করতে দিয়েছে সে নিজেকে ধ্বংসের মাঝে ফেলে দিয়েছে। মানুষ যেসব আপদে নিমজ্জিত হয় এর মূলভিত্তি হল দৃষ্টি। (আলজাওয়াবুলকাফী, পৃষ্ঠা-২০৪)
৫৭. এই কল্পনা ধরে রাখুন
আল্লাহ তাআলা বলেন,
اِنَّ اللهَ يَاْمُرُكُمْ اَنْ تَؤَدُّوْا الْاَماناتِ اِلى اَهْلِهَا
নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন আমানত তার হকদারকে দিয়ে দিতে। (সূরা নিসা ৫৮)
বিশেষ করে কুদৃষ্টির গুনাহ থেকে বাঁচার জন্য এই কল্পনা ধরে রাখুন যে, আমার চোখ আল্লাহপ্রদত্ত আমানত। এই আমানত ব্যবহার করতে হবে তাঁরই নির্দেশ অনুপাতে। বিপরীত করলে আমানতের খেয়ানতকারী হয়ে যাব। সাধারণত নিয়ম হল, আমানতে একবার খেয়ানত করলেও তার কছে দ্বিতীয়বার আমানত রাখা হয় না। এমন যেন না হয় যে, দুনিয়াতে আল্লাহর দেয়া দৃষ্টিশক্তি পরনারীর পেছনে ব্যয় করলাম, পরিণামে তিনি আমার দৃষ্টিশক্তি আখেরাতে ফেরত দিবেন না। ওইদিন যদি অন্ধ হয়ে ওঠতে হয় তাহলে কী অবস্থা হবে? পবিত্র কুরআনে এটার প্রমাণ আছে যে, আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন কিছুলোককে অন্ধ করে ওঠাবেন। তখন তারা জিজ্ঞেস করবে,
رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِىْ اَعْمى وَقَدْ كُنْتُ بَصِيْرًا
প্রভু! আমাকে অন্ধ বানিয়ে ওঠালেন কেন? আমার তো দৃষ্টিশক্তি ছিল!
৫৮. আল্লাহর নিয়মের কথা ভাবুন
নিজেকে বুঝান যে, আল্লাহর একটা নিয়ম আছে। কেউ যখন কোনো গুনাহর কাজ শুরু করে তখন আল্লাহ তার সঙ্গে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার আচরণ করেন। এতেও যদি বান্দা পিছু না হটে তাহলে তার সঙ্গে তিনি কিছু দিন যাবত দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখার আচরণ করতে থাকেন। এরপরেও ফিরে না আসলে আল্লাহ তাকে সাজা দেয়ার ইচ্ছা করেন। আর যে দুর্ভাগার ব্যাপারে তিনি শাস্তির ইচ্ছে করেন তাকে তিনি নাচিয়ে ছাড়েন। তখন তাকে ঘরে বসিয়ে রেখে লাঞ্ছিত করে ছাড়েন। এমন কি অন্যের জন্য ওই শাস্তিকে দৃষ্টান্ত বানিয়ে দেন। সুতরাং এভাবে ভাবুন, আমি অনেক দিন থেকে অমুক গুনাহয় লিপ্ত। এখন পর্যন্ত আল্লাহৎতাআলা দোষ গোপন করে রাখার আচরণ করছেন। যদি শাস্তি দেয়ার ইচ্ছা করে ফেলেন তাহলে আমার দীন-দুনিয়া উভয়টাই যাবে। আমার কিছু থাকবে না।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَنْ يُّهِنِ اللهُ فَمَا لَهُ مِنْ مُكْرِمٍ
আল্লাহ যাকে লাঞ্ছিত করেন, তার সম্মানদাতা কেউ নেই। (সূরা হজ্ব ১৮)
আয়াতটি নিয়ে ভাবলে গুনাহ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়া যায়।
৫৯. স্ত্রীকে সন্তুষ্ট রাখুন
নিজের স্ত্রীর সাথে মধুর সম্পর্ক বজায় রাখুন। তার সব বিষয়েয় প্রতি লক্ষ্য রাখুন। ঘরের স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে ভালোবাসামোহিত ঘনিষ্ঠতা ধরে রাখতে পারলে মুচকি হেসে স্বামীকে অভ্যর্থনা জানালে স্বামীর চিন্তা পরনারীর প্রতি যায় না। একটু ভেবে দেখুন, যদি স্বামী-স্ত্রীর প্রতিদিনের সম্পর্কটা বিরক্তিমাখা ঝগড়াপূর্ণ হয়, মন খারাপ করে স্বামী নাস্তা ছাড়া অফিসে চলে যায়, আর সেখানে পর্দাহীনা কোনো সহকর্মী হাসির আভা ছড়িয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে, স্যার! কেমন আছেন আপনি! তখন এই নারীর এই হাসিটা দাম্পত্যজীবনের জন্য বিষের ভূমিকা পালন করে। এভাবেই সংসারে ভাঙ্গন ধরে। ঘরে যখন সুন্দরী স্ত্রী ঝগড়াটে হয় তখন বাইরের কুশ্রী নারীও ‘জান্নাতের হূর’ মনে হয়। এজন্য স্বামী-স্ত্রী উভয়ের চেষ্টা থাকা উচিত, সংসারে যেন প্রেম-ভালোবাসার পরিবেশ থাকে। তখন বাইরের প্রতিকূলতা থেকে নিরাপদ থাকা সহজ হবে। সাধারণত কুদৃষ্টির গুনাহর শিকার হন তারাই যাদের স্ত্রী নেই কিংবা স্ত্রী থাকলেও জৈবিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে স্ত্রী পরিপূর্ণ তৃপ্তি দিতে পারে না। পবিত্র কুরআনে স্ত্রীর ‘উদ্দেশ্য’ বলা হয়েছে-
لِتَسْكُنُوْآ اِلَيْهَا
যাতে তাদের কাছে স্বস্তি লাভ কর।
যে স্ত্রীর কাছে স্বামী অস্বস্তিতে থাকে, সে স্ত্রী আল্লাহর কাছে কী জবাব দিবে? এখনকার যুবকেরা যে উদ্দীপনা নিয়ে অশ্লীল ভিডিও দেখে অনুরূপ আগ্রহ নিয়ে যদি নিজের স্ত্রীকে দেখত তাহলে তাকে জান্নাতের হূর মনে হত। প্রসিদ্ধ আছে, ভালোবাসার আতিশয্যের কারণে জুলায়খা প্রতিটি জিনিসের নাম রেখেছিলেন ‘ইউসুফ’। তার কাছে ইউসুফ ছাড়া দুনিয়ার অন্যকিছু চোখে ভাসত না। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে এরূপ অকৃত্রিম ভালোবাসা থাকলে স্বামীর দৃষ্টি পরনারীর প্রতি যাবে না।
৬০. নিজের নফসের সাথে বিতর্ক করুন
যখন মনে গুনাহর চিন্তা আসবে তখন তার সাথে বিতর্ক করুন যে, হে নফস! বা হে মন! তোমার নাম এত উঁচু অথচ তোমার কর্মকান্ড কত নিচু। তুমি সৃষ্টিকুলের চোখে আল্লাহর বন্ধু, কিন্তু কাজ কর তাঁর দুশমনের মত। বাহ্যিকদৃষ্টিতে ঈমানদার অথচ ভেতরে-ভেতরে পাক্কা গুনাহগার। লেবাসে-সূরতে ‘লা-ইলাহা’, লোকচক্ষুর আড়ালে ‘প্রতিমা-প্রতিমা।’ মানুষের সামনে আল্লাহর বান্দা, অন্দরমহলে শয়তানের গোলাম। তোমার যবান আল্লাহর তলবগার, তোমার চোখে পরনারীর পেয়ার। তুমি সকলের কাছে সাধাসিধে সূফী-বেচারা কিন্তু স্রষ্টার দৃষ্টিতে ক্ষমাযোগ্য বেচারা। তোমার উপরটা সুন্নাতসমৃদ্ধ, অথচ ভেতরটা যৌনতাতাড়িত। মাখলুকের কাছে তোমার স্বভাবচরিত্র গোপন, কিন্তু স্রষ্টার কাছে তো সবই দৃশ্যমান। দৃশ্যত তুমি জান্নাত প্রত্যাশী, বাস্তবে তুমি জাহান্নাম খরিদকারী। তোমার জন্য এই লোকসানের ব্যবসা থেকে ফিরে আসাটাই শ্রেয়। ছাড়ো এ ক্ষতির ব্যবসা। আল্লাহ তোমার জন্য তাওবার দরজা খোলা রেখেছেন। হতে পারে এটাই তোমার জন্য সুযোগ লুফে নেয়ার আখেরি দিন। পরে আক্ষেপ অনুশোচনার মাঝে কোনো ফায়দা নেই।
اب پچهتاۓ كيا ہوت
جب چڑيا ں چك گئيں كهيت
এখন আফসোস করে কী হবে!
চড়ুইরা তো ক্ষেত বিরাণ করে দিয়েছে।
কয়েকবার নিজের নফসের সাথে এভাবে বিতর্ক করলে বিশেষ করে গোপন গুনাহর ব্যাপারে তার দাপানি যথেষ্ট কমে আসবে।
৬১. পরিবেশ পাল্টান
গুনাহর পরিবেশ থেকে দূরে থাকুন। গুনাহর পরিবেশ থেকে নিজেকে দূরে রাখা এটা নবীগণের একটি তরিকা। দেখুন, হযরত ইউসুফ আ. জুলাইখার কাছে ছিলেন। জুলাইখা তাঁকে গুনাহর প্রতি আহবান করেছিল। গোপন গুনাহর পরিবেশও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ইউসুফ আ. এই পরিবেশকে পছন্দ করলেন না। তিনি গুনাহর পরিবেশ -যদিও তা ছিল আরাম-আয়েশের- বর্জন করে জেলখানার পরিবেশ বেছে নিলেন। তবুও গুনাহর পরিবেশে থাকাটাকে তিনি পসন্দ করেন নি। বরং তিনি আল্লাহর কাছে এই দোয়া করেছিলেন,
رَبِّ السِّجْنُ أَحَبُّ إِلَيَّ مِمَّا يَدْعُونَنِي إِلَيْهِ
হে আমার রব! তারা আমাকে যে কাজের দিকে আহবান করে, তার চাইতে আমি কারাগারই পছন্দ করি। (সূরা ইউসুফ ৩৩)
সুতরাং আমরাও এটা করব। গুনাহর পরিবেশ থেকে নিজেকে দূরে রাখব। বাসায় টিভি ভিসিআরের পরিবেশ পাল্টিয়ে সেখানে তালিমের পরিবেশ, আমলের পরিবেশ, তেলাওয়াতের পরিবেশ, জিকির-মুরাকাবা, দোয়ার পরিবেশ গড়ে তুলব। এর কারণে দুনিয়ার কিছু মজা তো ছাড়তে হবে। কিন্তু ছাড়বেন কার জন্য? আল্লাহর জন্য। আল্লাহর জন্য গুনাহর মজা ছাড়তে পাড়লে এর পরিবর্তে তিনি ঈমানের মজা দান করবেন। আর ঈমানের মজা তো এমন মজা যার জন্য কত মানুষ তাদের জানও দিয়ে দিয়েছে। সাহাবায়ে কেরামের ইতিহাসে যার প্রমাণ হাজার হাজার আছে। হাদিসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহ তাআলা বলেন,
مَنْ تَرَكَهَا مِنْ مَخَافَتِىْ اَبْدَلْتُهُ إِيْمَاناً يَجِدُ حَلَاوَتَه فِىْ قَلْبِه
যে আমার ভয়ে এগুলো ত্যাগ করবে, আমি তার অন্তরে এমন ঈমান সৃষ্টি করব যে, সে তার স্বাদ পাবে। (আততারগীব ওয়াততারহীব ২/৩৭)
৬২. তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ুন
যাতে একদিকে আপনার ঘুমও পূর্ণ হয়, অন্যদিকে যথাসময়ে ফজরের জন্য উঠতেও পারেন। ইসলামের শিক্ষা মূলত এটা যে, এশার পরপরই ঘুমাতে যাওয়া। বিজ্ঞানও এই অভ্যাসের যথার্থতার প্রমাণ প্রকাশ করেছে।
সলফে সালেহীনের যুগে মাঝে মাঝে কিছু লোক সুন্দর সুন্দর কথা নিয়ে বাজারে প্রচার করত। এক ব্যক্তি বাজারে হেঁটে হেঁটে প্রচার করতে লাগলো, أَهْلَكَكُمْ النَّوْمُ ‘হে মানুষ! ঘুম তোমাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছে। অর্থাৎ সে বুঝাতে চাইলো, যে মানুষ ঘুমের কারণে ইবাদত করে না তাই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। তখন একজন আল্লাহওয়ালা তাকে শুধরে দিয়ে বললেন, বিষয়টা এমন নয়। বরং প্রকৃত বিষয় হল, بَلْ أَهْلَكَتْكُمْ الْيَقِظَةُ মানুষকে জেগে থাকাটা ধ্বংস করে দিয়েছে। এর অর্থ হল, জেগে থেকে মানুষ গুনাহ করে। আর এটাই তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছে
এজন্যই বুজুর্গ বলেন, তোমার কথা সংশোধন করো এবং এভাবে বল,
خَفْ اللَّهَ بِالنَّهَارِ وَنَمْ بِاللَّيْلِ
দিনের বেলায় আল্লাহকে ভয় করো আর রাতের বেলায় ঘুমাও। (আদাবুদদুনয়া ওয়াদদীন ১/৯৮)
৬৩. ভাবুন, নির্জনতা আল্লাহ দেন কেন?
ভাবুন, নির্জনতা আল্লাহ দেন কেন? কেন আল্লাহ তাআলার আমাদেরকে একাকীর সময়গুলো দান করেন? আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَٱذْكُرِ ٱسْمَ رَبِّكَ وَتَبَتَّلْ إِلَيْهِ تَبْتِيلًا
আর তুমি তোমার রবের নাম স্মরণ কর এবং একাগ্রচিত্তে তাঁর প্রতি নিমগ্ন হও। (সূরা মুযাম্মিল ০৮)
সুতরাং নির্জন মুহূর্তগুলো আল্লাহ আমাদেরকে দান করেন, যেন আমরা আমাদের রবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে পারি। এজন্যই রাত যখন গভীর হয় তখন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ডাক আসে,
مَن يَدْعُونِي، فأسْتَجِيبَ له؟ مَن يَسْأَلُنِي فأُعْطِيَهُ؟ مَن يَستَغْفِرُني فأغْفِرَ له؟
কে আছে এমন যে আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দিবো? কে আছে এমন যে আমার কাছে দোয়া করবে এবং আমি তার দোয়া কবুল করবো? কে আছে এমন যে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে এবং আমি তাকে ক্ষমা করবো? (সহীহ বুখারী ১১৪৫)
ফুযাইল ইবন আ’য়ায রহ. এক দিন হুসাইন ইবনু যিয়াদ রহ.-এর হাত ধরে বলেন, শোনো হুসাইন!
يَنْزِلُ اللهُ تَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى سَمَاءِ الدُّنْيَا فَيَقُولُ الرَّبُّ : كَذَبَ مَنْ ادَّعَى مَحَبَّتِي إِذَا جَنَّهُ اللَّيْلُ نَامَ عَنِّي ؟ أَلَيْسَ كُلُّ حَبِيبٍ يُحِبُّ خَلْوَةَ حَبِيبِه ؟
আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক রাতে দুনিয়ার আসমানে আসেন। তারপর বলতে থাকেন, যে ব্যক্তি আমার প্রতি ভালোবাসার দাবী করে অথচ রাতের গভীরে ঘুমিয়ে থাকে; সে মূলতঃ মিথ্যা দাবী করলো। প্রত্যেক প্রেমিক কি তার প্রেমাস্পদের সঙ্গে একান্ত সময় কামনা করে না! (আল হুলইয়াহ ৮/৯৯,১০০)
চিন্তা করুন, যে ঘুমিয়ে থাকে, আল্লাহ তাআলা তাকেই বলেন, আমার প্রতি তোমার ভালোবাসার দাবী মিথ্যা। আর আমরা তো ঘুমিয়ে থাকি না; বরং নিশাচর প্রাণীর মত জেগে থাকি। কী নিয়ে জেগে থাকি? এসব ডিভাইস সঙ্গে নিয়ে জেগে থাকি; তাহলে আল্লাহ তাআলার আমাদের ভালোবাসার দাবী কতটুকু সত্য?!
৬৪. ফজরের নামাজের বিশেষ গুরুত্ব দিন
সকল নামাজই গুনাহ থেকে আত্মরক্ষার শক্তিশালী হাতিয়ার। সুতরাং সব নামাজেরই গুরুত্ব দিন। বিশেষ করে ফজরের নামাজের গুরুত্ব দিবেন। গুনাহর প্রতি আসক্তি যত বেশি হোক; যদি এই নামাজের গুরুত্ব দেন, ইন শা আল্লাহ, গুনাহর আসক্তি থেকে বের হতে পারবেন। কেননা হাদীস শরিফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,
يَعْقِدُ الشَّيْطَانُ عَلَى قَافِيَةِ رَأْسِ أَحَدِكُمْ إِذَا هُوَ نَامَ ثَلاَثَ عُقَدٍ، يَضْرِبُ كُلَّ عُقْدَةٍ عَلَيْكَ لَيْلٌ طَوِيلٌ فَارْقُدْ، فَإِنِ اسْتَيْقَظَ فَذَكَرَ اللَّهَ انْحَلَّتْ عُقْدَةٌ، فَإِنْ تَوَضَّأَ انْحَلَّتْ عُقْدَةٌ، فَإِنْ صَلَّى انْحَلَّتْ عُقْدَةٌ فَأَصْبَحَ نَشِيطًا طَيِّبَ النَّفْسِ، وَإِلاَّ أَصْبَحَ خَبِيثَ النَّفْسِ كَسْلاَنَ
তোমাদের কেউ যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন শয়তান তার ঘাড়ের পিছনের দিকে তিনটি গিঠ দেয়। প্রতি গিঠে সে এ বলে চাপড়ায়, তোমার সামনে রয়েছে দীর্ঘ রাত, অতএব তুমি শুয়ে থাক। তারপর সে যদি জাগ্রত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে একটি গিঠ খুলে যায়, পরে অজু করলে আর একটি গিঠ খুলে যায়, এরপর (ফজর) নামাজ আদায় করলে আর একটি গিঠ খুলে যায়। তখন তার সকাল বেলাটা হয়, উৎফুল্ল মনে ও অনাবিল চিত্তে। অন্যথায় সে সকালে উঠে কলূষ কালিমা ও আলস্য সহকারে। (সহীহ বুখারী ১১৪২)
যদি ঘুম থেকে উঠে কিছু জিকির করে নেন, অজু করে নেন, আর নামাজ পড়ে নেন তবে হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী আপনার অন্তর অনেক ফ্রেশ থাকবে। আপনার মনে ভাল ভাল চিন্তা আসবে। আর যদি তা না করেন, তবে হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী আপনার অন্তরটা হবে খবিস অন্তর। সারাদিন গুনাহের চিন্তায় মাথা কিলবিল করবে।
৬৫. প্রতি দিন এক পৃষ্ঠা হলেও কোরআন তেলাওয়াত করুন
ঈমানী দুর্বলতার একটি লক্ষণ হলো গুনাহ ও হারাম কাজে লিপ্ত হওয়া। এর প্রতিকার হিসেবে বেশি পরিমাণে কোরআন তেলাওয়াত করুন কিংবা শুনুন।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا
আর যখন তাদের সামনে পাঠ করা হয় কালাম, তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায়। (সূরা আনফাল ২)
৬৬. জবানের হেফাজত করুন
জবানের লাগামহীনতাও অসংখ্য গুনাহেকে ডেকে আনে। মিথ্যা বলা, গীবত করা, গালি দেয়া, ঝগড়া করা, হারাম খাওয়া থেকে শুরু করে কোন অপরাধটা এই জবান দ্বারা করা যায় না! এ অপরাধগুলো ইবলিস লবণ মরিচ মাখিয়ে নফসের সামনে পেশ করে। নফস তা জবানের মধ্যমে গ্রহণ করে। এজন্যই হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
إِذَا أَصْبَحَ ابْنُ آدَمَ فَإِنَّ الأَعْضَاءَ كُلَّهَا تُكَفِّرُ اللِّسَانَ فَتَقُولُ اتَّقِ اللَّهَ فِينَا فَإِنَّمَا نَحْنُ بِكَ فَإِنِ اسْتَقَمْتَ اسْتَقَمْنَا وَإِنِ اعْوَجَجْتَ اعْوَجَجْنَا
আদম সন্তান যখন সকালে উপনীত হয়, তখন তার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জিভকে অত্যন্ত বিনীতভাবে নিবেদন করে যে, তুমি আমাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। কারণ, আমাদের ব্যাপারসমূহ তোমার সাথেই সম্পৃক্ত। যদি তুমি সোজা সরল থাক, তাহলে আমরাও সোজা-সরল থাকব। আর তুমি যদি বাঁকা পথে যাও তাহলে আমরাও বাঁকা পথে যেতে বাধ্য হব। (তিরমিযী ২৪০৭)
সুতরাং জবানকে হারাম কথা ও হারাম খানা থেকে হেফাজত করুন। এটাও নফসের উপর একপ্রকার শাসন। এর কারণেও ইবলিস নিরাশ হয় আর অপরদিকে আল্লাহ তাআলা খুশি হন। হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,
لا يَسْتَقِيمُ إِيمانُ عبدٍ حتى يَسْتَقِيمَ قلبُهُ ، ولا يَسْتَقِيمُ قلبُهُ حتى يَسْتَقِيمَ لسانُهُ
কোন বান্দার ঈমান দুরস্ত হয় না; যতক্ষণ পর্যন্ত না তার অন্তর দুরস্ত হয় এবং তার অন্তরও দুরস্ত হয় না যতক্ষণ পর্যন্ত না তার জবান দুরস্ত হয়। (মুসনাদে আহমাদ ১০৪০৮)
৬৭. নিম্মের পাঁচটি গুনাহ থেকে বাঁচুন
যদি কেউ পাঁচটি গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে পারে তাহলে আল্লাহ তাআলা তাকে সকল প্রকার গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দিয়ে ওলী বানিয়ে মৃত্যু দিবেন।
এক: কুরআনে কারীম অশুদ্ধ পড়ার গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা।
দুই: চোখের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। (মা-বোনদের জন্য বেপর্দার গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা)।
তিন: অন্তরের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা।
চার: পুরুষদের টাখনুর নীচে কাপড়-পরার গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা।
পাঁচ: এক মুষ্ঠির কমে দাড়ী কাটা ছাটার গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে সব ধরনের গুনাহ থেকে বাঁচার তাওফিক দান করুন। আমীন।
৬৮.আল্লাহওয়ালাদের সোহবত গ্রহণ করুন
আল্লাহওয়ালাদের চেহারা দেখুন, তাঁদের মজলিসে বসুন, তাঁদের কথা শুনুন এবং উৎসাহ-উদ্দীপনা সঞ্চয় করুন, এতে নফস নিয়ন্ত্রণ করা এবং উপরোক্ত সকল পরামর্শ অনুযায়ী চলা আপনার জন্য সহজ হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ اتَّقُواْ اللّهَ وَكُونُواْ مَعَ الصَّادِقِينَ
হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক। (সূরা আত তাওবাহ ১১৯)
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত,
قِيلَ: يَا رَسُولَ اللهِ، أَيُّ جُلَسَائِنَا خَيْرٌ؟ قَالَ: مَنْ ذَكَّرَكُمُ اللهَ رُؤْيَتُهُ، وَزَادَ فِي عِلْمِكُمْ مَنْطِقُهُ، وَذَكَّرَكُمْ بِالْآخِرَةِ عَمَلُهُ
এক ব্যক্তি প্রশ্ন করলো, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাদের বসার সঙ্গী বা মজলিস হিসেবে কোনটি সবচেয়ে উত্তম? রাসুলুল্লাহ ﷺ উত্তর দিলেন, যার সাক্ষাৎ তোমাদেরকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যার কথায় তোমাদের ইলম বেড়ে যায় এবং যার আমল তোমাদেরকে আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। (মুসনাদ ইবন আব্বাস রাযি. ৬৩৮)
আমি আপনাকে আশ্বস্ত করছি, নেক মজলিসের প্রভাব আপনি তখনও নিশ্চিত অনুভব করবেন, যখন রাতের অন্ধকারে স্মার্ট ফোনটা হাতে নিবেন। ব্রাউজিং করার সময় গুনাহর চিন্তা যখন আপনাকে তাড়িত করবে, তখন এই নেক সোহবতের নূর আপনি অনুভব করবেন।
জাফর ইবন সুলাইমান রহ. বলেন,
كنت إذا وجدت من قلبي قسوة غدوت فنظرت إلى وجه محمد بن واسع –وهو تلميذ الإمام الحسن البصري وكان من كبار العباد والصالحين
আমি যখন আমার অন্তরে আল্লাহবিমুখতা অনুভব করতাম তখন মুহাম্মদ ইবন ওয়াসি রহ.-এর চেহারা দেখতাম, যিনি ছিলেন হাসান বসরি রহ.-এর শাগরিদ এবং অনেক বড় আবিদ ও নেককার । (নুযহাতুল ফুযালা ৬৩৮)
৬৯. আল্লাহওয়ালাদের জীবনী ও মালফুযাত পড়ুন
নিজেকে জাগাতে আল্লাহওয়ালাদের জীবনী, তাঁদের সফলতার গল্প, তাঁদের বাণী পড়ুন, জানুন । গুনাহ থেকে দূরে থাকার জন্য খুব বেশি কাজে লাগবে এগুলো। বিখ্যাত বুজুর্গ বিশির হাফী রহ. বলতেন,
حسبك أَن أقواما موتى تحيى القلوب بذكرهم ، وأن أقواما أحياء تقسو القلوب برؤيتهم
তোমার জন্য এটা জানা যথেষ্ট যে, কিছু মৃত মনীষী এমন আছেন যে, তাঁদের আলোচনা করলেও অন্তর জীবিত হয় এবং কিছু জীবিত মানুষ এমন আছে যে, তাদেরকে দেখলেও অন্তর শক্ত হয়ে যায়। (তারিখু দামিশক ১০/২১৪)
৭০. নিম্নোক্ত দোয়াগুলো বেশি বেশি পড়ুন
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الصِّحَّةَ وَالْعِفَّةَ وَالأَمَانَةَ وَحُسْنَ الْخُلُقِ وَالرِّضَا بِالْقَدَرِ
হে আল্লাহ! আপনার কাছে সুস্থতা, গুনাহমুক্ত জীবন, আমানতদারিতা, উত্তম চরিত্র ও তাকদিরের উপর সন্তুষ্টি প্রার্থনা করছি। (বাহরুল ফাওয়াইদ ১৫)
اللهُمَّ اقْسِمْ لَنَا مِنْ خَشْيَتِكَ مَا تُحُولُ بَيْنَنَا وَبَيْنَ مَعَاصِيكَ ، وَمَنْ طَاعَتِكَ مَا تُبَلِّغُنَا بِهِ جَنَّتَكَ
হে আল্লাহ! আপনার প্রতি এমন ভীতি আমাদেরকে দান করুন, যা আমাদের মাঝে এবং আমাদের গুনাহর মাঝে প্রতিবন্ধক হবে এবং এমন আনুগত্য দান করুন, যা আমাদেরকে জান্নাত পর্যন্ত পৌঁছাবে। (তিরমিযী ৩৫০২)