মাহরামকে নিয়ে মনের মাঝে কুচিন্তা আসে; কী করব?

জিজ্ঞাসা–৬৮২:  মাহরাম (ফ্যামিলি মেম্বার) কাউকে নিয়ে যদি মনের মাঝে কুচিন্তা আসে, অবশ্যই অনিচ্ছাকৃত এবং ক্রমাগত এ নিয়ে ইস্তিগফার করার পরও যদি হঠাৎ হঠাৎ এমন হয়, তখন কি করণীয়? এর বিধান কি?–নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক।

জবাব:

এক. মনে গুনাহর চিন্তা আসলে গুনাহ হয় না। তবে কেউ যদি গুনাহর পাকাপোক্ত নিয়ত করে তাহলে গুনাহ হয়। হাদিসে এসেছে, আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ বলেছেন,

إِنَّ اللَّهَ تَجَاوَزَ لِي عَنْ أُمَّتِي مَا وَسْوَسَتْ بِهِ صُدُورُهَا، مَا لَمْ تَعْمَلْ أَوْ تَكَلَّمْ

আল্লাহ আমার উম্মতের অন্তরে উদিত ওয়াসওয়াসা (পাপের চিন্তা ও ইচ্ছা) মাফ করে দিয়েছেন। যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তা কাজে পরিণত করে অথবা মুখে বলে। (বুখারী ২৩৬১)

উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় হাফেজ ইবন হাজর আস্কালানি রহ. বলেন,

والمراد : نفي الحرج عما يقع في النفس ، حتى يقع العمل بالجوارح ، أو القول باللسان على وفق ذلك

এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, মনে যা আসে তার দ্বারা কোনো ক্ষতি হয় না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে কাজ দ্বারা কিংবা কথা দ্বারা চিন্তা অনুপাতে তা বাস্তবায়ন করবে না। ( ফাতহুল বারি ৫/১৬১)

দুই. তবে কুচিন্তা গুনাহের পর্যায়ে গণ্য না হলেও এবং এর দ্বারা কোনো ক্ষতি না হলেও এটি যে গুনাহের পথ রচনাকারী সে বিষয়টি মনে রাখতে হবে। এজন্য আপনার প্রতি আমাদের পরামর্শ হল–

১. আপনি এই ওয়াসওয়াসাকে সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করবেন এবং কল্পিত-মাহরামের যে আচরণ আপনার মাঝে উক্ত কুচিন্তার উদ্রেক করে ওই আচরণের বা অংভঙ্গির মুখোমুখি না হওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। বিনাপ্রয়োজনে তাকে স্পর্শ করা, তার সঙ্গে নির্জনে অবস্থান করা পরিহার করবেন। এমনকি তার প্রতি বিনাপ্রয়োজনে না তাকানোর চেষ্টা করবেন। আবু বকর আল হুসাইনি আশ শাফিঈ বলেন, يحرم النظر إلى المحارم بشهوة بلا خلاف মাহরামের প্রতি কামনার দৃষ্টি দেয়া সকলের মতে হারাম। (কিফায়াতুল আখইয়ার ১/৪৬০)

২. তালিমের পরিবেশ, আমলের পরিবেশ, তেলাওয়াতের পরিবেশ, জিকির-মুরাকাবা, দোয়ার পরিবেশে বেশি বেশি সময় দিবেন। রাসূলুল্লাহ বলেছেন, نِعْمَتَانِ مَغْبُونٌ فِيهِمَا كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ الصِّحَّةُ وَالْفَرَاغُ  দুটো নিয়ামত এমন যে দুটোর বিষয়ে বহু লোক ধোঁকায় নিপতিত- স্বাস্থ্য এবং অবসর। (তিরমিযী ২৩০৭)

৩. আর যখনই নির্জনে থাকবেন, অবসর থাকবেন তখনই নিজেকে কোনো কাজে ব্যস্ত করে নিবেন। কাজটি দুনিয়ার বৈধ কাজ হলেও অসুবিধা নেই।  আর যদি কাজটি হয় ভাল বই পড়া, জিকির-মোরাকাবা করা, তেলাওয়াত করা তাহলে তো সবচে’ ভাল।

৪. কুচিন্তা চলে আসে এমন কাজ ও পরিবেশ–বিশেষত ইন্টারনেটের এডাল্ট কন্টেন্ট থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখুন। গোপন গুনাহর ব্যাপারে আল্লাহকে বেশি ভয় করুন।

৫. প্রত্যেক নামাযের পর দৈনিক অন্তত পাঁচ বার কিছু সময়ের জন্য- দুই থেকে পাঁচ মিনিটের জন্য আল্লাহর সান্নিধ্যের মুরাকাবা করুন। মুরাকাবা এভাবে করবেন- চোখ বন্ধ করবেন। তারপর ভাববেন, ‘আমি যেখানেই থাকি না আল্লাহ আমার সাথে আছেন।’ অথবা এই আয়াতের বিষয়বস্তু নিয়ে চিন্তা করবেন- هُوَ مَعَكُمْ اَيْنَمَا كُنْتُمْ ‘তোমরা যেখানেই তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন।’

এরপর নিজের নফসকে বুঝাবেন যে, দেখো, তুমি আল্লাহর দৃষ্টি থেকে কোনোভাবেই ভাগতে পারবে না। يَعْلَمُ خَائِنَةَ الْأَعْيُنِ وَمَا تُخْفِي الصُّدُورُ  চোখের চুরি এবং অন্তরের গোপন বিষয় তিনি জানেন। (সুরা মু’মিন ১৯)। এভাবে নিয়মিত কিছুদিন করতে পারলে -ইনশা আল্লাহ- ধীরে ধীরে আল্লাহর সান্নিধ্যের সার্বক্ষণিক অনুভূতি অন্তরে বসে যাবে এবং এই রোগ থেকে বের হওয়া সহজ হয়ে যাবে।

. মাঝে মাঝে কবর জেয়ারত করবেন। এর দ্বারা দিল নরম হবে। গুনাহর প্রতি আকর্ষণ কমে যাবে। আমলের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাবে। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ  বলেছেন, فَإِنَّهَا تُرِقُّ الْقَلْبَ ، وَتُدْمِعُ الْعَيْنَ ، وَتُذَكِّرُ الآخِرَةَ কবর জিয়ারত অন্তরকে নরম করে, চোখের পানি বের করে এবং আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। (মুসতাদরাক হাকিম ১৫৩২)

৭. আল্লাহর কাছে এভাবে দোয়া করবেন–

اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الصِّحَّةَ وَالْعِفَّةَ وَالأَمَانَةَ وَحُسْنَ الْخُلُقِ وَالرِّضَا بِالْقَدَرِ

হে আল্লাহ! আপনার কাছে সুস্থতা, গুনাহমুক্ত জীবন, আমানতদারিতা, উত্তম চরিত্র ও তাকদিরের উপর সন্তুষ্টি প্রার্থনা করছি। (বাহ্রুল ফাওয়াইদ ১৫)

اللهُمَّ اقْسِمْ لَنَا مِنْ خَشْيَتِكَ مَا تُحُولُ بَيْنَنَا وَبَيْنَ مَعَاصِيكَ ، وَمَنْ طَاعَتِكَ مَا تُبَلِّغُنَا بِهِ جَنَّتَكَ

হে আল্লাহ! আপনার প্রতি এমন ভীতি আমাদেরকে দান করুন, যা আমাদের মাঝে এবং আমাদের গুনাহর মাঝে প্রতিবন্ধক হবে এবং এমন আনুগত্য দান করুন, যা আমাদেরকে জান্নাত পর্যন্ত পৌঁছাবে। (তিরমিযী ৩৫০২)

৮. যদি বিবাহিত হন তাহলে নিয়মিত স্ত্রীসহবাস করুন। কেননা রাসূলুল্লাহ বলেছেন,

إِذَا أَحَدُكُمْ أَعْجَبَتْهُ الْمَرْأَةُ ، فَوَقَعَتْ فِي قَلْبِهِ ، فَلْيَعْمِدْ إِلَى امْرَأَتِهِ فَلْيُوَاقِعْهَا ، فَإِنَّ ذَلِكَ يَرُدُّ مَا فِي نَفْسِهِ

যখন তোমাদের কাউকে কোন স্ত্রীলোক মুগ্ধ করে এবং তা তার মনকে প্রলূব্ধ করে তখন সে যেন তার স্ত্রীর নিকট আসে এবং তার সাথে মিলন করে। এতে তার মনে যা আছে তা দূর করবে। (মুসলিম ১৪০৩)

আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি আপনাকে উক্ত আমলগুলো করার তাওফিক দিন এবং আপনাকে উক্ত কুমন্ত্রণা থেকে মুক্তি দান করুন। আমিন।

والله اعلم بالصواب
উত্তর দিয়েছেন
শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী
আরো পড়ুন–

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

7 − six =