শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী
হামদ ও সালাতের পর!
আল্লাহ তাআলার লাখো-কোটি শোকর যে, তিনি আমাদেরকে দীর্ঘ একমাস পর আবার এখানে নিজেদের ইসলাহের উদ্দেশ্যে জমায়েত হওয়ার তৌফিক দান করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ। ঈমানদারমাত্রই এইকথা বিশ্বাস করে যে, আমাদের কামিয়াবি হল আল্লাহ তাআলার হুকুম মানার ভিতর এবং নবীﷺ–এর তরিকা মানার ভিতর। বিপরীতে যদি আমরা আল্লাহর হুকুম না মেনে নবীজির তরীকা অনুসরণ না করে গুনাহ করতে থাকি তাহলে আমাদের জন্য ব্যর্থতা অবধারিত। ড. ইকবাল আমাদের অবস্থা দেখে যথার্থ বলেছেন যে, তোমরা বিশ্বাস করো একরকম কাজ করো ভিন্নরকম।
قلب میں سوز نہیں، رُوح میں احساس نہیں
کچھ بھی پیغامِ محمّدؐ کا تمھیں پاس نہیں
‘তোমাদের হৃদয়ে অনুভূতি নেই, অন্তরে জ্বালা নেই, মুহাম্মদের পয়গামের মর্যাদার তোমাদের কাছে নেই।’
আমরা চার শ্রেণীতে বিভক্ত
একটু চিন্তা করলে দেখা যায়, আল্লাহর হুকুম মানা এবং না মানার দিক থেকে আমরা চার শ্রেণীতে বিভক্ত।
এক. আমাদের মধ্যে কিছু লোক এমন আছে যারা ইবাদত করে, গুনাহও করে অর্থাৎ কিছু ইবাদত করে, কিছু গুনাহ করে।
দুই. কিছু লোক এমন আছে, যারা ইবাদতও করে না, গুনাহও করে না। ইবাদত করে না অলসতার কারণে। গুনাহ করে না জানা না থাকার কারণে। এদের সংখ্যা সমাজে নিতান্তই কম।
তিন . সমাজের মধ্যে কিছু দুর্ভাগা এমনও আছে, যারা কেবল গুনাহ করে, গুনাহের মাঝে আকণ্ঠ ডুবে থাকে, নেক আমল করার তাওফিক এদের মোটেও হয় না।
চার. এর বিপরীতে আল্লাহ তাআলার কিছু বান্দা এমনও আছেন যাঁরা কেবল নেক আমল করেন এবং গুনাহ থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করেন। এঁরাই আল্লাহ তাআলার খাস বান্দা। এরা আল্লাহর অলি।
নফল ইবাদত উত্তম না গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা উত্তম?
এখন প্রশ্ন হলো, নফল ইবাদত করা উত্তম না গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা উত্তম? আমরা তো মনে করি, ইবাদত বেশি বেশি করা উত্তম। কিন্তু আমাদের মাশায়েখগণ তা মনে করতেন না। বরং তাঁরা মনে করেন, নফল ইবাদতের চেয়েও বহু গুণে উত্তম হলো, গুনাহ না করা। কেননা, নফল ইবাদতের জন্য ধন্যবাদ পাবেন। সাওয়াব পাবেন। আখেরাতে আপনার মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু এর বিপরীতে কোনো জবাবদিহিতা নেই। অর্থাৎ না করলে কোনো গুনাহ নেই। পক্ষান্তরে গুনাহর জন্য জবাবদিহিতা আছে, শাস্তি আছে, আখেরাতের নাজাত থেকে বঞ্চিত হওয়ার মতো জঘন্য ব্যাপার আছে। মনে করুন, এক ব্যক্তি ফরজ ওয়াজিব সুন্নাতে মুআক্কাদা ঠিকভাবে আদায় করেছে। এক্ষেত্রে সে অলসতা কিংবা উদাসীনতাকে স্থান দেয় নি। কিন্তু সে অন্যান্য নফল আমল যেমন নফল নামাজ, নফল রোজা, নফল হজ, নফল সাদাকা খুব একটা করে নি। তবে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার পরিপূর্ণ চেষ্টা সে করেছে। তাহলে আল্লাহ তাআলার রহমতের প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখে বলা যায় যে, এ ব্যক্তির নাজাত নিশ্চিত। কেননা, আল্লাহ তাআলা এটা জিজ্ঞেস করবেন না যে, কেন অমুক নফল আমল কর নি? তবে আল্লাহ তাআলা এটা অবশ্যই জিজ্ঞেস করবেন যে, কেন তুমি দরজা-বন্ধ করে গুনাহ করেছ? কেন তুমি রাত জেগে ইউটিউবে, ফেসবুকে, ইনস্ট্রাগ্রামে, ইমুতে গুনাহ করেছ? কেন তুমি চোখের হেফাজত কর নি? কেন তুমি জবানের হেফাজত কর নি?
এজন্যই আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি.-কে যখন জিজ্ঞেস করা হলো যে, এক ব্যক্তির ইবাদত কম, গুনাহও কম। আরেক ব্যক্তির ইবাদতও বেশি গুনাহও বেশি। এই দুই ব্যক্তির মাঝে উত্তম কে? তিনি উত্তর দিলেন,
لا أَعْدِلُ بِالسَّلامَةِ شَيْئًا
‘গুনাহ থেকে নিরাপদ থাকার মত সমকক্ষ আমল আমি কোনটিকে মনে করি না।’ (আদাবুদদুনয়া ওয়াদদীন ১/৯৮)
জেগে থাকাটা মানুষকে ধ্বংস করে দিয়েছে
আমাদের মাশায়েখগণ থেকে বর্ণিত আছে যে, ইবাদত যা-ই করতে পারো তবে গুনাহ করো না। সলফে সালেহীনের যুগে মাঝে মাঝে কিছু লোক সুন্দর সুন্দর কথা নিয়ে বাজারে প্রচার করত। এক ব্যক্তি বাজারে হেঁটে হেঁটে প্রচার করতে লাগলো, أَهْلَكَكُمْ النَّوْمُ ‘হে মানুষ! ঘুম তোমাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছে। অর্থাৎ সে বুঝাতে চাইলো, যে মানুষ ঘুমের কারণে ইবাদত করে না তাই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। তখন একজন আল্লাহওয়ালা তাকে শুধরে দিয়ে বললেন, বিষয়টা এমন নয়। বরং প্রকৃত বিষয় হল, بَلْ أَهْلَكَتْكُمْ الْيَقِظَةُ মানুষকে জেগে থাকাটা ধ্বংস করে দিয়েছে। এর অর্থ হল, জেগে থেকে মানুষ গুনাহ করে। আর এটাই তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছে
এজন্যই বুজুর্গ বলেন, তোমার কথা সংশোধন করো এবং এভাবে বল,
خَفْ اللَّهَ بِالنَّهَارِ وَنَمْ بِاللَّيْلِ
দিনের বেলায় আল্লাহকে ভয় করো আর রাতের বেলায় ঘুমাও। (আদাবুদদুনয়া ওয়াদদীন ১/৯৮)
এখন তো সব কিছু উল্টো। এখন যুবকরা রাতের বেলায় জাগ্রত থাকে আর দিনের বেলায় ঘুমায়। আমাদের বুজুর্গ হযরত মাওলানা ইদ্রিস কান্ধলভী রহ. বলতেন, এখন সবকিছু উল্টো। আগে বাতি আলো দিত উপরের দিকে আর এখন বাতি আলো দেয় নিচের দিকে। আমাদের জীবনের কেবলা এখন ঠিক নেই। আমাদের জিন্দেগির কেবলা এখন উল্টে গিয়েছে।
পাঁচটি মহা মূল্যবান কথা
হাদিস শরিফে এসেছে, এক দিন রাসূলুল্লাহ ﷺ সাহাবায়েকেরামকে জিজ্ঞেস করলেন, পাঁচটি কথা আমার কাছ থেকে কে নিবে এবং মুখস্থ করবে তারপর অন্যের কাছে পৌঁছে দিবে? আবু হুরায়রা রাযি. বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি নিব, মুখস্থ করব, অন্যের কাছে পৌঁছে দিব।
নবীজী ﷺ বললেন,
اتَّقِ الْمَحَارِمَ تَكُنْ أَعْبَدَ النَّاسِ ، وَارْضَ بِمَا قَسَمَ اللهُ لَكَ تَكُنْ أَغْنَى النَّاسِ ، وَأَحْسِنْ إِلَى جَارِكَ تَكُنْ مُؤْمِنًا ، وَأَحِبَّ لِلنَّاسِ مَا تُحِبُّ لِنَفْسِكَ تَكُنْ مُسْلِمًا ، وَلاَ تُكْثِرِ الضَّحِكَ ، فَإِنَّ كَثْرَةَ الضَّحِكِ تُمِيتُ الْقَلْبَ
‘গুনাহসমূহ থেকে বাঁচবে তবে সর্বাপেক্ষা ইবাদতকারী লোক হিসাবে গণ্য হবে; তোমার তাকদীরে আল্লাহ তাআলা যা বণ্টন করে রেখেছেন সে বিষয়ে সন্তুষ্ট থাকবে, তবে সর্বাপেক্ষা অমুখাপেক্ষী লোক হতে পারবে; প্রতিবেশীর সঙ্গে সদ্ব্যহার করবে তবে প্রকৃত মু‘মিন হতে পারবে; নিজের জন্য যা পছন্দ কর মানুষের জন্যও তা পছন্দ করবে তাহলে প্রকৃত মুসলিম হতে পারবে; বেশী হাসবে না, কেননা বেশী হাস্য-কৌতুক হৃদয়কে মুর্দা বানিয়ে দেয়।’ (তিরমিযী ২৩০৫)
হাদিসটির সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা
উক্ত হাদিসের প্রথমাংশে বলা হয়েছে,
اتَّقِ الْمَحَارِمَ تَكُنْ أَعْبَدَ النَّاسِ
অর্থাৎ, জগতের যত ইবাদতগুজার আছে সকলের চাইতে তুমি আগে চলে যেতে পারবে, সকলেই তোমার থেকে পিছিয়ে যাবে যদি তুমি গুনাহ থেকে বেঁচে থাকো।
এজন্য আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ. বলতেন, আমার কাছে সন্দেহমুক্ত এক দিরহাম দান করা সন্দেহযুক্ত লক্ষ দিরহাম দান করার চেয়ে উত্তম।
উক্ত হাদীসের দ্বিতীয় অংশে নবীজি ﷺ বলেন,
وَارْضَ بِمَا قَسَمَ اللهُ لَكَ تَكُنْ أَغْنَى النَّاسِ
আল্লাহ তাআলা যা বণ্টন করে রেখেছেন সে বিষয়ে সন্তুষ্ট থাকবে, তবে সর্বাপেক্ষা সুখী হতে পারবে।
আমরাতো হাপিত্যেশ করি যে, পেলাম না-খেলাম না। অথচ নবীজি ﷺ বলেন, আল্লাহর দেওয়া বন্টনের উপর সন্তুষ্ট হয়ে যাও জগতের মধ্যে তুমি সবচাইতে বড় সুখী হতে পারবে। দেখবেন, যে যত বড় ধনী সে ততো বড় অসুখী। এর কারণ হলো, আল্লাহর দেওয়া বন্টনের উপর সে সন্তুষ্ট নয় বরং তার অবস্থা হলো এই যে, আরো চাই, আরো চাই এবং আরো চাই।
তৃতীয় অংশে নবীজি ﷺ বলেছেন,
وَأَحْسِنْ إِلَى جَارِكَ تَكُنْ مُؤْمِنًا
তুমি তোমার প্রতিবেশীর সাথে ভালো ব্যবহার করো তাহলে প্রকৃত মুমিন হতে পারবে।
আর চতুর্থ অংশে নবীজি ﷺ বলেন,
وَأَحِبَّ لِلنَّاسِ مَا تُحِبُّ لِنَفْسِكَ تَكُنْ مُسْلِمًا
তুমি নিজের জন্য যা পছন্দ করো অপর মুসলমানের জন্য তাই পছন্দ করো তাহলে মুসলিম হতে পারবে। যেমন তুমি চাও কেউ তোমাকে গালি না দিক। সুতরাং তুমিও কাউকে গালি দিওনা। তুমি চাও কেউ তোমার গীবত না করুক সুতরাং তুমিও গীবত করো না। তুমি চাও কেউ তোমার ব্যাপারে বদধারণা না করুক সুতরাং তুমিও কারো ব্যাপারে বদধারণা করো না।
হাদিসটির শেষাংশে নবীজি ﷺ বলেন,
وَلاَ تُكْثِرِ الضَّحِكَ ، فَإِنَّ كَثْرَةَ الضَّحِكِ تُمِيتُ الْقَلْبَ
বেশি আনন্দ-বিনোদন করো না। কারণ অতিরিক্ত বিনোদন মানুষের অন্তরকে মেরে ফেলে।
গুনাহ বর্জন করা ছাড়া আল্লাহর অলি হওয়া যায় না
যাই হোক, উক্ত হাদিসের প্রথমাংশে নবীজি ﷺ আল্লাহর অলি হওয়ার রহস্য বলে দিয়েছেন যে, কোনো আল্লাহর অলি অলি হতে পারে নি যতক্ষণ পর্যন্ত গুনাহ ছাড়তে পারে নি। আল্লাহর অলি হতে হলে, তাঁর দফতরে সব চাইতে বড় ইবাদতকারী হতে হলে গুনাহ ছাড়তেই হবে। এছাড়া বিকল্প নেই।
এ কারণে হযরত হাসান বসরী রহ. বলতেন,
مَا عَبَدَ الْعَابِدُونَ بِشَيْءٍ أَفْضَلَ مِنْ تَرْكِ مَا نَهَاهُمُ اللَّهُ عَنْه
‘আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয়গুলো থেকে বেঁচে থাকার চাইতে উত্তম কোন ইবাদত আর কোনো ইবাদতকারী করতে পারি নি।’ (জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম ২৯৬)
এটাই হলো সবচাইতে উত্তম ইবাদত। আল্লাহ আমাদেরকে তৌফিক দান করুন। আমিন।
হযরত আয়েশা রাযি. একদিন নবীজি ﷺ-কে বললেন, অনেকে রাত জেগে ইবাদত করে। আমরা মহিলারা একটু অলসপ্রকৃতির। রাত জেগে ইবাদত করতে পারি না। শুধু ঘুম আসে। পুরুষের তুলনায় মহিলাদের ঘুম বেশি। তো আমাদের শুধু ঘুম আসে। ফলে যারা রাত জেগে ইবাদত করে তাদের থেকে তো পিছনে পড়ে গেলাম। তখন আয়েশা রাযি.-কে নবীজী সান্ত্বনা ﷺ দিয়ে বললেন,
مَنْ سَرَّهُ أَنْ يَسْبِقَ الدَّائِبَ الْمُجْتَهِدَ فَلْيَكُفَّ عَنِ الذُّنُوبِ
যে ব্যক্তি খুব ইবাদতকারীর চাইতেও অগ্রসর হয়ে আনন্দ পেতে চায় তার জন্য উচিত হল, গুনাহসমূহ থেকে বেঁচে থাকা। অর্থাৎ যদি তুমি গুনাহ থেকে বেঁচে থাকো তাহলে রাত জেগে ইবাদতকারীর চাইতেও আগে বেড়ে যেতে পারবে। (মুসনাদ আবু ইয়া’লা ৪৯৫০)
একটি চমৎকার ঘটনা
কিতাবে এসেছে, কাজী আব্দুল ওয়াহিদ ইবনে যায়েদ রহ. ।যিনি ছিলেন একজন তাবে’ তাবিয়ী। বিখ্যাত তাবিয়ী হাসান বসরী রহ. এবং মালেক ইবনে দিনার রহ.-এর শাগরিদ ছিলেন। অনেক বড় আল্লাহর অলি ছিলেন। তিনি বলেন যে, আমি একদিন বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে -যাকে জুমা’ রাত বলা হয়। এ রাতের ফজিলত সম্পর্কে নবীজী ﷺ বলেন, পাঁচ রাতে আল্লাহ তাআলা দোয়া ফেরত দেন না। তন্মধ্যে একটি রাত হল, জুমার রাত। আব্দুল ওয়াহিদ ইবনে যায়েদ রহ. বলেন, আমি একদিন বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে বাইতুল মুকাদ্দাসে সারারাত ইবাদত করলাম। এরপর ভোররাতের দিকে আমি মসজিদের দরজা খুললাম। মসজিদে তখন আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না। ঠিক ওই সময়ে আঠার জন লোক একসাথে প্রবেশ করল। প্রত্যেকের পরনে লোহা জাতীয় পোশাক অর্থাৎ লোহা দিয়ে বানানো হয়েছে এ জাতীয় পোশাক এবং প্রত্যেকের পায়ে ছিল খেজুর পাতা দিয়ে বানানো জুতা। আর প্রত্যেকের গলায় ঝোলানো ছিল কোরআন মজিদ। আমি গুনে দেখলাম তারা মোট আঠার জন। তাঁদের চেহারা থেকে একপ্রকার নূরের ঝলক প্রতিভাত হচ্ছিল। এটা দেখে আমি অভিভূত হলাম এবং প্রভাবিত হলাম। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা এত বড় মর্যাদা পেলেন কিভাবে? কিভাবে এত বেশি সম্মানিত হলেন? তখন তাঁদের একজন উত্তর দিলেন,
يا عبد الواحد لايُوصِل إلى ولا يَةِ الله إلا بترك الْهَوَى
‘হে আব্দুল ওয়াহিদ! নফস-তাড়িত গুনাহ ত্যাগ করা ছাড়া আল্লাহর অলি হওয়া যায় না।’
আরেকজন বললেন,
ما عَرَفَ الله من لم يستَحِي منه في الخلاء
‘যে ব্যক্তি নির্জনতার সময়গুলোতে আল্লাহকে লজ্জা করে নি, সে আল্লাহর পরিচয় লাভ করতে পারে নি।’
একটি দরজা কি বন্ধ করা যাবে!
এক লোক সুযোগ পেয়ে জনৈক মহিলাকে অভাবগ্রস্ত পেয়ে খারাপ কাজের প্রস্তাব দিয়ে বসলো। মহিলাও অভাবের তাড়নায় রাজি হয়ে গেল। যখন কাজ শুরু করতে গেল তখন পুরুষটি মহিলাটিকে বলল, যাও, দরজা বন্ধ করে আসো। তখন মহিলাটি আশ্চর্য উত্তর দিল। সে বলল, সব দরজা তো বন্ধ করা যাবে কিন্তু একটি দরজা কি বন্ধ করা যাবে! অর্থাৎ আল্লাহর দরজা কি বন্ধ করা যাবে?
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
اَلَمْ يَعْلَمْ بِّاَنَّ اللهُ يَرى
‘সে কি জানে না যে আল্লাহ দেখতে পাচ্ছেন।’ (সূরা আ’লাক ১৪)
هُوَ مَعَكُمْ اَيْنَمَا كُنْتُمْ
‘তোমরা যেখানেই থাকো না কেন; তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন।’ (সূরা হাদীদ ০৪)
আল্লাহ আমাদেরকে নির্জনতার মুহূর্তগুলোতে আল্লাহকে অধিক ভয় করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
গুনাহ অনুপ্রবেশ করে দু’টি রোড ব্যবহার করে
মুহতারাম হাজিরিন! গুনাহ থেকে তো নিরাপদ থাকা তখনই সহজ হবে যখন আমরা বুঝবো যে, গুনাহগুলো আসে কোন রাস্তা দিয়ে। কেননা শত্রুকে ঘায়েল করতে হলে শত্রুর রাস্তা চিনতে হয়, যাতে করে শত্রু না আসতে পারে। গুনাহ তো হলো আমাদের জন্য বিষতুল্য। এই বিষ সরবরাহ করে ইবলিস। রিসিভ করে আমাদের নফস।
আমাদের মাশায়েখগণ বলেন, ইবলিস আমাদের পর্যন্ত এই গুনাহগুলোকে পৌঁছাতে গিয়ে দু’টি রাস্তা ব্যবহার করে থাকে। যত গুনাহ আছে সব গুনাহ এই দুটি রোডের মাধ্যমেই ইবলিস আমাদের কাছে পৌঁছায়। এমনকি কুফরি নামক গুনাহও এই দুটি রোডের যেকোনো একটি ব্যবহার হয়ে মানুষের কাছে আসে। একটি রোডের নাম হল, শুবুহাত। দ্বিতীয় রোডের নাম হল, শাহওয়াত। সুতরাং আমরা যদি এই দু’টি রোড ব্লক করে দেই তাহলে বাঁশরি থাকবে না, বাঁশিও বাজবে না। তখন গুনাহ আর হবে না।
ইসলামে শুবুহাতের কোনো স্থান নেই
শুবুহাত এর অর্থ হল, ওয়াসওয়াসা বা দ্বিধাদ্বন্দ্ব বা সন্দেহ সৃষ্টির মাধ্যমে কুমন্ত্রণা দেওয়া।
এই ওয়াসওয়াসা নানা ধরনের হতে পারে। ঈমানের ব্যাপারে হতে পারে, পবিত্রতার ব্যাপারে হতে পারে, নামাজের ব্যাপারে হতে পারে, ইবাদত-বন্দেগির ব্যাপার হতে পারে, এমনকি ব্যক্তির ব্যপারও হতে পারে যেমন, অমুক আমার ব্যাপারে এটা বলল কিনা; আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করল কিনা! নবীজী ﷺ বলেন, ইসলামে এই শুবুহাতের কোনো স্থান নেই। বরং তিনি বলেন,
إِنَّ الْحَلَالَ بَيِّنٌ، والْحَرَامَ بَيِّنٌ، وبَيْنَهُمَا مُشْتَبِهَاتٌ لَا يَعْلَمُهُنَّ كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ، فَمَنِ اتَّقَى الشُّبُهَاتِ فَقَدِ اسْتَبْرَأَ لِدِينِهِ، وعِرْضِهِ، ومَنْ وقَعَ فِي الشُّبُهَاتِ وقَعَ فِي الْحَرَامِ
‘হালাল স্পষ্ট এবং হারামও স্পষ্ট। আর এ দু’য়ের মাঝে রয়েছে বহু সন্দেহজনক বিষয় রয়েছে- যা অনেকেই জানে না। যে ব্যক্তি সেই সন্দেহজনক বিষয়সমূহ থেকে বেঁচে থাকবে। সে তার দীন ও মর্যাদা রক্ষা করতে পারবে। আর যে সন্দেহজনক বিষয়সমূহে লিপ্ত হল সে হারামেই লিপ্ত হল।’ (সহীহ বুখারী ৫২)
সুতরাং সন্দেহজনক বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া যাবে না; বরং নবীজির কথা অনুযায়ী চলব। যেমন নবীজি ﷺ বলেছেন,
ظُنوا بالْمُؤْمِنُينَ خَيْراً
‘তোমরা কারো প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করো না। কেননা, খারাপ ধারণা সবচেয়ে বড় মিথ্যা।’ (সহীহ বুখারী ৫১৪৩)
সুতরাং ভালো ধারণা রাখব। কেবল সন্দেহের ভিত্তিতে খারাপ ধারণা করবো না। এই ওয়াসওয়াসা বা সন্দেহ কার সৃষ্ট? শয়তানের সৃষ্ট। শয়তান মানুষের অন্তরে এগুলো সৃষ্টি করে। নবীজী ﷺ বলেন,
الحَمْدُ لله الذي رَدَّ كَيْدَ الشيطان إلى الوَسْوَسةِ
‘সমস্ত প্রশংসা ওই আল্লাহর জন্য যিনি শয়তানের যাবতীয় চক্রান্ত ওয়াসওয়াসার ভিতরে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছেন।’ (আবু দাউদ ৫১১২)
অর্থাৎ, সন্দেহ সৃষ্টি করে, দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি করে শয়তান মানুষের অন্তরে কেবল গুনাহর কুমন্ত্রণা দিতে পারে, কিন্তু সে গুনাহ করাতে পারে না। তার কুমন্ত্রণার পথ ধরে আমি গুনাহ করে নিলাম, এর অর্থ হল, আমি তার কুমন্ত্রণার জালে পড়ে গেলাম। আল’ইয়াযু বিল্লাহ।
এই ওয়াসওয়াসা কত মানুষের জীবনকে ধ্বংস করে দিয়েছে! কত সুন্দর বাগানকে বিলীন করে দিয়েছে! কত দাম্পত্যজীবনকে জাহান্নাম বানিয়ে ছেড়েছে! এখন তো ইমো হোয়াটসঅ্যাপ আর ফেসবুকের যুগ। তাই ওয়াসওয়াসার পরিমাণটা অতীতের তুলনায় আরো বেশি।
শুবুহাত এবং শাহওয়াত
ইবলিস আমাদের পর্যন্ত গুনাহগুলো পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে যে দ্বিতীয় রাস্তা ব্যবহার করে তার নাম হল, শাহওয়াত। শাহওয়াত মানে কামনা, বাসনা এবং যৌনতার প্রতি লালসা। ইবলিস আমাদের দেহের মাঝে এই কামনাগুলো তৈরি করে। সুতরাং ইবলিস শুবুহাত এবং শাহওয়াত এদু’টি রাস্তার মাধ্যমেই সকল গুনাহগুলো সাপ্লাই করে আর আমাদের নফস সেগুলো রিসিভ করে।
নফস গুনাহগুলো রিসিভ করে কিভাবে?
প্রশ্ন হল, রিসিভ করে কিভাবে? আসলে সে তো গডফাদার; তাই সে নিজে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। আর রিসিভ করার কাজে লাগায় আমাদের দেহের কিছু অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে। যেগুলোকে সে রিসিভ করার কাউন্টার হিসেবে ব্যবহার করে। শুবুহাত কিংবা শাহওয়াত–যে পথেই গুনাহ আসুক না কেন, ইবলিস গুনাহ যে পথেই সরবরাহ করুক না কেন; ওই অঙ্গগুলো তা গ্রহণ করে এবং এর মাধ্যমেই নফসের গ্রহণ করা হয়ে যায়। অর্থাৎ নফস কেমন যেন ওই অঙ্গগুলোকে বলে, তুমি গুনাহটা ধারণ কর এতেই আমি পেয়ে যাব। কেননা, তোমার রিসিভ করা মানে আমার রিসিভ করা। তোমার ধারণ করা মানে আমার ধারণ করা। তোমার গ্রহণ করা মানে আমার গ্রহণ করা।
গুনাহ রিসিভ করার চার কাউন্টার
মুহতারাম হাজিরিন! সুতরাং এ পর্যায়ে আমাদের জানা প্রয়োজন ইবলিসের সরবরাহকৃত গুনাহগুলো রিসিভ করার জন্য আমাদের কোন কোন অঙ্গকে নফস কাউন্টার হিসেবে ব্যবহার করে?
এরকম অঙ্গ প্রধানত চারটি। ১. চোখ ২. জবান ৩. কান ৪. মস্তিষ্ক। সুতরাং যদি আমরা এই চারটি অঙ্গের হেফাজত করতে পারি তাহলে ব্যভিচার ও গীবত কিংবা হারাম খাদ্য গ্রহণ করা থেকে শুরু করে কুফরি পর্যন্ত কোন গুনাহই আমাদের দ্বারা ইবলিস কিংবা নফস করাতে পারবে না, ইন শা আল্লাহ। একারণেই আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِۦ عِلْمٌ ۚ إِنَّ ٱلسَّمْعَ وَٱلْبَصَرَ وَٱلْفُؤَادَ كُلُّ أُوْلَٰٓئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْـُٔولًا
যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, অযথা তার পিছনে পড়ো না। কেননা, কেয়ামতের দিন কান, চোখ ও অন্তর; এসব কয়টির ব্যবহার সম্পর্কে তোমাকে জিজ্ঞেস করা হবে। (সূরা ইসরা ৩৬)
১. চোখের হেফাজত করুন
দৃষ্টির লাগামহীনতা বহু অপরাধের প্রধান উৎস। ইবলিস পরনারীর চেহারা, সুদের টাকা ঘুষের পয়সা ইত্যাদিকে খুব নয়নলোভন পদ্ধতিতে উপস্থাপন করে। নফস তা চোখের মাধ্যেমে রিসিভ করে মজা ভোগ করে এবং নিজের মধ্যে পুষে রাখে। সুযোগ পেলেই তা ফুলে-ফেঁপে বিশাল হয়ে ওঠে। দেখুন, কাবিল হাবিলের স্ত্রীর রূপ-যৌবনের প্রতি কুদৃষ্টি দিয়েছিল। পরিণামে তার কাঁধে এমনই ভূত চড়ে বসেছিল, আপন ভাইকে হত্যা করতেও তার কলিজা কাঁপে নি। এজন্যই ইসলাম বলে, পরনারীর প্রতি, তার ফটো কিংবা ভিডিওর প্রতি; অনুরূপভাবে অন্যের সম্পদের প্রতি, অন্যের ঘরের প্রতি দৃষ্টি দিবে না। তোমার দৃষ্টির এই হেফাজত তোমার নফসের জন্য শাসন। কেমন যেন সে যা চেয়েছে তা তুমি তাকে দাও নি; বরং তুমি তার উপর চপেটাঘাত করলে। এতে ইবলিস নিরাশ হয়েছে আর অপরদিকে তোমার মালিক খুশি হয়েছেন। এজন্যই রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,
اَلنَّظْرَةُ سَهْمٌ مَسْمُوْمٌ مِنْ سِهَامِ اِبْلِيْسَ
দৃষ্টি হল ইবলিসের বিষাক্ত তীরসমূহের অন্যতম। (আলজাওয়াবুলকাফী ২০৪)
তুমি যদি এই তীর থেকে আত্মরক্ষা করতে পার তাহলে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, হাদিসে কুদসি–
مَنْ تَرَكَهَا مِنْ مَخَافَتِىْ اَبْدَلْتُهُ إِيْمَاناً يَجِدُ حَلَاوَتَه فِىْ قَلْبِه
যে আমার ভয়ে তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিবে, আমি অন্তরে এমন ঈমান সৃষ্টি করব, যাতে সে তার স্বাদ পাবে। (আততারগীব ওয়াততারহীব ২/৩৭)
২. জবানের হেফাজত করুন
জবানের লাগামহীনতাও অসংখ্য গুনাহেকে ডেকে আনে। মিথ্যা বলা, গীবত করা, গালি দেয়া, ঝগড়া করা, হারাম খাওয়া থেকে শুরু করে কোন অপরাধটা এই জবান দ্বারা করা যায় না! এ অপরাধগুলো ইবলিস লবণ মরিচ মাখিয়ে নফসের সামনে পেশ করে। নফস তা জবানের মধ্যমে গ্রহণ করে। এজন্যই হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
إِذَا أَصْبَحَ ابْنُ آدَمَ فَإِنَّ الأَعْضَاءَ كُلَّهَا تُكَفِّرُ اللِّسَانَ فَتَقُولُ اتَّقِ اللَّهَ فِينَا فَإِنَّمَا نَحْنُ بِكَ فَإِنِ اسْتَقَمْتَ اسْتَقَمْنَا وَإِنِ اعْوَجَجْتَ اعْوَجَجْنَا
আদম সন্তান যখন সকালে উপনীত হয়, তখন তার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জিভকে অত্যন্ত বিনীতভাবে নিবেদন করে যে, তুমি আমাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। কারণ, আমাদের ব্যাপারসমূহ তোমার সাথেই সম্পৃক্ত। যদি তুমি সোজা সরল থাক, তাহলে আমরাও সোজা-সরল থাকব। আর তুমি যদি বাঁকা পথে যাও তাহলে আমরাও বাঁকা পথে যেতে বাধ্য হব। (তিরমিযী ২৪০৭)
সুতরাং জবানকে হারাম কথা ও হারাম খানা থেকে হেফাজত করুন। এটাও নফসের উপর একপ্রকার শাসন। এর কারণেও ইবলিস নিরাশ হয় আর অপরদিকে আল্লাহ তাআলা খুশি হন। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, কোন বান্দার ঈমান দুরস্ত হয় না; যতক্ষণ পর্যন্ত না তার অন্তর দুরস্ত হয় এবং তার অন্তরও দুরস্ত হয় না যতক্ষণ পর্যন্ত না তার জবান দুরস্ত হয়। (মুসনাদে আহমাদ ১০৪০৮)
৩. কানের হেফাজত করুন
ইসলামের মূলনীতি হল, যা বলা হারাম, তা শোনাও হারাম। অবলীলায় যে কোনো কিছু শোনা অন্তরে মুনাফেকি সৃষ্টির অন্যতম কারণ। যেমন গান সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাযি. বলেন,
الْغِنَاءُ يُنْبِتُ النِّفَاقَ فِى الْقَلْبِ كَمَا يُنْبِتُ الْمَاءُ الزَّرْعَ
পানি যেমন ভূমিতে তৃণলতা উৎপন্ন করে তেমনি গান মানুষের অন্তরে নিফাক সৃষ্টি করে। (বাইহাকী ২১৫৩৬ তাফসীরে কুরতুবী ১৪/৫২)
কোরআন মজীদে আছে, ইবলিস আদম-সন্তানকে ধোঁকা দেওয়ার আরজি পেশ করলে আল্লাহ তাআলা ইবলিসকে সম্বোধন করে বলেন,