মূল
মাহবুবুলওলামা হযরত মাওলানা পীর জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী মুজাদ্দেদী দা. বা.
অনুবাদ ও সম্পাদনা
শায়েখ উমায়ের কোববাদী
মুহাদ্দিস, মাদরাসা দারুর রাশাদ, মিরপুর, ঢাকা।
খতিব, বাইতুল ফালাহ জামে মসজিদ, মধ্যমনিপুর, মিরপুর, ঢাকা।
মাকতাবাতুলফকির
মধ্য মনিপুর, মিরপুর-২, ঢাকা-১২১৬
০১৮১৬-০৩৪১৭৫, ০১৭৪৬-৯৮১৪৪১
কুদৃষ্টি
প্রকাশক : মাওলানা উমায়ের কোববাদী
প্রকাশকাল : রজব ১৪৩৬ হিজরী, বৈশাখ ১৪২২ বাংলা, মে ২০১৫ ঈসায়ী
স্বত্ত্ব : কোনোপ্রকার পরিবর্তন ছাড়া, সম্পূর্ণ আমানতের সঙ্গে হুবহু ছাপানোর অনুমতি আছে।
অক্ষর বিন্যাস : ইসমাইল কম্পিউটার্স
প্রচ্ছদ : আবিষ্কার
মূল্য : ৫০ (পঞ্চাশ টাকা মাত্র)
Kudristi by Mowlana Umayer Kobbadi. Published by Maktabatulfaqeer, Dhaka. Price-Tk.-50.00, $-1.00
الله الله الله
অনুবাদকের কথা
نَحْمَدُہٗ وَنُصَلِّی عَلٰی رَسُوْلِہَ الْکَرِیْمِ
মাহবুবুলওলামা হযরত মাওলানা পীর জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী মুজাদ্দেদী দা.বা.। আধ্যাত্মিকজগতের এই উজ্জ্বলনক্ষত্রকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন অন্তত ওলামামহলে নেই। আধ্যাত্মিকতার এই জীবন্তপুরুষ গোটা বিশ্বব্যাপী নকশবন্দি-তরিকার শায়েখ হিসাবে বর্তমানে এতটাই গ্রহণযোগ্য ও পরিচিত যে, এর তুলনা তরিকার প্রাণপুরুষ খাজা বাহাউদ্দীন নকশবন্দী রহ-এর সাথেই চলে। অব্যক্ত এক স্নিগ্ধটানে আমি অধম ১৪৩৫ হিজরীর রমযান মাসে ছুটে গিয়েছিলাম সুদূর আফ্রিকার জাম্বিয়ার লুসাকাতে ‘সিলসিলাআ’লিয়া’ হিসাবে খ্যাত এই নকশবন্দি তরিকায় শামিল হয়ে সুলুক তথা আত্মশুদ্ধির পবিত্র মিছিলে শরিক হতে। হযরতের কাছে বাইআত হলাম। ই‘তেকাফ করলাম। دست بکار دل بیار ‘হাত থাকবে কাজে, দিল বন্ধুর সাথে’ এর সবকে উদ্ভাসিত হলাম। পাশাপাশি অবর্ণনীয় তাগিদ অনুভব করলাম হযরতের সুবিন্যস্ত আদ্যোপান্ত-বিশ্লেষণমুখী বয়ান ও লিখনীগুলো তরজমা করে মুসলিমসমাজে তুলে ধরার। এ তাগিদ থেকে আমাদের এ প্রয়াস। কোনো প্রকার প্রফেশনাল মানসিকতা নেই। আছে কেবল খেদমতের নিয়ত। নামও রেখেছি নিজের নামের সাথে ব্যবহার করা হযরতের পসন্দের নাম ‘ফকির’ শব্দের সাথে মিল রেখে ‘মাকতাবাতুলফকির’। ‘ফকির’ শব্দটির প্রতি আকর্ষণ আমার আরেকটি কারণে আগ থেকেই ছিল। তাহল, হাকিমুলউম্মত থানবী রহ.-এর অন্যতম মুজায মাওলানা কোববাদ সাহেব রহ.-থানবীর ভাষায় যিনি ছিলেন ‘নমুনায়ে সাহাবী’-তিনি নিজের নামের সাথে ‘ফকির’ শব্দটি লেখা পসন্দ করতেন। তাঁর সাথে আমার বন্ধন লুকিয়ে আছে রক্তের ভেতরেই।
‘মাকতাবাতুলফকির’-এর কোনো কিতাবেরই স্বত্ব সংরক্ষিত থাকবে না। যে-কোনো ব্যক্তি খেদমতের নিয়তে হুবহু ছাপানোর শর্তে ছাপতে পারবেন। প্রয়োজনে আমাদের সহযোগিতাও পাবেন।
বাকি রইল ভুলত্রুটির কথা। পেলে এবং সুযোগ হলে ধরিয়ে দিলে কৃতার্থ হব। আল্লাহ আমাদের সকলকে ক্ষমা করুন। আমীন।
উমায়ের কোববাদী
০১৮১৬০৩৪১৭৫
সূচিপত্র
দৃষ্টিসংরক্ষণ : পবিত্র কুরআন কী বলে?
দৃষ্টি সংযত রাখা সম্পর্কে হাদীসে যা রয়েছে
দৃষ্টি হঠাৎ পড়ে যাওয়া ক্ষমাযোগ্য
কুদৃষ্টি অনিষ্টের মূল
কুদৃষ্টি ব্যভিচারের প্রথম সিঁড়ি
কুদৃষ্টি থেকে বেঁচে থাকার মাঝে রয়েছে ঈমানের স্বাদ
কুদৃষ্টি দ্বারা কখনও তুষ্ট হওয়া যায় না
কুদৃষ্টি ক্ষতকে গভীর করে
এ থেকে বুড়োরাও নিরাপদ নয়
কুদৃষ্টির কারণে আমলের তাওফিক ছিনিয়ে নেয়া হয়
কুদৃষ্টির কারণে মুখস্থশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে
দৃষ্টি লাঞ্ছণার কারণ
কুদৃষ্টির কারণে বরকত শেষ হয়ে যায়
কুদৃষ্টিদানকারীর কাছে শয়তানের অনেক আশা-ভরসা
কুদৃষ্টির কারণে নেকি নষ্ট এবং গুনাহ অনিবার্য
কুদৃষ্টির কারণে মহান আল্লাহর অহঙ্কার জেগে ওঠে
কুদৃষ্টিদানকারী অভিশপ্ত
কুদৃষ্টিকে মানুষ সাধারণ মনে করে
কুদৃষ্টি থেকে কুকর্ম পর্যন্ত
কুদৃষ্টির কারণে দেহে দুর্গন্ধ
কুদৃষ্টির নগদ সাজা
কুদৃষ্টির কারণে পবিত্র কুরআন ভুলে গেল
কুদৃষ্টি ও ফটো-ভিডিও
কুদৃষ্টি এবং সৌন্দর্যপ্রেমের ধোঁকা
কুদৃষ্টির অশুভ পরিণাম
কুদৃষ্টির দৃষ্টান্তমূলক পরিণতি
কুদৃষ্টির অনির্ধারিত শাস্তি
কুদৃষ্টির প্রভাব অন্তরে
কুদৃষ্টি এবং নূরবিহীন চেহারা
কুদৃষ্টিমুক্ত থাকার পুরস্কার
কুদৃষ্টির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা
কুদৃষ্টির কারণে হাতিও টলে যায়
কুদৃষ্টির তিনটি বড় ক্ষতি
কুদৃষ্টি সম্পর্কে পূর্বসূরী সলফেসালেহীন যা বলেছেন
কুদৃষ্টির চিকিৎসা
পবিত্র কুরআনের আলোকে
পবিত্র হাদীসের আলোকে
সালাফ তথা পূর্বসূরী বুযুর্গদের বাণীর আলোকে
এক. কল্পনা পাল্টানো
দুই. নিজেকে সাজা দিন
অধমের অতিরিক্ত কিছু পরীক্ষিত ব্যবস্থাপত্র
এক. কুদৃষ্টির পরিবেশ থেকে বাঁচুন
দুই. স্ত্রীকে সন্তুষ্ট রাখুন
তিন. নিজেকে নির্লোভ করে নিন
চার. হূরদের সৌন্দর্যের কল্পনা করুন
পাঁচ. আল্লাহর দর্শন লাভ থেকে বঞ্চিত হওয়ার কথা ভাবুন
ছয়. নিজের মা-মেয়ের কল্পনা করুন
সাত. চোখে শলাকা পড়ার কথা ভাবুন
আট. নিয়মের কথা ভাবুন
নয়. নিজের নফসের সাথে বিতর্ক করুন
দশ. আল্লাহর সান্নিধ্যের মুরাকাবা করুন
একটি ভুল বুঝাবুঝি
الله الله الله
بسم الله الرحمن الرحيم
দৃষ্টির লাগামহীনতাই অধিকাংশ অশ্লীলতার প্রধান উৎস। এজন্য গবেষকরা বলে থাকেন, কুদৃষ্টি সকল অনিষ্টের মূল। এদু’টি ছিদ্র দিয়েই ফেতনার বন্যা ছুটে আসে। সমাজের মাঝে অবস্থিত থৈ থৈ করা নগ্নতার মূল কারণও এ দু’টি ছিদ্র। তাই ইসলাম ছিদ্র দু’টির ওপর পাহারাদার নিযুক্ত করে দিয়েছে। প্রত্যেক মুমিনকে দৃষ্টি অবনত রাখার নির্দেশ এটাও ইসলামের ফলপ্রসূ শিক্ষারই চমৎকার বহিঃপ্রকাশ। এতে পরনারীর প্রতি দৃষ্টি যায় না, যৌনতার উদ্দামতা দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে না। বাঁশও থাকে না, বাঁশিও বাজে না। নীতির কথা হল, Nip the evil in the bud. অর্থাৎ মন্দের উৎসটা শেষ করে দাও। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, যাদের দৃষ্টি নিয়ন্ত্রিত নয় তাদের মাঝে জৈবিকচাহিদার আগুন জ্বলতে থাকে। এই লাগামহীনতাই মানুষকে ধীরে ধীরে বেহায়াপনার অন্ধকার জগতের দিকে ঠেলে দেয়।
দৃষ্টিসংরক্ষণ : পবিত্র কুরআন কী বলে?
এ সুবাদে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন-
قُلْ لِلْمُؤْمِنِيْنَ يَغُضُّوْا مِنْ اَبْصَارِهِمْ وَ يَحْفَظُوْا فُرُوْجَهُمْ ذَالِكَ اَزْكى لَهُمْ
اِنَّ اللهَ خَبِيْرٌ بِمَا يَصْنَعُوْنَ
‘হে নবী! আপনি মুমিনদেরকে বলে দিন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য রয়েছে পবিত্রতা। তারা যা করে মহান আল্লাহ তা সম্পর্কে সম্যক অবগত।’(সূরা নূর : ৩০)
পবিত্র কুরআনের আয়াতটি মুমিনদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা। তাফসীরবিশারদগণ লিখেছেন, আয়াতটিতে রয়েছে শিষ্টাচার, সতর্কতা ও চ্যালেঞ্জের বিবরণ। নিম্নে তা উপস্থাপন করা হল-
ক. আয়াতের প্রথমাংশে রয়েছে শিষ্টাচারের বিবরণ। অর্থাৎ যেসব বস্ত্ত দেখা মুমিনদের জন্য অবৈধ, তা থেকে যেন দৃষ্টিকে অবনত রাখে। গোলামের কৃতিত্ব হল মনিবের আনুগত্য করা। আয়াতটিতে এ শিক্ষাও রয়েছে যে, দৃষ্টির হেফাজত প্রথম কাজ। লজ্জাস্থানের সংরক্ষণ সর্বশেষ কাজ। একটির জন্য অপরটি অপরিহার্য। সুতরাং দৃষ্টির লাগাম ধরতে না পারলে লজ্জাস্থানও অনিবার্যভাবে নিয়ন্ত্রণের গন্ডিতে রাখা যায় না।
খ. ذَالِكَ اَزْكى لَهُمْ অর্থাৎ এতে রয়েছে তাদের জন্য পবিত্রতা। আয়াতের এ অংশে রয়েছে সতর্কতা। দৃষ্টির হেফাজতে রয়েছে অন্তরের পবিত্রতা। ফলে গুনাহ্র কুমন্ত্রণা অন্তরে ইতিউতি করে না। ইবাদতে মনোযোগ আসে। প্রবৃত্তিপনা, শয়তানিপনা, পাশবিকতাড়না ও কুমন্ত্রণা প্রভৃতি থেকে অন্তপ্রাণকে বাঁচানো যায়। পক্ষান্তরে কুদৃষ্টির কারণে অন্তরের প্রশান্তি চলে যায়। অব্যক্ত অনুশোচনার অব্যাহত ভোগান্তির শিকার হতে হয়। ফেতনায় জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তীব্রতর হয়ে ওঠে।
গ. আয়াতের শেষাংশ اِنَّ اللهَ خَبِيْرٌ بِمَا يَصْنَعُوْنَ ‘নিশ্চয় মহান আল্লাহতাআলা তারা যা করে তা সর্ম্পকে জানেন।’ এর মাঝে রয়েছে চ্যালেঞ্জ। আল্লাহর পক্ষ থেকে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে যে, বান্দা যদি উক্ত দিকনির্দেশনার তোয়াক্কা না করে তাহলে যেন মনে রাখে যে, মহান আল্লাহ অসচেতন নন। তিনি বান্দার প্রতিটি পদক্ষেপ সম্পর্কে পরিপূর্ণরূপে জানেন। অবাধ্যদেরকে কিভাবে শায়েস্তা করতে হয়- তাও তিনি ভালোভাবেই জানেন।
মনে রাখবেন, পুরুষদের মতই নারীদেরকেও সুস্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারাও যেন দৃষ্টি সংযত রাখে। কারণ নারী-পুরুষ উভয় শ্রেণীরই সৃষ্টির উপকরণ অভিন্ন। সুতরাং যৌনতার প্রতি আকর্ষণ নারীপ্রকৃতিতেও রয়েছে। তাই আল্লাহতাআলা নারী জাতির উদ্দেশে বলেছেন-
قُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ اَبْصَارِهِنَّ وَ يَحْفَظْنَ فُرُوْجَهُنَّ
‘হে নবী! ঈমানদার নারীদেরকে বলে দিন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থানের সংরক্ষণ করে।’
উক্ত আয়াতদ্বয়ের বাহ্যিক ও অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এ বাস্তবতাকেই স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে, দৃষ্টির নিয়ন্ত্রণহীনতা বেহায়াপনার বিস্তৃতি ঘটায় এবং লজ্জাস্থানের শিহরণ তৈরি করে। এ জাতীয় পরিস্থিতিতে মানুষের বিবেকের ওপর পর্দা পড়ে যায়। মানুষ তখন বিবেকবুদ্ধির দিক থেকে অন্ধ হয়ে যায়। গুনাহে জড়িয়ে পড়ে লাঞ্ছণার অতল সাগরে ডুব দিয়ে বসে। এ ক্ষেত্রে পুরুষদের মতই নারীদের অবস্থা হয়। বরং নারীরা সাধারণত আবেগপ্রবণ হয়ে থাকে। অল্পতেই প্রভাবিত হয়ে পড়ে। সুতরাং তাদের দৃষ্টি কোনোদিকে ঝুঁকে পড়লে ক্ষতির আশঙ্কা অধিক থাকে। সুতরাং তাদের দৃষ্টি অবনত রাখার গুরুত্বটা একটু বেশি। ইমাম গাযালী রহ. বলেন-
ثُمَّ عَلَيْكَ وَفَّقَكَ اللهُ وَاِيَّانَا بِحِفْظِ الْعَيْنِ فَاِنَّهَا سَبَبُ كُلِّ فِتْنَةٍ وَافَةٍ
‘অতঃপর তুমি দৃষ্টির সংরক্ষণ অবশ্যই করবে। আল্লাহ তোমাকে এবং আমাকে তাওফিক দান করুন। কেননা, এটা প্রত্যেক ফেতনা ও আপদের কারণ।’ (মিনহাজুল আবিদীন, পৃষ্ঠা : ২৮)
এর দ্বারা জানা গেল, চোখের ফেতনা নিদারুণ ভয়াবহ। সমূহ ফেতনার মূল উৎস এটি।
দৃষ্টি সংযত রাখা সম্পর্কে হাদীসে যা রয়েছে
১.রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
غُضُّوْا اَبْصَارَكمُ وَاحْفَظُوْا فُرُوْجَكُمْ.
‘তোমরা দৃষ্টি অবনত রাখো এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত কর।’(আলজাওয়াবুলকাফী, পৃষ্ঠা : ২০৪)
হাফেজ ইবনুলকাইয়িম রহ. লিখেছেন, দৃষ্টি জৈবিকচাহিদার পিয়ন ও রাহবার হয়ে থাকে। দৃষ্টির সংরক্ষণ মূলতঃ লজ্জাস্থান ও যৌনচাহিদা পূরণের অবাধ সুযোগের সংরক্ষণ হয়ে থাকে। যে দৃষ্টিকে অবাধে বিচরণ করতে দিয়েছে সে নিজেকে ধ্বংসের মাঝে ফেলে দিয়েছে। মানুষ যেসব আপদে নিমজ্জিত হয় এর মূলভিত্তি হল দৃষ্টি।’(আলজাওয়াবুলকাফী, পৃষ্ঠা-২০৪)
২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
اَلنَّظْرَةُ سَهْمٌ مَسْمُوْمٌ مِنْ سِهَامِ اِبْلِيْسَ
‘দৃষ্টি হল ইবলিসের বিষাক্ত তীরসমূহের অন্যতম।’ (প্রাগুক্ত)
৩. জনৈক মনীষী বলেছেন-
اَلنَّظْرُ سَهْمٌ سَمَّ اِلَى الْقَلْبِ.
‘দৃষ্টি একটি তীর যা অন্তরে বিষ ঢেলে দেয়।’(ইবনুকাছীর, খন্ড : ০৩, পৃষ্ঠা : ২৮৩)
৪. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
اَلْعَيْنَانِ زِنَاهُمَا النَّظْرُ
‘চোখের ব্যভিচার হল দেখা।’ (মুসলিমশরীফ)
এসব হাদীস থেকে প্রতীয়মান হয়, যেব্যক্তি পরনারীর চেহারার প্রতি কামনার দৃষ্টিতে তাকায় সে তার সঙ্গে মনে মনে ব্যাভিচারও করে ফেলে। পূর্বসূরী বুযুর্গানেদীন দৃষ্টিকে বলেছেন, ‘ভালোবাসার বাহক’। জুলাইখা ইউসুফ আলাইহিসসালামের চেহারার প্রতি না তাকালে নিজের জৈবিককামনার কাছে এভাবে নেতিয়ে পড়ত না এবং গুনাহের প্রতি আহবানও করত না। ক্ষণিকের লাগামহীন আচরণের কারণে পবিত্র কুরআনে তার নাম লাঞ্ছণার সাথে আলোচিত হয়েছে। কেয়ামত পর্যন্ত তার দিকে নির্লজ্জা কাজের জন্য ইঙ্গিত করা হবে। শিক্ষাগ্রহণ করা উচিত, কত ভয়াবহ ও করুণ হয় কুদৃষ্টির লাঞ্ছণা।
দৃষ্টি হঠাৎ পড়ে যাওয়া ক্ষমাযোগ্য
অনেক সময় এমন হয়, পথে-ঘাটে আচমকাভাবে পরনারী সামনে এসে পড়ে। হঠাৎ তাদের চেহারার দিকে দৃষ্টি পড়ে যায়। এ পরিস্থিতি সম্পর্কে আলী রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। উত্তরে তিনি বলেছিলেন-
يَا عَلِىُّ لَا تُتْبِعِ النَّظْرَةَ النَّظْرَةَ. فَاِنَّ لَكَ الْاُوْلى وَلَيْسَتْ لَكَ الْاخِرَةَ
‘হে আলী! আচমকা দৃষ্টি পড়ে গেলে তুমি পুনরায় দৃষ্টি দিওনা। কেননা, প্রথমদৃষ্টি তোমার জন্য ক্ষমাযোগ্য এবং দ্বিতীয়বার দৃষ্টিপাত করা তোমার জন্য ক্ষমাযোগ্য নয়।’ (মেশকাতশরীফ)
বোঝা গেল, একবার দৃষ্টি পড়ে গেলে তা ক্ষমাযোগ্য। তবে যদি প্রথমবারের দৃষ্টিপাতটাও স্বেচ্ছায় হয় তাহলে এটাও হারাম। প্রথমদৃষ্টিপাত বৈধ হওয়ার অর্থ এই নয় যে, অপলক নয়নে গভীরভাবে একবার দেখা। কারণ এটাও হারাম।
জারীর ইবনুআবদিল্লাহ বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম, যে দৃষ্টি হঠাৎ পড়ে যায় তার বিধান কী? তিনি বলেন-
اِصْرِفْ بَصَرَكَ
‘দৃষ্টিকে ফিরিয়ে নাও।’ (মেশকাতশরীফ)
অনেক সময় শরীয়তসম্মত কোনো অপারগতার কারণে বিচারক, ডাক্তার ও জজ পরনারীর চেহারা দেখতে হয়। এক্ষেত্রে দেখার সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে হবে।
কুদৃষ্টি অনিষ্টের মূল
পরনারীর প্রতি কামনার দৃষ্টিতে তাকানো সকল অনিষ্টের মূল। শয়তান পরনারীর চেহারাকে খুব নয়নলোভন পদ্ধতিতে উপস্থাপন করে। দূর থেকে সব জিনিস ভালোই দেখায়। এজন্যই প্রবাদ আছে, দূরের ঢোল শ্রম্নতিমধুর হয়। কুদৃষ্টির ফলে মানবহৃদয়ে পাপের বীজ তৈরি হয়। সুযোগ পেলেই তা ফুলে-ফেঁপে বিশাল হয়ে ওঠে। কাবিল হাবিলের স্ত্রীর রূপ-যৌবনের প্রতি কুদৃষ্টি দিয়েছিল। পরিণামে তার কাঁধে এমনই ভূত চড়ে বসেছিল, আপন ভাইকে হত্যা করতেও তার কলিজা কাঁপে নি। পবিত্র কুরআনে তার এহেন কর্মকান্ডের আলোচনা এসেছে। গুনাহর ভিত্তি রচনা করার কারণে কেয়ামত পর্যন্ত ঘটিতব্য সকল হত্যার বোঝা তার ঘাড়েও চাপানো হবো।
বোঝা গেল, প্রথমদৃষ্টির ব্যাপারে তো ছাড় আছে। কিন্তু দ্বিতীয়বারের ক্ষেত্রে এই ছাড়টা আর থাকবে না।
چلے كہ ايك نظر تيرى بزم ديكھ آئيں
يہا ں جوآ ے تو بے اختيار بيٹھ گے
‘চল, একপলক দেখে আসি সভা তোমার,
মনের অজান্তেই এখানে এসেই তুমি বসে পড়লে।’
এজন্য এটাই শ্রেয় যে, প্রথমদৃষ্টির হেফাজত করবে। আশঙ্কার ভেতরে পড়ে যাওয়া সচেতন লোকদের স্বভাব নয়।
কুদৃষ্টি ব্যভিচারের প্রথম সিঁড়ি
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
اَلْعَيْنَانِ زِنَاهُمَا النَّظْرُ وَالْاُذُنَانِ زِنَاهُمَا الْاِسْتِمَاعُ وَاللِّسَانُ زِنَاهُمَا الْككَلَامُ وَالْيَدُ زِنَاهُمَا الْبَطْشُ وَالرِّجْلُ زِنَاهُمَا الخُطَا وَالْقَلْبُ يَهْوِىْ وَيَتَمَنَّى وَيُصَدِّقُ ذَالِكَ الْفَرْجُ اَوْ يُكَذِّبُه
‘দুই চোখের ব্যভিচার হল হারাম দৃষ্টি দেয়া, দুই কানের ব্যভিচার হল পরনারীর কণ্ঠস্বর শোনা, যবানের ব্যভিচার হল অশোভন উক্তি, হাতের ব্যভিচার হল পরনারী স্পর্শ করা, পায়ের ব্যভিচার হল গুনাহর কাজের দিকে পা বাড়ান, অন্তরের ব্যভিচার হল কামনা-বাসনা আর গুপ্তাঙ্গঁ তা সত্য অথবা মিথ্যায় পরিণত করে।’ (মেশকাতশরীফ, খন্ড : ১, পৃষ্ঠা : ৩২)
ইমাম গাযালী রহ. বলেন, ‘দৃষ্টি অন্তরে খটকা তৈরি করে। খটকাটা কল্পনায় রূপ নেয়। কল্পনা জৈবিকতাড়নাকে উসকে দেয়। আর জৈবিকতাড়না ইচ্ছার জন্ম দেয়।’ সুতরাং বোঝা গেল পরনারীকে দেখার পরেই ব্যভিচারের ইচ্ছা জাগে। না দেখলে ইচ্ছাও জাগবে না। প্রতীয়মান হল, ব্যভিচারের প্রথমসিঁড়ির নাম হল কুদৃষ্টি। প্রবাদ আছে, পৃথিবীর সবচে দীর্ঘতম সফর এক পা ওঠালেই শুরু হয়ে যায়। অনুরূপভাবে কুদৃষ্টির মাধ্যমে শুরু হয় ব্যভিচারের সফর। ঈমানদারের কর্তব্য হল সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা ফেলা থেকে বিরত থাকা।
কুদৃষ্টি থেকে বেঁচে থাকার মাঝে রয়েছে ঈমানের স্বাদ
মুসনাদেআহমাদে এসেছে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَنْظُرُ اِلى مَحَاسِنِ الْمَرْأَةِ اَوَّلَ مَرَّةٍ ثُمَّ يَغُضُّ بَصَرَه
اِلَّا اَحْدَثَ اللهُ لَهُ عِبَادَةً يَجِدُ حَلَاوَتَهَا
‘কোনো মুসলিমব্যক্তি কোনো নারীর সৌন্দর্য্যের দিকে তাকাল, এরপর সে তার দৃষ্টি নামিয়ে নিল, আল্লাহতাআলা তার অন্তরে ইবাদতের এমন স্বাদ দান করবেন, যা সে অনুভব করবে।’
তাবারানীশরীফে পরনারী থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে-
مَنْ تَرَكَهَا مِنْ مَخَافَتِىْ اَبْدَلْتُهُ إِيْمَاناً يَجِدُ حَلَاوَتَه فِىْ قَلْبِه
‘যে আমার ভয়ে তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিবে, আমি অন্তরে এমন ঈমান সৃষ্টি করব, যাতে সে তার স্বাদ পাবে।’(আততারগীব ওয়াততারহীব, খন্ড : ০২, পৃষ্ঠা : ৩৭)
কত উপকারী বেচাকেনা। কুদৃষ্টির সাময়িক ও তুচ্ছ স্বাদ ছেড়ে দিলে ঈমানের স্থায়ী মিষ্টতা ভাগ্যে জুটে। প্রতীয়মান হল, মহান আল্লাহ এমন ব্যক্তির বুকে প্রশান্তি দান করেন। এটা নিয়মের কথাও যে, আমলের প্রতিদান অনুরূপ বস্ত্ত দ্বারা দেয়া হয়। সুতরাং পরনারীর প্রতি দৃষ্টি দেয়ার ক্ষণিকের মজা ছেড়ে দিলে, এর বিনিময়ে আল্লাহ ঈমানের স্বাদ দান করবেন।
কুদৃষ্টি দ্বারা কখনও তুষ্ট হওয়া যায় না
হযরত থানবী রহ. বলেন, কুদৃষ্টি যতই দাও, এমন কি হাজার হাজার নারী-পুরুষ চোখের সামনে ঘোরালেও, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কুদৃষ্টি দিলেও পরিতৃপ্ততার নাগাল পাওয়া যাবে না।
কুদৃষ্টি এমন পিপাসার নাম যা নিবারণ হয় না। পানিখেকো রোগীর মত। পানি যতই পান করুক, এমন কি পেট ফেটে যাওয়ার মত অবস্থা হলেও যেন পিপাসা মিটে না।
সৌন্দর্য আপেক্ষিক বিষয়। আল্লাহতাআলা একজনের চাইতে আরেকজনকে বেশি সৌন্দর্য দান করেছেন। যত সুন্দরী নারীই দেখুক না কেন, আরেকজনকে দেখার পিপাসা অন্তরে রয়েই যায়। এই সমুদ্রে সারাজীবন সাতার কেটেও তীরের নাগাল পাবে না। কারণ এই সমুদ্র কূল-কিনারাবিহীন।
কুদৃষ্টি ক্ষতকে গভীর করে
কুদৃষ্টির তীর বিঁধে গেলে অন্তরের জ্বালা শুধু বাড়তেই থাকে। কুদৃষ্টির বৃদ্ধির পাশাপাশি হৃদয়ের এ ক্ষত আরো গভীর হতে থাকে। হাফেজ ইবনুলকাইয়িম রহ. বলেন, দৃষ্টির তীরে প্রথমে বিদ্ধ হয় নিক্ষেপকারী নিজেই। কারণ হল, দৃষ্টি নিক্ষেপকারী অপরপক্ষের দৃষ্টিবিনিময়কে নিজের ক্ষতের ওষুধ বলে মনে করে। অথচ তা ক্ষতকে আরো গভীর করে। (আলজাওয়াবুলকাফী : ৪১৭)
لو گ كا نٹو ں سے بچ كے چلتے ہيں
ہم نے پھو لو ں سے زخم كھا ۓ ہيں
‘লোকেরা চলে কাঁটা এড়িয়ে আর আমি
ফুলের আঘাতে আহত।’
হাফেজ ইবনুলকাইয়িম রহ. বলেন-
اَلصَّبْرُ عَلى غَضِّ الْبَصَرِ اَيْسَرُ عَلى الصَّبْرِ عَلى الْقَدِّ بَعْدَهُ
‘চোখ বুজে নেওয়া কঠিন নয়, তবে চোখ খোলা রাখার পরবর্তী কষ্টে ধৈর্যধারণ করা কঠিন।’ (প্রাগুক্ত)
এ থেকে বুড়োরাও নিরাপদ নয়
ব্যভিচার থেকে অনেকেই বেঁচে থাকতে পারে। কারণ, এটি করার জন্য পস্ন্যান ও আয়োজন লাগে। প্রথমত সঙ্গীর সম্মতি লাগে। দ্বিতীয়ত উপযুক্ত স্থান ও সুযোগের দরকার হয়। তৃতীয়ত মানুষের সামনে ধরা খেলে লাঞ্ছিত হতে হয়, তাই নির্জনতারও প্রয়োজন হয়। এজন্য ভদ্র ও সম্মানিতলোকেরা এতে কম জড়ায়। পেশাদারনারীর সাথে ব্যভিচার করতে হলে টাকা-পয়সা পানির মত ঢালতে হয়। তাছাড়া এইডস সিফিলিস টাইপের যৌন রোগের ভয় তো আছেই। পক্ষান্তরে কুদৃষ্টির গুনাহ করতে হলে এত কিছুর দরকার হয় না। এতে মানসম্মান যাওয়ার ভয় থাকে না। কারণ, কে কোন্ দৃষ্টিতে কার দিকে তাকাচ্ছে- এটা তো আল্লাহই ভালো জানেন। বৃদ্ধ লোকটি যে কি-না যৌনক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, সেও খারাপ দৃষ্টিতে দেখতে পারে। বরং অনেক সময় সে গুনাহ না করতে পারার আফসোসেও কুরে কুরে জ্বলতে পারে। কবির ভাষায়-
جوا نى سے زياد ہ وقت پيرى جوش ہوتا ہے
بهڑ كتا ہے چراغ صبح جب خاموش ہوتا ہے
‘অনেক সময় যৌবনের চাইতে বার্ধক্যের তেজ বেশি হয়,
(যেমন) নিস্তব্ধ ভোরে প্রদীপ জ্বলে ওঠে।’
অনেকে দেহের দিক থেকে বৃদ্ধ হলেও অন্তরের দিক থেকে সতেজ থাকে। এরা যৌবনের স্মৃতি সবসময় নিজেদের মাঝে খুঁজে ফিরে। কবির ভাষায়-
پيرى تمام ذكر جوانى كٹ گئ
كيا رات تھى كہ ايك كہانى ميں كٹ گئ
‘যৌবনস্মৃতিতে চলে গেল গোটা বার্ধক্য,
কী সে রাত ছিল যে, এককাহিনীতেই শেষ হয়ে গেল।’
অনেকের এক পা চলে যায় কবরে, কোমরটা সোজা রাখতে পারে না, তবুও খুঁজে বেড়ায় হারিয়ে যাওয়া যৌবনকে। কবির ভাষায়-
عہد پيرى ميں جوانى كى امنگ
أه كسى وقت ميں كيا ياد آيا
‘বৃদ্ধবেলায় যৌবনের উদ্দামতা,
আহ! কোন্ সময় কী যে মনে পড়ে গেল।’
তামাশার আরেকটি দিক হল, অনেক সময় নারীরা পরপুরুষকে ‘বুড়োমানুষ’ মনে করে পর্দা করে না, ফলে বুড়োমানুষটি কুদৃষ্টির গুনাহ সহজেই করে নিতে পারে। কামনালিপ্সু বৃদ্ধরা চুল সাদা করে ফেলে, কিন্তু অন্তর থাকে কলুষিত। বিচারদিবসে সময়ের ভাষাতে বলবে-
ناكرده گنا ہو ں كى بهى حسرت كى ملے داد
يا رب! ا گران كرده گنا ہو ں كى سزا ہے
‘না করা গুনাহগুলোর যে আফসোস, তারও আজ সাজা হবে।
প্রভু হে! যদি শুধু কৃত গুনাহগুলোর শাস্তি হত।’
হযরত থানবী রহ. বলেন, একবৃদ্ধকে আমি চিনতাম। অনেক কাজে তিনি ছিলেন আল্লাহভীরু। কিন্তু তিনি নিজে বলেছেন, তিনি কুদৃষ্টির রোগে আক্রান্ত। কুদৃষ্টির গুনাহ এতটাই ভয়াবহ। বুড়োমিয়া কবরের পাড়ে চলে গেছেন কিন্তু পুরনোরোগ তার সাথে লেগেই আছে।
কুদৃষ্টির কারণে আমলের তাওফিক ছিনিয়ে নেয়া হয়
শাইখুলহাদীস মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া রহ. বলেন, কুদৃষ্টি অত্যন্ত খতরনাক রোগ। এ বিষয়ে আমার নিজেরও একটা অভিজ্ঞতা আছে। আমার অনেক বন্ধু-বান্ধব যিকির ও মুজাহাদার প্রথম দিকে জোশ ও মজার ঘোরে থাকেন। কিন্তু কুদৃষ্টির কারণে ইবাদতের মজা হারিয়ে ফেলেন। পরিণামে ধীরে ধীরে ইবাদত ছেড়ে দেয়ার দিকে অগ্রসর হন।(আপবীতী খন্ড-০৬, পৃষ্ঠা- ৪১৮)
উদাহরণস্বরূপ, সুস্থ যুবকের যদি জ্বর হয়, ভালো হওয়ার নামও না থাকে তাহলে দুর্বলতার কারণে সে চলাফেরাতেও অক্ষম হয়ে পড়ে। কাজের প্রতি সে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তার মন চায় বিছানায় পড়ে থাকতে। অনুরূপভাবে কুদৃষ্টির রোগে আক্রান্তব্যক্তিও আধ্যাত্মিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। নেককাজ করা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। কিংবা কথাটা এভাবেও বলা যেতে পারে যে, আমলের তাওফিক তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়। নেককাজের নিয়তও করে, কিন্তু কুদৃষ্টির কারণে নিয়তে দুর্বলতা চলে আসে। কবির ভাষায়-
تيار تهے نماز كو ہم سن كے ذكر حور
جلوه بتو ں كا ديكھ كر نيت بدل گئ
‘জান্নাতিহূরের কথা শোনে নামাযের জন্য
প্রস্ত্তত ছিলাম, মূর্তিগুলোর দাপানি দেখে নিয়ত পাল্টে গেল।’
কুদৃষ্টির কারণে মুখস্থশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে
মাওলানা খলিল আহমদ সাহারানপুরী রহ. বলেন, পরনারী কিংবা সুশ্রীবালকের প্রতি কামনার দৃষ্টিতে তাকালে মুখস্থশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। এ কথার সত্যতার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, কুদৃষ্টিদানকারী হাফেজের ‘মঞ্জিল’ মুখস্থ থাকে না। হেফজপড়ুয়া ছাত্রদের কুরআন মুখস্থ করা জটিল হয়ে দাঁড়ায়।
ইমাম শাফিঈ রহ. নিজ শিক্ষক ইমাম ওয়াকী রহ.-এর কাছে মুখস্থশক্তির দুর্বলতার অভিযোগ করেন। তিনি তাঁকে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার দিকনির্দেশনা দেন। ইমাম শাফিঈ রহ. এ ঘটনাকে কবিতার পোশাক পরিয়ে বলেন-
شَكَوْتُ اِلى وَكِيْعٍ سُوْءَ حِفْظِىْ
فَاَوْصَانِىْ اِلى تَرْكِ ا لْمَعَاصِىْ
فَاِنَّ الْعِلْمَ نُوْرٌ مِّنْ اِلَهِىْ
وَ نُوْرُ اللهِ لَا يُعْطَىْ لِعَاصِىْ
‘আমি ইমাম ওয়াকীর কাছে নিজের মুখস্থশক্তির দুর্বলতা সম্পর্কে অভিযোগ করলাম। তিনি আমাকে উপদেশ দিয়ে বললেন, হে ছাত্র! গুনাহ ত্যাগ কর। কেননা, ইলম আল্লাহতাআলার নূর। আল্লাহর নূর কোনো গুনাহগারকে দেয়া হয় না।’
কলেজ ইউনিভার্সিটি বিশেষত মাদরাসার ছাত্রদের জন্য এতে শিক্ষাগ্রহণের উপকরণ আছে।
কুদৃষ্টি লাঞ্ছণার কারণ
শায়খ ওয়াসিতী রহ. বলতেন, মহান আল্লাহ যখন কোনো বান্দাকে লাঞ্ছিত করতে চান, তখন তাকে সুন্দর চেহারা দেখার অভ্যাসে লিপ্ত করে দেন। বোঝা গেল, কুদৃষ্টি অপমানিত হওয়ার মৌলিককারণ। যেসব সৌভাগ্যবান নিজেদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে তারা অনেক আপদ-মুসিবত থেকে বেঁচে থাকতে সক্ষম হয়। মীর তকী মীরের ভাষায়-
اس عاشقى ميں عزت سادات بهى گئ
‘প্রেমের এ খেলায় সাইয়েদদের সম্মানও গেল।’
মির্জা গালিব বলেন-
عشق نے غالب كو نكما كرديا
ورنہ ہم بهى آدمى تهے كام كے
‘প্রেমমগ্নতা গালিবকে করেছে অকর্মা,
অন্যথায় আমিও ছিলাম কাজের মানুষ।’
কুদৃষ্টির কারণে বরকত শেষ হয়ে যায়
কুদৃষ্টির অন্যতম মন্দপ্রভাব হল, এর কারণে রুটি রুজি ও সময়ের বরকত শেষ হয়ে যায়। ছোট ছোটকাজে বড় বড় সমস্যা ছুটে আসে। যাপিতজীবনের কষ্ট ও চেষ্টা সফলতার মুখ দেখে না। আপাতদৃষ্টিতে কাজ সম্পন্ন মনে হলেও যথাসময়ে কাজ অসম্পন্ন দেখা যায়। পেরেশানি ও টেনশনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মানুষ মনে করে, কেউ কিছু একটা করেছে। অথচ সে নিজের আত্মিককলুষতার কারণে বিপদাপদের মধ্যে পড়ে থাকে। নিজেই স্বীকার করে যে, একটা সময় ছিল যখন সে মাটিতে হাত রাখলেও সোনা হয়ে যেত। আর এখন সোনায় হাত রাখলেও মাটিতে পরিণত হয়। এসবই কুদৃষ্টির কারণে হয়।
কুদৃষ্টিদানকারীর কাছে শয়তানের অনেক আশা-ভরসা
জনৈক বুযুর্গের শয়তানের সাথে দেখা হল। তিনি শয়তানের কাছে জানতে চাইলেন, যে কারণে মানুষ তোমার জালে ধরা পড়ে সে ধ্বংসাত্মক কাজ কোনটি? শয়তান উত্তর দিল, পরনারীর প্রতি কামনার দৃষ্টি দেয়া এমন কাজ, আমি তার ব্যাপারে প্রত্যাশা রাখি যে, সে আমার জালে যেকোনো সময় ফেঁসে যাবে। দৃষ্টি অবনত রাখে এমন লোকের ব্যাপারে আমি নিরাশায় ভুগতে থাকি, আমার অনেক চেষ্টা-তদবির তার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়ে যায়। আমি শপথ করেছিলাম, আদমসন্তানকে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরব। চারিদিকের মধ্যে নিচের দিক পড়ে না। তাই এই দিকটা নিরাপদ। যেব্যক্তি দৃষ্টি নিচু করে সে আমাকে আশাহত করে।
কুদৃষ্টির কারণে নেকি নষ্ট এবং গুনাহ অনিবার্য
পরনারীর প্রতি কামনার দৃষ্টিদানকারী নগদ হোক কিংবা দেরিতে হোক ইশকেমাজাযী তথা অনৈতিক সম্পর্কে সাধারণত আটকা পড়ে। সে মাখলুককে নিজের প্রেমপাত্র বানিয়ে নেয়। জনৈক লোকের ভাষায়-
تو ہى ميرا دين و ايمان سجنا ں
‘হে প্রিয়তম! তুমিই আমার দীন ও ঈমান।’
এ জাতীয় কাজকে শিরকেখফী তথা গোপন শিরক বলা হয়। অথচ শিরক এমন গুনাহ যার কারণে সকল নেকি ধ্বংস হয়ে যাবে। এটাকেই বলে, নেকী ধ্বংস এবং গুনাহ অনিবার্য।
কুদৃষ্টির কারণে মহান আল্লাহর অহঙ্কার জেগে ওঠে
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
اَنَا غَيُوْرٌ وَاللهُ اَغْيَرُ مِنِّىْ وَ مِنْ غَيْرَتِه حَرَّمَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَماَ بَطَنَ
‘আমি আত্মমর্যাদাশীল। আল্লাহতাআলা আমার চেয়েও অধিক আত্মমর্যাদাশীল। আত্মমর্যাদাবোধের কারণে আল্লাহ বাহ্যিক ও গোপন অশ্লীলতা হারাম করেছেন।’
কুদৃষ্টি বেহায়াপনার ভূমিকাস্বরূপ। এটিতে কেউ লিপ্ত হলে মহান আল্লাহর অহঙ্কারে আঘাত আসে। তাকে তাঁর মহান দরবার থেকে অভিশপ্ত করে তাড়িয়ে দেয়া হয়। কুদৃষ্টিদানকারীকে নিজ রহমত থেকে দূরে ঠেলে দেয়া হয়। যারা সৎজীবনযাপন করতে চান, তারা যেন কুদৃষ্টির গুনাহ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকেন। এতে তাঁর রহমতঘনিষ্ঠ হওয়া যাবে।
কুদৃষ্টিদানকারী অভিশপ্ত
হাদীসশরীফে আছে-
لَعَنَ اللهُ النَّاظِرَ وَالْمَنْظُوْرَ اِلَيْهِ
‘মহান আল্লাহ অভিশম্পাত দেন দৃষ্টিাদানকারী পুরুষ ও দৃষ্টিদানে সুযোগদানকারী নারীর ওপর।’ (বাইহাকী, মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা-২৭০)
যেসব মেয়ে সাজগোজ করে পর্দার তোয়াক্কা না করে ঘুরে বেড়ায় এবং যারা তাদের দিকে কামনার দৃষ্টিতে তাকায়- উভয় শ্রেণী অভিশপ্ত। এটা কত বড় ক্ষতির কথা! কুদৃষ্টিদানকারী গুনাহয় লিপ্ত থাকাবস্থায় আল্লাহর রহমত থেকে ছিটকে পড়ে এবং তাঁর লা’নতের পাত্র হয়ে যায়। সুতরাং তাওবা করা উচিত। এমন যেন না হয়, মৃত্যু চলে এল অপরদিকে লা’নতের মধ্যে পড়ে রইল। মহান আল্লাহ বলেন –
خَسِرَ الدُّنْيَا وَالْآخِرِةُ ذَالِكَ هُوَ الْخُسْرَانُ الْمُبِيْنُ
‘এটা দুনিয়া ও আখেরাতের অপদস্থতা এবং স্পষ্ট অপদস্থতা।’
কুদৃষ্টিকে মানুষ সাধারণ মনে করে
কুদৃষ্টি বড় ধরনের গুনাহ হওয়া সত্ত্বেও অধিকাংশ মানুষ একে সাধারণ মনে করে। এজন্য দেদারসে এটি করে যায়। যৌবনের শুরুতে যৌবনের প্রাবল্যের কারণে গুনাহটি করে থাকে। পরে তা এমন দূরারোগ্যব্যাধিতে রূপ নেয় যে, কবরে যাওয়া পর্যন্ত এটি আর ছাড়াতে পারে না। সুতরাং এটি সাধারণ গুনাহ নয় বরং-
إِنَّهُ مِنْ اَعْظَمِ الْمَصَائِبِ
‘এটি মহা বিপদের একটি।’
কুদৃষ্টি থেকে কুকর্ম পর্যন্ত
হাফেজ ইবনুলকাইয়িম রহ. বলেন, দুর্ঘটনার শুরু হয় দৃষ্টি থেকে। যেমন লেলিহান আগুনের শুরুটা একটিমাত্র কয়লা দিয়ে। সুতরাং লজ্জাস্থানের সংরক্ষণের জন্য দৃষ্টির সংরক্ষণ জরুরী। (আলজাওয়াবুলকাফী, পৃষ্ঠা : ২০৪)
যেসব লোক কুদৃষ্টিতে জড়িয়ে পড়ে তারাই কুকর্মে লিপ্ত হয়। যাদের দৃষ্টি স্বাধীনতার শিকার হয় তাদের লজ্জাস্থান নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তখন মানুষ অপরিহার্যভাবে কুকর্মে জড়িয়ে পড়ে। সুতরাং জানা গেল, চোখ প্রথমে শুরু করে এবং লজ্জাস্থান তার শেষটা করে।
কুদৃষ্টির কারণে দেহে দুর্গন্ধ
শাইখুলহাদীস মাওলানা মুহাম্মদ যাকারিয়া রহ. বলেন, এটা খুবই পরীক্ষিত বিষয় যে, কুদৃষ্টির কারণে কাপড়ে দুর্গন্ধ তৈরি হয়। (আপবীতি)
কুদৃষ্টি কত ক্ষতিকর বিষয় যে, এর প্রতিক্রিয়া নগদ প্রকাশ পায়। এমনকি শরীর ও কাপড় থেকে দুর্গন্ধ বেরিয়ে আসে। পক্ষান্তরে যারা কুদৃষ্টিকে শালীন বানায়, পবিত্র জীবন যাপন করে তাদের দেহ থেকে সুগন্ধি ছড়ায়। হাদীস থেকে এর সমর্থন পাওয়া যায়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র দেহ থেকে এমন সুগন্ধি ছড়াত যে, সাহাবায়েকেরাম বুঝতে সক্ষম হতেন, এপথ দিয়ে নবীজী গিয়েছিলেন।
একহাদীসে এসেছে, উম্মেসুলাইম রাযি. ছোটদের মাধ্যমে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিন্দু-বিন্দু ঘাম শিশিতে সংগ্রহ করে নিতেন। পরে তা যখন সুগন্ধির সাথে মেশাতেন সুগন্ধি আরো বেড়ে যেত।
এই বিষয় দেখা যায় হযরত আবুবকর সিদ্দীক রাযি-এর মাঝে। হযরত উমর রাযি. বলতেন-
كَانَ رِيْحُ اَبِىْ بَكْر اَطْيَبَ مِنْ رِيْحِ الْمِسْكِ
‘আবুবকরের শরীরের সুগন্ধ মিশকের সুগন্ধির চেয়েও বেশি মোহনীয়।’
এর দ্বারা বোঝা গেল, পবিত্র শালীন জীবনযাপনকারীর শরীরে সুগন্ধির সৃষ্টি হয়, বিপরীতে অশ্লীলতায় লিপ্তব্যক্তির দেহে দুর্গন্ধ তৈরি হয়। যারা ইউরোপ আমেরিকায় গিয়েছেন তাদের এ অভিজ্ঞতা নিশ্চয় আছে যে, ইংরেজরা দেখতে অনেক স্মার্ট মনে হয়, তাদের পোশাকও থাকে বেশ পরিচ্ছন্ন, কিন্তু বিমানে পাশের সিটে বসলে একধরনের উৎকট গন্ধ তাদের শরীর থেকে স্পষ্ট অনুভূত হয়।
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন-
إِنَّمَا الْمُشْرِكُوْنَ نَجِسٌ
‘নিশ্চয় মুশরিকরা অপবিত্র।’
সারা দুনিয়া জানে অপবিত্রের মধ্যে দুর্গন্ধ থাকে, এর চেয়ে বেশি কিছু বলার প্রয়োজন নেই।
কুদৃষ্টির নগদ সাজা
কুদৃষ্টির একটি ধরন হল, কারো ঘরের দরজা-জানালা কিংবা ছিদ্র দিয়ে দেখা। হাদীসশরীফে এ ব্যপারে কঠোর সতর্কবাণী এসেছে। এমনকি ঘরের মালিককে দর্শনকারীর চোখ ফুঁড়ে দেয়ার অধিকারও দেয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
إِنَّ اِمْرَأً اِطَّلَعَ عَلَيْكَ بِغَيْرِ اِذْنِ فَخَذَفْتَه بِحِصَاةٍ فَفَقَأَتْ عَيْنُه
مَا كَانَ عَلَيْكَ مِنْ جَنَاحٍ
‘কেউ যদি অনুমতি ছাড়া তোমার ঘরের দিকে উঁকি মেরে দেখে তুমি তার প্রতি পাথর নিক্ষেপ কর। এর দ্বারা যদি তার চোখ ফুটো হয়ে যায় তোমার কোনো অপরাধ হবে না।’ (ইবনেকাসীর, খন্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ২৮০)
কুদৃষ্টির কারণে পবিত্র কুরআন ভুলে গেল
ইমাম ইবনুলজাওযী রহ. ‘তালবীসেইবলীস’ কিতাবে লিখেছেন, আবুআব্দুল্লাহ ইবনে আজলা বলেন, আমি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে একটি খৃস্টান সুশ্রীবালককে দেখছিলাম। ইত্যবসরে আবুআবদিল্লাহ বালখী রহ. আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, দাঁড়িয়ে আছ কেন? আমি বললাম, চাচা! একটু দেখুন, এই সুদর্শন চেহারাটিকে কিভাবে জাহান্নামের আগুনে শাস্তি দেয়া হবে! আমার এ উত্তর শুনে তিনি তার দুটো হাত দ্বারা আমার কাঁধে চাপড় মেরে বললেন, এই কুদৃষ্টির ফল তুমি পাবে। বেশ কিছুকাল যদিও চলে গেছে। কিন্তু চল্লিশবছর পর আমি গুনাহটির প্রতিক্রিয়া দেখলাম। পবিত্র কুরআন আমি ভুলে গেলাম।(তালবীসেইবলীস, পৃষ্ঠা : ৩৪৯)
আবুলআইয়ান বলেন, আমি আমার উসতাদ আবুবকর দাক্কাকের সাথে যাচ্ছিলাম। ইতোমধ্যে একটি কিশোরের কমনীয় চেহারার ওপর আমার কামদৃষ্টি পড়ে। উসতাদ সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেললেন। বললেন, তুমি এর পরিণতি ভোগ করবে। কিছুদিন পর আমি কুরআনমাজীদ ভুলে গেলাম।
কুদৃষ্টি ও ফটো-ভিডিও
কুদৃষ্টির আরেকটি ধরন হল, সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনে ব্যবহৃত কিংবা যৌনম্যাগাজিনের কভারপেজে ব্যবহৃত নগ্ন ফটো দেখা, টিভির সংবাদ দেখার বাহানায় ফিল্ম-নাটকের অভিনেত্রীদেরকে দেখা, পথে চলতে গিয়ে বিভিন্ন সাইনবোর্ডের মডেলদেরকে দেখা, গার্লফ্রেন্ড কিংবা বয়ফ্রেন্ডের ফটো লুকিয়ে রাখা এবং নির্জন পরিবেশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যৌনকাতর হয়ে দেখা, ইন্টারনেটে, পেশাদার নারীদের নগ্ন ফটো-ভিডিও দেখা অথবা বস্নুফ্লিম সম্বলিত সিডি দেখা- এসব কিছুই কুদৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত এবং হারাম। অনেকে বিয়ে-শাদির সময় নারী-পুরুষের অবাধ চলাফেরা সম্বলিত অনুষ্ঠানের ফটো-ভিডিও করে নিজের কাছে রেখে দেয় এবং নিজে দেখে, অন্যদেরকেও দেখায়। মনে রাখবেন, ফটো-ভিডিও দেখা সরাসরি দেখার চেয়েও ক্ষতিকর। পথের দেখা এতটা নিখুঁত ও নিবিড় হয়না, যতটা ফটো-ভিডিও দ্বারা হয়। তাই এর থেকে আরো বেশি সতর্ক থাকা জরুরি। বিকৃত রুচির জনৈক কবি ফটোর প্রশংসা করতে গিয়ে লিখেছেন-
تر ے تصوير ميں ايك بات تجھ سے بهى نرالى ہے
كہ جتنا چا ہوبو سے لو نہ جهڑ كى ہے نہ گالى ہے
‘তোমার ছবিতে একটি বিষয় তোমার চেয়ে সুখকর,
যত চাই চুমো দেই, নেই কোনো ঝাড়ি ও গালি।’
কুদৃষ্টি এবং সৌন্দর্যপ্রেমের ধোঁকা
কিছু অজ্ঞলোক বলে থাকে, আমরা সুদর্শন চেহারা দেখে মহান আল্লাহর বড়ত্বের সাথে পরিচিত হই। এটা নিচক প্রতারণা ও শয়তানিপ্রবঞ্চণা। মহান আল্লাহর বহু সৃষ্টি আছে যেগুলো দেখা বৈধ এবং যেগুলো তাঁর বিস্ময়কর কুদরতের বহিঃপ্রকাশ। ফুলের বিচিত্র বাহার দেখুন, সেগুলোর সৌরভ নিয়ে ভাবুন। ফলের সুগন্ধি কিভাবে মানুষের অন্তপ্রাণকে আচ্ছন্ন করে নেয়, তা সম্পর্কে চিন্তা করুন। ফলের বৈচিত্র ও মিষ্টতা সম্পর্কে ভাবুন। মহান আল্লাহ বলেন-
أُنْظُرُوْا إِلى ثَمَرِه إِذَا اَثْمَرَ
‘ফলের প্রতি তাকাও যখন তা পূর্ণতা লাভ করে।’
সমুদ্র লেক ও ঝর্ণাধারাগুলো দেখুন। পৃথিবীর প্রশস্ততা আকাশের উচ্চতা মানুষকে আহবান করে নিজেকে নিয়ে ভাবনার প্রতি। মহান আল্লাহ বলেন-
أَفَلَا يَنْظُرُوْنَ إِلى إِلْإِبِلِ كَيْفَ خُلِقَتْ وَإِلى السَّمَاءِ كَيْفَ رُفِعَتْ وَإِلى الْجِبَالِ كَيْفَ نُصِبَتْ وَ إِلى الْأَرْضِ كَيْفَ سُطِحَتْ
‘তবে কি তারা দৃষ্টিপাত করে না উটের দিকে, কিভাবে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং আকাশের দিকে কিভাবে ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে এবং পর্বতমালার দিকে, কিভাবে তাকে স্থাপন করা হয়েছে এবং ভূমন্ডলের দিকে কিভাবে তাকে বিস্তৃত করা হয়েছে?’
ভাবতে মনে চাইলে চাঁদ সূর্য তারকার সৌন্দর্য নিয়ে ভাবুন। বাতাসে উড়ন্ত দৃষ্টিনন্দন পাখি, পানির সাতারু বিচিত্র মৎসরাজি কি ভাবনার জন্য যথেষ্ট নয়? শুধু মানুষের চেহারা ভাবনার জন্য রয়ে গেল? এসবই খোঁড়া অজুহাত। গুনাহর অজুহাত নিকৃষ্ট গুনাহর মতই। হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ. এর সামনে একবার মনের কাছে পরাজিত একলোক এই অজুহাত পেশ করল যে, আমি তো সুশ্রীচেহারাগুলো দেখি আল্লাহর সৃষ্টিনিপুনতা ও কুদরতের কারিশমা অনুধাবন করার জন্য। তিনি লোকটিকে অত্যন্ত শিক্ষণীয় উত্তর দিলেন, বললেন, তুমি তোমার মায়ের লজ্জাস্থান নিয়ে ভাবো যে, কিভাবে এত সঙ্কীর্ণ পথ দিয়ে তোমার মত মানুষ জন্ম দিয়েছেন!
কুদৃষ্টির অশুভ পরিণাম
হযরত উসমানগণী রাযি.-এর কাছে একব্যক্তি এল যার দৃষ্টি পথে অবাঞ্চিত স্থানে পড়েছিল। তিনি লোকটির চোখ দেখেই বুঝে ফেললেন। বললেন-
مَا بَالُ أَقْوَا مٍ يَتَرَشَّحُ الزِّنَا مِنْ أَعْيُنِهِمْ
‘এজাতির কী হয়ে গেল! তাদের চোখ দিয়ে ব্যভিচার টপকে পড়ছে।’
লোকটি অবাক হয়ে গেল। বলে ওঠল, এখনও অহির ধারা অবশিষ্ট আছে? উসমান রাযি. উত্তর দিলেন, না, এটা তো মুমিনের অন্তদৃষ্টি।
اِتَّقُوْا فِرَاسَةَ الْمُؤْمِنِ فَاِنَّهُ يَنْظُرُ بِنُوْرِ اللهِ
‘মুমিনের অন্তদৃষ্টিকে ভয় কর। কারণ তিনি আল্লাহর নূর দ্বারা দেখেন।’
কাশফের অধিকারীরা লিখেছেন, কুদৃষ্টির কারণে এমন অন্ধকার সৃষ্টি হয় যে, যা অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লোকেরা ধরে ফেলেন। পক্ষান্তরে শালীন ও আল্লাহভীরুব্যক্তির চোখে থাকে নূর।
কুদৃষ্টির দৃষ্টান্তমূলক পরিণতি
শাইখুলহাদীস মাওলানা যাকারিয়া রহ. বলেন, একব্যক্তির ঘটনা। মৃত্যুর কাছাকাছি সময়ে লোকেরা তাকে কালেমার তালকীন দিল। লোকটি বলল, আমার জিহবা তো কালেমার জন্য নড়ে না। জিজ্ঞেস করা হল, কারণ কী? সে জানাল, এক মহিলা আমার কাছে এসেছিল তোয়ালে খরিদ করার জন্য। আমার ভালো লেগে ওঠে। আমি কামদৃষ্টি দিয়ে তাকে দেখেছিলাম।
ইবনুলজাওযী রহ. লিখেছেন, মিসরের জামেমসজিদের মুয়াজ্জিন আযান দেয়ার উদ্দেশে মিনারে ওঠল। পাশের ছাদে দৃষ্টি পড়তে জনৈক সুন্দরী খৃস্টাননারীর প্রতি তার চোখ পড়ল। ভাবল, নতুন ভাড়াটিয়া মনে হচ্ছে, আযানের পর গিয়ে পরিচিত হব। আযানের পর মুয়াজ্জিন গেল ওই প্রতিবেশীর বাড়িতে। দরজায় কড়া নাড়ার পর মহিলাটির বাবা বের হল। কথাবার্তার একটা পর্যায়ে জানা গেল, এতো মহিলা নয়; বরং কুমারী মেয়ে। এখনও বিয়ে হয় নি। মুয়াজ্জিন বিয়ের প্রস্তাব দিল। মেয়ের বাবা শর্ত জুড়ে দিল, আমাদের ধর্মগ্রহণ করতে হবে। মুয়াজ্জিনের অন্তরে কামনার এমন ভূত চেপে বসেছিল যে, সে ‘হ্যাঁ’ বলে দিল। মেয়ের বাবা বলল, ঠিক আছে, চল, ছাদে গিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি। মুয়াজ্জিন সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠতে লাগল। হঠাৎ পা পিছলে সে পড়ে গেল এবং ঘাড়ের রগ ছিঁড়ে গিয়ে সেখানেই মারা গেল।
نہ خدا ہى ملا نہ وصال صنم
نہ ادهر كے ہے نہ ادهر كے ہے
আল্লাহকে পেল না, প্রতিমারও ঘনিষ্ঠ হল না।
এ কূলও পেল না, ওই কূলও রইল না।
কুদৃষ্টির অনির্ধারিত শাস্তি
আল্লাহতাআলা বলেন-
يَعْلَمُ خَائِنَةُ الْاَعْيُنِ وَ مَا تُخْفِىْ الصُّدُوْرُ.
‘তিনি চোখের খেয়ানত ও অন্তরের মাঝে লুকায়িত বিষয়সমূহ সম্পর্কে জানেন।’
আলোচ্য আয়াতে ‘কুদৃষ্টি গুনাহ’ এটা বলা হয়েছে। কিন্তু নির্ধারিত কোনো শাস্তির কথা বলা হয় নি। এর রহস্য হল, মানুষ সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে। এক ধরনের লোক হল, যাদের অনুভূতিশক্তি এতটাই ভোঁতা যে, এরা কথায় নয়; বরং জুতায় মানে। আয়াতটিতে তাদেরকে হুমকি দেয়া হয়েছে যে, আমি চোখের খেয়ানত সম্পর্কে জানি। যদি বিরত না থাকো তাহলে মর্মস্পর্শী শাস্তি দেয়া হবে।
چوريا ں آنكهو ں كى اور سينو ں كى راز
جانتا ہے سب كو توا ے بے نياز
‘চোখের চুরি আর অন্তরের ভেদ,
হে অমুখাপেক্ষী আল্লাহ! তুমি জান সবকিছু।’
আরেক ধরনের লোক হল, অনুভূতিপ্রবণ; তারা যখন অনুধাবন করতে পারে যে, আমাদের মালিক আমাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে জেনে ফেলেছেন, তখন তারা লজ্জায় কাতর হয়ে যায়। আয়াতটিতে তাদেরকেও লজ্জা দেয়া হচ্ছে। এদের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। কুদৃষ্টির সাজা প্রত্যেককেই তার স্বভাব অনুপাতে দেয়া হবে। জনৈক লোকের ভাষায়-
جيسے روح و يسے فرشتے
‘আত্মা যেমন ফেরেশতা তেমন।’
جتنا بے حيا اتنى زياده سزا
‘নিলর্জ্জতা যত সাজাও হবে তত।’
কুদৃষ্টির প্রভাব অন্তরে
হযরতে আকদাস থানবী রহ. বলেন, দৃষ্টিদানের মাধ্যমে অন্তরের গুনাহর অস্তিত্ব আসে। অনেকে পরনারী ও সুশ্রীবালকের দিকে লালসার দৃষ্টিতে তাকায়। তখন অন্তরের এর একটা ছাপ পড়ে যায়। তারপর সে নির্জনে কল্পনার মাধ্যমে উক্ত লালসা চরিতার্থ করে। অন্তরের এ গুনাহ চোখের গুনাহর চেয়েও জঘন্য। ফকীহগণ লিখেছেন, কোনোব্যক্তি নিজ স্ত্রীর সাথে সহবাসকালে যদি পরনারীর কল্পনা করে তাহলে তার ব্যভিচারের গুনাহ হবে।
কুদৃষ্টি এবং নূরবিহীন চেহারা
কুদৃষ্টির কারণে চেহারার নূর চলে যাওয়া কুদৃষ্টির অন্যতম প্রভাব। হাদীসে আছে-
عَنْ اَبِىْ اُمَامَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَتَغُضَّنَّ اَبْصاَرَكُمْ وَلَتَحْفَظَنَّ فُرُوْجَكُمْ اَوْ لَيَكْسِفَنَّ اللهُ وُجُوْهَكُمْ
‘আবুউসামা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের চোখ অবশ্যই নিম্নগামী করবে এবং তোমাদের গুপ্তাঙ্গ সংরক্ষণ করবে তা না হলে আল্লাহতাআলা তোমাদের চেহারা বিনষ্ট করে দিবেন।’(তাবারানী বর্ণিত, আততারগীব ওয়াততারহীব, খন্ড : ০৩, পৃষ্ঠা : ৩৭)
চেহারা বিনষ্ট হওয়ার প্রথম ধাপ হল, চেহারাকে নূরবিহীন করে দেয়া। সুন্দর হওয়া সত্ত্বেও চেহারার মায়া চলে যাবে।
কুদৃষ্টিমুক্ত থাকার পুরস্কার
যেব্যক্তি দৃষ্টির হেফাজত করবে পরকালে সে দুটি পুরস্কার পাবে। প্রথমত, প্রতিটি দৃষ্টির হেফাজতের বিনিময়ে আল্লাহর সাক্ষাত লাভ দ্বারা সে ধন্য হবে। দ্বিতীয়ত, এমন চোখ কেয়ামতের দিন কান্না থেকে নিরাপদ থাকবে। পবিত্র হাদীসে আছে-
رُوِىَ عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَاَلَ رَسُوْلُ اللهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كُلُّ عَيْنٍ بَاكِيَةٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ اِلَّا عَيْنٌ غَضَّتْ عَنْ مَحَارِمِ اللهِ وَ عَيْنٌ سَهِرَتْ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ وَ عَيْنٌ خَرَجَ مِنْهَا مِثْلُ رَأْسِ الذُّبَابِ مِنْ خَشْيَةِ اللهِ
‘হযরত আবুহুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কেয়ামতের দিন সকল চোখ থেকেই পানি ঝরবে। তবে, কেবলমাত্র আল্লাহ ঘোষিত নিষিদ্ধ দৃষ্টি থেকে যে তার চোখ অবনমিত করেছে, যে চোখ আল্লাহর পথে পাহারায় কেটেছে এবং যে চোখ থেকে আল্লাহর ভয়ে মাছির মাথার পরিমাণ পানি বেরিয়েছে। তা ব্যতীত।’ (আততারগীব ওয়াততারহীব, খন্ড : ০৩, পৃষ্ঠা : ৩৪)
কুদৃষ্টির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা
কুদৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। পুরুষদের জন্য কেবল পরনারীকে দেখা নয়; বরং যদি মাহরামনারীকে দেখলেও কামনা জাগে তখন তাদেরকেও দেখা থেকে বেঁচে থাকতে হবে। বালকদেরকে দেখার ক্ষেত্রেও একই কথা। বরং কোনো পুরুষকে দেখলে যদি গুনাহর চিন্তা আসে তাহলে তাকেও দেখবে না। একই বিষয় নারীদের ক্ষেত্রেও। তাদের জন্য কেবল পরপুরুষ নয়; বরং কোনো ছোটছেলেকে দেখার পর যদি কুকল্পনা আসে তাকেও দেখা থেকে বিরত থাকবে। হযরত আবুহুরাইরা রাযি. ছোটছেলেদের প্রতি স্থির দৃষ্টিতে তাকানো থেকে নিষেধ করতেন। (তালবীসেইবলীস, পৃষ্ঠা : ৩৪৬)
আমাদের মাশায়েখ বলেছেন, তোমরা বালকদের সাথে বসো না। কারণ এটা মেয়েঘটিত দুর্ঘটনা থেকেও খতরনাক। এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হল, পরমেয়ের সাথে বসার ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা থাকে, পক্ষান্তরে কমবয়সী ছেলেদের সাথে বসার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকে না। সুতরাং এক্ষেত্রে ফেতনার আশঙ্কা বেশি। অনুরূপভাবে মহিলাদের জন্য পরপুরুষ পর্যন্ত পৌঁছার ক্ষেত্রে অনেক জটিলতা থাকে। কিন্তু নারী নারীর পাশে বসা সহজ। সুতরাং কোনো নারী যদি এই আশঙ্কা করে যে, অমুক মেয়ের পাশে বসলে গুনাহয় জড়িয়ে পড়ার ভয় আছে, তাহলে তার থেকেও পরপুরুষের মতই নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। প্রয়োজনে তার চেহারার প্রতিও তাকাবে না। তার সাথে গল্প করবে না।
قدم قدم پہ يہا ں احتياط لازم ہے
كہ منتظر ہے يہ دنيا كسى بہانے كى
‘এজগতে প্রতিটি পদক্ষেপে প্রয়োজন সতর্ক থাকার
কারণ দুনিয়া অপেক্ষায় থাকে কোনো বাহানার।’
কুদৃষ্টির কারণে হাতিও টলে যায়
কুদৃষ্টিতে অভ্যস্তব্যক্তি কখনও লজ্জাস্থানের সংরক্ষণ করতে পারে না। শয়তান তাকে কুকৌশলে ধোঁকায় ফেলে রাখে যে, তুমি তো কেবল দেখছ, করছ না তো! অথচ দেখাটাই তো করার ভূমিকা। দৃশ্যত মানুষ যত দৃঢ়চেতার অধিকারীই হোক (এমনকি হাতির মত হলেও) কুদৃষ্টি থেকে বেঁচে না থাকলে একদিন না হয় একদিন ফেঁসে যাবেই।
اب جس كے جى ميں آ ۓ وہى پا ۓ روشنى
ہم نے تو دل جلا كے سر عام ركهديا
‘এবার যার মনে দাগ কাটবে সেই আলো পাবে।
আমি অন্তর জ্বালিয়ে সবার সামনে রেখে দিয়েছি।’
কুদৃষ্টির তিনটি বড় ক্ষতি
কুদৃষ্টির কারণে মানুষের অন্তরে যৌনউদ্দামতার ঝড় সৃষ্টি হয়। মানুষ এ বন্যার তীব্রতায় ভেসে যায়। এর কারণে তিনটি বড় ক্ষতি অস্তিত্বে আসে।
এক. কুদৃষ্টির কারণে মানুষের অন্তরে কল্পিতপ্রিয়ার ছবি তৈরি হয়। সুন্দর চেহারা তার দেল-দেমাগে জেঁকে বসে। সে জানে, কল্পিতচেহারার অধিকারীণী পর্যন্ত পৌঁছতে সে পারবে না, তবুও সে নির্জনে তার কথা ভেবে মজা ভোগ করে। অনেক সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার সাথে কল্পনার জগতে গল্প করে। বিষয়টা এ পর্যন্ত গড়ায় যে, কবির ভাষায়-
تم مير ے پاس ہوتے ہو گويا
جب كو ئ دوسرا نہيں ہوتا
‘তুমি যেন আমার পাশে তখন থাকো,
যখন কেউ থাকে না।’
কুদৃষ্টিকে বাহন বানিয়েই শয়তান মানুষের মনমস্তিষ্কে জেঁকে বসে এবং তাকে শয়তানিকর্মকান্ড করার প্রতি তাড়া দেয়। ফাঁকা নির্জনস্থানে যেমনিভাবে অন্ধকার তার গাঢ় প্রভাব বিস্তার করে, অনুরূপভাবে শয়তানও ওইব্যক্তির অন্তরে বিষাক্ত প্রভাব ঢেলে দেয়। যাতে করে সে তার সামনে নিষিদ্ধ বিষয়গুলো খুবই আকর্ষণীয়পদ্ধতিতে উপস্থাপন করতে পারে এবং তার সামনে একটি নয়নলোভন মূর্তি তৈরি দাঁড় করিয়ে দিতে সক্ষম হয়। এমনব্যক্তির অন্তর দিবানিশি ওই মূর্তিটার পূজায় লিপ্ত থাকে। ইতরামিপূর্ণ আশা ও কামনা নিয়ে সে মেতে ওঠে। এটাকেই বলা হয় কামপূজা প্রবৃত্তিপূজা নফসপূজা। বরং এটা একপ্রকার মূর্তিপূজাও। এটা শিরকেখফী তথা গোপন শিরিক। আল্লাহতাআলা বলেন-
وَلَا تُطِعْ مَنْ اَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَنْ ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ اَمْرُهُ فُرُطاً
‘আর ওইব্যক্তির আনুগত্য করো না, যার চিত্তকে আমি আমার স্মরণ থেকে অমনোযোগী করে দিয়েছি। যে তার খেয়াল-খুশির অনুসরণ করে এবং যার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে।’ (সূরা কাহ্ফ : ২৮)
এসব কল্পিত উপাস্য থেকে নিজের অন্তপ্রাণকে মুক্ত করা ছাড়া ঈমানের স্বাদ ভাগ্যে জুটবে না এবং আল্লাহর নৈকট্যের সিণগ্ধ বাতাস পাওয়া যাবে না। কবির ভাষায়-
بتو ں كو تو ڑ كر تخيل كے ہو ں كے پتهر كے
‘মূর্তিগুলো ভেঙ্গে কল্পনায় হয়ে আছ পাথরের।’
দুই. কুদৃষ্টির দ্বিতীয় ক্ষতি হল, মানুষের মনমস্তিষ্ক বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে যায়। ঘরে সতী-সাধবী স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তার অন্তর স্ত্রীর প্রতি আসক্ত হয় না। স্ত্রী ভাল লাগে না। খুটিনাটি বিষয় নিয়েও স্ত্রীর ওপর রাগ করে। ঘরোয়াপরিবেশ তার কাছে অস্বস্তিকর মনে হয়। বাইরের মহিলাদের প্রতি সে কুকুর যেমন শিকারের দিকে তাকায়, সেভাবে তাকায়। অনেক সময় কাজকর্মেও তার মন বসে না, ছাত্র হলে পড়ালেখা ছাড়া বাকি সব ভালো লাগে। ব্যবসায়ী হলে ব্যবসা থেকে তার মন ওঠে যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুমালেও শান্তির ঘুম আসে না। কেউ দেখে মনে করবে যে, সে ঘুমিয়ে আছে, মূলত সে কল্পিতপ্রিয়ার কল্পনায় ডুবে আছে।
তিন. কুদৃষ্টির তৃতীয় বড় ক্ষতি হল, হৃদয় সুন্নাত-বিদআত ও হক বাতিলের মাঝে পার্থক্য করতে ব্যর্থ হয়ে যায়। অন্তর্দৃষ্টিশক্তি চলে যায়। দীনের প্রজ্ঞা ও ইলমিবৈভব থেকে বঞ্চিত হতে থাকে। গুনাহর কাজ তার কাছে গুনাহ মনে হয় না। এরূপ পরিস্থিতিতে দীনের ব্যাপারে শয়তান তাকে সন্দেহ-সংশয়ের মধ্যে ফেলে দেয়। নেককারদের সম্পর্কে তার অন্তরে বদধারণা সৃষ্টি হয়। এমনকি পোশাক-আশাকে ও অবয়বে দীনপালনকারী ব্যক্তিবর্গ তার কাছে ঘৃণার পাত্র মনে হয়। সে বাতিল ঘরানার হয়েও নিজেকে হকের ওপর প্রতিষ্ঠিত মনে করে। অবশেষে ঈমানহারা হয়ে জাহান্নামী হয়ে যায়।
কুদৃষ্টি সম্পর্কে পূর্বসূরী সলফেসালেহীন যা বলেছেন
এক. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لَعَنَ اللهُ النَّاظِرَ وَالْمَنْظُوْرَ اِلَيْهِ
‘কুদৃষ্টিদানকারী ও কুদৃষ্টিদানে সুযোগদানকারী উভয়ের ওপর আল্লাহ লা’নত করেছেন।’(বাইহাকী, মেশকাতশরীফ : ২৭০)
দুই. হযরত দাউদ আলাইহিসসালাম নিজের ছেলেকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, ‘বাঘ ও অজগরের পেছনে ছুটতে পার, কিন্তু কোনো নারীর পেছনে নয়।’ উদ্দেশ্য হল, বাঘ ও অজগর উল্টো তেড়ে আসলে মরণঘাটে চলে যাবে। কিন্তু নারী তেড়ে আসলে জাহান্নামের ফাঁদে ফেঁসে যাবে।
তিন. হযরত ইয়াহইয়া ইবনেযাকারিয়া আলাইহিসসালামকে জিজ্ঞেস করা হল, ব্যভিচারের শুরুটা কিভাবে হয়? তিনি বললেন, চোখ থেকে।
চার. হযরত উমর রাযি. বলেন, দুটো জীর্ণপুরনো হাড়ও একসাথে মিলিত হলে পরস্পরের প্রতি আসক্ত হবে। (জীর্ণহাড় দ্বারা উদ্দেশ্য হল, বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা।)
পাঁচ. হযরত সাঈদ ইবনুলমুসাইয়াব রহ. বলেন, যখন তুমি কাউকে দেখবে যে, সে কোনো সুশ্রীবালকের প্রতি অপলক তাকিয়ে থাকে, তাহলে বুঝে নাও ‘ডাল মেঁ কুচ কালা হায়’।
ছয়. ফতেহমুসিলী রহ. বলেন, আমি ত্রিশজন মাশায়েখের সাথে সাক্ষাত করেছি, যাদেরকে অলি-আবদাল মনে করা হয়, প্রত্যেকেই বিদায়কালে আমাকে উপদেশ দিয়েছেন, কমবয়সী ছেলেদের সংশ্রব থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকবে।
সাত. ইবনুযাহির মাকদিসী রহ. বলতেন, কোনোব্যক্তি যদি কোনো পুরুষের প্রতি আসক্ত থাকে তাহলে তার জন্য ওই পুরুষকে দেখা হারাম।
আট. ইমাম গাযালী রহ. বলতেন, মুরিদের ওপর হিংস্রপ্রাণীর থাবাকে আমি ওই পরিমাণ ভয় করি না, যে পরিমাণ ভয় করি তাকে কোনো কমবয়সী ছেলের সান্নিধ্যে দেখলে।
নয়. হযরত মাওলানা খলীল আহমদ সাহারানপুরী রহ. বলতেন, কুদৃষ্টি স্মরণশক্তির জন্য প্রাণনাশকারী বিষতুল্য।
দশ. মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহ. তাঁর মাকতুবাতে লিখেছেন, যার দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণে নেই, তার অন্তরও নিয়ন্ত্রণে নেই। আর যার অন্তর নিয়ন্ত্রণে নেই, তার লজ্জাস্থানও নিয়ন্ত্রণে নেই।
কুদৃষ্টির চিকিৎসা
বর্তমানে ইন্টারনেট টিভি ও ভিসিআরের কারণে ঘরে-ঘরে ফ্লিম নাটকের ছড়াছড়ি। নগ্নতা ও অশ্লীলতার তুফান চলছে। যুবতীরা পর্দাহীন হয়ে দেহপ্রদর্শনী করে মার্কেটে-মার্কেটে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এ্যাডভেটাইসের নামে পথের কিনারায় নারীদের আকর্ষণীয় ছবি দেখা যাচ্ছে। সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনে নারীদের উত্তেজক ছবি তো এখন সাধারণ বিষয়। এহেন পরিবেশে যুবক তো পরের কথা, বুড়োদের দৃষ্টি সংযত রাখাও মহা আপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শতচেষ্টা সত্ত্বেও এ থেকে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। যাদের অন্তরের হেদায়েতের আলো আছে, তারা গুনাহটির ব্যাপকতা দেখে ভেতরে-ভেতরে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। তরিকতের সালিক-মুরিদ ও শিষ্যরা নিজেদের পীরের কাছে এ থেকে পরিত্রাণের ওষুধ প্রার্থনা করেন। তাই প্রয়োজন মনে হল, এ থেকে পরিত্রাণের কিছু পরীক্ষিত ওষুধ কুরআন-হাদীসের আলোকে পেশ করব। যাতে দৃষ্টি হারামপাত্র থেকে ফিরে এসে হালালপথে ধাবিত হয়। যৌনউম্মাদনার জ্বলে ওঠা আগুন নিভে যায়। পবিত্র ও শালীন জীবনযাপন সহজ হয়ে যায়।
পবিত্র কুরআনের আলোকে
কুদৃষ্টি থেকে বাঁচার উদ্দেশে পবিত্র কুরআনের আলোকে সাতটি ব্যবস্থাপত্র নিম্নে উপস্থাপন করা হল-
এক. মহান আল্লাহ বলেন-
قُلْ لِلْمُؤْمِنِيْنَ يَغُضُّوْا مِنْ اَبْصَارِهِمْ
‘মুমিনদেরকে বলে দিন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি অবনত রাখে।’
কুদৃষ্টির সর্বোত্তম চিকিৎসা হল, নিজের দৃষ্টি অবনত রাখা। সুতরাং সালেক তথা আত্মশুদ্ধি প্রত্যাশীব্যক্তির জন্য আবশ্যক হল, পথে চলতে গিয়ে দৃষ্টিকে অবনত রাখার অভ্যাস গড়ে তোলা। পায়ে হেঁটে চললে দৃষ্টি নিচের দিকে রাখুন। গাড়িতে থাকলে দৃষ্টি এতটুকু উঠিয়ে রাখুন, যেন অন্যান্য গাড়ির চলাচল বুঝতে সক্ষম হন। কারো চেহারার প্রতি দৃষ্টি নয়; কারণ ফেতনার শুরুটা এটা দ্বারাই হয়। দৃষ্টি ভুল করে ফেললে ইসতেগফার করুন এবং দৃষ্টি নামিয়ে নিন। এ অভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা অব্যাহত রাখুন, এমনকি এটাকে জীবনের অংশ বানিয়ে নিন। অফিসিয়াল কাজে কিংবা কেনাকাটার সময় কোনো নারীর সাথে কথা বলার প্রয়োজন হলে তার চেহারার দিকে তাকাবেন না। যেমনিভাবে কেউ কারো ওপর অসন্তুষ্ট থাকলে কথা বলার সময় পরস্পরের প্রতি তাকায় না। দৃষ্টি বিনিময় করেনা। অনুরূপভাবে কোনো প্রয়োজনে পরনারীর সাথে কথা বলতে হলে এটা মনে রাখবেন যে, আল্লাহর নির্দেশের কারণে আমি তার প্রতি অসন্তুষ্ট, সুতরাং তার চেহারার প্রতি তাকাব না।
দুই. আল্লাহতাআলা বলেন-
فَانْكِحُوْا مَا طَابَ لَكُمْ مِّنَ النِّسَاءِ
‘নারীদের থেকে তোমাদের পছন্দমত বিয়ে কর।’ -সূরা নিসা : ৩
যত দ্রুত সম্ভব দীনদার অনুগত ও সুন্দরীনারী দেখে বিয়ে করে নিন, যাতে করে জৈবিকচাহিদা পূরণ করা যায়। ক্ষুধার্তব্যক্তি যদি অধিক নফল নামায পড়াকে নিজের ক্ষুধা নিবারণের ব্যবস্থাপত্র মনে করে তাহলে তার চিকিৎসা করা উচিত। ক্ষুধার ওষুধ হল, খানা খাওয়া এবং আল্লাহর কাছে ক্ষুধা নিবারণের প্রার্থনা করা। অনুরূপভাবে দৃষ্টি পবিত্র রাখার ব্যবস্থাপত্র হল, বিয়ে করা এবং আল্লাহর কাছে পবিত্র জীবনযাপনের জন্য দুআ করা। সুযোগ পেলে স্ত্রীর চেহারার দিকে ভালবাসাপূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে তাকাবেন। আল্লাহর শোকর আদায় করবেন যে, নেয়ামতটি না পেলে কত গস্নানি যে পোহাতে হত! যে কামদৃষ্টি মার্কেটে বিচরণশীল নারীর প্রতি দেন তা স্ত্রীর প্রতি দিন। স্ত্রীকে পরিষ্কার-পচ্ছিন্ন থাকার ব্যাপারে উৎসাহিত করবেন। ভাল কাপড় কিনে দিন। অন্য নারীর কাছে যা কিছু আছে তার সবই আপনার স্ত্রীর কাছেও আছে। ভাবুন, আমি যদি পরনারীর প্রতি তাকাই তাহলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হবেন। পক্ষান্তরে নিজের স্ত্রীকে দেখলে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন। হাদীসে আছে-
‘যেব্যক্তি স্ত্রীর প্রতি মুচকিহেসে তাকায় এবং যেস্ত্রী স্বামীর প্রতি মুচকি হেসে তাকায় তখন আল্লাহতাআলা উভয়ের প্রতি মুচকি হেসে তাকান।’
হালালকে দেখুন প্রাণভরে, যেন হারামের প্রতি লোভ না জাগে। যখনই মন পরনারীর প্রতি আকর্ষণবোধ করবে তখনই স্ত্রীর কথা কল্পনায় আনুন। দেখবেন, গুনাহর চিন্তা অন্তর থেকে দূর হয়ে যাবে।
তিন. আল্লাহতা‘আলা বলেন-
اِنَّ الذِّيْنَ اتَّقَوْا اِذَا مَسَّهُمْ طَائِفٌ مِّنَ الشَّيْطَانِ تَذَكَّرُوْا فَاِذَا هُمْ مُّبْصِرُوْنَ
‘নিশ্চয় যারা আল্লাহতাআলাকে ভয় করে যখন তাদেরকে শয়তানের কোনো দল ঘিরে ধরে তখন তারা আল্লাহর যিকির করে। সুতরাং তাদের অনুভূতি ফিরে আসে।’
আয়াতটিতে এ রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে যে, যখনই শয়তান আক্রমন করবে, অন্তরে কুমন্ত্রণা ঢেলে দিবে তখনই যিকিরের অস্ত্র ব্যবহার করে তা প্রতিহত করবে। এজন্য রাস্তাঘাটে চলাফেরার সময় যিকিরের প্রতি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। সম্ভব হলে তাসবীহ রাখবেন। অন্যথায় মনে-মনে যিকির করবেন। অলসতা গুনাহর অন্যতম ভূমিকা। সুতরাং যিকির দ্বারা অলসতা দূর করুন। যিকিরের আলো অন্তরে অপার্থিব প্রশান্তির জন্ম দেয়। তখন নিষিদ্ধস্থানে চোখও তুলতে মন চায় না।
دو عالم سے كرتى ہے بيگا نہ دل كو
عجب چيز ہے لذت آشنا ئ
‘যখন দুই জগত থেকে হৃদয়কে অপরিচিত করে নেয়,
তখন বন্ধুত্বের স্বাদ মুগ্ধতাছড়ানো হয়।’
চার. আল্লাহতাআলা বলেন-
اَلَمْ يَعْلَمْ بِّاَنَّ اللهُ يَرى
‘সে কি জানে না যে আল্লাহ দেখতে পাচ্ছেন।’ (সূরা আলাক : ১৪)
আত্মার সংশোধনপ্রয়াসী সালেক যখনই পরনারীর প্রতি তাকানোর ইচ্ছা করবে তখনই এ কল্পনা করবে যে, আল্লাহ আমাকে দেখতে পাচ্ছেন। এতে দৃষ্টির হেফাজত করা সহজ হবে। এর দৃষ্টান্ত হল,ওই নারীর বাবা কিংবা স্বামী যদি আমার দিকে তাকিয়ে থাকে তবে কি আমি ওই নারীর প্রতি তাকিয়ে থাকতে পারব? তখন কি আমার মনে হবে না যে, ওই নারীর বাবা বা স্বামী আমার ওপর রাগ করবেন? অনুরূপভাবে ভাবুন, আমি যদি পরনারীর প্রতি থাকাই, অথচ আল্লাহ আমাকে দেখছেন, তখন অবশ্যই তিনি রাগ করবেন। যদি তিনি পাকড়াও করেন তাহলে আমার কী অবস্থা হবে?
পাঁচ. আল্লাহতাআলা বলেন-
وَالذَّيْنَ جَاهَدُوْا فِيْنَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا
‘যারা আমার পথে সাধনা করে আমি অবশ্যই তাদেরকে পথ দেখাব।’ (সূরা আনকাবুত : ৬৯)
তাফসীরবিশারদগণ লিখেছেন, শরীয়তের ওপর চলার উদ্দেশ্যে মনের বিপরীত আমল করাকেই মুজাহাদা তথা সাধনা বলে। এটা বাস্তব যে, মুজাহাদা দ্বারা ‘মুশাহাদা’ লাভ হয়। সুতরাং পরনারীর প্রতি দৃষ্টি দিতে যখনই মন চাইবে তখনই নিজের ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে তার বিরোধিতা করবেন। মনে একথা বদ্ধমূল রাখবেন, এই সাধনার দ্বারা আমার প্রকৃত মাহবুব তথা আল্লাহতাআলার মুশাহাদা বা দর্শন নসিব হবে। এমনিতে এ ধরনের সাধনা হয় কয়েক মুহূর্তের। অথচ মুশাহাদার স্বাদ হবে চিরদিনের জন্য। মনে রাখবেন, যবতে-নফস তথা নফসকে দমানোর নূর দ্বারা অন্তর খুব দ্রুত পরিষ্কার হয়। তাসবিহর দানাও এর সামনে কিছু নয়। সাহসহারা হওয়া সমস্যার সমাধান নয়। হিম্মত ধরে রাখলে সমস্যার সমাধান হয়। সুতরাং মনের ওপর জোর খাটান। তাকে শরীয়তের লাগাম পরিয়ে দিন, যেন কেয়ামতের দিন সৌভাগ্যের মালা পরার ভাগ্য জুটে।
ছয়. আল্লাহতাআলা বলেন-
اِنَّ اللهَ يَاْمُرُكُمْ اَنْ تَؤَدُّوْا الْاَماناتِ اِلى اَهْلِهَا
‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন আমানত তার হকদারকে দিয়ে দিতে।’ (সূরা নিসা : ৫৮)
সংশোধনপ্রত্যাশী সালেক এই কল্পনা ধরে রাখবে যে, আমার চোখ আল্লাহপ্রদত্ত আমানত। এই আমানত ব্যবহার করতে হবে তাঁরই নির্দেশ অনুপাতে। বিপরীত করলে আমানতের খেয়ানতকারী হয়ে যাব। সাধারণত নিয়ম হল, আমানতে একবার খেয়ানত করলেও তার কছে দ্বিতীয়বার আমানত রাখা হয় না। এমন যেন না হয় যে, দুনিয়াতে আল্লাহর দেয়া দৃষ্টিশক্তি পরনারীর পেছনে ব্যয় করলাম, পরিণামে তিনি আমার দৃষ্টিশক্তি আখেরাতে ফেরত দিবেন না। ওইদিন যদি অন্ধ হয়ে ওঠতে হয় তাহলে কী অবস্থা হবে? পবিত্র কুরআনে এটার প্রমাণ আছে যে, আল্লাহতাআলা কেয়ামতের দিন কিছুলোককে অন্ধ করে ওঠাবেন। তখন তারা জিজ্ঞেস করবে-
رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِىْ اَعْمى وَقَدْ كُنْتُ بَصِيْرًا
‘প্রভু! আমাকে অন্ধ বানিয়ে ওঠালেন কেন? আমার তো দৃষ্টিশক্তি ছিল!’
এটা ভাবনার বিষয় যে, আমরা এমন যুগে দুনিয়াতে সৃষ্টি হয়েছি যখন আল্লাহর প্রিয়বন্ধুর দর্শনলাভ করতে পারি নি। কেয়ামতের দিনও যদি অন্ধ করে ওঠানো হয় তাহলে আল্লাহর প্রিয়বন্ধুর দর্শনলাভ থেকে বঞ্চিত হব। আল্লাহর প্রিয়বন্ধুর নাম হল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে দ্বিতীয়বার বঞ্চিত হওয়া থেকে বাঁচান। সুতরাং দৃষ্টিসংরক্ষণ জরুরি, যেন কেয়ামতের দিন আমানতটি দ্বিতীয়বার ফেরত পাই। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
اِنَّ اللهَ تَعَالى جَمِيْلٌ
‘নিশ্চয় আল্লাহ সুন্দর।’ (আলজামিউসসাগীর, খন্ড : ১, পৃষ্ঠা : ২৬৩)
এ কথাটা মাথায় রাখবেন যে, যদি আমি দুনিয়ার সুন্দরীদের প্রতি কুদৃষ্টি দেই তাহলে আল্লাহতাআলা কেয়ামতের দিন তার সৌন্দর্যের দর্শনলাভ থেকে আমাদের বঞ্চিত করে দেন কিনা!
সাত. আল্লাহতাআলা বলেছেন-
اَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِيْنَ آمَنُوْا اَنْ تَخْشَعَ قُلُوْبُهُمْ لِذِكْرِ اللهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ
‘যারা ঈমান আনে তাদের হৃদয় কি আল্লাহর স্মরণে ও যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে বিগলিত হওয়ার সময় কি আসে নি?’
সালেক তথা আত্মার সংশোধনপ্রত্যাশীর মন যখনই কুদৃষ্টির গুনাহতে লিপ্ত হওয়ার জন্য ইতিউতি করবে, তখনই সঙ্গে সঙ্গে আয়াতটির বিষয়বস্ত্ত সম্পর্কে চিন্তা করবে। তখনই নিজেকে সম্বোধন করে বলবে ‘ঈমানদারের কি এখনও আল্লাহকে ভয় করার সময় হয় নি?’ প্রতিটি কৃদৃষ্টির সময় আয়াতটির বিষয়বস্ত্ত সম্পর্কে ভাবতে থাকুন এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা করতে থাকুন। এতে আল্লাহতাআলা নিজের ভয় আপনার অন্তরে তৈরি করে দিবেন এবং কুদৃষ্টি থেকে সত্যিকারের তাওবা আপনার নসিব হবে।
পবিত্র হাদীসের আলোকে
প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দৃষ্টিসংরক্ষণের প্রতি অনেক গুরুত্বারোপ করেছেন। মানুষের চেহারার আকর্ষণ তো আছেই, এমন কি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবজন্তুর লজ্জাস্থানের প্রতি তাকানো থেকেও নিষেধ করেছেন। তিনি দৃষ্টিকে বলেছেন ‘ইবলিসের একটি বিষমিশ্রিত তীর’। হাদীসশরীফের প্রতি লক্ষ্য করলে কুদৃষ্টির চিকিৎসা সম্পর্কে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থাপত্র পাওয়া যায়। যথাক্রমে-
এক. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘পরনারীর প্রতি হঠাৎ দৃষ্টি পড়ে যাওয়ার পর যদি তার রূপলাবণ্য তোমাকে আকর্ষিত করে তাহলে ঘরে এসে নিজের স্ত্রীর সাথে সহবাস কর।’ কারণ পরনারীটির কাছে যা আছে তোমার স্ত্রীর কাছেও তা-ই আছে। এর দ্বারা বোঝা গেল, বৈধ উপায়ে নিজের প্রয়োজন পূরণ করার দ্বারা হারাম থেকে বাঁচা সহজ হয়।
দুই. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এক যুবক এল। বলল, ‘হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমাকে ব্যভিচারের অনুমতি দিন। প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে শাসালেন না; বরং স্নেহের সুরে বললেন, কেউ তোমার মায়ের সাথে ব্যভিচার করাটাকে তুমি কি পছন্দ করবে? যুবক বলল, না। নবীজী বললেন, তাহলে তোমার স্ত্রীর সাথে কেউ ব্যভিচার করুক- এটা কি চাও? যুবক উত্তর দিল, না। নবীজী বললেন, তাহলে তোমার বোনের সাথে ব্যভিচার করা হোক- এটা কি চাও? যুবক এবারও উত্তর দিল, না। এবার নবীজী বললেন, তবে তো তোমার মেয়ের সাথে এমনটি হোক- এটা কামনা কর কি? যুবক এবারও উত্তর দিল, না। যুবকের উত্তরগুলো শুনে এবার প্রিয় নবী বললেন, যার সাথে ব্যভিচার করার জন্য তুমি এতটা আগ্রহী সে তো নিশ্চয় কারো মা কিংবা স্ত্রী কিংবা বোন কিংবা মেয়ে হবে। যেমনিভাবে তোমার এসব মাহরামনারীর সাথে ব্যভিচার হওয়াটা তোমার জন্য অসহনীয়, অনুরূপভাবে অপরলোকটিও তো তার নিকটাত্মীয় নারীর সাথে এমনটি হওয়াটা কোনোভাবেই কামনা করে না। এ বলে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পবিত্র হাত যুবকটির বুকে রেখে তার জন্য পবিত্রতা ও সম্ভ্রমবোধ সংরক্ষণের দুআ করলেন। এ যুবক সাহাবী বলেন, এরপর থেকে আমার বুক থেকে ব্যভিচারের কামনা সম্পূর্ণরূপে দূর হয়ে গেল এবং অন্যান্য গুনাহর চেয়েও ব্যভিচারের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি আরো অনেক বেশি হল।
এর দ্বারা বোঝা গেল, সালেক একথা ভাববে- ‘যেমনিভাবে আমার নিকটতম কোনো নারীর প্রতি পরপুরুষের লোভাতুর শয়তানিদৃষ্টি আমার কাছে বিরক্তিকর ও আপত্তিজনক মনে হয়, তেমনিভাবে অন্যরাও এটা মোটেও পছন্দ করে না যে আমি তাদের নিকটতম কোনো নারীর প্রতি লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাই।’ এরূপ ভাবনার দ্বারা অন্তর স্থির ও শান্ত হয়ে যাবে। কুদৃষ্টির তাড়না নিস্তেজ হয়ে পড়বে। তাছাড়া কোনো কামেল শায়েখের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলে তাঁর কাছে রোগটির কথা খুলে বলুন এবং দুআ ও তাওয়াজ্জুহ কামনা করুন। পীর-মাশায়েখ নবীদের স্থলাভিষিক্ত হন। তাঁদের তাওয়াজ্জুহ দ্বারা অন্তরের অন্ধকার দূর হয়। তখন মানুষ প্রবৃত্তির নীচুতা থেকে বের হয়ে আধ্যাত্মিকতার সুউচ্চ স্তরে পৌঁছতে সক্ষম হয়। তাঁদের সান্নিধ্য ওষুধ এবং তাঁদের দৃষ্টি চিকিৎসা হয়ে থাকে।
সালাফ তথা পূর্বসূরী বুযুর্গদের বাণীর আলোকে
পীরমাশায়েখ তাঁদের ভক্ত-মুরিদদেরকে কুদৃষ্টি থেকে বাঁচার উদ্দেশে বিভিন্ন উপায় বলে দিয়েছেন। মৌলিকভাবে সেগুলোকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়।
এক. কল্পনা পাল্টানো
যখনই নফস-প্রবৃত্তি পরনারীকে দেখার ইচ্ছা করবে তখনই সালেক তথা আত্মশুদ্ধি-প্রয়াসীব্যক্তির উচিত নিজের কল্পনা পরনারী থেকে সরিয়ে অন্যদিকে নিবদ্ধ করা। ইচ্ছা করে যদি অন্য কল্পনা ঢুকানো যায় তাহলে পরনারীর চিন্তা আপনাআপনি দূর হয়ে যাবে। কয়েকটি দৃষ্টান্ত নিম্নে উপস্থাপন করা হল-
ক. ইমাম গাযালী রহ. বলেন, ‘হে প্রিয়! জেনে রেখো, কোনো পরনারী তোমার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় শয়তান কামনা করে যে, তুমি তার প্রতি দৃষ্টি দিবে। একটু দেখে নিবে যে, নারীটি কেমন। এরূপ পরিস্থিতিতে শয়তানের সাথে বিতর্ক জুড়ে দাও যে, আমি কেন দেখব? নারীটি যদি কুশ্রী হয় তাহলে আমি তো স্বাদহীন গুনাহয় লিপ্ত হব। আর সুন্দরী হলে গুনাহতো হবে, পাশাপাশি এই আফসোসও অন্তরে জন্ম নিবে যে, আহ! তাকে যদি আমি পেতাম! কিন্তু সকল নারীকে তো পাওয়া যায় না। সুতরাং অন্তরকে আফসোসের মধ্যে ফেলে দেয়ার মাঝে কী ফায়দা! এভাবে বিতর্ক করলে অন্তরই এ সিদ্ধান্তে পৌঁছে দিবে যে, দেখব না। গুনাহ করব না। মনকে আফসোসেও ফেলব না। মনের স্বস্তি দূর করে দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়।’
খ. হযরতের আকদাস থানভী রহ. বলতেন, ‘কোনো সুন্দরীর নারীর প্রতি আকর্ষণ হলে সঙ্গে সঙ্গে কোনো কুশ্রীব্যক্তির কল্পনা করুন। এমন ব্যক্তির কল্পনা করুন যার রঙ কালো, চেহারায় দাগ, চোখ অন্ধ, চুল এলোমেলো, দাঁতালো চোয়াল, ঠোঁট মোটা, নাক থেকে পানি বেয়ে ঠোঁট অবধি পৌঁছেছে- যেখানে মাছি বসে আছে। এভাবে কল্পনা করলে রুচিতে একপ্রকার ঘেন্না সৃষ্টি করে, যা আপনার অন্তর থেকে সুন্দরীর প্রতি আকর্ষণকে নষ্ট করে দিবে। কখনও কখনও ভাবুন, কল্পিত সুন্দরীটি মারা গেলে তাকে কবরে রাখা হবে। তার দেহ গলে মাটির সাথে মিশে যাবে। পোকামাকড় দেহটাকে খেয়ে ফেলবে। দুর্গন্ধ বের হবে। সুতরাং একে দেখে নিজের মালিককে অসন্তুষ্ট করব কেন?’
গ. জনৈক বুযুর্গ বলেন, ‘কোনো সুন্দরীর প্রতি আসক্ত হলে সাথে সাথে তার বৃদ্ধবেলার কথা কল্পনা করুন। কোমর কুঁজো হয়ে যাবে। হাড্ডিসার দেহ হয়ে যাবে। দৃষ্টিশক্তি তার একেবারে দুর্বল হয়ে পড়বে। কানে শুনতে পাবে না। মুখে দাঁত থাকবে না, পেটে অাঁত থাকবে না। বসলে পেশাব নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। চোয়াল ভেতরে ঢুকে যাবে। সুতরাং একে দেখে আমার প্রভুকে অসন্তুষ্ট করব কেন?
ঘ. জনৈক বুযুর্গ বলতেন, কোনো সুন্দরীকে দেখতে মন চাইলে সঙ্গে সঙ্গে কল্পনা করুন, আমার শায়েখ আমাকে দেখছেন। তাহলে মন আন্দোলিত হবে। দৃষ্টি সরে যাবে। তারপর ভাবুন, আমার শায়েখ আমার একাজটি দেখে কত না অসন্তুষ্ট হবেন! অথচ আল্লাহতাআলা বাস্তবেই দেখছেন। সুতরাং তিনি কী পরিমাণ অসন্তুষ্ট হবেন। এভাবে ভাবতে পারলে কুদৃষ্টি থেকে তাওবা নসিব হবে।
দুই. নিজেকে সাজা দিন
কুদৃষ্টি থেকে বাঁচার দ্বিতীয় পদ্ধতি হল, নিজেই নিজের জন্য সাজা নির্ধারণ করা যে, কুদৃষ্টি হয়ে গেলে আমি নিজেকে এই শাস্তি দিব। যেহেতু কুদৃষ্টির মজার চাইতে সাজার কষ্টটা বেশি হবে তাই ধীরে ধীরে কুদৃষ্টির অভ্যাস থেকে ফিরে আসা সহজ হয়ে যাবে।
ক. হযরত আকদাস থানবী রহ. বলতেন, ‘কুদৃষ্টির গুনাহর জন্য বিশ রাকাত নফল পড়ার সাজা ঠিক করে নাও। এতে নফস এক দু’দিনেই চিৎকার দিয়ে ওঠবে এবং কুদৃষ্টি থেকে ফিরে আসবে। শয়তানও বলবে, লোকটি তো দেখি একটি কুদৃষ্টির পরিবর্তে বিশটি সিজদা করছে। এমন যেন না হয় এর গুনাহগুলো নেকি দ্বারা পাল্টে দেয়া হবে। তখন তো আমার সারাজীবনের চেষ্টা বরবাদ হয়ে যাবে। সুতরাং একে কুদৃষ্টির কুমন্ত্রণা দেয়া যাবে না।’
খ. জনৈক বুযুর্গ বলতেন, ‘যে লোকটি ভোজনপ্রিয় তার উচিত তিনদিনের রোযার সাজা নির্ধারণ করা। যখন ক্ষুৎপিপাসায় থাকবে তখন রিপুর সব তাড়না নিস্তেজ হয়ে পড়বে।’
গ. জনৈক বুযুর্গ বলতেন, ‘কুদৃষ্টিতে অভ্যস্ত ব্যক্তি যদি গরিব হয় তাহলে সে নিজের ওপর কিছু সদকা নির্ধারণ করে নেয়ার শাস্তি আরোপ করবে। যখন নিজের প্রয়োজনকে কুরবানি দিয়ে সদকা করার প্রয়োজন পড়বে তখন সব ঘোর এমনিতে কেটে যাবে।’
ঘ. জনৈক বুযুর্গ বলতেন, ‘মনে কুদৃষ্টির তাড়না তৈরি হলে নির্জনে কাপড় পেঁচিয়ে তৈরি করা চাবুক দিয়ে নিজের পেটে কয়েকটি আঘাত করুন। তারপর ভাবুন, যখন কেয়ামতের দিন ফেরেশতারা চাবুক মারবে তখন কী অবস্থা হবে? এ পদ্ধতিতে কয়েকদিনের মধ্যেই কুদৃষ্টির অভ্যাস খতম হয়ে যাবে।’
অধমের অতিরিক্ত কিছু পরীক্ষিত ব্যবস্থাপত্র
নিচে কয়েকটি ব্যবস্থাপত্র উল্লেখ করা হল। এগুলোর দ্বারা অধম ও সংশ্লিষ্টরা অনেক উপকৃত হয়েছে। পাঠকরাও এগুলো অন্তরে গেঁথে নিতে পারলে উপকৃত হবেন- ইনশাআল্লাহ।
এক. কুদৃষ্টির পরিবেশ থেকে বাঁচুন
এটাই সবচেয়ে বড় সতর্কতা যে, যেসব পরিবেশে কুদৃষ্টি হয় সেগুলো থেকে দূরে থাকুন। বিয়ে-শাদির অবাধ অনুষ্ঠানগুলোতে মোটেও যাবেন না। কোথাও যাওয়ার দুটি পথ থাকলে ওই পথ বেছে নিন যেখানে কুদৃষ্টির আশঙ্কা কম থাকে। কারো দরজার কড়া নেড়ে সরাসরি না দাঁড়িয়ে একপাশে দাঁড়ান। এমন যেন না হয় যে, কোনো বালিকা দরজা খুলে দিল আর পর্দার লঙ্ঘন হয়ে গেল। বিমান ইত্যাদির টিকেট কাটার সময় ওই কাউণ্টারে যান যেখানে পুরুষ আছে, যেন মহিলার সাথে কথা বলতে না হয়। গাড়িতে চলার সময় আশপাশের গাড়িগুলোর প্রতি তাকাবেন না। হতে পারে কোনো নারীর ওপর কুদৃষ্টি পড়ে যাবে। নিজের বাসায় ঢোকার সময় গলা খাঁকারি দিয়ে বা আওয়াজ করে ঢুকুন। যাতে পরনারী থাকলে সে পর্দা করতে পারে। ট্রেন বা বিমানসফরে নিজের প্রিয় কোনো বই সঙ্গে রাখুন এবং তা পড়ে সময় কাটাবেন। ক্লান্তি আসলে শুয়ে পড়ুন। ঘুম না আসলে মুরাকাবার নিয়তে বসে থাকুন। চোখ খুললে ভ্রমণকারীনারীর প্রতি দৃষ্টি পড়ার আশঙ্কা আছে। রাস্তায় চলার সময় এমনভাবে দৃষ্টিকে অবনত করে রাখুন, যাতে পায়ের আওয়াজে অনুমান করতে পারেন নারী না পুরুষ। সবসময় মনে রাখুন, নারীরা আমাদের সাথে পর্দা করবে না, আমাদেরকেই তাদের সঙ্গে পর্দা করতে হবে। তাওয়াফকালীন দৃষ্টি পায়ের দিকে রাখুন। দৃষ্টি মোটেও ওঠাবেন না। বিনোদনকেন্দ্রে প্রথমত যাবেন না, একান্তই যদি যেতে হয় তাহলে এমন দিন বেছে নিন যেদিন লোকজন থাকে না বললেই চলে। যদি কোনো অফিস বা বিমানবন্দরের লাউঞ্জে বসে অপেক্ষা করার প্রয়োজন পড়ে, সেখানে যদি টিভি চলে কিংবা নারীর ছবিসম্বলিত সাইনবোর্ড থাকে, তাহলে ইচ্ছা করেই এসবের দিকে পিঠ দিয়ে বসুন। সড়কের পাশের সিনেমার পোস্টার বা বিজ্ঞাপনের দিকে তাকাবেন না। মোটরসাইকেল কিংবা গাড়ি চালানোর সময় রিকশা ইত্যাদি সামনে পড়লে সেখানে বসে থাকা নারীর প্রতি দৃষ্টি যেতে দিবেন না। যেসব সড়কে কিংবা গলিতে মেয়েদের স্কুল-কলেজ আছে সেগুলো এড়িয়ে চলা ভালো। বিধর্মীরাষ্ট্রে সফর করার প্রয়োজন পড়লে উত্তম হল, কারো চেহারা না দেখা। কারণ, প্রথমত যদি গ্রীস্মকাল হয় তখন তারা অর্ধনগ্ন থাকে। আর শীতকালে পোশাক দ্বারা দেহ ঢাকলেও নারী-পুরুষের মাঝে পার্থক্য করা কঠিন হয়। সবাইকে এক টাইপের মনে হয়। নারীরাও শাট-কোর্ট-টাই পরে। পুরুষের মত চুল কাটে। এই মসিবতের সামাধান এটাই যে, দৃষ্টি অবনত রাখুন এবং নিজের ঈমান বাঁচান। আল্লাহতাআলার কাছে বিনীতপ্রার্থনা করুন। কবির ভাষায়-
غم حيات كے ساۓ محيط نہ كرنا
كسى غريب كو دل كا غريب نہ كرنا
ميں امتحان كے قابل نہيں مرے مولى
مجهے گناه كا موقع نصيب نہ كرنا
‘বিষণ্ণজীবনের ছায়ায় আমাকে বেষ্টিত করবেন না।
গরিবকে অন্তরের গরিব করবেন না।
মাওলা আমার! আমি পরীক্ষার যোগ্য নই,
আমাকে গুনাহ করার সুযোগ দিবেন না।’
দুই. স্ত্রীকে সন্তুষ্ট রাখুন
নিজের স্ত্রীর সাথে মধুর সম্পর্ক বজায় রাখুন। তার সব বিষয়েয় প্রতি লক্ষ্য রাখুন। ঘরের স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে ভালোবাসামোহিত ঘনিষ্ঠতা ধরে রাখতে পারলে মুচকিহেসে স্বামীকে অভ্যর্থনা জানালে স্বামীর চিন্তা পরনারীর প্রতি যায় না। একটু ভেবে দেখুন যদি স্বামী-স্ত্রীর প্রতিদিনের সম্পর্কটা বিরক্তিমাখা ঝগড়াপূর্ণ হয়, মন খারাপ করে স্বামী নাস্তা ছাড়া অফিসে চলে যায়, আর সেখানে পর্দাহীনা কোনো সহকর্মী হাসির আভা ছড়িয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে, স্যার! কেমন আছেন আপনি! তখন এই নারীর এই হাসিটা দাম্পত্যজীবনের জন্য বিষের ভূমিকা পালন করে। এভাবেই সংসারে ভাঙ্গন ধরে। ঘরে যখন সুন্দরী স্ত্রী ঝগড়াটে হয় তখন বাইরের কুশ্রী নারীও ‘জান্নাতের হূর’ মনে হয়। এজন্য স্বামী-স্ত্রী উভয়ের চেষ্টা থাকা উচিত, সংসারে যেন প্রেম-ভালোবাসার পরিবেশ থাকে। তখন বাইরের প্রতিকূলতা থেকে নিরাপদ থাকা সহজ হবে। সাধারণত কুদৃষ্টির শিকার হন তারাই যাদের স্ত্রী নেই কিংবা স্ত্রী থাকলেও জৈবিকচাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে স্ত্রী পরিপূর্ণ তৃপ্তি দিতে পারে না। পবিত্র কুরআনে স্ত্রীর ‘উদ্দেশ্য’ বলা হয়েছে-
لِتَسْكُنُوْآ اِلَيْهَا
‘যাতে তাদের কাছে স্বস্তি লাভ কর।’
যেস্ত্রীর কাছে স্বামী অস্বস্তিতে থাকে, সে স্ত্রী আল্লাহর কাছে কী জবাব দিবে? এখনকার যুবকেরা যে উদ্দীপনা নিয়ে টেলিভিশন দেখে অনুরূপ আগ্রহ নিয়ে যদি নিজের স্ত্রীকে দেখত তাহলে তাকে জান্নাতের হূর মনে হত। প্রসিদ্ধ আছে, ভালোবাসার আতিশয্যের কারণে জুলায়খা প্রতিটি জিনিসের নাম রেখেছিলেন ‘ইউসুফ’। তার কাছে ইউসুফ ছাড়া দুনিয়ার অন্যকিছু চোখে ভাসত না। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে এরূপ অকৃত্রিম ভালোবাসা থাকলে স্বামীর দৃষ্টি পরনারীর প্রতি যাবে না।
তিন. নিজেকে নির্লোভ করে নিন
সালেক নিজের অন্তরে এ কল্পনা বারবার বদ্ধমূল করে নিবে যে, আমি আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করতে চাই না। পরনারীর প্রতি উত্থিত প্রতিটি দৃষ্টি আমাকে আমার প্রকৃত প্রেমাস্পদ থেকে দূরে সরিয়ে দিবে। পক্ষান্তরে পরনারীর প্রতি দৃষ্টি বিরত রাখার প্রতিটি দৃষ্টি আমাকে আমার প্রেমাস্পদের সাথে ঘনিষ্ঠ করে তুলবে। সুতরাং আমি আল্লাহর ঘনিষ্ঠতার পথকে নিজের জন্য বেছে নিলাম। তাঁর ভালোবাসায় আমি পরনারীকে দেখা থেকে তাওবা করে নিলাম। এবার যেকোনো পর্দাহীননারী আমার সামনে আসলে তার প্রতি আমার কোনো লোভ নেই। সে কালো কিংবা সুন্দরী, মোটা কিংবা চিকন, হূর কিংবা ডাইনি- যাই হোক না কেন; আমার জন্য নয়। সে অন্যের জন্য। তার দ্বারা যেহেতু আমার উদ্দেশ্য পূরণ হবার নয়, সুতরাং তার প্রতি তাকিয়ে লাভ কী?
বাজার-গলি দিয়ে চলার সময় নফস যখন পরনারীর প্রতি তাকানোর জন্য ইতিউতি করবে তখনই এই কল্পনার পুনরাবৃত্তি করবে যে, এর প্রতি আমার কোনো লোভ নেই। আপনার অভিজ্ঞতা হয়ত আছে যে, বাসে কিংবা স্টেশনে যদি আপনার পাশের চেয়ারে কোনো পুরুষ বসে তাহলে আপনার অনুভূতিকে আন্দোলিত করে না। কিন্তু যদি কোনো নারী বসে তাহলে বিচিত্র ভাবনা আপনাকে আন্দোলিত করে। এর কারণ হল, নফসের মধ্যে লোভ থাকে। ওই নারীটি যদি বৃদ্ধা হয় তাহলে তার সম্পর্কেও আপনার মাঝে কোনো ভাবনা আসবে না। এটা এ কথারই প্রমাণ যে, নফস বা প্রবৃত্তির মাঝে নষ্টামিও আছে। সুতরাং এই লোভ ও নষ্টামি থেকে নফসকে ইচ্ছাকৃতভাবে বের করার চেষ্টা করতে হবে। রাতের শেষপ্রহরে তাহাজ্জুদ-নামাযের পর মহান আল্লাহর কাছে দুআ করুন, হে মালিক! আমাকে পরনারী থেকে নির্লোভ করে দিন। হে ওই সত্তা! যার আঙ্গুলের মাঝে মানুষের অন্তর, আমার অন্তর থেকে পরনারীর আকর্ষণ দূর করে দিন। যাতে আমার কাছে পরনারী ও দেয়ালের মাঝে কোনো পার্থক্য না থাকে। এভাবে করতে পারলে কয়েকদিনের মধ্যে ফল পাবে। পরীক্ষা করে দেখুন।
চার. হূরদের সৌন্দর্যের কল্পনা করুন
নফস প্রবৃত্তি যদি পরনারী দেখতে চায় তাহলে সালেক তথা সংশোধনপ্রত্যাশীব্যক্তি মনে মনে হূরের সৌন্দর্য নিয়ে কল্পনা করবে। যেমন-
حُوْرٌ مَّقْصُوْراَتٌ فِىْ الْخِيَامِ
‘তাবুতে উপবিষ্ট হূরসমূহ’
قاصِرَتُ الطَّرْفِ
‘আনত নয়না’
لَمْ يَطْمِثْهُنَّ اِنْسٌ قَبْلَهُمْ وَلَا جَآنٌّ
‘যাদেরকে পূর্বে কোনো মানুষ কিংবা জিন স্পর্শ করে নি।’
كَاَنَّهُنَّ الْيَاقُوْتُ وَالْمَرْجَانُ
‘ইয়াকুত (পদ্মরাগ) ও মারজান (প্রবাল) মোতির মত।’
اَزْوَاجٌ مُّطَهَّرَةٌ
‘হায়েয-নেফাস থেকে পবিত্র স্ত্রীরা।
হূরদের এসব গুণের বিপরীতে পরনারী সম্পর্কে ভাবুন, কখনও হায়েযের রক্ত, কখনও সন্তান জন্ম দেয়ার রক্ত ঝরে। প্রতিদিন কয়েকবার পেশাব-পায়খানার ময়লা পেট থেকে বের হয়। নাক থেকে ময়লা ঝাড়ে। মুখ থেকে কফ-থুথু বের হয়। বগল থেকে ঘামের গন্ধ বের হয়। মাথায় উকুন পড়ে থাকে। কয়েকদিন গোসল না করলে শরীর থেকে উৎকট গন্ধ ছড়ায়। মেসওয়াক না করলে মুখ থেকে দুর্গন্ধ বের হয়। অসুস্থ হলে কয়েকদিনের মধ্যেই নেতিয়ে পড়ে। বৃদ্ধ হলে চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যাবে। মুখে দাঁত থাকবে না। পেটে আঁত থাকবে না। কোমর বাঁকিয়ে চলাফেরা করবে। কথা স্পষ্ট বলতে পারবে না। গুপ্তাঙ্গের লোম পরিষ্কার না করলে জঙ্গলসদৃশ হয়ে যাবে। সবসময় পেটে পেশাব-পায়খানার ময়লা নিয়ে চলে। এমন নারীর প্রতি তাকিয়ে কি আমার প্রভুকে অসন্তুষ্ট করব? জান্নাতের হূর নেয়ামত থেকে বঞ্চিত হব? সেই হূর থেকে যারা সবসময় কুমারী থাকবে। মোতির মত বিভা ছড়াবে। শরীরের প্রতিটি অঙ্গ সুগন্ধি দ্বারা মোহিত করবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হবে। পানিতে থুথু ফেললে পানি সুমিষ্ট হয়ে যাবে। আঙ্গুল বের করলে সূর্যের আলোর মত ঝলমলিয়ে ওঠবে। মৃতের মাঝেও প্রাণ চলে আসবে। যাকে কেউ স্পর্শ করে নি। যার অন্তস্থল থেকে উতলে ওঠা ভালোবাসা মানুষ স্বচক্ষে দেখতে পাবে। অসুস্থ হবে না। লাবণ্যহারা হবে না। এরূপ গুণবতী বিশ্বস্ত রূপপ্রাচুর্যে পরিপূর্ণ স্ত্রীকে পরনারীর প্রতি একটুখানি তাকানোর কারণে হারাব- এটা কোন ধরনের বুদ্ধিমানের কাজ? সুতরাং দুনিয়াতে আমার জন্য আছে হালাল স্ত্রী। আখেরাতে আছে মুগ্ধতাছড়ানো হূর। মার্কেটে ঘুরঘুরকারী মহিলাদের প্রতি আমার কোনো আকর্ষণ নেই। এদের থেকে আমার দৃষ্টিকে সংরক্ষণ করব। মালিককে সন্তুষ্ট করব। হূরের অধিকারী হব।
পাঁচ. আল্লাহর দর্শন লাভ থেকে বঞ্চিত হওয়ার কথা ভাবুন
হাদীসশরীফের ভাষ্য মতে জান্নাতিরা জান্নাতে আল্লাহর দর্শন লাভে ধন্য হবে। কেউ একবার দর্শন লাভ করবে। কেউ প্রতি বছর একবার, কেউ প্রতি মাসে একবার, কেউ প্রতি শুক্রবারে একবার, কেউ প্রতিদিন একবার দর্শন লাভ করার অকল্পনীয় সুযোগ পাবেন। যেলোকটি দুনিয়াতে অন্ধ হয়ে জন্ম নিয়েছিলেন, যাপিতজীবনে সৎ ও আল্লাহভীরু ছিলেন এবং সবর ও শোকরের সাথে জীবন কাটিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর সুমহান সৌভাগ্য হবে প্রতিটি মুহূর্তে তিনি আল্লাহকে দেখে বিমোহিত হবেন। আল্লাহ বলবেন, এতো আমার ওই বান্দা, যে দুনিয়াতে কাউকে ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখে নি। এখন সে যখন ইচ্ছা করবে, আমার নূরানী চেহারা দেখতে পারবে।
কোনো কোনো আলেম লিখেছেন, পরনারীর প্রতি দৃষ্টি দেয়া থেকে নিজের দৃষ্টিকে যে দুনিয়াতে সংরক্ষণ করবে, মহান আল্লাহ তাকে প্রতিটি বিরত রাখা দৃষ্টির বিনিময়ে একবার করে নিজের দর্শন দিয়ে ধন্য করবেন। সালেকের উচিত বিষয়টি নিয়ে মোরাকাবা করা এবং মনকে বুঝানো যে, কয়েক মুহূর্তের কুদৃষ্টির কারণে আল্লাহর সুমহান দর্শন থেকে বঞ্চিত হব কেন?
ছয়. নিজের মা-মেয়ের কল্পনা করুন
নফস যদি পরনারীকে দেখার জন্য লালসা করে তাহলে সঙ্গে-সঙ্গে নিজের মা-মেয়ের কল্পনা করুন। এ সম্পর্ক দু’টি এতই পবিত্র যে, প্রবৃত্তির তাড়না এমনভাবে মিটে যায় যেমনভাবে আগুনে পানি দিলে আগুন নিভে যায়। তবে এই আমল শালীনতাবোধসম্পন্ন শরীয়ত দ্বারা সমৃদ্ধ লোকদের জন্য অধিক উপকারী।
সাত. চোখে শলাকা পড়ার কথা ভাবুন
ওলামায়েকেরাম লিখেছেন, কুদৃষ্টিকারী যখন জাহান্নামে যাবে তখন ফেরেশাতারা তার চোখে গলিত শীশা ঢেলে দিবে। কোনো কোনো কিতাবে লেখা হয়েছে, লোহার শলাকা গরম করে তার চোখে ঢুকিয়ে দেয়া হবে। সালেকের নফস কুদৃষ্টির প্রতি যখন তাড়িত করবে তখন কল্পনা করুন, ক্ষণিকের মজার কারণে উত্তপ্ত শলাকা আমার চোখে বিদ্ধ করা হলে তখন আমার কী অবস্থা হবে! কয়েকদিন নিয়মিত এ কল্পনা করলে নফসের নষ্টামি দূর হয়ে যাবে।
আট. নিয়মের কথা ভাবুন
যেসব লোকের কুদৃষ্টির অভ্যাস পুরনো এবং প্রাথমিক চিকিৎসায় কাজ হয় না, তাদের উচিত হল, নিজেকে বুঝানো যে, আল্লাহর একটা নিয়ম আছে। কেউ যখন কোনো গুনাহর কাজ শুরু করে তখন আল্লাহ তার সঙ্গে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার আচরণ করেন। এতেও যদি বান্দা পিছু না হটে তাহলে তার সঙ্গে তিনি কিছু দিন যাবত দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখার আচরণ করতে থাকেন। এরপরেও ফিরে না আসলে আল্লাহ তাকে সাজা দেয়ার ইচ্ছা করেন। আর যে দুর্ভাগার ব্যাপারে তিনি শাস্তির ইচ্ছে করেন তাকে তিনি নাচিয়ে ছাড়েন। তখন তাকে ঘরে বসিয়ে রেখে লাঞ্ছিত করে ছাড়েন। এমন কি অন্যের জন্য ওই শাস্তিকে দৃষ্টান্ত বানিয়ে দেন। সুতরাং এভাবে ভাবুন, আমি অনেক দিন থেকে কুদৃষ্টির গুনাহয় লিপ্ত। এখন পর্যন্ত আল্লাহতাআলা দোষ গোপন করে রাখার আচরণ করছেন। যদি শাস্তি দেয়ার ইচ্ছা করে ফেলেন তাহলে আমার দীন-দুনিয়া উভয়টাই যাবে। আমার কিছু থাকবে না। আল্লাহতাআলা বলেন-
وَمَنْ يُّهِنِ اللهُ فَمَا لَهُ مِنْ مُكْرِمٍ
‘আল্লাহ যাকে লাঞ্ছিত করেন, তার সম্মানদাতা কেউ নেই।’ -সূরা হজ্ব : ১৮
আয়াতটি নিয়ে ভাবলে কুদৃষ্টি থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়া যায়।
নয়. নিজের নফসের সাথে বিতর্ক করুন
যখন নফস কুদৃষ্টি দেয়ার চেষ্টা করবে তখন তার সাথে বিতর্ক করুন যে, হে নফস! তোমার নাম এত উঁচু অথচ তোমার কর্মকান্ড কত নিচু। তুমি সৃষ্টিকুলের চোখে আল্লাহর বন্ধু, কিন্তু কাজ কর তাঁর দুশমনের মত। বাহ্যিকদৃষ্টিতে ঈমানদার অথচ ভেতরে-ভেতরে পাক্কা গুনাহগার। লেবাসে-সূরতে ‘লা-ইলাহা’, লোকচক্ষুর আড়ালে ‘প্রতিমা-প্রতিমা।’ মানুষের সামনে আল্লাহর বান্দা, অন্দরমহলে শয়তানের গোলাম। তোমার যবান আল্লাহর তলবগার, তোমার চোখে পরনারীর পেয়ার। তুমি সকলের কাছে সাধাসিধে সূফী-বেচারা কিন্তু স্রষ্টার দৃষ্টিতে ক্ষমাযোগ্য বেচারা। তোমার উপরটা সুন্নাতসমৃদ্ধ, অথচ ভেতরটা যৌনতাতাড়িত। মাখলুকের কাছে তোমার স্বভাবচরিত্র গোপন, কিন্তু স্রষ্টার কাছে তো সবই দৃশ্যমান। দৃশ্যত তুমি জান্নাত প্রত্যাশী, বাস্তবে তুমি জাহান্নাম খরিদকারী। তোমার জন্য এই লোকসানের ব্যবসা থেকে ফিরে আসাটাই শ্রেয়। ছাড়ো এ ক্ষতির ব্যবসা। আল্লাহ তোমার জন্য তাওবার দরজা খোলা রেখেছেন। হতে পারে এটাই তোমার জন্য সুযোগ লুফে নেয়ার আখেরি দিন। পরে আক্ষেপ অনুশোচনার মাঝে কোনো ফায়দা নেই।
اب پچهتاۓ كيا ہوت
جب چڑيا ں چك گئيں كهيت
‘এখন আফসোস করে কী হবে!
চড়ুইরা তো ক্ষেত বিরাণ করে দিয়েছে।’
কয়েকবার নিজের নফসের সাথে এভাবে বিতর্ক করলে কুদৃষ্টির ব্যাপারে তার দাপানি যথেষ্ট কমে আসবে।
দশ. আল্লাহর সান্নিধ্যের মুরাকাবা করুন
কুদৃষ্টিতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে সালেক তথা আত্মশুদ্ধিপ্রত্যাশী আল্লাহর সান্নিধ্যের অনুভূতি অন্তরে তৈরি করার উদ্দেশে প্রত্যেক নামাযের পর কিছু সময়ের জন্য নিম্নোক্ত আয়াতের বিষয়বস্ত্ত নিয়ে চিন্তা করবেন।
هُوَ مَعَكُمْ اَيْنَمَا كُنْتُمْ
‘তোমরা যেখানেই তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন।’
এরপর নিজের নফসকে বুঝাবেন যে, দেখো, তুমি আল্লাহর দৃষ্টি থেকে কোনোভাবেই ভাগতে পারবে না। তুমি যখন পরনারীর প্রতি তাকাও তখনও তোমার প্রভু তোমাকে দেখেন। এটা তো তার মহান ধৈর্যের পরিচয় যে, তিনি তোমাকে পাকড়াও করেন না। কিন্তু তুমি যদি এভাবে চলতে থাক তবে তিনি কতকাল ধৈর্য ধরবেন। এই দৃষ্টি তোমার জন্য রূহানী মৃত্যুর কারণ হতে পারে। যদি তুমি পরনারীকে কুদৃষ্টিতে দেখ তাহলে তোমার আপন-নারীদের প্রতি অন্যপুরুষরা কুদৃষ্টিতে দেখবে।
جيسے كرنى ويسى بهرنى نہ ما نے تو كركے ديكھ
جنت بهى ہے دوزخ بهى ہے نہ ما نے تو مركے ديكھ
‘যেমন কর্ম তেমন ফল, না মানলে করে দেখ
জান্নাত আছে জাহান্নামও আছে, না মানলে মরে দেখ।’
উক্ত মুরাকাবা করলে আল্লাহতাআলার রহমত তোমার সঙ্গী হবে এবং কুদৃষ্টি থেকে তাওবা করার খোশনসিব হবে। ইনশাআল্লাহ।
একটি ভুল বুঝাবুঝি
কিছু তরুণ যুবক এই প্রত্যাশা করে যে, তার মনে যেন পরনারীর প্রতি দৃষ্টি দেয়ার চিন্তাই সৃষ্টি না হয়। এই মর্যাদা লাভ না হলে তারা খুব চিন্তিত হয়। ভাবে, যিকির ও মুরাকাবায় কাজ হয় নি। মনে রাখবে, এটা শয়তানিকুমন্ত্রণা। নফস বা মনে যদি কুদৃষ্টির বাসনাই উদিত না হয় তাহলে তা থেকে বেঁচে থাকাটা কোন্ ধরনের বাহাদুরি। যদি কোনো ‘অন্ধ’ পরনারীকে না দেখার দাবী করে তাহলে এটা কোনো গৌরব বা অহঙ্কারের বিষয় নয়। মজা তো হল উদ্দাম যৌনচাহিদা থাকা সত্ত্বেও গুনাহ থেকে বেঁচে যাওয়া। অন্তরে লজ্জা সৃষ্টি করা। পরনারীর প্রতি দৃষ্টি দেয়া থেকে বেঁচে থাকা অনেক বড় জিহাদ। উল্লেখিত আমলগুলো সারাজীবন করতে হয়। নিজের দোষ-ত্রুটির জন্য কান্নাকাটি করতে হয়। এ অবস্থায় মারা গেলে শান্তিময় ঘুম আসবে। হয়ত তখন মুনকার-নাকীর ফেরেশতা বলাবলি করবে-
سرہا نے مير كے آہستے بو لو
ابهى تك روتے روتے سو گيا ہے
‘আমির সাহেবের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আস্তে কথা বল
এই পর্যন্ত কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েছে মাত্র।’
…..