তাহাজ্জুদ : আল্লাহর প্রিয় হওয়ার আমল

অন্য সময়ের ইবাদতে আমরা আল্লাহ তাআলাকে পাওয়ার চেষ্টা করি, আর রাতের শেষ প্রহরে স্বয়ং আল্লাহ বান্দাকে ডাকতে থাকেন। অন্য সময়ে আমরা আল্লাহকে তালাশ করি, রাতের শেষ প্রহরে স্বয়ং আল্লাহ তাঁর কিছু বান্দাকে তালাশ করেন।
আল্লাহ যেন আমার ডাকে সাড়া দেন। তিনি যেন আমাকে ক্ষমা করেন; এর জন্য আমাদের কত ভাবনা! আর রাতের শেষ প্রহরে স্বয়ং আল্লাহ বান্দাকে ডাকতে থাকেন দোয়া কবুলের জন্য, বান্দাকে ক্ষমা করার জন্য! আর এর জন্য তিনি প্রথম আসমানে চলে আসেন।
শিশু যখন কাঁদে, বাবা তখন সন্তানকে এভাবে জিজ্ঞেস করে, আব্বু! তোমার কী লাগবে? মজা লাগবে? আইসক্রিম দরকার? চকলেট দিব? কী প্রয়োজন? আব্বুকে বলো! আব্বু এখুনি এনে দিচ্ছি।
অনুরূপভাবে রাতের শেষ প্রহরে আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাকে জিজ্ঞেস করেন, বান্দা! তোমার কী দরকার? ক্ষমা দরকার? ক্ষমা করে দিব। রিজিক লাগবে? রিজিক দিয়ে দিব। বান্দা! আমি মাওলার কাছে বলো, তোমার কী প্রয়োজন, আমি পূরণ করে দিব।

َالْحَمْدُ لِلّهِ وَكَفَى وَسَلَامٌ عَلَى عِبَادِهِ الَّذِيْن َاصْطَفَى اَمَّا بَعْدُ! فَاَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ. بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ. تَتَجَافَىٰ جُنُوبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَطَمَعًا وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ
بارك الله لنا ولكم في القرآن العظيم ونفعني وإياكم بما فيه من الآيات والذكر الحكيم وجعلني وإياكم من الصالحين. أقول قولي هذا وأستغفر الله لي ولكم فاستغفروه إنه هو الغفور الرحيم. اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّعَلَى الِ سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّبَارِكْ وَسَلِّمْ.

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য, তিনি আজকেও আমাদেরকে তাঁর জন্য কিছু সময় বের করে বসার তাওফীক দান করেছেন আলহামদুলিল্লাহ। আজ যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা করেছি, শুরুতেই আমরা প্রত্যেকেই বিশেষ করে যারা ইতেকাফে আছি; এই নিয়ত করে নিব যে, ইনশাআল্লাহ, বিষয়টার ওপর সারা জীবন আমল করবো।

ফরজ নয় তবে বহু ফরজের চেয়ে ফযিলতপূর্ণ আমল
মুহতারাম হাজেরীন! তেলাওয়াতকৃত আয়াতে মুমিনগণের একটি গুণ এই বলে বর্ণনা করা হয়েছে যে, রাতের বেলা তারা শয্যা ত্যাগ করে জাহান্নামের ভয় ও জান্নাতের আশা নিয়ে তাদের মালিককে ডাকে। এর উদ্দেশ্য, তাহাজ্জুদ ও নফল নামায যা ঘুম থেকে উঠার পর গভীর রাতে পড়া হয়।
ওলামায়ে কেরাম লিখেছেন, ফরজ নয় তবে বহু ফরজের চেয়ে ফযিলতপূর্ণ একটা আমল আছে, যার নাম তাহাজ্জুদ।

তাহাজ্জুদ পড়ি না; নাকি আল্লাহ সুযোগ দেন না?
একটা সময় ছিল, তাকবীরে উলা ছুটে গেলে তাঁরা কান্নাকাটি করতেন। তাহাজ্জুদ ছুটে গেলেও কান্নাকাটি করতেন। আর এখন তো ফরজ ছুটে গেলেও কান্না আসে না। ঈমান চলে গেলেও আমরা কান্না করি না।
আমরা অনেকে এভাবে চিন্তা করি, আমি তাহাজ্জুদ পড়ি না। আমার অভ্যাস নেই।
কিন্তু বুজুর্গানে দীন এভাবে চিন্তা করতেন না। তাঁরা ভাবতেন, আল্লাহ তাআলা আমাকে তাহাজ্জুদ পড়ার সুযোগ দেননি।
আল্লাহ তাআলা কেন সুযোগ দিলেন না? নিশ্চয় আমার জীবনে এমন কোনো গোনাহ আছে, যার কারণে তিনি এই বিশেষ সময়ে আমার চেহারা দেখতে চান না।
অনেক সময় যুবকেরা আমাদের কাছে এসে বলে যে, হুজুর! কত বছর হয়ে গেছে রাতের বেলা ঘুমাইনি। বিস্ময়কর ব্যাপার হল, সারা রাত জেগে থাকি, কিন্তু ভোর রাত যখন হয় তখন ঘুম এমনভাবে চেপে বসে যে, ফজর নামাজটাও পড়তে পারিনা।
এর মূল কারণ হল, আল্লাহ তাআলা চান, এই বিশেষ সময়ে তাঁর প্রিয় বান্দারা তাঁর সঙ্গে নির্জনে সময় কাটাবে। এই জন্য কেমন যেন তিনি এই সময়ে পাপিষ্ঠদেরকে দূরে সরিয়ে দেন।
অনেক সময় দেখবেন, বিয়ে বাড়িতে লোকজন জড়ো হয় এবং চিন্তা করে, সারা রাত আড্ডা দিবে, গল্প করবে। কিন্তু ভোর রাত হলে দেখা যায়, সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। কারণ কী?
কারণ এটাই যে, আল্লাহ তাআলা চান, এই সময়ে তিনি তাঁর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের সুযোগ দিবেন। তাঁরা আল্লাহর সঙ্গে একান্ত সময় কাটাবে। সুতরাং এর মাঝে যেন অন্যরা ডিস্টার্ব করতে না পারে।

যে কারণে তুমি রমজানেও তাহাজ্জুদ থেকে বঞ্চিত
চিন্তার বিষয় এই যে, আমরা এখন রমজানের শেষ দিকে আছি। পেছনের রোজাগুলোর দিকে একটু তাকাই। প্রতি দিন তো সাহরী খাওয়ার উদ্দেশ্যে উঠেছি। কিন্তু দু’ চার রাকাত তাহাজ্জুদ পড়ার সুযোগ হয়েছে কি? যদি না হয়ে থাকে তাহলে এর অর্থ হল, আমরা এখনও গোনাহের জালে বন্দি হয়ে আছি।
ফুযায়ল ইবন ই’য়ায রহ. বলেন

إِذَا لَمْ تَقْدِرْ عَلَى قِيَامِ اللَّيْلِ وَصِيَامِ النَّهَارِ فَاعْلَمْ أَنَّكَ مَحْرُومٌ ، قد كَبَّلَتْكَ الخطايا والذنوب

যদি তুমি রাতে তাহাজ্জুদ নামায আর দিনে সিয়াম পালন করতে না পার তাহলে জেনে রেখো, তুমি বঞ্চিত। গুনাহ আর পাপাচার তোমাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে ফেলেছে। (লাতায়িফুল মাআ’রিফ : ৪৬)

গুনাহগার যে সম্মানের অধিকারী হয় না
এক ব্যক্তি ইবরাহীম ইবনু আদহাম রহ.-কে বলল

إني لَا أَقْدِرُ على قِيَامِ اللَّيْلِ فَصِفْ لِي دواءً

আমি তাহাজ্জুদে উঠতে পারিনা, তাই আমার জন্য একটি চিকিৎসা বলুন।
উত্তরে তিনি বললেন

لَا تعصيه بِالنَّهَارِ وَهُوَ يُقيمك بَيْنَ يَدَيْهِ في اللَّيْلِ فإن وُقُوفك بَيْنَ يَدَيْهِ في اللَّيْلِ من أَعْظَمِ الشَّرَفِ والْعَاصِي لَا يَسْتَحِقُّ ذلك الشرف

দিনের বেলায় গুনাহ করোনা, তাহলে তিনি তোমাকে রাতের বেলা তাঁর সামনে দাঁড় করাবেন। কারণ, রাতে তাঁর সামনে দাঁড়ানো অনেক বড় সম্মানের বিষয়। গুনাহগার সেই সম্মানের অধিকারী হয় না। (হা কাযা কানাসসালিহূন : ৩)

তুমি বন্দি! তোমার গুনাহই তোমাকে বন্দি করে রেখেছে
হাসান বসরী রহ এর এর উপনাম ছিল আবু সাঈদ। এক ব্যক্তি বলল, হে আবু সাঈদ! আমি চাই রাত জেগে ইবাদত করব, কিন্তু পারি না। এর কারণ কী?
তিনি উত্তর দিলেন

أَنْتَ رَجُلٌ قَدْ قَيَّدَتْكَ ذُنُوبُكَ

তুমি বন্দি! তোমার গুনাহই তোমাকে বন্দি করে রেখেছে। (সিফাতুস সাফওয়া : ৩/২৩৫)

একটি গোনাহর কারণে আমি পাঁচ মাস তাহাজ্জুদ থেকে বঞ্চিত
সুফ্য়ান সাওরী রহ. বলেন

حرمت قيام الليل خمسة أشهر بسبب ذنب أذنبته

আমি একটি গোনাহ করে ফেলেছি, যার কারণে আমি পাঁচ মাস তাহাজ্জুদ থেকে বঞ্চিত ছিলাম।
তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো, সেটি কী গোনাহ ছিলো?
তিনি বলেন

رأيتُ رجلا يبكي فقلت في نفسي: هذا مُراءٍ

এক ব্যক্তি কাঁদছিলো, আমি তাকে ‘লোকদেখানো কান্নাকারী’ বলেছিলাম। (হিলয়াতুল আউলিয়া : ৭/১৭)

আমরা কেন তাহাজ্জুদে থেকে বঞ্চিত?
এবার বুঝেছেন, আমরা কেন তাহাজ্জুদে থেকে বঞ্চিত? আমরা আমাদের দাদা-দাদী নানা-নানীকে দেখেছি, তাঁরা তাহাজ্জুদে ছিলেন নিয়মিত। কেননা, তাঁদের জীবনে গোনাহ কম ছিল।
এখন আমাদের রাত্রি-জাগরণ যে হয় না; তা নয়। এখন গুনাহর উপকরণ বেড়ে গেছে। আর আমরা সেগুলো নিয়ে এমনভাবে জেগে থাকি যে, চোখের পাতাও যেন নড়ে না। চিড়িয়াখানার নিশাচর প্রাণীর মত আমরা রাত জাগি। সারা রাত গোনাহের ভিতর ডুবে থাকি, আর সারা দিন ঘুমাই। এভাবে আমাদের যুবসমাজ একটা অকর্মা ও অথর্ব জাতিতে পরিণত হচ্ছে।
এবার বলুন, এই লোকটা কীভাবে চাকরি করবে, কীভাবে ব্যবসা করবে, কীভাবে নিজের পরিবার ও ছেলেমেয়েকে দেখা-শোনা করবে! সে নিজের বউকেও তো রাখতে পারবে না!
আল্লাহ আমাদেরকে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন আমীন।

বর্তমানে তালাকের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার কারণ
বর্তমানের এক বুজুর্গকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, আমাদের সময়ে তালাকের ঘটনা বেশি ঘটে; এর কারণ কী?
তিনি বললেন, এর কারণ হল, সকাল বেলার ঘুম।
লোকটি বলল, সকাল বেলার ঘুমের সঙ্গে তালাকের কী সম্পর্ক?
তিনি উত্তর দিলেন, যে সকালে ঘুমায়, মূলত সে রাতে কম ঘুমায়। আর সকাল বেলা ঘুমালে ওই বরকত থেকে বঞ্চিত হতে হয়, যে বরকতের দোয়া রাসুলুল্লাহ ﷺ করেছেন। সখর গামেদি রাযি. সূত্রে বর্ণিত, রাসুল ﷺ এ দোয়া করেছেন

اللَّهُمَّ بَارِكْ لأُمَّتِي فِي بُكُورِهَا

হে আল্লাহ, আমার উম্মতের জন্য দিনের শুরু বরকতময় করুন। (আবু দাউদ : ২৬০৬)
আর যে পরিবার বরকত থেকে বঞ্চিত হয়, ওই পরিবারে আল্লাহর রহমত থাকে না। ফলে পরস্পরের মিল-মহব্বত ওঠে যায়। তাই আল্লাহ যেটিকে ঘৃণা করেন সে-ই তালাকের ঘটনা ঘটে থাকে।
আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করুন আমীন।

ইবাদত আমাদের কাছে ভালো লাগে না কেন?
ইবাদতের স্বাদ আমরা পাই না। ইবাদত আমাদের কাছে ভালো লাগে না। সমাজ আজ গুনাহ দ্বারা ছেয়ে গেছে। যুব সমাজের অবস্থা দেখলে তো কান্না আসে। এসবের কারণ কী?
ইবনুল কাইইয়িম রহ. বলেন

أجمع العارفون بالله ان ذنوب الخلوات هي أصل الانتكاسات، وأن عبادات الخفاء هي أعظم أسباب الثبات

সকল আউলিয়ায়ে কেরাম একমত যে, বান্দার গোপন গুনাহ দীনের পথে তার পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ। আর বিপরীতে গোপন ইবাদত দীনের পথে অবিচল থাকার অন্যতম উপায়। (মাউকিউ দুরারিস সুন্নিয়্যা : ১/২৪৩)

তাহাজ্জুদের জন্য ওঠার তাওফীক কার হয়?
মূলত আল্লাহ তাআলা তাহাজ্জুদের জন্য ওঠার তাওফীক তাকেই দান করেন, যাকে আল্লাহ নিজ দরবারের সালিহ তথা নেক বান্দা হিসেবে কবুল করে নেন। আমি পারি না; এর অর্থ হল, আমি এখনও আল্লাহর নেক বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারিনি। তাই আজ থেকে প্রত্যেকেই পাক্কা-সাচ্চা নিয়ত করে নেন যে, ইনশাআল্লাহ, তাহাজ্জুদে অভ্যস্ত হব।

ইবাদতের মজা তো তাহাজ্জুদের মধ্যেই
আসলে ইবাদতের মজা তো পাওয়া যায় তাহাজ্জুদের মধ্যেই। নির্জনে আল্লাহ তাআলাকে সেজদা দেয়ার মজাই আলাদা। আপনি লোক চক্ষুর সামনে পঞ্চাশ রাকাত নামাজ পড়েন, আর লোক চক্ষুর আড়ালে রাতের গভীরে নির্জনে খুশু খুযু’র সঙ্গে দুই রাকাত নামাজ পড়েন, দেখবেন, যে স্বাদ এই দুই রাকাতে অনুভব করবেন তা আপনি ওই পঞ্চাশ রাকাতে পাবেন না।
আল্লাহর আরেফ চমৎকার বলেছেন

دل کی گہرائیوں سے انکا نام جب لیتا ہوں میں
چومتی ہے میرے قدموں کو بہار کائنات

হৃদয়ের গভীর থেকে যখন মাওলার নাম নেই; মনে হয় গোটা দুনিয়ার আমার পায়ের কাছে এসে লুটোপুটি খায়।
আফসোস! কবে আমরা এই মজা পাব!

দুনিয়ার স্বাদ কেবল তিনটি বিষয়ে রয়েছে
এ কারণে তাবিয়ী মুহাম্মদ ইবনুল মুনকাদির রহ. বলতেন

ما بقي من لذات الدنيا إلا ثلاث: قيام الليل، ولقاء الإخوان، والصلاة في جماعة

দুনিয়ার স্বাদ কেবল তিনটি বিষয়ে অবশিষ্ট রয়েছে। ১. ক্বিয়ামুল লায়ল তথা তাহাজ্জুদ নামায ২. দ্বীনী ভাইদের সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভ এবং ৩. জামাতে নামায আদায় করা। (আবূ ত্বালেব মাক্কী, কূতুল কুলূব ফী মু‘আমালাতিল মাহবূব : ১/৭১)

সালাহুদ্দীন আইয়ুবী রহ.
বাইতুল মুকাদ্দাস বিজেতা সালাহুদ্দীন আইয়ুবী রহ.-এর নাম নিশ্চয় আপনারা শুনেছেন। তাঁর ব্যাপারে প্রসিদ্ধ ছিল, তিনি জিহাদের ময়দানের জয়-পরাজয়ের ফয়সালা রাতে জায়নামাযে বসে করে নিতেন।
বাইতুল মুকাদ্দাস যে দিন জয় লাভ করেন, এর আগের রাতে তিনি সারা রাত ইবাদত করলেন। সকাল বেলা ফজর নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হয়েছেন। পথিমধ্যে ওই যুগের একজন প্রসিদ্ধ বুজুর্গের সঙ্গে দেখা। তিনি স্বভাববশতঃ তাঁর কাছে দোয়া চাইলেন, যেন বাইতুল মুকাদ্দাস জয় লাভ করতে পারেন।
বুজুর্গ মুসকি হেঁসে উত্তর দিলেন, সালাহুদ্দীন! আমার কাছে দোয়া চাওয়ার প্রয়োজন নেই। তুমি তো গতকাল রাতেই আল্লাহর কাছ থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস নিয়ে নিয়েছ।
এজন্য আল্লাহর শপথ করে বলছি, যদি আল্লাহর কিছু বান্দা-বান্দি এই মহান ইবাদতের আভ্যাস গড়ে তুলতে পারি, তাহলে দেশের চেহারাই পাল্টে যাবে।
আজকের এই মজলিসের একজন বান্দাও যদি এই দশ দিনের ইতিকাফের উসিলায় আজকের পর থেকে তাহাজ্জুদের পাবন্দ হয়ে যান, আশা করা যায়, এই মজলিসটা আমাদের জন্য নাজাতের উসিলা হয়ে যাবে।
আল্লাহ সকলকে তাহাজ্জুদের পাবন্দ বানিয়ে দিন আমীন।

তাহাজ্জুদ সাধারণ ব্যক্তিকে অসাধারণ করে তুলে
এজন্য ওয়াহাব ইবন মুনাব্বিহ রহ. বলতেন

قيام الليل يشرف به الوضيع ويعز به الذليل وصيام النهار يقطع عن صاحبه الشهوات وليس للمؤمن راحة دون دخول الجنة

রাতের তাহাজ্জুদ সাধারণ ব্যক্তিকে অসাধারণ করে তুলে। দুর্বল ব্যক্তিকে সম্মানিত করে তুলে। দিনের রোজা নফসকে দুর্বল করে। জান্নাতে প্রবেশের আগে মুমিনের আরাম নেই।  (মুখতাসার ক্বিয়ামুললাইল : ৬০)

অন্তরের আরোগ্য
ইবরাহীম আল-খাওয়াস রহ. এবং ইয়াহইয়া ইবনে মু‘আয রহ. বলেন

دَوَاءُ الْقلبِ خَمْسَةُ أَشْيَاءَ: قِرَاءَةُ الْقُرْآنِ بِالتَّدَبُّرِ، وَخَلَاءُ الْبَاطِنِ، وَقِيَامُ اللَّيْلِ، وَالتَّضَرُّعُ عِنْدَ السَّحَرِ، وَمُجَالَسَةُ الصَّالِحِينَ

পাঁচটি জিনিসে অন্তরের আরোগ্য রয়েছে
১. চিন্তা—গবেষণা করে কুরআন তেলাওয়াত।
২. পেট খালি রেখে খাদ্য গ্রহণ।
৩. কিয়ামুল লাইল তথা তাহাজ্জুদ।
৪. শেষ রাতের কাকুতি—মিনতি করে দোয়া এবং
৫. নেককার মানুষের সাহচর্য। (সিফাতুস সাফওয়া : ২/২৯৩)

রমাযানকে আত্মশুদ্ধির মাস কেন বলা হয়?
দেখুন, রমাযানকে আত্মশুদ্ধির মাস কেন বলা হয়? কারণ, একজন মানুষ চাইলে রমযানে সহজে এই পাঁচটি বিষয় অর্জন করতে পারে।
আলহামদুলিল্লাহ, এখানে ইতেকাফকারীদের মাঝে এই পাঁচটি গুণ অন্তত এই দশ দিনের জন্য পাওয়া যায়। আমি অবশ্যই গোনাহগার, আমরা অধিকাংশই না হয় গোনাহগার। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ্, এই মজলিসে এমন লোকও আছেন, যিনি সারা বছরই তাহাজ্জুদ পড়েন। এমন লোকও আছেন, যিনি রমযান আসলে এক রাতও ঘুমান না; সারা রাত ইবাদত করে কাটিয়ে দেন। এমন লোকও আছেন, রমযান আসলে দশ খতম, এগার খতম কুরআন তেলাওয়াত করেন।
সুতরাং আশা করা যায়, এ নেক বান্দাদের উসিলায় আল্লাহ তাআলা আমাদেরকেও মাফ করে দিবেন, ইনশাআল্লাহ।

তাহাজ্জুদগুজার ব্যক্তির চেহারা মায়াবী হয় কেন?
তাহাজ্জুদগুজার ব্যক্তির চেহারায় এক প্রকার নূর থাকে। এই নূরটা স্বয়ং আল্লাহ তাআলা দান করেন।
এজন্য দেখবেন, লোকটা দেখতে হয়ত কালো। বাহ্যিক চেহারা তেমন সুন্দর নয়। কিন্তু যারা ঈমানদার তারা লোকটিকে দেখে মন্তব্য করবে, লোকটা নেককার ভালো মানুষ।
মুনাফিক কিংবা পাপিষ্ঠদের কথা আমি বলছিনা। কারণ, কুকুরের পেটে তো ঘি হজম হয় না! তাই তাদের কাছে ভালো মানুষ ভালো লাগে না; বরং অনেক সময় চুলকানি শুরু হয়।
আমি প্রকৃত মুমিন-মুসলামানের কথা বলছি, তারা তাহাজ্জুদ্গুজার লোক দেখলে অন্তরে একপ্রকার মায়া অনুভব করে। এই মায়াটা আল্লাহ তাআলা ঢেলে দেন।
বিখ্যাত তাবিয়ী সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব রহ. বলেন

إِنَّ الرَّجُلَ لَيُصَلِّي بِاللَّيْلِ، فَيَجْعَلُ اللهُ في وَجْهِهِ نُوراً يُحِبُّهُ عَلَيْهِ كُلُّ مُسْلِمٍ، فَيَرَاهُ مَن لم يَرَهُ قَطُّ، فيَقُولُ: إِنِّي لَأُحِبُّ هَذا الرَّجُلَ

যে ব্যক্তি রাতে নামাজ আদায় করে, আল্লাহ্ তার চেহারায় নূর উদ্ভাসিত করে দেন। প্রত্যেক মুসলিম তাকে ভালোবাসে; যদিও পূর্বে কখনও তাকে না দেখে থাকে। তারা বলে, এই লোকটিকে আমার ভালো লাগে।

আল্লাহ তাআলা তাদেরকে নুরানী-পোশাক পরিধান করান
হাসান বসরী রহ.-কে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করেছিল

ما بالُ المتهَجِّدين باللَّيلِ أحسَنَ النَّاسِ وُجوهًا؟

তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়কারীরা কেন নুরানী চেহারার অধিকারী হয়?
উত্তরে তিনি বলেন

إنَّهم خَلَوا بالرَّحمنِ تبارك وتعالى، فألبَسَهم اللهُ عزَّ وجَلَّ نورًا مِن نُورِه

তাঁরা আল্লাহর সাথে নিভৃতে অবস্থান করেন, ফলে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে বিশেষ জ্যোতির্ময় পোশাক পরিধান করান। (আদদীনওয়ারী, আলমুজালাসা : ১/৪৪৫)

تمنا ہے کہ اب کوئی جگہ ایسی کہیں ہوتی
اکیلے بیٹھے رہتے یاد ان کی دل نشیں ہوتی

তামান্না আমার যদি পেতাম এমন কোনো নির্জনতা;
একাকী বসে ভাবতাম তাঁকে, দূর করতাম অস্থিরতা।

তাহাজ্জুদের ছয় ফায়দা
ওলামায়ে কেরাম লিখেছেন, তাহাজ্জুদে কমপক্ষে ছয়টি ফায়দা রয়েছে। যথা

أَنَّهُ يَحُطَّ الذُّنُوبَ كَمَا يَحُطُّ الرِّيحُ الْعَاصِفُ الْوَرَقَ الْيَابِسَ مِنْ الشَّجَرَةِ

তীব্র বাতাস যেমনিভাবে গাছের শুকনো পাতা ঝরিয়ে দেয়, অনুরূপভাবে তাহাজ্জুদ জীবনের গুনাহগুলোকে মিটিয়ে দেয়।

أَنَّهُ يُنَوِّرُ الْقَلْبَ

তাহাজ্জুদ কবরকে আলোকিত করে।

أَنَّهُ يُحَسِّنُ الْوَجْهَ

তাহাজ্জুদ চেহারা উজ্জ্বল করে

أَنَّهُ يُذْهِبُ الْكَسَلَ

তাহাজ্জুদ অলসতা দূর করে।

وَيُنَشِّطُ الْبَدَنَ

তাহাজ্জুদ শরীর চাঙ্গা করে।

أَنَّ مَوْضِعَهُ تَرَاهُ الْمَلَائِكَةُ مِنْ السَّمَاءِ كَمَا يَتَرَاءَى الْكَوْكَبُ الدُّرِّيُّ لَنَا فِي السَّمَاءِ

তাহাজ্জুদগুজার ব্যক্তির অবস্থান ফেরেশতারা দেখে, যেমন আমরা আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র দেখি। (মানাবী, ফায়যুল কাদীর : ৪/৩৫১)

যারা তাহাজ্জুদ পড়েন, ফেরেশতারা তাদের প্রতি তাকিয়ে থাকেন
কা’ব আলআহবার রাযি. বলেন

إن الملائكة يَنْظُرُونَ من السَّمَاءِ إلى الَّذِينَ يتهجدون بالليل كَمَا تنظرون أنتم إلى نجوم السَّمَاءِ

যেমনিভাবে তোমরা আকাশের তারকারাজি দেখো, অনুরূপভাবে ফেরেশতারা আকাশ থেকে তাদের প্রতি তাকিয়ে থাকেন যারা রাতে তাহাজ্জুদ পড়েন। (ইবনু রজব, ইখতিয়ার আল-আওলা : ৯১)

রিয়া ঢুকিয়ে এই কষ্টের আমল নষ্ট করে দিবেন না
যে ব্যক্তি তাহাজ্জুদে ওঠে, তখন সাধারণত তার মাঝে ইখলাস থাকে। কেননা, গভীর রাতে তার এই আমল দেখার মত তখন সেখানে কেউ থাকে না। তাই ইখলাস তখন থাকে। আন্যথায় সে এত কষ্ট করে ওঠে কিভাবে!
কিন্তু অনেকেই এই ইখলাস দিনের বেলায় ধরে রাখতে পারে না। ফলে তার এত কষ্টের আমলটি নষ্ট করে বসে।
যেমন অনেক সময় আরেকজনকে লক্ষ্য করে এভাবে বলে, আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন, আমিও আপনার জন্য তাহাজ্জুদের সময় দোয়া করবো। অর্থাৎ, কায়দা করে সে বুঝিয়ে দিল যে, আমি কিন্তু তাহাজ্জুদ পড়ি। অথচ এটা রিয়া। আর আমলে রিয়া চলে আসলে ওই আমল আল্লাহর জন্য আর থাকেনা। ফলে আমলটি বরবাদ হয়ে যায়।
অথচ এই আমলটি তো এতই মহান ছিল, যদি আল্লাহ কবুল করে নেন, তাহলে দুই রাকাত তাহাজ্জুদও নাজাতের জন্য যথেষ্ট হয়ে যেত। সুতরাং এই কষ্টের আমলের তাওফীক যদি হয়, তাহলে রিয়া ঢুকিয়ে একে বরবাদ করে দিবেন না।

জুনায়েদ বাগদাদী রহ.
আবু জাফর আলখুলদী রাহ. বলেন, ইনতিকালের পর জুনায়েদ বাগদাদী রহ.—কে একদিন স্বপ্নে দেখলাম। জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহ আপনার সঙ্গে কী আচরণ করেছেন?
তিনি বললেন

طَاحَتْ تِلْكَ الْإشَارَاتُ وَغَابَتْ تِلْكَ الْعِبَارَاتُ وَفَنِيَتْ تِلْكَ الْعُلُوْمُ وَنَفِدَتْ تِلْكَ الرّسُوْمُ وَمَا نَفَعَنَا إِلّا رُكَيْعَات كُنّا نَرْكَعُهَا فِى السّحرِ

সেইসব ইশারা মিটে গেছে, বাক্যাবলী সব হারিয়ে গেছে, জ্ঞান-বিদ্যা উধাও হয়ে গেছে, অদৃশ্য হয়ে গেছে সব কীর্তি ও কর্ম, কেবল উপকার করেছে শেষরাতের রাকাতগুলো।  (তাবাকাতুশ শাফিইয়্যাতিল কুবরা : ২/২৬৭)

পাঁচ জিনিস আছে পাঁচ জিনিসের মধ্যে
শাকীক বালখী রহ. আমি পাঁচটি জিনিস তালাশ করেছি এবং তা পাঁচ জায়গায় পেয়েছি

طَلَبْنَا تَرْكَ الذُّنُوبِ فَوَجَدْنَاهُ فِي صَلَاةِ الضُّحَى

গোনাহসমূহ ত্যাগ করার বিষয়টি তালাশ করেছি, পেয়েছি চাশতের নামাযে।

طَلَبْنَا ضِيَاءَ الْقُبُورِ فَوَجَدْنَاهُ فِي صَلَاةِ اللَّيْلِ

কবরের জ্যোতি তালাশ করেছি, পেয়েছি তাহাজ্জুদ নামাযে।

طَلَبْنَا جَوَابَ مُنْكَرٍ وَنَكِيرٍ فَوَجَدْنَاهُ فِي قِرَاءَةِ الْقُرْآنِ

মুনকার নাকীরের প্রশ্নে উত্তর তালাশ করেছি, পেয়েছি কুরআন তেলাওয়াতের মধ্যে।

طَلَبْنَا عُبُورَ الصِّرَاطِ فَوَجَدْنَاهُ فِي الصَّوْمِ وَالصَّدَقَةِ

পুলসিরাত পাড়ি দেয়ার বিষয়টি তালাশ করেছি, পেয়েছি রোজা ও সাদকার মধ্যে।

طَلَبْنَا ظِلَّ الْعَرْشِ فَوَجَدْنَاهُ فِي الْخَلْوَةِ

আরশের ছায়া তালাশ করেছি, পেয়েছি নির্জনে ইবাদত করার মধ্যে। (ইতহাফুস-সাদাতিল মুত্তাকীন ১০/৪১৮)
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকেও তাওফীক দান করুন আমীন।

হাদীসে তাহাজ্জুদের ফযিলত
ফরয নামাযের পরেই যার স্থান
হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন

أَفْضَلُ الصَّلَاةِ بَعْدَ الصَّلَاةِ المَكْتُوبَةِ الصَّلَاةُ في جَوْفِ اللَّيْلِ

ফরয নামাযের পর উত্তম নামায গভীর রাতে নামায পড়া। (মুসলিম : ১১৬৩)

অতীত গোনাহ মুছে দেয়, ভবিষ্যত গোনাহ থেকে রক্ষা করে
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন

عَلَيْكُمْ بِقِيَامِ اللّيْلِ فَإِنّهُ دَأَبُ الصّالِحِينَ قَبْلَكُمْ، وَهُوَ قُرْبَةٌ إِلَى رَبِّكُمْ، وَمَكْفَرَةٌ لِلسّيِّئَاتِ، وَمَنْهَاةٌ لِلإِثْمِ

তোমরা তাহাজ্জুদের প্রতি যত্নবান হও। কেননা তা তোমাদের পূর্ববর্তী সালেহীনের অভ্যাস এবং রবের নৈকট্য লাভের বিশেষ মাধ্যম। আর তা পাপরাশী মোচনকারী এবং গোনাহ থেকে বাধা প্রদানকারী। (তিরমিযী : ৩৫৪৯)

নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশের মাধ্যম
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন

يَاأَيّهَا النّاسُ، أَفْشُوا السّلاَمَ، وَأَطْعِمُوا الطّعَامَ، وَصَلّوا وَالنّاسُ نِيَامٌ، تَدْخُلُونَ الجَنّةَ بِسَلاَمٍ

হে লোক সকল! সালামের প্রসার কর। মানুষকে আহার করাও! আর রাতে যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে, তখন নামায আদায় কর! তাহলে নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। (তিরমিযী : ২৪৮৫)

আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করেন
বাবা সব সন্তানকে নিয়ে গর্ব করে না; বরং ওই সন্তানকে নিয়ে গর্ব করেন, যার কিছু কৃতিত্ব আছে। আল্লাহ তাআলাও যারা তাহাজ্জুদ পড়েন তাদেরকে নিয়ে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন

عَجِبَ رَبُّنَا مِنْ رَجُلَيْنِ: رَجُلٍ ثَارَ عَنْ وِطَائِهِ وَلِحَافِهِ مِنْ بَيْنَ حِبِّهِ وَأَهْلِهِ إِلَى صَلَاتِهِ فَيَقُولُ اللَّهُ جَلَّ وَعَلَا لِمَلَائِكَتِهِ: انْظُرُوا إِلَى عَبْدِي، ثَارَ عَنْ فِرَاشِهِ وَوِطَائِهِ مِنْ بَيْنَ حِبِّهِ وَأَهْلِهِ إِلَى صَلَاتِهِ رَغْبَةً فِيمَا عِنْدِي، وَشَفَقَةً مِمَّا عِنْدِي

আমাদের রব দু’ ব্যক্তির ব্যাপারে গর্ব করেন। একজন ওই ব্যক্তি যে বিছানা ও লেপ-তোশক ছেড়ে পরিবার-পরিজনের মধ্য থেকে উঠে গিয়ে নামাযে দাঁড়ায়। তখন আমাদের রব ফেরেশতাদেরকে বলেন, হে আমার ফেরেশতাগণ! দেখো আমার বান্দাকে, নরম বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছে, স্ত্রী ও প্রিয়জন ছেড়ে সে আমার কাছে যা আছে তা পাওয়ার আশায় তাহাজ্জুদের নামাযে দাঁড়িয়ে গিয়েছে।

وَرَجُلٍ غَزَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ، فَانْهَزَمَ أَصْحَابُهُ، وَعَلِمَ مَا عَلَيْهِ فِي الِانْهِزَامِ ، وَمَا لَهُ فِي الرُّجُوعِ، فَرَجَعَ حَتَّى هُرِيقَ دَمُهُ، فَيَقُولُ اللَّهُ لِمَلَائِكَتِهِ: انْظُرُوا إِلَى عَبْدِي، رَجَعَ رَجَاءً فِيمَا عِنْدِي، وَشَفَقًا مِمَّا عِنْدِي حَتَّى أُهَرِيقَ دَمُهُ

আরেক ব্যক্তি যে আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে। তার সাথীরা পরাজিত হয়েছে। সে জেনেছে যে পরাজিত হলে কী বিপদ আসতে পারে এবং জিহাদে ফেরত গেলে কী পুরস্কার পাবে, তখন সে যুদ্ধে ফেরত আসে। এমনকি শাহাদাত বরণ করে। তখন আল্লাহ্ ফেরেশতাদেরকে বলেন, দেখো আমার বান্দাকে সে জিহাদের ময়দানে ফেরত এসেছে, আমার কাছে যে পুরস্কার আছে তা পাওয়ার আশায় এবং আমার কাছে যে শাস্তি আছে তার ভয়ে; শেষ পর্যন্ত নিজের রক্ত প্রবাহিত করে দিয়েছে।  (মুসনাদে আহমদ : ৩৯৪৯)
অপর বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহ বলেন

فَإِنِّي أُشْهِدُكُمْ أَنِّي قَدْ أَعْطَيْتُهُ مَا رَجَا وَأَمَّنْتُهُ مِمَّا خَافَ

হে আমার ফেরেশতাগণ! তোমরা সাক্ষী থেকো, অতএব সে যা আশা করেছে অর্থাৎ জান্নাত আমি তাকে তা দিয়ে দিলাম। যাকে সে ভয় করে অর্থাৎ জাহান্নাম তা থেকে তাকে নিরাপদ করলাম। (তাবরানী : ৮৫৩২)

বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে
হাদীসে এসেছে, যারা তাহাজ্জুদগুজার আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন তাদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করে বিশেষভাবে ডাক দিবেন। উইনার (ডরহহবৎ) তথা প্রতিযোগিতায় বিজয়ী তো সকলেই হয়না! কিন্তু যারা উইনার হয় তাদেরকে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করা হয়। অনুরূপভাবে তাহাজ্জুদগুজারদেরকেও পুরস্কারের দিন আলাদাভাবে মূল্যায়ন করা হবে। অন্যদের থেকে আলাদা করে তাদেরকে ডাক দেয়া হবে। ডাক দেয়ার পদ্ধতিটাও হবে অন্যরকম! হাদীস শুনুন
আসমা বিনতে ইয়াযিদ রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন

إذَا جَمَعَ اللَّهُ الْأَوَّلِينَ وَالْآخَرِينَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ جَاءَ مُنَادٍ يُنَادِي بِصَوْتٍ يُسْمِعُ الْخَلَائِقَ : سَيَعْلَمُ الْخَلَائِقُ الْيَوْمَ مَنْ أَوْلَى بِالْكَرَمِ

যখন আল্লাহ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমস্ত লোককে কেয়ামতের দিনে সমবেত করবেন, তখন একজন ঘোষণাকারী এমনভাবে ঘোষণা করবে যে, সকল সৃষ্টি তা শুনতে পাবে। ঘোষণাকারী ঘোষণা দিবে, আজ এখুনি সমবেত লোকেরা জানতে পারবে যে, কারা অধিক সম্মানিত।

لِيَقُمْ الَّذِينَ كَانُوا تَتَجَافَى جُنُوبُهُمْ عَنْ الْمَضَاجِعِ

যারা রাতের বেলায় আরামের বিছানা থেকে নিজেদের পার্শ্বকে দূরে রেখেছিল, তারা দাঁড়িয়ে যাক।
নবীজী ﷺ বলেন

فَيَقُومُونَ وَهُمْ قَلِيلٌ

তখন তারা দাঁড়াবে, তবে তাঁরা সংখ্যায় কম হবে।

فَيَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ بِغَيْرِ حِسَابٍ

এরপর তারা বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে।

ثُمَّ يُؤْمَرُ بِسَائِرِ النَّاسِ إِلَى الْحِسَابِ

এরপর অবশিষ্ট সকল মানুষ থেকে হিসাব নেয়ার নির্দেশ করা হবে। (মুস্তাদরাকি হাকিম ৩৫০৮, বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান ২৯৭৪)

যার দাবী মিথ্যা
বৈধ হোক কিংবা অবৈধ হোক; সকল ভালোবাসার একটা পিক আওয়ার আছে। একটা যুতসই সময় আছে। একটা টাইমিং আছে। সকল ভালোবাসাই নির্জনতা চায়। আর আল্লাহকে ভালোবাসার ওই সময়টা হল, ভোর রাত। আমরা তো দাবী করি, আল্লাহকে ভালোবাসি। কিন্তু ওই টাইমটাতে হয় ঘুমিয়ে থাকি কিংবা গোনাহের ভিতরে ডুবে থাকি।
এই জন্য ফুযাইল ইবন ই’য়ায রহ. এক দিন হুসাইন ইবনু যিয়াদ রহ.-এর হাত ধরে বলেন, শোনো হুসাইন!

يَنْزِلُ اللهُ تَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى سَمَاءِ الدُّنْيَا فَيَقُولُ الرَّبُّ : كَذَبَ مَنْ ادَّعَى مَحَبَّتِي إِذَا جَنَّهُ اللَّيْلُ نَامَ عَنِّي ؟ أَلَيْسَ كُلُّ حَبِيبٍ يُحِبُّ خَلْوَةَ حَبِيبِه ؟

আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক রাতে দুনিয়ার আসমানে আসেন। তারপর বলতে থাকেন, যে ব্যক্তি আমার প্রতি ভালোবাসার দাবী করে অথচ রাতের গভীরে ঘুমিয়ে থাকে; সে মূলতঃ মিথ্যা দাবী করলো। প্রত্যেক প্রেমিক কি তার প্রেমাস্পদের সঙ্গে একান্ত সময় কামনা করে না!  (হিলয়াতুল আউলিয়া : ৮/৯৯, ১০০)

রাতের শেষ প্রহর : রব তোমাকে ডাকছেন!
অন্য সময়ের ইবাদতে আমরা আল্লাহ তাআলাকে পাওয়ার চেষ্টা করি, আর রাতের শেষ প্রহরে স্বয়ং আল্লাহ বান্দাকে ডাকতে থাকেন। অন্য সময়ে আমরা আল্লাহকে তালাশ করি, রাতের শেষ প্রহরে স্বয়ং আল্লাহ তাঁর কিছু বান্দাকে তালাশ করেন।
আল্লাহ যেন আমার ডাকে সাড়া দেন। তিনি যেন আমাকে ক্ষমা করেন; এর জন্য আমাদের কত ভাবনা! আর রাতের শেষ প্রহরে স্বয়ং আল্লাহ বান্দাকে ডাকতে থাকেন দোয়া কবুলের জন্য, বান্দাকে ক্ষমা করার জন্য! আর এর জন্য তিনি প্রথম আসমানে চলে আসেন।
শিশু যখন কাঁদে, বাবা তখন সন্তানকে এভাবে জিজ্ঞেস করে, আব্বু! তোমার কী লাগবে? মজা লাগবে? আইসক্রিম দরকার? চকলেট দিব? কী প্রয়োজন? আব্বুকে বলো! আব্বু এখুনি এনে দিচ্ছি।
অনুরূপভাবে রাতের শেষ প্রহরে আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাকে জিজ্ঞেস করেন, বান্দা! তোমার কী দরকার? ক্ষমা দরকার? ক্ষমা করে দিব। রিজিক লাগবে? রিজিক দিয়ে দিব। বান্দা! আমি মাওলার কাছে বলো, তোমার কী প্রয়োজন, আমি পূরণ করে দিব।

শুনুন নবীজি ﷺ-এর পাক যবানে

يَنْزِلُ رَبّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلّ لَيْلَةٍ إِلَى السّمَاءِ الدّنْيَا حِينَ يَبْقَى ثُلُثُ اللّيْلِ الآخِرُ يَقُولُ: مَنْ يَدْعُونِي، فَأَسْتَجِيبَ لَهُ مَنْ يَسْأَلُنِي فَأُعْطِيَهُ، مَنْ يَسْتَغْفِرُنِي فَأَغْفِرَ لَهُ

আমাদের রব প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করেন এবং বলেন, কে আছো, দুআ করবে আমি তার দুআ কবুল করব। কে আছো, আমার কাছে তার প্রয়োজন চাইবে আমি তাকে দান করব। কে আছো, আমার কাছে ক্ষমা চাইবে আমি তাকে ক্ষমা করব।  (বুখারী : ১১৪৫)

তুমি আমার আমি তোমার
সুতরাং ভোর রাতে ওঠে আপনি তাহাজ্জুদ পড়েছেন, দোয়া করেছেন, কান্নাকাটি করেছেন এর অর্থ হল, আপনি আল্লাহ তাআলার ডাকে সাড়া দিয়েছেন। কেমন যেন আল্লাহ আপনাকে একান্তে ডেকে জিজ্ঞেস করেছেন, ক্ষমা দরকার আছে কি? আপনি উত্তর দিয়েছেন, জি আল্লাহ! আছে, ক্ষমা করে দিন। আল্লাহ জিজ্ঞেস করেছেন, রিজিকের প্রয়োজন আছে কি? আপনি উত্তর দিয়েছেন, জি আল্লাহ! আছে, রিজিক দিয়ে দিন।

آنکھوں آنکھوں میں اشارے ہو گئے
ہم تمہارے تم ہمارے ہو گئے

চোখে চোখে হয়েছে ইশারা,
তুমি আমার আমি তোমার।

গভীর রাতে প্রভুর সান্নিধ্যে
আহ! কত বড় নেয়ামত এই তাহজ্জুদ। আমরা বুঝিনা, কিন্তু আল্লাহওয়ালারা বুঝতেন। তাই যত কষ্ট হোক, তাঁরা এই সময়ে ঘুমিয়ে থাকতে পারতেন না।
গভীর রাত। প্রায় তিনটা। হঠাৎ শাহ সুলতান আহমদ নানুপুরী রহ. খাদেমকে বললেন, আমি কলা খাবো, দোকানে গিয়ে কলা নিয়ে আসো।
খাদেম মনে মনে ভাবলো, এতো গভীর রাতে বাজারে দোকান খোলা থাকবে না। তাও হযরতের আদেশ মান্য করে খাদেম বাজারে গিয়ে দেখে, একটি দোকান খোলা, এবং দোকানের সামনে কলা ঝুলছে!
কলা ক্রয় করে হযরতের সম্মুখে পেশ করলেন। হযরত জিজ্ঞেস করলেন, দাম কত?
খাদেম বলল, অন্যান্য সময়ের চেয়ে এখন একটু বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়েছে, কারণ বাজারে একটা মাত্র দোকান খোলা।
তখন হযরত বললেন, দেখো! বাজারে একটা দোকান খোলা থাকায় কলার দাম বেড়ে গেছে, তেমনি যে ব্যক্তি তাহাজ্জুদ পড়ে, আল্লাহ পাক দেখেন, দুনিয়ার সকল লোক ঘুমে বিভোর কিন্তু এক ব্যক্তি নামায পড়ছে। তখন আল্লাহ পাকের কাছে উক্ত ব্যক্তির দাম এবং তার নামাজের দাম বেড়ে যায়। তখন যদি সে টুটিপুঁটি ইবাদতও করে আল্লাহ পাকের কাছে তার দাম অনেক বেশি!
আল্লাহু আকবার, কী সুন্দর দৃষ্টান্ত আমাদের জন্য!

স্ত্রীকে নিয়ে তাহাজ্জুদ
এত গুরুত্বপূর্ণ ও ফযীলতের আমল একা কেন, নিজের স্ত্রীকেও প্রস্তুত করুন। স্বামী-স্ত্রী দীন পালনের ক্ষেত্রে একে অপরের জন্য সহযোগী হোন। রাসূলুল্লাহ ﷺ এমন স্বামী-স্ত্রীর জন্য দোয়া করেছেন। যে স্বামী-স্ত্রীর জন্য নবীজির দোয়া আছে, তারা কতই না সৌভাগ্যবান! তাদের জীবন না জানি কত সুখময় হবে! তারা তো দুনিয়াতে বসেই জান্নাতের আবহ পাওয়া শুরু করবে। তারা তো কুড়েঘরে বসবাস করেও ফাইভস্টারের চেয়ে বেশি মজা নিবে। নবীজি ﷺ-এর দোয়া তাঁর নিজের ভাষাতেই শুনুন

رَحِمَ اللهُ رَجُلًا قَامَ مِنَ اللّيْلِ فَصَلّى، ثُمّ أَيْقَظَ امْرَأَتَهُ فَصَلّتْ، فَإِنْ أَبَتْ نَضَحَ فِي وَجْهِهَا الْمَاءَ

সে ব্যক্তির প্রতি আল্লাহ রহম করুন, যে রাতে উঠে নামায আদায় করে, তারপর স্ত্রীকে জাগিয়ে দেয় এবং সেও সালাত আদায় করে। স্ত্রী যদি উঠতে না চায় তখন তার চেহারায় পানি ছিটিয়ে হলেও উঠানোর চেষ্টা করে।

وَرَحِمَ اللهُ امْرَأَةً قَامَتْ مِنَ اللّيْلِ فَصَلّتْ، ثُمّ أَيْقَظَتْ زَوْجَهَا فَصَلّى، فَإِنْ أَبَى نَضَحْتَ فِي وَجْهِهِ الْمَاءَ

অনুরূপভাবে ওই নারীর প্রতি আল্লাহ রহম করুন, যে রাতে উঠে নামায আদায় করে তারপর স্বামীকে জাগিয়ে দেয় এবং স্বামী উঠে নামায আদায় করে। স্বামী উঠতে না চাইলে চেহারায় পানি ছিটিয়ে হলেও তাকে উঠানোর চেষ্টা করে।
(নাসায়ী : ১৩০২)

কোথায় আছে সুখ-শান্তি?
আপনি কি মনে করেন টাকা-পয়সার ভেতরে সুখ-শান্তি বিদ্যমান? যদি তা-ই হয় তাহলে বসুন্ধরা সিটি কিংবা যমুনা ফিউচার পার্কের মত কোনো আধুনিক মার্কেটে যান, সেখান থেকে এক কেজি সুখ কিংবা শান্তি কিনে নিয়ে আসেন!
সুখ-শান্তি কি কেনা যায়? তাহলে কোথায় আছে সুখ-শান্তি? মূলত সুখ-শান্তি আল্লাহ তাআলা তাঁর দীনের মাঝেই রেখেছেন।

সাহাবায়ে কেরাম এবং আমাদের মাঝে পার্থক্য
সাহাবায়ে কেরাম এটা বুঝেছেন বিধায় তারা উভয় জাহানেই সুখী হয়েছেন। আফসোস আমাদের জন্য! কারণ, আমরা এটা বুঝিনি। যার কারণে আমাদের কাছে দুনিয়া হল বাস্তবতা এবং আখেরাত যেন কল্পনার জগত। তাঁদের কাছে তাকয়ওয়া ছিল মূল সম্বল। আর আমাদের কাছে কম্বল তথা আরাম—আয়েশ হল মূল সম্বল!

ঘরের মালিক আমাদেরকে থাকতে দিবে না
এক ব্যক্তি আবু জর গিফারী রাযি.-এর ঘরে ঢুকে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখল যে, তেমন কিছু নেই। তাই জিজ্ঞেস করল, আপনার ঘরের আসবাবপত্র কোথায়?
আবু জর গিফারী রাযি. উত্তর দেন

إِنَّ لَنَا بَيْتًا نُوَجِّهُ إِلَيْهِ صَالِحَ مَتَاعِنَا

আমাদের একটি ঘর (জান্নাতে) আছে, ভালো ভালো আসবাবপত্র সেখানে পাঠিয়ে দেই।
লোকটি বলল, যতদিন এই ঘরে আছেন, ততদিনের জন্য হলেও তো এখানে কিছু রেখে দেয়া দরকার।
তিনি উত্তর দেন

إِنَّ صَاحِبَ الْمَنْزِلِ لَا يَدَعُنَا فِيهِ

ঘরের মালিক তো এখানে আমাদেরকে থাকতে দিবে না। (ইবনু আবিদ্দুনয়া, আযযুহদ : ১২৭)
এই হল তাঁদের মাঝে আর আমাদের মাঝে পার্থক্য। আমরা সব কিছু বস্তুর ভেতরে খুঁজি। বস্তুবাদ আর জড়বাদ আমাদের জীবনকে এমনভাবে গ্রাস করে নিয়েছে, আমরা এখন পেট আর চ্যাট তথা যৌনতা ছাড়া কিছু বুঝিনা! আমরা নিজেকে মনে করি টাকশাল বা টাকার মেশিন। টাকা বানাও, বাড়ি কর, গাড়ি কর এই হল আমাদের জীবনের এইম।

বোঝার চেষ্টা করুন
মনে করুন, হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে গেলেন, কিন্তু মৃত্যুকে ঠেকিয়ে দিতে পারবেন? এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার গল্প ফুরিয়ে যাওয়ার পর ফকিরের জন্য যে মাটির সাড়ে তিন হাত ঘর; ধনীর জন্যও তো মাটির সে-ই সাড়ে তিন হাত ঘর!
সুতরাং ভাই! দুনিয়ার হাকিকত বুঝুন। আখেরাতের হাকিকত বুঝুন। দুনিয়ার ৬০/৭০ বছরের জীবন আখেরাতের অনন্ত অসীম কালের তুলনায় এক বিকেলে বসে এক কাপ চা পান করার সমপরিমাণও নয়!
বোঝার চেষ্টা করুন, দুনিয়া তুচ্ছ, আখেরাত শ্রেষ্ঠ। দুনিয়া অতি ক্ষুদ্র, আখেরাত সুবিশাল। দুনিয়া নোংরা, আখেরাত নির্মল। দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী, আখেরাত চিরস্থায়ী। জীবনের কোনো পর্বই এখানে স্থায়ী নয়। এ জীবন একটি মায়াজাল। যেখানে আটকে পড়ে মানুষ প্রকৃত জীবনকে ভুলে যায়। আখেরাতের সোনালী পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দ্রুত বোঝার তাওফীক দান করুন আমীন।

তাহাজ্জুদে ওঠার কিছু রূহানী-টিপস
যাই হোক, আলোচনা চলছিল, তাহাজ্জুদ সম্পর্কে। এই পর্যায়ে রাতের শেষ প্রহরে যারা তাহাজ্জুদ আদায়ের জন্য ওঠতে চান তাদের উদ্দেশে কিছু রূহানী-টিপস বলে দিচ্ছি। আল্লাহ আমাকেও আমল করার তাওফীক দান করুন আমীন।

১. পাকাপোক্ত নিয়ত ও হিম্মত করুন
আপনার নিয়ত ও হিম্মত পাকাপোক্ত এটা আপনার আচরণে প্রকাশ পেতে হবে। এক লোক কক্সবাজার যাওয়ার ইচ্ছা করেছে, কিন্তু ব্যাগ গোছাচ্ছে না, তাহলে এই ইচ্ছার দাম নেই। অনুরূপভাবে আপনি তাহাজ্জুদের নিয়ত করেছেন, কিন্তু রাতের ১২—০১ টা পর্যন্ত ফেসবুক নিয়ে বসে থাকেন, তাহলে এই নিয়তেরও কোনো মূল্য নেই।
হাফেজ ইবনুল কাইয়িম রহ. বলেন

على قدرنية العَبْد وهمته ورغبته يكون توفيقه سُبْحَانَهُ وإعانته

বান্দার নিয়ত হিম্মত ও আগ্রহ অনুপাতে আল্লাহ তাআলার তাওফীক ও সাহায্য আসে।

কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী রহ.-এর জানাযা
এক্ষেত্রে অনেকে ব্যস্ততার অজুহাত তোলে। আসলে ব্যস্ততা কোনো অজুহাত হতে পারে না। আপনি তো রাজা—বাদশাহদের বেশি ব্যস্ত নয়। ইতিহাসে এমন রাজা-বাদশাহও পাওয়া যায়, ব্যস্ততা তাদের তাহাজ্জুদ কেড়ে নিতে পারে নি।
হযরত কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী রহ. ইন্তেকাল করলেন। বিশাল মাঠে জানাযার আয়োজন করা হল। জানাযার সময় হলে একজন ঘোষক ঘোষণা করলেন, হযরত বখতিয়ার কাকী রহ. ইন্তেকালের পূর্বে আমাকে অসিয়ত করে গেছেন,যার মাঝে চারটি গুণ থাকবে তিনি যেন বখতিয়ার কাকী রহ. এর জানাযা পড়ান। গুণ চারটি হলো
১. যার জীবনে কোনোদিন তাকবীরে উলা ছোটে নি।
২. যার কোনোদিন তাহাজ্জুদ কাযা হয় নি।
৩. যে কোনোদিন গায়রে মাহরামের দিকে বদনজরে তাকান নি ।
৪. এমন ইবাদতগুযার, যার কোনোদিন আসরের সুন্নতও ছোটে নি।
একথা শোনার পর পুরো মাঠে নিরবতা ছেয়ে গেলো। সবাই নিস্তব্ধ। কে আছেন এমন? এভাবেই কেটে গেলো বেশ কিছুক্ষণ। এরপর ভীড় ঠেলে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এলেন একজন। সবার দৃষ্টি তাঁর দিকে। ধীরে ধীরে জানাযার দিকে এগিয়ে এলেন। লাশের মুখ থেকে চাদর সরিয়ে বললেন, কুতুবুদ্দীন! তুমি নিজে তো চলে গেলে কিন্তু। আমাকে অপদস্ত করে গেলে। তারপর তিনি জনসম্মুখে আল্লাহ তাআলাকে সাক্ষী রেখে কসম খেয়ে বললেন, আমার মাঝে এই চারটি গুণ আছে। জনতা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো। আরে!! ইনি কে? তিনি আর কেউ নয়। তিনি হলেন তৎকালীন বাদশাহ শামসুদ্দীন আলতামাশ রহ.।
সুবহানাল্লাহ! একজন বাদশাহ যদি নিজের সকল ব্যস্ততা সত্বেও এমন আবেদের জীবন যাপন করতে পারেন। তাহলে আমরা যারা বিভিন্ন চাকরি বা ব্যবসা কিংবা অন্য কোনো পেশায় নিয়োজিত, আমরা কি পারি না এভাবে নিজেকে ইবাদতে ব্যস্ত রাখতে!
সুতরাং মূল বিষয় হল, নিয়ত ও হিম্মত। নিয়ত ও হিম্মত করুন, আল্লাহ আপনাকে তাওফীক দিয়ে দিবেন।

২. ইখলাস ধরে রাখার চেষ্টা করুন
ইখলাস থাকলে ওই আমল আল্লাহ তাআলা কবুল করে নেন। আর কবুল হওয়ার অন্যতম আলামত হল, আমলটা নিয়মিত করার তাওফীক হওয়া। সুতরাং ইখলাস ধরে রাখার চেষ্টা করুন। সালফে সালেহীন নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়তেন। কেননা, তাঁদের ইখলাস ছিল, তাই আল্লাহ তাআলা তাঁদেরকে নিয়মিত পড়ার তাওফীক দিয়ে দিতেন।
এক ব্যক্তি সাহাবী তামীম ইবনু আওস আদদারী রাযি.-কে জিজ্ঞেস করল

كَيْفَ صَلَاتُكَ بِاللَّيْلِ ؟

আপনার রাতের নামায কেমন?
এটা শুনে তিনি ভীষণ রাগ করলেন এবং বললেন

وَاللَّهِ لَرَكْعَةٌ أُصَلِّيهَا فِي جَوْفِ اللَّيْلِ فِي السِّرِّ أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ أَنْ أُصَلِّيَ اللَّيْلَ كُلَّهُ ثُمَّ أَقُصَّهُ عَلَى النَّاسِ

আল্লাহর কসম! সারা রাত নামায পড়ে মানুষের কাছে বলে বেড়ানোর চেয়ে আমার কাছে অধিক প্রিয় হল, নির্জনে গভীর রাতে এক রাকাত নামায পড়া। (আহমদ ইবনু হাম্বল, আযযুহদ ১/১৬৩)

আমাদের অবস্থা
আমাদের অবস্থা তো হল, যদি এক-দুই দিন তাহাজ্জুদ পড়ার সুযোগ হয়, নিজেকে আল্লাহর অলি ভাবা শুরু করি। আরবী ভাষায় একটা প্রবাদ আছে

صلي الحائك ركعتينِ فانتظر الوحي

তাঁতি দুই রাকাত নামায পড়ে অহির অপেক্ষায় বসে আছে।
আমাদের অবস্থাও এই তাঁতির মত। এক-দুই বার তাহাজ্জুদ পড়ার সুযোগ হলে তা মানুষের কাছে বলে বেড়ানো শুরু করি। অনেক সময় তো এভাবেও বলি, এত তাহাজ্জুদ পড়ি, কই আল্লাহ তো দোয়া কবুল করেন না।
এমনটি করবেন না। এটা আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি গোস্তাখি। এই ধরণের আচরণের কারণে ইবাদতের তাওফীক ছিনিয়ে নেয়া হয়।

৩. তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ুন
যাতে একদিকে আপনার ঘুমও পূর্ণ হয়, অন্যদিকে যথাসময়ে তাহাজ্জুদের জন্য উঠতেও পারেন। দ্রুত ঘুমালে তাহাজ্জুদ ও ফজরের শক্তি সঞ্চয় হয়।
ইসলামের শিক্ষা মূলত এটা যে, ঈশা নামাযের পরপরই ঘুমাতে যাওয়া। দেরিতে ঘুমানোর অনুমতি আছে শুধু তাদের জন্য যারা ইলম শিখতে চায়। এটা সুন্নাত। সুতরাং এই সুন্নাত মেনে চলুন। ইনশাআল্লাহ, তাহাজ্জুদে ওঠার তাওফীক হয়ে যাবে।

৪. ঘুমের আদবগুলো রক্ষা করুন
ঘুমাতে যাওয়ার আগে ঘুমের আদবগুলো রক্ষা করুন। যেমন অজুসহ ঘুমাতে যাওয়া এবং ঘুমের দোয়া পাঠ করা। যদি আপনি পবিত্র অবস্থায় ঘুমাতে যান, তবে ফেরেশতারা আপনার ঘুম থেকে জাগার আগ পর্যন্ত আপনার জন্য দোয়া করতে থাকবে।
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর একটি সুন্নত হলো রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে দু হাতের তালুতে সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক এবং সুরা নাস পাঠ করা। ঘুমাতে যাওয়ার আগে এসব সুন্নত পালন করা ভালো। এ ছাড়া আয়াতুল কুরসি এবং ঘুমের দোয়াগুলো পড়ে ঘুমকেও ইবাদতে পূর্ণ করা যায় ।

৫. সূরা বাক্বারার শেষ দুই আয়াত পড়ুন
রাতের বেলা ঘুমানোর পূর্বে সূরা বাক্বারার শেষ দুই আয়াত তেলাওয়াত করলে তাহাজ্জুদে ওঠার শক্তি সঞ্চয় হয়।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন

مَنْ قَرَأَ بِالآيَتَيْنِ مِنْ آخِرِ سُورَةِ الْبَقَرَةِ فِي لَيْلَةٍ كَفَتَاهُ

সূরা বাক্বারার শেষ দুটি আয়াত এমন যে, যে ব্যক্তি কোন রাতে ঐ দু’টি পড়বে তা তার সে রাতের জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে। (বুখারী : ৫০০৯)

৬. সূরা কাহফের শেষ চার আয়াত পড়ুন
ওলামায়ে কেরাম বলেছেন, রাতের বেলা ঘুমানোর আগে সূরা কাহফের শেষ চার আয়াত পড়ে নিলে সে মনে মনে যতটা বাজে ওঠার ইচ্ছা করবে, আল্লাহ তাকে ঠিক ততটা বাজে জাগিয়ে দিবেন। এটাও পরীক্ষিত একটি আমল।

৭. আল্লাহর কাছে খুব কাঁদুন
যদি নিয়ত ও হিম্মত করার পরেও তাহাজ্জুদে ওঠতে না পারেন, তাহলে পরের দিন আল্লাহর কাছে খুব কাঁদুন। দেখবেন, এটা অনেক কাজে দিবে।
আল্লাহ তাআলার দরবারে এভাবে কাঁদুন যে, ওগো আল্লাহ! আমি বুঝি এত অপ্রিয় হয়ে গেলাম যে, আপনি আমাকে আপনার সঙ্গে একান্তে মিলিত হওয়ার তাওফীক দিচ্ছেন না! ওগো আল্লাহ! আপনাকে মহব্বত করার উপযুক্ত আমাকে বানিয়ে দেন। ওগো আল্লাহ! আমাকে তাহাজ্জুদ পড়ার তাওফীক দিয়ে দেন।
বিশেষ করে এই দোয়াটি করবেন

اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ، وَالْعَجْزِ وَالْكَسَلِ، وَالْبُخْلِ وَالْجُبْنِ، وَضَلَعِ الدَّيْنِ وَغَلَبَةِ الرِّجَالِ

হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি আপনার আশ্রয় নিচ্ছি দুশ্চিন্তা ও দুঃখ থেকে, অপারগতা ও অলসতা থেকে, কৃপণতা ও ভীরুতা থেকে, ঋণের ভার ও মানুষদের দমন-পীড়ন থেকে।  (বুখারী : ২৮৯৩)

মুয়াবিয়া রাযি.-এর ঘটনা
শাইখুল ইসলাম তাকী উসমানী দা. বা. বলেছেন, মুয়াবিয়া রাযি.-এর একদিন তাহাজ্জুদ ছুটে গিয়েছিল। তাই পরের দিন আল্লাহ্র কাছে এমনভাবে কান্নাকাটি করেছিলেন যে, তাহাজ্জুদ পড়লে যে ফযিলত পেতেন, আল্লাহ তাঁর চেয়ে অনেক বেশি ফযিলত দিয়ে দিলেন।
পরের দিন তাহাজ্জুদের সময় ইবলিশ এসে তাঁকে ঘুম থেকে জাগাচ্ছিল। তিনি ইবলিশের হাত ধরে ফেললেন। জিজ্ঞেস করলেন, কে তুমি?
সে বলল, আমি ইবলিশ। গত কাল আপনাকে ধোঁকা দিয়েছিলাম। তাহাজ্জুদ পড়তে পারেননি। কিন্তু আপনি এমন কান্নাকাটি করলেন আল্লাহ আপনাকে তাহাজ্জুদের চেয়ে অনেক বেশি সওয়াব দিয়ে দিয়েছেন। তাই ভেবে দেখলাম, লস প্রজেক্টে হাত দিয়েছি। ভাবলাম, আপনি তাহাজ্জুদ পড়েন এটাই বরং ভাল।
সুতরাং বোঝা গেল, তাহাজ্জুদ ছুটে গেলে আল্লাহর নিকট অনুতপ্ত হয়ে পরের দিন কান্নাকাটি করলে শয়তান দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে আল্লাহ তাআলার তাওফীকে তাহাজ্জুদ আদায়ের সুযোগ হয়ে যায় ।
পরিশেষে দোয়া করি, আল্লাহ আমাদেরকে শেষ রাতে ওঠার অভ্যাস দান করুন। তাঁর দরবারে অধিকহারে রোনাযারি, কান্নাকাটি ও ইসতিগফার করার তাওফীক দান করুন। তাঁর নৈকট্য ও মাগফিরাত লাভ করার তাওফীক দান করুন আমীন।

وَآخِرُ دَعْوَانَا اَنِ الْحَمْدُ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ