খুতুবাত

খুতুবাত

শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী

গোপন গুনাহর চিকিৎসা

গোপন গুনাহর চিকিৎসা

বয়ান-১ : গোপন গুনাহর চিকিৎসা

اَلْحَمْدُ لِلّهِ وَكَفَى وَسَلَامٌ عَلَى عِبَادِهِ الَّذِيْن َاصْطَفَى اَمَّا بَعْدُ! فَاَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ. بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ. وَالْحَافِظِينَ فُرُوجَهُمْ وَالْحَافِظَاتِ وَالذَّاكِرِينَ اللَّهَ كَثِيرًا وَالذَّاكِرَاتِ أَعَدَّ اللَّهُ لَهُم مَّغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا. بارك الله لنا ولكم في القرآن  العظيم ونفعني وإياكم بما فيه من الآيات والذكر الحكيم وجعلني وإياكم من الصالحين. أقول قولي هذا وأستغفر الله لي ولكم فاستغفروه إنه هو الغفور الرحيم. اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّعَلَى الِ سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّبَارِكْ وَسَلِّمْ

নিজেদের সংশোধন করার উদ্দেশ্যে, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে তিনি আমাদেরকে এখানে জমায়েত হওয়ার তাওফিক দান করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ।

দীনের অন্যতম সৌন্দর্য্য

সুপ্রিয় শ্রোতা! আমাদের এই দীনের অন্যতম সৌন্দর্য্য হল, পবিত্র জীবন যাপন করা, ব্যভিচারমুক্ত জীবন যাপন করা। আবু সুফিয়ান তখনও মুসলিম হন নি, গিয়েছিলেন তৎকালীন পরাশক্তি হিরাক্লিয়াসের দরবারে। হিরাক্লিয়াস জিজ্ঞেস করেছিল, আরবের নবী তোমাদেরকে কী শেখায়? আবু সুফিয়ান উত্তর দিয়েছিল,

يَأْمُرُنَا بِالصَّلَاةِ وَالصَّدَقَةِ وَالْعَفَافِ وَالصِّلَةِ

তিনি আমাদেরকে নির্দেশ দেন নামাযের, সদকার। আর নির্দেশ দেন, পবিত্র জীবন যাপনের, ব্যভিচারমুক্ত জীবন যাপনের এবং আত্নীয়তদের সঙ্গে সদ্ব্যহারের। (বুখারী ৫৫৪৯)

দেখুন, এই দীন যখন এসেছে তখন একজন অমুসলিমও মনে করত যে, ব্যভিচারমুক্ত জীবন যাপন-এই দীনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এজন্য রাসুলুল্লাহ বলেছেন,

إِنَّ لِكُلِّ دِينٍ خُلُقًا وَخُلُقُ الإِسْلاَمِ الْحَيَاءُ

নিশ্চয় প্রত্যেক ধর্মের আলাদা সভ্যতা রয়েছে। আর ইসলামের সভ্যতা হল, লজ্জা। (ইবনু মাজাহ ৪১৮১)

অপর হাদিসে তিনি বলেন, বরং بَلْ هُوَ الدِّينُ كُلُّهُ দীনের পুরাটাই হল, লজ্জা।  (মাকারিমুল আখলাক ৮৩)

আপনার প্রতি জিজ্ঞাসা

মা-শা-আল্লাহ, আমরা এখানে যারা এসেছি, প্রায় সকলেই সুলুকের সঙ্গে সম্পর্ক রাখি। আমার ধারণা মতে আজকের এই মজলিসের প্রায় সকলেই তাহাজ্জুদ, মোরাকাবা, মোশাহাদা, মুজাহাদা, যিকর ও শোগলের সঙ্গে কিছুটা হলেও পরিচিত।  তাই আপনাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, এই পরিবেশে ব্যভিচার সম্পর্কে ওয়াজের দরকার কী? আমরা তো এই গুনাহয় লিপ্ত নই। তাহলে আপনার প্রতি আমার জিজ্ঞাসা- আপনি কি পরনারীর প্রতি কুদৃষ্টি দানে অভ্যস্ত? ইমো, ম্যাসেঞ্জার ইত্যাদিতে অবৈধ চ্যাটিং করেন কিনা? গান শুনতে ভালো লাগে কিনা? পরনারী দেখলে মন ইতিউতি করে কিনা? সিরিয়াল, হিন্দি ফ্লিম কিংবা আরও বিশ্রী কিছুর প্রতি আপনি আসক্ত কিনা? আপনি গোপন গুনাহ যেমন, মাস্টারবেশন (হস্তমৈথুন) বা পর্ণ মুভি দেখায় অভ্যস্ত কিনা? বন্ধু-বান্ধবের আড্ডায় সেক্স্যুয়াল আলোচনা আপনার ভালো লাগে কিনা? অবৈধ প্রেমে জড়িয়ে আছেন কিনা? মেয়েদের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিতে আপনার ভাল লাগে কিনা?

আর মাস্তুরাতের মজলিসে যারা আছেন তাঁদের প্রতি অতিরিক্ত আরো কিছু জিজ্ঞাসা- আপনি কি বেপর্দায় অভ্যস্ত?  আপনার বয়ফ্রেন্ড আছে কিনা? পরপুরুষ দেখার পর আপনার মনে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় কিনা? সাজগোজ করে রাস্তায়, মার্কেটে, অফিসে কিংবা বেড়ানোর উদ্দেশে আপনি বের হন কিনা? হিন্দি সিরিয়ালের নেশা আপনার আছে কিনা? দেবর বা কাজিনদের সামনে আপনি নির্বিঘ্নে চলে আসেন কিনা?

উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, তাহলে…

এসব প্রশ্নের উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, তাহলে এর অর্থ হল, আপনি ব্যভিচারে লিপ্ত। কেননা আপনার আমার নবী বলেছেন,

الْعَيْنَانِ زِنَاهُمَا النَّظَرُ، وَالْأُذُنَانِ زِنَاهُمَا الِاسْتِمَاعُ، وَاللِّسَانُ زِنَاهُ الْكَلَامُ، وَالْيَدُ زِنَاهَا الْبَطْشُ، وَالرِّجْلُ زِنَاهَا الْخُطَا، وَالْقَلْبُ يَهْوَى وَيَتَمَنَّى، وَيُصَدِّقُ ذَلِكَ الْفَرْجُ أَوْ يُكَذِّبُهُ

দুই চোখের ব্যভিচার হল হারাম দৃষ্টি দেয়া, দুই কানের ব্যভিচার হল পরনারীর কণ্ঠস্বর শোনা, যবানের ব্যভিচার হল অশোভন উক্তি, হাতের ব্যভিচার হল পরনারী স্পর্শ করা, পায়ের ব্যভিচার হল গুনাহর কাজের দিকে পা বাড়ান, অন্তরের ব্যভিচার হল কামনা-বাসনা আর গুপ্তাঙ্গঁ তা সত্য অথবা মিথ্যায় পরিণত করে। (মেশকাত খন্ড : ১, পৃষ্ঠা : ৩২)

আল্লাহর বান্দারা আমাদের কাছে অভিযোগ করেন, ইবাদতে মন বসে না, গুনাহ ভালো লাগে ইত্যাদি। আসলে বৃষ্টি শরীরকে ভিজিয়ে দেয়, রোদ শরীর থেকে ঘাম বের করে আনে। অনুরুপভাবে এসব বিচিত্র ব্যভিচারের কিছু অনিবার্য ফলাফল আছে। তাহল, নামাযে মনোযোগ না বসা, জায়নামাযে বেশি সময় থাকতে না পারা, নেক কাজ ভালো না লাগা, অন্যান্য গুনাহর প্রতি উত্যুঙ্গ আগ্রহ সৃষ্টি হওয়া ইত্যাদি।

যাই হোক, আশা করি, এতক্ষণে আমরা অনুধাবন করতে পেরেছি যে, এ গুনাহ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত আমরা কেউ নই; বরং কোন না কোনভাবে আমরা গুনাহটির সঙ্গে জড়িত।

গুনাহটির মূল কারণ

আল্লাহর বান্দা! গুনাহটির মূল কারণ তো হল, অন্তরে আল্লাহর ভয় না থাকা, আল্লাহর প্রতি মহব্বত না থাকা। তাঁর সামনে উপস্থিতির লজ্জা অন্তরে না থাকা।

পরনারীকে ‘খালাম্মা’ কিংবা ‘বোন’ বলছি, আর অন্তরে রাখছি ভিন্ন চিন্তা! কাজের মেয়েকে মা বলে ডাক দিচ্ছি অথচ অন্তরে লুকিয়ে আছে ভিন্ন কল্পনা! এমনও দেখা যায়, স্কুল ছুটি হলে বুড়ো মিয়া স্কুলের মেয়েদের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে! এক পা কবরে চলে গেছে এখনও খবর শোনার আড়ালে অন্তরে লালন করে পরনারীর প্রতি নেশা! এগুলো কি আল্লাহর সামনে উপস্থিতির লজ্জা অন্তরে না থাকার আলামত নয়? আল্লাহ তো বলেছেন,

يَعْلَمُ خَائِنَةَ الْأَعْيُنِ وَمَا تُخْفِي الصُّدُورُ

চোখের চুরি এবং অন্তরের গোপন বিষয় তিনি জানেন।  (সুরা মু’মিন ১৯)

রাসুলুল্লাহ বলেছেন,

إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ إِذَا أَرَادَ أَنْ يُهْلِكَ عَبْدًا، نَزَعَ مِنْهُ الْحَيَاءَ

আল্লাহ যখন কোন বান্দাকে ধ্বংস করতে চান, তার থেকে লজ্জা তুলে নেন। (ইবনু মাজাহ ৪০৫৪)

এজন্য আল্লাহর এক আরেফ বলেন,

فَاستَـحْيِ مِن نَظرِ الإِلَهِ وَقُل لَـهَا — إِنَّ الَّذِي خَلَقَ الظَّلَامَ يَـرَانِـي

লজ্জা কর রবের দৃষ্টিকে। নফসকে বল, যিনি অন্ধকার সৃষ্টি করেছেন, তিনি আমাকে দেখেন।

যৌবন সকলের আছে

মুহতারাম উপস্থিতি, মূলত যৌবন সকলের আছে। দেখুন, রাসুলুল্লাহ ﷺ যেমনিভাবে যুবকদের ব্যাপারে বলেছেন,

يَا شَبَابَ قُرَيْشٍ ، احْفَظُوا فُرُوجَكُمْ وَلا تَزْنُوا ، أَلا مَنْ حَفِظَ فَرْجَهُ فَلَهُ الْجَنَّةُ

হে কুরাইশের যুবকেরা! তোমরা লজ্জাস্থান হেফাজত কর এবং ব্যভিচার করো না। মনে রেখ, যে ব্যক্তি লজ্জাস্থান হেফাজত করবে তার জন্য রয়েছে জান্নাত। (বাইহাকি ৫০১৫)

অনুরূপভাবে বৃদ্ধদের ব্যাপারেও তিনি বলেছেন,

ثَلَاثَةٌ لَا يُكَلِّمُهُمُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ، وَلَا يُزَكِّيهِمْ ، وَلَا يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ ، وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ ، شَيْخٌ زَانٍ ، وَمَلِكٌ كَذَّابٌ ، وَعَائِلٌ مُسْتَكْبِرٌ

তিন শ্রেণীর লোকের সঙ্গে আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন কথা বলবেন না। তাদের তিনি পবিত্রও করবেন না। তাদের দিকে তাকাবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। তারা হচ্ছে- ১. বৃদ্ধ ব্যভিচারী ২. মিথ্যাবাদী শাসক এবং ৩. অহঙ্কারী দরিদ্র ব্যক্তি। (মুসলিম ১৫৯)

অন্যথায় বৃদ্ধ লোকটির নাটক-সিনেমার প্রতি এত আসক্তি কেন! কেন সংবাদ দেখার বাহানায় টেলিভিশন থেকে মুখ ফেরাতে চায় না! কেন স্কুল ছুটি হলে দোকানের ব্যাঞ্চে বসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে! তাছাড়া বুড়ার জন্য বুড়িও তো আছে!

উম্মতের প্রতি রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর উইশ

এজন্য রাসুলুল্লাহ ﷺ উম্মতের প্রতি উইশ ব্যক্ত করেছেন, তিনি উম্মতের সকলের কামনা করেছেন তারা যেন ব্যভিচার থেকে দূরে থাকে। তিনি বলেন,

مَنْ يَضْمَنْ لِي مَا بَيْنَ لَحْيَيْهِ وَمَا بَيْنَ رِجْلَيْهِ أَضْمَنُ لَهُ الْجَنَّةَ

কে এই অঙ্গীকার করবে যে, সে তার দুই চোয়ালের মধ্যস্থিত বস্ত্তর এবং তার দু’পায়ের মধ্যস্থিত বস্ত্তর জিম্মাদার হবে? তবে আমি তার জন্য জান্নাতের জিম্মাদার হব। (বুখারী ৬১৩৬ )

যৌবন সম্পর্কে পুরুষদের চাইতে নারীরা বেশি সতর্ক থাকতে হয় কেন?

পবিত্র জীবন তথা ব্যভিচারমুক্ত জীবন যাপনের প্রচেষ্টা পুরুষদের চাইতে নারীদের মাঝে এক্টু বেশি থাকতে হয়। কেননা, নারী সাধারণত এক্টু সহজ-সরল হয়। মনে করে, অমুক আমাকে তো মেয়ে হিসেবে দেখে। ছেলেটা তো আমাকে খালা ডাকে। লোকটি তো আমাকে বোন ভাবে। এই জাতীয় ভাবনার কারণে পরপুরুষের সামনে অনায়াসে চলে যায়। কিন্তু সে তো জানেনা, ওই পুরুষটি যে তাকে এই পবিত্র শব্দগুলোর আড়ালে মনে মনে ভোগ করে যায়। দুনিয়ার চোখে সে সাদা মানুষ থাকে, কিন্তু অন্তরে লুকিয়ে রাখে ব্যভিচার। আমাদের শায়খের ভাষায়; বাহ্যিক দৃষ্টিতে ‘বান্দা’,কিন্তু অন্তর অনেক ‘গান্দা’। গান্দা মানে দুর্গন্ধময়।

তাছাড়া একজন নারী বেপর্দায় চললে বহু পুরুষের গুনাহর ‘কারণ’ সে হয়। যেমন ধরুন, একজন নারী বাসা থেকে বের হল। গেল আধা মাইল। যাওয়ার পথে তার প্রতি একশ’ পুরুষ কুদৃষ্টি দিল। তাহলে এর অর্থ হল, সে একজন। তবে তার কারণে চোখের ব্যভিচার ও মনের ব্যভিচারে লিপ্ত হল একশ’ জন। এভাবে একশ’ পুরুষ গোপন গুনাহ করে নিল শুধু তার কারণে।

এই জন্য যে নারী বেপর্দায় চলে তার ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ ﷺ দুই বার বলেছেন, সে এমন, সে এমন অর্থাৎ সে ব্যভিচারিণী। রাসুলুল্লাহ ﷺ -এর ভাষায়-

كُلُّ عَيْنٍ زَانِيَةٌ ، وَالْمَرْأَةُ إِذَا اسْتَعْطَرَتْ فَمَرَّتْ بِالْمَجْلِسِ فَهِيَ كَذَا وَكَذَا

প্রতিটি চোখ ব্যভিচারী। কোন মহিলা যদি পারফিউম লাগিয়ে কোন মজলিসের পাশ দিয়ে যায় তবে সে এমন, সে এমন অর্থাৎ ব্যভিচারিণী। (তিরমিযী ২৭৮৬)

তাহলে বুঝা গেল, ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার বিষয়টি থেকে সতর্ক থাকার গুরুত্ব পুরুষদের চাইতে নারীদের জন্য বেশি জরুরি।

নারীদের কাছ থেকে আলাদা বাইয়াত

আর এই জন্য রাসুলুল্লাহ ﷺ -কে আল্লাহ তাআলা আলাদাভাবে নির্দেশ দিয়েছেন যে, আপনি নারীদের কাছ থেকে বাইয়াত গ্রহণ করুন, তারা যেন ব্যভিচার না করে। এমনিতে তো রাসুলুল্লাহ নারীপুরুষ সকলের কাছ থেকে বাইয়াত গ্রহণ করতেন। বাইয়াত মানে কমিটম্যান্ট বা অঙ্গীকার। তিনি কখনও বাইয়াত নিতেন এ মর্মে যে, শিরক করা যাবে না, নামায কায়েম করবে ইত্যাদি। এভাবে তিনি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বাইয়াত নিতেন। পুরুষদের কাছ থেকে নিতেন আর পর্দার আড়াল থেকে নারীদের কাছ থেকেও নিতেন। কিন্তু আল্লাহ তাআলা বলেন, আপনি স্বতন্ত্রভাবে নারীদের কাছ থেকে বাইয়াত নিন যে, তারা যেন ব্যভিচার না করে। আল্লাহ বলেন,

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِذَا جَاءَكَ الْمُؤْمِنَاتُ يُبَايِعْنَكَ عَلَىٰ أَن لَّا يُشْرِكْنَ بِاللَّهِ شَيْئًا وَلَا يَسْرِقْنَ وَلَا يَزْنِينَ وَلَا يَقْتُلْنَ أَوْلَادَهُنَّ

হে নবী, ঈমানদার নারীরা যেন আপনার কাছে এসে আনুগত্যের বাইয়াত নেয় যে, তারা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না। (সূরা মুমতাহিনা ১২)

লজ্জাবতী নারীর প্রশংসা আল্লাহ নিজে করেছেন

লজ্জা তো থাকবে নারীপুরুষ সকলের মাঝে। কিন্তু নারীর মাঝে এটা থাকতে হয় আরো বেশি পরিমাণে। এজন্যই তো বলা হয়, লজ্জা নারীর ভূষণ। যার কারণে এক লজ্জাবতী নারীর প্রশংসা আল্লাহ কোরআন মজিদে করেছেন। পক্ষান্তরে আল্লাহ পুরুষদের জন্য এরকম স্বতন্ত্র প্রশংসা করেন নি। হযরত শোয়াইব আ. এর দুই মেয়ে ছিল। তাদের একজনকে তিনি মুসা আ. এর নিকট কোনো এক কাজে পাঠিয়েছিলেন। তখন আসা-যাওয়ার মধ্যে তার লজ্জা এতটাই ছিল যে, আল্লাহ প্রশংসা করে বলেন,

فَجَاءَتْهُ إِحْدَاهُمَا تَمْشِي عَلَى اسْتِحْيَاءٍ قَالَتْ إِنَّ أَبِي يَدْعُوكَ

বালিকাদ্বয়ের একজন লজ্জাজড়িত পা ফেলে ফেলে তার কাছে আগমন করল। বলল, আমার পিতা আপনাকে ডাকছেন। (সূরা কাসাস ২৫)

মুফাসসিরে কেরাম লিখেছেন, যে নারী পর্দার সাথে চলবে, আপাদমস্তক লজ্জাবতী হবে তার জন্যও এ প্রশংসা প্রযোজ্য হবে। মা-বোনেরা, একটু ভাবুন তো, আপনার প্রশংসা যদি আরশ থেকে হয়, তখন না জানি আল্লাহ আপনার মাকাম কোথায় রেখেছেন!

ব্যভিচারের অন্যতম কারণসমূহ

সম্মানিত দীনি ভাই ও বোনেরা, ব্যভিচার সাধারণত তিনটি কারণে হয়। আমরা এখন সেই কারণগুলো জানব এবং পাশাপাশি সেগুলোর প্রতিকার ও চিকিৎসা হিসেবে আমাদের মাশায়েখগণ যা বলেছেন, তা সম্পর্কেও কিছুটা শুনব। যাতে করে আমল করতে পারি। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফিক দান করুন। আমীন।

এক. কুদৃষ্টি এবং পর্দাহীনতা

ব্যভিচারের অন্যতম কারণ পুরুষদের কুদৃষ্টি এবং নারীদের পর্দাহীনতা। আল্লাহ পুরুষদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন তারা যেন দৃষ্টির হেফাজত করে। আর নারীদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন তারা যেন পর্দার সঙ্গে চলে। ‘পর্দা’ মানে নিজেকে লুকিয়ে রাখা। রাসুলুল্লাহ বলেছেন, المرأة عوْرةٌ নারী গোপন জিনিস। (তাবরানী ৩০৩৬) কোনো কোনো মুহাদ্দিস এর ব্যাখ্যায় বলেন, أي وجه المرأة عورة অর্থাৎ, নারীদের চেহারা গোপন জিনিস।

আমাদের এজাতীয় মিথ্যা দাবী

আপনি বলতে পারেন, অমুক ব্যক্তি পরনারীর সঙ্গে কথা বললে কী হবে, তার মন ভাল। আমার মেয়ে বেপর্দায় চললে কী হবে, তার মন পবিত্র। গুনাহর চিন্তা তাদের মাথায় আসে না। অথচ কোরআন ও হাদিস সামনে আনলে বুঝা যায়, আমাদের এজাতীয় দাবী মিথ্যা। কেননা, কোরআন মজিদে আল্লাহ তাআলা বলেন,

فَأَلْهَمَهَا فُجُورَهَا وَتَقْوَاهَا

অতঃপর তাকে তার অসৎকর্ম ও সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন। (সূরা শামস 8)

এ আয়াতের তাফসিরে মুফাসসিরে কেরাম লিখেন, যেহেতু মানুষকে অসৎকর্ম ও সৎকর্মের জ্ঞান দান করা হয়েছে, সেহেতু মানুষ নেক পরিবেশে নেক আমলের প্রতি আকৃষ্ট হয়। গুনাহর পরিবেশে গুনাহর প্রতি আগ্রহবোধ করে। আর কুদৃষ্টি ও পর্দাহীনতা ধীরে ধীরে দুর্ঘটনার পরিবেশ তৈরি করে। মানুষকে ধীরে ধীরে ব্যভিচারের কাছে নিয়ে যায়। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেছেন,

وَلاَ تَقْرَبُواْ الزِّنَى إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاء سَبِيلاً

তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ। (সূরা বনী ইসরাইল ৩২)

এজন্যই রাসুলুল্লাহ পুরুষদের কুদৃষ্টি সম্পর্কে বলেছেন,

اَلنَّظْرَةُ سَهْمٌ مَسْمُوْمٌ مِنْ سِهَامِ اِبْلِيْسَ

কুদৃষ্টি ইবলিসের বিষমিশ্রিত তীর। (মুসনাদুশ শিহাব ২৭৯)

আর পর্দাহীন-নারী সম্পর্কে বলেছেন,

فَاِذَا خَرَجَتْ اِسْتَشْرَفَهَا الشَّيْطَانُ

এরা যখন বের হয় শয়তান চুপিসারে এদেরকে দেখে। (তাবরানী ৩০৩৬)  যাতে পরপুরুষকে এদের মায়াজালে বন্দি করে নিতে পারে।

কুদৃষ্টি এবং পর্দাহীনতার চিকিৎসা

চিকিৎসা অনেক। আমাদের মাশায়েখগণ খুলে খুলে বলেছেন। তন্মধ্য থেকে আজ আপাতত তিনটি চিকিৎসার কথা বলছি। আল্লাহ বক্তা-শ্রোতা সকলকে আমল করার তাওফিক দিন। আমীন। হিম্মত করুন। আমরা হিম্মত করলে আল্লাহর তাওফিক আমাদের সঙ্গী হবে। মনে রাখবেন, হিম্মত ছাড়া কোনো কাজ হয় না; দুনিয়ারও না, আখেরাতেরও না। হিম্মত করে চেষ্টা শুরু করলে কাজ হবে-এটা আল্লাহ তাআলার ওয়াদা। তিনি তো আমাদেরকে প্রতিশ্রিতি দিয়ে বলেছেন,

وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا

যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করব। (সূরা আ’নকাবুত ৬৯)

১. দৃষ্টির হেফাজত করুন

দৃষ্টির হেফাজত করুন। এটি পবিত্র জীবন যাপনের জন্য কোরআনি-ব্যবস্থাপত্র। এই ব্যবস্থাপত্র কেবল পুরুষের জন্য এমনটি নয়। বরং পুরুষ-নারী উভয়ের জন্য এটি প্রযোজ্য। দেখুন, আল্লাহ তাআলা পুরুষদেরকে যেমনিভাবে বলেছেন,

قُل لِّلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ

মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাযত করে। অর্থাৎ, ব্যভিচার থেকে বেঁচে থাকে। (সূরা নূর ৩০)

এর পরের আয়াতেই তিনি অনুরূপ নির্দেশ নারিদেরকেও দিয়েছেন।

وَقُل لِّلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ

ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাযত করে। অর্থাৎ, ব্যভিচার থেকে বেঁচে থাকে। (সূরা নূর ৩১)

সুতরাং বুঝা গেল, ব্যভিচার থেকে নিজেকে রক্ষা করলে দৃষ্টির হেফাজত করতে হবে। এমন নয় যে, এটা কেবল পুরুষরা করবে; বরং নারীদের জন্য এই ব্যবস্থাপত্র সমভাবে প্রযোজ্য।

২. কয়েক মিনিট মোরাকাবা করুন

আমাদের শায়েখ মাহবুবুল ওলামা হযরত মাওলানা পীর যুলফিকার আহমদ নকশবন্দী মুজাদ্দেদী দা. বা. বলেন,  প্রত্যেক নামাযের পর দৈনিক অন্তত পাঁচ বার কিছু সময়ের জন্য- দুই থেকে পাঁচ মিনিটের জন্য আল্লাহর সান্নিধ্যের মুরাকাবা করুন। মুরাকাবা এভাবে করবেন- চোখ বন্ধ করবেন। তারপর ভাববেন, ‘আমি যেখানেই থাকি না আল্লাহ আমার সাথে আছেন।’ অথবা এই আয়াতের বিষয়বস্তু নিয়ে চিন্তা করবেন- هُوَ مَعَكُمْ اَيْنَمَا كُنْتُمْ ‘তোমরা যেখানেই তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন।’

এরপর নিজের নফসকে বুঝাবেন যে, দেখো, তুমি আল্লাহর দৃষ্টি থেকে কোনোভাবেই ভাগতে পারবে না। তুমি যখন পরনারীর প্রতি তাকাও তখনও তোমার প্রভু তোমাকে দেখেন। আর আপনি যদি নারী হন, তাহলে নফসকে বুঝাবেন যে, দেখো, তুমি আল্লাহর দৃষ্টি থেকে কোনোভাবেই পালাতে পারবে না। যখন তুমি পরপুরুষের সামনে যাও তখনও তোমার মালিক তোমাকে দেখেন। এটা তো তার মহান ধৈর্যের পরিচয় যে, তিনি তোমাকে পাকড়াও করেন না। কিন্তু তুমি যদি এভাবে চলতে থাক তবে তিনি কতকাল ধৈর্য ধরবেন! এভাবে নিয়মিত কিছুদিন করতে পারলে -ইনশা আল্লাহ- ধীরে ধীরে আল্লাহর সান্নিধ্যের সার্বক্ষণিক অনুভূতি অন্তরে বসে যাবে এবং এই রোগ থেকে বের হওয়া সহজ হয়ে যাবে।

৩. নিজেকে সাজা দিন

পুরুষ কুদৃষ্টি থেকে এবং নারী বেপর্দা থেকে বাঁচার জন্য আরেকটি চিকিৎসা হল, নিজেই নিজের জন্য সাজা নির্ধারণ করা যে, কুদৃষ্টি হয়ে গেলে আমি নিজেকে এই শাস্তি দিব এবং পরপুরুষের সামনে গেলে এই শাস্তি দিব। যেমন, নির্জনে গামছা বা ওড়না পেঁচিয়ে চাবুকের মত বানাবেন। তার তা দিয়ে নিজের পেটে বা পিঠে কয়েকটি আঘাত করুন। তারপর ভাবুন, যখন কেয়ামতের দিন ফেরেশতারা চাবুক মারবে তখন কী অবস্থা হবে? এ পদ্ধতিতে কয়েকদিনের মধ্যেই কুদৃষ্টির চিন্তা  এবং বেপর্দার  অভ্যাস খতম হয়ে যাবে-ইনশা আল্লাহ।

শাইখুল হাদিস জাকারিয়া রহ. তো কঠিন কথা বলেছেন। তিনি বলেন, যে পুরুষ পরনারীর প্রতি কুদৃষ্টি দানে অভ্যস্ত, যে নারী বেপর্দায় অভ্যস্ত তার ব্যাপারে আমাদের মাশায়েখগণের অভিজ্ঞতা হল, সে ঈমান নিয়ে মরতে পারে না।

আমাদের মাশায়েখগণ আরো বলেন, যে পুরুষ নিজেকে কুদৃষ্টি থেকে হেফাযত করতে চায়, যে নারী চায় যে, সে পর্দায় চলবে সে নিউইয়র্ক শহরেও তা পারবে। পক্ষান্তরে যে তা চায় না, সে হারাম শরীফের ভেতরেও তা পারে না। এজন্য যারা হজে গিয়েছেন, তারা দেখে থাকবেন, হারাম শরীফের মত পবিত্র স্থানেও কত নারী বেপর্দায় চলে এবং কত যুবক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদেরকে দেখে এবং সকলের সামনে মনে মনে গোপন গুনাহ করে!

দুই. নির্জন অবস্থান

প্রিয় উপস্থিতি, ব্যভিচারের দ্বিতীয় কারণ হল, নির্জন অবস্থান। কারণ, নির্জনতার সুযোগ নিয়ে শয়তান নানা ধরণের চিন্তা মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে থাকে। হ্যাঁ, ইবাদতের উদ্দেশ্যে নির্জনতা অবলম্বনে অসুবিধা নেই। কিন্তু বিনা কাজে নির্জনতা অবলম্বন মানে শয়তানকে সুযোগ করে দেয়া। এজন্য আমাদের মাশায়েখগণ বিশেষত যুবকদেরকে উপদেশ দিয়ে থাকেন, তোমরা নির্জনে অবস্থান করবে না। এমনকি তাঁরা বলে থাকেন, অবিবাহিতরা বাথরুমেও বেশি সময় কাটাবে না। গাইরে মাহরাম কারো সঙ্গে নির্জনে সময় অতিবাহিত করবে না। গাইরে মাহরামের সঙ্গে একাকী সফর করবে না।

পরিতাপের বিষয় হল, অথচ এ ব্যাপারে এমনকি দীনদার ফ্যামিলিতেও শীথিলতা দেখা দেয়। বিশেষত দেবর-ভাবী, শালী-দুলাভাই এবং কাজিনদের ক্ষেত্রে। দেবরের সঙ্গে বাবার বাড়িতে যাওয়া, ডাক্তারের কাছে যাওয়া, দুলা ভাইয়ের সঙ্গে ঘুরতে বের হওয়া, বাড়ির কাজের লোক বা মহিলা রেখে স্ত্রী স্বামীকে রেখে স্বামী স্ত্রীকে রেখে বাইরে চলে যাওয়া, টিউটর ও ছাত্রীর একান্তে নির্জনবাস ও পড়াশোনা– এসব তো এখন সাধারণ ব্যাপার হয়ে গেছে। যার কারণে এদের মাঝেই বিপর্যয় বেশি ঘটে। অথচ রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

‏ لاَ يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ إِلاَّ كَانَ ثَالِثَهُمَا الشَّيْطَانُ

কোনো পুরুষ যখন কোন স্ত্রীলোকের সঙ্গে নির্জনে সাক্ষাৎ করে তখন এদের সঙ্গে অবশ্যই তৃতীয় জন থাকে শয়তান। (তিরমিযী ১১৭২)

এ রোগের চিকিৎসা

নির্জনতার মুহূর্তে ব্যভিচারের চিন্তা আসলে তার চিকিৎসা কী? আসলে ইতিপূর্বে যে  চিকিৎসাগুলোর কথা বলা হয়েছে, সেগুলো এখানেও প্রযোজ্য। তবুও আমাদের মাশায়েখগণ এজাতীয় রোগের আরো কিছু চিকিৎসার কথা বলেছেন। সেখান থেকে আরো তিনটি বলে দিচ্ছি। আল্লাহ বক্তা-শ্রোতা সকলকে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

১. চিন্তা করুন

আল্লাহ তাআলা বলেন,

اَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِيْنَ آمَنُوْا اَنْ تَخْشَعَ قُلُوْبُهُمْ لِذِكْرِ اللهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ

‘যারা ঈমান আনে তাদের হৃদয় কি আল্লাহর স্মরণে ও যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে বিগলিত হওয়ার সময় কি আসে নি?’ (সূরা হাদীদ ১৬)

আমাদের শায়েখ ও মুর্শিদ মাহবুবুল ওলামা মাওলানা পীর যুলফিকার আহমদ নকশবন্দী মুজাদ্দেদী দা. বা. বলেন, নির্জনতার মুহূর্তে যখনই গুনাহ করতে মনে চাইবে তখনই সঙ্গে সঙ্গে আয়াতটির বিষয়বস্তু সম্পর্কে চিন্তা করবে। এরপর নিজেকে সম্বোধন করে বলবে, ‘ঈমানদারের কি এখনও আল্লাহকে ভয় করার সময় হয় নি?’ পাশাপাশি মনে মনে আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা করতে থাকো। এতে আল্লাহতাআলা নিজের ভয় তোমার অন্তরে তৈরি করে দিবেন এবং সত্যিকারের তাওবা আপনার নসিব হবে।

২. সময়ের মূল্য  দিন

শাইখুল ইসলাম মুফতি তাকী উসমানী দা. বা. বলেন, সময়কে গুনাহর মধ্য দিয়ে কাটানোর ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। কখনও অবসর সময় কাটাবে না। যখনই নির্জনে থাকবে, অবসর থাকবে তখনই নিজেকে কোনো কাজে ব্যস্ত করে নিবে। কাজটি দুনিয়ার বৈধ কাজ হলেও অসুবিধা নেই। তবুও আল্লাহর নাফরমানির ভেতর সময় নষ্ট করো না। আর যদি কাজটি হয় ভাল বই পড়া, জিকির-মোরাকাবা করা, তেলাওয়াত করা তাহলে তো সবচে’ ভাল।  তিনি বলেন, আমাদের শায়েখ ও মুর্শিদ ডা. আব্দুল  হাই আরেফী রহ. বলতেন, ‘কাজের ভেতরে কাজ ঢুকিয়ে দাও। অবসর আছো তো কোনো কাজের প্রোগ্রাম করে নাও। হাতে একটি কাজ আছে তো আরেকটি কাজের প্রোগ্রাম বানিয়ে নাও।’

দেখুন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

نِعْمَتَانِ مَغْبُونٌ فِيهِمَا كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ الصِّحَّةُ وَالْفَرَاغُ

দুটো নিয়ামত এমন যে দুটোর বিষয়ে বহু লোক ধোঁকায় নিপতিত- স্বাস্থ্য এবং অবসর। (তিরমিযী ২৩০৭)

অতএব, সময় নষ্ট করবেন না। জীবনের খণ্ড খণ্ড অংশগুলোর নামই তো সময়। সুতরাং সময় নষ্ট করা মানে জীবন নষ্ট করা। আল্লাহ আমাদেরকে আমল করার তাওফিক দিন। আমীন।

৩.পরিবেশ বেছে চলুন

এটাই সবচেয়ে বড় সতর্কতা যে, যেসব পরিবেশে ব্যভিচারের কল্পনা আসে, সেসব পরিবেশ থেকে দূরে থাকা। আমাদের শায়েখ বলেন, সবসময় মনে রাখবে, নারীরা আমাদের সাথে পর্দা করবে না, আমাদেরকেই তাদের সঙ্গে পর্দা করতে হবে। সুতরাং নিজের বাসায়ও ঢোকার সময় গলা খাঁকারি দিয়ে বা আওয়াজ করে ঢুকবেন। আল্লাহ তাআলার কাছে নিজের ঈমান বাঁচানোর বিনীত প্রার্থনা করবেন। । কবির ভাষায়-

ميں امتحان كے قابل نہيں مرے مولى

مجهے گناه كا موقع نصيب نہ كرنا

‘মাওলা আমার! আমি পরীক্ষার যোগ্য নই,

আমাকে গুনাহ করার সুযোগ দিবেন না।’

তিন. ইন্টারনেটের অপব্যবহার

মুহতারাম উপস্থিতি, আজ আমাদের নিয়ন্ত্রক আমরা নই। আমরা আজ মনস্তাত্বিকভাবে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের হাতে বন্দি। আমাদের যুবকদের হাতে তারা স্মার্ট ফোন তুলে দিয়েছে। আমাদের শায়খের ভাষায়, ‘এটা সেল ফোন নয়; হেল ফোন (hell phone)। hell অর্থ জাহান্নাম। এটা ইন্টারনেট নয়; enter net মানে জালে প্রবেশ করানো। এটা চ্যাটিং নয়; চিটিং (cheating) বা প্রতারণা।’ আমি এগুলোর সঠিক ব্যবহারের সমালোচনা করছি না। আর না এগুলোর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করছি। তবে আমি বুঝাতে চাচ্ছি, এগুলোর অপব্যবহারের ভয়াবহতা। যুবকরা আজ রাত কাটায় এসবের সঙ্গে। কখন যে রাত কেটে যায়, টেরই পায় না। ফেসবুক নিয়ে বসে, ম্যাসেঞ্জারে পরনারীর সঙ্গে চ্যাট করে, চিন্তা করে, একটু পরে ঘুমিয়ে পড়ব, এই আর অল্প কিছুক্ষণ…কিন্তু পারে না। এভাবে কখন যে রাত পলপল করে শেষ হয়ে যায়…১০ টা থেকে ১১ টা, ১১ টা থেকে ১২ টা ০১ টা ০২ টা ০৩ টা… তারপর ফজরের আযানের ডাক শুনে ঘুম থেকে উঠে না; বরং আযানের ডাক শুনে ঘুমাতে যায়। কিন্তু ঈমানদার তো, তাই মাঝে মাঝে মন খচখচও করে। কিন্তু কী করবে! পারে না। কারণ, হাতে যে শেকল। সে যে এই শিকলে বন্দী হয়ে আছে। আর এই শিকলের নাম হল, ইন্টারনেট, স্মার্ট ফোন। আর এটাই তারুণ্যকে, যুবসমাজকে ধীরে ধীরে ঠেলে দিচ্ছে নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে। আল্লাহর কাছে পানাহ চাই, এমনও শুনেছি, এখনকার যুবক-যুবতীরা নাকি এখন ইমো, ম্যাসেঞ্জার ইত্যাদির মাধ্যমেও সেক্স করে, ব্যভিচার করে!

অভিবাকদের বলছি…

এজন্য অভিবাকদের উদ্দেশ্য বলছি। আপনার সন্তান কী করে, তা একটু তদারকি করবেন। মাঝে মাঝে তার দরজার নীচে দেখবেন, গভীর রাতে তার রুম থেকে কম্পিউটারের স্ক্রিনের আলো আসে কিনা! ল্যাপটপ, মোবাইল এসবের পেছনে মাত্রারিক্ত সময় দেয় কিনা? প্রয়োজনে স্মার্ট ফোন কিনে দিতে বললে শর্ত জুড়ে দিবেন যে, ঠিক আছে, কিনে দিব তবে সেটে পাসওয়ার্ড দিতে পারবা না। তাকে বলবেন, আমি মাঝে মধ্যে তোমার সেটে কী আছে- দেখব। মনে রাখবেন, এটা গোয়েন্দাগিরি নয়। বরং এটা তরবিয়তেরই অংশ। আপনি এমনটি করবেন, আপনার সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য, তার জীবন পবিত্র হিসেবে তৈরি করার জন্য।

এ রোগের চিকিৎসা

মুহতারাম উপস্থিতি, যারা ইন্টারনেটে আসক্ত। গান, সিনেমা, সিরিয়াল ও এজাতীয় নোংরা বিষয়ের নেশায় নেশাগ্রস্থ, তাদের জন্য চিকিৎসা কী হতে পারে- আমাদের মাশায়েখগণ তাও বলে দিয়েছেন। তাছাড়া ইতিপূর্বে আমরা দুই রোগের জন্য যে ছয়টি চিকিৎসার কথা শুনেছি, সেগুলোও এখানে প্রযোজ্য। তবুও এ রোগের জন্য আরো তিনটি ব্যবস্থাপত্র দিয়ে দিচ্ছি। আল্লাহ আমাদের সকলকে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

১. মাঝে মাঝে জ্বলন্ত আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে ভাববেন…

মাঝে মাঝে গ্যাসের চুলার সামনে দাঁড়াবেন। আগুন দেখবেন। আল্লাহ বলেছেন,

أَفَرَأَيْتُمُ النَّارَ الَّتِي تُورُونَ

‘তোমরা যে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত কর, সে সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কি?’ (সূরা ওয়াকিয়া ৭১)

সুতরাং আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে ভাববেন, এই দুনিয়ার আগুনের ইন্ধন তো লাকড়ি, গ্যাস ইত্যাদি। এর উত্তাপ যদি এত বেশি হয় যে, আমি এক মিনিটও সইতে পারব না। তাহলে এই গোপন গুনাহর কারণে আমি যে নিজেকে ওই জাহান্নামের উপযুক্ত করে নিচ্ছি,

وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ

যে আগুনের ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, সেই আগুন আমি সৈহ্য করব কিভাবে! এভাবে চিন্তা করলে গোপন গুনাহর ভূত ধীরে ধীরে নেমে যাবে, ইনশা আল্লাহ।

২.মাঝে মাঝে কবর জেয়ারত করবেন

মাঝে মাঝে কবর জেয়ারত করবেন। এর দ্বারা দিল নরম হবে। গুনাহর প্রতি আকর্ষণ কমে যাবে। আমলের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাবে। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

 فَإِنَّهَا تُرِقُّ الْقَلْبَ ، وَتُدْمِعُ الْعَيْنَ ، وَتُذَكِّرُ الآخِرَةَ

কবর জিয়ারত অন্তরকে নরম করে, চোখের পানি বের করে এবং আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। (মুসতাদরাক হাকিম ১৫৩২)

৩. পরিবেশ পাল্টান

গুনাহর পরিবেশ থেকে দূরে থাকুন। গুনাহর পরিবেশ থেকে নিজেকে দূরে রাখা এটা নবীগণের একটি তরিকা। দেখুন, হযরত ইউসুফ আ. জুলাইখার কাছে ছিলেন। জুলাইখা তাঁকে গুনাহর প্রতি আহবান করেছিল। গোপন গুনাহর পরিবেশও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ইউসুফ আ. এই পরিবেশকে পছন্দ করলেন না। তিনি গুনাহর পরিবেশ -যদিও তা ছিল আরাম-আয়েশের- বর্জন করে জেলখানার পরিবেশ বেছে নিলেন। তবুও গুনাহর পরিবেশে থাকাটাকে তিনি পসন্দ করেন নি। বরং তিনি আল্লাহর কাছে এই দোয়া করেছিলেন,

رَبِّ السِّجْنُ أَحَبُّ إِلَيَّ مِمَّا يَدْعُونَنِي إِلَيْهِ

হে আমার রব! তারা আমাকে যে কাজের দিকে আহবান করে, তার চাইতে আমি কারাগারই পছন্দ করি। (সূরা ইউসুফ ৩৩)

সুতরাং আমরাও এটা করব। গুনাহর পরিবেশ থেকে নিজেকে দূরে রাখব। বাসায় টিভি ভিসিআরের পরিবেশ পাল্টিয়ে সেখানে তালিমের পরিবেশ, আমলের পরিবেশ, তেলাওয়াতের পরিবেশ, জিকির-মুরাকাবা, দোয়ার পরিবেশ গড়ে তুলব। এর কারণে দুনিয়ার কিছু মজা তো ছাড়তে হবে। কিন্তু ছাড়বেন কার জন্য? আল্লাহর জন্য। আল্লাহর জন্য গুনাহর মজা ছাড়তে পাড়লে এর পরিবর্তে তিনি ঈমানের মজা দান করবেন। আর ঈমানের মজা তো এমন মজা যার জন্য কত মানুষ তাদের জানও দিয়ে দিয়েছে। সাহাবায়ে কেরামের ইতিহাসে যার প্রমাণ হাজার হাজার আছে। হাদিসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহ তাআলা বলেন,

مَنْ تَرَكَهَا مِنْ مَخَافَتِىْ اَبْدَلْتُهُ إِيْمَاناً يَجِدُ حَلَاوَتَه فِىْ قَلْبِه

যে আমার ভয়ে এগুলো ত্যাগ করবে, আমি তার অন্তরে এমন ঈমান সৃষ্টি করব যে,  সে তার স্বাদ পাবে। (আততারগীব ওয়াততারহীব ২/৩৭)

অভিবাবকদের উদ্দেশ্যে আরেকটি কথা…

আমাদের সমাজের একটা নতুন ট্র্যান্ড হল, ছেলে মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হয়ে যাওয়ার পরেও অভিবাবকরা যথা সময়ে তাদেরকে বিয়ে-শাদি দেয় না। ফলে অবৈধ প্রেমসহ নানা ধরণের গোপন গুনাহয় তারা জড়িয়ে পড়ে। অপরদিকে বয়সও বাড়তে থাকে। পরবর্তীতে দেখা যায়, আর পাত্র বা পাত্রী খুঁজে পায় না। তখন মনে করে বসে, অমুক তাবিজ করেছে, অমুক বিয়ে বন্ধ করে রেখেছে। এভাবে গীবত, অপবাদ, বদধারণাসহ আরো কত গুনাহ তৈরি হতে থাকে। এজন্য আমার সঙ্গে যারা মহব্বত রাখেন, বিশেষত তাদের প্রতি জোরালো তাগিদ দিচ্ছি যে, ছেলে মেয়ে বিশেষ করে মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হলে বিয়ে দিয়ে দিতে দেরি করবেন না। মনে রাখবেন, আপনার এ জাতীয় উদাসীনতার কারণে যদি আপনার মেয়ে কিংবা ছেলে গোপন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে এই গুনাহর ভার আপনার উপরও পড়বে। এর জন্য আপনাকেও আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।

গোপন গুনাহর সবচেয়ে বড় ভয়াবহতা

শাইখুল হাদিস মাওলানা যাকারিয়া রহ. শাইখ আবু আব্দুল্লাহ উন্দুলুসী রহ. সম্পর্কে লিখেছেন। তিনি ছিলেন সমকালীন বিখ্যাত ওলী, মুহাদ্দিস ও কালের জগদ্বিখ্যাত মনীষীদের অন্যতম। তার সহজ পরিচয়ের জন্য এতটুকু বলাই যথেষ্ট। পৃথিবীখ্যাত ওলী হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহ. ও হযরত শিবলী রহ.-ও ছিলেন তাঁর শিষ্য। শয়তানের ধোঁকায় পড়ে এক খ্রিস্টান সুন্দরী মেয়ের প্রতি তিনি কুদৃষ্টি দিয়েছিলেন। যার সুত্র ধরে তাঁর বেলায়েত চলে গিয়েছিল। এমন কি -আল্লাহর কাছে পানাহ চাই- তাঁর ঈমানের উত্তাপও নিভে গিয়েছিল। পরবর্তীতে তাঁর হাজার হাজার মুরিদানের দোয়া ও কান্নাকাটির উসিলায় আল্লাহ তাঁকে আবার কবুল করেছিলেন। হারানো মর্যাদা ফিরে পেয়েছিলেন। বোঝা গেল, কুদৃষ্টি, বেপর্দা, গোপন গুনাহ এমন এক গুনাহ যার কারণে -আবারো আল্লাহর কাছে পানাহ চাই- ঈমান পর্যন্ত চলে যায়।

দোয়া করুন

গোপন গুনাহর কারণে ধীরে ধীরে ঈমান পর্যন্ত চলে যায়- কথাটা একজন ইমানদারের কলিজায় আগুন ধরে যাওয়ার মত কথা। এজন্য আমরা আল্লাহর কাছে এভাবে দোয়া করব–

اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الصِّحَّةَ وَالْعِفَّةَ وَالأَمَانَةَ وَحُسْنَ الْخُلُقِ وَالرِّضَا بِالْقَدَرِ

হে আল্লাহ! আপনার কাছে সুস্থতা, গুনাহমুক্ত জীবন, আমানতদারিতা, উত্তম চরিত্র ও তাকদিরের উপর সন্তুষ্টি প্রার্থনা করছি। (বাহ্রুল ফাওয়াইদ ১৫)

اللهُمَّ اقْسِمْ لَنَا مِنْ خَشْيَتِكَ مَا تُحُولُ بَيْنَنَا وَبَيْنَ مَعَاصِيكَ ، وَمَنْ طَاعَتِكَ مَا تُبَلِّغُنَا بِهِ جَنَّتَكَ

হে আল্লাহ! আপনার প্রতি এমন ভীতি আমাদেরকে দান করুন, যা আমাদের মাঝে এবং আমাদের গুনাহর মাঝে প্রতিবন্ধক হবে এবং এমন আনুগত্য দান করুন, যা আমাদেরকে জান্নাত পর্যন্ত পৌঁছাবে। (তিরমিযী ৩৫০২)

গোপন গুনাহর চিন্তা আসলে ভাবুন…

ডা. আব্দুল হাই আরেফী রহ. বলতেন, যখন গুনাহর চিন্তা মাথায় আসবে, তখন এটা চিন্তা করবে যে, গুনাহটি তুমি তোমার প্রিয়জন যেমন, তোমার মা-বাবা, উস্তাদ, শায়েখ, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে এদের সামনে করতে পারবে কিনা? যদি না পার তাহলে তারা তো এখানে উপস্থিত নেই, কিন্তু আল্লাহ তো আছেন। সুতরাং তার সামনে কিভাবে গুনাহটি করবে? তাছাড়া আল্লাহ তো বলেছেন, সুতরাং কেয়ামতের দিন আমার প্রিয়জনদের সামনে আমার গুনাহটি প্রকাশ পেয়ে গেলে তখন আমার অবস্থা কেমন হবে?

কিছু কিছু গুনাহর ক্ষেত্রে এই ভাবনাটাও বেশ কাজে আসে।

মা-বোনদের জন্য বিশেষ উপদেশ

এজন্য পরিশেষে মা-বোনদেরকে বিশেষভাবে বলছি, দয়া করে বেপর্দায় চলে আপনি একজন শত শত পুরুষের গুনাহর কারণ হবেন না। শয়তানের রশি হবেন না। হাদিসে বেপর্দা নারীকেحَبَائِلُ الشَّيْطَانِ  তথাশয়তানের রশি বলা হয়েছে। সব নারীকে শয়তানের রশি বলা হয় নি। বরং নেককার নারী সম্পর্কে বলা হয়েছে,

إِنَّمَا الدُّنْيَا مَتَاعٌ وَلَيْسَ مِنْ مَتَاعِ الدُّنْيَا شَيْءٌ أَفْضَلَ مِنْ الْمَرْأَةِ الصَّالِحَةِ

‘দুনিয়ার সব কিছু সম্পদ।’ মানবসম্পদ (Manpower ) তো শ্রেষ্ঠ সম্পদ। আর মানবসম্পদের মধ্যেও ‘শ্রেষ্ঠ সম্পদ হল, নেককার নারী। ‘নেককার নারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ সম্পদ পৃথিবীতে দ্বিতীয় টি নেই। (ইবন মাজাহ ১৮৫৫)

দয়া করে আপনারা পুরুষের জন্য ফেতনার কারণ হবেন না। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, 

مَا تَرَكْتُ بَعْدِي فِتْنَةً أَضَرَّ عَلَى الرِّجَالِ مِنْ النِّسَاءِ

আমার পরবর্তীতে পুরুষের জন্য নারীর ফিতনার চেয়ে কঠিন কোন ফিতনা আমি রেখে যায় নি। (সহীহ বোখারী ৪৮০৮ )

যাই হোক, আলোচনা একটু দীর্ঘ হয়ে গেছে। আল্লাহ আমাদের এই সময়গুলোকে কবুল করুন। এ পর্যন্ত যা বলা হয়েছে, তার উপর আমাদের প্রত্যেককে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

وَآخِرُ دَعْوَانَا اَنِ الْحَمْدُ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ

 

যারা আমাদের মধ্য থেকে নয়

বয়ান-২: যারা আমাদের মধ্য থেকে নয়

اَلْحَمْدُ لِلّهِ وَكَفَى وَسَلَامٌ عَلَى عِبَادِهِ الَّذِيْن َاصْطَفَى اَمَّا بَعْدُ! فَاَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ. بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ.لَقَدْ مَنَّ ٱللَّهُ عَلَى ٱلْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِّنْ أَنفُسِهِمْ. بارك الله لنا ولكم في القرآن  العظيم ونفعني وإياكم بما فيه من الآيات والذكر الحكيم وجعلني وإياكم من الصالحين. أقول قولي هذا وأستغفر الله لي ولكم فاستغفروه إنه هو الغفور الرحيم. اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّعَلَى الِ سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّبَارِكْ وَسَلِّمْ

হামদ ও সালাতের পর!

আল্লাহর সবচে’ বড় নেয়ামত

মুজাদ্দিদে আলফেসানি রহ. বলেন, আল্লাহ তাআলার সকল নেয়ামত আপন স্থানে বড়। তবে আল্লাহর সবচে’ বড় নেয়ামত হল, মুহাম্মদ ﷺ এর অস্তিত্ব। এর দলিল হল, আল্লাহ বান্দাকে অসংখ্য নেয়ামত দিয়েছেন কিন্তু সরাসরি খোঁটা দেন নি। পক্ষান্তরে নবীজি ﷺ-কে পাঠিয়ে তিনি আমাদেরকে খোঁটা দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন,

لَقَدْ مَنَّ ٱللَّهُ عَلَى ٱلْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِّنْ أَنفُسِهِمْ

আল্লাহ ঈমানদারদের উপর অনুগ্রহ করেছেন যে, তাদের মাঝে তাদের নিজেদের মধ্য থেকে নবী পাঠিয়েছেন। (সূরা আল ইমরান ১৬৪)
এর দ্বারা বুঝা গেল, নবীজি ﷺ-এর অস্তিত্বই আমাদের জন্য সবচে’ বড় নেয়ামত।
মহব্বত ও ইতাআ’ত
নবীজি ﷺ সম্পর্কে আমাদের মৌলিকভাবে দুটি কাজ করতে হয়। এক. তাঁকে মহব্বত করতে হয় পরিপূর্ণ অন্তর দিয়ে। দুই. তাঁর ইতাআ’ত বা অনুসরণ করতে হয় পরিপূর্ণ শক্তি দিয়ে। এই দুই গুণ যে ব্যক্তি বা জাতির মাঝে থাকবে, দুনিয়া আখেরাতে সফলতা তার সামনে চোখ ধাঁধিয়ে ধরা দিবে।
সাহাবায়ে কেরামের ইতিহাস দেখুন। তারা একসময় ছিলেন আইয়ামে জাহিলিয়াত তথা মূর্খতার যুগের নাগরিক। কিন্তু তাঁদের মাঝে উক্ত গুণ দুটি চলে এসেছিল। তাঁরা হয়ে ওঠলেন মানবেতিহাসের সবচে’ শ্রেষ্ঠ ও সোনালী মানুষ।
এমনিতে সাহাবায়ে কেরামের গুণ-বৈভব ছিল আকাশচুম্বি। যার বিবরণ দিতে হলে লক্ষ-কোটি পৃষ্ঠার প্রয়োজন পড়বে। কিন্তু যদি এই লক্ষ-কোটি পৃষ্ঠার একটা শিরোনাম দেয়া হয় তাহলে শিরোনাম দাঁড়াবে এই-  فلما أحبه القوم بكل قلوبهم أطاعوه بكل قواهم অর্থাৎ তাঁরা নবীজিকে মহব্বত করেছেন পরিপূর্ণ অন্তর দিয়ে তাপ তাঁর ইতাআত বা অনুসরণ করেছেন পরিপূর্ণ শক্তি দিয়ে। 
আল্লাহ আমাদেরকে এই তাওফিক দান করুন। আমীন।
আল্লাহর এক আরেফ চমৎকার বলেছেন,

محمد ؐ کی محبت دین حق کی شرط اول ہے
اس میں ہو اگر خامی تو سب کچھ نامکمل ہے

মুহাম্মদ ﷺ-এর প্রতি মহব্বত সত্য ধর্মের প্রধান শর্ত;

যদি এতে ত্রুটি থাকে তবে সবই অপরিপূর্ণ।

আল্লাহর আরেক আরেফ বলেন,

مغزِ قرآں، روحِ ایماں، جانِ دیں

ہست حبِ رحمتہ اللعالمینؐ

কোরআনের মগজ, ঈমানের রূহ এবং দীনের প্রাণ হল, রাহমাতাল লিল আ’লামিনের প্রতি ভালোবাসা।

মহব্বত কাকে বলে?

এক্ষেত্রে দুটি পরিভাষা আছে। এক. মহব্বত। দুই. ইশক। মহব্বতের আতিশয্যকে বলা হয়, ইশক। আমরা নবীজি ﷺ -কে ইশক-মহব্বত করব। প্রশ্ন হল, মহব্বত কাকে বলে?  জুনাইদ বোগদাদি রহ.-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, মহব্বত কাকে বলে? উত্তরে তিনি বলেন,

دخول صفات المحبوب على البدل من صفات المحب

অর্থাৎ, মহব্বতের মধ্যে দুই পক্ষ থাকে। যিনি মহব্বত করেন, তার নাম-মুহিব্ব বা আশেক। যাকে মহব্বত করা হয়, তার নাম- মাহবুব বা মা’শুক। মহব্বত বলা হয়, মুহিব্ব বা আশেক নিজের মধ্যে বিদ্যমান স্বভাবগুলোকে বিসর্জন দিবে। সেই স্থানে গ্রহণ করবে মাহবুব বা মা’শুকের স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যকে। (সালওয়াতুল আ’রেফীন ১৯৮)

মুহিব্ব বা আশেক মনে করবে, আমার ইচ্ছা ইচ্ছা নয়, মাহবুবের ইচ্ছাই ইচ্ছা। আমার রুচি রুচি নয়, মাহবুবের রুচিই রুচি। আমার চাওয়া চাওয়া নয়, মাহবুবের চাওয়াই চাওয়া।

মহব্বতের এই পরিচয় সাহাবায়ে কেরামের মাঝে পরিপূর্ণ মাত্রায় ছিল। তাঁরা নিজেদের কামনা-বাসনা, আবেগ-উচ্ছ্বাস, উৎসাহ-উদ্দীপনা, রাগ-ক্ষোভ; এক কথায় সব কিছুই মাটি করে দিয়েছিলেন নবীজি ﷺ-এর আনুগত্যের সামনে। একেই বলা হয়, প্রকৃত মহব্বত। এটাই প্রকৃত ভালোবাসা।

এজন্য আরেফ বিল্লাহ হাকীম আখতার রহ. বলেন, একটি লাইটের প্রতি দূর থেকে তাকালে মনে হয় যেন একটা আলোর গোলা। তার উপরে যে কাঁচ থাকে তা ওই আলোর মাঝে এমনভাবে বিলীন হয়ে যায় যে, দূর থেকে ওই কাঁচ বুঝা যায় না। অনুরূপভাবে মুহিব্ব বা আশেক তার মাহবুব বা মাশুকের মহব্বতে নিজেকে তাঁর মাঝে একেবারে বিলীন করে দেয়ার নাম মহব্বত।

ہم ترے شوق میں یوں خود کو گنوا بیٹھے ہیں

جیسے بچے کسی تہوار میں گم ہو جائیں

‘আমি তোমার মহব্বতে নিজেকে হারিয়ে বসেছি; যেমন শিশু বড় ভিড়ের মাঝে হারিয়ে যায়।’

আমাদের শায়খ ও মুরশিদ মাহবুবুল ওলামা পীর জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী মুজাদ্দেদী দা. বা. বলেন, মহব্বত হল, অন্তরের একপ্রকার ঢেউ বা উচ্ছ্বাস যা মাহবুবের কাছে পৌঁছার আগ পর্যন্ত থামে না। মহব্বত হল, অন্তরের একপ্রকার আগুন যা মাহবুব পর্যন্ত পোঁছা ছাড়া নিভে না।

এজন্য আল্লাহর আরেফ বলেন,

محبت محبت کرتے ہو لیکن

 محبت نہیں جس میں شدت نہیں ہے

‘মহব্বতের দাবী সত্য নয়; যদি না থাকে আতিশয্যতা।’

মহব্বতের পথে চলতে হলে যা জানতে হয়

যে কোনো রাস্তায় চলতে হলে তার মাঝে অবস্থিত বাধা-বিপত্তিগুলো জানতে হয়। সেগুলো এড়িয়ে চলতে হয়। অন্যথায় মনজিলে মাক্সুদ পর্যন্ত পৌঁছা যায় না। মহব্বত হল, একটি রাস্তা। মাহবুব পর্যন্ত পৌঁছার রাস্তা। আশেক তার মাশুক পর্যন্ত পৌঁছার রাস্তা। এই রাস্তার মাঝে অবস্থিত বাঁধাগুলো কী কী– তা যদি জানা থাকে তাহলে এই রাস্তাটা অতিক্রম করা সহজ হবে। নবীজি ﷺ হাদিসের মধ্যে কিছু জিনিস সম্পর্কে বলেছেন, لَيْسَ مِنَّا অর্থাৎ, এটা আমাদের রাস্তা নয়। لَيْسَ مِنی  বা لَيْسَ مِنْ أُمَّتِي অর্থাৎ, কেউ যদি এই পথে চলে তাহলে সে আমাকে মহব্বতকারী নয়। কেউ যদি এই পথে চলে তাহলে সে আমার আমার উম্মতভুক্ত নয়। সে আহ্লুস সুন্নাহ ওয়াল জা’মাত নয়।

মুহতারাম হাজিরীন! আজকের মজলিসে আমরা এজাতীয় কিছু হাদিসের আলোচনা করব– ইনশা আল্লাহ। প্রত্যেকটি হাদিস আমরা নিজের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখব। আল্লাহ না করুন, যে স্বভাবগুলো আলোচনা করা হবে সেগুলো যদি আমাদের মাঝে পাওয়া যায় তাহলে পরিত্যাগ করার ব্যাপারে সচেষ্ট হব– ইনশা আল্লাহ। বরং আমি বলব, আমাদের অবস্থা যেন এমন হয় যেমনটি কবি বলেছেন–

میں نے فانیؔ ڈوبتی دیکھی ہے نبض کائنات

جب مزاج یار کچھ برہم نظر آیا مجھے

‘আমি তো গোটা বিশ্ব তলিয়ে যেতে কিংবা ডুবে যেতে দেখেছি; যখন দেখেছি আমার প্রিয়তম আমার কোনো ব্যাপারে নারাজ বা অসন্তুষ্ট।’

আমাদের অবস্থা যেন এমন হয়– মাহবুবকে পাওয়ার জন্য, নবীজি ﷺ পর্যন্ত পৌঁছার জন্য প্রয়োজনে নিজের মনকে শাসন করব, ইচ্ছাকে ত্যাগ করব, বিলাসিতাকে বিসর্জন দিব, অলসতাকে দূরে ঠেলে দিব, গাফলতির চাদর খুলে ফেলব, ট্রেন্ড গুঁড়িয়ে দিব; মানুষের কথায় কান দিব না, সমাজের প্রথায় মন দিব না, চোখ রাঙ্গানিকে ভয় করব না, বন্ধুদের ডাকে সাড়া দিব না তবু আমাদের প্রকৃত মাহবুবকে জয় করবই এবং যে সকল ক্ষেত্রে নবীজি ﷺ বলেছেন, لَيْسَ مِنَّا অর্থাৎ, এটা আমাদের রাস্তা নয়। لَيْسَ مِنی অর্থাৎ, কেউ যদি এই পথে চলে তাহলে সে আমাকে মহব্বতকারী নয় সে সকল কাজ বা স্বভাব যে কোনো মূল্যে ত্যাগ করবই। হে আল্লাহ, আপনিই একমাত্র তাওফিকদাতা।

যাই হোক, এসম্পর্কিত হাদিসগুলো এখন পেশ করা হচ্ছে, আমরা শোনার জন্য, বুঝার জন্য এবং আমল করার জন্য মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করি।

১. যে আমার সুন্নতের প্রতি বিমুখ হবে…

যেমন আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

فمنْ رغِب عَنْ سُنَّتِي فَلَيسَ مِنِّى

‘যে আমার সুন্নতের প্রতি বিমুখ হবে সে আমার উম্মতভুক্ত নয়।’ (বুখারী ৪৭৭৬)

মুহাদ্দিসিনে কেরাম বলেন, এখানে দুটি বিষয়। একটি হল, যে সুন্নতের ওপর আমল করতে পারে না তবে নিজেকে এজন্য অপরাধী মনে করে করে। এ কারণে সে মনে মনে লজ্জিত থাকে। সুফিয়ানে কেরাম বলেন, এই ব্যক্তি হল ওই আশেকের মত যে নিজের মহবুবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারে না কিন্তু এর জন্য সে মনে মনে লজ্জিত থাকে। এ জাতীয় ব্যাক্তি উক্ত হাদিসের আওতায় পড়বে না।

আরেকটি হল, সুন্নত দেখতে পারে না; বরং সুন্নাতের নাম শুনলে, সুন্নাত দেখলে সে খুব বাজেভাবে রিঅ্যাক্ট করে। যেমন সে বলে, যত সব ফালতু কাজ সব দাঁড়িওয়ালারাই করে। এ জাতীয় ব্যাক্তি উক্ত হাদিসের আওতায় পড়ে যাবে। চিন্তা করে দেখুন, কেয়ামতের দিন যে লোকটিকে দেখে নবীজি ﷺ বলবেন, একে আমি চিনি না, এ আমার উম্মত নয়; তার অবস্থাটা কেমন হবে!

সুন্নাতের দৃষ্টান্ত

আমাদের শায়খ ও মুরশিদ মাহবুবুল ওলামা পীর জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী মুজাদ্দেদী দা. বা. সুন্নাতের একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত দিয়ে থাকেন, তিনি বলেন, যেমনভাবে একটা মেয়েকে যখন বরের উদ্দেশে সাজানো হয় তখন তার যে অঙ্গেই অলঙ্কার রাখা হয় ওই অঙ্গেরই সৌন্দর্য বেড়ে যায়, তেমনিভাবে আমাদের জিন্দেগির যে অংশেই নবীজী ﷺ এর সুন্নাত চলে আসবে, ওই অংশেরই সৌন্দর্য বেড়ে যাবে এবং আল্লাহর কাছে মায়ার হয়ে যাবে।

২. যে বড়দের সম্মান করে না…

উবাদা ইবন সামিত রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

لَيْسَ مِنْ أُمَّتِي مَنْ لَمْ يُجِلَّ كَبِيرَنَا وَيَرْحَمْ صَغِيرَنَا وَيَعْرِفْ لِعَالِمِنَا حَقَّهُ

‘সে আমার উম্মতভুক্ত নয় যে আমাদের বড়দের সম্মান করে না এবং আমাদের ছোটকে স্নেহ করে না এবং আমাদের আলেমের হক জানে না।’ (মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/১৪)

বাবা-মাকে বেশি বিরক্ত করলে তাঁরা যেমন বলেন, ‘যা তুই এমন করলে আমি আর তোর মা বা বাবা নই’, তেমন নবীজীও বলছেন, বড়কে অশ্রদ্ধা করলে তোমরাও আমার উম্মত নও। বাবা-মার এমন কথায় যেমন আমরা তাঁদের সন্তানতালিকা থেকে বাদ পড়ি না, আমরাও তেমন নবীর উম্মত থেকে বাদ যাব না বটে। কিন্তু এটা এতই অপ্রিয় ও নিন্দনীয় কাজ যে আমি যেন এমন স্বভাব নিয়ে মহান চরিত্রবান নবীর উম্মত হবার যোগ্যতাই হারিয়ে ফেলি।

ভেবে দেখুন,রাসুলুল্লাহ ﷺ গুরুজনের প্রতি অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ এতই অপছন্দ করতেন যে এমন কঠিন কথা বলে আমাদের সচেতন করতে চেয়েছেন। বড়দের অসম্মান না করতে আমাদের সাবধান করেছেন। বড়কে সম্মান করার অর্থ চলাফেরা ও কথাবার্তায় তাঁদের প্রতি সম্মান বজায় রাখা। সামাজিক কর্মকাণ্ডে তাঁদের অগ্রাধিকার দেয়া। কোনো কাজ করতে গিয়ে তাঁদের সামনে রাখা। পরিবারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিংবা যানবাহনে বা সভা- সমাবেশে বড়দের জন্য আসন ছেড়ে দেওয়া। রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, বড়দের প্রতি এভাবে আদব দেখাতে পারলে প্রকারন্তরে তুমি আল্লাহকে সম্মান করেছ।

إِنَّ مِنْ إِجْلَالِ اللَّهِ : إِكْرَامَ ذِي الشَّيْبَةِ الْمُسْلِمِ

‘বৃদ্ধ মুসলিমকে সম্মান করা আল্লাহকে সম্মান করারই নামান্তর।’ (আবু দাউদ ৪৮৪৩)

প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ ইমাম কাজী আবু ইয়া‘লা রহ. একবার পথচলার সময় তাঁর শিষ্যকে বললেন, ‘তুমি যখন কোনো শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির সঙ্গে পথ চলবে তখন তাঁর কোন দিকে থাকবে?’ আমি বললাম, আমার তা জানা নেই। তিনি বললেন, ‘তাঁকে ইমামের স্থানে রাখবে। অর্থাৎ তুমি থাকবে ডান দিকে আর বাম দিক তার জন্য ছেড়ে দেবে। যাতে করে থুথু ফেলা বা নাক পরিষ্কারের প্রয়োজন হলে তিনি অনায়াসে বাম দিকে তা করতে পারেন।’

সুতরাং বড়দের প্রতি কতটা বিনয়ী ও শ্রদ্ধাপরায়ণ হতে হবে। কতটা ভক্তি ও সম্মান দেখিয়ে তাঁদের দো‘আ নিতে হবে। বড় যদি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তোমার চেয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্নও হন, তবুও তাঁকে ছোট করে কথা বলবে না। তাঁর সামনে ভুলেও বড়াই দেখাবে না। তুমি যদি আজ তাঁকে অশ্রদ্ধা করে মনে কষ্ট দাও, কালই কিন্তু তোমার চেয়ে ছোট কারও কাছ থেকে একই ব্যবহার পেয়ে যাবে। তখন ঠিকই বুঝতে পারবে তিনি তোমার আচরণে কেমন মর্মযাতনায় ভুগেছিলেন। বড়দের দেখে সালাম দিবে। অকারণে তাঁদের সামনে চেঁচামেচি বা শোরগোল করবে না। তাঁরা কিছু চাইলে দূর থেকে নিক্ষেপ না করে সবিনয়ে গিয়ে তোমার ডান হাত দ্বারা দিবে।  রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

مَا أَكْرَم شَابٌّ شَيْخاً لِسِنِّهِ إِلاَّ قَيَّضَ اللَّه لَهُ مَنْ يُكْرِمُهُ عِنْد سِنِّه

‘কোনো যুবক যদি কোনো বৃদ্ধকে তার বার্ধক্যের কারণে সম্মান করে তাহলে আল্লাহ তায়ালা তার বার্ধক্যের সময় তাকে সম্মান করবে এমন লোক নিয়োজিত রাখবেন।’ (তিরমিযি ২০২২)

এজন্যই প্রসিদ্ধ আছে,  بی‌ادب محروم گشت از لطف رب বেয়াদব আল্লাহর ফজল ও করম থেকে মাহ্রুম হয়।

আসলে মুসলিম মানেই ভদ্র হবে, মার্জিত হবে, শিষ্টাচারপূর্ণ হবে।الـأدب هو الدين كله ভদ্রতা মানেই দীনদারি। الدين كله خلق দীনের সবটাই জুড়ে রয়েছে চরিত্রশিক্ষা।

৩. যে ছোটকে স্নেহ করে না…

উক্ত হাদিসের দ্বিতীয় অংশ ছিল, وَيَرْحَمْ صَغِيرَنَاযে আমাদের ছোটকে স্নেহ করে না সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়। কিছু লোক এমন আছে যারা ছোট বাচ্চা দেখলে ঝাড়ি মারে। ধমক দেয়। এটা ঠিক নয়। আবার অনেক অভিভাবক আছেন যারা শিশুদের সাথে কোমল আচরণ করেন না, তাদের কথাও মনোযোগ দিয়ে শোনেন না। কেবল হু, হ্যাঁ করে যান। এটাও ঠিক নয়। আলই’য়াযু বিল্লাহ, আমরা তো আমাদের নবীজী ﷺ থেকে হয়ে বড় যায় নি। তিনি তো শিশুদের ওপর রাগ করতেন না। ঝাড়ি দিতেন না। তাদের সঙ্গে কর্কশ ভাষায় কথা বলতেন না। বরং কেউ কোনো শিশুর ওপর রাগ করলে তিনি তার উপর রাগ করতেন।  তিনি ছোটদেরকে আদর করে কাছে বসাতেন। তাদেরকে চুমো দিতেন। কোলে তুলে নিতেন। এমনকি কোনো শিশু তাঁর কোলে পেশাব করে দিলেও তিনি কিছু বলতে ন না।

ছোটদের প্রতি নবীজীর ভালোবাসা

একদিনের ঘটনা। হাদিসের একাধিক কিতাবে ঘটনাটি এসেছে। নবীজী ﷺ খেতে বসেছিলেন। কিন্তু খানা তখনও শুরু করেন নি। উম্মে কায়েস বিনতে মিহসান রাযি. তার শিশুপুত্রটিকে কোলে করে রাসূলের সাথে দেখা করতে আসলেন। শিশুটিকে দেখে নবীজী ﷺ তার দিকে এগিয়ে এলেন। পরম আদরে কোলে তুলে নিয়ে খাবারের জায়গায় গিয়ে বসলেন। শিশুটি নবীজীর আদর পেয়ে তাঁর কোলেই পেশাব করে ভিজিয়ে দিল।

এ ঘটনায় নবীজি মুচকি হাসলেন। তাঁর চেহারায় বিরক্তি প্রকাশ পেল না। তিনি পানি আনার জন্য একজনকে বললেন। পানি আনা হলে যে যে জায়গায় পেশাব পড়েছিল সেখানে পানি ঢেলে দিলেন।

একদিকে নবীজী ﷺ-এর শান ও মহান মর্যাদার কথা ভাবুন, আরেকদিকে এই ঘটনাটি দেখুন। এতেই বুঝা যায়, নবীজীর হৃদয়ে ছোটদের প্রতি কী পরিমাণ মায়া ছিল!

— আনাস রাযি. নবীজীর খেদমত করতেন। আট বছর বয়স থেকে নবীজীর খেদমত করেছেন। এতটুকুন বালকের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের ভুলত্রুটি হওয়া একান্তই স্বাভাবিক। কিন্তু নবীজী কখনো তার গায়ে হাত তোলেন নি, এমনকি কখনো এমন কথাও বলেননি যে, আনাস! তুমি এই কাজটি কেন করেছ, আর ঐ কাজটি কেন করনি। অথচ আমরা পানি আনতে একটু দেরি হলেই ছোট্ট কাজের ছেলে বা মেয়ের সাথে কত খারাপ ব্যবহার করি।

— হযরত আবু হুরাইরা রাযি. বলেন, নবী কারীম ﷺ তাঁর নাতি হাসানকে চুমু খেলেন। সেখানে আকরা ইবনে হাবিস রাযি. নামে এক সাহাবী বসা ছিলেন। হাসানকে চুমু খাওয়া দেখে তিনি বললেন, আমার দশটি সন্তান রয়েছে। আমি তাদের কাউকে চুমু খাই নি। নবীজী তার দিকে তাকিয়ে বললেন, مَن لا يَرحَمْ لا يُرحَمْ যে দয়া করে না, তার প্রতিও দয়া করা হবে না। (বুখারী ৫৬৫১)

— আরেক হাদিসে আছে, হজরত আয়েশা রাযি. বলেন, এক গ্রাম্যব্যক্তি নবী করিম ﷺ -এর কাছে এলো। নবীজি তাকে বললেন, তোমরা কি তোমাদের শিশুদেরকে চুমু খাও? সে বললো, ‘জী না।’ নবী করিম ﷺ বললেন, أَوَ أَمْلِكُ لَكَ أَنْ نَزَعَ اللَّهُ مِنْ قَلْبِكَ الرَّحْمَةَ ؟ তোমাদের অন্তরে যদি দয়া-মায়া না থাকে, তাহলে আমার কী করার আছে! (বুখারী ৫৬৫২)

— আমরো জানি, নবীজী ﷺ-এর ঘরেও শিশু ছিল। হাসান রাযি. ও হুসাইন রাযি.। নবীজী তাঁদেরকে কেমন আদর করতেন! আবু হুরায়রা রাযি. বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ ﷺ হাসান ও হোসাইন দুইজনকে দুই কাঁধে নিয়ে আমাদের সামনে এলেন এবং একবার এর গালে আদর করছিলেন আরেকবার ওর গালে আদর করছিলেন। এক সাহাবী বলে উঠলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি কি এদেরকে খুব ভালোবাসেন? নবীজী ﷺ উত্তর দিলেন, مَنْ أَحَبَّهُمَا فَقَدْ أَحَبَّنِي وَمَنْ أَبْغَضَهُمَا فَقَدْ أَبْغَضَنِي যে এদের ভালোবাসবে সে আমাকে ভালোবাসল, আর যে এদের প্রতি বিদ্বেষ রাখবে সে যেন আমার প্রতি বিদ্বেষ রাখল। (মাজমাউয যাওয়াইদ ৯/১৮০)

— এমন ঘটনাও আছে যে, হাসান রাযি. ও হুসাইন রাযি. অনেক সময় রাসূলে কারীম ﷺ-এর পিঠে চড়ে বসতেন, তাঁকে ঘোড়া বানিয়ে তারা খেলতেন। এমন চমৎকার দৃশ্য দেখে একদিন এক সাহাবী মজা করে বলে উঠলেন, نِعْمَ الْمَرْكَبُ رَكِبْتَ يَا غُلَامُ বৎস! তুমি দারুণ সাওয়ারি পেয়েছ! নবীজী ﷺ তখন উত্তর দিলেন, وَنِعْمَ الرَّاكِبُ هُوَ আরোহীও দারুণ! (তিরমিযী ৩৭৪৬)

নামাযের মত ইবাদতেও এমনটি ঘটত যে, নবীজী ﷺ সিজদায় গিয়েছেন আর হাসান বা হুসাইন রাযি. তাঁর পিঠে চড়ে বসেছেন। ফলে তিনি দীর্ঘ সময় সিজদায় থাকতেন। অপেক্ষা করতেন কখন তারা পিঠ থেকে নামবে। (নাসাঈ ১১৪১)

দেখুন, আর আমরা কী করি? মসজিদে কোনো বাচ্চাকে দেখলে এমন ধমক লাগাই যে, তার শিশু মনে মসজিদের ব্যাপারেই ভয় ঢুকিয়ে দেই। তখন সে মনে করে মসজিদে গেলে বড়দের ধমক খেতে হয়। অবশেষে এই শিশুটা আর নামাযের অভ্যাস করতে পারে না। এমনিতে অবুঝ শিশুকে মসজিদে নিয়ে আসা নিষেধ। একটু বুঝমান হলে তাকে মসজিদে আসার অভ্যাস করাতে হয়। কিন্তু যদি কোনো অবুঝ শিশু মসজিদে চলে আসে তাহলে তার সঙ্গে পুলিশি-আচরণ করে তার কচি অন্তরে নামাযের ব্যাপারে অনীহা সৃস্টি করা যাবে না। যদি তা করেন তাহলে لَيْسَ مِنْ أُمَّتِي সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়-এর আওতায় পড়ে যাবেন। আল্লাহ আমাদের প্রত্যককে হেফাজত করুন। আমীন।

৪. যে আমাদের আলেমের হক জানে না…

উক্ত হাদিসের শেষ অংশ ছিল, وَيَعْرِفْ لِعَالِمِنَا حَقَّهُযে আমাদের আলেমের হক জানে না সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়। আব্দুল্লাহ ইবন মুবারক রহ. বলতেন,

مَنِ اسْتَخَفَّ بِالْعُلَمَاءِ ذَهَبَتْ آخِرَتُهُ، وَمَنِ اسْتَخَفَّ بِالْأُمَرَاءِ ذَهَبَتْ دُنْيَاهُ، وَمَنِ اسْتَخَفَّ بِالْإِخْوَانِ ذَهَبَتْ مُرُوءَتُهُ

যে ব্যক্তি আলেম-ওলামাকে ছোট করবে তার আখেরাত বরবাদ হবে, যে ব্যক্তি দুনিয়াদার নেতাদেরকে উপহাস করবে তার দুনিয়া নষ্ট হবে আর যে ব্যক্তি ভাই-বন্ধুকে হেয় প্রতিপন্ন করবে তার ব্যক্তিত্ব খাটো হয়ে যাবে।

সুতরাং আল্লাহর বান্দারা! সাবধান! আখেরাত ঠিক রাখতে হলে আলেম- ওলামার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা রাখতে হবে। মনে রাখবেন, আপনাদের জন্য দরদী , হিতাকাঙ্খী ওলামায়ে কেরামের চাইতে বেশি আর কেউ নয়। আপনার দল আপনার নেতাও নয়। মিডিয়ার অপপ্রচারের ফাঁদে পা দিয়ে আমরা আজ ওলামায়েকেরামকে গালি দিচ্ছি, কিছু একটা ঘটলেই আলেম-ওলামার দিকে আঙ্গুল তুলে দিচ্ছি। আমাদের অবস্থার দিকে তাকালে মনে হয়, আমরা যেন এই শ্রেণীর লোকগুলোকে আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু মনে করি। না আল্লাহর বান্দা! আজ থেকে এমনটি করবেন না। আজ থেকে তাওবা করুন। আল্লাহ যাঁদেরকে সম্মানিত করেছেন, তাঁদের ব্যাপারে নেগেটিভ ধারণা বর্জন করুন। আশ্চর্যের ব্যাপার! এক দিকে আমরা এটা জানি যে, মিডিয়া মানেই মিথ্যার বাজার। অপরদিকে এই মিডিয়ার কথা বিশ্বাস করেই আলেম-ওলামার ব্যাপারে খারাপ মন্তব্য-বক্তব্য দিয়ে বসি! আবার এই মিডিয়াই আমার দলের বিরুদ্ধে কিংবা নেতার বিরুদ্ধে কিছু বললে তখন বলি, এই সব মিডিয়ার অপপ্রচার! এরূপ দ্বিমুখী আচরণ কেন? এজন্য আজ থেকে ওলামায়েকেরামের সম্মান নষ্ট হয় এমন কোনো কথা বলার আগে অন্তত পক্ষে একবার চিন্তা করবেন, আমার এই জাতীয় আচরণের কারণে لَيْسَ مِنْ أُمَّتِي এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে আমি এই উম্মত থেকে খারিজ হয়ে যাচ্ছি না তো? সুতরাং একজন আলেমকে সম্মান দিতে শিখুন। তাঁকে নবীজীর ওয়ারিশ হিসেবে মুল্যায়ন করুন। খতিব বাগদাদী রহ. এই মর্মে একটি সুন্দর হাদিস এনেছেন, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

أَكْرِمُوا الْعُلَمَاءَ فَإِنَّهُمْ وَرَثَةُ الأَنْبِيَاءِ فَمَنْ أَكْرَمَهُمْ فَقَدْ أَكْرَمَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ

তোমরা ওলামায়েকেরামকে সম্মান কর। কেননা তাঁরা আম্বিয়ায়েকেরামের ওয়ারিশ। যে ব্যক্তি তাঁদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা দেখাবে সে যেন আল্লাহ ও তাঁর প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা দেখাল।

ওলামায়েরকেরামের সঙ্গে থাকুন

আল্লাহর বান্দারা! এজন্য বেশি বুঝার চেষ্টা করবেন না। বরং ঈমান বাঁচাতে হলে, আখেরাত ঠিক রাখতে হলে, নিজেকে গোমরাহ হওয়া থেকে রক্ষা করতে হলে ওলামায়েকেরামের সঙ্গে থাকুন। রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

الْبَرَكَةُ مَعَ أَكَابِرِكُمْ

যারা দীনের লাইনে তোমাদের চেয়ে বড়। তাঁদের সঙ্গে থাক। এর মধ্যেই বরকত। (সহিহ ইবনু হিব্বান ৫৫৯)

আমাদের সমাজের কথিত আহলে হাদিসের ভাইয়েরা পথভ্রষ্ট কেন? এ কারণে যে, তারা ওলামায়েকেরাম থেকে বেশি বুঝে ফেলেছে যে! আবার কিছু যুবক আছে, জিহাদ জিহাদ করে। পণ্ডিতি করে বলে, ‘শাহাদাহ’। শাহাদাত নয়; শাহাদাহ। যদি বলা হয়, ভাই, তোমাকে এই জিহাদ বা শাহাদাহ কে শিখালো? তখন ওলামায়েকেরামের মহলে যার নাম-ধাম নেই, এমন কারো নাম নিয়ে বলবে, অমুক শায়েখ বা অমুক হাফিযাহুল্লাহ…বলেছেন। যুবক! মনে রাখবা, ওলামায়েকেরামের চোখে যেটা জিহাদ নয়, সেটা তোমার কাছে জিহাদ হতে পারে, কিন্তু আল্লাহর কাছে নয়। ওলামায়েকেরামের কাছে যা শাহাদাত নয়, তা তোমার কাছে শাহাদাহ হতে পারে, কিন্তু আল্লাহর কাছে সেটা হবে জাহিলিয়াতের ওপর মৃত্যু; এছাড়া আর কিছু নয়। আজ কথিত কিছু শায়েখ বা কথিত কিছু ‘হাফিযাহুল্লাহ’র কারণে যুবকরা বিভ্রান্ত হচ্ছে। জিহাদের নামে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে যাচ্ছে। যার কারণে প্রকৃত জিহাদ বা প্রকৃত শাহাদাত উম্মাহর কাছে অপরিচিত হয়ে যাচ্ছে। আসল আর নকল সব একাকার হয়ে যাচ্ছে। এর সুযোগ নিচ্ছে ইসলামের শত্রুদের হাতে পরিচালিত মিডিয়াগুলো। তারা দাঁড়ি-টুপির ব্যাপারে বিভিন্ন কুধারণা মানুষের মগজে বসিয়ে দিচ্ছে। এর একমাত্র সমাধান হল, ওলামায়েকেরামের সঙ্গে থাকা। তাঁরা যেটাকে দীন বলেন, সেটাকেই দীন মনে করা। যেটাকে জিহাদ বলেন, সেটাকেই জিহাদ মনে করা। যেটাকে জঙ্গিবাদ বলেন, সেটাকে জঙ্গিবাদই মনে করা। যেটাকে তাবলীগ বলেন, সেটাকেই তাবলীগ মনে করা। যাকে হক বলবেন, তাকে হক হিসেবে বিশ্বাস করা। মোট কথা, অন্তত দীনের যে কোনো বিষয়ে তাঁদের কথার বাইরে না যাওয়া এবং তাঁদের সঙ্গে থাকা। এটা ওলামায়েকেরামের হক বা অধিকার। যদি ওলামায়েকেরামের এই নুন্যতম হক আদায় করতে না পারেন, তাহলে নবীজী وَيَعْرِفْ لِعَالِمِنَا حَقَّه,বলেছেনযে আমাদের আলেমের হক জানে না সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।

উম্মতের প্রতি ওলামায়েকেরামের চাইতে দরদী আর কেউ নয়

এজন্য আবারো বলছি, কথাটা অন্তরে মরণ পর্যন্ত মনে রাখবেন, আপনাদের জন্য দরদী, হিতাকাঙ্খী ওলামায়ে কেরামের চাইতে বেশি আর কেউ নয়। ইয়াহইয়া ইবনু মুয়ায রহ. বলেন, ওলামায়েকেরাম উম্মতের প্রতি আমাদের মা-বাবার চাইতেও বেশি দয়ালু। এক ব্যক্তি প্রশ্ন করলেন, কিভাবে? তিনি উত্তর দিলেন,

  لأنَّ آباءهم وأمَّهاتهم يحفَظُونهم من نار الدنيا،والعلماء يحفَظُونهم من نار الآخِرة

কেননা, তাদের বাবা-মা তাদেরকে দুনিয়ার আগুন থেকে বাঁচিয়ে রাখে আর ওলামায়েকেরাম তাদেরকে আখেরাতের আগুন থেকে হেফাজত করে।

৫. যে ব্যক্তি বিভিন্ন মাধ্যমে ভাগ্যের ভালো-মন্দ যাচাই করে…

সম্মানিত হাজেরিন! নবীজী ﷺযাদের সম্পর্কে বলেছেন, لَيْسَ مِنَّا এরা আমাদের মধ্য থেকে নয়। তারা কারা? এই মর্মে আমরা ইতিপূর্বে চার শ্রেণীর কথা জানতে পেরেছি। এ বিষয়ে আরো হাদিস আছে। একেকটি হাদিস ‘ইনশাআল্লাহ’ বলা হবে, আর আমরা মনে মনে তাওবা করতে থাকব এবং দোয়া করতে থাকবো যে, হে আল্লাহ! নবীজী যাদের ব্যাপারে বলেছেন, এরা আমাদের মধ্য থেকে থেকে নয়, আপনি আমাদেরকে সেসব হতভাগাদের অন্তর্ভুক্ত করবেন না। আমীন। যাই হোক, এব্যাপারে আরেকটি হাদিস বলা হচ্ছে, সকলেই মনোযোগ দিন।

ইমরান ইবনু হুসাইন রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

لَيْسَ مِنَّا مَنْ تَطَيَّرَ أَوْ تُطُيِّرَ لَهُ ، أَوْ تَكَهَّنَ أَوْ تُكُهِّنَ لَهُ ، أَوْ سَحَرَ أَوْ سُحِرَ لَهُ ، وَمَنْ أَتَى كَاهِنًا ، فَصَدَّقَهُ بِمَا يَقُولُ ، فَقَدْ كَفَرَ بِمَا أُنْزِلَ عَلَى مُحَمَّدٍ ﷺ

যে ব্যক্তি পাখি উড়িয়ে ভাগ্যের ভাল-মন্দ যাচাই করলো, অথবা যার ভাগ্যের ভাল-মন্দ যাচাই করার জন্য পাখি উড়ানো হল, অথবা যে ব্যক্তি ভাগ্য গণনা করলো, অথবা যার ভাগ্য গণনা করা হলো, অথবা যে ব্যক্তি যাদু করলো অথবা যার জন্য যাদু করা হলো অথবা যে ব্যক্তি কোন গণকের কাছে আসলো অতঃপর সে [গণক] যা বললো তা বিশ্বাস করলো সে ব্যক্তি মূলতঃ মুহাম্মদ ﷺ এর উপর যা নাযিল করা হয়েছে তা অস্বীকার করল। (মাজমাউয যাওয়াইদ ৫/১২০)

আরবে পাখি উড়িয়ে, তীর দ্বারা বিশেষ পদ্ধতিতে ভাগ্য গণনা করা হত। আমাদের সমাজেও রাশিফল বের করার নামে ভাগ্য নির্ণয় করার বেশ কিছু পদ্ধতি চালু আছে। জ্যোতিষী, গণক, টিয়া পাখি, বানর, সাপুড়িয়ার সাপ, সোলেমানিয়া তাবিজের কিতাব ইত্যাদির মাধ্যমে রাশিফল নির্ণয় করা হয়। কিছু পত্রিকায় তো রাশিফল নামে একটা পাতাই বরাদ্দ করে রাখে। প্রথম আলো পত্রিকা তো এজাতীয় যত শয়তানি আছে, সবগুলোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে থাকে। রাশিফল নামে তারা বিশেষ সংখ্যা বের করে। এসবই হারাম, কবিরা গুনাহ। এদের কথা বিশ্বাস করাও কবিরা গুনাহ। এমনকি হাদিসে এটাকে শিরকও বলা হয়েছে। শিরক বলতে এখানে ছোট শিরক উদ্দেশ্য। যার দ্বারা মুশরিক হয় না, তবে এটা শক্ত কবিরা গুনাহ এবং এটা মানুষকে ধীরে ধীরে বড় শিরকের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

হাদিস শরিফে এসেছে,  রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, কুলক্ষণ বা দুর্ভাগ্যের ধারণা যে ব্যক্তিকে তার স্বীয় প্রয়োজন, দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে দূরে রাখলো, সে মূলতঃ শিরক করলো। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, এর কাফ্ফারা কী? উত্তরে তিনি বললেন, তোমরা এ দোয়া পড়বে,

اللهم لاَ خَيْرَ إلا خَيْرُكَ وَلاَ طَيْرَ إلا طَيْرُكَ وَلاَ إِلَهَ غَيْرُكَ

হে আল্লাহ, আপনার মঙ্গল ব্যতীত কোন মঙ্গল নেই। আপানার অকল্যাণ ছাড়া কোন অকল্যাণ নেই। আরা আপনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। (আহমদ ৭০৪৫)

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এই গুনাহ থেকেও বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন।

৬. যে ব্যক্তি যাদু করে…

যে ব্যক্তি যে ব্যক্তি যাদু করে কিংবা যার জন্য যাদুকর অন্যের বিরুদ্ধে যাদু করে– নবীজী ﷺ-এর ভাষায়; لَيْسَ مِنَّا এরা আমাদের মধ্য থেকে নয়। যাদুটোনা করা, আরেকজনের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে তাবিজ করা এসবই এর অন্তর্ভুক্ত হবে।

এমনিতে তাবিজ যদি কোরআনের আয়াত কিংবা হাদিসের কোনো দোয়ার মাধ্যমে হয় এবং অন্যের ক্ষতির উদ্দেশ্যে না হয় তাহলে এটা জায়েয আছে। আমাদের দেশে তো তাবিজের কিতাব হিসেবে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ বইয়ের নাম হল, সোলেমানিয়া তাবিজের কিতাব। সুলাইমান আলাইহিসসালামের দিকে নিসবত করে এর নাম রাখা হয়েছে। বইটির বিকৃত বানান বা উচ্চারণের মধ্যেই একজন নবীর সঙ্গে জঘন্য বেয়াদবি প্রকাশ পায়। উপরন্তু বইটিতে কুফরী ও শিরকি কথার অভাব নেই। অবশ্য কিছু সহিহ কথাও আছে। যাই হোক, যারা আমল করতে পারেন তাদের জন্য হল আমল। এক্ষেত্রে এটাই মূল সুন্নত। আর যারা আমল করতে সক্ষম নয় যেমন, শিশুরা আমল করতে পারে না, তাদের জন্য হল তাবিজ বা শরিয়তসম্মত ঝাড়-ফুঁক করা যেতে পারে। তবে তা হতে হবে অবশ্যই কোনো দীনদার আলেম থেকে। হিন্দু। বৌদ্ধ, মগ, চাকমা, টিপরা, কামরুকামাক্ষা এসব অমুসলিমদের থেকে তাবিজ গ্রহণ করা মানেই ছোট শিরকে জড়িয়ে পড়া। আর তা যদি হয় আরেকজনের ক্ষতির উদ্দেশ্য তাহলে এটা তো চুরির ওপর সীনাজুরি। নবীজী ﷺ-এর ভাষায়; لَيْسَ مِنَّا এরা আমাদের মধ্য থেকে নয়। অনেক সময় তো মানুষকে প্রাণে মেরে ফেলার জন্যও যাদুটোনা করা হয়। এটা তো কাউকে সরাসরি মেরে ফেলার মতই আরো জঘন্য অপরাধ। এমনকি ইসলামী খেলাফত থাকলে এই অপরাধের শাস্তি হত, মৃত্যুদণ্ড। হাদিসে এসেছে, حَدُّ السَّاحِرِ ضَرْبَةٌ بِالسَّيْفِ যাদুকরের শাস্তি হচ্ছে তলোয়ারের আঘাতে গর্দান উড়িয়ে দেয়া। ইমাম আযম আবু হানিফা রহ ও এরকম ফতওয়া দিতেন যে, যাদুকর যদি তার যাদুটোনা দ্বারা কাউকে মরে ফেলে তাহলে তার শাস্তি হল, মৃত্যুদণ্ড।

৭. যে ব্যক্তি অমুসলিমদের সাথে সাদৃশ্য রাখে…

সম্মানিত হাজেরিন! আলোচনা দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। সামনের আলোচনা ‘ইনশাআল্লাহ’ সংক্ষিপ্ত করার চেষ্টা করা হবে। এখন এই মর্মে চতুর্থ হাদিস পেশ করা হচ্ছে, যেখানে নবীজী ﷺ বলেছেন, لَيْسَ مِنَّا এরা আমাদের মধ্য থেকে নয়। তারা কারা? রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন,

لَيْسَ مِنَّا مَنْ تَشَبَّهَ بِغَيْرِنَا، لَا تَشَبَّهُوا بِالْيَهُودِ، وَلَا بِالنَّصَارَى، فَإِنَّ تَسْلِيمَ الْيَهُودِ الْإِشَارَةُ بِالْأَصَابِعِ، وَتَسْلِيمَ النَّصَارَى الْإِشَارَةُ بِالْأَكُفِّ

যে ব্যক্তি অমুসলিমদের সাথে সাদৃশ্য রাখে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়। তোমরা ইয়াহূদী ও খৃষ্টানদের সাথে সদৃশ অবলম্বন করো না। কারণ ইয়াহূদীদের অভিবাদন হল, আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করা আর খৃষ্টানদের অভিবাদন হল, হাতের তালু দিয়ে ইশারা করা। (তিরমিযি ২৬৩৮)

৮. যে নারী পুরুষের সাথে এবং যে  পুরুষ নারীর সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করে…

এই মর্মে আরেকটি হাদিস আছে, বিশেষ করে যুবসমাজের উদ্দেশ্যে পেশ করা হচ্ছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

لَيْسَ مِنَّا مَنْ تَشَبَّهَ بِالرِّجَالِ مِنَ النِّسَاءِ، وَلَا مَنْ تَشَبَّهَ بِالنِّسَاءِ مِنَ الرِّجَالِ

যে সব নারী পুরুষের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করে এবং যে সব পুরুষ নারীর সাদৃশ্য অবলম্বন করে, তারা আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়। ( মুসনাদে আহমদ ২/৬৫৮০)

৯. যে ব্যক্তি প্রতারণা করে…

রাসূলুল্লাহ ﷺ একদিন স্তুপ করে রাখা খাদ্যশস্যের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি স্তুপের ভেতর হাত প্রবেশ করালে আঙ্গুলগুলো ভিজে গেল। স্তুপের মালিককে জিজ্ঞাসা করলেন, ব্যাপার কী? মালিক উত্তর দিল, ইয়া রাসূলুল্লাহ! বৃষ্টির পানিতে তা ভিজে গিয়েছিল। নবী করীমﷺ বললেন, তবে তা উপরে রাখলে না কেন, যেন মানুষ তা দেখতে পায়? مَنْ غشَّنَا فَلَيْسَ مِنَّا যে প্রতারণা দেয় সে আমার দলভুক্ত নয়। (মুসলিম ১০১)

১০. যে ব্যক্তি মুসলমানের বিপক্ষে অস্ত্র ধারণ করে…

অনুরূপ আরেকটি হাদিস আছে, যেটির ওপর আমল করলে আমাদের দেশে আর কোনো সমস্যাই থাকবে না। কেননা একটা রাষ্ট্রের মূল সমস্যা হল দু’টি। দুর্নীতি এবং সন্ত্রাস। আর রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

مَنْ حَمَلَ عَلَيْنَا السِّلَاحَ ، فَلَيْسَ مِنَّا ، وَمَنْ غَشَّنَا ، فَلَيْسَ مِنَّا

সে ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে আমাদের উপর অস্ত্র তোলে। আর যে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করে, সেও আমাদের দলভুক্ত নয়। (মুসলিম ১০২)

দেখুন, এই একটি হাদিসে সন্ত্রাস ও দুর্নীতি উভয়টারই সলিউশন আছে। যদি দেশের প্রত্যেক সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজ একথা চিন্তা করত যে, আমি আমার এই জাতীয় কর্মকাণ্ডের কারণে তাঁর উম্মত থেকে খারিজ হয়ে যাচ্ছি, যার সুপারিশ ছাড়া আখেরাতে নাজাতের কল্পনাও করা যায় না; তাহলে এই দেশে কোনো সন্ত্রাসী অস্ত্র পকেটে রাখার এবং কোনো দুর্নীতিবাজ জনগণের সঙ্গে দুর্নীতি করার সাহস করত না। এজন্যই ওলামায়েকেরাম বলেন, যে যত বড় মুমিম সে তত ভাল সুনাগরিক। আল্লাহ আমাদেরকে সুনাগরিক হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমীন।

১১. মৃত্যুশোক প্রকাশে যে মহিলা বিলাপ করে কাঁদে …

এবার বিশেষত মা-বোনদের উদ্দেশ্যে একটা হাদিস। আমরা স্বাভাবিকভাবেই কারো মৃত্যুতে ব্যাথিত হই এবং আমরা কান্নাকাটি করি। এটা নিষেধ নয়। তবে অনেক সময় মহিলারা কী করে? তারা মৃতের জন্য কাঁদতে গিয়ে বিলাপ করে কান্নাকাটি করে, বুক চাপড়ায়, মুখমণ্ডলে আঘাত করে, কাপড় ছিঁড়ে ফেলে। আবার অনেক পুরুষ বা মহিলা আছে শোক পালন করতে গিয়ে চুল মুণ্ডন করে ফেলে। আরো কত কী করে! এগুলো সীমালঙ্ঘন। রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

لَيْسَ مِنَّا مَنْ حَلَقَ وَمَنْ سَلَقَ وَمَنْ خَرَقَ

মৃত্যুশোক প্রকাশে যে মহিলা মাথা মুড়িয়ে বিলাপ করে কাঁদে এবং কাপড় ছিঁড়ে ফেলে সে আমাদের দলভুক্ত নয়। (আবু দাউদ ৩১৩০)

অপর হাদিসে নবীজী ﷺ বলেন,

لَيْسَ مِنَّا مَنْ ضَرَبَ الْخُدُودَ، أَوْ شَقَّ الْجُيُوبَ، أَوْ دَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ

যারা (মৃত ব্যক্তির জন্য শোক প্রকাশে) গালে চপেটাঘাত করে, জামার বক্ষ ছিন্ন করে বং জাহিলী যুগের মত চিৎকার দেয়, তারা আমাদের দলভুক্ত নয়। (বুখারী ১২৯৭)

১২. যে ব্যক্তি মোচ কাটে না…

মুহতারাম হাজেরিন! রাসুলুল্লাহ ﷺ যে সকল হাদিসেلَيْسَ مِنَّا কিংবা لَيسَ مِنِّى বলে আমাদেরকে সতর্ক করেছেন যে, এটা আমার রাস্তা নয়, এরা আমাদের দলভুক্ত নয়, এরা আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়, এরা আমাকে মহব্বতকারী নয়; সে সকল হাদিস আপনাদের সামনে পেশ করা হচ্ছে। আরো কিছু হাদিস আপনাদের সামনে পেশ করার উদ্দেশ্যে আমি নোট করে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু আলোচনা একটু দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে বিধায় এই মর্মে এখান থেকে কিছু হাদিস এবং শুধু তরজমা পেশ করা হচ্ছে। হাদিসের আজমতের প্রতি খেয়াল রেখে আমরা পরিপূর্ণ মনোযোগটা এদিকে ধরে রাখার চেষ্টা করি এবং আল্লাহর কাছে পানাহ চাই যে, তিনি যেন আমাদেরকে এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত না করুন। আমীন।

যায়েদ ইবনু আরকাম রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি,

مَنْ لَمْ يَأْخُذْ شَارِبَهُ فَلَيْسَ مِنَّا

যে ব্যক্তি মোচ কাটে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়। (তিরমিযি ২৬৫৮)

সুতরাং পুরুষেরা জেনারেলদের মত মোচ রাখবেন না। মোচ ছোট করে রাখবেন।

১৩. যে ব্যক্তি কোন স্ত্রীকে তার স্বামীর বিরুদ্ধে  প্ররোচিত করে …

আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

لَيْسَ مِنَّا مَنْ خَبَّبَ امْرَأَةً عَلَى زَوْجِهَا أَوْ عَبْدًا عَلَى سَيِّدِهِ

যে ব্যক্তি কোন স্ত্রীকে তার স্বামীর বিরুদ্ধে অথবা দাসকে তার মনিবের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়। (আবু দাউদ ২১৭৫)

১৪. যে ব্যক্তি ছিনতাই করে …

জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

مَنِ انْتَهَبَ نُهْبَةً مَشْهُورَةً فَلَيْسَ مِنَّا

যে ব্যক্তি অন্যের মাল ছিনতাই করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়। (আবু দাউদ ৪৩৪০)

১৫. যে ব্যক্তি সুন্দর সূরে কোরআন পাঠ করে না…

আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يَتَغَنَّ بِالْقُرْآنِ

যে ব্যক্তি সুন্দর সূরে কোরআন পাঠ করে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়। (বুখারী৭০১৯)

অথচ আমাদের মধ্যে এমন লোকও আছে, যার সুন্দর করে তেলাওয়াত করা তো দুরের কথা; বরং তেলাওয়াতই করতে পারে না কিংবা পারলেও সহিহ করে পারে না। আর এভাবেই কবরে চলে যাচ্ছে! আল্লাহর বান্দা! আল্লাহর কাছে কী জবাব দিবেন?

১৬. যে ব্যক্তি অত্যাচারী শাসকের সহযোগিতা করে…

কা‘ব ইবন উজরা রাযি. থেকে বর্ণিত যে, একদিন রাসূলুল্লাহ ﷺ হুজরা থেকে আমাদের কাছে বের হয়ে এলেন। আমরা সেখানে ছিলাম নয় জন। পাঁচজন আরব আর চারজন আনারব (বা এর বিপরীত)। তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

اسْمَعُوا هَلْ سَمِعْتُمْ أَنَّهُ سَيَكُونُ بَعْدِي أُمَرَاءُ فَمَنْ دَخَلَ عَلَيْهِمْ فَصَدَّقَهُمْ بِكَذِبِهِمْ وَأَعَانَهُمْ عَلَى ظُلْمِهِمْ فَلَيْسَ مِنِّي وَلَسْتُ مِنْهُ وَلَيْسَ بِوَارِدٍ عَلَىَّ الْحَوْضَ وَمَنْ لَمْ يَدْخُلْ عَلَيْهِمْ وَلَمْ يُعِنْهُمْ عَلَى ظُلْمِهِمْ وَلَمْ يُصَدِّقْهُمْ بِكَذِبِهِمْ فَهُوَ مِنِّي وَأَنَا مِنْهُ وَهُوَ وَارِدٌ عَلَىَّ الْحَوْضَ

তোমরা শোন, তোমরা কি শুনেছ যে আমার মৃত্যুর পরে অচিরেই এমন কিছু শাসক হবে, যারা তাদের কাছে যাবে এবং তাদের মিথ্যাচারকে সমর্থন করবে আর তাদের যুলুমে তাদের সহযোগীতা করবে তারা আমার নয় এবং আমিও তাদের নই। তারা হাওযে কাওছারে আমার কাছে পৌছাতে পারবে না। কিন্তু যারা তাদের কাছে যাবে না, তাদের যুলুমের ক্ষেত্রে তাদের সহযোগীতা করবে না এবং তাদের মিথ্যাচারের সমর্থন করবেনা তারা আমার আর আমিও তাদের, তারা হাওযে কাওছারে আমার কাছে আসতে পারবে। (তিরমিযী ২২৬২)

১৭. যে ব্যক্তি সাম্প্রদায়িকতার প্রতি মানুষকে আহবান করে…

জুবাইর ইবনু মুতই’ম থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

لَيْسَ مِنّا مَنْ دَعَا إِلَى عَصَبِيّةٍ، وَلَيْسَ مِنّا مَنْ قَاتَلَ عَلَى عَصَبِيّةٍ، وَلَيْسَ مِنّا مَنْ مَاتَ عَلَى عَصَبِيّةٍ

যে ব্যক্তি আসাবিয়াতের (সাম্প্রদায়িকতা, জাতীয়বাদ, গোত্রবাদ) দিকে ডাকে বা আসাবিয়াতের কারণে লড়াই-যুদ্ধ করে বা আসাবিয়াতের উপর মৃত্যুবরণ করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়। (আবু দাউদ ৫১২১)

যে কথাগুলো আজকের মজলিসে আলোচনা হল, আল্লাহ আমাদের সকলকে আমল করার তাওফিক দান করুন। যে কোনো অবস্থায় আমরা যেন আমাদের নবীজীর সুন্নতকে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারি, আল্লাহ আমাদের সকলকে সেই হিম্মত দান করুন। আমীন।

وہ مرد نہیں جو ڈر جائیں حالات کے خونی منظر سے

جس دور میں جینا مشکل ہو اس دور میں جینا لازم ہے

পরিবেশের কারণে যে ঘাবড়ে যায়, পিছিয়ে যায়, সে তো মর্দে মুমিন নয়। মর্দে মুমিন তো সে যে পরিবেশকে পাল্টে দেয়।

 

وَآخِرُ دَعْوَانَا اَنِ الْحَمْدُ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ

রমজানের প্রস্তুতি

রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণ করুন এখনই

বয়ান-৩: রমজানের প্রস্তুতি

اَلْحَمْدُ لِلّهِ وَكَفَى وَسَلَامٌ عَلَى عِبَادِهِ الَّذِيْن َاصْطَفَى اَمَّا بَعْدُ! فَاَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ. بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ.قُلْ بِفَضْلِ اللّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَلِكَ فَلْيَفْرَحُواْ هُوَ خَيْرٌ مِّمَّا يَجْمَعُونَ. بارك الله لنا ولكم في القرآن  العظيم ونفعني وإياكم بما فيه من الآيات والذكر الحكيم وجعلني وإياكم من الصالحين. أقول قولي هذا وأستغفر الله لي ولكم فاستغفروه إنه هو الغفور الرحيم. اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّعَلَى الِ سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّبَارِكْ وَسَلِّمْ

হামদ ও সালাতের পর!

চমৎকার দৃষ্টান্ত

সম্মানিত হাজেরিন! অসংখ্য কল্যাণ, রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের হাতছানি দিয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হতে যাচ্ছে পবিত্র রমজান মাস। মাসটির অফুরন্ত কল্যাণ বুঝাতে গিয়ে চমৎকার দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন মুজাদ্দিদে আলফেছানি রহ.। তিনি বলেন, একটি বিশাল সমুদ্র। ওই সমুদ্র থেকে আঙ্গুলের ডগায় করে যদি এগার বারে এগার ফোঁটা পানি তোলা হয়। তাহলে এগার মাসের দৃষ্টান্ত হল, এগার ফোঁটা পানি। আর গোটা সমুদ্রটাই হচ্ছে রমজানের দৃষ্টান্ত। সুতরাং আমরা কল্পনাও করতে পারব না যে, এই মাসে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কী পরিমাণ কল্যাণ দিতে চান!

এটা আশা নয়; তামাশা 

মাসটি সম্পর্কে আমাদের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি হল, যেহেতু রহমতের মাস, মাগফিরাতের মাস, নাজাতের মাস সুতরাং কোনো না কোনোভাবে মাফ তো পেয়েই যাব! এই দৃষ্টিভঙ্গি ভুল নয় তবে পরিপূর্ণ নয়। কেননা, এই মাসে আল্লাহ অবশ্যই আমাদেরকে মাফ করতে চান। তবে বিনা শর্তে নয়। শর্ত হল, إِذَا اجْتَنَبَ الْكَبَائِرَ যখন আমরা মাসটিকে কবিরা গুনাহ থেকে মুক্ত রাখব তখনই তিনি আমাদেরকে মাফ করবেন। (মুসলিম ৩৪৯)

যদি কোনো ব্যক্তি রমজানেও কবিরা গুনাহয় ডুবে থাকে আর আল্লাহর রহমতের আশা করে তাহলে হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী রহ. বলেন, এর নাম রহমতের আশা নয়; বরং এটা রহমতের সঙ্গে তামাশা। রহমতের আশা করা নিষেধ নয়; তবে তামাশা করা নিষেধ।

এজন্য বলেছি, আমাদের লালিত দৃষ্টিভঙ্গি ভুল নয় তবে পরিপূর্ণ নয়।  একে শর্ত পূরণের মাধ্যমে পরিপূর্ণ করতে হবে।

ভোগের প্রস্তুতি নয়; ত্যাগের প্রস্তুতি নিন

আবার আমরা রমজানের প্রস্তুতি বলতে বুঝি, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। কাজেই খেজুর তেল পেঁয়াজ ইত্যাদি কিনে নাও! রমজানের জন্য খাদ্য মজুদ কর! ব্যাস! এটাই রমজানের প্রস্তুতি। এটাও ঠিক নয়। কেননা, রমজানের অন্যতম শিক্ষা তো হল, ভোগের প্রস্তুতি নয়; ত্যাগের প্রস্তুতি নেয়া। ‘সাওম’ তো বলা হয়, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি ত্যাগ করাকে। অথচ আমরা ত্যাগের প্রস্তুতি না নিয়ে ভোগের প্রস্তুতি নিয়ে থাকি!

দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টান

আমি আপনাদেরকে রমজান উপলক্ষে আগে ভাগে বাজার করে নেয়া থেকে নিষেধ করছি না। তবে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর কথা বলছি। এভাবে চিন্তা করবেন যে, বাজার-সদাই করতে গেলে অনেক সময়ের প্রয়োজন হয়। তাছাড়া আজকাল মার্কেটগুলোর যে অবস্থা…চোখের হেফাজত করা মুশকিল হয়। এজন্য রমজানের আগেই এই কাজ সেরে ফেলব, যাতে সময়ের হেফাজত হয় এবং মুবারক মাসে একটু বেশি ইবাদত করা যায়। অনুরূপভাবে যাতে চোখের হেফাজত হয় এবং মাসটিকে গুনাহ থেকে মুক্ত রাখা সহজ হয়।

রাসূলুল্লাহ ﷺ রজব মাস আসলেই আমাদেরকে রিমাইন্ডার (Reminder) দিতেন যে, রমজান আসছে…। তিনি রজবের চাঁদ দেখলে দোয়া করতেন,

اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي رَجَبٍ، وَشَعْبَانَ، وَبَلِّغْنَا رَمَضَانَ

‘হে আল্লাহ!  হে আল্লাহ! রজব ও শাবান মাস আমাদের জন্য বরকতময় করুন এবং আমাদেরকে রমজান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিন।’ (তাবরানি ৩৯৩৯)

সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে এসেছে, كانوا يدعون الله تعالى ستة أشهر أن يبلغهم رمضان ‘তাঁরা ছয় মাস আগ থেকেই আল্লাহর কাছে মাসটির জন্য দোয়া শুরু করে দিতেন।’ (লাতায়িফুল মাআরিফ ১৪৮)

কে কত বড় আল্লাহর ওলি

আমাদের শায়েখ মুরশিদ মাহবুবুল ওলামা হযরত মাওলানা পীর জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী মুজাদ্দেদী দা. বা. বলেন, আগেকার দিনে কে কত বড় আল্লাহর ওলি–এটা ওজন করা হত, কে কতটা রমজান পেয়েছেন। যিনি যত বেশি রমজান পেয়েছেন তাঁকে তত বড় আল্লাহর ওলি মনে করা হত। কেননা বেশি রমাজান পেয়েছেন মানে বেশি ইবাদত করেছেন। আর বেশি ইবাদত করেছেন মানে আল্লাহর বেশি পেয়ারা হয়েছেন। সুতরাং যিনি যত বেশি রমজান পেয়েছেন তিনি তত বড় আল্লাহর ওলি হয়েছেন।

রমজানের এপিঠ-ওপিঠ

সম্মানিত মুসল্লিয়ানে কেরাম! রমজান রহমতের। আবার রমজান কিন্তু গজবেরও। কারণ এই রমজানকে কেন্দ্র করেই জিবরাইল আলাইহিসসালামের একটা বদদোয়া আছে, যে বদদোয়ার সঙ্গে নবীজি ﷺ-এর ‘আমীন’ আছে। স্থানটা ছিল মসজিদে নববি। নবীজি ﷺ ছিলেন মিম্ববের প্রথম ধাপে। জিবরাইল আলাইহিসসালাম বদদোয়া করে বসলেন, بَعُدَ مَنْ أَدْرَكَ رَمَضَانَ ، فَلَمْ يُغْفَرْ لَهُ ‘যে ব্যক্তি রমজান পেল অথচ নিজের গুনাহ মাফ করাতে পারল না, সে আল্লাহ তাআলার রহমত থেকে দূরে সরে যাক।’ আর আল্লাহর তাআলার রহমত-বঞ্চিত হওয়াটাকেই পরিভাষায় ‘গজব’ বা লানত বলা হয়। প্রতি উত্তরে নবীজি ﷺ বললেন, ‘আমীন’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! কবুল করে নিন! (বাইহাকি, শুয়াবুল ঈমান ১৬৬৮)

অপর বর্ণনায় এসেছে, জিবরাইল আলাইহিসসালাম বলেছিলেন, رَغِمَ أَنْفُ عَبْدٍ دَخَلَ عَلَيْهِ رَمَضَانُ لَمْ يُغْفَرْ لَهُ ওই ব্যক্তি ধ্বংস হোক, যে রমযান পেয়েও নিজের গুনাহ মাফ করাতে পারল না। নবীজি ﷺ বলেন, তখন আমি বললাম, আমীন। (আলআদাবুল মুফরাদ ৬৪৬)

একটু অন্তরটাকে নাড়া দিন। অনুভতিকে জাগ্রত করুন যে, যে বিষয়ে জিবরাইল আলাইহিসসালামের মত ফেরেশতা বদদোয়া করেছেন, নবীজি ﷺ ‘আমীন’ বলেছেন। তাও আবার মসজিদে নববিতে! সে বিষয়টা কতটা নাজুক ও হৃদয়স্পর্শী হতে পারে। এমনিতে নবীজি ﷺ-এর নেকদোয়া কিংবা বদদোয়া আল্লাহ তাআলার কাছে মকবুল, সেখানে আবার যুক্ত হয়েছে মসজিদে নববি–যা দোয়া কবুলের অন্যতম স্থান হিসেবে আমরা সকলেই জানি। সুতরাং রমজান পাওয়ার পরেও যে ব্যক্তি গুনাহ মাফ করতে পারবে না; না জানি সে কত বড় বদ নসিব!

রমজানের প্রস্তুতি

এজন্য আমাদের আসন্ন রমজান যেন গজব কিংবা লানতের না হয়; বরং যেন রহমত মাগফিরাত ও নাজাতের হয়–এ লক্ষে আমাদেরকে আগেই কিছু প্রস্তুতি নেয়া দরকার। সে প্রস্তুতিগুলো কী কী হতে পারে, কিভাবে হতে পারে–তা আমাদেরকে আমাদের মাশায়েখগণ কোরআন-সুন্নাহর আলোকে চিহ্নিত করে দিয়েছেন। আমাদের কাজ হল, কেবল আমলে পরিণত করা। এখন সে প্রস্তুতিগুলোর মধ্য থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতি বা পরামর্শ আপনাদের সামনে তুলে ধরছি–ইনশা আল্লাহ।

আমি আপনাদের জন্য দোয়া করি, আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন যে, আল্লাহ তাআলা যেন সকলকে আমল করার তাওফিক দেন। আমিন। তাঁরই কাছে তাওফিক প্রার্থনা করছি, যাতে আমরা রমজানের মহা মূল্যবান মুহূর্তগুলোকে নেক আমালের মাধ্যমে কাজে লাগিয়ে উপকৃত হতে পারি। আরো প্রার্থনা, যাবতীয় গুনাহ থেকে যেন বিরত থাকার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারি। 

এক. তাওবা-ইস্তেগফারের অভ্যাস করুন

এখন থেকেই অধিকহারে তাওবা-ইস্তেগফারের অভ্যাস করুন। তাওবার মূল হল, লজ্জিত হওয়া। এমনকি সহিহ বুখারীর সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুল বারীতে এসেছে, মাশায়েখগণ এও বলেছেন, يَكْفِي فِي التَّوْبَةِ تَحَقُّقُ النَّدَمِ লজ্জিত হওয়াটা পাওয়া গেলেই চলবে, তাওবা হয়ে যাবে। হাদিসেও আছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, النَّدَمُ تَوْبَةٌ লজ্জিত হওয়াটাই তাওবা। (সহিহ ইবন হিব্বান ২/৩৭৯)

সুতরাং অতীত গুনাহর ব্যাপারে এখন থেকে লজ্জিত হোন এবং তাওবা করেছি; এটা বুঝানোর জন্য অধিকহারে ইস্তেফার করুন। তাওবা করার সময় আল্লাহ তাআলার রহমতের আশা রাখুন। মনে রাখবেন, আমাদের গুনাহর চাইতে তাঁর রহমতের সংখ্যা আরো বেশি। আমরা যে পরিমাণে গুনাহ করতে পারি, তিনি এর চাইতে বেশি মাফ করতে পারেন।

সুতরাং নিজ তাওফিক অনুপাতে একটা স্ট্যান্ডার্ড সংখ্যা নির্ধারণ করে যেমন, প্রতিদিন কম পক্ষে ২০০, ৫০০, ১০০০ বার ইস্তেফার করার নিয়ত করুন। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,  إِنِّي لَأَسْتَغْفِرُ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ كُلَّ يَوْمٍ مِائَةَ مَرَّةٍ আমি প্রতিদিন আল্লাহর কাছে তাওবা-ইস্তেগফার করি এক শত বার। (মুসনাদে আহমাদ ২/৪৫০)

যিনি সম্পূর্ণ নিস্পাপ, যাঁর জীবনে গুনাহর লেশমাত্রও ছিল না, তিনি যদি প্রতিদিন এক শত বার তাওবা-ইস্তেগফার করে থাকেন তাহলে আমাদের গুনাহয় থৈ থৈ করা এ জীবনে কী পরিমাণ তাওবা-ইস্তেগফার করা দরকার! আমরা তো জমিনের যে অংশেই পা রেখেছি, সেখানেই গুনাহর সাক্ষী রেখে দিয়েছি। সুতরাং এখন থেকে তাওবার মাঝে পড়ে থাকা আমাদের জন্য আরো অনেক বেশি দরকার।

কী জঘন্য চিন্তা!

সম্মানিত হাজেরিন! আমরা অনেকেই এভাবে চিন্তা করে বসে থাকি যে, ‘রমজান আসুক, তখন তাওবা করব। এর আগে ইচ্ছে মত যত পারি গুনাহ করে মজা লুটে নেই।’ কী জঘন্য চিন্তা! এর অর্থ হল, আল্লাহ তাআলার রহমতের আশাটাকে নিজের গুনাহ করার হাতিয়ার বানিয়ে ফেললাম। এটা আল্লাহর রহমতের সঙ্গে এক প্রকার তামাশা নয় কি? এর দ্বারা আল্লাহ তাআলার অহংকারে লাগে। এজন্য খবরদার, এমন চিন্তা করবেন না; বরং এখন থেকেই অধিকহারে তাওবা-ইস্তেগফার-কান্নাকাটি শুরু করে দিন। অন্যথায় দেখবেন, উক্ত নেগেটিভ চিন্তার কারণে যদি আল্লাহ তাআলার বড়ত্বে আঘাত লেগে যায় তাহলে তিনি রহমতের মাসে রহমতের পরিবেশেও আপনাকে তাওবা করার তাওফিক দিবেন না।

দুই. আনন্দিত হোন

রমজানের আগমণে আনন্দিত হওয়া; এটাও রমজানের প্রস্তুতিরই একটি অংশ। মুমিনের বৈশিষ্ট্য হল, নেক আমল সামনে আসলে খুশি হয়। আর মুনাফিক ভ্রূ কুচকিয়ে ফেলে, সে নারাজ হয়ে যায়। এজন্য দেখবেন, রমজান আসছে–একথা শুনে অনেকেই খুশি হচ্ছেন। আবার অনেকেই নারাজ হচ্ছেন। বিশেষ করে ফুডস বা রেস্টুরেন্ট ব্যবসা থাকলে তো আর কথাই নেই। ভীষণ মনে কষ্ট তার। ডায়বেটিস রোগীও নারাজ। আমি সবার কথা বলছি না। সমাজের কিছু মানুষের কথা বলছি। রোগীর মনঃকষ্ট রোগের কারণে, ব্যবসায়ীর মনঃকষ্ট ব্যবসার কারণে, ক্রেতা বা ভোক্তার মনঃকষ্ট রমজান আসলে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে এ নিয়ে। একেকজন একেক কারণে নারাজ। বলুন তো, আল্লাহর ভয় না থাকার অভাবে ব্যবসায়ীরা এ মাসকে শোষণের হাতিয়ার বানিয়ে নিচ্ছে; এতে রমজানের কী দোষ! দয়া করে এমনটি করবেন না। বরং রমজানের আগমণে আনন্দিত হোন। ঈমানের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। আল্লাহ তাআলা তো বলেছেন,

قُلْ بِفَضْلِ اللّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَلِكَ فَلْيَفْرَحُواْ هُوَ خَيْرٌ مِّمَّا يَجْمَعُونَ
আপনি বলুন! এটা আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর রহমতেই হয়েছে। সুতরাং এতে তারা যেন আনন্দিত হয়। তারা যা কিছু সঞ্চয় করে, এটা তার চেয়ে উত্তম। (সূরা ইউনুস ৫৮)
সুতরাং আমাদের যদি কিছু বাহ্যিক ক্ষতি হয়ও, তাহলেও আমাদের উচিত আল্লাহর ওই দয়া ও মেহেরবাণীর প্রাপ্তিতে আনন্দিত হওয়া, যা তিনি এ মাসে আমাদেরকে দান করবেন। কেননা, আমাদের নগদ লাভ থেকে, বাহ্যিক সঞ্চয় থেকে সেটা অনেক উত্তম যা তিনি তাঁর খাজানা থেকে আমাদেরকে এই মাসে দান করবেন। যার নাম রহমত। যার নাম মাগফিরাত। যার নাম নাজাত। আলহামদুলিল্লাহ, আমরা তো মুমিন। সুতরাং আমাদের উচিত খুশি হওয়া। এটাই আল্লাহর নির্দেশ– فَلْيَفْرَحُواْ তাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত, তারা যেন আনন্দিত হয়। এজন্য হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,
مَا أَتَى عَلَى الْمُسْلِمِينَ شَهْرٌ خَيْرٌ لَهُمْ مِنْ رَمَضَانَ ، وَلا أَتَى عَلَى الْمُنَافِقِينَ شَهْرٌ شَرٌّ لَهُمْ مِنْ رَمَضَانَ وَذَلِكَ لِمَا يُعِّدُ الْمُؤْمِنُ فِيهِ مِنَ الْقُوَّةِ لِلْعِبَادَةِ وَمَا يُعِدُّ فِيهِ الْمُنَافِقُ مِنْ غَفَلاتِ النَّاسِ وَعَوَرَاتِهِمْ ، هُوَ غُنْمٌ لِلْمُؤْمِنِ يَغْتَنِمُهُ التَّاجِرُ
আল্লাহ তাআলার কসম! মুসলমানদের জন্য রমযানের চেয়ে উত্তম কোনো মাস আসে নি এবং মুনাফিকদের জন্য রমযান মাসের চেয়ে অধিক ক্ষতির মাসও আর আসে নি। কেননা মুমিনগণ এ মাসে (গোটা বছরের জন্য) ইবাদতের শক্তি ও পাথেয় সংগ্রহ করে। আর মুনাফিকরা তাতে মানুষের উদাসীনতা ও দোষত্রুটি অন্বেষণ করে। এ মাস মুমিনের জন্য গনীমত আর মুনাফিকের জন্য ক্ষতির কারণ। (মুসনাদে আহমদ ৮৩৬৮)
কারো যদি আনন্দিত হতে মনে না চায় তাহলে মনের বিপরীতে হলেও আনন্দিত হবেন। বলতে পারেন, সেটা কীভাবে? এভাবে যে, আনন্দিত হতে না পারার জন্য আল্লাহর কাছে তাওবা করবেন, লজ্জিত হবেন তাহলে ‘ইনশা-আল্লাহ’ আপনি আনন্দিত হয়েছেন বলে আল্লাহ গণ্য করে নিবেন।
তিন. পেছনের অনাদায়ী রোজা থেকে মুক্ত হোন
বিশেষত মা-বোনদের উদ্দেশ্যে বলছি। আমাদের জীবনেও থাকতে পারে। হয়ত বিগত বছরগুলোর কোনো রোজা হয়ত কোনো কারণে ক্বাযা হয়ে গিয়েছিল। যেগুলো এখন পর্যন্ত আদায় করা হয় নি। মা-বোনেরা এজাতীয় রোজাগুলোকে ‘ভাংতি রোজা বলে। এটা তাদের মাঝে প্রচলিত একটি বিশেষ পরিভাষা। যদি এমন কোনো রোজা থেকে যায় তাহলে সেগুলো রমজান আসার আগেই শাবান মাসের মধ্যে আদায় করে দায়মুক্ত হয়ে যান। সাহাবায়ে কেরামের জিন্দেগিতে এজাতীয় রোজা থাকলে তাঁরা শাবান মাসেই পূরণ করে দিতেন। যেমন, আয়েশা রাযি বলেন,
كَانَ يَكُونُ عَلَيَّ الصَّوْمُ مِنْ رَمَضَانَ فَمَا أَسْتَطِيعُ أَنْ أَقْضِيَهُ إِلا فِي شَعْبَانَ
আমার উপর বিগত রমজানের রোজা বাকি থাকলে শা‘বান মাসে ছাড়া আমি তা আদায় করতে পারতাম না। (বুখারী ১৮৪৯)
চার. রমজানের জরুরি ইলম শিখুন
রমজান আসার আগে রমজানের ফাযায়েল ও মাসাইলের ইলম শিখুন। কেননা আমলের আগে মাসাইলের ইলমের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এমনকি ইলম শেখা ছাড়া তো ঈমানও পরিপূর্ণভাবে শেখা হয় না। কিসের কারণে রোজা ভাঙ্গে কিংবা মাক্রুহ হয়ে যায় ইত্যাদি মাসআলা এখন থেকে শেখা শুরু করে দিন।
পরিবারের সদস্যদের রমজানের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে রোজার ফজিলতের হাদিস ও এর বিভিন্ন মাসআলা তুলে ধরে খাবারের টেবিলে বা অন্য কোনো সুযোগে প্রতিদিন কিছু সময় ঘরোয়া তালিম হতে পারে। কোনো সন্তান কোরআন তিলাওয়াত না জানলে অথবা তিলাওয়াত অশুদ্ধ থাকলে তাকে এ সুযোগে শুদ্ধ তিলাওয়াত শেখানোর ব্যবস্থা গ্রহণ মাতা-পিতার দায়িত্ব। এ জন্য রমজানের আগেই শিক্ষক ঠিক করে রাখা উচিত। অন্তত নামাজ পড়ার জন্য জরুরি পরিমাণ সুরা ও নামাজের মাসায়েল ভালোভাবে শেখানো রমজান আসার আগেই নিশ্চিত করা চাই। পরিবারের প্রত্যেক সদস্যই যেন রমজানে কোরআন তিলাওয়াতের অভ্যাস গড়ে তোলে, সে জন্য পরিবারপ্রধান তাদের উৎসাহিত করবেন। অনৈসলামিক টিভি প্রগ্রামমুক্ত পরিবার গঠনের সিদ্ধান্তও নিতে হবে রমজান থেকে। সন্তানরা যেন ফেসবুক বা টিভিতে অযথা সময় নষ্ট না করে ইবাদতে মনোযোগী হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
আমলের প্রস্তুতিও আমল

দেখুন, আমলের প্রস্তুতিও কিন্তু আমলই। যেমন এক হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,

أَلَا أَدُلُّكُمْ عَلَى مَا يَمْحُو اللَّهُ بِهِ الْخَطَايَا ، وَيَرْفَعُ بِهِ الدَّرَجَاتِ ؟ قَالُوا بَلَى يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ : إِسْبَاغُ الْوُضُوءِ عَلَى الْمَكَارِهِ ، وَكَثْرَةُ الْخُطَا إِلَى الْمَسَاجِدِ ، وَانْتِظَارُ الصَّلَاةِ بَعْدَ الصَّلَاةِ

আমি কি তোমাদেরকে এমন কাজ বলে দেব না, যার দ্বারা আল্লাহ তাআলা গুনাহগুলো মিটিয়ে দিবেন এবং জান্নাতে মর্যাদা বাড়িয়ে দিবেন? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, অবশ্যই বলুন, হে আল্লাহর রাসূল! রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, কষ্টের সময় পূর্ণরূপে ওযূ করা, মসজিদের দিকে বেশী বেশী আসা-যাওয়া করা  এবং এক নামাযের পর দ্বিতীয় নামাযের অপেক্ষা করা। (মুসলিম ৪০২)

এখানে মূল আমল কিন্তু নামায। ওযু করা, মসজিদে যাওয়া এক নামাযের পর দ্বিতীয় নামাযের অপেক্ষা করা এগুলো হল, নামাযের প্রস্তুতি। অথচ রাসূলুল্লাহ ﷺ এগুলোর জন্যও সাওয়াব নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এতে বুঝা গেল, আমলের প্রস্তুতিও আল্লাহ তাআলার দরবারে আমল হিসেবেই গণ্য হয়। এমনকি প্রস্তুতি পর্বেও আমলের সমান সাওয়াব পাওয়া যায়। যেমন রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, أَمَا إِنَّكُمْ فِي صَلاَةٍ مَا انْتَظَرْتُمُوهَا শোন! তোমরা যতক্ষণ সালাতের অপেক্ষায় ছিলে ততক্ষণ তোমরা সালাতেই ছিলে। (বুখারী ৫৫৬)
সুতরাং যদি আমরা রমজান আসার আগে রমজানের ফাযায়েল ও মাসাইলের ইলম শিখি তাহলে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে রমজানের রহমত দিয়ে দিবেন এবং রমজান আসার আগেই আমরা রমজানের ফজিলত পাওয়া শুরু করব–ইনশাআল্লাহ।
পাঁচ. রমজানে হালাল খানার ফিকির করুন
হাদিসে শরিফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزّورِ وَالعَمَلَ بِهِ، فَلَيْسَ لِلهِ حَاجَةٌ فِي أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ
ব্যক্তি রোযা অবস্থায় মিথ্যাচারিতা ও মন্দ কাজ করা পরিত্যাগ করেনি তার পানাহার পরিত্যাগের কোনোই গুরুত্ব আল্লাহর কাছে নেই। আল্লাহ তাআলা তার পানাহার ত্যাগ করার কোনোই পরোয়া করেন না। (বুখারী ১৯০৩)
আমাদের জীবনের একটি বড় ধরণের মিথ্যাচারিতা ও মন্দ কাজের নাম হল, হারাম খাওয়া। অন্তত রমজানকে এ থেকে পবিত্র রাখি। এমনিতে হারাম তো সর্বাবস্থায় বর্জনীয়। কিন্তু কিছু মানুষ আছে এমন এরা হারামের মধ্যে যেন ‘সুপার গ্লু’র মত আটকে আছে। এদেরকে হারাম বর্জনের নসিহত যতই শোনান না কেন; কানে নিবে না। এদের প্রতি আমাদের মাশায়েখগণের একটা কাকুতিপূর্ণ নসিহত হল, আল্লাহর বান্দা, অন্ততে রমজানে সেভ জোনে থাকো। পরিবারকে হারাম থেকে পবিত্র রাখো। রমজানে রহমত কুড়াতে না পারলেও গজব আহবান করো না। এজন্য প্রয়োজনে রমজানে তোমার কত টাকা খরচ হতে, হিসাব করে ওই পরিমাণ টাকা কারো কাছ থেকে ঋণ নাও এবং ওই টাকাগুলো রমজানে পরিবারের জন্য খরচ কর। তবুও গুনাহ ও হারামমুক্ত রমজান কাটাও এবং নবীজি ﷺ ও জিবরাইল আলাইহিসসালামের বদ দোয়া থেকে আত্মরক্ষা কর।
ছয়. আরো কিছু প্রস্তুতি
রমজান কোরআন নাজিলের মাস। এজন্য এ মাসের অন্যতম আমল হল, কোরআন তেলাওয়াত করা। আমরা অনেকেই ভাবছি, রমজান আসলে খুব তেলাওয়াত করব। আসলে এরকম সাধারণত হয়ে ওঠে না; বরং অভ্যাস থাকতে হয়। এজন্য আজ থেকে কিছু কিছু তেলাওয়াতের অভ্যাস করুন।
যে বদ অভ্যাস হঠাৎ ছেড়ে দেয়া কঠিন হবে বলে মনে করেন, তা দূর করার অনুশীলন এখন থেকেই শুরু করে দিন।
এখন থেকে কিছু জিকিরের, কিছু দোয়া ও কান্নাকাটির প্র্যাকটিস শুরু করে দিন। অন্যথায় পরে কষ্ট হবে।
আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রত্যেককে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

وَآخِرُ دَعْوَانَا اَنِ الْحَمْدُ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ

তাকওয়ার মাসে তাকওয়ার অনুশীলন

তাকওয়ার মাসে তাকওয়ার অনুশীলন

বয়ান-৪ : তাকওয়ার মাসে তাকওয়ার অনুশীলন

اَلْحَمْدُ لِلّهِ وَكَفَى وَسَلَامٌ عَلَى عِبَادِهِ الَّذِيْن َاصْطَفَى اَمَّا بَعْدُ! فَاَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ. بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ.فَإِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ. بارك الله لنا ولكم في القرآن  العظيم ونفعني وإياكم بما فيه من الآيات والذكر الحكيم وجعلني وإياكم من الصالحين. أقول قولي هذا وأستغفر الله لي ولكم فاستغفروه إنه هو الغفور الرحيم. اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّعَلَى الِ سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّبَارِكْ وَسَلِّمْ

হামদ ও সালাতের পর!

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য, তিনি আমাদেরকে জুমার নামাজ আদায়ের লক্ষে মসজিদে আসার তাওফিক দান করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ।

রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করুন

সম্মানিত হাজেরিন! আর কয়েক দিন পরই শুরু হবে রমজান মাস। মাসটিকে কেন্দ্র করে এখন থেকেই দেখা যাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের বিভিন্ন ধরণের আয়োজন ও আহবান। এখন থেকেই তারা বিভিন্ন ধরণের বিভিন্ন সাইজের বিভিন্ন কালারের পোস্টার ও লিফলেট বিতরণ করবে। ‘রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করুন’ শিরোনামে আমাদেরকে বিভিন্ন পরামর্শ দিবে। এটা ভালো। খারাপ নয়। আমরা  মুসলিম সমাজে যে বসবাস করছি; এটা তার কিঞ্চিৎ নমুনা।  আমাদের সালাফগণও আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন, যেন মাসটির পবিত্রতা রক্ষা করা যায়। তাবিয়ী ইয়াহইয়া ইবনু আবী কাছীর রহ. বলেন, রমজানের আগমণে সালফে সালিহীন আল্লাহর কাছে এভাবে দোয়া করতেন,

اَللَّهُمَّ سَلِّمْنـِيْ إِلَى رَمَضَانَ وَسَلِّمْ لِـيْ رَمَضَانَ وَتَسَلَّمْهُ مِنِيْ مُتَقَبَّلاً

হে আল্লাহ! আমাকে রমজান পর্যন্ত নিরাপদ রাখুন। রমজানকে আমার জন্য নিরাপদ করুন এবং রমজানের আমলগুলো কবুল করে আমার কাছ থেকে রমজানকে বিদায় করুন। (লাতায়েফুল মাআরিফ ১৪৮)

রোজার মূল মাকসাদ

আসলে এই মাসে রোজা পালন করার মূল মাকসাদ হল, তাকওয়া অর্জন করা। রোজা সংক্রান্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা এটাই বলেছেন যে, لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ যাতে করে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার। রাসুলুল্লাহ ﷺ-ও এটাই বুঝিয়েছেন। এজন্য তিনি বলেন,

لَيْسَ الصِّيَامُ مِنَ الأَكْلِ وَالشُّرْبِ ، إِنَّمَا الصِّيَامُ مِنَ اللَّغْوِ وَالرَّفَثِ

পানাহার থেকে বিরত থাকার নাম রোজা নয়। আসলে রোজা হল, অসার ও অশ্লীল কথা ও কর্ম থেকে বিরত থাকার নাম। (সহিহ ইবনু খুযাইমা ১৯৯৬)
সুতরাং যে ব্যক্তি এই মাসে তাকওয়ার অনুশীলন করতে পারবে না, সে ব্যর্থ হবে। রমজান আসল অথচ সে যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেল তাহলে সে রমজানের বেনিফিড লাভ করতে পারে নি।
আমাদের মাঝে তাকওয়া আছে কিনা?
এজন্য আজ ইনশাআল্লাহ তাকওয়ার পরিচয় ও আলামত নিয়ে কিছু কথা বলা হবে। আমাদের আকাবির-আসলাফ তাকওয়া বলতে কী বুঝতেন? একজন ব্যক্তির মাঝে তাকওয়া আছে কিনা; তার আলামত কী? শুধু এই দুটি বিষয় নিয়ে আজ আলোচনা করা হবে। তাকওয়ার উপাকারিতা ইত্যাদি নিয়ে আজ আলোচনা করার সুযোগ হবে না। উদ্দেশ্য হল, প্রথমত, যাতে আমরা নিজেদেরকে একটু যাচিয়ে-খতিয়ে দেখতে পারি, আসলে আমাদের মাঝে তাকওয়া আছে কিনা? দ্বিতীয়ত, যদি না থাকে তাহলে যেন আজ থেকে এর অনুশীলন শুরু করতে পারি, তাওবা করে তাকওয়ার জীবন যাপনের প্রতি যত্নশীল হতে পারি। সর্বোপরি আসন্ন রমজান যেন রহমতের রমজান হিসেবে গ্রহণ করতে পারি এবং লানতের রমজান থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে তাকওয়ার জিন্দেগি দান করুন। আমীন।
মূলত তাকওয়া তো এমন এক সম্পদ, যে ব্যক্তি এটি অর্জন করতে পারে আল্লাহ তাআলা তাঁর জন্য হয়ে যান। সে মহান মালিকের ভালোবাসার পাত্র হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন, فَإِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকিদেরকে ভালোবাসেন। (সূরা আলি ইমরান ৭৬)
কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হবে
মুহতারাম হাজেরিন! মানুষ দুনিয়ার সামান্য ক্ষণস্থায়ী ভালোবাসার জন্য কত কিছু করে। কত সেক্রিফাইজ করে! চিন্তা করে দেখুন, একজন মানুষ ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করতে রাতে বিছানায় যাওয়ার আগ পর্যন্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কী পরিমাণ কায়িক পরিশ্রম করে! এত ত্যাগ এত সংগ্রাম এত কুরবানি শুধু এজন্যই তো যে, সে তার বিবি-বাচ্চাকে মহব্বত করে, ফ্যামিলিকে ভালোবাসে। অন্যথায় একজন মানুষ শুধু নিজে চলার জন্য তো এত পরিশ্রমের প্রয়োজন হয় না। সুতরাং দুনিয়ার এই ক্ষণস্থায়ী মহব্বতের তাড়নায় তাড়িত হয়ে যদি আমরা এত কিছু করতে পারি তাহলে আল্লাহ তাআলার চিরস্থায়ী মহব্বতের জন্য কি একটুও কষ্ট স্বীকার করতে পারব না? আল্লাহ তাআলা তো বলেছেন, আমি মুত্তাকিদেরকে ভালোবাসি। অতএব তাঁর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আমাদেরকেও কিছু কুরবানি করতে হবে। কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। কিছু আরাম বিসর্জন দিতে হবে। আমরা সকলেই ইনশাআল্লাহ  এর জন্য প্রস্তুত আছি তো? প্রত্যকেই দৃঢ়তার সাথে বলি—ইনশাআল্লাহ প্রস্তুত আছি।
আল্লাহর ভালোবাসাই চিরস্থায়ী
একজন মুমিন হিসেবে আমাদেরকে এটা বুঝতে হবে যে, আল্লাহর ভালোবাসাই চিরস্থায়ী। এছাড়া সকল ভালোবাসা ক্ষণস্থায়ী। আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় হাবীবকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
يَا مُحَمَّدُ ، عِشْ مَا شِئْتَ فَإِنَّكَ مَيِّتٌ ، وَأَحْبِبْ مَنْ أَحْبَبْتَ فَإِنَّكَ مَفَارِقُهُ
হে মুহাম্মাদ! যতদিন খুশী জীবন যাপন করুন। কিন্তু মনে রাখবেন, আপনাকে একদিন মরতেই হবে। যার সাথে খুশী বন্ধুত্ব করুন, ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তুলুন। কিন্তু মনে রাখবেন, আপনাকে একদিন পৃথক হতেই হবে। (মুসতাদরাকি হাকেম ৭৯২১)
আল্লাহর আরেফ বলেন,

أَلاَ يَا سَاكِنَ الْقَصْرِ الْمُعَلَّى + سَتُدْفَنُ عَنْ قَرِيْبٍ فِى التُّرَابِ

قَلِيْلُ عُمْرُنَا فِي دَارِ دُنْيَا + وَمَرْجَعُنَا إِلَى بَيْتِ التُّرَابِ

‘শোন হে সুউচ্চ প্রাসাদে বসবাসকারী! সত্বর তুমি দাফন হবে মাটিতে। ইহকালে আমরা আমাদের জীবনের অল্প সময়ই কাটিয়ে থাকি। আর আমাদের প্রত্যাবর্তন স্থল হল মাটির ঘরে (কবরে)।’

আল্লাহ তাআলা বলেন,

كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ * وَيَبْقَى وَجْهُ رَبِّكَ ذُو الْجَلالِ وَالإِكْرَامِ
এই মহা বিশ্বের সবকিছুই ধ্বংসশীল। একমাত্র আপনার মহিমায় ও মহানুভব পালনকর্তার সত্তা ছাড়া। (সূরা আর রাহমান ২৬,২৭)
মালিককে ভালোবাসবো
আল্লাহর বান্দারা! সুতরাং আমরা আমাদের মালিককে ভালোবাসবো। এটাই আমাদের জন্য মরণের আগেও কাজে আসবে এবং মরণের পরেও কাজে আসবে। যদি আমরা তাকওয়া অর্জন করে তাঁর মহব্বত লাভে সৌভাগ্যবান হতে পারি, তাহলে তিনি আমাদের দুনিয়াও দেখবেন, আখেরাতও দেখবেন। আমাদের সকল পেরেশানি, সকল আহাজারি তিনি একজন অভিবাকের মত; বরং পরম বন্ধুর মত কিংবা একসঙ্গে মিলিয়ে বলতে পারি যে, অভিবাবক-বন্ধুর মত দেখবেন, শুনবেন এবং মুক্তি ও সমাধানের রাস্তাও দেখিয়ে দিবেন। এমনকি যা কোন চোখ কখনো দেখে নি, কান কখনো শুনে নি, মানুষের হৃদয় কখনো কল্পনা করে নি—এমন এক জগতের মেহমান বানিয়ে তাঁর দিদার দ্বারা সম্মানিত করবেন।
শেষ হাসিটা মুত্তাকিরাই হাঁসবে
সামনে রমজান আসছে। তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলাকে মানিয়ে নেয়ার সবচেয়ে সুন্দর সময়। এই তাকওয়াই আমাদেরকে আমাদের মালিকের কাছে নিয়ে যেতে পারবে, তাঁর প্রিয় বানিয়ে দিতে পারবে। যার কারণে যুগে যুগে সকল নবী নিজেদের উম্মতকে এই তাকওয়া অর্জনের তাগিদ দিয়ে গেছেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِذْ قَالَ لَهُمْ أَخُوهُمْ نُوحٌ أَلَا تَتَّقُونَ
إِذْ قَالَ لَهُمْ أَخُوهُمْ هُودٌ أَلَا تَتَّقُونَ
إِذْ قَالَ لَهُمْ أَخُوهُمْ صَالِحٌ أَلَا تَتَّقُونَ
إِذْ قَالَ لَهُمْ أَخُوهُمْ لُوطٌ أَلَا تَتَّقُونَ
إِذْ قَالَ لَهُمْ شُعَيْبٌ أَلَا تَتَّقُونَ

এ সকল আয়াতে বলা হয়েছে নুহ হুদ সালিহ লুত শুয়াইব আলাইহিহিমুস সালামসহ সকল নবী নিজ জাতিকে তাকওয়ার তাগিদ দিয়েছেন।

আল্লাহ তাআলা কোরআন মজিদে তাকওয়ার কথা বলেছেন, একবার নয় , দুইবার নয়; দুইশত আটান্ন বার বলেছেন। তন্মধ্য থেকে সর্ব মোট ৭৬ বার আমাদেরকে  اتَّقُوا বলে সরাসরি তাকওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিরমিযির হাদিসে এসেছে, আমাদের নবীজী ﷺও বলেন, اتَّقِ اللَّهِ حَيْثُمَا كُنْتَ ‘তুমি যেখানেই থাকবে তাকওয়া নিয়ে থাকবে।’ তাকওয়া যেন তোমার চব্বিশ ঘণ্টা সময়ের প্রতিটি সেকেন্ডের জন্য নিত্যসঙ্গী হয়। কেন? কারণ হল, فَإِنَّ خَيْرَ الزَّادِ التَّقْوَىٰ সবচেয়ে দামি সম্পদ হচ্ছে তাকওয়া। বুজুর্গানে দীন তো আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন এভাবে যে, ‘হে আল্লাহ! ওই সেকেন্ড থেকে পানাহ চাই যে সেকেন্ডে আপনার স্মরণ আমার অন্তরে নেই।’ হাদিস শরিফেও এজাতীয় দোয়া শিক্ষা দেয়া হয়েছে।  فَلَا تَكِلْنِي إِلَى نَفْسِي طَرْفَةَ عَيْنٍ হে আল্লাহ! আমাকে আমার নফসের কাছে চোখের এক পলকের জন্যও ছেড়ে দিবেন না।’ আল্লাহ বিভিন্ন আয়াতে বার বার বলেছেন, শেষ হাসিটা মুত্তাকিরাই হাঁসবে। وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ আর শেষ ফল তো যারা মুত্তাকী তাঁদের জন্যই। মুত্তাকিরাই জান্নাতের মেহমান হবে। সেখানে তাঁর সঙ্গে দীদারের মহান সুযোগ পাবে। إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللَّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ আল্লাহ তো মুত্তাকিদেরকেই কবুল করেন।

وہ دل ہی کیا جو ترے ملنے کی دعا نہ کرے
میں تجھ کو بھول کے زندہ رہوں خدا نہ کرے

‘যে অন্তর প্রিয়তমের সঙ্গে সাক্ষাতের কামনা করবে না, সেটা তো অন্তরই নয়। প্রিয়তম! আমি তোমাকে ভুলে গিয়ে জীবিত থাকব; আল্লাহ না করুন এমনটি যেন না হয়।’

তাকওয়ার জিন্দেগি গঠন করুন 

আল্লাহর বান্দারা! সুতরাং আমরা তাকওয়ার মাসে তাকওয়ার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিব। এ দুনিয়া তামাশার জায়গা নয়। আল্লাহকে ভুলে গিয়ে জিন্দেগি কাটাবেন তো আফসোস ছাড়া কিছুই পাওয়া যাবে না। যাদেরকে নিয়ে আমাদের সঙ্গ ও স্বপ্ন তারা কোনো উপকারে আসবে না। অতএব, আজ থেকে দৃঢ় সংকল্প করুন, প্রয়োজনে কষ্ট স্বীকার করব, আশা-আকাঙ্খাগুলোকে মাটি দিয়ে দিব, মজা ও বিনোদন ত্যাগ করব। তবুও তাকওয়ার জিন্দেগি তথা আল্লাহকে পাওয়ার জিন্দেগি বানাবো। এই দিল ও দেমাগে আল্লাহর ভয় ও মহব্বত সর্বদা জাগরুক রাখব। হাদিস শরিফে এসেছে,

التَّقْوَى هَاهُنا

তাকওয়ার অবস্থান দিলে। তাকওয়া দিলে থাকে। সুতরাং এই দিল তৈরি করতে হবে। দিলের সব জঞ্জাল দূর করে সেখানে আল্লাহভীতি ঢুকাতে হবে। আল্লাহর আরেফ বলেন,

نہیں دل میں داغ تمنا بھی باقی

انہیں پر سے ان کی نشانی لٹا دی

‘দিলে নেই তামান্নার কোনো নিশানা; তাঁর জন্যই সব মুছে ফেলেছি।’

তাকওয়া বলতে আমরা যা বুঝি 

মুহতারাম হাজেরিন! এবার আসুন, একটি খতিয়ে দেখি, আমি কি মুত্তাকি? যে তাকওয়ার কথা এতক্ষণ পর্যন্ত বলা হল, যার নির্দেশ আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ছিয়াত্তর বার সরাসরি কোরআন মজিদে দিয়েছেন, সকল নবী তাঁর উম্মতকে যে তাকওয়া অর্জনের কথা বলতেন, অসংখ্য হাদিসে আমাদের নবীজী যে তাকওয়া অবলম্বনের কথা বলেছেন; তা কি আমাদের মাঝে আছে? এর জবাব পেতে হলে সালফে সালেহীন; যারা তাকওয়ার জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন; তারা তাকওয়া বলতে কী বুঝতেন–তা আমাদেরকে জানতে হবে। তাঁদের দেয়া তাকওয়ার সংজ্ঞার সাথে আমাদের যাপিত জীবনকে মিলালেই প্রকৃত সত্য বের হয়ে আসবে যে, আমরা আসলে কতটুকু মুত্তাকি! আমরা তাকওয়া বলতে কী বুঝি আর তাঁরা কী বুঝতেন?

এমনিতে তাকওয়া বলতে আমরা বুঝি, আল্লাহভীতি বা আল্লাহর ভয়। হ্যাঁ, এটা তাকওয়ার ভুল পরিচয় নয়। কিন্তু কেবল কি এতটুকু? না এর আরো ব্যাখ্যা আছে? আমাদের এই অসম্পূর্ণ বুঝের কারণে আমাদের মধ্য থেকে কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয়, তুমি কি আল্লাহকে ভয় কর? তখন সে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিবে, হ্যাঁ, করি তো! অথচ তার বাস্তব জীবন কিন্তু তাকওয়া থেকে অনেক দূরে। বাস্তব জীবনে হয়ত তার মাঝে তাকওয়া বলতে কিছুই নেই। গুনাহর মাঝে ডুবে থাকা এবং আমল থেকে দূরে থাকার মাঝেই হয়ত সে জীবনের স্বার্থকতা খুঁজে নিয়েছে। তাকওয়ার পথের পথিক হওয়া তো দুরের কথা, বাস্তবে সে হয়ত এই পথ কখনও মাড়ায়ই নি। অথচ দেখুন, সালফে সালেহীন তাকওয়া বলতে কী বুঝতেন!

সালফে সালেহীনের দৃষ্টিতে তাকওয়া

— আলী রাযি. বলতেন,

هِي الْخَوْفُ مِنَ الْجَلِيلِ، وَالْعَمَلُ بِالتَّنْزِيلِ، وَالْقَنَاعَةُ بِالْقَلِيلِ، والاستعداد لِيَوْمِ الرَّحِيلِ

অর্থাৎ, তাকওয়া হল চারটি বিষয়।  এক. আল্লাহর ভয়। দুই. কোরআনে যা নাযিল হয়েছে তদানুযায়ী আমল। তিন. অল্পে তুষ্টি। চার. শেষ দিবসের জন্য সদা প্রস্তুতি।

তিনি এও বলতেন, المُتّقي مَنْ اتّقى الذُّنوب যে ব্যক্তি গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে, সেই মুত্তাকি। এটাও বলতেন, عِنْدَ حُضُورِ الشَّهَوَاتِ وَاللَّذَّاتِ يَتَبَيَّنُ وَرَعُ الْأتقياءِ প্রবৃত্তির কামনা ও মজার তাড়না সামনে আসলে প্রকৃত মুত্তাকিদের পরহেজগারি প্রকাশ পায়। এও বলতেন, رَأْسُ التَّقْوَى تَركُ الشَّهْوَةَ তাকওয়ার মূল হচ্ছে, প্রবৃত্তির কামনা ত্যাগ করা।

ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব রাযি. একদিন উবাই ইবনু কা‘ব রাযি.-কে তাকওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। উবাই রাযি. বললেন, أَمَا سَلَكْتَ طَرِيقًا ذَا شَوْكٍ؟ ‘আপনি কি কাঁটা যুক্ত পথে চলেননি? ওমর রাযি. বললেন, হাঁ। উবাই রাযি. বললেন, فَمَا عَمِلْتَ فِيهِ ؟ কিভাবে চলেছেন? ওমর রাযি.  বললেন, تَشَمَّرْتُ وَحَذِرْتُ খুব সাবধানে ও কষ্ট করে চলেছি। উবাই রাযি. বললেন, فَذَلِكَ التَّقْوَى ‘ওটাই হল তাকওয়া। অর্থাৎ দুনিয়ার জীবনে নিজেকে সমস্ত গুনাহ থেকে এভাবে বেঁচে চলাই হল তাকওয়া।   

— অনুরূপ প্রশ্ন এক ব্যক্তি আবু হুরায়রা রাযি.-কে করেছিলেন যে, তাকওয়া কাকে বলে? তিনি বললেন,أَخَذْتَ طَرِيْقًا ذَا شَوْكٍ؟ তুমি কি কখনো কাঁটাযুক্ত পথে চলেছ? লোকটি বলল, হাঁ। তিনি বললেন, فَكَيْفَ صَنَعْتَ؟ কিভাবে চলেছ? লোকটি বলল, إِذَا رَأَيْتُ الشَّوْكَ عَدَلْتُ عَنْهُ أَوْ جَاوَزْتُهُ أَوْ قَصُرْتُ عَنْهُ আমি কাঁটা দেখলে তা এড়িয়ে চলি। অথবা ডিঙিয়ে যাই অথবা দূরে থাকি। আবু হুরায়রা রাযি. বললেন, ذَاكَ التَّقْوَى এটাই হল তাকওয়া।

— আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাযি. বলেন,

أَنْ يُطَاعَ فَلا يُعْصَى , وَأَنْ يُذْكَرَ فَلا يُنْسَى , وَأَنْ يُشْكَرَ فَلا يُكْفَرَ

তাকওয়া হচ্ছে, আল্লাহ্‌র আনুগত্য করা- নাফরমানি না করা, তাঁকে স্মরণ করা- ভুলে না যাওয়া, তাঁর কৃতজ্ঞতা করা- কুফরী না করা।

— ওমর ইবনু আব্দুল আজিজ রহ. বলেন,

لَيْسَ تَقْوَى اللَّهِ بِصِيَامِ النِّهَارِ ، وَلا بِقَيَامِ اللَّيْلِ ، وَالتَّخْلِيطِ فِيمَا بَيْنَ ذَلِكَ ، وَلَكِنَّ تَقْوَى اللَّهِ تَرْكُ مَا حَرَّمَ اللَّهُ ، وَأَدَاءُ مَا افْتَرَضَ اللَّهُ ، فَمَنْ رُزِقَ بَعْدَ ذَلِكَ خَيْرًا فَهُوَ خَيْرٌ إِلَى خَيْرٍ

দিনে রোজা রাখা আর রাতে নফল নামাজ আদায় এবং এর মাঝে আজেবাজে চলার নাম তাকওয়া নয়; বরং প্রকৃত তাকওয়া হচ্ছে, আল্লাহ্‌ যা হারাম করেছেন তা পরিত্যাগ করা, তিনি যা ফরয করেছেন তা বাস্তবায়ন করা। কেউ যদি এর অতিরিক্ত কিছু করতে পারে তবে সোনায় সোহাগা।

ওমর ইবনু আব্দুল আজিজ রহ.-কে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন,متَى يبلغُ العَبْدُ سنامَ التَقوى؟ বান্দা তাকওয়ার উচ্চ শিখরে কখন পৌঁছে? তিনি উত্তর দিলেন,

إذا وضَعَ جميعَ ما في قلبِهِ من الخَواطرِ في طَبَقٍ ، وطافَ به في السّوقِ لم يستَحِ من شيءٍ فيه إذْ قلبُهُ طاهرٌ مِن بواطنِ الإثمِ

যখন বান্দা তার অন্তরের যা আছে তার সবই একটি প্লেটে সাজিয়ে যদি বাজারে ঘুরে এবং এর কারণে যদি তাকে মোটেও লজ্জিত হতে না হয় তাহলে তার অন্তর গোপন গুনাহসমূহ থেকে পবিত্র এবং সে তাকওয়ার উচ্চ শিখরে উপনীত।

 — তালাক ইবনু হাবীব রহ. বলেন, যখন ফেতনার আগুন দেখা দিবে তখন তা তাকওয়া দ্বারা নিভিয়ে দিবে। শাগরিদরা জিজ্ঞেস করল, তাকওয়া কী? তিনি উত্তর দিলেন,

أنْ تَعمل بطاعةِ اللَّهِ على نُورٍ من الله، تَرجو ثوابَ الله، وأن تَتركَ مَعصيةَ اللهِ على نُورٍ من الله تَخاف عقابَ الله

আল্লাহপ্রদত্ত হেদায়েত দিয়ে আল্লাহর আনুগত্য করবে, এর মাঝে সাওয়াবের আশা করবে। আর আল্লাহপ্রদত্ত হেদায়েত দিয়ে আল্লাহর নাফরমানি ত্যাগ করবে, এ ক্ষেত্রে আল্লাহর আযাবের ভয় করবে।

— জনৈক বুজুর্গ বলেন,

البكاءُ بَيْنَ يَدي اللَّهِ تَقْوَى و الشَّكوى لِغيره مذلة . هل فكّرت يوما أنّكَ غالية على اللَّهِ

আল্লাহর সামনে কাঁদার নাম তাকওয়া। অন্যের সামনে অভিযোগ করার নাম জিল্লতি। তুমি কি একটা দিন ভেবে দেখেছ যে, তুমি আল্লাহর ব্যাপারে অতিরঞ্জনে লিপ্ত!

— আমাদের শায়েখ ও মুরশিদ মাহবুবুলওলামা পীর জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী মুজাদ্দেদী দা. বা. বলেন, কোনো গোলাম যদি তার মালিকের সকল আদেশ মেনে চলে এবং সকল নিষেধ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে তাহলে মালিক তার উপর সন্তুষ্ট হয়ে যায়। অনুরূপভাবে বান্দা যখন আল্লাহ তাআলার আদেশ ও নিষেধ শুনবে এবং তদনুযায়ী জীবন যাপন করবে তাহলে এরই নাম তাকওয়া। আল্লাহ তাআলা তখন ওই বান্দার ওপর সন্তুষ্ট হয়ে যান এবং তাঁকে ভালবাসেন। 

জগতের সব পেয়েছ কেবল আল্লাহকে পাও নি; তুমি কিছুই পাও নি

আল্লাহর বান্দারা! তাকওয়ার যে পরিচয়গুলো আমাদের সামনে এসেছে, এর আলোকে প্রত্যেকেই নিজেকে প্রশ্ন করি, আপনি আপনাকে প্রশ্ন করেন, আমি আমাকে প্রশ্ন করি, আসলেই কি আমার আর আপনার মাঝে তাকওয়া আছে? আমরা কি আসলে মুত্তাকিদের কাতারে পড়ি? আমাদের কাছে সবই আছে, কেবল আল্লাহ নেই, আল্লাহর ভয় নেই, তাঁর প্রতি পরিপূর্ণ মহব্বত নেই।

اس شہر میں سب کچھ ہے بس اک تیری کمی ہے

‘এই শহরে সবই আছে, কেবল শুধু তুমি নেই।’ তো আসলে আমাদের মাঝে কিছুই নেই। মুজাহিদে মিল্লাত শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. বলতেন, তুমি জগতের সব পেয়েছ কেবল আল্লাহকে পাও নি তাহলে তুমি কিছুই পাও নি। আর তুমি জগতের কিছুই পাও নি তবে আল্লাহকে পেয়েছ তাহলে মূলত তুমি সব কিছুই পেয়েছ। আমাদের দেশের বরেণ্য আলেমে দীন মুফতি দেলাওয়ার হুসাইন দা. বা.-কে এক বার মুনাজাতে বলতে শুনেছি, হে আল্লাহ! আপনি আমাদের হয়ে যান এবং আমাদেরকে আপনার বানিয়ে নিন। আজ আমাদের মাঝে এই সম্পদেরই অভাব। যার কারণে আমাদের কাছে সব থাকার পরেও শান্তি নেই, নিরাপত্তা নেই। সব আছে, এরপরেও হাহাকার কমে না, অভাব দূর হয় না।

আসুন, আল্লাহর রঙ্গে রঙ্গিন হই

এজন্য আল্লাহর বান্দারা! এখন সংক্ষেপে তাকওয়ার কিছু আলামত বলে দিচ্ছি। আমরা ইনশাআল্লাহ চেষ্টা করব যেন এই আলামত বা গুণগুলো নিজেদের মাঝে নিয়ে আসা যায়। সামনে রমজান আসছে, যেন এমন হয় যে, এই রমজানেই আমরা নিজেদেরকে মুত্তাকিদের কাতারে শামিল করে নিতে পারি। এজন্য দীর্ঘ অনুশীলন বা প্রশিক্ষণ জরুরি। আল্লাহঅয়ালাদের সোহবত প্রয়োজন। তাই চেষ্টা এখন থেকেই শুরু করতে হবে। আল্লাহঅয়ালাদের কাছে যেয়ে যেয়ে এই গুণগুলোর রঙ্গে রঙ্গিন হতে হবে। এটা মূলত আল্লাহর নূর বা তাঁর রঙ।

صِبْغَةَ اللَّهِ ۖ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ صِبْغَةً ۖ وَنَحْنُ لَهُ عَابِدُونَ

আমরা আল্লাহর রঙ গ্রহণ করেছি। আল্লাহর রঙ এর চাইতে উত্তম রঙ আর কার হতে পারে? আমরা তাঁরই ইবাদত করি। ( সূরা বাকারা ১৩৮)

دم كے دم میں قلب نورانی ہوئی

مرد حق سے ملکے حقا نی ہوئی

ধীরে ধীরে অন্তর আলোকিত হয়েছে, আল্লাহঅয়ালার সঙ্গে মিলে হক্কানি হয়েছে।

যাই হোক, তাকওয়ার আলামত অনেক। তন্মধ্য থেকে আমাদের মাশায়েখগণ দশটি আলামত বিশেষভাবে উল্লেখ করে থাকেন। যেগুলো এই–

তাকওয়ার দশ আলামত

. যাবতীয় গুনাহ থেকে দূরে থাকা

الابتعاد عن معاصي الله অর্থাৎ যাবতীয় গুনাহ থেকে দূরে থাকা। এটা করতে পারলে আমরা ইনশাআল্লাহ মুত্তাকি হতে পারব। অনেকে বলেন, বর্তমান পরিবেশটাই হল, গুনাহর পরিবেশ। এই পরিবেশে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা অসম্ভব। আসলে এ জাতীয় কথা তারাই বলে থাকে, যারা মনে করে পরিবেশ পাওয়া গেলে গুনাহ ছাড়ব; অন্যথায় নয়। এরা মূলত গুনাহ ছাড়ে পরিবেশের জন্য; আল্লাহর জন্য নয়। কারণ যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য গুনাহ ছাড়ে, সে পরিবেশের অজুহাত দেয় না। মর্দে মুমিন তো হল সেই যে গুনাহর পরিবেশেও গুনাহ ছাড়তে পারে।

. ইবাদতের প্রতি লালায়িত থাকা

الحرص على طاعات الله অর্থাৎ ইবাদতের প্রতি লালায়িত থাকা। বিশেষত নামাযের প্রতি লালায়িত থাকা। এজন্য অনেকে এক্ষেত্রে বলেছেন, إقامة الصلاة বা নামাজ কায়েম করা। অর্থাৎ পুরুষ হলে মসজিদে জামাতের সঙ্গে নামায আদায় করা। আর নারী হলে ওয়াক্তের শুরুতে নামাজ আদায় করে নেয়া। এ বিষয়ে অলসতা উদাসীনতা কিংবা শীথিলতা প্রদর্শন না করা।

. আল্লাহর নিদর্শনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন

تعظيم شعائر الله অর্থাৎআল্লাহর শাআয়ের তথা নিদর্শনসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। যে সকল কথা ও কাজ এবং স্থান ও সময়কে আল্লাহ তাআলা ইসলামের জন্য নিদর্শন বা প্রতীক নির্ধারণ করেছেন, এগুলোকে আল্লাহর শাআয়ের বলা হয়। এগুলো মূলত আল্লাহ তাআলার কুদরত ও রহমতের নিদর্শন এবং ইসলামের প্রতীক। এগুলো অনেক। তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল চারটি–১. কালামুল্লাহ বা কোরআন মজিদ ২. বাইতুল্লাহ ৩. রাসূলুল্লাহ ﷺ ৪. আল্লাহ তাআলার সকল ইবাদত-বন্দেগী। বিশেষত কালিমা, নামায, যাকাত, সওম, হজ্ব ইত্যাদি। দাঁড়ি টুপি পাগড়ি মসজিদ মাদরাসাও এর মধ্যে আছে। এগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তি রাখা চাই। কেননা এটা তাকওয়ার অন্যতম আলামত। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ

আর কেউ আল্লাহর শাআয়েরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলে এটা তো অন্তরস্থ তাকওয়া থেকেই উৎসারিত। (সূরা হজ ৩২)

. আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ খরচ করা 

بذل المال في سبيل الله অর্থাৎআল্লাহর রাস্তায় সম্পদ খরচ করা। এটাও তাকওয়ার আলামত। আল্লাহ তাআলা বলেন,  وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ মুত্তাকিদের অন্যতম গুণ হল, তাঁরা আল্লাহর দেয়া রিজিক থেকে আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে।

. সর্বদা আল্লাহর জিকির করা

المداومة على ذكر الله অর্থাৎ সর্বদা আল্লাহর জিকির করা। হাদিস শরিফে এসেছে, এক সাহাবী বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! ইসলামের বিধিবিধান তো অনেক হয়ে গেছে। তাই আমাকে একটা শর্ট লিস্ট করে দিন তথা সংক্ষেপে এমন কিছু বলে দিন, যাতে আমি সব সময় করতে পারি। নবীজী ﷺ উত্তর দিলেন, لَا يَزَالُ لِسَانُكَ رَطْبًا مِنْ ذِكْرِ اللَّهِ তুমি সব সময় তোমার জিহবাকে আল্লাহর জিকিররত রাখবে। (তিরমিযী ৩৩৭৫)

ہر دم الله الله کر
نور سے اپنا سینہ بھر

جئے تو اس کا ہو کر جی
مرے تو اس کا ہو کر مر

দমে দমে ‘আল্লাহ আল্লাহ’ কর; হৃদয় নূর দ্বারা পূর্ণ কর। বেঁচে থাকলে তাঁরই জন্য বেঁচে থাক, মরণ হলে তাঁরই জন্য হয়ে মর।

. আল্লাহর কাছে তাওবা ও ইস্তেগফার করা

الاستغفار والتوبة إلى الله অর্থাৎ সর্বদা আল্লাহর কাছে তাওবা ও ইস্তেগফার করা। আল্লাহ তাআলা বলেন,

إِنَّ الَّذِينَ اتَّقَوْا إِذَا مَسَّهُمْ طَائِفٌ مِّنَ الشَّيْطَانِ تَذَكَّرُوا فَإِذَا هُم مُّبْصِرُونَ

যাদের মনে তাকওয়া রয়েছে, তাদের উপর শয়তানের আগমন ঘটার সাথে সাথেই তারা (তাওবা ইস্তেগফার করে) সতর্ক হয়ে যায় এবং তখনই তাদের বিবেচনাশক্তি জাগ্রত হয়ে উঠে। (সূরা আরাফ ২০১)
إلهي عبدُكَ العَاصِي أتاكَ
مُقِرًّا بالذُّنوبِ وقد دَعَاكَ
فإن تغفِر فأنتَ لِذَاكَ أهلٌ
وإن تطرُد فمَن يرحم سِواكَ
ইয়া ইলাহী! আপনার গুনাহগার বান্দা আপনারই কাছে এসেছে, নিজের গুনহগুলোর কথা স্বীকার করে নিয়ে আপনাকেই ডাক দিয়েছে। যদি ক্ষমা করেন আর আপনিই তো ক্ষমাশীল। আর যদি ক্ষমা না করেন তাহলে আপনি ছাড়া রহম  করবে কে!
. আল্লাহর জন্য বিনয়ী হওয়া

التواضع لله অর্থাৎ আল্লাহর জন্য বিনয়ী হওয়া। নিজেকে অপর মুসলমান থেকে ছোট মনে করা। এটাও তাকওয়ার আলামত। কেননা, إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ মুত্তাকিরা আল্লাহর কাছে সম্মানিত। আর বিনয় ছাড়া আল্লাহ কাউকে সম্মানিত করেন না। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِينَ يَمْشُونَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْنًا

রহমানের বান্দাগণের বৈশিষ্ট্য হল, তাঁরা জমিনে বিনয়ের সঙ্গে বিচরণ করে। (সূরা ফুরকান ৬৩)

রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন,

وَمَا تَوَاضَعَ أَحَدٌ للَّهِ إِلَّا رَفَعَهُ اللَّهُ

কোনো ব্যক্তি বিনয়ী হলে আল্লাহ তাআলা তাঁকে অবশ্যই সম্মানিত করবেন। (মুসলিম ২৫৮৮)

. আল্লাহর সঙ্গে নির্জন সময় কাটানোর প্রতি ভালোবাসা রাখা

حب الخلوة مع الله অর্থাৎ আল্লাহর সঙ্গে নির্জন সময় কাটানোর প্রতি ভালোবাসা রাখা। দুলহান যেমনিভাবে নববধূর সঙ্গে নির্জন সময় কাটানোর জন্য অধীর আগ্রহী ও অস্থির থাকে তেমনিভাবে মুত্তাকি বান্দাও আল্লাহর সঙ্গে কিছুক্ষণ নির্জন সময় কাটানোর জন্য প্রচণ্ড তাড়নায় তাড়িত থাকে। তাঁর একান্ত তামান্না থাকে–

تمنا ہے کہ اب کوئی جگہ ایسی کہیں ہوتی
اکیلے بیٹھے رہتے یاد ان کی دل نشیں ہوتی

তামান্না আমার যদি পেতাম এমন কোনো নির্জনতা; একাকী বসে ভাবতাম তাঁকে দূর করতাম অস্থিরতা।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

إِنَّ اللَّهَ مَعَ الَّذِينَ اتَّقَوا وَّالَّذِينَ هُم مُّحْسِنُونَ

নিশ্চয় যারা মুত্তাকি এবং নেক আমলকারী আল্লাহ তাঁদের সঙ্গে আছেন। (সূরা নাহল ১২৮)

. ইনসাফ করা ও জুলুম থেকে দূরে রাখা

إقامة العدل والبعد عن الظلم অর্থাৎ ইনসাফ করা ও জুলুম থেকে দূরে রাখা। এটাও তাকওয়ার একটি আলামত, মুত্তাকিদের অন্যতম গুণ ও বৈশিষ্ট্য। সুতরাং আমরা এর প্রতিও যত্নবান হব। বিশেষ করে আমাদের পারিবারিক জীবনে এই জিনসটার বড়ই অভাব। মানুষ নিজের কাছের মানুষের উপর জুলুম বেশি করে। স্বজনপ্রীতি দেখিয়ে সঠিক সময়ে সঠিক কথা থেকে বিরত থাকে, যা আরেকজনের জুলুমের কারণ হয়। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَقُولُوا قَوْلًا سَدِيدًا

হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল। (সূরা আহযাব ৭০)

১০. সৎ কাজের আদেশ করা ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা

الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر অর্থাৎ তাকওয়ার একটি আলামত হল, সৎ কাজের আদেশ করা ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা। এটা তো বর্তমান দুনিয়াতে নাই বললেই চলে। বিশেষত এর দ্বিতীয় অংশ–অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা। যার দুর্ভিক্ষ বর্তমানে চলছে। তবে এই ক্ষেত্রে লক্ষ রাখতে হবে যে, হক কথা লাঠি নয় যে মেরে দিতে হবে। বরং হেকমত বুদ্ধিমত্তা ও নম্রতার মিশেলে হক কথা বলতে হয়। শাইখুল ইসলাম শাব্বীর আহমদ উসমানী রহ বলেন, হক কথা হক নিয়তে হক তরিকায় বলতে হয়। অন্যথায় সমস্যা সৃষ্টি হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَتَعَاوَنُواْ عَلَى الْبرِّ وَالتَّقْوَى وَلاَ تَعَاوَنُواْ عَلَى الإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَاتَّقُواْ اللّهَ إِنَّ اللّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ

সৎকর্ম ও তাকওয়ার ভিত্তিতে একে অন্যের সাহায্য কর। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা কঠোর শাস্তিদাতা। (সূরা মায়েদা ২)

সম্মানিত হাজেরিন! এতক্ষণের আলোচনায় আশা করি, এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, বর্তমানে তাকওয়ার খুবই অভাব চলছে। আমরা আসলে মুত্তাকি হয়ে উঠতে পারি নি। আর কয়েকদিন পরেই শুরু হবে, বছরের সেরা মাস, রমজান মাস। এটি তাকওয়া অনুশীলনের সবচেয়ে উপযুক্ত মাস। এই মাসকে আমরা অবশ্যই তাকওয়া অর্জনে সচেষ্ট থাকব। তাকওয়ার অনুশীলনের মাধ্যমে মাসটি থেকে আল্লাহর রহমত মাগফিরাত ও নাজাত গ্রহণ করব। মনে রাখবেন, আল্লাহ আমাদেরকে তো দিতে চান। কিন্তু প্রশ্ন হল, আমরা নিতে চাই কিনা?

আল্লাহ আমাদের সকলকে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

وَآخِرُ دَعْوَانَا اَنِ الْحَمْدُ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ

হেদায়েতের ছয় আলামত

বয়ান-৫: হেদায়েতের ছয় আলামত

الحمد لله نحمده ونستعينه ونستغفره ونؤمن به ونتوكل عليه ونعوذبالله من شرور أنفسنا ومن سيئات أعمالنا.من يهده الله فلا مضلّ له ومن يضلله فلاهادي له, واشهد أن لا اله الا الله وحده لا شريك له اَمَّا بَعْدُ! فَاَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ. بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ
رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ. بارك الله لنا ولكم في القرآن  العظيم ونفعني وإياكم بما فيه من الآيات والذكر الحكيم. اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّعَلَى الِ سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّبَارِكْ وَسَلِّمْ

অত্র অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল মাআরিফ আল ইসলামিয়ার উদ্যোগে আয়োজিত দুই দিনব্যাপী ওয়াজ ও দোয়ার মাহফিলের চলতি অধিবেশনের সম্মানিত সভাপতি উপস্থিত ওলামায়ে কেরাম মুরুব্বিয়ানে ইযাম, দূর দূরান্ত থেকে আগত সর্বস্তরের মুসলমান ভাইয়েরা, পর্দার আড়ালে অপেক্ষারত আমার মা ও বোনেরা!

ভূমিকা
বর্তমান দুনিয়াতে ঐ জিনিসের সব চেয়ে বেশি অভাব, যে জিনিসের দাম আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি। আল্লাহ এ পর্যন্ত যত নবী এবং রাসূল পাঠিয়েছেন, সমস্ত নবী-রাসূলকে পাঠিয়েছেন মানব জাতির হেদায়াতের জন্য। শেষ নবী আমাদের নবী। শ্রেষ্ঠ নবী আমাদের নবী বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা । তাঁর উপর নাযিলকৃত কুরআন আল্লাহ কেন পাঠিয়েছেন? আল্লাহ বলেন هدي للناس ‘মানুষের হেদায়েতের জন্য।’
আমরা প্রতিদিন ১২ রাকাত নামায সুন্নত পড়ি। ১৭ রাকাত ফরয হিসেবে পড়ি। বিতর ৩ রাকাত পড়ি ওয়াজিব হিসেবে। এই সুন্নত নামাযগুলো যদি আদায় না করে কেউ। ফজরের আগে ২ রাকাত, যোহরের আগে ৪ রাকাত পরে ২ রাকাত, মাগরিবের পরে ২ রাকাত, এশার পরে ২ রাকাত। ফকীহগণ লিখেছেন সে ব্যাক্তি গোনাহাগার হয়। অর্থাৎ, সর্বমোট ৩২ রাকাত নামায প্রতিদিন একজন মুসলমান পুরুষ নারী পড়তে বাধ্য। আর এই ৩২ রাকাত নামাযে আমরা সূরা ফাতেহা পড়ি। আর ৩২ বার আল্লাহর কাছে দোয়া করি। اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ হে আল্লাহ আপনি আমাদের হেদায়াত দান করুন।

হেদায়েতের গুরুত্ব
হেদায়াতের কী পরমিাণ গুরুত্ব হলে আল্লাহ এর জন্য তার সমস্ত নবীকে, সমস্ত রাসূলকে পাঠিয়েছেন। আর কী পরিমাণ গুরুত্ব হলে আল্লাহ প্রতিদিন ৩২বার আমাদের বাধ্য করেন তার কাছে হেদায়াত চাওয়ার জন্যে।

হেদায়েতের এ পরিমাণ গুরুত্ব কেন?
মূলত হেদায়াতের এ পরিমাণ গুরুত্ব কেন? কারণ এই জগতে এর নাম হেদায়াত হলেও জগৎ পরিবর্তন হওয়ার সাথে সাথে এর নাম হয় নাজাত।
অর্থাৎ, এক ব্যক্তি এই জগতে হেদায়াত পেয়েছে, এ কথার অর্থ হলো আখেরাতে সে নাজাত পেয়েছে। আর এক ব্যক্তি এই জগতে হেদায়াত পায় নাই এ কথার সোজা অর্থ হলো, আখেরাতে তার নাজাতের কোনো ব্যবস্থা হয় নাই।
যেমনিভাবে স্থান পরিবর্তন হয়ে গেলে জায়গা পরিবর্তন হয়ে গেলে মুদ্রার নাম পরিবর্তন হয়। যেমন বাংলাদেশের মুদ্রার নাম টাকা। স্থান পরিবর্তন হয়ে ইন্ডিয়াতে এর নাম হয় রুপী। ইউরোপে গেলে ইউরো। আর এমেরিকাতে গেলে এর নাম হয় ডলার। সৌদি আরবে রিয়াল। কুয়েতে দিনার। ঠিক তেমনিভাবে এই জগতে নাম হলো হেদায়াত। আর একজন মানুষ যখন এ জগত থেকে পরিবর্তন হয়ে ইন্তেকাল হয়ে আখেরাতে পৌঁছায় তখন তার নাম হয় নাজাত।
কোনো ব্যক্তি হেদায়াত পেয়েছে এ কথার অর্থ হলো, তার নাজাতের ব্যবস্থা হয়ে তার ঠিকানা জান্নাত হয়েছে। আর কোনো ব্যক্তি হেদায়াত পায় নাই এ কথার অর্থ হলো- তার নাজাতের কোনো ব্যবস্থা হয় নাই।

হেদায়াত পাওয়ার চারটি অর্থ
একজন মানুষ হেদায়াত পায় নাই দুনিয়ার জগতে এর চারটি অর্থ। হেদায়াত পায় নাই এই কথার অর্থ হল-
এক. হয় এই লোকটা কাফের।
দুই. অথবা এই লোকটা মুশরিক
তিন. এই লোকটা বেদাতি
চার. অথবা এই লোকটা ফাসেক।

একটি প্রবাদ

আপনি কোন লোককে যদি জিজ্ঞেস করেন- তুমি হেদায়াতের উপর আছো কি না? বলবে- আছি অথবা কাউকে যদি আপনি গোমরাহ বলে পথভ্রষ্ট বলে গালি দেন তাহলে সে সাথে সাথেই ক্ষেপে যাবে। তাহলে এই কথার অর্থ হল দুনিয়ার জগতে আমরা সকলেই দাবী করি যে আমরা হেদায়াতের উপর আছি। আসলে একজন মানুষ হেদায়েতের উপর আছে কিনা এর ৬ আলামত।
একটি প্রবাদ আছে চকচক করলেই সোনা হয় না। একজন লোক মাটির নিচে একটা চকচকে জিনিস পেল সে মনে করলো- আমি তো ধনী হয়ে গেছি! কিন্তু যখন ওই বস্তুটা স্বর্ণকারের কাছে নিয়ে জহুরির কাছে নিয়ে কষ্টিপাথরে ঘষা দিয়ে দেখা গেল যে- ঐ বস্তুটি আসলেই সোনা নয়। ঠিক তেমনিভাবে হেদায়াতের উপর আছি মনে করলেই হেদায়াতের উপর আছি একথা ধরা যাবে না; বরং এর ৬টি আলামত। এর ভিত্তিতে বলা হবে এই লোকটা হেদায়াতের উপর আছে অথবা এই লোকটা হেদায়াতের উপর নাই।

আলোচ্য বিষয়
আমার মূল উদ্দেশ্য হলো, এই ৬ টি আলামত আপনাদের শুনানো এবং প্রত্যেকেই আমরা মিলিয়ে দেখব। আমার মাইকের আওয়াজ যে পর্যন্ত যাচ্ছে প্রত্যেকেই আমরা নিজের সঙ্গে মিলিয়ে দেখব যে, এই আলামতগুলোর ভিত্তিতে আমি হেদায়াতের উপর আছি কিনা?

হেদায়াতের সম্পর্ক নাজাতের সাথে
যেহেতু হেদায়াতের সম্পর্ক নাজাতের সাথে সেহেতু আমাদের জিন্দেগীর কার কার হেদায়েতের দরকার আছে, আল্লাহকে দেখান! সবার দরকার আছে? আল্লাহ আমাদেরকে হেদায়াত দান করুন! সকলে বলি, আমিন!!
হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এর ঘটনা। এই হেদায়াতের সম্পর্ক মূলত অন্তরের সাথে। হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম একবার তার সাহাবীদের নিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। ঈসা আলাইহিস সালাম এর সাহাবীদের ইসলামের পরিভাষায় বলা হয় হাওয়ারী। কোরআনের ভাষায় তাদের নাম হাওয়ারী।

ঈসা আলাইহিস সালাম হাওয়ারীদের নিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে একটা কবরস্থানের মধ্যে একটা মাথার খুলি পাওয়া গেল। ওই মাথার খুলিটা নিয়ে তার কানের ভেতর দিয়ে কিছু একটা জিনিস ঢুকানোর চেষ্টা করলেন; কিন্তু ঢুকলো না। তাই অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সাথে এই মাথার খুলিটা তিনি ফেলে দিলেন।
আরেকটু দূর অগ্রসর হওয়ার পর হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম আরেকটা মাথার খুলি পেলেন। ঈসা আলাইহিস সালাম ওই খুলিটা নিয়ে তার ভেতরে কিছু একটা জিনিস ঢুকানোর চেষ্টা করলেন। এবার ওই বস্তুটা ঢুকলো কিন্তু ভেতরে থাকলো না, বের হয়ে গেল। ঈসা আলাইহিস সালাম মাথার খুলিটা তাচ্ছিল্যের সাথে ফুটবলের মত ফেলে দিলেন।
কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর আরেকটা কবরস্থানে তিনি মাথার আরেকটি খুলি পেলেন। এবার ওই মাথার খুলির ভেতরে তিনি কিছু একটা জিনিস ঢোকানোর চেষ্টা করলেন। যেই ঢুকানোর চেষ্টা করলেন ওটা ঢুকলো এবং ভেতরে রয়ে গেল। ঈসা আলাইহিস সালাম মাথার খুলিটা যত্ন সহকারে তার ব্যাগের ভেতর রাখলেন। তারপর তিনি একটা পবিত্র জায়গা দেখে ওই মাথার খুলিটা দাফন করলেন।

হাওয়ারীরা জিজ্ঞেস করল- ওগো আল্লাহর নবী! আপনি তিন মাথার খুলির সঙ্গে তিন ধরনের আচরণ কেন করলেন? ঈসা আলাইহিস সালাম উত্তর দিলেন- প্রথম মাথার খুলিটি যে লোকটার ছিল ওই লোকটি হেদায়াত পায় নাই। আর দ্বিতীয় যে মাথার খুলিটি ছিল সে হেদায়াত পেয়েছে; কিন্তু ধরে রাখতে পারে নাই। আর তৃতীয় মাথার খুলিটি যার ছিল সে হেদায়াত পেয়েছে এবং ধরে রেখেছে। এখান থেকে বুঝা যায় যে, হেদায়াত পাওয়া এবং না পাওয়ার দিক থেকে মানব জাতি ৩ প্রকার।

হেদায়াত পাওয়া এবং না পাওয়ার দিক থেকে মানুষ ৩ প্রকার।
এক প্রকারের মানুষ মোটেও হেদায়াত পায় না। আর এক প্রকারের মানুষ হেদায়াত পাওয়ার পর ধরে রাখতে পারে না। আর এক প্রকার মানুষ সম্পূণরূপে হেদায়েত পেয়ে যায়। মনে রাখতে হবে, মূলত এই জগতে যে পরিমাণ একজন মানুষ হেদায়াত পাবে, ওই জগতে ওই পরিমাণে সে নাজাত পাবে।

একই ইবাদতের বিভিন্ন প্রকার সওয়াব
এজন্য হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ বলেন, কোন ব্যক্তি তার নামাজের সওয়াব পাবে ১০%। কোন ব্যক্তি তার নামাজের সওয়াব পাবে ২০%। কোন ব্যক্তি তার নামাজের সওয়াব পাবে ৩০%। কোন ব্যক্তি তার নামাজের সওয়াব পাবে ৪০%। কোন ব্যক্তি তার নামাজের সওয়াব পাবে ৫০%। কেউ সম্পূর্ণটাই পাবে।
এরূপ হওয়ার কারণ কি? কারণ- যে পরিমাণ হেদায়াত ওই পরিমাণ নাজাত। মনে রাখবেন, হেদায়াত ছাড়া কোন মানুষ কোন আমলের সওয়াব পায় না। প্রতিদান পায় না। এর বড় প্রমাণ হলো- কুখ্যাত মুনাফিক আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই। সে হেদায়াত পেয়েছে কিন্তু ধরে রাখতে পারে নাই। এবার দেখুন- আপনাদের জিজ্ঞেস করি- শ্রোতাগণ সকলেই বলবেন! এই আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই সে নামায পড়তো কিনা? (শ্রোতাগণ) জি! সে নামাজের সওয়াব পাবে? (শ্রোতাগণ) জি না! অথচ হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ বলেন- তোমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যদি একটি নহর প্রবাহিত হয় আর সেখান থেকে একজন মানুষ দৈনিক পাঁচবার তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো ধৌত করেهَلْ يَبْقَى مِنْ دَرَنِهِ شَيْءٌ؟ ‘তার গায়ের মধ্যে কোন ময়লা বাকি থাকে কি?’ সাহাবী বললেন যে,- قَالُوا: لَا يَبْقَى مِنْ دَرَنِهِ شَيْء ‘তার গায়ের মধ্যে কোন ময়লা থাকার কথা নয়। তার গায়ের মধ্যে কোন ময়লা থাকে না।’ নবীজি বলেন- فَذَلِكَ مَثَلُ الصَّلَوَاتِ الْخَمْسِ، يَمْحُو اللَّهُ بِهِنَّ الْخَطَايَا ‘পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের দৃষ্টান্ত এমন- যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামায নিয়মিত আদায় করবে আল্লাহ তাআলা তার গুনাহগুলো মিটিয়ে দিবেন আর আখেরাতের নাজাতের ব্যবস্থা করে দিবেন।’

আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই তার ইবাদতের প্রতিদান পাবে না কেন?
আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই কেবল যে নামায পড়তো এমন নয়, নবীজির পিছনে নামায পড়তো, পাঁচ ওয়াক্ত নামায প্রতিদিন নবীজির পেছনে দাঁড়িয়ে আদায় করার পরেও নামাযের এই ভেনিফিড, নামাযের এই সওয়াব সে কি পাবে? না! কেন কিসের অভাবে? হেদায়াতের অভাবে! হেদায়াতের অভাবে নামায তো দূরে থাক (নামায তো মস্ত বড় ইবাদত) একজন মানুষ সুবহানাল্লাহ বলার পরিমাণ সাওয়াবও পায় না।
কোন ব্যক্তির কাছে যদি হেদায়াত না থাকে তার নামায, তার রোযা, তার হজ, তার যাকাত, তার দাড়ি তার টুপি, তার পাগড়ী, তার চিল্লা তার সাল কিছু কাজে আসবে না।

অল্প আমলই নাজাতের জন্য যথেষ্ট
আর যদি কারো কাছে হেদায়াত থাকে। নবীজী বলেন- হেদায়াত যদি তোমার কাছে পরিপূর্ণ মাত্রায় থাকে  أَخْلِصْ دِينَكَ يَكْفِكَ الْعَمَلُ الْقَلِيلُ হেদায়াত যদি তোমার কাছে বেশি থাকে আর আমল যদি কম থাকে, আল্লাহ তায়ালা তোমাকে নাজাত দিয়ে দিবেন। কম আমলই তোমার জন্য তোমার নাজাতের জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে।

হেদায়াতের উপর না থাকার ৬ টি আলামত

তাহলে দেখার বিষয় হল- কারা আমরা হেদায়াতের উপর আছি আর কারা হেদায়াতের উপর নাই। ভূমিকা আর দীর্ঘায়িত না করে আমি এখন এই ৬ টি আলামত বলতে যাচ্ছি। এই আলামতগুলো বলার আগে একটি জিনিস স্মরণ করিয়ে দিই। সেটা হলো, আগেই বলেছি- এই আলামতগুলো অন্যের সাথে মিলানোর চেষ্টা করবেন না; বরং নিজের সাথে মিলিয়ে দেখবেন। আমাদের একটা বদ অভ্যাস আছে যখন কোন দোষের কথা শুনি, নেতিবাচক কথা শুনি, নেগেটিভ কথা শুনি তখন আঙ্গুলটা অন্যের দিকে দেই।

বিজ্ঞ বচন
বিজ্ঞজনরা বলেন- তুমি যখন আঙ্গুলটা অন্যের দিকে দিয়ে রাখো। তখন আঙ্গুল অন্যের দিকে যায় একটা আর তোমার দিকে থাকে কয়টা? কাজেই অন্যের দিকে হাত তুলবেন না; বরং নিজের জিন্দেগীর সাথে মিলাবেন।
এক ব্যক্তি হেদায়াতের উপর নাই। মুফাসসিরীনে কেরাম বলেন- এর সর্ব মোট ছয় আলামত। এখন আলামতগুলো শুনার জন্য আমরা সকলেই মানসিক পস্তুতি গ্রহণ করি।

১ নং আলামত অহংকার এর সাথে গুনাহ করা
এক নম্বর আলামত হল, কোন ব্যক্তি যদি অহংকারের সাথে গুনাহ করে। আলামত হলো- ওই লোকটা হেদায়েতের উপর নাই। একজন মুমিনের গুনাহ হয় আর একজন পথভ্রষ্ট ব্যক্তি অহংকার এর সাথে গুনাহ করে। দুটি এক হলো? নাকি ব্যবধান হলো? ব্যবধান হলো।
আপনি বলতে পারেন, হুজুর এটা আমার মধ্যে নাই। আমি একটা একটা দৃষ্টান্ত পেশ করব আর জিন্দেগীর সাথে মিলাবো। বাকি দৃষ্টান্তগুলো এর সাথে মিলিয়ে দেখব। দেখেন তো আমার আর আপনার মধ্যে এই আলামত আছে কিনা?

দৃষ্টান্ত : মেয়ে বিয়ে
ধরে নিন, আপনার মেয়ের বিয়ে লেগেছে। এর ১৫ দিন আগে আপনার পাশের ঘরের একটা মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ওই ঘরের যে মেয়েটার বিয়ে হয়েছিল ওই ঘরের লোকদের সাথে আপনার কোন কারণে রেষারেষি হাড্ডাহাড্ডি ঝগড়া-লড়াই আছে। অপরদিকে আপনার ছেলে বিদেশ থেকে ৫০ হাজার টাকা পাঠিয়েছে- তার বোনের বিয়ের জন্য, আপনার মেয়ের বিয়ের জন্য। আপনি এবার চিন্তা করলেন- বিয়ে কেমনে দিতে হয় আমাদের প্রতিবেশীকে দেখিয়ে ছাড়বো। এই চিন্তা করে একটা বড় গেটের ব্যবস্থা করলেন। গায়ে হলুদের ব্যবস্থা করলেন। এই চিন্তা করে আপনার পরিবারের যারা যুবক আছে তারা গান-বাজনার আয়োজন করল। বলেন তো- এই যে গুনাহগুলো করেছে; কেবল কি গুনাহ হয়েছে নাকি অহংকারের সাথে গুনাহ করেছে? অহংকার এর সাথে গুনাহ করেছে!
কোন ব্যক্তি যদি অহংকার এর সাথে গুনাহ করে আলামত হলো- ওই লোকটা হেদায়াতের উপর নাই।

২ নং আলামত : গুনাহ করাকে ইজ্জতের কারণ মনে করা আর নেক কাজ করতে লজ্জাবোধ করা
দুই নাম্বার আলামত হল- কোন ব্যক্তি যদি গুনাহ করাটাকে ইজ্জতের কারণ মনে করে। আর নেক আমল করাটাকে লজ্জার কারণ মনে করে। শরমের কারণ মনে করে। আলামত হলো, ওই লোকটা হেদায়েতের উপর নাই।

দৃষ্টান্ত এক : টাখনুর নিচে কাপড় পরিধান করা
যেমন রাসূলুল্লাহ বলেছেন- পুরুষ তার লুঙ্গি পায়জামা প্যান্ট পরবে টাখনুর উপরে। কিন্তু টাখনুর নিচে পুরুষ তার কাপড় পরিধান করে কেন? সাধারণত দুই কারণে-

এক কারণ হলো- আমি টাখনুর উপর কাপড় পরে, টাখনুর উপর প্যান্ট পরে বের হলে মানুষ আমায় কী বলবে? দ্বিতীয় কারণ হলো- অহংকার। অথচ নবীজি ﷺ  হাদিস এর মধ্যে বলেন-

إزرَةُ المُسلِمِ إِلى نصْفِ السَّاقِ، وَلاَ حَرَجَ أَوْ لاَ جُنَاحَ فِيمَا بَيْنَهُ وَبَيْنَ الكَعْبَيْنِ، فَمَا كانَ أَسْفَلَ منَ الكعْبَينِ فَهَوُ في النَّارِ

মুসলমান পুরুষদের পোশাক হবে টাখনুর উপরে আর যদি টাখনুর নিচে যায় তাহলে সে জাহান্নামী। তার ওই অংশ জাহান্নামী। এখন এই পুরুষ টাখনুর উপরে প্যান্টটা উঠাতে পারে; তবে উঠায় নাই কেন? অহংকারের কারণে। টাখনুর উপরে প্যান্টটা উঠতে পারে নাই কেন? মানুষ কী বলবে! এটা আলামত হলো- এই লোকটা হেদায়আতের উপর নাই।

দৃষ্টান্ত দুই : পর্দা না করা
একজন নারী দীর্ঘদিন পর্যন্ত পর্দা করে নাই। এখন যখন ওয়াজ মাহফিলে শুনেছে পর্দাসংক্রান্ত বিধান পর্দা ফরজ। নবীজী বলেন- نِسَاءٌ كَاسِيَاتٌ عَارِيَاتٌ مُمِيلَاتٌ مَائِلَاتٌ কিছু মহিলা পোশাক পরে উলঙ্গ হবে অর্থাৎ এমন টাইট-ফিট পোশাক পরবে; যার কারণে ওই মহিলা উলঙ্গ তো নয়; তবে পোশাক পরেও উলঙ্গ। অথবা এমন পাতলা পোশাক পরবে, যে পাতলা পোশাক পরার কারণে ওই মহিলা উলঙ্গ তো নয়; তবে পোশাক পরেও উলঙ্গ। অথবা এমন  শর্টকাট ছোট পোশাক পরবে যার কারণে ওই মহিলার কিছু অংশ দেখা যায় কিছু অংশ দেখা যায় না। এর কারণে এই মহিলা উলঙ্গ তো নয়; তবে পোশাক পরেও উলঙ্গ। নবীজি এই জাতীয় মহিলা সম্পর্কে বলেছেন- لَا يَدْخُلْنَ الْجَنَّةَ ولا يَجِدْنَ رِيحَهَا এরা জান্নাতে তো যাবে না; জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না।

এই হাদিসটা শোনার পর মহিলার চিন্তা হলো- আমাকে তো পর্দা করা দরকার। ঠিক তখনি তার আরেকটা চিন্তা মাথায় আসলো, যখন এতদিন পর্যন্ত পর্দা করি নাই, এতদিন পর্যন্ত মামাতো ভাই ফুফাতো ভাই দুলাভাইদের সাথে দেখা দিয়েছি, দেবরের সাথে দেখা দিয়েছি , এখন যদি নতুন করে পর্দা শুরু করি তাহলে মানুষ কী বলবে? মানুষ বলবে- বুজুর্গ হয়ে গেছে। সূফি হয়ে গেছে। অর্থা নেক আমল করতে সে লজ্জা করল।
যে ব্যক্তি নেক আমল করতে লজ্জা করে আলামত হলো- ওই লোকটা হেদায়াতের উপর নাই। আশা করি আমাদের বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না যে, আমরা কারা হেদায়োতের উপর আছি আর কারা হেদায়োতের উপর নাই।

৩ নং আলামত : উম্মতের নেককার জামাতের সাথে বিদ্বেষ পোষণ করা
তিন নং আলামত হলো- উম্মতের মধ্যে যারা নেককার তাদের সাথে যারা বিদ্বেষ রাখে, শত্রুতা রাখে, আলামত হলো- ওই লোকটা হেদায়াতের উপর নাই। আপনি বলতে পারেন- হুজুর এই আলামতটা আমার মধ্যে নাই। আমি দেখাচ্ছি, আছে কিনা?

উম্মতের নেককার জামাত কারা?
এই আলামতটা বুঝার আগে আমাদের বুঝতে হবে- উম্মতের নেককার কারা? সব চাইতে নেককার কারা? জিজ্ঞেস করতে হবে আল্লাহকে। দেখি আল্লাহ কী বলেন? আল্লাহ বলেন- قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ ‘আপনি বলে দিন, যাদের কাছে ইলম আছে এবং যাদের কাছে ইলম নেই তারা কি সমান?’

ওলামায়ে কেরাম যারা আছেন তারা বুঝবেন, এখানেاستفهام টি হল  توبيخ (ধমক এবং নিন্দা জ্ঞাপনার্থে) অর্থাৎ আল্লাহ বুঝাচ্ছেন- যে লোকটা আলেম আর যে লোকটা আলেম নয়, তাকে একমাপে দেখার এক ওজনে দেখার, এককরে দেখার একরকম করে দেখার সাহস তোমাকে কে দিয়েছে? কারণ যে লোকটা আলেম আল্লাহর কাছে তার মর্যাদা অনেক বেশি। তাহলে বুঝে থাকলে বলুন- উম্মতের মধ্যে সবচাইতে বেশি মর্যাদাবান কারা? আলেম-ওলামা। কোরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন-إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে ওলামায়ে কেরামই কেবল তাঁকে ভয় করে।’ আর অন্য আয়াতে বলেন-إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে সে সবচাইতে বেশি মর্যাদাবান।’

এজন্য কোরআন এবং হাদিসকে সামনে এনে আমরা দেখলে যেটা বুঝতে পারি আমাদের সামনে যে বিষয়টি পরিষ্কার হয় সেটি হল, উম্মতের সবচাইতে নেককার জামাতের নাম হল-ওলামায়ে কেরামের জামাত। এই কারণেই সাধারণ মানুষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে- ওলামায়ে কেরাম যা বলেন তোমরা তা শুনো।

একটি দ্বন্দ্ব ও তার নিরসন
এ কথা বললেই তখন অনেকে প্রশ্ন করে- হুজুর কার কথা শুনবো? এক আলেম বলেন একরকম, তো আরেক হুজুর বলেন আরেক রকম!

এজন্য সামনে ৫ মিনিট আমি যে কথাগুলো বলতে যাচ্ছি সেই কথাগুলো খুব মনোযোগের সাথে শুনার চেষ্টা করবেন। ইনশাআল্লাহ আমি গ্যারান্টি দিয়ে যাচ্ছি এর উপর আমল করতে পারলে মৃত্যু পর্যন্ত আপনি হেদায়াতের উপর থাকতে পারবেন।

হাকীমুল উম্মত এর অভিজ্ঞতা
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত আশরাফ আলী থানবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন- যে লোকটা বলে কার কথা শুনব? কোন আলেমের কথা শুনব? তিনি বলেন, আমার অভিজ্ঞতা হল, এই লোকটা মূলত কোন আলেমের কথা শুনে না। আমার অভিজ্ঞতা হল, এই লোকটা মূলত কোন আলেমের কাছে যায় না।

আলেম ওলামার মতপার্থক্য কেয়ামতের আলামত
মূলত আলেম-ওলামার মাঝে পরস্পর মতবিরোধ থাকা, আলেম ওলামার মাঝে পরস্পর মতপার্থক্য থাকা, একেকজন একেক রকম করে বলা, এটা কেয়ামতের আলামত। বলুন, কিসের আলামত? কেয়ামতের আলামত। এই মতপার্থক্য কমার চিন্তা কখনো করবেন না, কমার আশা করবেন না। কারণ হাদিসের মধ্যে এসেছে, নবী আলাইহিস সালাম বলেন, প্রত্যেক বর্তমান ফিতনা ভবিষ্যতে ফিতনা থেকে ছোট হবে। কিন্তু বর্তমান ফিৎনার লোকজন মনে করবে- এর চাইতে বড় ফেতনা আর নাই।
এই হাদীস থেকে বোঝা যায়- ওলামায়ে কেরামের মতপার্থক্য থাকা এটা কেয়ামতের আলামত। এই মতপার্থক্য কমবে না। আরো বাড়তে থাকবে। একদিকে ওলামায়ে কেরামের মতপার্থক্য বাড়তে থাকবে। আরেকদিকে আল্লাহ তাআলা এই ইসলামকে, এই দীনকে কেয়ামত পর্যন্ত হেফাজত করবেন ওলামায়ে কেরাম এর মাধ্যমে।

এই দুই কথার সমন্বয় কী?
তাহলে দুই কথার সমন্বয় কী? দুই কথার সমন্বয় হলো, এই ওলামায়ে কেরামের মাঝে পরস্পর মতপার্থক্য থাকার পরেও আলেমগণ একেকজন একেক রকম করে বলা সত্ত্বেও কিছু বিষয়ে এমন হবে যে, সে সব বিষয়ে আলেমগণ একমত হয়ে যাবেন। একেকজন একেক রকম করে বলা সত্ত্বেও কিছু বিষয়ে এমন হবে, যে বিষয় সম্পর্কে সব আলেম এক রকম করে বলবেন। পরস্পর মতপার্থক্য থাকাটা কেয়ামতের আলামত, আর কিছু কিছু বিষয়ে ওলামায়ে কেরাম একমত হয়ে যাওয়াটা ইসলাম কেয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকার আলামত।

আলেম-ওলামার ঐক্য থেকে সরে যাওয়ার পরিণতি গোমরাহী
আলেমগণ যখন কোন বিষয়ে একমত হয়ে যান তখন কোন সাধারণ মানুষ ওই একমত হয়ে যাওয়া কথাটা থেকে সরে গেলেই তখন সাথে সাথেই সে গোমরাহ হয়ে যায়। পথভ্রষ্ট হয়ে যায়।

আলেম ওলামার: ঐক্য কাদিয়ানীরা কাফের
যদি এই থিওরিক্যাল কথাটা বর্তমান সময়ের সাথে প্র্যাকটিক্যালিটি মিলিয়ে দেয়া হয় তাহলে আমাদের জন্য বুঝতে সুবিধা হবে। যেমন, আলেম ওলামার পরস্পরের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। একেক জন একেক রকম করে কথা বলেন। বলা সত্ত্বেও এই মুসলিম উম্মাহর মধ্যে একদল তৈরি হয়েছিল, তারা তাদের নাম দিয়েছিল আহমদীয়া মুসলিম জামাত। আলেম-ওলামার মধ্যে মতপার্থক্য থাকার পরেও তারা এই জামাত সম্পর্কে একমত হয়ে তারা বলে দিলেন- আহমদীয়া মুসলিম জামাত ‘মুসলিম’ নয়; এরা অমুসলিম কাদিয়ানী বেইমান। (এটা হল কিয়ামত পর্যন্ত দীন টিকে থাকার আলামত)

আলেম ওলামার ঐক্য: জামাতে ইসলামী ইসলামী দল নয়
আলেম ওলামার মাঝে মতপার্থক্য আছে। মতপার্থক্য থাকার পরও একটা ইসলামী জামাত সম্পর্কে সকল বলে দিয়েছেন যে, এরা ইসলামী নয়। তাদের নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য আপন স্থানে। এটা হল কেয়ামতের আলামত। এই মতপার্থক্য থাকার পরেও তারা বললেন এই জামাতটা ইসলামী নয়। (এটা হল কিয়ামত পর্যন্ত দীন টিকে থাকার আলামত)

আলেম ওলামার ঐক্য: আহলে হাদীসরা হাদীসের অনুসারী নয়
আলেম ওলামার মতপার্থক্য আছে। তাদের নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকার পরও মুসলিম উম্মাহর মধ্যে একদল বের হলো। তারা নাম দিল আমরা হলাম- আহলে হাদিস। আলেম ওলামার মধ্যে মতপার্থক্য থাকার পরও তারা একমত হয়ে বলে দিলেন যে- এই আহলে হাদীস, এরা হাদীসের অনুসারী নয়; বরং হাদিস অনুসরণের নামে হাদিসের উপর মিথ্যারোপ করে যাচ্ছে। এর সাথে ধোঁকাবাজি করে যাচ্ছে।

আলেম ওলামার ঐক্য: সাদ তাবলীগ থেকে বের হয়ে গেছে
আলেম-ওলামারা মাঝে মতপার্থক্য আছে। মতপার্থক্য থাকার পরেও ওলামায়ে কেরাম একমত হয়ে বললেন- দাওয়াত ও তাবলীগের সাথে দীর্ঘদিন ছিল মাওলানা সাদ। তিনি এখন দাওয়াত ও তাবলীগ থেকে বের হয়ে গেছেন। আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত থেকে বের হয়ে তিনি পথভ্রষ্ট হয়ে গেছেন।

সাদপন্থীদের গোমরাহ বলা উম্মতে মুসলিমার উপর আবশ্যক
যেমনিভাবে আলেম-ওলামা একমত হয়ে আহমদীয়া মুসলিম জামাতকে বেঈমান বলার সাথে সাথে সাধারন মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব হয়ে গেছে তাদেরকে বেইমান বলা। যেমনিভাবে আহলে হাদিস ‘আহলে হাদিস’ নাম ধারণ করার পরেও আলেম-ওলামা একমত হয়ে বলে দিলেন- এই আহলে হাদিস মূলত ফেতনাবাজ গোষ্ঠী। তখন সাধারণ মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব হয়ে গেছে তাদেরকে ফিতনাবাজ বলা। যেমনিভাবে তথাকথিত জামাতে ইসলামী ‘ইসলামী’ আলেম-ওলামা একমত হয়ে বলে দিলেন, এরা ইসলামী নয়। তখন সাধারণ মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব হয়ে গেছে এদেরকে ইসলামী দল না বলা। ঠিক তেমনিভাবে সা’দের অনুসারী যারা- আলেম ওলামা তাদের নিজেদের মাঝে মতপার্থক্য থাকার পরও তার অনুসারীদের সম্পর্কে একমত হয়ে বলেছেন- এরা পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে। এরা গোমরাহ হয়ে গেছে। সুতরাং সাধারণ মুসলমানদের উপর ওয়াজিব হয়ে গেছে তাদেরকে পথভ্রষ্ট বলা।

দলিল
আপনারা বলতে পারেন, আপনি যে এই কথা বলেছেন এই কথার দলিল কী? আপনি যে এই কথা বললেন এ কথার প্রমাণ কী? দলিল হল কোরআন মাজিদোর আয়াত। আল্লাহ তা’আলা বলেন-شَهِدَ اللَّهُ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ وَالْمَلَائِكَةُ وَأُولُو الْعِلْمِ অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা বলেন আল্লাহ সাক্ষী দিচ্ছেন- لا اله الا الله সাক্ষী দিচ্ছেন ফেরেশতাগণ لا اله الا الله আর সাক্ষী দিচ্ছেন ওলামায়ে কেরাম- لا اله الا الله

এবার আপনারা বলুন- আল্লাহ যদি কোন কথা বলেন তাহলে কোন মুসলমানের অধিকার আছে এই কথা থেকে সরে যাওয়ার? সবাই বলবেন, এই কথা থেকে সরে যাওয়ার অধিকার কারও আছে? না।
ঠিক অনুরূপভাবে ফেরেশতারা যখন কোন বিষয়ে সাক্ষী দেন তখন কোন মুসলমানের অধিকার আছে ওই সাক্ষ্য থেকে সরে যাওয়ার? না। মুফাসসিরীনে কেরাম বলেন- আল্লাহর সাক্ষীর সামনে বিদ্রোহ করার অধিকার যেমনিভাবে কোন মুসলমানের নাই। বিদ্রোহ করলে পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে, গোমরাহ হয়ে যাবে। যেমনিভাবে ফেরেশতাদের সাক্ষীর উপর বিদ্রোহ করার অধিকার কোন মুসলমানের নাই। বিদ্রোহ করলেই ওই লোকটা পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে। গোমরা হয়ে যাবে। ঠিক তেমনিভাবে ওলামায়ে কেরাম একমত হয়ে যখন কোনো কথা বলবেন, তখন কোন মুসলমানের অধিকার নাই তার ব্যাপারে বিদ্রোহ করার। বিদ্রোহ করলেই ঐ লোকটা পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে।

মুফাসসিরীনে কেরামের এই কথা থেকে বুঝা গেল- আলেম ওলামার পরস্পর মতপার্থক্য থাকার পরেও যখন তারা একমত হয়ে কোন কথা বলেন, তখন সাধারন মুসলমানদের অধিকার থাকে না সেই একমত হয়ে যাওয়া কথা থেকে সরে যাওয়া।

ওলামায়ে কেরামের ঐক্য তিন হযরতজীর তরীকা সঠিক

আরেকটি কথা গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করে রাখি, যেমনিভাবে আলেম-ওলামা একমত হয়েছেই মাওলানা সা’দ তাবলীগ থেকে বের হয়ে গেছেন। ঠিক তেমনিভাবে আলেম-ওলামা এই কথার উপরে একমত হয়েছেন যে, দাওয়াত ও তাবলীগ হল হক জামাত।

হযরতজী মাওলানা ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহি  তাবলীগের যেই রূপ আমাকে আপনাকে দিয়ে গেছেন, আলেম-ওলামারা একমত হয়ে বলেছেন, এরূপের সাথে কোরআন সুন্নাহর সম্পর্ক আছে।
হযরতজী মাওলানা ইউসুফ সাহেব যেটা রেখে গেছেন। ওলামা কেরাম বলেছেন, এর সাথেও কোরআন সুন্নাহর সম্পর্ক আছে।
হযরতজী এনামুল হাসান রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তিনি যে নমুনা পেশ করেছেন। তার সম্পর্কে ওলামায়ে কেরাম বলেছেন, এর সাথে কোরআন সুন্নাহর সম্পর্ক আছে।

তাবলীগ বিদ্বেষীরা গোমরাহ
সুতরাং যারা আগে থেকেই দাওয়াত ও তাবলীগ দেখতে পারে না, বলুন তো তারা কি হেদায়াতের উপর আছে? না। কেন? তারা কেন হেদায়াতের উপর নাই? যে মূলনীতির ভিত্তিতে মাওলানা সা’দকে আজকে গোমরাহ বলতে হয়। ওই মূলনীতির ভিত্তিতেই আজকে যারা দাওয়াত ও তাবলীগ দেখতে পারে না, তারা হেদায়েতের উপর নাই। মূলনীতি ভিন্ন নয়, মূলনীতি একই।

মারামারি নয় মারা হয়েছে
এই সা’দপন্থীদের গোমরাহ হয়ে যাওয়ার একটা নিদর্শন আমরা পেলাম। গত শনিবারে ০১/১২/১৮ টঙ্গী ইজতেমার ময়দানে। এর বড় একটা প্রমাণ দেখলাম গত শনিবারের ০১/১২/০১৮ একটা দুর্ঘটনায়।
গত পরশু ০৬/১২/১৮ বৃহস্পতিবার আমি এক জায়গায় মাহফিলে যাওয়ার পর এক যুবক আমাকে জিজ্ঞাসা করল, হুজুর সেদিন যে মারামারি হলো, আমরা কার পক্ষে যাব? আমি বললাম্‌ সেখানে মারামারি তো হয় নাই; বরং মারা হয়েছে। বলেন তো মারামারি হয়েছে নাকি মারা হয়েছে? মারা হয়েছে। সেখানে মারামারি হয় নাই। আপনাদের চোখের সামনে অনেক ঘটনা আছে। আমরাও দেখেছি আমরাও শুনেছি অনেক ঘটনা। এখন ইন্টারনেটের উছিলায় অনেক ঘটনা আমরা সকলেই জানি।

তালেবে ইলমের প্রতি ওমরের রাযি.-এর বিনয়তা
ছোট ছোট তালিবে ইলমগুলো, আহ! এই তালেবে ইলমগুলো কারা? হযরত ওমর রা., যার সম্পর্কে নবীজি আলাইহিস সালাম বলেছেন- لوكان بعدي نبيا لكان عمر [আমার পরে যদি কোন নবী আসত (আসবে না) যদি আসতো, যদি হতো তার নাম হতো- ওমর।] এমন মহান ব্যক্তি অর্ধ পৃথিবীর শাসক যিনি ছিলেন, কী পরিমাণ ব্যস্ততা তার। এমন মহান ব্যক্তি পর্যন্ত তার রাষ্ট্রীয় ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে মদিনার মসজিদে নববীতে কোরআন শিখতো যেসব তালিবে ইলম। তিনি তাদের কাছে যেতেন আর তাদের কাছে গিয়ে বলতেন- তোমাদের চাচা ওমর এর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া কর! ছোট ছোট এই তালেবে ইলমরা বলতো- কী দোয়া করব? তখন ওমর রাযি. শিখিয়ে দিতেন- তোমরা আল্লাহর কাছে দোয়া কর- ‘ওগো আল্লাহ আপনি আমাদেরকে মাফ করে দিন!’

তাহলে ইলমদের প্রতি আবু হুরায়রা রাযি.-এর শ্রদ্ধা
হযরত আবু হুরায়রা রাযি.-এর এক অভ্যাস ছিল- সাহাবায়ে কেরামদের অভ্যাস ছিল কোরআন শিক্ষারত ছোট ছোট বাচ্চা তালিবে ইলমদের কাছে যেতেন এবং দোয়া চাইতেন। কী বলে দোয়া চাইতেন? যে  তোমরা বল- তিনি যেন তোমাদের চাচা আবু হুরায়রাকে ক্ষমা করে দেন।
اللهم اغفر لابي هريرة [ওগো আল্লাহ আপনি আবু হুরায়রা কে মাফ করে দেন।]

শনিবারের ঘটনা
এই ছোট ছোট বাচ্চা তালিবে ইলমগুলো ঐদিন সূরা ইয়াসিন একলক্ষ বার পড়ার আমলে লিপ্ত ছিল। ৭০ হাজার বার পড়া শেষ হয়ে গেছে আর ৩০ হাজার বার বাকি ছিল। সেখানে ওই ইজতেমার ময়দানে হযরত মাওলানা জুবায়ের সাহেব -এর ছদারাতে যে মাদ্রাসা চলে সেই মাদ্রাসার ছোট ছোট তালেবে ইলেমরাও ছিল। তাদের গায়ে হাত তুলেছে। তাদেরকে রক্তাক্ত করেছে। এক একটা মাদ্রাসার শত শত তালিবে ইলম। কেউ তাদের হাত হারিয়েছে। কেউ চোখ হারিয়েছে। কেউ বা পা হারিয়েছে। ইজতেমার ময়দানে খুঁজে খুঁজে আলেম-ওলামাদের গায়ে হাত তুলেছে। যারা আলেম ওলামার গায়ে হাত তুলেছে পথভ্রষ্ট সন্ত্রাসী ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।

এই জাতীয় কথা শুনলে অনেকেই বলেন- হুজুর আমাদেরকে এগুলোর সাথে মিলাবেন না। আমরা এলাকার বিচারক মানুষ। আমরা রাজনীতি করি। আমরা ব্যবসায়ী। আমরা এই করি। আমরা সেই করি। আমরা দু’পক্ষের সঙ্গে আছি।

দ্বি মুখী হওয়া থেকে সাবধান
মনে রাখবেন দুই পক্ষে থাকার কোনো সুযোগ নেই। সুযোগ নেই তার প্রমাণ কী? তার প্রমাণ হলো- কোরআন। আয়াতে আল্লাহ বলেন-

وَقَالُوا لَوْ كُنَّا نَسْمَعُ أَوْ نَعْقِلُ مَا كُنَّا فِي أَصْحَابِ السَّعِيرِ

অর্থাৎ কিছু লোক যখন জাহান্নামে যাবে জাহান্নামে যাওয়ার পরে তখন ওই লোকগুলোকে আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন- জাহান্নামে কেন আসলে? তারা যে উত্তর দিবে তারা যে তথ্য পেশ করবে আল্লাহতালা সেই তথ্যকে সত্যায়ন করে আকাশ থেকে ওহী নাযিল করেছেন। আল্লাহ বলেন- তারা যেই কথাগুলো বলবে সেই কথাগুলো ঠিক আছে। এই মর্মে আল্লাহ নাযিল করেন যে তারা বলবে মূল বিষয় হলো এই যে, আমরা আলেম ওলামার কথা শুনতাম না যদি আমরা আলেম ওলামার কথা শুনতাম তাহলে আজকে আমরা জাহান্নামী হতাম না। আর আরেকদল বলবে- আমরা আলেম হই নাই। যদি আমরা আলেম হয়ে যেতাম তাহলে আজকে আমরা জাহান্নামী হতাম না।

মুফাসসিরীনে কেরাম লিখেন- আমরা আলেম ওলামার কথা শুনতাম না। এই কথা কেন আল্লাহ আগে বললেন? আলেম-ওলামা হয়ে যায় নাই। যদি হয়ে যেতাম তাহলে জাহান্নামী হতাম না। এ কথা কেন পরে বললেন?

উম্মতের আলেম হবে কম তাদের অনুসারী হবে বেশি
এর কারণ হিসেবে মুফাসসিরীনে কেরামে লিখেন- মূলত আলেম-ওলামার অনুসারীদের সংখ্যা থাকবে বেশি আর আলেম ওলামার সংখ্যা থাকবে কম। কারণ আল্লাহ তাআলা সকলকে আলেম-ওলামা হওয়ার দায়িত্ব দেননি; বরং আল্লাহ বলেছেন-

فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ

প্রত্যেক বড় জামাত থেকে ছোট একটা জামাত বের হবে ইলম শিক্ষার জন্য। তারপর তারা যখন ইলম শিখে আসবে। উম্মতকে তখন হেদায়াতের কথা শুনাবে। জান্নাতের সুসংবাদ দিবে। জাহান্নাম সম্পর্কে ভয় দেখাবে। আর এই বড় জামাত তথা সকলের জন্য তখন ওয়াজিব হয়ে যাবে এই ছোট জামাত (যারা ইলেম শিখে এসেছে) তাদের কথা শোনা।
এখান থেকে বুঝা গেল আলেম-ওলামার সংখ্যা বেশি হবে নাকি আলেম-ওলামার অনুসারীদের সংখ্যা হবে? আলেম ওলামার অনুসারীদের সংখ্যা বেশি হবে। এই লোকগুলো বলবে- ওগো আল্লাহ! যদি আমরা আলেম ওলামার অনুসারী হয়ে যেতাম। অথবা আলেম-ওলামা হয়ে যেতাম তাহলে আজকে জাহান্নামী হতাম না।

এই আয়াত থেকে বুঝা গেল- যারা বলে আমরা কোন পক্ষে নাই। আমরা কোন দলে নাই। আমরা সবার সাথে আছি। এই দলের সাথে আছি। ওই দলের সাথে আছি। আল্লাহর দপ্তরে তার নাম মুনাফিকের তালিকায় থাকবে বিধায় সেও গোমরাহ-পথভ্রষ্ট ছাড়া আর কিছু নয়। কোনো দলে নাই এ কথা বলার সুযোগ নেই। যেমনিভাবে দাওয়াত ও তাবলীগ জামাতকে না-হক বলার সুযোগ নাই আলেম-ওলামা একমত হওয়ার কারণে। অনুরূপভাবে মাওলানা সাদ পন্থীদের হক বলার সুযোগ নেই আলেম-ওলামা একমত হয়ে যাওয়ার কারণে। ঠিক তেমনিভাবে আমরা কোনো দলে নাই এ কথা বলার কোনো সুযোগ নেই হককে চিনে তার অনুসরণ করা ওয়াজিব হওয়ার কারণে। সুতরাং বলুন, আমরা দুই দলের কোনো দলে নাই এ কথা বলার সুযোগ আছে?  না।
دین زندھ ھوتاھے ھر قربانی کے بعد
এই ছোট ছোট তালেবে এলেমদের গায়ে হাত তুলেছে। আলেম ওলামার গায়ে হাত তুলেছে তাদের রক্ত ঝরিয়েছে; তবে একটা সুসংবাদ আছে। আল্লাহ তাআলা তার দীনের জন্য মাঝে মধ্যে রক্ত চান কেন? কেন চান? জানেন যাতে দীন পুনরায় আবার জীবিত হয়। কারণ মানুষ যখন অনেকদিন সুখে থাকে নিরাপত্তার ভিতরে থাকে তখন যে দীনর জন্য রক্ত দরকার এটা মানুষ ভুলে যায়। যখন মানুষ ভুলে যায় তখন আল্লাহ তাআলা দীনের জন্য কিছু রক্ত নেন। যেমনিভাবে একটা আধা মরা গাছকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য তার গোড়ায় পানি ঢালতে হয়। ঠিক তেমনিভাবে আমাদের থেকে যখন দীনদারী মুছে যেতে থাকে, চলে যেতে থাকে। তখন এই দীনদারীকে উজ্জীবিত করার জন্য উম্মতের রক্তের প্রয়োজন হয়। এজন্য আল্লাহ তাআলা মাঝে মাঝে রক্ত নেন।

জাপানের ঘটনা
গত পরশু ০৫/১২/১৮ জাপানের এক কারগুজারী শুনছিলাম । এক আলেম বলছেন- যিনি জাপান সফর করে এসেছেন সবে মাত্র দু এক দিন হয়েছে। তিনি বলেন- (যে দিন বলেছেন ওই দিনই তিনি সফর করে এসেছেন) তিনি আমাদের শোনাচ্ছিলেন দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ পুরা জাপান ব্যাপী চলছিল। যখন দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ চলছিল তখন এই মাওলানা সাদ এর সাথে ওলামায়ে কেরামের এই মতপার্থক্য শুরু হয়। তখন জাপানের তাবলীগের সাথীরা (মাশোয়ারা) পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, আমরা আপাতত পর্যবেক্ষণ করব, দেখতে থাকব ঘটনা কোন দিকে গড়ায়? যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের কাছে পরিষ্কার হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত চুপ থাকব। আমরা মাওলানা সাদের মারকাজ নিজামুদ্দিন থেকে কোন জামাত আসলে তাদের গ্রহণ করবো আর ওলামায়ে কেরামের পক্ষ থেকে অন্য কোনো জামাত কোনো দেশ থেকে আসলে তাদেরকেও গ্রহণ করব। তাদেরকে আমরা দেখতে থাকি।
এরপর যখন শনিবারে ০১/১২/১৮ এ ঘটনা ঘটল। এই ঘটনা ঘটার পর তার পরের দিন তথা রবিবারে ০২/১২/১৮ জাপান তাবলীগের সমস্ত পুরনো সাথী এবং আলেম-ওলামাদের নিয়ে মিটিং (মাশোয়ারা) ছিল। এরপর ওই মাশোয়ারা হতে সিদ্ধান্ত হয় যে, যারা আলেম ওলামার গায়ে হাত তুলতে পারে তারা কখনো উম্মতের জন্য উপকারী হতে পারে না। এরপর তারা সিদ্ধান্ত নেন যে, আলেম-ওলামা যা বলবে আমরা তাই শুনবো আল্লাহর বান্দারা আপনারা দেখেছেন- শত শত তালেবে এলেম, শত শত আলেম ওলামা টঙ্গির ময়দানে রক্ত ঝরিয়েছেন। মূলত আল্লাহ বদরের (যুদ্ধের) পর ইসলামকে উজ্জীবিত করেছেন। গোটা বিশ্বব্যাপী ইসলামের পতাকা উড্ডীন করেছিলেন। আল্লাহর রহমতের উপর আশা রেখে আমরা আল্লাহর কসম করে এ কথাও বলতে পারি- খোদার কসম! আলেম ওলামার এ রক্তের বিনিময়ে দাওয়াত ও তাবলীগ আবার পুনরায় সারা বিশ্বে তার পতাকা উড্ডীন করবে ইনশাআল্লাহ।

ফেৎনাবাজদের অবসান সুনিশ্চিত
আর যারা উম্মতের মধ্যে ফিতনা ছড়ায়। যেমনিভাবে কাদিয়ানীরা এই উম্মতের মধ্যে ফিতনা সৃষ্টি করে টিকে থাকতে পারে নাই। যেমনিভাবে মাওলানা মওদূদী ফিৎনা সৃষ্টি করে টিকে থাকতে পারে নাই। যেমনিভাবে ডাক্তার স্কলাররা উম্মতের মধ্যে ফিৎনা সৃষ্টি করে টিকে থাকতে পারে নাই। তেমনিভাবে মাওলানা সাদ ও ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। উম্মতের মধ্যে যে ফিতনা সৃষ্টি করে তার কোনো অবস্থান উম্মতের মধ্যে হবে না।

সাদপন্থী আলেমরা সর্বনিকৃষ্ট আলেম
তারা একটা কথা বলে থাকে বলে থাকে যে, আমাদের সাথে তো আলেম-ওলামা আছে। বলে এ কথা? আমাদের সাথেও আলেম ওলামা আছে? বলে! এবার দেখেন এই কথাটার জবাব আমরা হাদিসে কী পাই! রাসূল ﷺ বলেন,

إِنَّ مِنْ أَشْرَاطِ السَّاعَةِ أَنْ يُلْتَمَسَ الْعِلْمُ عِنْدَ الأَصَاغِرِ

নিশ্চয় কেয়ামতের আলামত হলো যে, লোকজন তাদের ছোটদের (নিকৃষ্টদের) থেকে ইলম তালাশ করবে। (কিতাবুয যুহদ, ইবনু মুবারক ৬০)

এই হাদীসের ব্যাখ্যায় আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযিআল্লাহু আনহু বলেন-

واذاالتمسوامن أصاغرهم واشرارهم هلكوا

লোকজন যখন তাদের হীন ও দুষ্ট লোকদের থেকে ইলম তালাশ করবে, তখন তারা ধ্বংস হবে।

এই কথার অর্থ কী? এই কথার অর্থ হল- ওলামায়ে কেরামের বাজারে যাদের মূল্য নাই। কেয়ামতের একটা আলামত হলো- কিছু মানুষ তাদেরকে আলেম বানিয়ে তাদের কাছ থেকে ইলম গ্রহণ করবে।

ওলামায়ে কেরামের বাজারে যাদের মূল্য নাই কেয়ামতের আগে কিছু মানুষ তাদেরকে আলেম বানিয়ে তাদের কাছ থেকে ইলম গ্রহণ করবে।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন- যখন মানুষ এই সমস্ত লোক যাদের নাম-দাম ওলামায়েকরামের বাজারে নাই, ওলামায়ে কেরামের সমাজে যাদের কোন মূল্য নাই, ওলামায়ে কেরামের সমাজ যাদেরকে চিনে না, যাদেরকে জানে না, তাদের থেকে যখন মানুষ এলেম গ্রহণ করা শুরু করবে তখন যার থেকে এলেম গ্রহণ করবে সে হলো উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে দুষ্ট সবচেয়ে ফিতনাবাজ। আর এই ফিতনাবাজ থেকে এলেম গ্রহণ করার কারণে এই দুষ্ট লোকটা থেকে এলেম গ্রহণ করার কারণে। যারা করবে তারা ধংস হয়ে যাবে! তারা ধ্বংস হয়ে যাবে!!
এখান থেকে বুঝা যায়, তারা যে বলে- আমাদের সাথে আলেম-ওলামা আছে। আপনারা ভালো করেই জানেন- তাদের সাথে যে সমস্ত আলেম-ওলামা আছে ঐ সমস্ত আলেম ওলামার মূল্য বাজারে আগেও ছিল না এখনো নাই। আলেম ওলামার সমাজে তাদের নাম ছিল না। কে এই তথাকথিত আশরাফ আলী? কে এই ওয়াসিফ গং? এগুলোতো কোন আলেম নয়। আর কে এই তথাকথিত নাসিম? এগুলোতো কোন আলেম নয়। আলেম নামে জাহেল মূর্খ।
আর কথিত ওলামায়ে কেরামের সমাজে যাদের নাম নাই যাদের নাম শোনা যায় না, তাদের থেকে যদি তোমরা এলেম গ্রহণ করো তাহলে ওয়াসিফ গং-রা হলো সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী! বড় ফেতনাবাজ !! বলেছেন নবীজির সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযিআল্লাহু তা’আলা আনহু। আর তাদের অনুসারীরা যারা, তারা ধ্বংস হয়ে যাবে! ধ্বংস হয়ে যাবে!! ধ্বংস হয়ে যাবে!!!

ইমাম আহমদ ইবনে রহমাতুল্লাহি আলাইহি-এরউক্তি
এক্ষেত্রে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহমাতুল্লাহি আলাইহি চমৎকার বলেছেন,

أَنَّ لُحُومَ العُلَمَاءِ مَسْمُومَةٌوَعَادَةَ اللهِ فِي هَتْكِ أَسْتَارِ مُنْتَقِصِهِمْ مَعْلُومَةٌ

মনে রাখবে, যারা ওলামায়ে কেরামের গীবত কর, ওলামায়ে কেরামের গোস্ত বিষ বিষ বিষ। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি ওলামায়ে কেরামের গোস্ত খাবে ওলামায়ে কেরামের গীবত করবে; তাহলে তার উপর আল্লাহর আযাব আসবেই এই কথা স্বতঃসিদ্ধ। (আল মাজমু’ ,নববী ১/৫৮৯)

যেমনভাবে আসমান আছে এই কথা স্বতঃসিদ্ধ। যেমনিভাবে জমিন আছে এই কথা স্বতঃসিদ্ধ। যেমনিভাবে বাতাস আছে এই কথা স্বতঃসিদ্ধ। ঠিক তেমনিভাবে আলেম ওলামারা গীবত যারা করবে তাদের উপর আল্লাহর আযাব আসবেই; এ কথাও স্বতঃসিদ্ধ।

ইবনে আসাকির রহমতুল্লাহি আলাইহি এর উক্তি
এই মর্মে ইবনে আসাকির রহ. বলেন- তিনি একজন হাফেযে হাদীস ছিলেন। তিনি বলেন- শুনে রাখ জেনে রাখ!

وَأَنَّ مَنْ أَطْلَقَ لِسَانَهُ فِي العُلَمَاءِ بالثَّلْبِ بَلاََه ُاللهُ قَبْلَ مَوْتِهِ بِمَوْتِ القَلْبِ

যে ব্যক্তি তার জবানকে দরাজ-লম্বা করবে, আলেম ওলামার গীবত করার ব্যাপারে যে ব্যক্তি জবান দরাজ লম্বা করবে আলেম ওলামার সমালোচনা করার ব্যাপারে। মওতের আগে আল্লাহ তাআলা তাকে বেঈমান করে ছাড়বেন। নাউযুবিল্লাহ। (আল মাজমু’ ,নববী ১/৫৮৯)

এ জন্য ফতোয়ার কিতাব খুলে দেখুন! যে কোন ফতোয়ার কিতাব খুলে দেখুন!! ফতোয়ায়ে শামীসহ যে কোনো ফতুয়ার কিতাব খুলে দেখুন!!! আলেম-উলামার কিংবা আলেম হওয়ার কারণে যদি কেউ সমালোচনা করে সেখানে লেখা আছে-كاد أن يكفر সে ব্যক্তি বেইমান হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

যে ব্যক্তি আলেম ওলামার সমালোচনা করে তার পরিণতি যদি এমন হয়, যে লোকটা আলেম ওলামার রক্ত ঝরালো সেই লোকটার অবস্থা কেমন হবে! আল্লাহর রহমত এর উপর, আল্লাহর বিচার এর উপর আশা রেখে আমরা এ কথা বলি- যে লোকটা আলেম ওলামার রক্ত ঝরায় সেই লোকটা বেঈমান হয়ে মরবে। নাউজুবিল্লাহ। আল্লাহ আমাদেরকে বুঝার তৌফিক দান করুন।

আল্লামা নিজামুদ্দিন শামযী রহমতুল্লাহি আলাইহি এর মূল্যবান উক্তি
হযরত মাওলানা নিজাম উদ্দিন শামযী রহমতুল্লাহি আলাইহি এর একটি কথা মনে পড়ল। কথাটা বলেই আমি আমার সামনের আলোচনায় চলে যাব। আল্লামা নিজামুদ্দিন শামযী অনেক বড় আলেম ছিলেন। এই আল্লামা বলেন- এই মহা মণীষী বলেন- এ গোটা দুনিয়াতে ইহুদি খ্রিস্টানরা যতগুলো চক্রান্ত করে, অতীতে করেছে, বর্তমানে করছ, ভবিষ্যতেও করবে। তিনি বলেন- সবগুলো চক্রান্তের ফিরিস্তি তৈরি করে, সবগুলো চক্রান্তের উপর বিস্তারিত আলোচনা করে যদি কয়েক ভলিউমে কয়েক হাজার পৃষ্ঠার বই লিখা হয় তাহলে বইটা যত বড়ই হোক না কেন, এই বইয়ের নাম থাকবে? থাকবে। তিনি বলেন এই বইয়ের নাম হবে এই- ‘সাধারণ মানুষের অন্তরে আলেম ওলামার প্রতি বিদ্বেষ তৈরি কর।’ এই বইয়ের নাম হবে এই- ‘সাধারণ মানুষের অন্তরে আলেম ওলামার ব্যাপারে কুধারণা তৈরি কর।’ ঐ বইয়ের নাম হবে- ‘সাধারণ মানুষের সাথে আলেম ওলামার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে দাও।’

লাভ কী এতে?
সাধারণ মানুষের সাথে আলেম ওলামার সম্পর্ক নষ্ট হলে কী হবে? মুফতি শফি রহমতুল্লাহি আলাই বলেন- কী হবে শুনো! হবে তো এই যে- সাধারণ মানুষের সাথে যদি আলেম ওলামার সম্পর্ক নষ্ট হয় যেমনভাবে রাখাল বকরি চরানোর জন্য মাঠে যায় আর যদি রাখাল চরানোর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে চলে আসে, তাহলে যেকোনো সময় যেকোনো হিংস্র জানোয়ার বকরিগুলোর উপর আক্রমণ করার ভয় থাকে। ঠিক তেমনিভাবে আলেম ওলামার কাঁধে সাধারণ মানুষের ঈমান আমলের দায়িত্ব আল্লাহ দিয়েছেন। যদি আলেম-ওলামা সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তাহলে ইহুদি খ্রিস্টান নামক জরানোয়াররা, ইহুদি খ্রিস্টান নামক হায়েনার, এই সমস্ত জানোয়াররা সাধারণ মানুষের রক্ত চোষা শুরু করে দিবে। এই জন্য আপনি যত চক্রান্ত বলেন- আপনি কাদিয়ানীর চক্রান্ত বলেন কিংবা তথাকথিত ইসলামী জামাতের চক্রান্ত বলেন কিংবা তথাকথিত আহলে হাদীসের চক্রান্ত বলেন কিংবা তথাকথিত ডাক্তারদের চক্রান্ত বলেন কিংবা সাদের চক্রান্ত বলেন, খৃস্টানরা আলেম-ওলামাদের যে মৌলবাদী বলে, সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ বলে, ওই সমস্ত চক্রান্ত বলেন, সমস্ত চক্রান্তের গোড়ার কথা একটা- আলেম ওলামার সাথে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক নষ্ট করে দাও। এই সম্পর্ক নষ্ট হলেই তখন সাধারণ মানুষের নাকে দড়ি লাগিয়ে যেমন ইচ্ছা তেমন ব্যবহার করতে পারবে।
সাদপন্থীরা আলেম ওলামার প্রতি তাদের আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে খ্রিস্টানদের দালাল এই সাদ তার অনুসারীদেরকে এখন নাকে দড়ি লাগিয়ে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে ব্যবহার করছে। আল্লাহ আমাদেরকে বুঝার তৌফিক দান করুন।

এজন্য একজন মানুষ হেদায়েতের উপর নাই এ কথার ৬ টি আলামত
এক নম্বর আলামত হল- অহংকার এর সাথে গুনাহ করা। মনে আছে? না ভুলে গেছেন? মনে আছে।
দুই নাম্বার আলামত হল- নেক কাজ করাটাকে লজ্জার মনে করা, শরমের মনে করা।
তিন নাম্বার আলামত হল- উম্মতের নেক জামাতকে দেখতে না পারা। উম্মতের নেকদলকে দেখতে না পারা।
চার নম্বর আলামত শুনার জন্য আমরা সকলেই মানসিক পস্তুতি গ্রহণ করি

চার নম্বর আলামত : উপদেশকে বিরক্তিকর মনে করা
চার নম্বর আলামত হল- নসিহতকে উপদেশকে ওয়াজকে বিরক্তিকর মনে করা। কোন ব্যক্তি যদি নসিহতকে ওয়াজকে বিরক্তিকর মনে করে। আলামত হলো ওই লোকটা হেদায়েতের উপর নাই।

দৃষ্টান্ত-১
দাওয়াত ও তাবলীগের ভাইয়েরা যে বেচারাকে দাওয়াতের জন্য গেছে, দাওয়াত দিতে গিয়ে যখন তার সামনে দাঁড়ালো তখন কিছু কথা আল্লাহর বড়ত্বের কথা আখেরাতের কথা, কিছু কথা তারা তাদের এলেম মত বলল। বলার পরে এই লোকটা জবাব দিল ঘ্যান-ঘ্যান করবেন না। ওয়াজ আমিও কম জানি না। আছে নাকি আমাদের এ সমাজে? আছে না কি এরকম লোক যে বলেঘ্যান-ঘ্যান করবেন না, ওয়াজ আমিও কম জানি না? আছে। এভাবে যে লোকটা নসিহতকে বিরক্তিকর মনে করে আলামাত হলো ওই লোকটা হেদায়েতের উপর নাই।

দৃষ্টান্ত-২
ছেলে নামায পড়ে না। বাবা মাশাআল্লাহ নামায পড়ে। নামায পড়ার কারণে ছেলেকে নামাযের দাওয়াত দিয়েছেন। স্বামী স্ত্রীকে নামাযের দাওয়াত দিয়েছে্ন। বড় ভাই ছোট ভাইকে নামাযের দাওয়াত দিয়েছে। আলেম নামাযের দাওয়াত দিয়েছেন। এখন তার কাছে এই দাওয়াতটা বিরক্তিকর মনে হলো। আলামত হলো লোকটা হেদায়েতের উপর নাই

সুদখোরের কাণ্ড
আমার মনে আছে বিগত ৭ থেকে ৮ বছর আগে আমি ঢাকায় যে মসজিদে জুমা’ পড়াই ওই মসজিদে জু্মায় সুদের ব্যাপারে ওয়াজ করছিলাম। তখন মসজিদ থেকে বের হয়ে এক আল্লাহর বান্দা এমন ক্ষেপা ক্ষেপলো যে, হুজুর কি আর ওয়াজ খুঁজে পায় না? শুধু সুদের ওয়াজ পাইছে আর কি কোনো ওয়াজ নাই? এই ক্ষেপার পিছনে কারণ কী? পরে জানতে পারলাম- এই ক্ষেপার পেছনে মূল কারণ হলো- ওই লোকটা সুদের কারবার এর সাথে জড়িত। এজন্য দেখবেন- সমাজে মসজিদের মধ্যে যখন ইমাম সাহেব কোন ওয়াজ করেন। বলেন তো- ইমাম সাহেবের ওয়াজ করার স্বাধীনতা আছে কি না? (আছে) কে দিয়েছে? আল্লাহ এবং তার রাসুল দিয়েছেন! এখন তিনি কোন বিষয়ে ওয়াজ করেছেন। কারো গায়ে লেগে গেছে। গায়ে লেগে যাওয়ার কারণে সে ওই ইমামের পেছনে চক্রান্ত শুরু করে দিয়েছে। আলামত হলো- ঐ লোকটা পথভ্রষ্ট। ঐ লোকটা হেদায়েতের উপর নাই।

পাঁচ নাম্বার আলামত শোনার জন্য আমরা সকলেই মানসিক পস্তুতি গ্রহণ করি। আশা করি আমাদের বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। আমাদের সমাজে আমরা কতজন হেদায়েতের উপর আছি আর কতজন হেদায়েতের উপর নাই। অথচ এ হেদায়েত এতটাই দামি আল্লাহতালা প্রত্যেক দিন প্রত্যেক নারী-পুরুষকে একবার নয় দুইবার নয় ৩২ বার বাধ্য করেন- তোমরা আমার কাছে হেদায়েত চাও! আমার কাছে হেদায়েত ভিক্ষা চাও!!
اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ

পাঁচ নং আলামত : অন্তরে হিংসা থাকা
যে ব্যক্তির অন্তরে হিংসা আছে সে লোকটা হেদায়েতের উপর নাই

অন্তরে হিংসা আছে কিনা বুঝার উপায়
আপনি বলতে পারেন হুজুর আমার মধ্যে হিংসা নাই। আপনি দেখেন তো অপর মুসলমানের কোন নেয়ামত দেখে আপনার অন্তর জ্বলে ওঠে কিনা? আপনার মনে চায় কিনা তার কাছে টাকা আছে, টাকা না থাকুক। অমুকের কাছে এলেম আছে, এলেম না থাকুক। অমুক দেখতে সুন্দর, এমন টা না হোক। অমুককে মানুষ সম্মান করে, সম্মান না করুক। এটা যদি আপনার অন্তর চায় তাহলে বুঝা যাবে যে আপনার অন্তরে হিংসা আছে।

দৃষ্টান্ত
একজন মানুষ যে হিংসার কারণে গোমরাহ হয় এর দলিল কী এর প্রমাণ কী? এর দলিল হল ইবলিশ শয়তান, ইবলিশ। আদমকে সিজদা করার জন্য যখন তাকে বলা হয়েছে- মুফাসসিরীনে কেরামের লিখেন তার অন্তরের মধ্যে তখন তিনটা গুনাহ একসাথে জেগেছিল।

হাফেয ইবনুল কাইয়িম রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর বাণী
এই জন্য এই মুসলিম বিশ্বের একজন বড় আলেমেদীন খুব চমৎকার কথা বলেছেন- মজা পাবেন। মনে রাখলে সারা জীবন কাজে আসবে ইনশাআল্লাহ। হাফেয ইবনুল কাইয়িম রহমাতুল্লাহি আলাইহির কথা। হাফেয ইবনুল কাইয়িম রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন- এই দুনিয়াতে যত গুনাহ পরিচালিত হয় সবগুলো গুনাহের তিনটা ইঞ্জিন। বলেন কয়টা? তিনটা। আর সবগুলো গুনাহের দুইজন ড্রাইভার, একজন ট্রাফিক।
[তিন ইঞ্জিন দুই ড্রাইভের এক ট্রাফিক]
তিনি বলেন- চাই এগুনাহ-টা কুফুরি হোক। চাই এগুনাহ-টা শিরকি হোক। চাই এগুনাহ-টা অফিসের সুদের কারবার ঘুষের কারবার হোক অথবা সমাজের বেপর্দা হোক। যে গুনাই হোক না কেন সমস্ত গুনাহর পেছনে তিনটি গুনাহ ইঞ্জিন হিসেবে কাজ করে।

 তিনটি ইঞ্জিন  কী?
একটা ইঞ্জিনের নাম হল অহংকার। বলেন- একটা ইঞ্জিনের নাম হলো কী? অহংকার।
দুই নম্বর ইঞ্জিনের নাম হল- হিংসা। বলেন কী? হিংসা।
তিন নম্বর এর নাম হল- লোভ।
অহংকার হিংসা লোভ এই তিনটা ইঞ্জিন দ্বারা সমস্ত গুনাহ পরিচালিত হয়। এখন এই ইঞ্জিন চালানোর জন্য ড্রাইভার লাগবে না? ড্রাইভার হলো দুইজন।

দুইজন ড্রাইভার কে?
এক ড্রাইভ এর নাম হলো- নফস মানে মন। যেভাবে মন চায় সেভাবে চলা।
মন চেয়েছে এখন মুভি দেখবো। কেন? অবৈধ উপায়ে যৌন চাহিদা পূরণের লোভ।
মন চেয়েছে এখন সুদের কারবার করবো। কেন? অবৈধ উপায়ে অর্থ সম্পদ উপার্জনের লোভ।
মন চেয়েছে এখন পর নারীর প্রতি কুদৃষ্টি দিব। কেন? অবৈধ উপায়ে যৌন চাহিদা পূরণের জন্য।
মন চেয়েছে এখন অমুকের গীবত করব, সমালোচনা করবো। কেন? নিজের সম্মান বাড়ানোর লোভ।

লোভ তিন প্রকার
১. সম্মান বাড়ানোর লোভ
২. অর্থের লোভ
৩. অবৈধ উপায়ে যৌন চাহিদা পূরণের লোভ
আর সমস্ত গুনাহ পরিচালিত হয় হয়তো অহংকারের কারণে অথবা লোভের কারণে অথবা হিংসার কারণে।
একজনকে আমি অপবাদ দিচ্ছি। কেন? আমি তার ব্যাপারে অপবাদ দিচ্ছি তাকে দেখতে পারি না। হিংসার কারণে। আমি টাখনুর নিচে কাপড় পরি কেন? অহংকারের কারনে। আমি একজন বড় ব্যক্তির সামনে উঁচু গলায় কথা বলি। কেন? অহংকার এর কারণে। ছোটকে সালাম দিতে পারি না। কেন? অহংকার এর কারণে। এভাবে যতগুলো গুনাহ পরিচালিত হয় সবগুলো গুনাহর পেছনে মূল তিনটা জিনিস কার্যকর। একটা ইঞ্জিনের নাম হল- অহংকার। আরেকটা ইঞ্জিনের নাম হল- হিংসা। আরেকটা ইঞ্জিনের নাম হলো- লোভ।
আর দ্বিতীয় ড্রাইভার এর নাম হলো রাগ বা গোস্বা। গোস্বার কারণে মানুষ গুনাহ করে। গোস্বার কারণে জুলুম করে। গোস্বার কারণে অপবাদ দেয়। গোস্বার কারণে মিথ্যা বলে। গোস্বার কারণে আরও অনেক গুনাহ হয়।

ট্রাফিকের পরিচয়
আর এই ড্রাইভার কোন দিকে যাবে এর জন্য একটা ট্রাফিকের দরকার আছে না? এ ট্রাফিক এর নাম হলো ইবলিশ। বলেন ট্রাফিকের নাম কী? ইবলিস। যেহেতু এই তিনটা ইঞ্জিন থেকে বেঁচে থাকা আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য আমি প্রত্যেকটা ইঞ্জিন থেকে বেঁচে থাকার জন্য একটা একটা চিকিৎসা বলব। কে কে আমল করতে রাজি আছি সবাই? অনেকগুলো চিকিৎসা থেকে শুধু একটা একটা বলব। কারণ সময় কম।

অহংকার থেকে বাঁচার উপায়
অহংকার নমুনা থেকে বেঁচে থাকার জন্য হাদিস এর চিকিৎসা হলো- বেশি করে সালাম দেওয়া। বলেন কী? বেশি করে সালাম দেওয়া। কীভাবে দেখেন খুব লক্ষ্য করে!
বাবা ছেলেকে সালাম দিতে পারেনা কেন? বাবা হওয়ার অহংকার।
বুড়া যোয়ানকে সালাম দিতে পারেনা কেন? বুড়া হওয়ার অহংকার।
শিক্ষিত-অশিক্ষিত কে সালাম দিতে পারেনা কেন? শিক্ষিত হওয়ার অহংকার।
শ্বশুর জামাইকে সালাম দিতে পারেনা কেন? শশুর হওয়ার অহংকার।
শাশুড়ি বউমাকে সালাম দিতে পারেনা কেন? শ্বাশুড়াী হওয়ার অহংকার।
বড় ভাই ছোট ভাইকে সালাম দিতে পারেনা কেন? বড় ভাই হওয়ার অহংকার।
ধনী গরীবকে সালাম দিতে পারেনা কেন? ধনী হওয়ার অহংকার।
চেয়ারম্যান সাহেব সাধারণ মানুষকে সালাম দিতে পারে না কেন? চেয়ারম্যান হওয়ার অহংকার।
প্রিন্সিপাল সাধারণ শিক্ষককে সালাম দিতে পারেনা কেন? প্রিন্সিপাল হওয়ার অহংকার।
শিক্ষক ছাত্রকে সালাম দিতে পারেনা কেন? শিক্ষক হওয়ার অহংকার।
ইমাম মুসল্লিকে সালাম দিতে পারেনা কেন? ইমাম হওয়ার অহংকার।
হুজুর সাধারণ মানুষকে সালাম দিতে পারেনা কেন? হুজুর হওয়ার অহংকার।
স্বামী-স্ত্রীকে সালাম দিতে পারেনা কেন? স্বামী হওয়ার অহংকার।
আর আমার আপনার নবী ছিলেন সমস্ত অহংকার থেকে মুক্ত। তাই তিনি ছোট-বড় সকলকে সালাম দিতেন। সুতরাং হাদিসের চিকিৎসা হলো বেশি করে সালাম দেওয়া। আর নবীজি বলেছেন,

الْبَادِئُ بِالسَّلَامِ بَرِيءٌ مِنَ الْكِبْرِ

যে ব্যক্তি সালাম আগে শুরু করতে পারবে আল্লাহ তাআলা তাকে ধীরে ধীরে অহংকার থেকে মুক্তি দিয়ে দেবেন। (শুয়াবুল ঈমান, বায়হাকী ৮৪০৭)

এজন্য এই শিক্ষা গ্রহণ করবেন তো ইনশাআল্লাহ?

হিংসা থেকে বাঁচার উপায়
দুই নাম্বার ইঞ্জিনের নাম হল- হিংসা। দুই নম্বর ইঞ্জিনের নাম কী? হিংসা। কোরান হাদিস থেকে সবচাইতে বড় চিকিৎসা হল- যার ব্যাপারে হিংসা হয় তার সাথে দুইটা আচরণ করবেন! একটা আচরণ হলো- তার সাথে আপনি আগ বাড়িয়ে সদাচরণ করবেন। তার সাথে আপনি আগ বাড়িয়ে ভালো ব্যবহার করবেন। তার সাথে আপনি আগ বাড়িয়ে সালাম দিবেন। আর সে যদি আপনার সাথে অন্যায় করে আপনি তাকে মাফ করে দিবেন।
আর দ্বিতীয় চিকিৎসা (তা মূলত এক চিকিৎসারই দুটি শাখা) হলো- তার কাছে যে নেয়ামতটা থাকার কারণে আপনার হিংসা হয় ওই নেয়ামতের ব্যাপারে আপনি দোয়া করবেন।
যেমন- তার সম্পদের কারণে আপনার হিংসা হচ্ছে, তাহলে আপনি এভাবে দোয়া করবেন- ‘আল্লাহ আপনি তার সম্পদ আরো বাড়িয়ে দিন!’
তার এলেম এর কারণে হিংসা হচ্ছে, আপনি মনের বিপরীত এই দোয়া করবেন- ‘হে আল্লাহ! আপনি তার এলেম আরো বাড়িয়ে দিন!’
সে দেখতে-শুনতে সুন্দর এই জন্য আপনার হিংসা হচ্ছে। আপনি দোয়া করবেন- ‘হে আল্লাহ! আপনি তাকে আরো সুন্দর বানিয়ে দিন!’ যে কারণে হিংসা হচ্ছে আপনি আপনার মনের বিপরীতে সে জন্য দোয়া করবেন। পারবেন না ইনশাআল্লাহ!

লোভ থেকে বাঁচার উপায়
তিন নাম্বার ইঞ্জিনের নাম হচ্ছে- লোভ। হাদীস থেকে এর চিকিৎসা হলো- দান-সদকা খয়রাত এগুলো বেশি বেশি করে করা। যে ব্যক্তি বেশি বেশি করে দান করে দান, সদকা, খয়রাত করতে পারবে আল্লাহ তাআলা তার অন্তর থেকে ধীরে ধীরে লোপ দূর করে দিবেন। এই চিকিৎসা হলো লোভ যদি সম্পদের লোভ হয়।
আর যদি লোভ হয় অবৈধ উপায়ে যৌন চাহিদা পূরণের, তাহলে এই রোগের চিকিৎসা কী? রোগের চিকিৎসা হলো- পুরুষ হলে দৃষ্টির হেফাজত করা আর মহিলা হলে পর্দার সাথে চলা। তাহলে আল্লাহতায়ালা ধীরে ধীরে তার অন্তর থেকে এই রোগ দূর করে দিবেন।
আর যদি লোভ হয় পদমর্যাদা পাওয়ার লোভ। তাহলে এই রোগের চিকিৎসা কী? এই রোগের চিকিৎসা হলো- আলেম-ওলামা সাথে বেশি করে চলাফেরা করা। তাদের সাথে উঠাবসা করলে আল্লাহতালা ধীরে ধীরে তার অন্তর থেকে এই রোগটা ও দূর করে দিবেন। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে সবগুলো রোগ দূর করার তৌফিক দান করুন আমীন।
যাই হোক সেটা বলতে যাচ্ছিলাম- একজন মানুষ হেদায়েতের উপর নাই এর পাঁচ নাম্বার আলামত হচ্ছে- হিংসা। বলেন পাঁচ নাম্বার আলামত কী? হিংসা। আমার সময় শেষ হয়ে আসছে এজন্য ছয় নাম্বার আলামত বলে হেদায়েতের উপর কীভাবে আসবো এ সম্পর্কে পাঁচ-সাত মিনিট একটা সংক্ষিপ্ত রাস্তা বলে আমার আলোচনা শেষ করবো ইনশাআল্লাহ।

ছয় নাম্বার আলামত : কুরআন হাদিস সামনে আসার পরও টালবাহানা করা
কুরআন-হাদীস সামনে আসার পরও যে লোকটা বাপ-দাদার দোহাই দিয়ে কুরআন হাদিস মানতে পারে না; আলামত হলো- লোকটার হেদায়েতের উপর নাই।

দৃষ্টান্ত:
আমাদের সমাজে যারা মিলাদ কিয়াম পার্টি সিন্নী পাটি; তারা এই রোগে লিপ্ত। যখন তাদের বলা হয় কুরআনে তো মিলাদ-কিয়াম নাই। আলহামদুলিল্লাহ আমাদের নোয়াখালী অঞ্চলে তো এগুলো নাই। আছে নাকি? আছে। তো যখন তাদের বলা হয় কুরআনে তো নাই এই মিলাদের কথা। আছে দুরুদের কথা। হাদীসে আছে- ‘নবীজি আলাইহিস সালাম কখনও কিয়াম করে নাই। সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম কখনও কিয়াম করেন নাই। তোমরা কোত্থেকে কর? তখন বলে- বাপ-দাদা কইরা আসছে, মানুষ কইরা আসছে, এত মানুষ করে।

যেই লোকটা এভাবে কুরআন হাদীসের সামনে মানুষের দোহাই দিবে। কুরআন হাদীসের সামনে বাপ দাদার দোহাই দিবে। আলামত হলো- ঐ লোকটা হেদায়েতের উপর নাই। তাহলে একজন মানুষ হেদায়েতের উপরে নাই এর সর্বমোট কয় আলামত? (ছয় আলামত) বলেন- এর সর্বমোট কয় আলামত? ছয় আলামত। এই ছয় আলামতের শিরোনাম বলে দিয়ে হেদায়েতের উপর আসার রাস্তা কী হবে- আমি সে দিকে চলে যাব।
এক নাম্বার. আলামত হল- কোন ব্যক্তি যদি অহংকারের সাথে গুনাহ করে তাহলে আলামত হলো- ঐ লোকটা হেদায়েতের উপর নাই।

দুই নাম্বার. নেক কাজ করতে যদি লজ্জাজনক মনে হয়, শরমের মনে হয়, আলামত হলো ঐ লোকটা হেদায়েতের উপর নাই।
তিন নাম্বার. উম্মতের নেক জামাতকে যদি দেখতে না পারে, তার সাথে যদি শত্রুতা রাখে, বিদ্বেষ রাখে, আলামত হলো- ওই লোকটা হেদায়েতের উপর নাই।
চার নাম্বার. নসীহত বা উপদেশ বা ওয়াজকে যদি কোনো ব্যক্তি বিরক্তিকর মনে করে, আলামত হলো- ওই লোকটা হেদায়েতের উপর নাই।
পাঁচ নাম্বার. কোন ব্যক্তির অন্তরে যদি হিংসা থাকে, আলামত হলো- ওই লোকটা হেদায়েতের উপর নাই। ছয় নাম্বার. কোন ব্যক্তির সামনে কুরআন হাদীস স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও সে যদি বাপ-দাদার দোহাই দেয়, আলামত হলো- ওই লোকটা হেদায়েতের উপর নাই। এবার হেদায়েতের উপর আসার দরকার আছে কি না? আছে।
আমরা আশা করি এখানে বসেই টের পেয়ে গেছি কে কে আমরা হেদায়াতে নাই। শুরুতেই বলেছি আঙ্গুল টাকার দিকে রাখবো নিজের দিকে এজন্য আমরা আশাকরি প্রত্যেকে টের পেয়ে গেছি কে কে আমরা হেদায়েতের উপর নাই (আর কে কে আছি।)

হেদায়েতের উপর আসার পদ্ধতি
হেদায়েতের উপর আসার মৌলিক চিকিৎসা আল্লাহতায়ালা সূরা ফাতেহার মধ্যে দুইটা দিয়েছেন। একটার নাম হল- দোয়া। আর একটার নাম হল- সোহবত।
সূরা ফাতিহায়-
اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ  এর মাধ্যমে আল্লাহতালা এই পথ দিলেন। এই রাস্তা দিলেন যে হেদায়েত পাওয়ার একটা পথ হলো- দোয়া। আল্লাহর কাছে দোয়া করা। হে আল্লাহ আপনি হেদায়েত দান করুন।
আমি আপনাদের সামনে খুতবাতে যে আয়াতটা তেলাওয়াত করেছি সেটি হল- হেদায়েতের দোয়া সম্পর্কিত। আল্লাহ বলেন-

رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ

হে আল্লাহ আপনি হেদায়েত দেওয়ার পর গোমরাহ করবেন না। হে আল্লাহ আপনি হেদায়েত দান করুন। (মর্মাথর্) তাহলে একটা রাস্তা হল দোয়া। আর কোন হেদায়েত দিবে আল্লাহ তাআলাঅ দ্বিতীয় আয়াতে বলেন,

صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ

যাদেরকে আপনি নেয়ামত দিয়েছেন। হে আল্লাহ! তাদের পথে আপনি আমাকে হেদায়েত দিন! এখান থেকে বুঝা যায় দ্বিতীয় নাম্বার পথ হলো সোহবত। দ্বিতীয় নাম্বার পথ হলো- আলেম-ওলামার কাছে বেশি বেশি আসা যাওয়া করা।

এক নম্বর পথ হলো- দোয়া। এ সম্পর্কে আমি বিস্তারিত আজকের বলতে যাব না। শুধু এতোটুকু বলব- আমরা আমাদের কোনো দোয়াতেই হেদায়েতের দোয়া করতে ভুলব না। রাজি আছি? ইনশাআল্লাহ। আল্লাহর কাছে হেদায়েত চেয়ে দোয়া করব? ইনশাআল্লাহ। মনে রাখবেন! এ সম্পর্কে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা সেটা হলো- ধনসম্পত্তি, টাকা-পয়সা আল্লাহ না চাইলেও দেন। যেমন আল্লাহ কারুনকে দিয়েছেন ফেরাউন কে দিয়েছেন আবার এই ধন সম্পদ আল্লাহ নবীদেরকে দিয়েছেন; কিন্তু হেদায়াত এটা এমন একটা জিনিস এমন একটা দামী জিনিস যে, এটা আল্লাহর কাছে ভিক্ষা করা ছাড়া আল্লাহ দেন না। আল্লাহর কাছে মনের থেকে হেদায়েত কামনা করতে হবে। এজন্য আল্লাহর কাছে হেদায়েত ভিক্ষা চাইবেন।

দুই নাম্বার হল আলেম-ওলামাদের সোহবতে থাকবেন। আলেম-ওলামার কাছে আসা যাওয়া করবেন। এতে হবে কী? (একটা ছোট উদাহরণ দিয়ে আমি আমার আলোচনা শেষ করবো।)

আমার শায়খ ও মুরশিদ বলেন
দেখো একটা বাচ্চার যখন জন্ম গ্রহণ করে জন্মগ্রহণ করলেই তখন সে মায়ের দুধ পান করে এছাড়া অন্য কিছু তার পেটে সয়না যখন বাচ্চাটা আরেকটু বড় হয় তখন আস্তে আস্তে গরুর দুধ পান করা শুরু হয়। আরেকটু বড় হলে তখন আস্তে আস্তে ছোট খাবার খাওয়া শুরু করে। আরেকটু বড় হলে যে কোন খাবার খেতে সক্ষম হয়। ঠিক তেমনিভাবে আলেম ওলামার বুকের সাথে যদি আপনি লেগে থাকেন তাহলে আপনি যে কোনো রাস্তায় হেদায়েত পাবেন। আর যদি আলেম-ওলামা থেকে বিচ্ছিন্ন হন তাহলে আপনি বোখারী শরিফ বোগলে নিয়ে হাটবেন, হেদায়েত পাওয়ার চিন্তা করবেন। ডাক্তারদের কথা শুনবেন হেদায়েত পাওয়ার চিন্তা করবেন। আল্লাহর বান্দা এগুলো এখন আপনার হজম হবে না। বদহজম হবে। আপনি পড়েন নিষেধ করি নাই। আপনি ডাক্তারদের লেকচার শুনেন নিষেধ করি নাই। সাদের বক্তব্য আপনি শুনেন নিষেধ করি নাই। মিথ্যুক মতিউর রহমান মাদানীর বক্তব্য শুনেন নিষেধ করি নাই। মিথ্যুক আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ এর বক্তব্য শুনেন নিষেধ করি নাই। বেদআতীদের বক্তব্য শুনেন নিষেধ করি নাই। তবে আলেম’-ওলামার বুকের সাথে লেগে থাকেন, তাদের সাথে লেগে থেকে পেটের হজমটা বাড়ান। হজম যদি না বাড়ান আর ডাক্তারদের কথা শুনেন গোমাহ হবেন।

হজম যদি না বাড়ান আর সাদের কথা শুনেন পথভ্রষ্ট হবেন। হজম যদি না বাড়ান আর আপনি ইউটিউব এর বক্তাদের কথা শুনেন আপনার বদ হজম হবে। হজম যদি না বাড়ান আর আপনি বুখারী শরীফ বগলের নিচে নিয়ে হাঁটেন তাহলে বদ হজম হবে। পথভ্রষ্ট হবেন। আর আলেম ওলামার বুকের সাথে লেগে থাকেন, হজম বাড়বে। যে কোন কথা আপনি শুনবেন আপনি কখনো পথভ্রষ্ট হবেন না। আল্লাহ আমাদেরকে হেদায়েতের এই রাস্তাটা গ্রহণ করার তৌফিক দান করুন। আল্লাহ আমাদের সকল গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার তৌফিক দান করুন আমীন।

واخر دعوانا أن الحمد لله رب العلمين

বিশ্ব ভালোবাসা দিবস

বয়ান-৬ : বিশ্ব ভালোবাসা দিবস

اَلْحَمْدُ لِلّهِ وَكَفَى وَسَلَامٌ عَلَى عِبَادِهِ الَّذِيْن َاصْطَفَى اَمَّا بَعْدُ! فَاَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ. بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ.لَا تَقْرَبُوا الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ. بارك الله لنا ولكم في القرآن  العظيم ونفعني وإياكم بما فيه من الآيات والذكر الحكيم وجعلني وإياكم من الصالحين. أقول قولي هذا وأستغفر الله لي ولكم فاستغفروه إنه هو الغفور الرحيم. اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّعَلَى الِ سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّبَارِكْ وَسَلِّمْ

কায়রো কনফারেন্সের প্রোগ্রাম অব এ্যাকশন

১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৪ ইং। জাতিসংঘের উদ্দেশ্যে কায়রোতে একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্স হয়েছিল। কনফারেন্সের বিষয়বস্তু ছিল– নাগরিক উন্নয়ন ও পরিবার পরিকল্পনা। এ বিষয়বস্তুটি ছিল উক্ত প্রোগ্রামের বাহ্যিক বিষয়বস্তু। মূলত এ বিষয়বস্তুর মাঝে লুকিয়ে ছিল, মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে এক গভীর ষড়যন্ত্র। মুসলমানদের স্বাতন্ত্র-দেয়াল ভেঙ্গে দেয়াই ছিল উক্ত প্রোগ্রামের আসল উদ্দেশ্য। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে লজ্জা শালীনতা ও সতীত্বের মত পবিত্র মূল্যবোধ মুসলমানরা লালন করে আসছে সেগুলোকে মাটিতে মিশিয়ে দেয়াই ছিল উক্ত কনফারেন্সের প্রোগ্রাম অব এ্যাকশন। উক্ত প্রোগ্রামের পুরো বিবরণ তো এ সংক্ষিপ্ত সময়ে দেয়া সম্ভব নয়; তাই এর দু’ একটি বিষয় উপস্থাপন করছি– যাতে ষড়যন্ত্রের গভীরতা আপনাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে যায়।

যেমন, সেখানে একটি প্রস্তাব ছিল, শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে একেবারে প্রাথমিক পর্যায় থেকে যৌন শিক্ষা (Sex Education) দানের ব্যবস্থা করা হোক। কনডমসহ অন্যান্য গর্ভরোধক সহজলভ্য করা হোক। অধিকহারে এমন পরামর্শকেন্দ্রসমূহ প্রতিষ্ঠা করা হোক যেগুলোতে বিবাহিত-অবিবাহিত সকলকেই যৌনতথ্য সরবরাহ করা যাবে। আর এ লক্ষে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াগুলোকে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

সম্মানিত মুসল্লিয়ানে কেরাম! মূলত গোটা পাশ্চাত্যসমাজ আজ অপবিত্রতা ও নগ্নতার উত্তাপে ছাই হয়ে গেছে। তাদের সমাজে পরিচয় দেয়ার মত বাবা নেই, ভাই নেই, চাচা নেই, মামা নেই, দাদা নেই, নানা নেই। আছে শুধুই ফ্রেন্ড। মা-বাবার রূপ, ভাই-বোনের রূপ, স্বামী-স্ত্রীর রূপ তাদের সমাজ থেকে হারিয়ে গেছে। এখন তাদের আছে শুধু গার্লফ্রেন্ড কিংবা বয়ফ্রেন্ড। যার ফলে তাদের সমাজের নারী ও পুরুষ পেয়ে গেল চাহিদা পুরণের অবাধ সুযোগ। এজন্যই তাদের দেশগুলোতে সেক্স এডুক্যাশন এক স্বাভাবিক কালচার। কিন্তু মুসলমানদের কাছে এগুলো কখনও স্বাভাবিক কালচার হতে পারে না। তারা আমাদেরকে পথহারা করতে চায়। তাদের অসভ্যতা সভ্যতার নামে আমাদের জীবনে ছড়িয়ে দিতে চায়। কায়রো কনফারেন্সের প্রোগ্রাম অব এ্যাকশনের মাধ্যমে আমাদের সামনে মূলত এই কঠিন বাস্তবতাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

এক ইউরোপিয়ান তরুণীর কান্না

একবার তাবলীগ জামাতের একটি দল এডমবরা গিয়েছিল। মসজিদে সবেমাত্র মাগরিবের নামাজ শেষ হয়েছে। এক তরুণী এসে জামাতের একজনকে জিজ্ঞেস করল, ইংরেজি জানো? লোকটি বলল, হ্যাঁ, জানি। মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, তোমরা এখানে কী করলে? লোকটি উত্তর দিল, আমরা ইবাদত করেছি। মেয়েটি বলল, আজ আবার কিসের ইবাদত, আজ তো রোববার নয়? জামাতের লোকটি উত্তর দিল, আমরা আল্লাহর ইবাদত প্রতি দিন পাঁচ বার করি। এরপর লোকটি মেয়েটিকে ইসলাম সম্পর্কে আরো কিছু ধারণা দিল। লোকটি ছিল যুবক। তার কথাবার্তা শোনার পর মেয়েটি হ্যান্ডশেক করার জন্য তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। জামাতের যুবকটি তখন বিনয়ের সঙ্গে বলল, দুঃখিত, আমি তোমার সঙ্গে হাত মেলাতে পারব না। মেয়েটি আশ্চর্য জিজ্ঞেস করল, কেন? যুবক উত্তর দিল, এই হাত দিয়ে আমি কেবল আমার স্ত্রীকে স্পর্শ করি। এ ছাড়া অন্য কোন নারীকে স্পর্শ করি না। এটা আমার স্ত্রীর আমানত। এ কথা শোনার পর মেয়েটি চিৎকার করে কাঁদতে থাকে এবং কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়ে। সে বিলাপ করে বলতে থাকে, তুমি যে মেয়ের স্বামী সে খুব ভাগ্যবান। আহা! আমাদের ইউরোপের পুরুষরা যদি এমন হত!

একটি জরিপ

সম্মানিত মুসল্লিয়ানে কেরাম! এটা হল তাদের নারী স্বাধীনতার মূল্য। এ কেবল একজন তরুণীর কান্না ছিল না। বরং মূলত এটি ছিল গোটা পাশ্চাত্যসমাজের নারীসমাজের কান্না–যা বের হয়ে এসেছে এক তরুণীর কণ্ঠ থেকে। গত ২০০০ সালে একটা জরিপ চালানো হয়েছিল। জরিপে দেখা গেছে, সেখানকার মেয়েদেরকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তোমরা ঘরে থাকতে চাও না ঘরের বাইরে কাজ করতে চাও? তখন তাদের শতকরা আটানব্বই জন উত্তর দিয়েছিল, আমরা ঘরে ফিরে যেতে চাই। কিন্তু সমস্যা হল, আমরা আজ অসহায়। আমাদের ঘরে আমাদের পেছনে স্বামী নেই, ভাই নেই, বাবা নেই। বয়ফ্রেন্ডরা তাদের নিজেদের গরজ শেষ হবার পর আমাদেরকে টিস্যু পেপারের মত বাইরে ছুঁড়ে মারে। ফলে আমাদের হৃদয়ের ব্যথা শোনার মত কেউ থাকে না।

বিশ্ব ভালোবাসা দিবস–অবাধ যৌনাচার দিবস

বিশ্বাস করুন, এই চিত্রটা অত্যন্ত করুণ। এই করুণ চিত্রের মাঝেই বর্তমান পশ্চিমাদের বসবাস। তাই তারা চাচ্ছে, তারা যে আযাব ও গজবের শিকার হয়েছে, আমাদের তরুণ তরুণীরাও যেন তার শিকার হয়। অথচ এর বিপরীতে মহান আল্লাহ আমাদেরকে দান করেছেন এক পবিত্র জীবনবিধান। তিনি আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, তোমরা যৌবনের পবিত্রতা রক্ষার জন্য বিয়ে কর, যৌবনকে পবিত্র রাখো। আর আল্লাহ বলেছেন, وَلاَ تَقْرَبُواْ الزِّنَى إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاء سَبِيلاً তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ। (সূরা বনী ইসরাইল ৩২)

এ হল আল্লাহর নির্দেশ। মনে রাখবেন, যে দেশে যে সমাজে যে শহরে যে এলাকায় পর্দাহীনতা গানবাজনা টিভিভিসিয়ার ডিশক্যাবল অবাধ ইন্টারনেট ও নারীপুরুষের অবাধ মেলামেশা ব্যাপক হয়ে পড়ে, সেখানে ব্যভিচার ডেকে আনতে হয় না; বরং তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছড়িয়ে পড়ে। তাই আল্লাহ বলেছেন,  জীবন ও যৌবনকে পবিত্র রাখতে হলে তোমরা لَا تَقْرَبُوا الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ এসব নির্লজ্জতার কাছেও যেয়ো না, প্রকাশ্য হোক কিংবা অপ্রকাশ্য। (সূরা আনআ’ম ১৫১)

ভ্যালেন্টাইন্স ডে বা তথাকথিত বিশ্ব ভালোবাসা দিবসও এমনই একটি নির্লজ্জতার দিবস–যা তরুণ-তরুণীকে অবাধ যৌনাচারের প্রতি ঠেলে দেয়। এজন্য আমরা বলব, এটা ভালোবাসা দিবস নয়; বরং মূলত এটা অবাধ যৌনাচার দিবস। এটি কপোত-কপোতির অবৈধ রোম্যান্স চর্চার নোংরা দিবস।

দিবস নয়; আগ্রাসন

আরো স্পষ্ট বললে বলতে হয়, প্রকৃতপক্ষে এটা দিবস নয়; বরং আগ্রাসন। আমাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য চারিত্রিক মাধুর্য ও সামাজিক কাঠামো ভেঙ্গে দেয়ার জন্য পশ্চিমাদের এক সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের নামই হল–ভ্যালেন্টাইন্স ডে বা তথাকথিত বিশ্ব ভালোবাসা দিবস।

কায়রো সম্মেলনের মত সম্মেলনগুলোতে গৃহীত ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্যই মুসলিম দেশগুলোতে তারা নতুন এ দিবসের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে। এর মাধ্যমে তারা নরনারীর বিবাহপূর্ব অবৈধ সম্পর্কের ব্যবস্থা মুসলিম দেশগুলোতেও চালু করতে চাচ্ছে। বিশেষ করে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ বাংলাদেশে। যায়যায় দিন নামক একটি পত্রিকা সর্ব প্রথম এ দেশে এ দিবসটির আমদানি করেছে। তারপর তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরো কয়েকটি পত্রিকা ম্যাগাজিন ও রেডিও-টিভি চ্যানেল। অন্যথায় এ দেশের যুবসমাজ এ অপদিবসটির সঙ্গে পরিচিত ছিল না।

প্রশ্ন জাগে, ১- এ দিবসের ইতিবৃত্ত কী?  কোত্থেকে শুরু হয় এ দিবস উদযাপন? ২- দিবসটি পালনের মূল ইন্ধনদাতা কারা? ৩- দিবসটি পালন করা যাবে না কেন? ৪- দিবসটি পালনের প্রভাব ও পরিণাম কী?

আজ আপনাদের সামনে এই চারটি পয়েন্টে আলোচনা করব–ইনশা আল্লাহ।

ভ্যালেন্টাইন্স ডে‘র সূচনা

প্রথম প্রশ্ন হল, দিবসটির ইতিবৃত্ত কী? বা এটি কিভাবে শুরু হয়? মূলত এর সূচনা নিয়ে অনেক গল্প আছে। সবচে’ বহুল প্রচলিত গল্প হল, ক্লডিয়াসের সেনাবাহিনীকে নিয়ে। তৃতীয় শতাব্দীর শুরুর দিকে রোমান সম্রাট ক্লডিয়াসের শখ হল, বিশাল সেনাবাহিনী গড়ে তোলার। কিন্তু জনগণ পরিবারপরিজনের প্রতি দুর্বলতার কারণে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চাইত না। সম্রাট তখন বের করলেন নতুন পথ। আইন জারি করলেন, বিয়ের উপর। তরুণপ্রজন্ম বিষয়টি মেনে নিতে পারল না। তখন এগিয়ে এল, সম্রাটের পাদ্রী, যার নাম ছিল সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। গোপনে তরুণ-তরুণীদের প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ করত সে। সম্রাট খবর পেয়ে ক্রূব্ধ হয়ে ভ্যালেন্টাইনকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়ে দিলেন। জেলে থাকা অবস্থায় সে জেলারের কন্যার প্রেমে পড়ে। জেলের মধ্যে সে মেয়েটির সঙ্গে গল্প করত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এরই মধ্যে শাস্তি হিসেবে ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হল। মৃত্যুর আগে সে প্রেমিকদের উদ্দেশ্যে একটি চিরকুট লিখে। চিরকুটটিতে লেখা চিল–লাভ ফ্রম ইউর ভ্যালেন্টাইন। এই ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুর দিনটিই ভালোবাসা দিবস হিসেবে গণ্য করা হয়। দিনটি ছিল ২৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি।

ভিন্ন বক্তব্য

কিছু গবেষকের লেখায়, অন্য রকম ইতিহাস পাওয়া যায়। যীশু খ্রিস্টের জন্মের আগে পৌত্তলিকদের মাঝে বিভিন্ন দেব-দেবীর পুজার প্রচলন ছিল। পশু পাখির জন্য একটি দেবতা, গ্রীস্মকালের জন্য আলাদা দেবতা, শীতকালের জন্য ভিন্ন দেবতা, ঝড় বৃষ্টির জন্য স্বতন্ত্র দেবতা–এভাবে তাদের বিভিন্ন দেবতা ছিল। লুপারকালিয়া নামক একটি দেবতা ছিল ধান গম শস্য ইত্যাদি উৎপাদনের জন্য। এ দেবতার নামে তারা একটি পূজার অনুষ্ঠান করত। অনুষ্ঠানে যুবতী-তরুণীদের মাঝে লটারি দেয়া হত।  লটারিতে যে যুবতী যে যুবকের ভাগে পড়ত এক বছর পর্যন্ত সে তাকে ভোগ করত। অনুষ্ঠানে যুবকটি দেবতার নামে একটি পশু জবাই করত। জবাইকৃত পশুটির চামড়া যুবতীর গায়ে জড়িয়ে দেয়া হত। যুবক একটি চাবুক নিয়ে যুবতীর গায়ে চামড়ার উপর দিয়ে আঘাত করত। আর মনে করত, এর মাধ্যমে যুবতীটি সন্তানদানের উপযুক্ত হবে। আর এই পুরো অনুষ্ঠানটি উদযাপিত হত ১৪ ফেব্রুয়ারী।

এরপর এল খ্রিস্টধর্ম। খ্রিস্টধর্ম ছিল ওই যুগের সত্য ধর্ম–আসমানি ধর্ম। তাই খ্রিস্টধর্ম পৌত্তলিকদের এ অনুষ্ঠান সমর্থন করল না। খ্রিস্টধর্মের পাদ্রীরা জনগণকে বুঝালো, এটা মূর্তির ধর্মের অনুষ্ঠান; খ্রিস্টধর্মের নয়। কিন্তু অধিকাংশই এই অনুষ্ঠান বর্জন করতে রাজি হল না। তাই পাদ্রীরা এই অনুষ্ঠানকে বিশুদ্ধ করার চেষ্টা করল। তবে চেষ্টাটা ছিল ভুল পথে। তারা বলল, অনুষ্ঠানটি দেবতার নামে না হয়ে পাদ্রীদের নামে হোক। লটারিও যুবতীর নামে না হয়ে পাদ্রীদের নামে হোক। অবশেষে পাদ্রীদের নামে লটারি চালু করা হল। লটারিতে যে যুবক বা যুবতী যে পাদ্রীর ভাগে পড়ত সে তার সংস্পর্শে এক বছর থাকত, যাতে তার চরিত্র ভাল হয়।

৪৭৬ সনে পোপ জেলিয়াস বলল, অনুস্থানের ধরণ যেহেতু পরিবর্তন করা হয়েছে সুতরাং এর নামও পরিবর্তন করা হোক। আগে দেবতার নামে অনুষ্ঠানটি চলত এখন একজন পাদ্রীর নামে চলবে। অবশেষে ভ্যালেন্টাইন ছিল সে পাদ্রী যার নামে অনুষ্ঠানটি নতুন রূপে আসে। শেষ পর্যন্ত ৪৭৬ সনের পোপ জেলিয়াসের প্রস্তাবটি আরো বিশ বছর পর অর্থাৎ ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে এটি আনুষ্ঠানিক রূপ নেয়।

ইতিহাসের সার

ভ্যালেন্টাইন্স ডে বা তথাকথিত বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের ইতিহাসের সার আমরা কী পেলাম? আমরা এখানে কয়েকটি বিষয় পেয়েছি।

১- দিবসটি একজন খ্রিস্টান পাদ্রী বা পোপের আবিস্কার; যা একজন মুসলমানের ধর্মীয় বিশ্বাস কখনও সমর্থন করতে পারে না। অথবা বলতে পারি–

২- দিবসটি মূলত মূর্তিপূজার ধর্ম  ও খ্রিস্টধর্মের যৌথ আবিস্কার; যার সঙ্গে ইসালমের কোনো আপোস নেই। বিষয়টির মুল্যায়ন করতে গিয়ে অধ্যাপক ড্রেপার মন্তব্য করেছিলেন, একজন খ্রিস্টান ও একজন মুসলিমের মাঝে মৌলিক পার্থক্য হল, খ্রিস্টান মূর্তিপূজার সংস্কৃতির সঙ্গে আপোস করতে পারে; পক্ষান্তরে মুসলিম তা পারে না।

৩- দিবসটি যুবক ও যুবতীর অবাধ যৌনাচারের মাধ্যমে অস্তিত্বে আসে; যা একজন মুসলমানের আত্মমর্যাদাবোধের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।

দিবসটি উদযাপনের মূল ইন্ধনদাতা কারা?

দিবসটি উদযাপনের মূল ইন্ধনদাতা কারা? এটা ছিল, আজকের আলোচনার দ্বিতীয় পয়েন্ট। আসলে মুসলমানদের চরিত্র নষ্ট করার পাশাপাশি এর মধ্যে পুঁজিবাদীদের স্বার্থও নিহিত আছে। ভালোবাসা দিবসের আড়ালে এটা তাদের রমরমা বাণিজ্যও বটে। দৈনিক প্রথম আলো ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০০০৯-এ একজন কলামিস্ট লিখেছেন, ‘বিশ্বে প্রতি বছর দিবসটিতে এক বিলিয়নের অধিক কার্ড বিক্রি হয়। ফুল বিক্রি হয় ১১০ মিলিয়ন।’ এছাড়াও নতুন কাপড় ( লাল রঙের শাড়ি-পাঞ্জাবী বিশেষ করে ) রেস্তোরা , ক্যান্ডি এর যে বিশাল বানিজ্য হয় সেই কথা কারো অজানা নয়।  মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো তো আরও এক ধাপ এগিয়ে। এমনকি বিমানেও থাকে বিভিন্ন ভ্যালেন্টাইন্স অফার। অবস্থাদৃষ্টে মনে হবে, তাদের কাছে এটি যেন কর্পোরেট বানিজ্য দিবস।

সুতরাং আমরা বলতে পারি, দিবসটি পুঁজিবাদীদের জন্য শোষণের একটি হাতিয়ারও। মুসলিম বিশ্বকে শোষণ করার অসংখ্য হাতিয়ারের মধ্যে এটিও একটি হাতিয়ার। মার্কিন সমাজের ইয়াংকি ব্যবসায়ীরা এজন্যই ১৮৪০ সনে দিবসটিকে বাণিজ্যিক রূপ দেয়। এটি উদযাপনের মূল ইন্ধনদাতা এই মার্কিন সমাজ।

দিবসটি উদযাপন করা যাবে কি?

আজকের আলোচনার তৃতীয় পয়েন্ট হল, দিবসটি উদযাপন করা যাবে কি? এক কথায় এর উত্তর হল, না এবং না এবং না। কেননা, যে দিবসটির সঙ্গে মূর্তিপূজার সংস্কৃতি জড়িত, লটারি জড়িত, অবাধ যৌনাচার জড়িত, পৌত্তলিক সংস্কৃতির সঙ্গে খ্রিষ্টানদের আপোসকামিতা জড়িত, বিজাতীয় সংস্কৃতি জড়িত এবং যে দিবসটির কারণে আমরা শোষণের পাত্র হচ্ছি; এমন একটি নোংরা জঘন্য দিবস উদযাপনের অনুমতি ইসলাম আপনাকে মোটেও দিতে পারে না। এমনকি মজা করার উদ্দেশ্যেও এটি উদযাপন করা যাবে না। কারণ, এক বছর হয়ত মজা করলেন, পরের বছর দেখা যাবে তা বাস্তবতার পোশাক পরে আপনার জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছে। বরং যারা দিবসটি উদযাপন করে তাদেরকে সাধ্যমত বাধা দেয়া আপনার জন্য ফরজ। এটি ভালোবাসা দিবসের নামে ঈমান বিধ্বংসী দিবস বিধায় কোনোভাবেই এটি উদযাপন করা যাবে না। কোনো মুসলমান এটি গ্রহণ করতে পারে না। ঈমান-আকিদা তো ফুটবল বা ক্রিকেট নয় যে, এ নিয়ে খেলা করা হবে!

তাছাড়া দিবসটি বিবাহপূর্ব ভালবাসার প্রতি যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করে। আর  বিবাহপূর্ব ভালবাসা মানেই হল, বিভিন্ন হোটেলে, পার্কে, রেস্তোরাঁয়, শিক্ষাঙ্গনে ও বিভিন্ন বিনোদন স্পটে যুবক-যুবতীর চ্যাটিং-ডেটিং-ইটিং-সেটিং ও অবশেষে চিটিং করা। আর এ ভাবেই উন্মুক্ত হয় ব্যভিচারের পথ। অথচ আল্লাহ বলেছেন,

وَلاَ تَقْرَبُواْ الزِّنَى إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاء سَبِيلاً

তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ। (সূরা বনী ইসরাইল ৩২)

তিনি আরো বলেছেন, لَا تَقْرَبُوا الْفَوَاحِشَ  তোমরা অশ্লীল কাজের কাছেও যেও না। (সূরা আনআ’ম ১৫১)

অশ্লীল কাজ কাকে বলে?

অশ্লীল কাজ কাকে বলে? যে সকল কর্ম ও আচরণ মানুষকে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও ব্যভিচারের প্রতি আকৃষ্ট করে তাকেই অশ্লীল কর্ম বলা হয়। বিবাহপূর্ব প্রেম যেখানে থাকবে সেখানে ব্যভিচার, ধর্ষণ এমনকি হত্যার মত অপরাধ সেখানে ঘটবেই। তাই আল্লাহ নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা থেকে আমাদেরকে নিষেধ করেছেন। অন্যত্র তিনি বলেছেন,

قُل لِّلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ذَلِكَ أَزْكَى لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ – وَقُل لِّلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ
মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাযত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন। ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাযত করে। (সূরা নূর ৩০,৩১)
একবার এক যুবক রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর খেদমতে এসে বলল, ائْذَنْ لِي بِالزِّنَا ‘আমাকে ব্যভিচার করার অনুমতি দিন।’ যুবকটির এমন আপত্তিকর আবদার শুনে সাহাবায়ে কেরাম ক্ষিপ্ত হলেন। তারা যুবকটিকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘চুপ, একদম চুপ।’ কিন্তু  রাসুলুল্লাহ ﷺ যুবকটিকে কাছে ডেকে নিজের কাছে বসালেন এবং বললেন,  أَتُحِبُّهُ لأُمِّكَ؟ ‘কাজটা তোমার মায়ের সঙ্গে কেউ করুক; তুমি কি এটা পসন্দ করবে?’ যুবক উত্তর দিল, ‘আল্লাহর কসম, আমি কখনই তা পসন্দ করব না।’ রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন, وَلا النَّاسُ يُحِبُّونَهُ لأُمَّهَاتِهِمْ ‘তুমি কেন; বরং কোনো সন্তানই নিজের মায়ের ব্যাপারে কক্ষনও এরকম কামনা করবে না।’ রাসুলুল্লাহ ﷺ পুনরায় বললেন, أَفَتُحِبُّهُ لابْنَتِكَ؟ ‘তোমার মেয়ের সঙ্গে কাজটা হোক; এটা কি তুমি কামনা করবে? যুবক এবারও আগের মতই উত্তর দিল। রাসুলুল্লাহ ﷺ এবারও বললেন, وَلا النَّاسُ يُحِبُّونَهُ لِبَنَاتِهِمْ ‘তুমি কেন; বরং কোনো মানুষই নিজের মেয়ের ব্যাপারে এরকম কল্পনাও করতে পারে না।’ পুনরায় রাসুলুল্লাহ ﷺ জিজ্ঞেস করলেন, أَفَتُحِبُّهُ لأُخْتِكَ؟ ‘তোমার বোনের ব্যাপারে কি এরূপ চাইবে?’ যুবক আগের মতই উত্তর দিল। রাসুলুল্লাহ ﷺ-ও আগের মতই উত্তর দিলেন, وَلا النَّاسُ يُحِبُّونَهُ لأَخَوَاتِهِمْ ‘আর কোনো মানুষই নিজের বোনের ব্যাপারে এরূপ কল্পনা করতে পারে না।’ পুনরায় রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন, أَفَتُحِبُّهُ لِعَمَّتِكَ؟ ‘তোমার ফুফুর ব্যাপারে কি তুমি এরূপ কামনা করবে? যুবকটি আগের উত্তরটাই ব্যক্ত করল। রাসুলুল্লাহ ﷺ-ও তাকে বললেন, وَلا النَّاسُ يُحِبُّونَهُ لِعَمَّاتِهِمْ ‘কোনো মানুষই নিজের ফুফুর ব্যাপারে এরূপ চাইতে পারে না।’ তারপর রাসুলুল্লাহ ﷺ যুবকটির মাথার উপর রাখলেন এবং দোয়া করলেন, اللَّهُمَّ اغْفِرْ ذَنْبَهُ ، وَطَهِّرْ قَلْبَهُ ، وَحَصِّنْ فَرْجَهُ ‘হে আল্লাহ! এর গুনাহ মাফ করুন। এর অন্তর পবিত্র করে দিন এবং এর যৌনাঙ্গ পবিত্র পবিত্র রাখুন।’ ( মুসনাদে আহমাদ ২১৭০৮)
অপর হাদিসে এসেছে, আল্লাহ কেয়ামতের দিন যৌবন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। যৌবনের আনন্দের দিনগুলো, উচ্ছলতার দিনগুলো কোন পথে ব্যয় করেছ? এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া ছাড়া কোনো মানুষ এক কদমও নড়তে পারবে না। অন্য হাদিসে তিনি বলেছেন, কেয়ামতের দিন নবী ও রাসুলদের সঙ্গে আল্লাহর আরশের নীচে ওই সমস্ত যুবককে তিনি স্থান দিবেন, যারা নিজেদের যৌবনকে পবিত্র রেখেছে।
দিবসটির কুপ্রভাব
সম্মানিত মুসল্লিয়ানে কেরাম! চতুর্থ যে প্রশ্নটি আপনাদের সামনে রেখেছিলাম, তাহল, দিবসটি উদযাপনের কারণে ব্যক্তি সমাজ ও পরিবারে এর কী প্রভাব পড়ে। এ প্রসঙ্গে ইসলামের বক্তব্য হল, বিবাহপূর্ব প্রেম বৈধ নয়; বরং হারাম। আমাদের সমাজে এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী আছে, এদের বিবেকে পচন ধরেছে। এরা বিবাহপূর্ব প্রেমকে ‘পবিত্র’ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়! তাই তারা দিবসটি উদযাপনের প্রতি যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করে থাকে। ফলে আমাদের যুবসমাজের কাছে এখন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ভাল লাগে না, প্রেম ভাল লাগে। চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্রগুলোই এখন তাদের কাছে অধিক প্রিয়। স্কুল-কলেজের ড্রেস পরে বই-কলম হাতে নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা আজকাল এগুলোতেই সময় কাটায়। ক্যারিয়ার গঠনের চিন্তা নেই; আছে শধু প্রেমের চিন্তা। অবৈধ ভালবাসা আজ তাদেরকে উন্মাদ করে দিয়েছে। ভালবাসা দিবস সেই উন্মাদনাকেই উসকে দিচ্ছে। ঠিক আগুনে পেট্রোল ঢালার মত। যার ফলে আমাদের যুবসমাজ আজ লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে বিজাতীয়দের ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত হচ্ছে। চ্যাটিং-ডেটিং-ইটিং-সেটিং নিয়েই তারা এখন বেশির সময় পড়ে থাকে। শিক্ষা ও যৌনতাকে আজ তারা একাকার করে ফেলেছে। এর পরিণাম নিশ্চয় অত্যন্ত ভয়াবহ। ধর্ষণ গুম হত্যা এখনকার সমাজের সাধারণ চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর কারণ কী? এর জন্য কি আমাদের বিশেষ করে যুবসমাজের চারিত্রিক অবক্ষয় দায়ী নয় কি? তাই এখুনি যদি আমাদের এই চলতি প্রজন্মকে যদি টেনে না ধরি তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পিতৃ পরিচয় হারিয়ে বসবে। আমাদের পারিবারিক বন্ধন ভেঙ্গে পড়বে। জীবনের শৃঙ্খলা বোধ বিক্ষিপ্ততায় হারিয়ে যাবে। আমরা লক্ষ্য করেছি, ইতিমধ্যে তা শুরুও হয়েছে। এজন্য আসুন, সকল অশ্লীলতাকে আমরা ‘না’ বলি। এ জাতীয় দিবস পরিহার করার ব্যাপারে একে অপরকে সচেতন করে তুলি। সকল সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। আমাদের যুবশক্তিকে ধ্বংসের এই অতল সমুদ্র থেকে উদ্ধার করি। আল্লাহ আমাদেরকে সেই তাওফিকই দান করুন। আমিন।
واخر دعوانا أن الحمد لله رب العلمين