শাইখুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী
অনুবাদ
মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী
চরিত্রের মাহাত্ম্য
চরিত্র গঠন এবং আল্লাহর বিধান অনুযায়ী তাকে পরিচালনা করা ইবাদতের মতোই অতীব জরুরী বিষয়। বরং একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, ইবাদত, লেনদেন, সামাজিক-শিষ্টাচারে ইসলামের যত বিধান আছে সব বিধানই যথাযথভাবে পালনের জন্য চারিত্রিক শুদ্ধতা প্রয়োজন। নিষ্কলুষ চরিত্র না থাকলে নামাজ-রোজা কোনো কাজে আসবে না। বরং তখন তাতে হিতে বিপরীত হয়। তাই চারিত্রিক পবিত্রতা এবং তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশাধীন করা বাস্তব জীবনের জন্য ভিত্তিপ্রস্তর। আর ইমারত তৈরীর জন্য ভিত্তিপ্রস্তরের প্রয়োজনীয়তা তো অনস্বীকার্য।
চরিত্র কাকে বল?
সর্বশ্রুত চরিত্র আর আলোচ্য চরিত্রের ব্যাখ্যা এক নয়। উভয়ের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। আমাদের সমাজে চরিত্র বলতে যা বুঝায় তা হল, একটু মুচকি হেসে কারো সঙ্গে কথা বলা, হাস্যোজ্জ্বল চেহারা নিয়ে কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ করা, নম্র কথা বলা। এই গুণগুলো থাকলে তাকে বলা হয়, উত্তম চরিত্রের মানুষ, ফুলের মত চরিত্র তার। কিন্তু যে চরিত্রের কথা আমরা আলোচনা করছি এবং যে ধরনের চরিত্র ইসলাম আমাদের নিকট চায় তার ব্যাখ্যা আরো ব্যাপক। প্রফুল্ল বদনে কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ করাকেই কেবল চরিত্র বলা হয় না। এটি চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এটি প্রকৃত চরিত্র নয়। প্রকৃত চরিত্রের সম্পর্ক মানুষের আত্মার সঙ্গে। আত্মার একটি গুণকেই বলা হয়, চরিত্র। মানুষের হৃদয়ে বিভিন্ন আবেগ স্বপ্ন কামনা-বাসনা অনেক সময় চেপে বসে। যেগুলোকে বলা হয় চরিত্র। আর এগুলোর শুদ্ধ করা আবশ্যক। এ কথারই তাগিদ দিয়েছে ইসলাম।
আত্মার তাৎপর্য
আরেকটু স্পষ্ট করে বুঝতে হলে সর্বপ্রথম জানা প্রয়োজন, মানুষ কাকে বলে? শরীর ও আত্মার সমষ্টিকেই ‘মানুষ’ বলা হয়। শুধু দেহকে মানুষ বলা হয় না; বরং মানুষ ওই দেহের নাম যার মাঝে আত্মা আছে। মনে করুন, কেউ মারা গেল। তাহলে তার দেহে কোনো পরিবর্তন এসেছে কি? চোখ নাক কান কিংবা মুখাবয়ব হাত-পা সবই তো আছে। জীবিত অবস্থায় যেমন ছিল তেমনি আছে। তবুও বাস্তব মানুষের সঙ্গে তফাতটা কোথায়? তফাতটা এখানেই যে, এ দেহটির মাঝে এক সময় রূহ তথা আত্মা ছিল। আর এখন তা নেই। বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে আর বাস্তব মানুষ নয়। মানুষ থেকে সে পরিণত হয়েছে জড়বস্তুতে।
তাড়াতাড়ি দাফন কর
রূহ বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান ঘটে। যে মানুষটি ছিল অনেকের নয়নের মনি, ভালোবাসার পাত্র, অর্থ-প্রতিপত্তির মালিক, স্ত্রী-পরিজনের অধিপতি, বন্ধু-বান্ধবের প্রিয় পাত্র; রূহ বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে মানুষটি হয়ে যায় একেবারে নিঃস্ব। মা-বাবা, স্ত্রী-পরিজন, ছেলে-সন্তান, বন্ধুবান্ধব, অর্থ-প্রতিপত্তি সবকিছু ফেলে রেখে তাকে পাড়ি দিতে হয় অন্য জগতে। তখন এ সব স্বজনও চায় তাকে কবরের ঠিকানায় রেখে আসতে। কেউই তখন তাকে কাছে ধরে রাখতে প্রস্তুত নয়। যত প্রিয় হোক না কেন; সকলেই চায় তাকে দাফন করে দিতে। সেই প্রিয় জন যে সবসময় তার সঙ্গ কামনা করত, তার ইঙ্গিত নেচে বেড়াত; রূহ চলে যাওয়ার পর সেও চায় তাড়াতাড়ি কবরে রেখে আসতে। নিজ সন্তানেরাও চায়না তাদের প্রিয় আব্বুকে আরো দু’একদিন কাছে রাখতে। বেশির চেয়ে বেশি হয়তো দু’একদিন কিংবা বড়জোর এক সপ্তাহ চা পাতা বরফ ইত্যাদি দিয়ে রাখলেও তারপরই তাকে ফেলে রেখে আসে অন্ধকার কবরে। এমনকি আমি এমন ঘটনাও শুনেছি, পত্রিকায় এসেছে, এক লোককে তার প্রিয়জনরা মৃত ভেবে দাফন করে দিয়েছিল। আসলে লোকটি মরে নি বরং দম আটকে গিয়েছিল। অবশেষে দম ছেড়ে দেওয়ার পর বেচারা কোনোমতে কবরের উপরে উঠে গিয়েছে এবং নিজ বাড়িতে চলে এসেছে। ঘরের দরজা নাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিতর থেকে তার বাবা বলে উঠল, কে? উত্তরে লোকটি যে-ই তার নাম বলল, সঙ্গে সঙ্গে তার পিতা ঘর থেকে বের হয়ে খুব লাঠিপেটা দিল। পিতা বলল, আমার ছেলে তো মারা গিয়েছে! এখন এই ভূতটা আসলো কোত্থেকে? অবশেষে দুর্ভাগা আগে না মরলেও এখন মারের চোটে মরে গেল।
তাহলে এমন কী বিশাল পরিবর্তন ঘটল যে, সমস্ত দেহ যেমন ছিল ঠিক তেমন থাকা সত্ত্বেও এই লাশটিকে ঘরে রাখতে কেউ প্রস্তুত নয়! পরিবর্তন একটাই– এ দেহের মধ্যে আগে রূহ ছিল, এখন আর নেই। বোঝা গেল, দেহের মূল শক্তি হল, রূহ। এটি দেহের মধ্যে বর্তমান থাকলেই সে মানুষ। অন্যথায় সে মানুষ নয়। এই রূহ তথা আত্মার বিয়োগের পর মানুষ আর মানুষ থাকে না; বরং লাশে পরিণত হয়। যে লাশের সঙ্গে সম্পর্ক কেউ রাখতে চায় না। সকলেই চায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দাফন করে দাও।
আত্মার ব্যাধিসমূহ
মানুষের দেহ যেমন বহু বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। দেহ কখনো সুস্থ থাকে, সুশ্রী থাকে, শক্তিমান থাকে; কখনো বা অসুস্থ, দুর্বল, ভঙ্গুর ও পুষ্টিহীন থাকে। অনুরূপভাবে মানুষের আত্মাও বহু বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। আত্মা কখনও শক্তিশালী হয়, কখনও হয় দুর্বল। কখনো উত্তম গুণের অধিকারী হয়, কখনো হয় অসৎগুণের আবাসস্থল। মানুষের শরীর যেমনিভাবে ব্যাধিগ্রস্থ হয়, জ্বর-পেটের পীড়া প্রভৃতি ব্যাধি দেহকে আক্রান্ত করে, তেমনিভাবে আত্মাও রোগাক্রান্ত হয়। তাহলে আত্মার সে ব্যাধিগুলো কী? আত্মার ব্যাধি হল, অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ ও অকৃতজ্ঞতা ইত্যাদি। এসব রোগ আত্মাকে আক্রান্ত করে অসুস্থ ও দুর্বল করে দেয়।
আত্মার শোভা ও সৌন্দর্য
যেমনিভাবে মানুষের দেহ সুন্দর ও সুস্থ থাকে। যথা বলা হয়ে থাকে, অমুক দেখতে খুব সুন্দর, হরিণের চোখের মত চোখ ইত্যাদি। তেমনিভাবে আত্মারও সৌন্দর্য আছে। সুশ্রী ও সশোভিত আত্মা সেটি; যার মধ্যে বিনয়, ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা ও একনিষ্ঠতার গুণ আছে। যে আত্মা কামনার দাস নয়, প্রদর্শনমুখী নয়, সে আত্মাই সুন্দর আত্মা।
শারীরিক ইবাদত
এমন অনেক বিধি-বিধান আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দান করেছেন যেগুলোর সম্পর্ক আমাদের শরীরের সাথে। যথা নামাজ কিসের মাধ্যমে পড়া হয়? শরীরকে দাঁড় করিয়ে, রুকুতে ঝুঁকে, সিজদায় অবনত হয়ে অতঃপর বসে সালাম ফিরিয়ে নেওয়ার নামই তো নামাজ। এসব কিছু করতে হলে দেহের প্রয়োজন। যে ইবাদতের মধ্যে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে কাজে লাগাতে হয়, তাকে বলা হয় শারীরিক ইবাদত। তাই নামাজ একটি শারীরিক ইবাদত। অনুরূপভাবে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শরীরকে পানাহারমুক্ত রাখতে পারলে রোজা পালন হয়। হাতের মাধ্যমে নির্ধারিত সম্পদ গরিবকে দান করতে হয়। হজের মধ্যে মেহনত করতে হয়, সবর করতে হয়। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে হজের বিধান আদায় করতে হয়। সুতরাং এগুলো শারীরিক ইবাদত। কোনো কোনোটিতে আর্থিক ইবাদতের অংশও অবশ্য রয়েছে।
বিনয় আত্মার কাজ
এসব শারীরিক ইবাদতের মত কিছু আত্মিক ইবাদতও রয়েছে। এসব শারীরিক ইবাদত যেমনিভাবে ফরজ, তেমনিভাবে আত্মিক ইবাদতগুলোও ফরজ। যথা আল্লাহ তাআলার একটি নির্দেশ, বিনয়। কিন্তু বিনয়ের সম্পর্ক দেহের সঙ্গে নয় বরং আত্মার সঙ্গে। বিনয়ী হওয়া আত্মার কাজ। আল্লাহর নির্দেশ মতে প্রত্যেককে এই কাজটি পূর্ণভাবে আদায় করতে হয়।
অনেক মূর্খ মনে করে, বিনয় মানে মেহমান আসলে তাকে আদর-আপ্যায়ন করা, সেবা-যত্ন করা। মূলত এর নাম বিনয় নয়। আবার কিছুটা লেখাপড়া করেছে এমন কিছু লোকের ধারণা হল, বিনয় দ্বারা উদ্দেশ্য নিজেকে অন্যের সামনে ছোট করে উপস্থাপন করা। কিছু লোক মনে করে, ঘাড় কিছুটা কাত করে দিয়ে, বক্ষ একটু ঝুঁকিয়ে দিয়ে মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করাকেই বিনয় বলা হয়। এমন করলে তাকে মনে করা হয় অত্যন্ত ভদ্র ও বিনয়ী।
প্রকৃতপক্ষে দেহের সাথে বিনয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। বিনয়ের সম্পর্ক আত্মার সঙ্গে। মানুষ নিজ অন্তরে নিজেকে ছোট জ্ঞান করলে সেটাই বিনয়। মনে করতে হবে, আমার চেয়ে দুর্বল, অপদার্থ গোলাম আর কেউ নেই। আমার কোনো শক্তি-সামর্থ্য, প্রতিপত্তি নেই। এরূপ মানসিকতা নিজের মধ্যে সৃষ্টি করতে পারলে সেটাই হবে বিনয়। আর এরূপ বিনয়েরই নির্দেশ দিয়েছেন মহান আল্লাহ।
ইখলাস অন্তরের একটি অবস্থা
আল্লাহ তাআলা ইখলাসের নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন, নিজের মধ্যে ইখলাস সৃষ্টি কর। ইবাদতে ইখলাস পয়দা কর। প্রতিটি কাজে একমাত্র আল্লাহ তাআলার রাজি-খুশি করার প্রতি লক্ষ্যে করা; এটাকেই বলা হয় ইখলাস। মুখে উচ্চারণ করলে ইখলাস এসে যায় না। এটি অন্তরে একটি অবস্থা। আত্মা্র একটি বৈশিষ্ট্য। যা লাভ করার নির্দেশ আমরা পেয়েছি।
শোকর অন্তরের আমল
শোকরের নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ তাআলা। নেয়ামত পেলে আল্লাহর শোকর আদায় কর। কৃতজ্ঞচিত্ত হওয়ার নামই শোকর। এটি অন্তরের একটি আমল। যত বেশি শোকর করবে আত্মাও ততো বেশি শক্তিশালী হবে।
সবরের তাৎপর্য
আল্লাহ তাআলা সবর তথা ধৈর্যধারণের আদেশ দিয়েছেন। অপ্রীতিকর কোনো বিষয়ের মুখোমুখি হলে বুঝে নেবে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে। আল্লাহর হেকমতেই সবকিছু হয়। সবকিছু তার ইচ্ছাধীন। যত অপ্রীতিকরই মনে হোক না কেন, ভাবতে হবে, এতে আল্লাহ তাআলার কোন হেকমত রয়েছে। এরূপ মানসিকতার নাম সবর বা ধৈর্য।
চরিত্র গঠন করা আবশ্যক
বোঝা গেল, আল্লাহ তাআলার অনেক বিধি-বিধানের সম্পর্ক এই রূহের সঙ্গে। সবরের স্থানে সবর করা, নামাজের সময় নামাজ পড়ার মতোই একটি ফরজ। শোকরের স্থানে শোকর করা, রোজার দিনে রোজা পালন করার মতোই একটি ফরয। যাকাত ওয়াজিব হলে যেমনিভাবে যাকাত দিতে হয় তেমনিভাবে ইখলাসের সময় ইখলাস অবলম্বন করতে হয়। এগুলোও ফরজ, যা সম্পূর্ণ আল্লাহপ্রদত্ত।
আত্মিক ব্যাধি হারাম
বাহ্যিক দৃষ্টিতে শারীরিক বিচারে অনেক কাজকেই গুনাহ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যথা মিথ্যা বলা, গীবত বলা, ঘুষ নেওয়া, সুদ খাওয়া, মদ পান করা, সন্ত্রাস করা– এসবই গুনাহের কাজ। এগুলো মানুষ তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দ্বারা করে। তাই এগুলোর সম্পর্ক মানবদেহের সাথে। অনুরূপভাবে আল্লাহ তাআলা অনেক উহ্য কাজকেও গুনাহ বলেছেন। যেগুলো চর্ম চোখে দেখা যায় না। এগুলো মানুষের আত্মিক রোগ। মহান আল্লাহ এগুলোকে হারাম বলেছেন। মদ পান করা, শূকর খাওয়া, ব্যভিচার করা যেমনিভাবে হারাম, তেমনিভাবে এগুলোও হারাম। হারাম হওয়ার দিক থেকে সবই সমপর্যায়ের।
সারকথা, মহান আল্লাহ আত্মাসম্পর্কীয় কিছু বিধি-নিষেধ দান করেছেন, যেগুলোর সম্পর্ক আত্মার সাথে। কিছু বৈশিষ্ট্য অর্জন করার জন্য বলেছেন আর কিছুকে বলেছেন বর্জন করার জন্য। গ্রহণীয় আত্মিক গুণগুলো গ্রহণ করতে হয় আর বর্জনীয় আর্থিক ব্যাধিসমূহ বর্জন করতে হয়। এরূপ করতে পারলেই তখন বলা হবে চরিত্র শুদ্ধ হয়েছে। আত্মার গোপন অবস্থাকেই তো চরিত্র বলে। গ্রহণীয় চরিত্রকে বলা হয়, উত্তম চরিত্র। বর্জনীয় চরিত্রকে বলা হয়, অধম চরিত্র।
আশাকরি আপনারা নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন, চরিত্র কাকে বলে? মুচকি হেসে কথা বলার নাম চরিত্র নয়; বরং এটা চরিত্রের একপ্রকার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। কারণ মানুষের চরিত্র ভালো হলে অপরের সাথে তার ব্যবহার সুন্দর হয়। কিন্তু আসল চরিত্র এটি নয়। আসল চরিত্রের সম্পর্ক একমাত্র আত্মার সঙ্গে। আত্মা পরিশুদ্ধ হলে এবং আল্লাহর বিধি-বিধান পালনের জন্য সদা প্রস্তুত থাকলে তখন তাকে বলা হবে উত্তম চরিত্রের অধিকারী।
ক্রোধের তাৎপর্য
চরিত্র বিশুদ্ধ কিভাবে হয়? একটি দৃষ্টান্ত পেশ করলে বিষয়টি সহজেই বুঝে আসবে। যথা ক্রোধ মানুষের একটি আত্মিক বৈশিষ্ট্য। ক্রোধের জন্ম সর্বপ্রথম মানুষের অন্তরে হয়। এরপর হাত-পা কিংবা ভাষার মাধ্যমে তার প্রতিফলন ঘটে। গোস্বায় চেহারা লাল হওয়া, হাত-পা-জবান নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে যাওয়া গোস্বার বহিঃপ্রকাশ। অন্যথায় আসল গোস্বা অন্তরের উত্তপ্ত অবস্থার নাম। অসংখ্য আত্মিক ব্যাধির মূলে রয়েছে এই ক্রোধ, যার কারণে মানুষ অনেক গুনাহের সম্মুখীন হয়।
গোস্বা না আসাও একপ্রকার ব্যাধি
গোস্বা যদি মানুষের মাঝে মোটেও না থাকে, যত কিছু ঘটুক না কেন– তবু রাগ জাগে না তাহলে এটাও একপ্রকার অসুস্থতা। আল্লাহ তা’আলা মানুষের মাঝে গোস্বা রেখেছেন, যেন সে নিজেকে, নিজের প্রাণ-সম্ভ্রমকে, নিজের দ্বীনকে হেফাজত করতে পারে। যদি পিস্তলের মুখোমুখি হওয়ার পরও কারো গোস্বা সৃষ্টি না হয় তাহলে এটা রোগ। নবীজিকে নিয়ে কেউ ব্যঙ্গ করেছে আর আমার গোস্বা উঠলো না, আমি দর্শকের ভূমিকায় নিশ্চুপ রয়েছি তাহলে বুঝতে হবে, গোস্বা না আসার দরুন আমি অসুস্থ।
ক্রোধের মাঝে ভারসাম্য থাকতে হবে
সীমাতিরিক্ত ক্রোধ আসাও একটি ব্যাধি। ক্রোধের উদ্দেশ্য অন্যের অনিষ্টতা থেকে নিরাপদ থাকা। এতোটুকু গ্রহণীয়। কিন্তু প্রয়োজনের চেয়েও বেশি রেগে যাওয়া, যথা যেখানে একটু থাপ্পড়ই যথেষ্ট ছিল, সে ক্ষেত্রে বেদম প্রহার করা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। তাই গোস্বা একেবারে না থাকা যেমনিভাবে দূষণীয়, তেমনিহবে রাগের আতিশয্যে ফেটে পড়ার উপক্রম হওয়াও গুনাহ। ভারসাম্য বজায় না থাকলে প্রয়োজনের মুহূর্তেও গোস্বা না হলে –এটা হবে অনুচিত।
হযরত আলী রাযি. ও তাঁর ক্রোধ
হযরত আলী রাযি.-এর একটি ঘটনা। এক ইহুদি একবার নবী কারীম ﷺ সম্পর্কে কটুক্তি করে বসল। আলী রাযি. তা শুনে ফেললেন। তিনি ওই ইহুদিকে আছাড় দিয়ে তার বুকের উপর উঠে বসলেন। পালাবার পথ না পেয়ে ইহুদি আলী রাযি.-এর মুখে থুতু মেরে দিল। এই অবস্থার সম্মুখীন হয়ে আলী রাযি. সঙ্গে সঙ্গে তাকে ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। জিজ্ঞেস করা হলো, ‘আপনি এটা কী করলেন, ইহুদি আপনার সাথে দ্বিগুণ হঠকারিতা দেখিয়েছে, আপনার তো উচিত ছিল, তাকে মারধর করা?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘ব্যাপার হচ্ছে, ইহুদি যখন নবীজি ﷺ সম্পর্কে কটুক্তি করেছে তখন নবীজির শানে গোস্তাখি করার জন্য তাকে শাস্তি দিয়েছি। তখনকার গোস্বা আমার স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে ছিল না; বরং ছিল নবীজি ﷺ-এর ইজ্জত রক্ষার নিমিত্তে। কিন্তু সে যখন আমার মুখে থুতু নিক্ষেপ করেছে তখন আমার ক্ষিপ্রতার পেছনে নিজস্ব স্বার্থ জড়িত হয়ে গিয়েছে। নিজের প্রতিশোধপরায়ণ মানসিকতা আমার মাঝে চলে এসেছে। তখন আমি ভাবলাম, নিজের স্বার্থে আঘাত আসলে তার প্রতিশোধ নেওয়া ভালো নয়। নবীজির আদর্শ তো এমন ছিল না। তিনি নিজের জন্য কারো থেকে প্রতিশোধ নেন নি। এরূপ ভাবনার শিকার হওয়ার কারণে আমি তাকে মুক্ত করে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম।’ একেই বলে ভারসাম্যপূর্ণ গোস্বা। যৌক্তিক কারণে গোস্বা হলেন আবার প্রয়োজনের মুহূর্তে তাকে নিয়ন্ত্রণ করে নিলেন এবং ইহুদিকে ছেড়ে দিলেন।
ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনীয়তা
মানুষের আত্মার প্রতিটি চরিত্রের ক্ষেত্রে এই একই অবস্থা। যতক্ষণ পর্যন্ত ভারসাম্য বজায় থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত সে মন্দ নয়। ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেলে, মধ্যপন্থা ভেঙ্গে গেলে তখন সেটাই অসুস্থতা। সর্ব ক্ষেত্রে মধ্যপন্থাই কাম্য। আত্মশুদ্ধির অর্থ এটাই যে, নির্দিষ্ট মাপকাঠিতে সংযোজন বা বিয়োজন না হওয়া চাই।
আত্মার গুরুত্ব
তাই রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
‘জেনে রেখো, মানবদেহে একটি গোশতপিণ্ড আছে। যা সুস্থ হলে গোটা মানবদেহ সুস্থ আর অসুস্থ হলে সম্পূর্ণ দেহ নষ্ট হয়ে যায়। আর তা হচ্ছে রূহ বা আত্মা।’
এখানে গোশতপিণ্ড দ্বারা সাধারণ গোশতের টুকরা উদ্দেশ্য নয়। কারণ হার্ট অপারেশন করলে তার মধ্যে অহংকার, হিংসা, বিদ্বেষ এগুলো পরিলক্ষিত হবে না। ডাক্তার হৃদয়ের বহির্বিভাগ চেক করে হয়তো বলতে পারবেন, তার স্পন্দন ঠিকমতো আছে কিনা। সে যথাযথ কাজ করছে কিনা। চেকআপ কিংবা যন্ত্রের সাহায্যে হৃদয়ের বাইরের দিকটা বোঝা গেলেও আভ্যন্তরীণ দিকটা দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যায়।
অদেখা ব্যাধি
মানুষের হৃদয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যা চর্ম চোখে দেখা যায় না। হৃদয়ে শোকর আছে কিনা, বিদ্বেষ হিংসা আছে কিনা, শোকর ও সবরের মাত্রা কতটুকু– এসব বিষয় সাধারণ ডাক্তার ধরতে পারে না। চেক করার মত কোনো মেশিন, চিহ্নিত করার জন্য কোনো প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয় নি।
সুফীগণ আত্মার চিকিৎসক
এজাতীয় রোগের চিকিৎসক, এগুলো চিহ্নিতকারী ডাক্তার ভিন্ন আরেকটি দল, যারা সুফি নামে পরিচিত। যারা পারদর্শী হন চরিত্রবিদ্যায়। আত্মার এসব অসুস্থতাকে নির্ণয় করে যারা চিকিৎসা চালান। এটা স্বতন্ত্র একটি বিদ্যা। পরিপূর্ণ একটি শাস্ত্র। এ বিদ্যার শিক্ষাদান ও গ্রহণ সাধারণ চিকিৎসা-বিদ্যার মতোই করা হয়।
শরীরের বাহ্যিক ব্যাধির মাঝেও আবার শ্রেণীবিন্যাস আছে। কিছু রোগ আছে মানুষ যা সহজেই অনুধাবন করতে পারে। জ্বর আসলে মানুষ বুঝতে পারে, তার জ্বর এসেছে। শরীরে তাপ-ব্যথা অনুভূত হলে বুঝে নেয়, জ্বর আসছে। নিজে বুঝতে না পারলে থার্মোমিটার দ্বারা যাঁচাই করে দেখে নেয় যে, তার জ্বর আছে কিনা। থার্মোমিটারও কোনো কাজ না হলে রোগ নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়া হয়। আত্মার রোগ কিন্তু এমন নয়। অনেক সময় মানুষ বুঝতেই পারেনা, তার মধ্যে আত্মিক ব্যাধি আছে কিনা। এর নির্ণয়ের জন্য কোনো যন্ত্র মার্কেটে নেই। পার্থিব চিকিৎসা-বিদ্যায় পারদর্শীরা নির্ণয় করতে পারেনা, তার মধ্যে অহংকার ইত্যাদি আছে কিনা। আত্মিক ব্যাধিগ্রস্থ মানুষ তার রোগ নির্ণয় করতে এবং চিকিৎসা নিতে যেতে হয় কোনো আত্মার চিকিৎসকের নিকট।
বিনয় কিংবা লোকদেখানো বিনয়
বিনয়ের পরিচয় নিশ্চয়ই আপনারা জানতে পেরেছেন– বিনয় অর্থ নিজেকে ছোট মনে করা।
এবিষয়ে হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী রহ. বলেছেন, মানুষ অনেক সময় লোক দেখানো বিনয় প্রকাশ করে বলে থাকে, আমি গুনাহগার, মূর্খ, নাচিজ, অকর্মা, আমার কোনো অবস্থান নেই। এর দ্বারা অনেক ক্ষেত্রে সন্দেহ হয়, বাস্তবে লোকটি বিনয়ী কিনা! সে নিজেকে কত ছোট ভাবছে!
বাহ্যিক দৃষ্টিতে লোকটিকে বিনয়ী মনে হলেও অনেক ক্ষেত্রে বস্তুতঃ সে এমন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী নয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, এমন লোক একাধারে দু’টি ব্যধিতে আক্রান্ত থাকে। প্রথমত, অহংকার। দ্বিতীয়ত, লোক দেখানোর পীড়া। কারণ লোকটি যে বলেছে, সে দুর্বল, ভঙ্গুর, মূর্খ, গুনাহগার ইত্যাদি। এগুলো সে হৃদয় থেকে বলছে না; বরং এজন্য বলছে, যেন মানুষ তাকে বিনয়ী-নম্র-ভদ্র মনে করে।
এমন মানুষকে পরীক্ষা করার পদ্ধতি
হযরত বলেছেন, এ জাতীয় লোককেও পরীক্ষা করার পদ্ধতি আছে। সে যখন এভাবে নিজেকে ছোট করে উপস্থাপন করবে তখন তার কথার পিঠে সঙ্গে সঙ্গে বলে দিতে হবে, ‘হ্যাঁ, বাস্তবেই আপনি এমন। আসলেই আপনি অথর্ব, পাপী, মূর্খ। আপনার কোনো ইমেজ নেই।’ তারপর দেখুন, তার মনের অবস্থাটা কেমন হয়। এরূপ উত্তরদানকারী লোকটিকে সে বাস্তবে ‘বাহবা’ দিবে কিনা। তার জন্য কৃতজ্ঞতায় মন ভরে উঠবে কিনা। নাকি এতে তার মনে কষ্ট যাবে! হৃদয় ভারাক্রান্ত হবে যে, সত্যিই সত্যিই লোকটি আমাকে এমন ভাবল!
তখনই দেখা যাবে মূলত লোকটি নিজেকে এমন দুর্বল করে উপস্থাপন করার পেছনে কারণ ছিল, যেন শ্রোতা প্রতিউত্তরে বলে যে, জনাব! আপনি এ-কি বলছেন! এটা তো আপনার বিনয়। অন্যথায় বাস্তবে তো আপনি অনেক বড় জ্ঞানী ও আল্লাহওয়ালা। শ্রোতার মুখ থেকে এ বাহবা বের করানোর জন্য ছিল তার এই বিনয় প্রকাশ। প্রকৃতপক্ষে তার অন্তর অহংকারপূর্ণ। অথচ দেখাচ্ছে সে বিনয়ী। এটা বিনয় নয় বরং বিনয়প্রদর্শন।
অপরের জুতা সোজা করা
এক ভদ্রলোক আমার আব্বাজানের মজলিসে আসা-যাওয়া করতেন। একদিন তিনি দেখতে পেলেন, লোকটি মজলিসে এসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অন্যের জুতা সোজা করে দিচ্ছে। এরপর থেকে তার প্রতি দিনের কর্মসূচি ছিল, মজলিসে উপস্থিত লোকজনের জুতা সোজা করে দিয়ে মজলিসে শরিক হওয়া। আব্বাজান এভাবে বেশ কয়েকদিন দেখতে পেলেন। পরে একদিন তিনি লোকটিকে কাজটি করতে নিষেধ করে দিলেন। এর কারণ হিসেবে তিনি বললেন, আসলে বেচারা ধারণা করেছে তার মধ্যে অহংকারের রোগ আছে। আর এ রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে অপরের জুতা সোজা করাকে সে বাছাই করে নিয়েছে। সে ভেবেছে, অপরের জুতা সোজা করলে তার অহংকার দূর হয়ে যাবে। অথচ লোকটির জানা নেই, তার এ কাজ হীতে বিপরীত হচ্ছে। ফায়দা তো দূরের কথা বরং তার মাঝে অহংকার রোগের পাশাপাশি অহমিকাও চলে আসছে। সে জুতা সোজা করার কাজ করে ভেবেছে, তার অহংকার মিটে গেছে এবং বিনয়ের পরিসীমায় প্রবেশ করেছে। অথচ পরিণতিতে তার মধ্যে অহমিকা রোগও সংযোজন হয়েছে। তাই তার জন্য ভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হলো।
বোঝা গেল, সাধারণের দৃষ্টি আর চিকিৎসকের দৃষ্টি এক নয়। দৃশ্যত লোকটির এ কাজ ছিল বিনয়ের কাজ। অথচ চিকিৎসক বুঝে ফেলেছেন, তার কাজটি ছিল মূলত অহংকার সৃষ্টিকারী। বিনয়ের সাথে যার কোনো সম্পর্ক নেই। তাই আত্মার ব্যাপারটি বড়ই নাজুক। মানুষ এ ব্যাপারে নিজে নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না কোনো চিকিৎসকের ধারে যাবে। চিকিৎসকই বলবেন, কোন কাজটি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কর্তৃক নির্দেশিত আর কোনটি নির্দেশিত নয় এবং কোন কাজ কতটুকু করা যাবে আর কতটুকু করা যাবেনা।
তাসাউফ কাকে বলে?
এসব না বোঝার কারণে বর্তমানে আধ্যাত্মিকতা এক আনুষ্ঠানিকতায় রূপ নিয়েছে। কোনো পীর সাহেবের দরবারে হাতে হাত রাখলো আর তিনিও বাইয়াত করে নিলেন তারপর কিছু ওজিফা-সবক বলে দিলেন। বলে দিলেন, সকালে এটা পড়বে, সন্ধ্যায় এটা পড়বে, আল্লাহ-বিল্লাহ করবে, ব্যাস! এতটুকুই যথেষ্ট! গোপন ব্যাধি চিকিৎসার কোনো উদ্যোগ নেই, চরিত্র গঠনের কোনো প্রচেষ্টা নেই, উত্তম চরিত্র গ্রহণ করার প্রতি কোনো গুরুত্ব নেই, অসৎ চরিত্রের ব্যাপারে কোনো উদ্বেগ নেই। এসব কিছুই নেই অথচ অজিফা করছে নিয়মিত! তাহলে কোনো ফল হবে না; বরং অনেক ক্ষেত্রে এসব তখন আত্মিক ব্যাধিকে আরো বেপরোয়া করে তোলে।
বিভিন্ন অজিফা এবং আমলের তাৎপর্য
এসব অজিফা-জিকির-আমলের উপমা ভিটামিন ওষুধের মত। ভিটামিন ওষুধের প্রকৃতি হল, অসুস্থতাবস্থায় খেলে অনেক ক্ষেত্রে ক্রিয়াশীল হয় না বরং তখন অসুস্থতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। তদ্রুপ অহংকার-অহমিকা হৃদয়ে থাকলে শুধু বসে বসে অজিফা পড়লেই কাজ হবেনা। বরং তখন ওজিফা অনেক ক্ষেত্রে অহংকারকে আরো উস্কিয়ে দেয়। তাই উপদেশ দেওয়া হয়, ওজিফা-জিকির-আমল সবকিছু কোনো আল্লাহওয়ালার নির্দেশনা মতো কর। কারণ, আল্লাহওয়ালারা তাঁদের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নির্ণয় করবেন যে, কী পরিমাণ অজিফা-জিকির তোমার আত্মশুদ্ধির জন্য প্রয়োজন। প্রয়োজনে তাঁরা তোমার এসব অজিফা ও জিকির সাময়িকভাবে বন্ধও করে দিতে পারেন।
হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ. এভাবে বহু মানুষের চিকিৎসা করেছেন। প্রয়োজনে তিনি সমস্ত জিকির-অজিফা আমল ছাড়িয়ে নিয়েছেন। বিশেষ অবস্থায়, যখন এগুলো ক্রিয়াশীল হওয়ার পরিবর্তে প্রতিক্রিয়াশীল হতো তখন তিনি আর এগুলো করতে দিতেন না।
মুজাহাদার আসল উদ্দেশ্য
অথচ বর্তমানে আধ্যাত্মিকতা ও পীর-মুরিদীকে অন্যভাবে গ্রহণ করা হচ্ছে। নির্দিষ্ট অজিফা-জিকির-আমল আদায়ের উপরই যেন সম্পূর্ণ জোর প্রয়োগ করা হচ্ছে। আত্মশুদ্ধির কোনো ফিকির করা হচ্ছে না; অথচ লোকটি আত্মিক ব্যধিতে জর্জরিত! প্রথম দিকের সুফীগণ কিন্তু এমন ছিলেন না; বরং তাঁদের প্রথম পদক্ষেপ ছিল, চারিত্রিক অবক্ষয় থেকে মুক্ত করে পরিশীলিত করে তোলা। এজন্যই ভুক্তভোগীকে মুজাহাদার কাজ দেওয়া হতো। সাধনা-মুজাহাদা করানোর পরই তাকে প্রকৃত মানুষ করে গড়ে তোলা হতো।
শায়েখ আব্দুল কুদ্দুস গাঙ্গুহী রহ.-এর নাতির ঘটনা
শাহ আব্দুল কুদ্দুস রহ. ছিলেন গাঙ্গুহের একজন শীর্ষস্থানীয় অলি। আমাদের বুযুর্গদের সূত্রপরম্পরায় তাঁর বিশেষ অবস্থান রয়েছে। তাঁর এক নাতি ছিল। শায়েখ জীবিত থাকাকালীন তার মাথায় কখনোই ফিকির আসেনি যে, আমার দাদা থেকে সারা দুনিয়ার মানুষ ফয়েজ নিচ্ছে আর আমি শাহী মেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছি! অথচ চলে গেলে তো আর শত আফসোস করেও পাবো না, তাই তার দরবারে থেকে আমি আত্মশুদ্ধি করে নেই। এভাবে নাতি কখনো ভেবে দেখিনি। ইনতেকালের পর তার আফসোস জেগে উঠল। ভাবল, দাদাকে নিজের কাছে পেয়েও ধন্য হতে পারলাম না। বাতির নিচে অন্ধকারের মতই আমি রয়ে গেলাম। অথচ দুনিয়ার অসংখ্য মানুষ তাঁর থেকে ফয়েজ-বরকত লাভ করেছে। এভাবে তার আফসোস উজ্জীবিত হয়ে উঠল। ব্যাকুল হয়ে পড়ল যে, এখন সেই ক্ষতিপূরণ করা যায় কিভাবে! বহু ভেবেচিন্তে উপায় বের করল যে, দাদার নিকট থেকে যারা উপকৃত হয়ে ধন্য হয়েছেন তাদের কাছে গিয়ে উপকৃত হওয়া যায়। অনুসন্ধানে নামল, দাদার খলিফাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় আল্লাহওয়ালা কে? তারপর বলখের এক বুজুর্গের সংবাদ পেল। তিনিই দাদার শীর্ষ খলিফা। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল, কোথায় বলখ আর কোথায় গঙ্গুহ! ঘরের সম্পদকে কদর না করায় তার আজ এই পরিণতি। তবুও কী আর করা, যেহেতু সত্যের পিপাসা তার হৃদয়ে ছিল তাই সে বলখের পথে পাড়ি জমালো।
শায়খের নাতিকে অভ্যর্থনা
অন্য দিকে শায়েখের ওই বলখীয় খলিফা যখন জানতে পারলেন তারই শায়েখের নাতি তার নিকট আসছে। তিনি শহর থেকে বের হয়ে তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। সসম্মানে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসলেন। উন্নত খাবার পরিবেশন করলেন। থাকার উন্নত ব্যবস্থা করে দিলেন। না জানি আরো কত কি করলেন!
গোসলখানার ওখানে আগুন জ্বালাবে
এভাবে এক-দু’দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর নাতি বলল, হযরত! আপনি আমার সঙ্গে সদাচরণ দেখিয়েছেন, অত্যন্ত আদর-যত্ন করেছেন। কিন্তু আসলে আমি অন্য একটি উদ্দেশ্যে এসেছি। বুজুর্গ জিজ্ঞেস করলেন, কী উদ্দেশ্যে? বলল, আপনি আমার বাড়ি থেকে যে দৌলত নিয়ে এসেছেন তার কিছু অংশ আমাকেও দান করবেন–এই উদ্দেশ্যে এসেছি। বুজুর্গ বললেন, আচ্ছা, এই দৌলত নিতে এসেছ। বলল, জি, হযরত! এবার বুজুর্গ বললেন, যদি সেই দৌলত অর্জন করার জন্যই এসে থাকো তাহলে গালিচা-কার্পেট-সম্মান-উন্নত খাবার সব কিছুই ছেড়ে দিতে হবে। থাকার যে আলীশান ব্যবস্থা করা হয়েছে, তাও ছাড়তে হবে। জিজ্ঞেস করল, তাহলে আমাকে কী করতে হবে? বুজুর্গ উত্তর দিলেন, আমাদের মসজিদের পাশে একটি গোসলখানা আছে। সেখানে যারা অজু করে তাদের জন্য লাকড়ি জ্বালিয়ে গরম পানির ব্যবস্থা করা হয়। তোমার কাজ হলো, শুধু লাকড়ি জ্বালাবে আর গরম পানি করবে। বুজুর্গ আমল-অজিফা-জিকির এসব কিছুর কথাই বললেন না। বললেন, তোমার আপাতত কাজ এটাই। জিজ্ঞেস করা হয়, তাহলে হযরত, থাকার ব্যবস্থা? বললেন, রাতে ঘুমোতে হলে ওখানে গোসলখানার পাশেই শুয়ে থাকবে।
কোথায় লালগালিচার সংবর্ধনা, উন্নত থাকা-খাওয়া, আপ্যায়ন আর কোথায় গোসলখানায় বসে বসে আগুন জ্বালানোর কাজ!
আমিত্বকে আরো বিনাশ করতে হবে
শায়খ আব্দুল কুদ্দুস রহ.-এর নাতি তারই এক বলখীয় খলীফার দরবারে এসে যথারীতি গোসলখানার সামনে পানি গরম করার কাজ করতে লাগলেন। একদিন বলখীয় বুজুর্গ ঝাড়ুদারকে ডেকে বললেন, দেখবে, গোসলখানার পাশে এক লোক বসা আছে। ময়লার ঝুড়ি নিয়ে যাওয়ার সময় তার পাশ দিয়ে যাবে এবং এমনভাবে তার পাশ ঘেঁষে যাবে, যেন ময়লার গন্ধ তার নাকে লাগে। ঝাড়ুদার কথামতো যেই তার পাশ দিয়ে যেতে চাইলো তখন তার সহ্য হলো না। সারাজীবন যে শাহী হালতে জীবন কাটিয়েছে, তার এটা সহনীয় হয় কিভাবে! তাই সে ধমকের সুরে বলে উঠলো, এই তোমার সাহস তো কম নয়! ময়লার ঝুড়ি আমার নাকের কাছে এভাবে নিয়ে এলো কেন? ভাগ্য ভালো–এটা গাঙ্গুহ নয়। অন্যথায় দেখে নিতাম। তারপর বলখের বুজুর্গ ঝাড়ুদারকে বললেন, কী ব্যাপার, কী বলল? ঝাড়ুদার তখন বৃত্তান্ত শোনালো। বুজুর্গ তখন মন্তব্য করলেন, উহুঁ, আমিত্ব এখনো রয়ে গেছে। এখনো চাউল সিদ্ধ হয় নি।
এভাবে আরও কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর বুজুর্গ ঝাড়ুদারকে ডেকে বললেন, এবার ময়লার ঝুড়ি শুধু নাকের পাশ দিয়ে নিয়ে যাবে না বরং এমনভাবে যাবে যেন ময়লার তার শরীরে লেগে যায়। এরপর কী ঘটে; আমাকে জানাবে। ঝাড়ুদার বুজুর্গের কথামতো কাজ করলো। বুজুর্গ এবার কী হয়েছে; জানতে চাইলেন। বলল, এবার ঝুড়িটা একেবারেই তার শরীর ঘেঁষে নিয়ে গিয়েছি এবং এতে কিছু ময়লাও তার গায়ে লেগেছে। তবু আমাকে কিছু বলল না। তবে খুব দাঁত-মুখ খিচিয়ে আমার প্রতি তাকিয়ে ছিল। বুজুর্গ মন্তব্য করলেন, আলহামদুলিল্লাহ, কাজ হচ্ছে।
এবার হৃদয়ের তাগুত ভেঙ্গেছে
অতঃপর কিছুদিন পর বুজুর্গ ঝাড়ুদারকে বললেন, এবার তুমি তার পাশ কেটে এমনভাবে যাবে, যেন তোমার ময়লার ঝুড়ি থেকে বেশকিছু ময়লা তার গায়ে পড়ে। এতে তার প্রতিক্রিয়া কী হয়; জানাবে। সে তাই করলো। বুজুর্গ জিজ্ঞেস করলেন, কী প্রতিক্রিয়া দেখলে? উত্তর দিল, এবারের ব্যাপারটি সত্যিই বিস্ময়কর! ঝুড়ি ফেলতে গিয়ে আমিও পড়ে গিয়েছিলাম। এতে সে একেবারেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমাকে জিজ্ঞেস করতে লাগল, ব্যথা পাননি তো? বুজুর্গ মন্তব্য করলেন, আলহামদুলিল্লাহ, তার অন্তরে যে তাগুত বিরাজ করেছিল; তা ভেঙ্গে গেছে।
শিকল ছাড়তে পারবে না
এবার নাতিকে ডেকে এনে দায়িত্ব পরিবর্তন করে দিলেন। বললেন, গোসলখানায় তোমার দায়িত্ব শেষ। এখন থেকে তুমি আমার সঙ্গে থাকবে। তবে এভাবে থাকবে যে, আমি যখন শিকার করতে বের হব তখন তুমি আমার শিকারি কুকুরটির শিকল হাতে রাখবে এবং আমার সঙ্গে থাকবে। এভাবে মর্যাদা কিছুটা বাড়লে। শায়খের সোহবত লাভের মর্যাদা পেল। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল, কুকুরের শিকল ধরে রাখতে গিয়ে। কুকুর যখন শিকার দেখল তখন দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিলো। এক পর্যায়ে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। আর কুকুর তাকে নিয়েই টেনে হিচড়ে চলতে লাগলো। তবুও সে কুকুরের শিকল ছাড়লো না। কারণ, এ ছিল শায়েখের নির্দেশ। পরিণতিতে সে আহত হয়ে পড়ল। দর দর করে শরীর থেকে রক্ত ঝরে পড়তে লাগলো।
ওই দৌলত ন্যস্ত করলাম
রাতের বেলা বুজুর্গ তার শাইখ আব্দুল কুদ্দুস গাঙ্গুহকে স্বপ্নে দেখলেন। তিনি বললেন, মিঁয়া, আমি তোমাকে দিয়ে তো এত কষ্ট উঠাই নি। এতে বুজুর্গ দিশা পেলেন এবং তাকে ডেকে বললেন, আপনি যে দৌলত লাভ করতে এখানে এসেছেন এবং যে দৌলত আমি আপনার বাড়ি থেকে এনেছিলাম। আমি সেই সম্পূর্ণ দৌলত ‘আলহামদুলিল্লাহ’ আপনাকে ন্যস্ত করলাম। দাদার উত্তরাধিকার আপনি পেয়ে গেছেন। এবার আল্লাহর ফজলে আপনি দেশে ফিরতে পারেন।
সংশোধনের আসল উদ্দেশ্য
বলছিলাম, সম্মানিত সুফীগণের মূল কাজ ছিল, রোগ উপশম করা। তাঁদের দরবারে কেবল অজিফা-জিকির আর নির্দিষ্ট আমল ছিল না। হ্যাঁ, এগুলো ছিল; তবে ভিটামিন স্বরূপ ছিল। এগুলো ছিল সংশোধনের সহযোগী হিসেবে। অন্যথায় আসল উদ্দেশ্য ছিল, অহংকার-অহমিকা, হিংসা-বিদ্বেষ, কপটতা, রিয়া, পদের লোভ; মোটকথা যাবতীয় আত্মিক পীড়া অন্তর থেকে বের করে দিয়ে ভুক্তভোগীকে পুতপবিত্র করে দেওয়া। আল্লাহর ভয়, তাঁর প্রতি ভরসা-আস্থা, একনিষ্ঠতা, ইখলাস ও বিনয়সহ যাবতীয় উত্তম গুণ মানুষের অন্তরে গেঁথে দেয়াই আধ্যাত্মিকতা বা তাসাউফের মূল কথা।
আত্মশুদ্ধি কেন প্রয়োজন?
অনেকের ধারণা, তাসাউফ শরীয়ত বহির্ভূত কোনো বিষয়। জেনে রাখুন, তাসাউফ ইসলামি শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দৃশ্যমান যাবতীয় কাজের বিধি-বিধানই তো শরিয়ত। আর অদৃশ্যমান সমস্ত কাজের সমষ্টি হল তরিকত। আত্মশুদ্ধি না হলে দৃশ্যমান সকল কাজই মূল্যহীন। যেমন, ইখলাস একটি অদৃশ্য আমল। ইখলাস বলা হয়, প্রত্যেক কাজেই আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে একমাত্র আল্লাহর জন্যই সকল কাজ করা। কারো মনে ইখলাস না থাকলে তার নামাযও অনর্থক। কেউ হয়তো নামাজ পড়ে যেন মানুষ তাকে মুত্তাকী-পরহেযগার-বুজুর্গ ধারণা করে। তাহলে এই ব্যক্তির দৃশ্যমান নামাজ তো ঠিক আছে। কিন্তু এ ইখলাস না থাকার কারণে এই ঠিক থাকা মূলত ঠিক থাকা নয়। বরং তার নামাজও তখন ব্যর্থ হবে। উপরন্তু গুনাহও হবে। হাদীস শরীফে নবীজী ﷺ বলেছেন,
مَنْ صَلَّى يُرَائِي فَقَدْ أَشْرَكَ بالله
‘যে ব্যক্তি মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ে প্রকারান্তরে সে আল্লাহর সঙ্গে শরিক করে।’
কারণ কেমন যেন সে আল্লাহকে বাদ দিয়ে মাখলুককে খুশি করার তালে মত্ত। কাজেই বাহ্যিক অবস্থা দুরস্ত করার চেয়েও আত্মিক অবস্থা শুদ্ধ করার গুরুত্ব বেশি। এমন না হলে বাহ্যিক আমল ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।
নিজের চিকিৎসক খোঁজ করুন
আমাদের বুজুর্গরা পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন, মানুষ যেহেতু নিজের সংশোধন নিজে করতে পারে না তাই কোনো চিকিৎসক খুঁজে নেওয়া প্রয়োজন। ওই চিকিৎসককে পীর-শায়েখ-ওস্তাদ; যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন; মূলত তিনি হবেন একজন চিকিৎসক। আত্মার চিকিৎসক। যতদিন মানুষ এরূপ না করবে ততদিন আত্মার রোগে ভুগতে থাকবে এবং আমল ব্যর্থ হবে।
আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে বুঝার এবং আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
وَآخِرُ دَعْوَانَا اَنِ الْحَمْدُ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ