মূল
মাহবুবুলওলামা হযরত মাওলানা পীর
জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী মুজাদ্দেদী
অনুবাদ ও সম্পাদনা
শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী
দ্বিতীয় অধ্যায়
ইশকে ইলাহির প্রভাবসমূহ
ইশকে ইলাহির বরকত এতই প্রবল ও অধিক যে, এটি যার অন্তরে সূচিত হয় তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত অপার্থিব নূরে নূরান্বিত হয়ে উঠে।
চেহারায় প্রভাব
সত্যনিষ্ঠ আশেকের চেহারা ইশকে ইলাহির নূর দ্বারা নূরান্বিত হয়। সাধারণ মানুষের দৃষ্টি তাঁর নূরাণি-চেহারার দিকে পড়লে পরে জীবনের গিল্টি খুলে যায়।
একবারের ঘটনা। কিছু হিন্দু মুসলমান হল। তখন তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হল, তোমরা এ কাজ করলে কেন? উত্তরে তারা আল্লামা আনোয়ার শাহ্ কাশ্মিরী রহ.-এর চেহারার প্রতি ইঙ্গিত করে বলল, এটা কোনো মিথ্যাবাদীর চেহারা হতে পারে না। যেহেতু এই চেহারার অধিকারী লোকটি মুসলমান, তাই আমরাও মুসলমান হয়ে গেলাম।
অন্য এক সময়ের ঘটনা। হযরত মুরশিদে আলম রহ. হারাম শরিফে অবস্থান করছিলেন। ইত্যবসরে তাঁর দৃষ্টি পড়ল হযরত মাওলানা ক্বারী মুহাম্মদ তৈয়্যব রহ. এর দিকে। তিনি এগিয়ে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, ক্বারী সাহেব! এই নূরানী-চেহারা আপনি কিভাবে বানালেন? ক্বারী সাহেব উত্তর দিলেন, আমি নয়; আমার মুরশিদ বানিয়ে দিয়েছেন।
হাদীসশরিফে আল্লাহওয়ালাদের নিদর্শন বলা হয়েছে-
الَّذِينَ إِذَا رُؤُوا ذُكِرَ اللَّهُ
‘তাদেরকে দেখলে কথা মনে পড়ে যাবে।’ (আল আদাবুল মুফরাদ ৩৩২)
বোঝা গেল, আল্লাহওয়ালাদের চেহারায় এতটাই নূর থাকে যে, তাঁদের প্রতি তাকালে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়। কোরআন মজিদে সাহাবায়ে কেরামের ব্যাপারে বলা হয়েছে-
سِيمَاهُمْ فِي وُجُوهِهِمْ مِنْ أَثَرِ السُّجُودِ
তাদের নিদর্শণ হল, তাদের চেহারায় আছে সিজদার ছাপ। (সূরা ফাতহ ২৯)
প্রতীয়মান হল, সিজদার ইবাদতগুলো মানুষের চেহারায় নূর তৈরি করে সাজিয়ে দেয়।
নবী করীম ﷺ খুব বেশি অসুস্থ ছিলেন, তখন আবুবকর রাযি. কয়েক ওয়াক্ত নামাযের ইমামতি করেছিলেন। সাহাবায়ে কেরাম বলেন, তখনকার এক নামাযের পরের ঘটনা। নবীজী ঘরের দরজা ফাঁক করে মসজিদের দিকে তাকালেন। তখন তাঁর নূরানী-চেহারা দেখে আমাদের কাছে মনে হয়েছিল-
كَأَنَّ وَجْهَهُ وَرَقَةُ مُصْحَفٍ
কেন যেন তাঁর চেহারা ছিল কুরআনের পাতা। (বুখারি ৬৫৯)
শাহ আতাউল্লাহ বুখারি রহ. বলতেন, ছাওর গুহায় রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর পবিত্র মাথা হযরত আবুবকর রাযি. এর কোলে ছিল। এভাবেই তিনি আবুবকর রাযি. এর কোলে শোয়া ছিলেন। আবুবকর রাযি. বসে বসে তাঁর চেহারা দেখছিলেন। শাহ আতাউল্লাহ বুখারি বলেন, কল্পনার জগতে আমার কাছে মানে হচ্ছিল, হে আবুবকর! আপনার কোল যেন পবিত্র কোরআনের রেহাল। আর রাসূলুল্লাহﷺ-এর চেহারা যেন পবিত্র কোরআন। হে আবুবকর! আপনি যখন বসে বসে নবীজীর চেহারা দেখছিলেন, যেন আপনি পবিত্র কোরআনই তেলাওয়াত করছিলেন।
একবারের ঘটনা। খাজা আবুল হাসান খিরকানি রহ. বললেন, বায়েজিদ বোস্তামি রহ. এর চেহারায় এতটাই নূর ছিল যে, যে লোক তাঁকে দেখত তার অন্তরের জট খুলে যেত। তখন উপস্থিত এক লোক প্রশ্ন করে বসল, আবু জাহাল রাসূলুল্লাহﷺ-এর চেহারা দেখেছিল, তার অন্তরের জট তো খুলে নি। সুতরাং আপনি কিভাবে বললেন, বায়েজিদ বোস্তামির চেহারা দেখে লোকদের অন্তরের জট খুলে যায়? উত্তরে আবুল হাসান খিরকানি রহ. বললেন, আরে বোকা! আবু জাহাল নবীজীর চেহারা দেখল-ই বা কখন? লোকটি তখন হতচকিত হয়ে বলল, কী বলেন, দেখেনি? আবুল হাসান খিরকানি রহ. উত্তর দিলেন, আবু জাহাল আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদের চেহারা দেখেছিল। যদি একবার সে তাঁর পবিত্র চেহারার প্রতি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর চেহারা হিসাবে দৃষ্টি দিত তাহলে সে হেদায়েত থেকে বঞ্চিত হত না।
আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম ইহুদিদের বড় আলেম ছিলেন। নবীকরীম ﷺ-এর দরবারে আসলেন তিনটি প্রশ্ন করার নিয়তে। কিন্তু তাঁর নূরানি-চেহারা দেখে ইসলাম গ্রহণ করে নিলেন। হয়ে গেলেন- রাযিয়াল্লাহু আনহু। কেউ জিজ্ঞেস করল, আপনি তো এসেছিলেন ভিন্ন মতলবে, এখন এমন কী ঘটল? উত্তরে তিনি নবীজী ﷺ-এর নূরানী-চেহারার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন-
وَاللهِ هَذَا الْوَجْهَ لَيْسَ بِوَجْهِ كَذَّابٍ
আল্লাহর কসম! এই চেহারা কোনো মিথ্যাবাদির চেহারা হতে পারে না। (ইবন মাজাহ ৩২৫০)
তাবিঈদের মধ্য থেকে অনেকে প্রশাসকও ছিলেন। তখন জনৈক প্রশাসক নিজের কিছু লোককে কাফেরদেও কাছে পাঠালেন জিযিয়া-ট্যাক্স উসুল করে আনার জন্য। কাফেররা দিতে অস্বীকার করল। তখন তাদেরকে জিজ্ঞাস করা হল, তোমরা জিযয়া দিচ্ছ না কেন; অথচ এর আগে তো আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে জিযয়া দিতে? তারা উত্তর দিল, হ্যাঁ, তোমাদের পূর্বপুরুষরা আসতেন। তাঁদের কাপড় ছিল জীর্ণ-পুরনো। চুল থাকত এলোমেলো। রাতের ইবাদতের কারণে চোখ থাকত ঢুলঢুলু। তবে তাঁদের চেহারায় থাকত অপার্থিব গাম্ভীর্যতা। যার কারণে আমরা তাঁদের প্রতি চোখ তুলে কথা বলারও সাহস করতাম না। তোমাদের মধ্যে এই গুণগুলো নেই। সুতরাং চলে যাও। আমরা তোমাদের হাতে কিছুই দিব না।
দৃষ্টিতে প্রভাব
সত্যনিষ্ঠ আশেকের দৃষ্টিতেও থাকে অন্যরকম প্রভাব। তাঁর দৃষ্টি যেখানে পড়ে প্রভাব বিস্তার করে ছাড়ে। কবির ভাষায়-
نگاہ ولی میں وہ تاثیر دکھی
بد لتی ہزاروں کی تقدیر دیکھی
ওলির দৃষ্টিতে দেখেছি প্রভাব মুগ্ধকর
প্রভাবে বদলেছে তাকদির অনেকের।
হযরত খাজা বেগালাম হাসান সুয়াগ রহ. নকশবন্দিয়া-সিললিার একজন বুজুর্গ ছিলেন। তাঁর খেদমতে কোনো বেঈমান আসলে তিনি তাঁকে যদি পরিপূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে দেখতেন তাহলে সে ইসলাম গ্রহণ করে নিত। এটা মাঝে মাঝে ঘটত। এভাবে বেশকিছু হিন্দু যুবক মুসলিম হয়ে গেল। হিন্দুরা এতে ক্ষেপে গিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করে বসল। অভিযোগ তোলা হল, এ লোকটি আমাদের যুতকদেরকে জোরপূর্বক মুসলিম বানিয়ে নিচ্ছে। অবশেষে হযরতকে আদালতে তলব করা হল। তিনি আদালতে উপস্থিত হলেন এবং জানতে চাইলেন, আমাকে ডাকা হয়েছে কেন? ম্যজিস্ট্রেট উত্তর দিল, আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, আপনি হিন্দুদেরকে জোরপূর্বক মুসলমান বানান। অভিযোগ শুনে হযরত খুব বিস্মিত হলেন। অবশেষে মামলার শুনানি শুরু হল। এক পর্যায়ে বাদীপক্ষের সাক্ষী যখন সাক্ষ্যদানের উদ্দেশ্যে দাঁড়াল, তখন হযরত তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, বল তো মিঁয়া সাহেব! আপানাকে কি আমি মুসলিম বানিয়েছি? উত্তরে সে কালিমা পড়ে নিল। তারপর আসলো ধারাবাহিকভাবে দ্বিতীয় সাক্ষী, তৃতীয় সাক্ষী এবং চতুর্থ সাক্ষী। হযরত প্রত্যেককে একই প্রশ্ন করলেন, উত্তরে সবাই কালিমা পড়ে নিল। ম্যাজিস্ট্রেট নিজেও ছিলেন হিন্দু। এই কাণ্ড দেখে তিনি ঘাবড়ে গেলেন। আশঙ্কা করলেন, তার প্রতি তাকিয়েও খাজা সাহেব উক্ত প্রশ্ন করে বসেন কি-না এবং তিনিও উত্তরে কালিমা পড়ে ফেলেন কি-না! তাই তিনি বললেন, বেশ! আর নয়। আমি বুঝে গেছি। এই বলে তিনি মামলা খারিজ করে দিয়ে তাঁকে সসম্মানে মুক্তি দিয়ে দিলেন।
হযরত শাহ আব্দলু কাদের রহ. দিল্লির একটি মসজিদে আঠার বছর ইতেকাফের নিয়তে ছিলেন। ওই সময়ে তিনি পবিত্র কোরআনের তরজমা লেখার কাজও সম্পন্ন করেছিলেন। আঠার বছর পর যখন মসজিদ থেকে বের হলেন, তখন হঠাৎ সামনে পড়ল একটি কুকুর। তাঁর ওই সময়ের দৃষ্টিটা পড়ে গেল কুকুরটার ওপর। ফলে কুকুরটার মধ্যে ‘জযব’ দেখা দিল। তারপর থেকে সে যে দিকে যেত, অন্য কুকুররা তার পেছনে পেছনে চলা শুরু করে দিত।
হাদীস শরিফে এসেছে- اَلْعَيْنُ حَقٌّ. ‘নজর বা দৃষ্টি লাগা বাস্তব।’
সাহাবায়ে কেরামের কারো কারো নজর লেগেছিল, তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁদেরকে নজর নামানেরা উপায় বলে দিয়েছিলেন। ভারনার বিষয় হল, হিংসা বিদ্বেষ ও শত্রুতামিশ্রিত দৃষ্টির যদি প্রভাব থাকে তাহলে বিপরীতে আশেকের দুষ্টি-যে দৃষ্টিতে মিশে আছে ইখলাস, আন্তরিকতা, দয়া-মায়া; সে দৃষ্টি নিজের প্রভাব দেখাতে পারবে না কেন?
যবানে প্রভাব
সত্যনিষ্ঠ আশেকের যবানেও তাছির বা প্রভাব থাকে। একদিকে তাঁর যবার থেকে নিসৃত দোয়া আল্লাহ তাআলার দরবারেও কবুল হয়ে যায়। অপরদিকে তাঁর কথায় মানুষের অন্তরে দাগ সৃষ্টি করে। একই কথা সাধারণ কেউ বললে ওই পরিমাণ প্রভাব ফেলে না, যে পরিমাণ প্রভাব একজন আশেকের মুখের কথায় হয়। আশেকের কথা মানুষের হৃদয়-গভীরে গিয়ে রেখাপাত করে।
دل سے جو بات نکلتی ہے اثر رکھتی ہے
অন্তপুরী থেকে বের হওয়া কথার প্রভাব হয় বিস্তর।
শাহ আব্দুল কুদ্দুস গাঙ্গুহি রহ. এর সাহবেজাদা প্রতিষ্ঠানিক ইলম অর্জণ করে যখন বাড়িতে আসলেন, তখন এক মাহফিলে শাহ সাহেব তাকে বললেন, বেটা! তোমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখে, এদেরকে কিছু নসিহত কর। সাহবেজাদা তখন নিজের ইলমি-বৈভব ছড়িয়ে খুব জোশের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ নসিহত করলেন। কিন্তু মজলিসের কারো যেন পশমও নড়ল না। অবশেষে শাহ সাহেব মজলিসের লোকদের উদ্দেশ্যে বললেন, ফকিরগণ! গতকাল আমি দুধ রেখেছিলাম। একটা বিড়াল সব দুধ খেয়ে ফেলল। শাহ সাহেবের এই সাধারণ কথায় মজলিসের চেহারা পাল্টে গেল। কান্নার রোল পড়ে গেল। মাহফিল শেষে যখন বাপ-বেটা দু’জনই বাড়িতে গেলেন তখন শাহ সাহেব বললেন, বেটা! তুমি কত সুন্তর সুন্দর কথা বলেছ, কত চমৎকার বয়ান করেছ, কিন্তু কারো যেন কানেই পড়ে নি। অথচ আমি একেবারে সাধারণ কথা বলেছি, মজলিসের হাল ‘বেহাল’ হয়ে গেল। এর কারণ কী? সাহেববজাদা উত্তর দিলেন, আব্বাজান! এটা আপনিই ভালো বলতে পারেন। শাহ সাহেব বললেন, বেটা! অন্তরে যদি ইশকের আগুন থাকে তখন যবান থেকে বের হওয়া প্রতিটি সাধারণ কথাই ‘অসাধারণ’ হয়ে ওঠে। তখন ওই সাধারণ কথাটাই মানুষের অন্তরে তুফান তুলতে পারে।
মাটিতে প্রভাব
মানুষ তো রক্তে-গোশতে গড়া এবং তার বুকের মধ্যে আছে স্পন্ধনকারী অন্তর। ইশক তো এমন আজব জিনিস যে, মানুষ কেন, এর প্রভাব মাটিতেও পড়ে। মাটির সঙ্গেও যদি ইশক মিশে যায় তাহলে সে মাটিও হয়ে ওঠে স্মৃতির আকর। তাজমহল এবং কর্ডোভা জামে মসজিদ এত প্রসিদ্ধ কেন? কোন জিনিস এগুলোকে স্মরণীয় করে রেখেছে? ইট-মাটির তৈরি এই ইমারতগুলো ইতিহাসের পাতায় সৌন্দর্য হয়ে আছে কেন? কারণ, এগুলোর সঙ্গে মিশে আছে ইশক ও প্রেম। ভাবুন, মাখলুকের প্রতি ভালোবাসার যদি এত ডংকা বাজে তাহলে খালিক তথা আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার অবস্থা কেমন হবে!
আরো পড়ুন– ইশকে ইলাহী পর্ব-০৪