২. সৌন্দর্য ও কমনীয়তা
♠———————————————————————————♠
কারও প্রতি ভালবাসা ও আসক্তি তৈরি হওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে, তাঁর রূপ-লাবন্য-সৌন্দর্য ও কমনীয়তা। সুন্দর ও সুশ্রী ব্যক্তি বা বস্তু বা দৃশ্য দেখা মাত্রই মানুষের মাঝে আপনাআপনিই একটা ভাললাগা তৈরি হয়ে যায়। আর নবী করিম ﷺ-কে আল্লাহ পাক এমন অপরূপ সৌন্দর্য দান করেছিলেন তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
১. হাদিস শরিফে এসেছে ,
إِنَّ اللَّهَ جَمِيلٌ يُحِبُّ الْجَمَالَ
‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা অতি সুন্দর এবং সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন।’
স্বয়ং আল্লাহ পাক যখন সৌন্দর্য পছন্দ করেন তখন তিনি তাঁর প্রধান প্রিয় পাত্র এবং প্রেমাস্পদকে কেমন সৌন্দর্য দান করবেন তা সহজেই অনুমেয়। কবির ভাষায়–
نازاں ہے جس پے حسن وہ حسنِ رسول ہے
یہ کہکشانں تو آپ کے قدموں کی دھول ہے
ہے رہرواںِ شوق چلو سرکے بل چلیں
توبہ کا درر کھلا ہے محمد کے شہر میں
‘গর্ব করার মত সৌন্দর্য হল রাসুল ﷺ-এর সৌন্দর্য। এসব নক্ষত্রপুঞ্জ আর ছায়াপথ রসুল ﷺ-এর পদধুলা মাত্র। হে পথিক! এখানে মাথার ওপর ভর করে (নত হয়ে) চলো। কেননা মদিনা তৈয়্যবার পথের কাঁটাও ফুল সমতুল্য।’
২. হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, আল্লাহ তাআলা এমন কোনো নবী প্রেরণ করেন নি যাঁর আকৃতি এবং কণ্ঠ সুন্দর নয়। আমাদের আখেরী নবী সব নবী থেকে অধিক সুন্দর এবং সুললিত কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন। (শামায়েলে তিরমিযি)
৩. হযরত হাসসান রাযি. নবী করিম ﷺ-এর সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন,
وَأَحسَنُ مِنكَ لَم تَرَ قَطُّ عَيني
وَأَجمَلُ مِنكَ لَم تَلِدِ النِساءُ
خُلِقتَ مُبَرَّءً مِن كُلِّ عَيبٍ
كَأَنَّكَ قَد خُلِقتَ كَما تَشاءُ
‘তাঁর চেয় সুন্দরতম
দেখেনি কভু নেত্রমম
দেয়নি জনম মাতৃকূলে
তব অধিক সুন্দরতম।
সকল ত্রুটির উর্ধে রেখে
তোমায় করা হয়েছে সৃজন
সৃষ্টি তোমায় হয়েছে করা
তেমনি রূপে চেয়েছ যেমন।’
৪. আল্লামা কুরতবী রহ. লিখেছেন, নবী করিম ﷺ-এর সম্পূর্ণ সৌন্দর্যের বিকাশ ঘটানো হয় নি। নইলে মানুষ তার সৌন্দর্যের তেজস্ক্রিয়তা সহ্য করতে পারত না।
৫. মুফতি এলাহী বখশ কান্ধলবী রহ. শিয়ামুলহাবিব নামক কিতাবে লিখেছেন। নবী করিম ﷺ-এর এত সৌন্দর্য থাকার কারণ হল, আল্লাহ পাকের আত্মমর্যাদাবোধের কারণে তার প্রেমাস্পদের পূর্ণ সৌন্দর্য সাধারণের সামনে প্রকাশ করেন নি।
৬. হযরত কাসেম নানুতুবী রহ. বলতেন,
جمال كو تيرے كب پہچےحسن يوسف كا
وه دلر بائےزليخا توشاهدستار
رہا جمال پہ تيرے حجا ب بشر يت
نہ جانا كو ن ہےکچھ بھي كسی نے جزستار
‘হযরত ইউসুফ আ.-এর সৌন্দর্য কখনও আপনার কমনীয়তা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে না। তিনি ছিলেন জুলাইখার দিলরুবা আর আপনি হচ্ছেন অন্তর্যামীর নিদর্শন। আপনার সৌন্দর্যের ওপর মানবিক অবগুণ্ঠন টানিয়ে রাখা হয়েছে। অন্তর্যামী ছাড়া কেউই জানে না আপনি কে?’
৭. অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, নবী করিম ﷺ বলেছেন, আমার ভাই ইউসুফ ছিলেন কান্তিময় আর আমি হলাম লাবন্যময়। অর্থাৎ দৃষ্টিনন্দন ও চিত্তাকর্ষক।
৮. وَأَلْقَيْتُ عَلَيْكَ مَحَبَّةً مِّنِّي ‘আমি তোমার প্রতি মহব্বত সঞ্চারিত করেছিলাম’–এই আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগন লিখেছেন, আল্লাহ পাক হযরত মুসা আ.-এর চোখে লাবন্যময়তা প্রদান করেছিলেন। ফলে যেই তাঁর দিকে তাকাত সেই বিমুগ্ধ হয়ে যেত। আকৃষ্ট হয়ে পড়ত। এখানে ভাবার বিষয় হচ্ছে, যদি হযরত মুসা আ.-এর কেবল চোখের লাবন্যতাই ফেরাউনের মত মহা শত্রুর মন নরম করে দিয়ে তাকে বিমুগ্ধ ও আকৃষ্ট করতে পারে, তাহলে নবী করিম ﷺ-এর গোটা শরীরের লাবন্যতা মানব জাতির হৃদয়ে কেমন প্রভাব বিস্তার করবে? কবির ভাষায়,
گرمصورصورت آں دل ستاں خواهد كشيد
ليك حيرانم كه نازش راچساں خواهد كشيد
‘যদি কোনো চিত্রকর সেই সৌন্দর্যের আধার কমনীয় ও লাবন্যময় মাহপুরুষের গোটা চিত্র অংকন করতে যায় তাহলে ভেবে বিস্মিত হই যে, সে কীভাবে তার এমন অপার্থিব সৌন্দর্য তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলবে?”
৯. হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাযি. বলতেন, নবী করিম ﷺ-এর পবিত্র চোখে এতটাই লাজুকতা বিরাজ করত, যা আরবের সম্ভ্রান্ত পরিবারের পর্দানশীন কুমারীর চোখেও দিখা যেত না। তিনি আরও বলতেন, জুলাইখার বান্ধবীরা যদি নবী করিম ﷺ-এর রূপ-লাবন্য দেখত তাহলে তাদের হাতের আঙ্গুল নয় বরং হৃদয়ই কেটে ফেলত। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রা. কবিতরা মাধ্যমে নবী করিম ﷺ– এর সৌন্দর্যের বর্ণনা এভাবে উপস্থাপন করেছেন,
لنا شمسٌ وللآفاق شمسٌ
وشمسی خیرُ من شمسِ السماء
فانّ الشمس تطلعُ بعد فجرٍ
وشمسی طالعٌ بعد العشاء
নীল নীলিমার দূর কিনারে
এক যে আছে, দ্বীপ্ত অরুণ
মেঘে গগনের রয়েছে রবি
তার চেয়ে যার অধিক কিরণ
হয় যে উদয় আকাশ রবি
পূর্ব কিনারে ফজর পরে
উদয় ঘটে মোর সবিতার নিত্য রাতে ইশার পরে।’
১০. হাদিসে বর্ণিত আছে, একবার হযরত হালিমা সা’দিয়ার মেয়ে শায়মা তার মাকে বলেন, ‘আমি ভীষণ ক্লান্ত। আমার দুধ ভাই মুহাম্মাদকে যদি আমার সাথে পাঠান, তাহলেই কেবল আমি ছাগল চড়াতে মাঠে যাব।’ মা এর কারণ জানতে চাইলে শায়মা বলেন, ‘আমি বহুবার পরীক্ষা করে দেখেছি, যখন আমার দুধ ভাই মুহাম্মাদ আমার সাথে থাকেন তখন ছাগলগুলো খুব দ্রুত ঘাস খেয়ে পেট ভরে নেয়। আর আমার ভাইকে কোলে নিয়ে আমি যেখানে বসে থাকি ছাগলগুলোও সেখানে এসে আমার চারপাশে গোল হয়ে বসে পড়ে। এরপর ছাগলগুলোও আমার সাথে বিমুগ্ধচিত্ত্বে অপলক নেত্রে মুহাম্মাদের অবয়বের দিকে তাকিয়ে তাঁর রূপ-লাবণ্য অবলোকন করতে থাকে। কবির ভাষায়,
ا ے ازل كے حسيں ا ے ا بد كے حسيں
تجھ سا كوئى نہيں تجھ سا كوئى نہيں
‘হে সৃষ্টিলগ্নের সুন্দর! হে অনন্তের সুন্দর!! তোমার মত সুন্দর আর কেউ নেই। তোমার মত সুন্দর আর কেউ নেই!!’
১১. আমিরে শরিয়ত সৈয়দ আতাউল্লাহ শাহ বোখারী রহ. তাঁর নিজ আঙ্গিকে বিশেষ ভঙ্গিমায় নবী করিম ﷺ-এর হিজরতের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। গারে সওরে অবস্থানকালের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন,
‘হে আবু বকর সিদ্দিক! আপনার কোলটা আমার কাছে একটি খোলা রেহালের মত মনে হচ্ছে। আর নবীজির চেহারাকে মনে হচ্ছে সেখানে রাখা পবিত্র কুরআন। হে আবু বকর! আপনাকে মনে হচ্ছে আপনি সেই কুরআনের সম্মানিত পাঠক। আপনি বসে বসে তা পাঠ করছেন …।’
১২. সাহাবায়ে কেরাম রাযি. বলতেন, যখন আমরা নবী করিম ﷺ-এর এর দিকে মুখ তুলে তাকাতাম, كَأَنَّ وَجْهَهُ وَرَقَةُ مُصْحَفٍ তখন মনে হত তার পবিত্র মুখমন্ডল যেন পবিত্র কুরআনের পৃষ্ঠা।
১৩. হযরত জাবের বিন সামুরা নামক সাহাবী রাযি. রাতের বেলায় মসজিদে নববীতে প্রবেশ করছিলেন। সামনে দিয়েই যাচ্ছিলেন নবী করিম ﷺ। সেটি ছিল পূর্ণিমার রাত। মাথার ওপর ভরা পূর্ণিমার চাঁদ জ্বল জ্বল করছিল। সেই সাহাবী একবার নবী করিম ﷺ-এর পবিত্র চেহারার দিকে তাকান আবার আকাশের চাঁদের দিকে তাকান। তিনি বলেন, ‘অতপর আমার অন্তর সাক্ষি দেয় পূর্ণিমার চাঁদের চেয়ে আমার প্রিয় নবী ﷺ-এর চেহারা মোবারক অনেক সুন্দর। অনেক উজ্জ্বল …।’ হে আকাশের চাঁদ! দুনিয়ার মানুষ তোমার সৌন্দর্যের আলোচনা করলেও আরবের চাঁদের সাথে তোমার কোনো তুলনাই চলে না। কবি বলেন,
چاند سے تشبیہ دینا بھی کیا انصاف ہے
چاند کی منہ پر چھایئاں مدنی کا چہرہ صاف ہے
‘নবী করিম ﷺ-কে চাঁদের সাথে তুলনা দেয়া একদম ন্যায়-ভ্রষ্ট ব্যাপার। কেননা, চাঁদের গায়ে দাগ রয়েছে কিন্তু মুহাম্মাদ মোস্তফা ﷺ-এর অবয়বে কোনো কালিমা নেই।’
১৪. হযরত আম্মার বিন ইয়াসারের পৌত্র রবি বিনতে মাসউদ নামক মহিলা সাহাবীকে বলেন, আপনি একটু নবী করিম ﷺ-এর হুলিয়া মোবারকের (গঠনাকৃতির) বর্ণনা দিন। তিনি এক কথায় বলে দিলেন, لَوْ رَأَيْتَهُ لَرَأَيْتَ الشَّمْسَ الطَّالِعَةَ ‘তুমি তার দিকে তাকালে মনে করতে পার যে, তোমার সামনে আকাশের সূর্য নেমে এসেছে।’
১৫. একবার হযরত আলী রাযি. নবী করিম ﷺ সম্পর্কে বলেন,
مَنْ رَآهُ بَدِيهَةً هَابَهُ ، وَمَنْ خَالَطَهُ مَعْرِفَةً أَحَبَّهُ ، يَقُولُ نَاعِتُهُ : لَمْ أَرَ قَبْلَهُ وَلَا بَعْدَهُ مِثْلَهُ
‘আচমকা দর্শনকারী তাঁকে দেখে চমকে যেত। গভীরভাবে দর্শনকারী তাঁর প্রতি বিমুগ্ধ হয়ে পড়ত। আর সাধারণ দর্শকরা বলত, তার মত সুন্দর কাউকে আগেও দেখি নি পরেও দেখব না।’
১৬. পবরর্তীকালে কেউ একজন হযরত জাবের বিন সামরা রাযি.-কে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘নবী করিম ﷺ-এর চেহারা মোবারক কি তলোযারেরমত চকচকে ছিল? হযরত জাবের রাযি. তাৎক্ষণিক বলে উঠেছিলেন,
لا، بل كان مثل الشمس والقمر
‘না, না, তলোয়ারের মত কেন হবে। বরং তিনি চাঁদ সুরুজের চেয়েও সুন্দর ছিলেন।’
১৭. হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كان رسولُ اللهِ ﷺ أزهَرَ اللَّونِ كأنَّ عَرَقَه اللُّولؤُ
‘নবী করিম ﷺ-এর গাত্র বর্ণ ছিল দুধে আলতা মিশ্রিত শুভ্ররক্তিম। গায়ের ঘামের ফোটাকে মনে হত মুক্তোর দানা।’
১৮. হযরত খারেজা বিন জায়েদ রহ. বলতেন, নবী ﷺ মানুষের মধ্যে সবচে’ বেশি গাম্ভীর্যপূর্ণ ছিলেন। তাঁর প্রতিটি কর্ম ছিল গাম্ভীর্যসমৃদ্ধ।
১৯. হযরত আবু সাঈদ খুদুরী রাযি. থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ‘নবী করিম ﷺ আরবের সম্ভ্রান্ত ঘরের পর্দাানশীন কুমারীর চেয়েও লাজুক ছিলেন। কোনো কিছু তাঁর কাছে অপছন্দনীয় হলে তা তাঁর চেহারাতেই ভেসে উঠত।’
২০. হযরত আব্দুল্লাহ বিন সালাম রাযি. বলতেন, (ইসলাম গ্রহণের পূর্বে) আমি তাকে দেখতে গেলাম।
فَلَمَّا تَبَيَّنْتُ وَجْهَهُ عَرَفْتُ أَنَّ وَجْهَهُ لَيْسَ بِوَجْهِ كَذَّابٍ
‘গিয়ে তাকে দেখা মাত্রই নিশ্চিত হলাম, এটি কোনো মিথ্যাবাদী লোকের চেহারা হতে পারে না।’
২১. হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ مِنْ أَحْسَنِ النَّاسِ خُلُقًا ، وَلا مَسَسْتُ خَزًّا وَلا حَرِيرًا وَلا شَيْئًا كَانَ أَلْيَنَ مِنْ كَفِّ رَسُولِ اللَّهِﷺ وَلا شَمَمْتُ مِسْكًا قَطُّ وَلا عِطْرًا كَانَ كَانَ أَطْيَبَ مِنْ عَرَقِ النَّبِيِّ ﷺ
‘নবী করিম ﷺ সৌন্দর্যের দিক থেকে সবচে বেশি সুন্দর ছিলেন। আমি কখনও রেশমের মসৃন কোনো কাপড় বা অন্য কিছুই স্পর্শ করি নি যা নবী করিম ﷺ-এর হাতের তালুর চেয়ে কোমল, তুলতুলে-নরম। আর এমন কোনো সুগন্ধীর ঘ্রাণ গ্রহণ করি নি যা নবী করিম ﷺ-এর শরীরের ঘামের চেয়ে সুরভিত সুবাসিত!!’
২২. হযরত জাবের ইবন সামুরা রাযি. বলেন, একবার নবী করিম ﷺ মসজিদ থেকে বের হয়ে বাসার দিকে রওয়ানা দিলে শিশুরা তাঁকে ঘিরে ধরে। তখন তিনি আদর করে আমার গালে তাঁর পবিত্র হাত বুলিয়ে দেন। এতে আমার মুখমন্ডল শীতল হয়ে যায়। সেই সাথে তা থেকে এমন সুঘ্রাণ বের হতে থাকে যেন এইমাত্র হাত কোনো আতরদানী থেকে বের করা হয়েছে। (মুসলিম)
২৩. একবার হযরত মুসআব ইবন উমায়ের রাযি. পবিত্র কুরআনের তাফসির করছিলেন। তাফসিরের মাঝে নবী করিম ﷺ-এর প্রসঙ্গ এলেই হযরত আবু আব্দুর রহমানের আঁখিদ্বয় ছলছলিয়ে উঠত তাঁর দিদারের আশায়। হৃদয় অস্থির হয়ে পড়ত। একপর্যায়ে তিনি হযরত মুসআব ইবন উমায়ের রাযি.-কে বললেন, ‘হজের মৌসুম কবে আসবে! কবে তাঁর দিদার লাভে ধন্য হতে পারব?!’ হযরত মুসআব ইবন উমায়ের রাযি. উত্তর দেন, ‘একট ধৈর্য ধরুন, অচিরেই হজের মৌসুম চলে আসবে। দিন খুব দ্রুতই চলে যাবে।’ ইত্যবসরে সমবেত জনতার মাঝ থেকে হযরত ইবন মুসলিম বলে উঠেন, ‘জীবনের কোনো ভরসা নেই। কখন মৃত্যু এসে পড়ে বলা যায় না। তাই সেদিনের অপেক্ষায় না থেকে আপনি আজই তার হুলিয়া মোবারক বর্ণনা করে দিন। বলে দিন, তিনি দেখতে কেমন?’ সঙ্গে সঙ্গে সমবেত জনতা একবাক্যে বলে উঠে যে, ইবন মুসলিম আমাদে্র সকলের মনের কথাটাই বলে দিয়েছে। হযরত মুসআব ইবন উমায়ের রাযি. নড়ে-চড়ে শান্ত হয়ে বসলেন। চোখ বুঁজে মাথা নিচু করে একটু ভেবে নিলেন। যেন নবী করিম ﷺ-এর পুরা হুলিয়া মোবারক একবার জেহেনে আওড়িয়ে নিলেন। অতপর মাথা উঁচু করে বলা শুরু করেন,
‘নবী করিম ﷺ-এর গায়ের রং ছিল দুধে আলতা মিশ্রিত অতুলনীয় ফর্সা। আখিঁদ্বয় হরিণ অক্ষির মত আকষর্ণীয়। ভ্রু ঘন-কালো উঁচু। চুল সামান্য কোঁকড়া তবে মোলায়েম-মসৃন। দাঁড়ি ঘন-কালো। উভয় কাঁধের মাঝে সামান্য ব্যাবধান ছিল। ঘাড় ছিল চাঁদির মত চকচকে। হাতের তালু ও পা সোন্তপূর্ণ মোলায়েম। চলার সময় মনে হত তিনি যেন একটু নিচের দিকে অবতরণ করছেন। (একটু সামনে ঝুঁকে হাঁটতেন) যখন দাঁড়িয়ে যেতেন মনে হত যেন কোনো চাটান থেকে বের হয়ে আসছেন। কারও দিকে তাকালে পূর্ণ মনোযোগের সাথে তাকাতেন। তাঁর শরীরে ঘাম ঝরলে মনে হত যেন মুক্তার দানা ঝলমল করছে। তিনি খর্বকারও ছিলেন না আবার বেঢপপা লম্বাও ছিলেন না। তাঁর উচ্চতা ছিল মানানসই মাঝারী। পিঠে উভয় কাঁধের মাঝে নবুওয়াতের মোহর ছিল। কিউ তাঁকে একবার দেখলেই প্রভাবিত ও বিমুগ্ধ হয়ে যেত। এবং ধীরে ধীরে তাঁর প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি হত। তিনি সবচে’ বেশি দানশীল এবং সবার চেয়ে সাহসী-বাহাদুর ছিলেন। কথায় সত্যবাদী, অঙ্গীকার পূরণে সম্পূর্ণ দায়বদ্ধ। স্বভাব একদম নম্র। চালচলন অনুপম। তার মত সুন্দর কাউকে আমি আগেও দেখিনি পরেও দেখি নি। (ফেদাইয়ূন মিন আসরির রাসুলﷺ পৃ. ৬০)
কবি বলেন,
اے چہرہ زیبائے تو رشکِ بتانِ آذری
ہر چند وصفت می کنم در حسنِ زاں زیبا تری
آفاق ہا گردیدہ اُم مِہر بتاں دز دیدہ اَم
بسیار خوباں دیدہ ام اما تو چیزے دیگری
‘হে নবী! আপনার কমনীয় চেহারা দেখে আজরের হাতে তৈরি মূর্ তিও ঈর্ষা করে। আমি আপনার সৌন্দর্যের যতই বর্ণনা দেই না কেন আপনি তা থেকে অনেক উর্ধে, অনেক সুন্দর। গোটা বিশ্ব ঘুরে বেড়িয়েছি সূর্যের মত উজ্জ্বল সৌন্দর্য দেখেছি, কিন্তু আপনি অন্য চিজ। ভিন জগতের বস্তু। আপনার কোনো তুলনা হয় না। আপনি অনুপম।’
২৪. তানবীরুল আবসার নামক কিতাবের ২৬ নং পৃষ্টায় রয়েছে,
خوشا چشمے کہ دید آں رُوئے زیبا
خوشا دل کہ دارد خیالِ محمد ﷺ
‘সেই চক্ষু কত সৌভাগ্যবান যে প্রিয়নবী ﷺ-এর কান্তিময় অবয়ব দর্শন করেছে। সেই হৃদয় কত সার্থক ও ভাগ্যবান যেখানে মুহাম্মাদ মোস্তফা ﷺ-এর খেয়াল-ধ্যান বাস করে।’
২৫. সাইয়্যিদুল কাওনাইন খুবই অভিজাতপূর্ণ ছিলেন। তার গঠন ছিল মাঝারি, তবে সমবেত জনতার মাঝে তাঁকেই সবচে’ বেশি উঁচু মনে হত।
২৬. আল্লাহর প্রিয় রাসুল ﷺ-এর নূরানী চেহারা ছিল পূর্ণিমার চাঁদের মত। গায়ের রং ছিল লালিমাযুক্ত শুভ্র। সীমাহীন নয়নাভিরাম চিত্তাকর্ষক ও মনমুগ্ধকর। কপাল ছিল অনুপম কোমল-মসৃন। কবি চমৎকার বলেছেন,
ا ے رسول اﻣين خاتم المر سلين
تجھ سا كوئى نہيں تجھ سا كوئى نہيں
ہے عقيده يہ ا پنا بصدق ويقين
تجھ سا كوئى نہيں تجھ سا كوئى نہيں
دست قد رت نے ا يسا بنا يا تجھے
جملہ ا وصاف سے خود سجا يا تجھے
ا ے ازل كے حسيں ا ے ا بد كے حسيں
تجھ سا كوئى نہيں تجھ سا كوئى نہيں
بزم كو نين پهلے سجا ئ گئ
پهر تير ی ذا ت منظرپر لا ئ گئ
سيد المر سلين سيدالآخرين
تجھ سا كوئى نہيں تجھ سا كوئى نہيں
مصطفى مجتبى تير ی مدح وثنا
ميرے بس ميں نہيں دسترس ميں نہيں
دل كو ھمت نہيں لب كو يارا نہيں
تجھ سا كوئى نہيں تجھ سا كوئى نہيں
كوئى بتلائے كيسے سراپا لكهوں
كوئى ہے ايسا جس كو ميں تجھ سا لكهوں
توبہ توبہ نہيں كوئى تجھ سا نہيں
تجھ سا كوئى نہيں تجھ سا كوئى نہيں
ا ے سراپا نفيس ا نفس دو جها ں
سرور دلبراں دلبر عاشقاں
ڈ هونڈتى ہے تجھے ميرے جا ن حزيں
تجھ سا كوئى نہيں تجھ سا كوئى نہيں
‘হে বিশ্বস্ত রাসুল! শেষনবী! তোমার মত কেউ নেই। তোমার তূল্য কেউ নেই। সততা ও দৃঢ়তার সাথে এই বিশ্বাস পোষণ করি, তোমার মত কেউ নেই তোমার অনুরূপ কেউ নেই। মহান আল্লাহর কুদরতি হাতে তুমি তৈরি হয়েছ। তিনি সকল প্রকার যাবতীয় গুণের সমাহার ঘটিয়েছেন তোমার মাঝে। উভয় জাহান প্রথমে সুশোভিত করা হয়েছে এরপর তোমার সত্ত্বা দৃশ্যপটে আনা হয়েছে। তুমি উভয় জাহানের সর্দার। তোমার মত কেউ নেই। তোমার মত কেউ নেই। হে মোস্তফা! হে মুজতাবা! তোমার গুণগান আর প্রশংসা করা আমার সাধ্যের বাইরে। অন্তরে সাহস নেই। ঠোটে শক্তি নেই। তোমার মত কেউ নেই তোমার মত কেউ নেই। কেউ কি বলে দিতে পারে? কীভাবে তোমার পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা লিখব! এমন কেউ কি রয়েছে? যাকে আমি তোমার মত বলব। তৌবা! তৌবা!! না, না, কেউই তোমার মত নয়। তোমার মত কেউ নেই। তোমার তুল্য কেউ নেই। হে উভয় জগতের সবচে’ দামী ব্যক্তি! প্রেমাস্পদের সম্রাট ও আশেকদের প্রেমাস্পদ! আমার ব্যাথিত হৃদয় সর্বদা তোমাকে খুঁজে বেড়ায়। তোমার মত কেউ নেই। তোমার তুল্য কেউ নেই …।’
২৭. দোজাহানের গৌরব মুহাম্মাদ ﷺ-এর কপাল ছিল মসৃন ও প্রশস্ত। ভ্রু ছিল সরু-ঘণ, কুঞ্চিত, ঈষৎ বাঁকা। যুগল নয় বরং ভ্রুদ্বয়ের মাঝে ব্যবধান ছিল। সেখানে একটি রগ ছিল যা ক্রোধের সময় ফুলে উঠত।
২৮. নবী করিম ﷺ-এর চুল মোবারক কানের লতি পর্যন্ত ছিল, মাথার মাঝ বরাবর সিঁথি ছিল। আর তা ছিল হালকা কোঁকড়া-মসৃন।
مر كر كسى كى زلف پہ معلوم ہو تجھے
فرقت كى رات كٹتى ہے كس پيج و تاب ميں
‘ তুমি কি জানো, কার জুলফির সৌরভে পাগলপারা হয়ে বিরহের রাত বিনীদ্র কাটে।’
২৯. হুজুর পাক ﷺ-এর চক্ষু ছিল ভীষণ মানানসই। চোখের মণি ছিল কুচকুচে কালো। সাদা অংশে হালকা লাল রেখা ছিল …। তাঁর সৌন্দর্য দেখে চোখ তৃপ্ত হত না।
يـزيـدكَ وجْـهُـهُ حـسْـنـاً
إذا ما زِدْتَهُ نظرَا.
‘তাঁর চোখ যতই তোমার দিকে দৃষ্টি দিবে ততই তার সৌন্দর্যের বর্ধন ঘটতে থাকবে।’
৩০. রহমাতুল লিল আলামীনের মুখমন্ডল ছিল মানানসই আন্দাজের প্রশস্ত। দাঁতগুলো ছিল ধবধবে শুভ্র। সামনের দাঁতের মাঝে সামান্য ফাঁকা ছিল। মুচকি হাসির সময় তা দিয়ে যেন আলো ঠিকরে পড়ত।
حيا سے سر جھكا لينا ادا سے مسكرا دينا
حسينوں كو بهى كتنا سہل ہے بجلى گرا دينا
লাজে মস্তক নুয়ে দেয়া, কথা বলার সময় মুচকি হাসি দেয়া। সুরূপাদের জন্য কতই না সহজ বিজলী চমকে দেয়া!!’
৩১. নবী করিম ﷺ-এর নাকের ওপর একধরনের নূর বা চমক ছিল। যার কারণে মনে হত তার নাক উঁচু।
৩২. তাঁর দাঁড়ি ছিল চাপা-ঘন। যা তাঁর সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দিত।
৩৩. নবী করিম ﷺ-এর গর্দান ছিল ভীষণ মসৃণ, সুন্দর চাঁদের মত চকচকে। হযরত আলী রাযি. বলতেন- নবী করিম ﷺ-এর উভয় কাঁধের মাঝে নবুওয়াতের মহর ছিল। যা আখেরী নবীর প্রতীক হিসেবে বিবেচিত ছিল। (শামায়েলে তিরমিযি)
কাসিদায়ে বুরদা থেকে—
فَهْوَ الَّذِي تَمَّ مَعْنَاهُ وَصُورَتَهُ
ثُمَّ اصْطَفَاهُ حَبِيبًا بَارِئَ النَّسَمِ
مُنَزَّهًا عَنْ شَرِيكٍ فِي مَحَاسِنِهِ
فَجَوْهَرُ الْحُسْنِ فِيهِ غَيْرُ مُنْقَسِمِ
‘ব্যাস, আপনার জাহেরি ও বাতেনি সৌন্দর্য ও গুণাবলী চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। অতপর আল্লাহ পাক আপনাকে তার প্রেমাস্পদ বানিয়ে নিয়েছেন। আপনি তার অনেক উর্ধে যে, আপনার সৌন্দর্যের সাথে অন্য কারও সৌন্দর্যের তুলনা করা হবে। অতপর আপনার সৌন্দর্যের কোনো তুলনা নেই। আপনার সৌন্দর্য অনুপম। বিভাজ্য নয়।’
يارب صلى وسلم دائما ابدا
على حبيبك خير الخلق كلهم
‘হে খোদা! সদা সর্বদা আপনার হাবিবের ওপর রহমত বর্ষণ করতে থাকুন। যিনি সৃষ্টিজীবের শ্রেষ্ঠ।’
উল্লেখিত দলিল দ্বারা একথা পরিস্কারভাবে প্রমাণিত হয়ে গেল যে, নবী করিম ﷺ-এর উপমা তিনি নিজেই। তিনি সকল ভালবাসা পাওয়ার প্রধান দাবীদার। তাই প্রতেক মুমিনের জন্য আবশ্যক যে, তাকে মনে-প্রাণে ভালবাসবে।
‘গোটা বিশ্বের সৌন্দর্য যখন ছড়িয়ে দেয়া হয়, তখন তা অগণিত ছিল। যখন সেগুলো একত্রিত করা হয় তখন তা আপনার নামে গণ্য হয়। অর্থাৎ সকল সৌন্দর্যর সমষ্টি আপনি মুহাম্মাদ ﷺ।’
আরো পড়ুন– ইশকে রাসূল পর্ব-০৫