ইশকে রাসূল–৬: কোরআন-হাদীস ও যুক্তির আলোকে নবীপ্রেমের গুরুত্ব

নবীপ্রেম
নবীপ্রেম

মূল: মাহবুবুলওলামা হযরত মাওলানা পীর জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী মুজাদ্দেদী দা: বা:

অনুবাদ
শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী

অধ্যায়-৪

ইশকে রাসুলের তথা নবীপ্রেমের গুরুত্ব

মহান আল্লাহ তাঁর সকল গুণে পূর্ণাঙ্গ, তিনি আসমান-জমিনের সকল খাজানার মালিক। সেই মহান করুণাময় আল্লাহ মানুষকে তাঁর অপরিসীম নাজ-নেয়ামত দ্বারা ঢেকে রেখেছেন। যেমন তিনি যদি মানুষকে হেদায়াত দান না করতেন তাহলে তাঁরা হেদায়াত পেত না, তিনি দৃষ্টিশক্তি না দিলে মানুষ অন্ধ থাকত। শ্রবণ শক্তি না দিলে বধির হয়ে থাকত। বাকশক্তি না দিলে বোবা হয়ে থাকত। পা না দিলে ল্যাংড়া হত, মাথায় চুল না দিলে টাক থাকত। আকল না দিলে পাগল হত। সৌন্দর্য না দিলে কদাকার হত। সুস্থতা না দিলে অসুস্থ থাকত। সন্তান না দিলে আঁটকুড়ো হত। সম্মান না দিলে অসম্মানী হত। মোটকথা, মানুষের কাছে যা কিছু আছে সবকিছু আল্লাহ পাকের মহান করুণার দান।

তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এত বেহিসাব নাজ-নেয়ামত আর অনুদান দেয়া সত্ত্বেও আল্লাহ পাক সে জন্য এক ফোটা খোঁটাও দেন নি। তদুপরি বিশেষ একটি নেয়ামত দান করে মহিয়ান-গরিয়ান আল্লাহ তাআলাও যেন মজা পেয়ে গেছেন যে, তিনি এই নেয়ামতের বিপরীতে খোঁটা দিয়ে দিয়েছেন এবং স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন,

لَقَدْ مَنَّ اللّهُ عَلَى الْمُؤمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولاً

‘আল্লাহ ঈমানদারদের উপর অনুগ্রহ করেছেন যে, তাদের মাঝে তাদের নিজেদের মধ্য থেকে নবী পাঠিয়েছেন।’

আল্লাহ পাক মানুষের মাঝে রাসুল পাঠিয়ে অফুরন্ত অনুগ্রহ এবং ইহসান করেছেন। নবী করিম -এর আগমন গোটা মানব জাতির জন্য এক বিশেষ ও স্পেশাল অনুদান। মানুষের সহজাত স্বভাব হল, তারা অনুদান পেয়ে খুশি হয়ে সে অনুদানকে যেমন ভালবাসে তেমনি আরও বেশি ভালবাসে সেই অনুদানদাতাকে। যার কারণে মুমিনগণ মহান আল্লাহপাককে যেমন গভীর ভালবাসে তেমনি আল্লাহর প্রিয় রাসুল -কেও পর্যাপ্ত ভালোবাসে। তিরমিযি শরিফের বর্ণনা, নবী করিম বলেছেন,

أَحِبُّوا اللَّهَ لِمَا يَغْذُوكُمْ مِنْ نِعَمِهِ وَأَحِبُّونِي بِحُبِّ اللَّهِ

তোমাদেরকে নেয়ামত দেওয়ার কারণে তোমরা আল্লাহ পাককে ভালবাসো। আর আমাকে ভালবাসো মহান আল্লাহকে ভালবাসার কারণে।

উদ্দেশ্য: যেহেতু দয়াময় আল্লাহ আমাকে ভালবাসে তাই তোমরা আমাকে ভালবাস। ইশকে রাসুলের এটি কতই না জ্বাজ্জল্যমান প্রমাণ!

محمد کی محبت ہے سند آزاد ہونے کی 
خدا کے دامن توحید میں آباد ہونے کی 

মুহাম্মদ মোস্তফা -কে ভালবাসা সাস্বাধীনতার আর আল্লাহ পাকের একত্ববাদের আঁচলে পরিপালিত হওয়ার  সনদপত্র।

যে ব্যক্তি হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা -কে ভালবাসে প্রকৃতপক্ষে সেই আল্লাহপ্রদত্ত নেয়ামতরাজির মূল্যায়ন করে। কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে। আর সাধারণ নিয়ম হল, কৃতজ্ঞব্যক্তির নেয়ামত বৃদ্ধি করে দেয়া হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, لَئِن شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ ‘তোমরা যদি আমার নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় কর তাহলে আমি সেই নেয়ামত তোমাদের জন্য আরও বৃদ্ধি করে দিব।’

এখানে একটি প্রশ্ন জাগে, আল্লহ তাআলা যত নেয়ামত দান করেছেন তার মধ্যে সর্ব শ্রেষ্ঠ ও সর্ব সেরা মহা মূল্যবান নেয়ামত হচ্ছে হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা -কে রাসুল হিসেবে প্রেরণ করা। তো এখন এই মহা নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করার ফলে তা কীভাবে আরো বাড়িয়ে দেয়া হবে? আল্লাহ তাআলা এর চেয়ে উন্নত উত্তম ও মূল্যবান কোন নেয়ামত আরো দান করবেন?

এর উত্তর হল, এই শুকরিয়ার ফল স্বরূপ যে নেয়ামত আল্লাহ তাআলা বৃদ্ধি করে দিবেন তাহল, আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি ও ভালবাসা। আল্লাহ পাকও তাকে ভালবাসবেন। তাকে স্বীয় সন্তুষ্টি দান করবেন।

کی محمّدؐ سے وفا تُو نے تو ہم تیرے ہیں
یہ جہاں چیز ہے کیا، لوح و قلم تیرے ہی

‘তুমি যদি আমার প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ -এর প্রতি কৃতজ্ঞ হও তাহলে আমি আল্লাহ তোমার হয়ে যাব। তখন এই জাহান, লৌহ-কলম সব কিছুই তোমারই হবে।

নবী করিম  -এর ভালবাসা দুনিয়া-আখেরাত উভয় জাহানের সফলতার চাবি কাঠি। এর দ্বারা মুষলধারে বৃষ্টির মত আল্লাহ পাকের রহমত বর্ষিত হতে থাকে। আর এটাই হচ্ছে সৌভাগ্যের নিশানা।

ہر کہ عشقِ مصطفیٰ سامانِ اوست
بحر و بر دَر گوشۂ دامانِ اوست

‘যে ব্যক্তি ইশকে রাসুলের গভীরে প্রবেশ করবে, জল-স্থলের সবি তার আঁচলে বাঁধা পড়ে যাবে।’

নবী করিম -এর সাথে সম্পর্ক স্থাপন হওয়া মানে প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ পাকের সাথেই সম্পর্ক স্থাপন হওয়া। পবিত্র কুরআনে ঘোষণা হচ্ছে,

إِنَّ الَّذِينَ يُبَايِعُونَكَ إِنَّمَا يُبَايِعُونَ اللَّهَ يَدُ اللَّهِ فَوْقَ أَيْدِيهِمْ

‘নিশ্চয় যারা আপনার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে তারা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর হাতেই বাইয়াত গ্রহণ করে। আল্লাহ পাকের হাত তাদের হাতের ওপরে রয়েছে।’

অতএব যে সকল সাহাবা নবী করিম -এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেছে তাদের বাইয়াত প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর হাতে বলেই গণ্য করা হয়েছে। কেননা, আল্লাহ পাক বলেছেন, তাদের হাতের ওপর আল্লাহর হাত রয়েছে।

একবার যুদ্ধের ময়দানে নবী করিম কাফের শত্রুদের লক্ষ করে মুঠোভরে কংকর নিক্ষেপ করেন। আর সেই নিক্ষেপ করাকে নিজের সাথে সম্পৃক্ত করে আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেন,

وَمَا رَمَيْتَ إِذْ رَمَيْتَ وَلَكِنَّ اللَّهَ رَمَى

‘আপনি যখন পাথর নিক্ষেপ করছিলেন, তা মূলত: আপনি নিক্ষেপ করছিলেন না বরং তা আমি আল্লাহ পাক নিক্ষেপ করছিলাম।’
এসকল উদাহরণ থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, যখন নবী করিম  -এর কাজকে মহান আল্লাহ পাক নিজের কাজ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। সুতরাং তাঁকে ভালবাসাও প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ পাককে ভালবাসা বলে বিবেচিত হবে। অথবা এভাবে বলা যায় যে, নবীজির সাথে সম্পর্ক হওয়া মানেই প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ পাকের সাথে সম্পর্ক স্থাপন হওয়া। পক্ষান্তরে নবীজির  সাথে যার ভালবাসা ও সম্পর্ক থাকবে না আল্লাহ পাকের সাথেও তার ভালবাসা ও সম্পর্ক থাকবে না।

نسبت مصطفیٰ بھی عجب چیز ہے جس کو نسبت نہیں اس کی عزت نہیں

خود خدا نے یہ فرمادیا جو تمہارا نہیں وہ ہمارا نہیں

‘হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা -এর সাথে স্থাপন এক আজব ব্যাপার বটে! তার সাথে যার সম্পর্ক নেই তার সম্মানও নেই। স্বয়ং আল্লাহই তার প্রিয় রাসূল -কে বলে দিয়েছেন, যে তোমার নয়, সে আমারও নয়।’

ইশকে রাসুল -এর গুরুত্ব নিচের দলিল-প্রমাণ দ্বারা আরও সুদৃঢ়ভাবে সাব্যস্ত হয়।

পবিত্র কোরআন থেকে দলিল

১- আল্লাহ পাক বলেন,

النَّبِيُّ أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنفُسِهِمْ

‘নবী মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা অধিক ঘনিষ্ঠ।’

উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় আনোয়ারুল বারী নামক কিতাবে (৩/১১৫পৃষ্ঠায়) উল্লেখ আছে, নবী করিম মুমিনদের জন্য তাদের প্রাণের চেয়েও আপন। সেটি রুহানী তথা আত্মিক দিকে দিয়ে। এক কেরাআতে রয়েছে, وَهُوَ أبٌ لَهُمْ তিনি তাদের পিতা। তো দৈহিক বা রক্তের সম্পর্কের কারণে যদি একে অপরের সাথে ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে তাহলে আত্মিক বা হৃদ্যিক সম্পর্কের কারণে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠবে না কেন! হৃদ্যিক সম্পর্ক তো রক্তের সম্পর্কের চেয়ে আরও অনেক মজবুত ও সুদৃঢ় হয়। কেননা রক্তের সম্পর্কের কারণে যদি ভালোবাসা তৈরি হয় তাহলে আত্মিক সম্পর্কে কারণে সৃষ্টি হয় ‘ইশক’। আর  রক্তের সম্পর্কের কারণে যা ইশকে মাজাজি (পার্থিব/রূপক ভালবাসা) হয় আত্মিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তা পৌঁছে যায় ইশকে হাকিকির পর্যায়ে।
কবি শিফতা বলেন,

شاید اسی کا نام محبت ہے شیفتہؔ

اک آگ سی ہے سینے کے اندر لگی ہوئی

‘শিফতা! হয়তো এরই নাম হবে মহব্বত;  যা হৃদয়ে এক প্রজ্বলিত আগুন হয়ে বিরাজ করে।’

এছাড়া النَّبِيُّ أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنفُسِهِمْ -এর আরও বিস্তারিত তাফসির ও ব্যাখ্যা জানতে হলে, ইলমে নবুওয়াতের সবুজ-শ্যামল প্রাণবন্ত ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকা মনোরম উপত্যকা থেকে হৃদয় মনকে প্রফুল্ল ও স্নিগ্ধ করতে হলে হজ্জাতুল ইসলাম কাসেম নানুতবী রহ. কর্তৃক লিখিত কিতাব ‘আবে হায়াত’ পাঠ করা দরকার। এছাড়া আল্লামা বদরুদ্দিন আইনী রহ.-ও এ বিষয়ে চমৎকার আলোচনা করেছেন। (উমদাতুল কারী ১/১৬৯)

২- আল্লাহ পাক বলেন,

قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ

‘হে নবী! বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহ ও তোমাদিগকে ভালবাসেন এবং তোমাদিগকে তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন।’

আরায়েসুল বয়ানে উল্লেখ আছে, قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللّهُ অর্থাৎ এ সকল লোককে বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাসার দাবী করে থাকো এবং তোমাদের দাবী যদি সত্য ও নিখুঁত হয় তাহলে তার প্রমাণ স্বরূপ আমার আনুগত্য ও অনুকরণ কর। আমি হলাম প্রেমিককূলের সম্রাট, সত্যবাদীদর মাথার মুকুট, রাসুলদের নেতা, সত্যান্বেষীদের ইমাম। তাই তোমাদের দেখিয়ে দিব, এই পথে চলাার ক্ষেত্রে কী কী জিনিস প্রতিবন্ধক ও ক্ষতির কারণ আর কোন কোন জিনিস উপকারী ও সহায়ক। যেগুলো তোমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে, আমি সেগুলো দেখিয়ে দিব। এছাড়া সাধণা ও নৈকট্য লাভের গোপন রহস্য বাতলে দিব। ভাল কাজ ও উত্তম জীবন যাপনের পন্থা বলে দিব। ভদ্র-রুচিশীল ও মার্জিতভাবে চলার সুন্দর উপায় শিখিয়ে দিব। সেই সাথে উত্তম চরিত্র গঠনের কৌশল হাতে কলমে শিক্ষা দিব। যেগুলো তোমাদের জীবন চলার পথে কাজে দিবে। কেননা, আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে এসব কিছু আমার কাছে উদঘাটন করে দেয়া হয়েছে। আর তার নৈকট্যের নূর দ্বারা আমাকে পূর্ণ করা হয়েছে। আমার অনুসরণ তাই মূলত প্রিয়তম মালিকের ভালবাসার প্রতি কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ। যেহেতু তোমরা যদি আমার আনুগত্য কর আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় কর তাহলে আল্লাহ পাক তোমাদের মহব্বত ও মা’রেফাত আরও বহুগুণে বাড়িয়ে দিবেন। আল্লাহ পাক বলেছেন, তোমরা আমার আনুগত্য কর, আল্লাহ পাক তোমাদের ভালবাসবেন। অন্যত্র বলেছেন, আর যদি তার শুকরিয়া আদায় কর তাহলে তোমাদের নেয়ামত বৃদ্ধি করে দিব।

আল্লাহপ্রেমিকদের ভাষায় মহব্বতের হাকিকত(প্রেমের রহস্য) হচ্ছে, হৃদয় ভালবাসার আগুনে দগ্ধ হয়ে কাবাব হয়ে যাবে। আত্মা ইশকের স্বাদে পানিহীন (শুকনায় ছেড়ে দেয়া) মাছের মত ছটফট করবে। অনুভুতি প্রেম-অর্নবে ডুবে যাবে এবং অন্তরকে পবিত্র পানি দ্বারা বিশুদ্ধ করে এক মনে এক ধ্যানে শুধু তার প্রেমাস্পদকেই অপলক নয়নে দেখতে খাকবে। অন্য সব কিছু থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখবে। গোপন রহস্যের আকাশে ভ্রমণ করবে। সর্বোপরি প্রেমাস্পদের যাবতীয় আদত-অভ্যাস, স্বভাব-চরিত্র, চাল-চলন নিজের মাঝে ধারণ করবে। এটাই হচ্ছে প্রকৃত প্রেম।

আর ইত্তেবা বা আনুগত্য বলতে স্বেচ্ছায় অনুসরণ করাকে বুঝায়। যেখানে কোনো জোরজবরদস্তি থাকে না। যেখানে সানন্দে আদেশ পালিত হয়। কোনো লোভ-লাভ এখানে কাজ করে না। এখানে থাকে শুধু একটাই; তাহল, তাবে’ তথা অনুসরণকারী মাতবু’ তথা অনসৃত ব্যক্তির অনুসরণ নিখুঁতভাবে করা। আর এটা কেবল তখনই সম্ভব হয়, যখন অনসৃত ব্যক্তির প্রতি থাকে একদম স্বচ্ছ, নিরেট, নির্ভেজাল ও সার্থহীন ভালোবাসা।

ইমাম রাগেব ইস্পাহানি ‘ইত্তেবা’ শব্দের অর্থ করতে গিয়ে বলেছেন, এটি হচ্ছে দুধের বাছুর তার মা-গাভীকে অনুসরণ করার মত। অর্থাৎ মা-গাভীর পিছে পিছে তার বাছুরের চলাকে ‘তাবিআ’ বলে। যেখানে বাছুর সানন্দে তা করে মায়ের প্রতি অনুরক্ত ও প্রীত হয়ে। এর দ্বারা বোঝা যায়, সানন্দে ও ভালোবাসার টানে আনুগত্য করার নামই ইত্তেবা।
চাকর বা কর্মচারী তার চাকুরী রক্ষার্থে মালিকের যে আদেশ পালন করে বা তার আনুগত্য করে সেটাকে ইত্তেবা বলা যাবে না। বরং সভ্য ভদ্র ছাত্ররা বিনা স্বার্থে সানন্দে স্বত:স্কুর্তভাবে স্বেচ্ছায় উস্তাদগণের যে কাজ করে দেয় সেটাকে বলা হবে ইত্তেবা।
আল্লাহ পাকের প্রিয়পাত্র হওয়ার জন্য আমাদেরকে তার রাসুলের এমন আনুগত্য করার জন্যই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইশকে ইলাহী অর্জনের জন্য ইশকে রাসুল একটা সেরা মাধ্যম। কবি বলেন,

عجب چیز ہے عشق شاہ مدینہ

یہی تو ہے عشق حقیقی کا زینہ

ہے معمور اس عشق سے جس کا سینہ

اسی کا ہے مرنا اسی کا ہے جینا

‘মদিনার বাদশাহর ইশক এক আজব জিনিস। প্রকৃত ইশকের এটিই শোভা। যার হৃদয় এই ইশক দ্বারা নির্মিত, তার বেঁচে থাকা মরে যাওয়া সবই স্বার্থক।’

৩- আল্লাহ পাক বলেন,

قُلْ إِن كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَآؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُم مِّنَ اللّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُواْ حَتَّى يَأْتِيَ اللّهُ بِأَمْرِهِ وَاللّهُ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ

‘হে রাসুল! আপনি বলে দিন, তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই তোমাদের পত্নী, তোমাদের গোত্র তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান-যাকে তোমরা পছন্দ কর-আল্লাহ, তাঁর রসূল ও তাঁর রাহে জেহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা কর, আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত, আর আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়েত করেন না।’

দীন ইসলাম যেহেতু সহজাত ধর্ম। তাই মানুষের বাহ্যিক প্রয়োজন ও মানবিক চাহিদার প্রতি গভীর খেয়াল রাখে। যার কারণেই আল্লাহ পাক এই নির্দেশ প্রদান করেন নি যে, সকল আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করে দাও। পাড়া-প্রতিবেশী বন্ধু-বান্ধব ও সমাজ থেকে বিছিন্ন হয়ে যাও। ঘর-সংসার ত্যাগ করে বৈরাগী হয়ে যাও। বরং দীন ইসলাম ভারসাম্যপূর্ণ মধ্যপন্থার জীবন যাপন পদ্ধতির শিক্ষা দিয়েছে। বলেছে, ঘর সংসার ত্যাগ করে বন-জঙ্গল আর গিরি-গুহার পথ আল্লাহর দিকে নিয়ে যাবে না। বরং সোজাভাবে লোকসমাজ আর বাজারের পথে যেয়ে আল্লাহর কাছে যেতে হবে। দুনিয়ার সম্পদ, সাজগোছের মধ্যে ডুবে যাওয়া এবং আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের সম্পর্কেও মাঝে হারিয়ে বিলীন হয়ে যাওয়া থেকেও মানবজীবনের লক্ষ-উদেশ্য অনেক ঊর্ধের। তাই এসব জিনিসকে ভালবাসা নিষেধ নয়। তবে এসবের মোহে এগুলোর মাঝে ডুবে যাওয়া নিষেধ। সুতরাং এগুলো যেন আল্লাহ ও তাঁর রাসুল -এর প্রতি ভালবাসার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে যেয়ে শহিদ হওয়ার তামান্না লালনের ক্ষেত্রে  বাধা সৃষ্টি করতে না পারে। যদি এমন হয় তাহলে এগুলোকে ভালবাসা নিষেধ নয়। আর যদি কখনও এমন অবস্থা তৈরি হয় যে এসব বস্তু তোমাদেরকে আল্লাহর পথে বের হতে বাধা দেয় তাহলে এগুলোকে পদদলিত করে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। অতএব এই আয়াত থেকে পরিস্কার বোঝা গেল যে, আল্লাহর রাসুলের প্রতি ভালবাসা অন্য সবকিছু থেকে অধিকতর হতে হবে।

کچھ نہیں مانگتا شاہوں سے یہ شیدا تیرا
اس کی دولت ہے فقط نقشِ کفِ پا تیرا

দুনিয়ার বাদশাহদের কাছে আমি কিছুই চাই না। আমার সম্পদ তো একটাই—আপনার হাতের ইশারায় চলা।

হাদিসের আলোকে দলিল
১- হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী করিম বলেছেন,

ثَلَاثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ ، وَجَدَ حَلَاوَةَ الْإِيمَانِ ؛ أَنْ يَكُونَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ ، أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا ، وَأَنْ يُحِبَّ الْمَرْءَ لَا يُحِبُّهُ إِلَّا لِلَّهِ ، وَأَنْ يَكْرَهَ أَنْ يَعُودَ فِي الْكُفْرِ كَمَا يَكْرَهُ أَنْ يُقْذَفَ فِي النَّارِ

তিনটি গুণ যার মধ্যে বিদ্যমান থাকবে, সে ঈমানের প্রকৃত স্বাদ অনুভব করতে সক্ষম হবে।
(১) যার মধ্যে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের ভালবাসা অন্যান্য সকল বস্তু হতে অধিক পরিমাণে থাকবে।
(২) যে ব্যক্তি কোন মানুষকে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য ভালবাসে।
(৩) যে ব্যক্তি ঈমান গ্রহণের পর কুফরীতে ফিরে যাওয়াকে তেমনই অপছন্দ করে, যেমন অপছন্দ করে অগ্নিতে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে।
আনওয়ারুল বারী নামক কিতাবে রয়েছে, ঈমানের মিষ্টতা দ্বারা উদ্দেশ্য হল, আল্লাহর ইবাদতে স্বাদ অনুভূত হবে আর আল্লাহ ও তার রাসুল -এর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যে কোনো ধরনের কষ্ট সহ্য করতে পারবে। হাদিস শরিফে তিনটি জিনিসের আলোচনা এসেছে। কিন্তু এখানে উদ্দেশ্য প্রথমটির ব্যাখ্যা পেশ করা। আর সেটি হল, আল্লাহ ও তার রাসুল -কে অন্য সমস্ত কিছু থেকে বেশি ভালবাসা। আল্লাহকে ভালবাসার প্রথম কারণ, তিনি আমাদের সৃষ্টিকর্তা-প্রতিপালনকারী, সকল প্রকার নেয়ামতদাতা। তার দয়া ও কৃপাতেই সকল নেয়ামত পেয়ে থাকি। নবী করিম ﷺ-কে ভালবাসতে হবে এ কারণে যে, সমুদয় অত্মিক নেয়ামত এবং ইলম লাভের তিনিই একমাত্র মাধ্যম।
‘ঈমানের মিষ্টতা’ সম্পর্কে মুহাদ্দিস আরেফ বিন আবু জামরাহ রহ. লিখেছেন, ফেকাহবিদদের মত অনুসারে ‘হালাওয়াতে ঈমান’ তথা ঈমানের মিষ্টতা দ্বারা উদ্দেশ্য হল, বিশ্বাসের দিক থেকে দৃঢ় থাকা এবং আল্লাহর যাবতীয় বিধান পরিপালনে পরিপূর্ণ অনুগত থাকা।
সুফী-সাধকগণ এটাকে ‘অনুভূত বস্তু’ বলে সাব্যস্ত করেছেন। আমার নিকট এই মতটাই বেশি যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য। (বাহ্জাতুন নুফুস ১/২৫)।

সাহাবায়েকেরাম ও সলফে সালেহীনের নিম্নোক্ত ঘটনা দ্বারা সুফি-সাধকদের দাবী আরও শক্তিশালী হয়।

  • হযরত বেলাল রাযি.-এর উপর এমন লোমহর্ষক অবর্ণনীয় নিষ্ঠুর নির্যাতনের পরও ‘আহাদ-আহাদ’ বলতে থাকা এবং তাঁর মৃত্যুকালে ঘরের লোকজন বলে ওঠেছিল,  واكرُبَاهُ ؟ ‘আহ, কী কষ্ট!’ এটা শুনে তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেছিলেন, بل واطرباه! غداً نلقى الأحبة محمداً وحزبه ‘না, বরং কত আনন্দ! কেননা আগামীতে প্রিয়তম মুহাম্মদ ও তাঁর সাহাবায়েকেরামের সঙ্গে মিলিত হব।’ এটাই হচ্ছে, ঈমানের স্বাদ।
  •  জনৈক সাহাবী চোরকে তার ঘোড়া নিয়ে যেতে দেখেও নামাজ ছেড়ে দেন নি। কেননা, ঘোড়ার চেয়ে নামাজই তার কাছে বেশি মূল্যবান মনে হয়েছিল।
  • জনৈক পাহারাদার মুজাহিদ সাহাবী একের পর এক শত্রু পক্ষের তীরের আঘাত খেতে থাকার পরও সুরা কাহাফ শেষ না করে নামাজের সালাম ফেরান নি।
  • হযরত ইবরাহিম ইবন আদহাম রহ. বলেন, আল্লাহ পাকের ইবাদত-বন্দেগী আর জিকির-আজকারের মাঝে আমি যে মজা আর স্বাদ পাই তা যদি দুনিয়ার কোনো সম্রাট জানতে বা বুঝতে পারতেন তাহলে তিনি তার সকল বাহিনী নিয়ে আমার ওপর আক্রমন করে তা ছিনিয়ে নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাতেন।
  • হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহ. বলেন, আল্লাহওয়ালাদের রাত জেগে ইবাদত করা নবদম্পতির বাসর রাতের আনন্দ উপভোগের চেয়ে বেশি মজাদার ও সুখময়। কারও যদি এমন সুখময় মজাদার ইবাদত করার সুযোগ না হয়, অর্থাৎ ইবাদতের এমন স্বাদ উপভোগ করতে না পারে তাহলে সে যেন আপাতত এটা অস্বীকার করা থেকে বিরত থাকে এবং সেই সব সৌভাগ্যবানের কথা মেনে নেয়।
    কবির ভাষায়,

وإذا لَم تَرَ الهلالَ فَسَلِّمْ * لأنَاسٍ رَأوهُ بالأبْصَارِ

‘তুমি যদি স্বচক্ষে আকাশে চাঁদ দেখতে না পাও তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের কথা মেনে নাও।’

অতএব, অতি পরিস্কারভাবে প্রমাণিত হয়ে গেল, অন্তরে নবী করিম ﷺ-এর প্রতি ইশক-মহব্বত সৃষ্টি হওয়া ‘ঈমানের মিষ্টতা অনুভব’ নসীব হওয়ার বড় আলামত।

২- হযরত আনাস রাযি. বর্ণনা করেছেন, নবী করিম বলেন,

لا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكونَ أحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِه وَالنَّاسِ أَجْمَعينَ

তোমাদের মধ্যে থেকে কোনো ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত আমি নবী তার কাছে তার পিতা-মাতা, ছেলে-মেয়ে ও সমস্ত মানুষ থেকে অধিক প্রিয় না হব।

স্বীয় পিতা-মাতা, সন্তানাদি ও আত্মীয়-স্বজনের প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি হওয়া মানুষের সহজাত ও স্বাভাবিক। সেই ভালবাসার শেকলে বন্দি হয়ে মানুষ নানা প্রকার দুঃখ কষ্ট সহ্য করে। এমন কি অনেক সময় পাপের পথও বেছে নিয়ে জাহান্নাম খরিদ করে থাকে।
উল্লেখিত হাদিস শরিফে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বাতলে দেয়া হয়েছে, মুমিনদের নবী করিম -এর সাথে সবচে’ বেশি ভালবাসা থাকতে হবে। অন্তরে যখন ইশকে রাসুল প্রাধান্য লাভ করবে, মানুষ তখন রক্তের বন্ধন আর আতত্মীয়তার সম্পর্কের কারণে শরিয়ত পরিপন্থী কোনো কাজ করতে পারবেনা।وَالنَّاسِ أَجْمَعينَ  শব্দ বলে এর গন্ডি ও পরিধি ব্যাপক বিস্তৃত করে দেয়া হয়েছে। অতএব সমস্ত মাখলুকের চেয়ে নবী করিম ওপর বেশি ভালবাসা থাকতে হবে। আর এটিকে ঈমানের শর্ত হিসেবে জুড়ে দেয়া হয়েছে। যদ্দরুন এর গুরুত্ব আরও বহুদুর বুদ্ধি পেয়েছে।
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে। একবার নবী করিম আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন যে, হে আল্লাহ! আমাকে অতি দ্রুত আমার বন্ধুদের সাথে মিলিত করুন। এমন কথা শুনে হযরত সওবান রাযি. বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনাকে ভালবাসে এমন বন্ধু তো আমরাই এবং আমরা এখানে উপস্থিতও আছি, তবে আপনি কাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য দোয়া করছেন? নবী করিম বললেন, হে সাওবান! তোমরা আমাকে স্বচক্ষে দেখেছ, আমার ওপর ওহী নাজেল হতে দেখেছ, ফেরেশতাদের অবতরণ করতে দেখেছ, সর্বদা আমার সংশ্রবে থাকার সৌভাগ্য অর্জন করেছ তাই তোমাদের ঈমান অনেক মূল্যবান। কিন্তু এরপরও কিয়ামতের পূর্বে এমন কিছু লোকের আগমন ঘটবে, যারা আমাকে দেখবে না। শুধু কিতাবে আমার আলোচনা পড়বে। কিন্তু এতটুকুতেই আমার প্রতি তাদের এমন আন্তরিক ভালবাসা জন্মিবে। যদি সম্ভব হত, তাহলে তাদের সন্তানদেরকে বিক্রি করে হলেও আমার দিদারে ছুটে আসত। হে সাওবান! আমি আমার সেই সব পাগল বন্ধুদের সাথে মিলিত হবার জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করছি।

৩- হযরত ওমর রাযি. একবার নবী করিম -এর দরবারে উপস্থিত হয়ে আরজ করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার ঈমান কি পূর্ণাঙ্গ? কেননা, لَأَنْتَ أحَبُّ إلَيَّ مِن كُلِّ شيءٍ إلَّا مِن نَفْسِي আপনি আমার কাছে সব কিছুর থেকে প্রিয় হলেও আমার প্রাণ থেকে যে প্রিয় নন?

নবী করিম বললেন, لَا، والذي نَفْسِي بيَدِهِ، حتَّى أكُونَ أحَبَّ إلَيْكَ مِن نَفْسِكَ না, ওই সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, যতক্ষণ তোমার কাছে আমি তোমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় হতে না পারব ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি পরিপূর্ণ মুমিন হতে পারবে না।

এই কথা শুনে হযরত ওমর রাযি. প্রচন্ডভাবে কেঁপে ওঠেন। এরপর বলেন, فَإِنَّهُ الآنَ، وَاللَّهِ، لَأَنْتَ أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ نَفْسِي হ্যাঁ, ইয়া রাসুলাল্লাহ! এখন আল্লাহর কসম! এখন আপনি আমার কাছে আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয়। জবাবে নবী করিম বললেন, الآنَ يَا عُمَرُ হ্যাঁ, হে ওমর! এখন তোমার ঈমান পূর্ণতা পেয়েছে।

এখানে একটি সূক্ষ্ম বিষয় প্রনিধানযোগ্য। তাহল এই যে, প্রথমে হযরত ওমর রাযি.-এর ধারণা ছিল এই যে, মানুষ সাধারণত নিজের ব্যথায় যে পরিমাণ ব্যথিত হয়, অন্যের ব্যথায় সে পরিমাণে ব্যথিত হয় না। কিন্তু যখন নবীজী বললেন, ‘যতক্ষণ তোমার কাছে আমি তোমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় হতে না পারব…’তখন  ওমর রাযি. চিন্তা করে দেখলেন আর তখনই তাঁর এই কথা বুঝে এসে গিয়েছিল যে, আল্লাহ না করুন, যদি কোনো দুশমন নবীজীর উপর আক্রমন করে বসে তখন তো আমি নবীজী -কে বাঁচানোর জন্য প্রাণ দেয়ার জন্যও প্রস্তুত হয়ে যাব। তাই দ্বীতিয় বারে তিনি চকিত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলে দিলেন যে, আলহামদুলিল্লাহ,হ্যাঁ, ইয়া রাসুলাল্লাহ! এখন আল্লাহর কসম! এখন আপনি আমার কাছে আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয়।

محمد کی محبت دین حق کی شرط اول ہے
اسی میں ہو اگر خامی تو سب کچھ نامکمل ہے

মুহাম্মদ -এর প্রতি ভালোবাসা এই দীনের প্রধান শর্ত। যদি এতে ত্রুটি থাকে তাহলে সবকিছুই অপরিপূর্ণ।

৪- এক গ্রাম্য সাহাবী নবী করিম -এর দরবারে এসে জিজ্ঞেস করলেন, مَتَى تكون االسَّاعَةُ؟ কেয়ামত কবে হবে?
নবীজী তাকে উত্তর দিলেন, مَاذا أَعْدَدْتَ لَهَا؟ তুমি এর জন্য কী প্রস্তুতি নিয়েছো?
গ্রাম্য লোকটি উত্তর দিলেন, কিয়ামতের জন্য আমার দীর্ঘ কোনো প্রস্তুতি নেই। অনেক নামাজ কিংবা অনেক রোজা আমার নেই। অর্থাৎ আমি শুধু ফরজ নামাজগুলো আদায় করি এবং ফরজ রোজাগুলো রাখি। তবে আমার একটি আমল আছে। আর তা হল,إِلَّا أَنِّي أُحِبُّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ আমি আল্লাহ এবং তার রাসুলকে ভালবাসি।
এটা শুনে নবীজি বললেন, المَرْءُ مَعَ مَنْ أَحَبَّ মানুষ তার সঙ্গেই থাকবে যার সঙ্গে তার ভালোবাসা আছে।

সাহাবায়েকেরাম বলতেন, ঈমানের পর আমরা এত আনন্দ অন্য কোন হাদিস থেকে পাই নি, যে পরিমাণ আনন্দ পেয়েছি উক্ত হাদিস শুনে। আশেকদের জন্য এটা সত্যিই এক আনন্দ-সন্দেশ।
বর্ণিত আছে যে, নবী করিম -এর একজন একনিষ্ঠ আশিক হযরত সাওবান রাযি.। তিনি একদিন ফ্যাকাশে চেহারা নিয়ে নবীজির দরবারে আসলেন। নবী করিম তার এই অবস্থা দেখে ‘কারণ’ জিজ্ঞেস করলেন। ব্যাকুল-প্রেমিক সাওবান রাযি. দিলেন, হে আল্লাহর রাসূল! শারীরিকভাবে আমার কোনো কষ্ট নেই, দুনিয়াবী কোনো পেরেশানিও নেই। আসল বিষয় হল, যখন আপনার চেহারা দেখতে না পাই তখন অন্তর ব্যাকুল হয়ে ওঠে আর আপনার দিদারের জন্য আপনার কাছে হাজির হয়ে যাই। এখন বারবার মনে মনে একটি কথা পীড়া দিচ্ছে যে, জান্নাতে তো আপনার মাকাম হবে সবচাইতে উঁচুতে। আর এই ‘মিসকিন’ পড়ে থাকবে কোনো নিচুস্তরের জান্নাতে। যদি সেখানে আপনার সাক্ষাৎ ভাগ্যে না জুটে তাহলে জান্নাতে কোনো মজাই তো পাওয়া যাবে না।
নবীজি তার এই বৃত্তান্ত শুনে চুপ হয়ে গেলেন। ইত্যবসরে জিব্রাইল আ. এই সুসংবাদ নিয়ে আসলেন যে, অনুসরণকারী প্রেমিকদের জন্য জান্নাতে নবী-বিরহের কোন ব্যথা থাকবে না।

وَمَن يُطِعِ اللّهَ وَالرَّسُولَ فَأُوْلَـئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللّهُ عَلَيْهِم مِّنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاء وَالصَّالِحِينَ وَحَسُنَ أُولَـئِكَ رَفِيقًا

আর যে কেউ আল্লাহর হুকুম এবং তাঁর রসূলের হুকুম মান্য করবে, তাহলে যাঁদের প্রতি আল্লাহ নেয়ামত দান করেছেন, সে তাঁদের সঙ্গী হবে। তাঁরা হলেন নবী, ছিদ্দীক, শহীদ ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিবর্গ। আর তাদের সান্নিধ্যই হল উত্তম।

এ থেকে বোঝা গেল, নবীজী -এর প্রতি যার অন্তরে সাচ্চা ভালোবাসা থাকবে, কিয়ামতের দিন তার জায়গা নবীজির কদম মোবারকের পাশে থাকবে।

যৌক্তিক প্রমাণ
এ পর্যায়ে নিম্মে নবী করিম -এর প্রতি ভালোবাসা সম্পর্কিত যৌক্তিক দলিল পেশ করা হচ্ছে।
নবীজি বলেছেন, أوَّلُ ما خلق الله نوري‘ আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন।’ বিষয়টি হযরত কাসেম নানুতুবী রহ নিজস্ব ভঙ্গিতে চমৎকার করে পেশ করেছেন এভাবে,

سب سے پہلے مشیت کے انوار سے
نقش روئے محمد بنایا گیا
پھر اسی نقش سے مانگ کر روشنی
بزم کون ومکاں سجایا گیا

‘সর্বপ্রথম আল্লাহ তাআলার ইচ্ছার নূর দ্বারা মুহাম্মদ এর চেহারার নকশা বানানো হয়েছে। তারপরও সে নকশা থেকে জলস্থলকে সাজিয়ে আলোকিত করা হয়েছে।’

সুতরাং যেন সারা বিশ্ব নবীজির অস্তিত্বের কাছে বন্ধকৃত বস্তুর মতো হয়ে গেল। আরবিতে একটি প্রবাদ আছে, كُلَّ شَيْءٍ يرجع إلى اصله ‘প্রতিটি বস্তু তার মূলের দিকেই প্রত্যাবর্তন করে৷’ এর সত্যতা বুখারী শরীফের একটি হাদিসেও পাওয়া যায় যে, নিঃসন্দেহে ঈমান মদীনার দিকে এমনভাবে ফিরে আসবে যেভাবে সাপ তার গর্তের দিকে ফিরে আসে।
এথেকে বুঝা গেল, বিশ্বের সবকিছু তার মূলের দিকে ফিরে যাওয়ার আকর্ষণ লাভ করে। যেমন বলা হয়েছে, প্রতিটি শিশু ইসলামপ্রকৃতির উপর সৃষ্টি হয়। এ কারণেই শরীয়তের কোনো বিষয়ে জানা না থাকলে মানুষ নিজের অন্তরকে সাক্ষী বানানোর কথা বলা হয়েছে। কেননা অন্তর সঠিক ফতোয়া দিয়ে থাকে। তবে হ্যাঁ, যার অন্তর গুনাহ দ্বারা কলুষিত, অন্তরে যার জং ধরে গেছে, অন্তরের চক্ষুর উপর যার পর্দা পড়ে গেছে, সে সঠিক দিশা খুঁজে পায় না। পক্ষান্তরে যার বিবেক পরিশীলিত, অন্তর পরিশুদ্ধ তাহলে সেই সঠিক দিশা খুঁজে পায়। একে বলা হয় হেদায়েত। এ ধরনের মানুষ নবী করিম -এর প্রতি স্বভাবজাত এক অব্যক্ত ভালোবাসা অনুভব করে।

নবী কারীম -এর প্রতি ভালোবাসার স্বভাবজাত এই আকর্ষণ কেবল মানুষের মাঝেই নয় বরং জীবজন্তু উদ্ভিদ এমনকি জড়বস্তুর মাঝেও পাওয়া যায়। এ বিষয়ে কিছু প্রমাণ নিম্নে পেশ করা হল,

  • বিদায় হজের সময় যখন নবীজি উটগুলোকে নিজের পবিত্র হাত দ্বারা জবাই করছিলেন। তখন সাহাবায়েকেরাম এ দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন যে, উটগুলো কোরবানি হওয়ার জন্য একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছিল যে, কে কার আগে নিজের ঘাড় নবীজির সামনে পেশ করতে পারে !

آبروئے ایک تو زہ کرد کمانے بہ کمینے نے
یک صید نیا سود زمانے بہ زمینے

প্রতিটি শিকার নিশানার দিকে নিজেই দৌড়ে দৌড়ে যেত যে, প্রথমে আমাকে শিকার করুন।

আমির খসরু বলেন,

ہمہ آہوان صحرا سر خود نہادہ ہر کف
بہ امید آنکہ روزے بہ شکار خواہی آمد

বনের প্রতিটি হরিণ মাথা হাতে নিয়ে এই আশায় ঘুরতো যে, একদিন তিনি শিকার করার জন্য আসবেন আর আমরা নিজেকে তার সামনে পেশ করে দিব।

  • অনুরূপভাবে একটি উট নবীজির খেদমতে এসে নিজের দুঃখ পেরেশানি ব্যক্ত করা এবং কান্না করা ও জীবজন্তুর মাঝে নবীজির প্রতি ভালোবাসা বিদ্যমান এর জ্বলন্ত প্রমাণ।
  • اسطوانہ حنانہ তথা খেজুর গাছের গোড়া নবীজির বিরহে এই পরিমাণ কান্না করেছে যে, মসজিদে নববী গুঞ্জন করে উঠেছিল। এ দেখে সাহাবায়ে কেরাম আশ্চর্য হয়েছিলেন।
  • বিভিন্ন স্থানে গাছ গাছালি নবীজিকে সালাম করা তাদের মাঝে নবীজীর প্রতি ভালবাসা অস্তিত্বের সুস্পষ্ট প্রমাণ।
  • বুখারী ও মুসলিমের এক বর্ণনায় এসেছে নবী করিম একবার উহুদ পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, هَذَا جَبَلٌ يُحِبُّنَا وَنُحِبُّهُ এটি এমন পাহাড় যে আমাদেরকে ভালবাসে আমরা যাকে ভালোবাসি।

পাহাড়ের প্রতি নবীজির এই সম্মোধন প্রমাণ করে যে নবীজীর প্রতি ভালবাসা জড় বস্তুর মাঝেও ছিল। এসকল দৃষ্টান্ত নবীজির প্রতি ভালোবাসার ব্যাপকতা প্রমাণ বহন করে।

(চলবে)