গোপন গুনাহর চিকিৎসা (পর্ব-০৩)

গোপন গুনাহর চিকিৎসা

ব্যভিচারের অন্যতম কারণসমূহ

সম্মানিত দীনি ভাই ও বোনেরা, ব্যভিচার সাধারণত তিনটি কারণে হয়। আমরা এখন সেই কারণগুলো জানব এবং পাশাপাশি সেগুলোর প্রতিকার ও চিকিৎসা হিসেবে আমাদের মাশায়েখগণ যা বলেছেন, তা সম্পর্কেও কিছুটা শুনব। যাতে করে আমল করতে পারি। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফিক দান করুন। আমীন।

এক. কুদৃষ্টি এবং পর্দাহীনতা

ব্যভিচারের অন্যতম কারণ পুরুষদের কুদৃষ্টি এবং নারীদের পর্দাহীনতা। আল্লাহ পুরুষদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন তারা যেন দৃষ্টির হেফাজত করে। আর নারীদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন তারা যেন পর্দার সঙ্গে চলে। ‘পর্দা’ মানে নিজেকে লুকিয়ে রাখা। রাসুলুল্লাহ বলেছেন, المرأة عوْرةٌ নারী গোপন জিনিস। (তাবরানী ৩০৩৬) কোনো কোনো মুহাদ্দিস এর ব্যাখ্যায় বলেন, أي وجه المرأة عورة অর্থাৎ, নারীদের চেহারা গোপন জিনিস।

আমাদের এজাতীয় মিথ্যা দাবী

আপনি বলতে পারেন, অমুক ব্যক্তি পরনারীর সঙ্গে কথা বললে কী হবে, তার মন ভাল। আমার মেয়ে বেপর্দায় চললে কী হবে, তার মন পবিত্র। গুনাহর চিন্তা তাদের মাথায় আসে না। অথচ কোরআন ও হাদিস সামনে আনলে বুঝা যায়, আমাদের এজাতীয় দাবী মিথ্যা। কেননা, কোরআন মজিদে আল্লাহ তাআলা বলেন,

فَأَلْهَمَهَا فُجُورَهَا وَتَقْوَاهَا

অতঃপর তাকে তার অসৎকর্ম ও সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন। (সূরা শামস 8)

এ আয়াতের তাফসিরে মুফাসসিরে কেরাম লিখেন, যেহেতু মানুষকে অসৎকর্ম ও সৎকর্মের জ্ঞান দান করা হয়েছে, সেহেতু মানুষ নেক পরিবেশে নেক আমলের প্রতি আকৃষ্ট হয়। গুনাহর পরিবেশে গুনাহর প্রতি আগ্রহবোধ করে। আর কুদৃষ্টি ও পর্দাহীনতা ধীরে ধীরে দুর্ঘটনার পরিবেশ তৈরি করে। মানুষকে ধীরে ধীরে ব্যভিচারের কাছে নিয়ে যায়। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেছেন, وَلاَ تَقْرَبُواْ الزِّنَى إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاء سَبِيلاً তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ। (সূরা বনী ইসরাইল ৩২)

এজন্যই রাসুলুল্লাহ পুরুষদের কুদৃষ্টি সম্পর্কে বলেছেন, اَلنَّظْرَةُ سَهْمٌ مَسْمُوْمٌ مِنْ سِهَامِ اِبْلِيْسَ কুদৃষ্টি ইবলিসের বিষমিশ্রিত তীর। (মুসনাদুশ শিহাব ২৭৯)

আর পর্দাহীন-নারী সম্পর্কে বলেছেন, فَاِذَا خَرَجَتْ اِسْتَشْرَفَهَا الشَّيْطَانُ এরা যখন বের হয় শয়তান চুপিসারে এদেরকে দেখে। (তাবরানী ৩০৩৬)  যাতে পরপুরুষকে এদের মায়াজালে বন্দি করে নিতে পারে।

কুদৃষ্টি এবং পর্দাহীনতার চিকিৎসা

চিকিৎসা অনেক। আমাদের মাশায়েখগণ খুলে খুলে বলেছেন। তন্মধ্য থেকে আজ আপাতত তিনটি চিকিৎসার কথা বলছি। আল্লাহ বক্তা-শ্রোতা সকলকে আমল করার তাওফিক দিন। আমীন। হিম্মত করুন। আমরা হিম্মত করলে আল্লাহর তাওফিক আমাদের সঙ্গী হবে। মনে রাখবেন, হিম্মত ছাড়া কোনো কাজ হয় না; দুনিয়ারও না, আখেরাতেরও না। হিম্মত করে চেষ্টা শুরু করলে কাজ হবে-এটা আল্লাহ তাআলার ওয়াদা। তিনি তো আমাদেরকে প্রতিশ্রিতি দিয়ে বলেছেন, وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করব। (সূরা আ’নকাবুত ৬৯)

১. দৃষ্টির হেফাজত করুন

দৃষ্টির হেফাজত করুন। এটি পবিত্র জীবন যাপনের জন্য কোরআনি-ব্যবস্থাপত্র। এই ব্যবস্থাপত্র কেবল পুরুষের জন্য এমনটি নয়। বরং পুরুষ-নারী উভয়ের জন্য এটি প্রযোজ্য। দেখুন, আল্লাহ তাআলা পুরুষদেরকে যেমনিভাবে বলেছেন,

قُل لِّلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ

মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাযত করে। অর্থাৎ, ব্যভিচার থেকে বেঁচে থাকে। (সূরা নূর ৩০)

এর পরের আয়াতেই তিনি অনুরূপ নির্দেশ নারিদেরকেও দিয়েছেন।

وَقُل لِّلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ

ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাযত করে। অর্থাৎ, ব্যভিচার থেকে বেঁচে থাকে। (সূরা নূর ৩১)

সুতরাং বুঝা গেল, ব্যভিচার থেকে নিজেকে রক্ষা করলে দৃষ্টির হেফাজত করতে হবে। এমন নয় যে, এটা কেবল পুরুষরা করবে; বরং নারীদের জন্য এই ব্যবস্থাপত্র সমভাবে প্রযোজ্য।

২. কয়েক মিনিট মোরাকাবা করুন

আমাদের শায়েখ মাহবুবুল ওলামা হযরত মাওলানা পীর যুলফিকার আহমদ নকশবন্দী মুজাদ্দেদী দা. বা. বলেন,  প্রত্যেক নামাযের পর দৈনিক অন্তত পাঁচ বার কিছু সময়ের জন্য- দুই থেকে পাঁচ মিনিটের জন্য আল্লাহর সান্নিধ্যের মুরাকাবা করুন। মুরাকাবা এভাবে করবেন- চোখ বন্ধ করবেন। তারপর ভাববেন, ‘আমি যেখানেই থাকি না আল্লাহ আমার সাথে আছেন।’ অথবা এই আয়াতের বিষয়বস্তু নিয়ে চিন্তা করবেন- هُوَ مَعَكُمْ اَيْنَمَا كُنْتُمْ ‘তোমরা যেখানেই তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন।’

এরপর নিজের নফসকে বুঝাবেন যে, দেখো, তুমি আল্লাহর দৃষ্টি থেকে কোনোভাবেই ভাগতে পারবে না। তুমি যখন পরনারীর প্রতি তাকাও তখনও তোমার প্রভু তোমাকে দেখেন। আর আপনি যদি নারী হন, তাহলে নফসকে বুঝাবেন যে, দেখো, তুমি আল্লাহর দৃষ্টি থেকে কোনোভাবেই পালাতে পারবে না। যখন তুমি পরপুরুষের সামনে যাও তখনও তোমার মালিক তোমাকে দেখেন। এটা তো তার মহান ধৈর্যের পরিচয় যে, তিনি তোমাকে পাকড়াও করেন না। কিন্তু তুমি যদি এভাবে চলতে থাক তবে তিনি কতকাল ধৈর্য ধরবেন! এভাবে নিয়মিত কিছুদিন করতে পারলে -ইনশা আল্লাহ- ধীরে ধীরে আল্লাহর সান্নিধ্যের সার্বক্ষণিক অনুভূতি অন্তরে বসে যাবে এবং এই রোগ থেকে বের হওয়া সহজ হয়ে যাবে।

৩. নিজেকে সাজা দিন

পুরুষ কুদৃষ্টি থেকে এবং নারী বেপর্দা থেকে বাঁচার জন্য আরেকটি চিকিৎসা হল, নিজেই নিজের জন্য সাজা নির্ধারণ করা যে, কুদৃষ্টি হয়ে গেলে আমি নিজেকে এই শাস্তি দিব এবং পরপুরুষের সামনে গেলে এই শাস্তি দিব। যেমন, নির্জনে গামছা বা ওড়না পেঁচিয়ে চাবুকের মত বানাবেন। তার তা দিয়ে নিজের পেটে বা পিঠে কয়েকটি আঘাত করুন। তারপর ভাবুন, যখন কেয়ামতের দিন ফেরেশতারা চাবুক মারবে তখন কী অবস্থা হবে? এ পদ্ধতিতে কয়েকদিনের মধ্যেই কুদৃষ্টির চিন্তা  এবং বেপর্দার  অভ্যাস খতম হয়ে যাবে-ইনশা আল্লাহ।

শাইখুল হাদিস জাকারিয়া রহ. তো কঠিন কথা বলেছেন। তিনি বলেন, যে পুরুষ পরনারীর প্রতি কুদৃষ্টি দানে অভ্যস্ত, যে নারী বেপর্দায় অভ্যস্ত তার ব্যাপারে আমাদের মাশায়েখগণের অভিজ্ঞতা হল, সে ঈমান নিয়ে মরতে পারে না।

আমাদের মাশায়েখগণ আরো বলেন, যে পুরুষ নিজেকে কুদৃষ্টি থেকে হেফাযত করতে চায়, যে নারী চায় যে, সে পর্দায় চলবে সে নিউইয়র্ক শহরেও তা পারবে। পক্ষান্তরে যে তা চায় না, সে হারাম শরীফের ভেতরেও তা পারে না। এজন্য যারা হজে গিয়েছেন, তারা দেখে থাকবেন, হারাম শরীফের মত পবিত্র স্থানেও কত নারী বেপর্দায় চলে এবং কত যুবক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদেরকে দেখে এবং সকলের সামনে মনে মনে গোপন গুনাহ করে!

(চলবে)

আরো পড়ুন–