জিলহজ্জের প্রথম দশদিন ইবাদতের মহান মৌসুম। আল্লাহ তাআলা বছরের অন্যসব দিনের উপর এ দিনগুলোকে মর্যাদা দিয়েছেন। এ দশক এতটাই ফযীলতপূর্ণ ও মহিমান্বিত যে, আল্লাহ তাআলা এ দশকের রাতগুলোর কসম করেছেন। ইরশাদ হয়েছে,
وَ الْفَجْرِ، وَ لَیَالٍ عَشْرٍ
শপথ ফযরের, শপথ দশ রাত্রির। (সূরা ফাজর ১-২)
হাদিস শরিফে এসেছে, ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত তিনি রাসুলুল্লাহ ﷺ থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন,
مَا مِنْ أَيَّامٍ الْعَمَلُ الصَّالِحُ فِيهَا أَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنْ هَذِهِ الْأَيَّامِ يَعْنِي أَيَّامَ الْعَشْرِ ، قالوا يا رسول الله: ولا الجهاد في سبيل الله؟ قال: وَلَا الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، إِلَّا رَجُلٌ خَرَجَ بِنَفْسِهِ وَمَالِهِ فَلَمْ يَرْجِعْ مِنْ ذَلِكَ بِشَيْءٍ
অন্য যে কোন সময়ের নেক আমলের চেয়ে আল্লাহর কাছে এ দিনগুলোর তথা দশদিনের নেক আমল অধিক প্রিয়। তারা (সাহাবীরা) বলেন, আল্লাহর পথে জিহাদও নয়!! তিনি বলেন, আল্লাহর পথে জিহাদও নয়; তবে কোনো লোক যদি তার জানমাল নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে এবং কোন কিছু নিয়ে ফেরত না আসে সেটা ভিন্ন কথা। (বুখারী ৯৬৯ আবু দাউদ ২৪৩৮)
ইমাম ইবন কাসীর রহ. বলেন,
فهذه النصوص وغيرها تدلّ على أنّ هذه العشر أفضل من سائر أيام السنة من غير استثناء شيء منها، حتى العشر الأواخر من رمضان. ولكنّ ليالي العشر الأواخر من رمضان أفضل من ليالي عشر ذي الحجة، لاشتمالها على ليلة القدر، التي هي خير من ألف شهر
এ সকল দলিল ও অন্যান্য দলিল প্রমাণ করে যে, এ দশটি দিন বছরের অন্য দিনগুলোর চেয়ে উত্তম; এমনকি রমযানের শেষ দশ দিবসের চেয়েও উত্তম। তবে, রমযানের শেষ দশরাত্রি যিলহজ্জের দশরাত্রির চেয়ে উত্তম; যেহেতু ঐ রাতগুলোতে লাইলাতুল ক্বদর আছে, যে রাতটি হাজার রাতের চেয়ে উত্তম। (তাফসীরে ইবনে কাছীর ৫/৪১২)
তাই একজন মুমিনের কর্তব্য হচ্ছে, খাঁটি তওবা করার মাধ্যমে এ দিনগুলো শুরু করা। এরপর এ দিনগুলোতে অধিক হারে সাধারণ সকল নেক কাজ করা এবং নিম্নোক্ত বিষয় ও আমলগুলোর ওপর গুরুত্ব দেয়া–
১. গুনাহ না করা
নেক আমল যতটুকু করতে পারি-না পারি; গুনাহের মাধ্যমে যেন এ সম্মানিত দিনগুলোর অসম্মান না করি। আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَلَا تَظْلِمُوْا فِیْهِنَّ اَنْفُسَكُمْ
(…তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত) …সুতরাং এ মাসসমূহে তোমরা নিজেদের প্রতি যুলুম করো না। (সূরা তাওবা ৩৬)
আল্লাহর নাফরমানী নিজের উপর সবচেয়ে বড় যুলুম। কারণ, এর ক্ষতি তো নিজের উপরই আপতিত হবে। সুতরাং গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা এ মাসের প্রথম কাজ, সাথে সাথে নেক আমলেও যত্নবান হওয়া দরকার।
এ কারণে ইবনু রজব হাম্বলী রহ. লাতাইফুল মাআরিফে জিলহজ্জের আলোচনায় বলেন,
احذروا المعاصي فإنها تحرم المغفرة في مواسم الرحمة
রহমতের মওসুমসমূহে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকো। কেননা তা ক্ষমা থেকে বঞ্চিত করে। (লাতায়েফুল মাআরেফ, পৃ. ৩৭৯)
২. এই দশটি দিনকে যিকির-তাসবীহ দ্বারা প্রানবন্ত রাখা
এমনিতে যিকির আল্লাহ তাআলার কাছে অনেক প্রিয় আমল। এ দশকের আমল হিসেবে বিশেষভাবে যিকিরের কথা এসেছে। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
مَا مِنْ أَيّامٍ أَعْظَمُ عِنْدَ اللهِ وَلَا أَحَبّ إِلَيْهِ الْعَمَلُ فِيهِنّ مِنْ هَذِهِ الْأَيّامِ الْعَشْرِ، فَأَكْثِرُوا فِيهِنّ مِنَ التّهْلِيلِ وَالتّكْبِيرِ وَالتّحْم
আল্লাহ তাআলার নিকট আশারায়ে জিলহজ্জ মাসের আমলের চেয়ে অধিক মহৎ এবং অধিক প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই। সুতরাং তোমরা এই দিনগুলোতে বেশি বেশি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার এবং আলহামদু লিল্লাহ পড়। (মুসনাদে আহমাদ ৫৪৪৬; আদদাআওয়াতুল কাবীর, তবারানী ৫৩৪)
৩. চুল, নখ, মোচ ইত্যাদি না কাটা
জিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবানীর আগ পর্যন্ত নিজের নখ, চুল, মোচ, নাভীর নিচের পশম ইত্যাদি না কাটা। এটা মুস্তাহাব আমল।
উম্মে সালামা রাযি. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
إذا رأيتم هلال ذي الحجة وأراد أحدكم أن يضحي فليمسك عن شعره وأظفاره
তোমরা যদি যিলহজ্ব মাসের চাঁদ দেখতে পাও আর তোমাদের কেউ কুরবানী করার ইচ্ছা করে তবে সে যেন স্বীয় চুল ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকে। (সহীহ মুসলিম ১৯৭৭; জামে তিরমিযী ১৫২৩)
যে ব্যক্তি কুরবানী করতে সক্ষম নয় সেও এ আমল পালন করবে। অর্থাৎ নিজের চুল, নখ, গোঁফ ইত্যাদি কাটবে না; বরং তা কুরবানীর দিন কাটবে।
আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা্যি. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
أمرت بيوم الأضحى جعله الله عيدا لهذه الأمة. قال له رجل :يا رسول الله! أرأيت إن لم أجد إلا منيحة أنثى أفأضحي بها؟ قال : لا، ولكن خذ من شعرك وأظفارك وتقص شاربك وتحلق عانتك، فذلك تمام أضحيتك
আমি কুরবানীর দিন সম্পর্কে আদিষ্ট হয়েছি (অর্থাৎ এ দিবসে কুরবানী করার আদেশ করা হয়েছে।) আল্লাহ তাআলা তা এ উম্মতের জন্য ঈদ হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। এক ব্যক্তি আরজ করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি আমার কাছে শুধু একটি মানীহা থাকে অর্থাৎ যা শুধু দুধপানের জন্য দেওয়া হয়েছে? আল্লাহর রাসূল ﷺ বললেন, না; বরং সেদিন তুমি তোমার চুল কাটবে (মুন্ডাবে বা ছোট করবে), নখ কাটবে, মোচ এবং নাভীর নিচের পশম পরিষ্কার করবে। এটাই আল্লাহর কাছে তোমার পূর্ণ কুরবানী বলে গণ্য হবে। (মুসনাদে আহমদ ৬৫৭৫)
অর্থাৎ যারা কুরবানী করতে সক্ষম নয় তারাও যেন মুসলমানদের সাথে ঈদের আনন্দ ও খুশি উদযাপনে অংশীদার হয়। তারা এগুলো কর্তন করেও পরিপূর্ণ সওয়াবের অধিকারী হবে। অনুরূপভাবে হাজীদের সাদৃশ্য অবলম্বনকারী হবে।
৪. ঈদুল আযহার দিন ছাড়া প্রথম নয় দিন রোযা রাখা
এই দশকের আরেকটি বিশেষ আমল হল, ঈদুল আযহার দিন ছাড়া প্রথম নয় দিন রোযা রাখা। হাদিস শরিফে এসেছে,
كَانَ رَسُولُ اللهِ ﷺ يَصُومُ تِسْعَ ذِي الْحِجّةِ.
নবী কারীম ﷺ এই নয়টি দিবসে (জিলহজ্জ মাসের প্রথম নয় দিন) রোযা রাখতেন। (আবু দাউদ ২৪৩৭ মুসনাদে আহমাদ ২২২৩৪)
৫. বিশেষভাবে নয় তারিখের রোযা রাখা
জিলহজ্জ মাসের প্রথম নয় দিনের মধ্যে নবম তারিখের রোযা সর্বাধিক ফযীলতপূর্ণ। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
صيام يوم عرفة أحتسب على الله أن يكفر السنة التي بعده والسنة التي قبله
আরাফার দিনের (নয় তারিখের) রোযার বিষয়ে আমি আল্লাহর নিকট আশাবাদী যে, তিনি এর দ্বারা বিগত এক বছর ও আগামী বছরের গুনাহ মিটিয়ে দিবেন। (সহীহ মুসলিম ১১৬২)
৬. ০৯ জিলহজ্জ থেকে তাকবীরে তাশরীক শুরু করা
৯ জিলহজ্জ ফজর হতে ১৩ জিলহজ্জ আসর পর্যন্ত মোট তেইশ ওয়াক্তের নামাযের পর একবার করে তাকবীরে তাশরীক বলা ওয়াজিব। তাকবীরে তাশরীক এই–
اللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ لَا إِلَهَ إِلّا اللهُ، وَاللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ وَلِلهِ الْحَمْدُ
৭. কুরাবানীর দিনে কুরবানী করা
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
أُمِرْتُ بِيَوْمِ الْأَضْحَى، جَعَلَهُ اللهُ عِيدًا لِهَذِهِ الْأُمّةِ
আমাকে ‘ইয়াওমুল আযহা’র আদেশ করা হয়েছে (অর্থাৎ, এ দিবসে কুরবানী করার আদেশ করা হয়েছে); এ দিবসকে আল্লাহ তাআলা এ উম্মতের জন্য ঈদ বানিয়েছেন। (মুসনাদে আহমাদ ৬৫৭৫)
সুতরাং আসুন, গুনাহ থেকে বেঁচে থেকে এ মাসের সম্মান রক্ষা করি। নেক আমলের মাধ্যমে এ মাসের যথাযথ কদর করি। তাকবীর-তাসবীহ-যিকিরে প্রাণবন্ত করি এ মাসকে। তাওবা-ইস্তিগফারের মাধ্যমে ধন্য হই ক্ষমা লাভে। একমাত্র আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্য হজ্জ-কুরবানীসহ অন্যান্য আমল করি। নয় দিনের রোযার মাধ্যমে সমৃদ্ধ করি নেক আমলের ভান্ডার। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন।