শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী
এক. কার জন্য সাজবেন?
প্রিয় বোন, সাজসজ্জার ক্ষেত্রে প্রথমে ভাবতে হবে, আপনি কার জন্য এবং কাকে দেখানোর জন্য সাজবেন। কোরআনে কারিমে নারীদের সৌন্দর্য্য প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। তবে মাহরাম ১৪ শ্রেণির পুরুষ ছাড়া। কাজেই নারী, নারীসদৃশ হিজড়া এবং মাহরাম পুরুষদের সামনে সাজসজ্জার প্রদর্শন বৈধ। তবে স্বামী ব্যতীত অন্য মাহরাম পুরুষের (ছেলে, পিতা, ভাই প্রমুখ) সামনে পেট ও পিঠের সৌন্দর্য্য প্রকাশ করা জায়েয নয়। (বাদায়ে’ ৫/১২০) আর হ্যাঁ, তাদের মধ্য থেকে যদি কারও সামনে সাজসজ্জা প্রদর্শনে ফেতনার প্রবল আশঙ্কা থাকে- তাহলে তার সামনে সৌন্দর্য্য প্রকাশ নাজায়েয। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ أَوْ آبَائِهِنَّ أَوْ آبَاء بُعُولَتِهِنَّ أَوْ أَبْنَائِهِنَّ أَوْ أَبْنَاء بُعُولَتِهِنَّ أَوْ إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي أَخَوَاتِهِنَّ أَوْ نِسَائِهِنَّ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُنَّ أَوِ التَّابِعِينَ غَيْرِ أُوْلِي الْإِرْبَةِ مِنَ الرِّجَالِ أَوِ الطِّفْلِ الَّذِينَ لَمْ يَظْهَرُوا عَلَى عَوْرَاتِ النِّسَاء
তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাঁদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ, ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো আছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। (সূরা নূর ৩১)
আর স্বামীর সামনে সাজসজ্জা ও সৌন্দর্য প্রদর্শন শুধু বৈধই নয় বরং করণীয়। হাদিস শরিফে এসেছে,
عَنْ أَبِي أُمَامَةَ-رضي الله عنه- عَنِ النَّبِيِّ –ﷺ-، أَنَّهُ كَانَ يَقُولُ: مَا اسْتَفَادَ الْمُؤْمِنُ بَعْدَ تَقْوَى اللَّهِ خَيْرًا لَهُ مِنْ زَوْجَةٍ صَالِحَةٍ، إِنْ أَمَرَهَا أَطَاعَتْهُ، وَإِنْ نَظَرَ إِلَيْهَا سَرَّتْهُ، وَإِنْ أَقْسَمَ عَلَيْهَا أَبَرَّتْهُ، وَإِنْ غَابَ عَنْهَا نَصَحَتْهُ فِي نَفْسِهَا وَمَالِهِ
আবু উমামা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলতেন, কোনো মুমিন ব্যক্তি আল্লাহ্ভীতির পর উত্তম যা লাভ করে তা হলো পুণ্যময়ী স্ত্রী। স্বামী তাকে কোন নির্দেশ দিলে সে তা পালন করে; সে তার দিকে তাকালে (তার বাহ্যিক সাজসজ্জা ও চরিত্রের মাধুর্যতা) তাকে আনন্দিত করে এবং সে তাকে শপথ করে কিছু বললে সে তা পূর্ণ করে। আর স্বামীর অনুপস্থিতিতে সে তার সম্ভ্রম ও সম্পদের হেফাযত করে। (সুনান ইবন মাজাহ ১৮৫৭)
দুই. সাজসজ্জার ক্ষেত্রে ইসলামের মূলনীতি
নারীর জন্য কী ধরণের সাজসজ্জা বৈধ হবে- ইসলাম এক্ষেত্রে কিছু মুলনীতি আরোপ করেছে। মূলনীতিগুলো হচ্ছে এই–
১- কোনো সাজসজ্জা হারাম হওয়ার ব্যাপারে যতক্ষণ পর্যন্ত দলিল পাওয়া যাবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত তা বৈধ। আর হারাম হওয়ার দলিল পাওয়া গেলে তা অবৈধ। কেননা, বস্তুর মূল হচ্ছে, বৈধতা। আল্লাহ তাআলা বলেন,
مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ
যে ব্যক্তি বিজাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে তাদের দলভুক্ত গণ্য হবে। (আবু দাউদ ৪০৩১)
৪- সাজসজ্জার ক্ষেত্রে ক্ষতিকর বস্তু বা প্রসাধনী ব্যবহার করা যাবে না। কেননা, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, لا ضرر ولا ضرار ক্ষতি ও ক্ষতি সাধনের কোন অনুমতি নেই। (সুনানে দারাকুতনী ৩০৭৯)
তিন. প্রসঙ্গ- চেহারার সাজসজ্জা
১- ভ্রু প্লাক করা। এটা হারাম। হাদিস শরিফে এসেছে,
قَالَ عَبْدُ اللَّهِ: لَعَنَ اللَّهُ الوَاشِمَاتِ وَالمُسْتَوْشِمَاتِ، وَالمُتَنَمِّصَاتِ، وَالمُتَفَلِّجَاتِ لِلْحُسْنِ، المُغَيِّرَاتِ خَلْقَ اللَّهِ تَعَالَى
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলা অভিশম্পাত করেছেন সেসব নারীদের উপর যারা দেহাঙ্গে উল্কি উৎকীর্ণ করে এবং যারা করায়, তেমনি যারা ভ্রু চেঁছে সরু (প্লাক) করে, যারা সৌন্দর্য মানসে দাঁতের মাঝে ফাঁক সৃষ্টি করে, যারা মহান আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে পরিবর্তন আনে। (বুখারী ৪৮৮৬, ৪৮৮৭, ৫৯৩১, ৫৯৪৩, ৫৯৪৮)
২- চেহারায় উল্কি অংকন করা। উক্ত হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় যে, শুধু চেহারা নয়; বরং দেহের যেকোনো অঙ্গে উল্কি অংকন করা হারাম।
৩- ফেক আইল্যাস বা কৃত্রিম পাপড়ি লাগানো। এটাও নাজায়েয। ড. খালিদ আল মুসলিহ বলেন,
أخاف أن تكون من الوصل المحرم الذي لعن الله فاعله، كما جاء الخبر عن رسول الله ﷺ: (لعن الله الواصلة والمستوصلة) عن جماعة من الصحابة رضي الله عنهم، … ومما لا يخفي أن في هذا العمل كذبا، وقد يكون معه تدليس أو غش، فالذي أنصح به الأخوات أن يجتنبن مثل هذه الوسائل التجميلية، والاكتفاء بالمباح،
(والمتفلجات للحسن) يفهم منه أن المذمومة من فعلت ذلك لأجل الحسن، فلو احتاجت إلى ذلك لمداواة مثلا جاز
المكياج من باب الزينة، إذا كان لا يضر الوجه ولا يسبب ضرراً فلا حرج في ذلك، أما إذا كان يسبب ضرر فلا يُفعل
মেকআপ সাজসজ্জার অন্তর্ভুক্ত। যদি চেহারা বা ত্বকের ক্ষতি না করে তাহলে অসুবিধা নেই। কিন্তু যদি এর কারণে ক্ষতি হয় তাহলে করা যাবে না। (www.binbaz.org.sa)
তবে এসব বস্তু ব্যবহারের সময় নিম্নোক্ত বিষ্যগুলোর প্রতি খেয়াল রাখতে হবে-
৪- চুল কালার করা । মহিলাদের জন্য চুলে কালো কলপ ব্যবহার করা জায়েয নয়। এছাড়া স্বামীর দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে-পরপুরুষকে দেখানো উদ্দেশ্য না হলে-মহিলারা চুল বাদামী, সোনালী, লালচে প্রভৃতি কলপ দিয়ে রঙাতে পারে। (রদ্দুল মুহতার ৬/৭৫৬ আলমুগনী ১/১২৭ আল-ফাতাওয়াল মুহিম্মাহ, লিনিসাইল উম্মাহ ২৫)
তবে তাতে যেন কোন সেলিব্রেটি বা কাফের নারীর অনুকরণ বা বেশধারণ উদ্দেশ্য না হয়। কেননা হাদীস শরীফে এসেছে,وَمَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ যে ব্যক্তি যে জাতির অনুকরণ করে সে সেই জাতির দলভুক্ত। (আহমদ ৫১১৪)
৫- চুল কাটা।মহিলাদের চুলের ক্ষেত্রে শরীয়তের মৌলিক নীতিমালা হল : ১. মহিলারা চুল লম্বা রাখবে। হাদীস শরীফ থেকে জানা যায় যে, উম্মাহাতুল মুমিনীন রাযি. চুল লম্বা রাখতেন। ২. এ পরিমাণ ছোট করবে না যে, পুরুষের চুলের মতো হয়ে যায়। হাদীস শরীফে পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বনকারিনী মহিলার প্রতি অভিসম্পাত করা হয়েছে। ৩. চুল কাটার ক্ষেত্রে বিজাতীয়দের অনুকরণ করবে না। কারণ হাদীসে বিজাতীয়দের অনুকরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। অতএব যে মহিলার চুল এত লম্বা যে, কিছু অংশ কাটলে পুরুষের চুলের সাথে সাদৃশ্য হবে না তার জন্য ঐ পরিমাণ কাটা জায়েয হবে। পক্ষান্তরে যার চুল তত লম্বা নয়; বরং অল্প কাটলেই কাঁধ সমান হয়ে যাবে এবং পুরুষের বাবরী চুলের মতো দেখা যাবে তার জন্য অল্প করেও কাটার অনুমতি নেই। তবে জটিল অসুস্থতার কারণে চিকিৎসার প্রয়োজনে অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শে চুল ছোট করা, এমনকি জরুরতবশতঃ কামানোরও অনুমতি রয়েছে। তবে সর্বাবস্থায় ফ্যাশনের অনুকরণ করা থেকে বিরত থাকা জরুরি। উপরোক্ত মূলনীতির আলোকে মহিলারা তাদের চুল খাটো করতে পারবে। (সহীহ বুখারী ২/৮৭৪; জামে তিরমিযী ১/১০৩; সহীহ মুসলিম ১/১৪৮; তাকমিলা ফাতহুল মুলহিম ১/৪৭২)