পরিশ্রম উন্নতির চাবিকাঠি

পরিশ্রম উন্নতির চাবিকাঠি
পরিশ্রম উন্নতির চাবিকাঠি

পরিশ্রম উন্নতির চাবিকাঠি

মূল

মাহবুবুলওলামা হযরত মাওলানা পীর
জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী মুজাদ্দেদী

অনুবাদ ও সম্পাদনা
শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী

 

হামদে-বারী তাআলা ও দুরুদে সালাতের পর!

মানবজীবনের লক্ষ্য
মানুষ নিজ চেষ্টা অনুপাতে ফলাফল পায়। মানুষের চেষ্টাটাই মূল বিষয়। মানুষ গাছ নয় দাঁড়িয়ে থাকবে। পাথর নয় পড়ে থাকবে। মানুষ সৃষ্টির সেরা আশরাফুল মাখলুকাত। সে আল্লাহর স্মরণে নিমগ্ন থাকবে। মানবজীবনের লক্ষ্য আল্লাহর বন্দেগি। সে বেঁচে থাকে আল্লাহর স্মরণের জন্য। এ সুবিশাল বিশ্বজগত যা আমরা বিস্তৃতভাবে দেখতে পাচ্ছি। আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন মানুষের জন্য। আর মানুষকে সৃষ্টি করেছেন আল্লাহর ইবাদতের জন্য।

نہ تو زمين کیلئے ہے نہ آسمان کیلۓ
جہاں ہے تیرے لۓ تو نہیں جہاں کیلۓ
তুমি জমিনের জন্য নও, আসমানের জন্যও নও,
বরং পৃথিবীটাই তোমার জন্য।

মহাবিশ্ব কার জন্য?

আসমানের বিশালতা, জমিনের সজীবতা, সমুদ্রের গভীরতা, সমুজ্জ্বল তারকারজি, রুক্ষ্ম পাহাড়সমূহ, নির্মল বাতাস এবং প্রকৃতির এ বিশাল নয়নাভিরাম সমারোহ মানুষের জন্য। যে আল্লাহ তাঁর সম্পন্ন কুদরত দিয়ে মানুষের জন্য এত আয়োজন করেছেন, তিনি কতই না মহান!

کھیتیاں سر سبز ہيں تیری غذا کے واسطے

چاند سورج اور ستارے ہیں ضیا کے واسطے

بحروبروشمس و قمر وماہ شماکے واسطے

یہ جہاں تیرے لئےتوخداکےواسطے

ক্ষেত-খামার শষ্য-শ্যামল তোমার খাদ্যের জন্য,

রবি শসি তারকারাজি আলোর মেলার জন্য;

সাগর পৃথিবী চন্দ্র সূর্য মাস গণনার জন্য,

পৃথিবীটা তোমার জন্যার তুমি আল্লাহর জন্য।

জীবনের পথ
মানুষ পৃথিবীতে দু’ধরণের জীবন যাপন করতে পারে। এক. মন যেভাবে চায় সেভাবে। দুই. রব যেভাবে চায় সেভাবে।

আসুন, একটু যাচিয়ে-খতিয়ে দেখি যে, এর কোনটি আমাদের জন্য উত্তম ও অনুপম?
মানুষ মন মতো চলার অর্থ হল, সে যা চিন্তা করে তা-ই করে বসে। চিন্তার রয়েছে কয়েকটি পথ। যেমন চোখ। চোখ দ্বারা মানুষ দেখে। কান। কান দ্বারা মানুষ শুনে। মুখ দ্বারা মানুষ বলে। এগুলোর মাধ্যমে সে তথ্য সংগ্রহ করে কিংবা বলা যায়, জ্ঞান অর্জন করে। তারপর ওই জ্ঞানের ভিত্তিতে মানুষ জীবন যাপনের পথ তৈরি করে নেয়।

মানুষের দেখা ক্রটিপূর্ণ
মানুষ যেসব পথ ধরে জ্ঞানার্জন করে, লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, পথগুলো ক্রটিপূর্ণ। যেমন মানুষের দেখা ক্রটিপূর্ণ। সে সব কিছু দেখে না। অথচ বিড়াল অন্ধকারেও দেখতে পায়। মানুষের দৃষ্টিশক্তি একটা পর্যায় পর্যন্ত গিয়ে অচল। যেমন ঈগল পাখি কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত দেখে। কিন্তু মানুষ দেখে না। বাতাসে রয়েছে কোটি কোটি অনু ও জীবানু। কিন্তু আমরা দেখি না। দেখলে হয়ত জীবন যাপন করা দুস্কর হয়ে পড়ত। এজন্য মহান আল্লাহ আমাদের দৃষ্টিশক্তিকে একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত চলমান রেখেছেন। এতেই রয়েছে আমাদের কল্যাণ। অন্যথায় আমাদের প্রতিটি নিঃশ্বাসে রয়েছে অসংখ্য জীবানু। সাদা চোখে সেগুলো দেখা না গেলেও মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখা যায়। বর্তমানে কিছু ক্যাপসুল পাওয়া যায়। যেগুলো খুলে টেবিলের ওপর রাখলে মনে হবে পাউডার। বস্তুত সেগুলো জীবানু। মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখলে সেগুলোর নড়াচড়াও পরিস্কার দেখা যাবে। কিন্তু সাদা চোখে দেখা যায় না। কারণ আমাদের দৃষ্টিশক্তি পরিপূর্ণ নয়; বরং সীমিত। নিজেস্ব গণ্ডির বাইরে আমাদের দৃষ্টিশক্তি অকার্যকর। সুতরাং বোঝা গেল, মানুষের দৃষ্টিশক্তি পরিপূর্ণ নয়; ক্রটিপূর্ণ।

দেখুন! চোরের উৎপাত থেকে বাঁচার জন্য মানুষ এলার্ম ব্যবহার করে থাকে। এর এক মাথায় ট্রান্সমিটার থাকে। আরেক মাথায় থাকে রিসিভার। মাঝখান দিয়ে বিদ্যুত-তরঙ্গ দৌড়াতে থাকে। খালি চোখে বিদ্যুত-তরঙ্গের এ দাপাদাপি মানুষ দেখতে পায় না। চোর যখন ঢুকে তখন এতে ছেদ পড়ে। সাথে সাথে এলার্ম বেজে ওঠে। চোর ধরা পড়ে। সুতরাং এ কয়েকটি উদাহরণ থেকে প্রতীয়মান হল, মানুষের দেখা ক্রটিপূর্ণ।

শ্রবণশক্তিও ক্রটিপূর্ণ
মানুষের শ্রবণশক্তি দেখুন। আমরা কিছু শব্দ শুনতে পাই। কিছু পাই না। বর্তমানে বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষ সত্তেও ভুমিকম্প অনুধাবনের জন্য ল্যাবরোটরিগুলোতে কুকুর-বিড়াল রাখা হয়। বিজ্ঞানীরা বলেন, ভূমিকম্প শুরু হওয়ার অনেক আগ থেকেই মাটির গভীর থেকে কিছু শব্দ আসে। মানুষ শুনতে পায় না। কিন্তু প্রাণীরা শোনে। তখন তারা লাফালাফি শুরু করে দেয়। এটা ভূকিমম্পের প্রতি ইঙ্গিতবহ হয়। দেখুন! মানুষ যা শুনতে অক্ষম, প্রণীরা তা শুনতে সক্ষম। মানুষের শ্রবনশক্তির একটা ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ড আছে। এর ভেতরে শব্দ হলে আমরা শুনতে পাই, অন্যথায় পাই না।

অনুরুপ আরো আছে। যেমন ইঁদুরের জন্য বর্তমানে একটি বৈদ্যুতিক যন্ত্র (Electronics Instrument) তৈরি করা হয়েছে। যার নাম Bye Bye Rat এটা মূলত এক প্রকার Sound System তথা ধ্বনিব্যবস্থা। এটা বৈদ্যুতিক ধ্বনিকে এমন এক ফ্রিকোয়েন্সি থেকে বের করে আনে কিংবা নিক্ষেপ করে, সাধারণ মানুষের পক্ষে যা সেখানে অবস্থান করলেও অনুধাবন করা সম্ভব নয়, কিন্তু ইঁদুর সাথে সাথে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। দেখুন! সে শব্দ আমরা শুনতে পাই না। কিন্তু ইঁদুর ঠিকই শুনতে পায়। এমনকি সে সেখানে টিকে থাকতে পারে না, বরং পালিয়ে বাঁচে। বোঝা গেল, সব শব্দ মানুষ শুনতে পায় না। মানুষের শুনার জন্য একটা ব্যান্ড আছে। যেমন রেডিওর ব্যান্ড আছে। শর্ট ভয়েস, মিডিয়াম ভয়েস ইত্যাদি- এগুলো রেডিওর ব্যান্ড। আমরা যদি শর্ট ভয়েসে রেডিও ‘অন’ করি তাহলে সে শর্ট ওয়েভ রিসিভ করে, কিন্তু মিডিয়াম ভয়েস রিসিভ করতে পারে না। মিডিয়াম ভয়েসে অন করলে সে মিডিয়ামটা রিসিভ করে। কিন্তু শর্টটা পারে না। অনুরূপভাবে মানুষের শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তিরও একটা ব্যান্ড আছে। এই ব্যান্ডের ভেতর আমরা কাজ চালাতে পারি, এর বাইরে পারি না। মোটকথা, মানুষ এগুলোর মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে। আর যেহেতু এগুলো ক্রটিপূর্ণ ও দুর্বল, সুতরাং এগুলোর মাধ্যমে অর্জিত তথ্য ও জ্ঞানও অবশ্যই দুর্বল হবে।

জীবন যাপনের পথ দু’টি
জীবর যাপনের পথ দু’টি। এক. নিজের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী জীবন যাপন করা। দুই, খালিক ও মালিকের বিধিবিধান মোতাবেক জীবন যাপন করা। আর এটা স্বতসিদ্ধ কথা যে, মানুষের জ্ঞান ও তথ্য সংগ্রহের ‘মাধ্যম’ যেহেতু দুর্বল, সুতরাং মানুষের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণও অবশ্যই কমজোর। যে ব্যক্তি নিজের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ নয়; বরং মহান আল্লাহ প্রদত্ত বিধিবিধানকে যাপিত জীবনের জন্য ‘নির্দেশক’ বানাবে, তার সফলতা অনিবার্য। মেশিন তৈরিকারী ইঞ্জিনিয়ারই ভালো বলতে পারে তার মেশিনটি কেমন সার্ভিস দিবে। মানুষও একপ্রকার মেশিন। তৈরি করেছেন মহান আল্লাহ। সুতরাং তিনিই ভালো জানেন মানুষ চলবে কিভাবে এবং কী হবে তার জীবন যাপন পদ্ধতি। সাধারণত বিদেশ থেকে আসা মেশিনের সাথে কোম্পানি একজন ইঞ্জিনিয়ার পাঠায়। সাথে একটা গাইডবুকও দেয়। ইঞ্জিনিয়ার এসে মেশিন ফিট করে নিজে চালায়। তারপর কিছু লোককে ট্রেনিং দিয়ে বলে দেয় যে, আমি না থাকলে মেশিনটি এভাবে চালাবে, তাহলে সমস্যা হবে না। এরপরেও যদি সমস্যা হয় তাহলে গাইডবুক দেখে নিবে। এতে সব লেখা আছে। এ বলে ইঞ্জিনিয়ার চলে যায়।

মুসলমান উক্ত উদাহরণটি অনুধাবন করতে পারলে জীবনের বোঝা সহজ হয়ে যাবে। আল্লাহ ‘মানুষ’ নামক মেশিন সৃষ্টি করেছেন। নবীদেরকে প্রেরণ করেছেন। সকলের শেষে এসেছেন মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ  । তিনি মানুষের জন্য ইঞ্জিনিয়ার হয়ে এসেছেন। গাইডবুক হিসাবে এনেছেন পবিত্র কুরআন। তিনি নিজে সেই গাইডবুক অনুযায়ী জীবন যাপন করেছেন। যাওয়ার সময় সাহাবায়েকেরামকে বলে গেছেন, আমি যেভাবে জীবন যাপন করেছি, তোমরাও সেভাবে জীবন যাপন কর; তাহলে সফলকাম হবে। তিনি বলে গিয়েছেন, আমি বিদায় নিচ্ছি। কিন্তু তোমাদের জন্য পথনির্দেশিকা তথা Instraction Book হিসাবে রেখে যাচ্ছি পবিত্র কুরআন। এটি তোমাদের জন্য হেদায়েতের কিতাব। যদি তোমরা কিতাবখানা ফলো কর, তাহলে কামিয়াব হবে। আর পবিত্র কুরআন সত্যিকার অর্থেই সত্যের সমষ্টি, বাস্তবতার ভান্ডার। এই পবিত্র কুরআন আমাদের কাছে রয়েছে। পবিত্র কুরআনের বাস্তব ব্যাখ্যা রাসুলুল্লাহ -এর সুন্নাহ। যা আমাদের জীবন যাপনের জন্য আলোর মিনার।

ইলমের গুরুত্ব
ইলম অর্জনের ব্যাপারে ইসলাম ধর্ম অত্যাধিক গুরুত্বারোপ করেছে। অন্যান্য ধর্ম অতটা গুরুত্ব দেই নি। চৌদ্দশ বছর পূর্বেও অারবরা মূর্খতা ও হিংস্রতার ব্যাপারে ছিল প্রসিদ্ধ। এমনকি কাইসার ও কিসরা তাদের ওপর রাজত্ব করাটাকেও অপছন্দ করত। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক গিবন নিজ গ্রন্থে লিখেছেন-

At that time Arabia was the most degraded nation of the world
‘অনারব ছিল পৃথিবীর সবচে’ মূর্খ ও অসভ্য জাতি।’ এমন গোষ্ঠির কাছে প্রেরণ করা হয়েছে রাসুলুল্লাহ -কে। তিনি মানবজাতিকে আল্লাহর প্রতি দাওয়াত দেন। এই মূর্খজাতিকে ইলম ও জ্ঞানের ফযিলত শোনান- طَلَبُ العِلْمِ فَرِيْضَةٌ عَلَىْ كُلِّ مُسْلِمٍ ‘ইলম অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ফরয।’ তারপর বলেন- أُطْلُبوا الْعِلْمَ مِنَ الْمَهْدِ إِلَى الَّلحْدِ ‘ইলম অর্জন করতে থাক দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত।’

ইমাম গাযালী রহ. এর বাণী- ‘ওলামায়েকেরামের কলমের কালি, শহিদের রক্তের চেয়ে দামী।’ বলুন! জ্ঞানের প্রতি এতটা গুরুত্বারোপ আর কে করেছে!

ইতহাসের সবচে’ শ্রেষ্ঠ মানুষ

পাকিস্তানে একটি বই বেশ প্রসিদ্ধি লাভ করে। বইটির নাম– A ranking of the most influential personalities of the history (ইতিহাসে সবচে’ প্রভাব বিস্তারকারী মনীষীদের শ্রেণীবিন্যাস) বইটির লেখক মাইকেল হার্ট। খ্রিস্টান। তিনি নিজ ধারণা অনুপাতে ওই সমস্ত মনীষীর একটা র‌্যাঙ্ক বা শ্রেণীবিন্যাস নির্ধারণ করেছেন। যাঁরা পৃথিবী থেকে বিখ্যাত হয়ে অতিবাহিত হয়ে গিয়েছেন। এই ক্রমধারায় তিনি সর্ব প্রথম মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর পবিত্র নাম উল্লেখ করছেন। এসুবাদে তাঁর প্রথম বাক্যটি বেশ চমৎকার। তিনি লিখেছেন-

My choice of Muhammad to lead the ranking of the most influential personalities in history will surprise some of the readers

অর্থাৎ ‘আমি আরবের মুহাম্মদকে ইতহাসের সবচে’ শ্রেষ্ঠ ও প্রভাব বিস্তারকারীর মর্যাদা দিলাম কেন- এ বিষয়ে অনেক শিক্ষিতজন বিম্ময় প্রকাশ করেছেন।’

এরপর মাইকেল হার্ট কারণ হিসাবে বলেন, পৃথিবীতে যত বড় বড় মনীষী এসেছেন, যদি আপনি তাদের শৈশব কৈশোর ও তারুণ্যের সময়গুলো মন্থন করেন। দেখবেন, তারা যুগের শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়ে নামজাদা শিক্ষকের নিকট শিক্ষালাভ করেছেন। নিউটন ইতিহাসের একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী। তারও দক্ষ শিক্ষক ছিল। তিনি তার সময়ের সেরা স্কুল কলেজ ও ভার্সিটি থেকে শিক্ষা লাভ করেছেন। কিন্তু একমাত্র ব্যক্তিত্ব- যিনি জীবনে কোথাও কোন শিক্ষকের ছাত্র হন নি। এরপরেও তিনি মানবতাকে জ্ঞানের সাজে সজ্জিত করেছেন। এই বাস্তবতা আমাকে ইতিহাসের সবচে’ প্রভাবশালী মনীষীদের ক্রমধারায় তাঁর নাম সকলের আগে রাখতে বাধ্য করেছে।

বাস্তবেই এটা নিঃসন্দেহে সত্য। দেখুন! রাসুলুল্লাহ জীবনে আরবের বাইরে কদম রাখেন নি। অবশ্য যুবক বয়সে গিয়েছেন ব্যবসার উদ্দেশ্যে। কিন্তু নবুওয়ত প্রাপ্তির পর আরবের বাইরে পা ফেলেন নি। নবী হওয়ায় তাঁর সাহাবীরা তাঁর আশে পাশেই সব সময় থাকতেন। তাঁদের কেউ কায়সার কিসরায় গিয়ে ম্যানেজম্যান্ট কিংবা ইকোনেমিক্স কোর্স করার উদ্দেশ্যে বাইরে যান নি। তিনি আরবেই ছিলেন। তাঁর সাহাবীরা তাঁর কাছেই ছিলেন। এরপরেও কায়সার কিসরার মুকুট ছিনিয়ে এনেছেন। বিশাল রাজত্বকে পরাজিত করেছেন। তাঁরাই পৃথিবীকে শিখিয়েছেন- পৃথিবীর নেতৃত্ব কিভাবে দিতে হয়। পৃথিবী পরিচালনায় এ নিপুন দক্ষতা তাঁরা কোথায় শিখেছেন? এটা রাসুলুল্লাহ মহান আল্লাহর কাছ থেকে শিখেছিলেন। আর তিনি শিখিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় সাহাবীদেরকে।

চমৎকার ঘটনা
সুপ্রিয় শ্রোতা! বিশ্বাস করুন, ইলম তথা জ্ঞানার্জনের প্রতি রাসূলুল্লাহ যে পরিমাণ গুরুত্ব দিয়েছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এর নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। একবারের ঘটনা। আমরা একবার Effective Manager নামক একটি কোর্স করছিলাম। কোর্সের টিচার ছিলেন ইংলেন্ডের Mr. Borrodi (মিস্টার বর্রোদি)। যিনি একই সময় ক্যালোফোনিয়ার, ইংল্যান্ডের, জার্মানের এবং ইংল্যান্ডের কয়েকটি নামকরা ভর্সিটির প্রফেসর ছিলেন। এমন একজন দক্ষ ও নামকরা ব্যক্তি আমাদেরকে কোর্স করাচ্ছিলেন। লেকচারের সময় একববার তিনি ‘জ্ঞান’ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বললেন, আমাদের বিজ্ঞানীরা এ বিষয়টি আজ উপলব্ধি করেছেন যে, কেবল ছাত্র জীবনে নয়, বরং পেশাগত জীবনেও পড়তে হয়। সারা জীবনেই পড়তে হয়। কথাটা তিনি এমনভাবে বললেন, যেন এটা বহু রিসার্চের পর তাদের উপলব্ধিতে এসেছে। তখন আমি দাঁড়িয়ে বললাম, ‘আপনাকে আমাদের রাসূলুল্লাহ -এর একটি হাদীস শুনাতে চাই’। তিনি বললেন ‘অবশ্যই শুনবো। বলুন’। তখন আমি তাকে ‘জ্ঞান অর্জন কর কবর থেকে দোলনা পর্যন্ত’ হাদীসটি শুনালাম। আমার মুখে হাদীস শোনামাত্র তিনি লেকচার রেখে ব্রিফকেস থেকে ডাইরি বের করলেন। বললেন, হাদীসটি আমার ডাইরিতে লিখে দিন। ভবিষ্যতে আমি আমার লেকচারে হাদীসটি পড়ে শুনাবো এবং বলবো, চৌদ্দশ’ বছর পূর্বে মুসলমানদের নবী জ্ঞানের ব্যাপারে এতটা গুরুত্ব দিয়েছেন। সুবহানাল্লাহ!

ইলম অর্জন করবেন কিভাবে?
ইলম অর্জনের পথ কী–এ সম্পর্কে শুনুন। ইলম অর্জনের জন্য মেহনত করতে হয়। আরবীতে প্রবাদ আছে, من طلب فقد وجد ‘মানুষ যা অর্জনের চেষ্টা করে, কেবল তা পায়।’ আমরাই নিজ হাতে আমাদের জীবন গড়ি এবং আমরাই নিজ হাতে আমাদের ধ্বংসের পথ রচনা করি। এটা একেবারে সত্য কথা যে, পরিশ্রম এমন সৃষ্টিবস্তুর নাম, যে ব্যক্তি যে পরিমাণ কষ্ট করতে থাকবে তার জীবন ততটা সুমিষ্ট হতে থাকবে।

মনীষীদের সাধনা

ইমাম শাফিঈ রহ.
সালফে-সালেহীন ইলমের জগতে যে পরিমাণ সাধনা করেছেন, তা শুনলে মানুষ বিস্মিত হয়ে যায়। ভাবতে পারেন, শাফিঈ রহ. মাত্র তের বছর বয়সে ‘ইমাম শাফিঈ’ হয়েছেন! মাত্র তের বছর বয়সে কুরআন-হাদীসের ইলম অর্জন করে নিয়েছেন। এমনকি কুরআনের দরস প্রদানও শুরু করেছিলেন। এটা ছিল তার সাধনার সুফল। ইলম অর্জনের প্রতি প্রচন্ড স্পৃহার করণে তিনি এ জগতে বিশাল বিশাল সমুদ্র পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। বনে গিয়েছিলেন ‘ব্যক্তি শাফিঈ’ থেকে ইমাম শাফিঈ রহ.।

মুহাম্মাদ বিন কাসিম রহ.
সতের বছরের তরুণ ছিলেন মুহাম্মদ বিন কাসিম। বর্তমান এই বয়সের ছেলেকে একটা পরিবার সামলাতে বললে তাও পারবে না। অথচ কিশোর মুহাম্মদ এই বয়সেই হয়েছেন কামান্ডার ইন চিফ। বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে যাচ্ছেন। কোথায়? যেখানে রয়েছে রাজা দাহিরের সজ্জিত প্রতিষ্ঠিত রাজত্ব। সিন্দুর যে ময়দানটিতে রাজা দাহির বনাম মুহাম্মদ বিন কাসিম লড়াই হয়েছে, আমি সেটি দেখেছি। ময়দানের বিশালতা দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। এক অব্যক্ত অনুভূতি তখন আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। আমি আবেগভরা কন্ঠে বললাম, এই কিশোর এসেছে কোথা থেকে? তার সাথে ছিল না কোন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্যবাহিনী। এটাই সত্য যে, হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তাকে এক বিশেষ পরিস্থিতে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আমার সেনাবাহিনী বিভিন্ন লড়াইয়ে ব্যস্ত রয়েছে। সংবাদ পেলাম আমাদের কিছু নারী আসছিলেন। রাজা দাহিরের লুটেরা বাহিনী তাদের সর্বস্ব লুটে নিয়েছে। কাফেলাকে বন্দি করেছে। কাফেলার এক অসহায় নারী বাঁচার আকুতি জানিয়েছেন। এরই ভিত্তিতে মুহাম্মদ বিন কাসিম রহ. কিছু যুবককে একসাথ করলেন। এরা নিয়মতান্ত্রিক সৈন্য ছিল না। এরা ছিল ঈমানের প্রেরণায় উজ্জীবিত। সবাই শ্লোগান তুলল, আমরা আছি আপনার সাথে। কিতাবে এসেছে, এবিষয়টি মুহাম্মদ বিন কাসিমের হৃদয়ে এতটাই দাগ কেটেছিল, তিনি বসা থেকে হঠাৎ লাফিয়ে ওঠলেন এবং চিৎকার করে বলে উঠলেন – لبيك يا اختى لبيك يا اختى ‘হে বোন! আমি আসছি, হে বোন! আমি আসছি।’

সীমিত কয়েকজন যুবকের এই দল রাজা দাহিরের সুবিন্যস্ত প্রশিক্ষিত বাহিনীকে চরমভাবে পরাজিত করেন। শুধুতাই নয়, এ বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করে তিনি সেকেন্ড লাইনের হাতে নিজের কমান্ড দিয়ে দিলেন। নিজে আরো সামনে মার্চ করলেন। নিজে এতটাই আত্মবিশ্বাসের সাথে লড়াই করেছেন যে, এখানকার দায়িত্ব সেকেন্ড লাইনের হাতে দিয়ে নিজে আরো অগ্রসর হতে লাগলেন। এমনকি সিন্ধু থেকে মুলতান পর্যন্ত ইসলামের পতাকা সমুন্নত করে ছাড়লেন।

সফল জীবন
আজও আমাদের যুবকরা যদি এই উদ্যমতা লালন করত, বন্ধুগণ, আমি বলব, তাহলে পৃথিবীর কোন শক্তি আমাদের দিকে নখ, দাঁত খিঁচিয়ে তাকানো তো অনেক দূরের কথা; বরং চোখ তুলে তাকানোরও সাহস করত না। এজন্য মেহনতকে আপন করে নেয়া বর্তমান সময়ের দাবী। অলসতা সফলতা নিয়ে আসতে পারে না। মেহনতই উন্নতির চাবিকাঠি।

আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ.
বিখ্যাত মুহাদ্দিস আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ.। তাঁর কাছে হাদীস শিক্ষার্থীদের বিশাল সমাগম হত। একবার কালির দোয়াত গণনা করে দেখা গেল যে, চল্লিশ হাজার দোয়াত আছে। ওই যুগে তো লাউডস্পিকার ছিলনা, তাই তিনি যা দরস দিতেন তা উপস্থিতিদের মাঝে পৌঁছিয়ে দেয়ার জন্য নামাজের মুকাব্বিরের মত চারশ’ মুকাব্বির ছিল। ভাবুন! কত বিশাল সমাবেশ হত। এ বিশাল সমাবেশের সকলেই তাঁর ছাত্র। তিনি ছিলেন সকলের হাদীসের শিক্ষক।

জনৈক মুহাদ্দিস
এক মুহাদ্দিসের জীবনীতে এসেছে, তিনি যে পরিমাণ কিতাব লিখেছেন, হিসাব করলে তার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি দিনে গড়ে দশ পৃষ্ঠা করে পড়ে। এটা সাধারণ কোন বিষয় নয়। এর মাঝে তো বার তের বছর ইলম লেখার পেছনেই চলে গিয়েছে। এই বার তের বছর বাদ দিলে দেখা যাবে দৈনিক হয়ত বিশ পৃষ্ঠা লিখেছেন। দৈনিক বিশ পৃষ্ঠা বুঝে পড়া এটা আমাদের জন্য চেষ্টাসাধ্য। যারা লেখালেখি করেন, তারা জানেন যে, দৈনিক এক পৃষ্ঠা করে লেখাও কতটা পরিশ্রমের কাজ। সেখানে তিনি বিশ পৃষ্ঠা করে লিখেছেন। ভাবুন! কী পরিমাণ পরিশ্রম তিনি করেছেন!

আরো কিছু ঘটনা 

— ইসলামী যুগের বিখ্যাত পর্যটক ইবনু মাওকিল রহ. দীর্ঘ আটাইশ বছর লাগাতর ভ্রমণ করেছিলেন। ইতিহাসে তাকে ‘সাহিবুল মাসালিক ওয়ালমামালিক ওয়ালমাগাদির ওয়ালমাহালিক’ নামে স্মরণ করা হয়।
–হাফেজ আবুল কাসেম সুলাইমান ইবনে আহমাদ তাবরানী রহ.। মা’আজিমে ছালাছাহর লেখক। হাদীস অন্বেষণে লাগাতার তেত্রিশ বছর ভ্রমণ করেছিলেন। এক হাজার শায়খ থেকে ইলম অর্জন করেছিলেন।
— আবু হাতিম রাযী রহ.। ইলমে হাদীসের জন্য তিনি নয় হাজার মাইল পায়ে হেঁটে ভ্রমন করেছিলেন। এটা তিনি নিজেই বলেছেন।
— ইবনু মুক্বরী রহ.। একটি কিতাবের কপি অর্জনের উদ্দেশ্যে আটশ’ চল্লিশ মাইল পায়ে হেঁটে সফর করেছিলেন।
–হাফেজ আবু আব্দুল্লাহ ইস্পাহানী রহ.। হাদীস অন্বেষণের উদ্দেশ্যে একশ’ বিশ জায়গা সফর করেছিলেন।
— আরবী সাহিত্যের ইমাম ইমাম সীবওয়াইহ রহ.। প্রথমে তিনি হাম্মাদ ইবনু সালামাহ রহ.-এর শাগরিদ ছিলেন। একদিন উসতাদ বললেন, ليس ابا الدرداء কিন্তু তিনি ভুল করে লিখেন ليس ابو الدرداء ভুলের জন্য উসতাদ তাকে শাসালেন। এপর তিনি এই পরিমাণ মেহনত করলেন যে, নাহব শাস্ত্রে ইমাম বনে গেলেন।
— আল্লাম ইবনুল জাওযী রহ.। একবার তিনি মিম্বরে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি এই আঙ্গুল দিয়ে দুই হাজার খন্ড কিতাব লিখেছি। সে যুগের কলম ছিল বাঁশের কুঞ্চি দ্বারা তৈরিকৃত। তাঁর অসিয়ত মোতাবিক তাঁর জীবনে ব্যবহৃত কলমের অবশিষ্টাংশ দ্বারা শেষ গোসলের পানি গরম করা হয়।
— ইবরাহীম হারবী রহ.। লাগাতার পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত আরবী সাহিত্যের ইমাম ছালাব রহ.-এর সাহিত্য ক্লাসে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
— একবার ইমাম রাযী রহ. বলেন- والله انى اتأسف فى الفوات عن الإشتغال بالعلم فى وقت الأكل, فان الوقت والزمان  عزير’আল্লাহর কসম! পানাহারের ব্যস্ততার কারণে যে সময়টুকু ইলম অর্জণ করতে পারি নি, তার জন্য আমার আফসোস হয়। কারণ সময় বড় প্রিয়বস্তু।’

–ইমাম গাযালী রহ.-এর তা’লিকাত যেগুলো তিনি আবু নসর ইসমাঈল রহ. থেকে লিখেছিলেন। সেগুলো লুটে নিয়ে গেল। তিনি ডাকাত সরদারের কাছে সেগুলো চাইলেন। ডাকাত সরদার শুনে হেসে ফেলল। বলল, ‘ছেলে! তুমি ছাই পড়েছ. একটুখানি কাগজের জন্য তুমি পঙ্গু হয়ে গেলে!’ অবশেষে তিনি তা’লীকাত পেলেন। কিন্তু পুনরায় হারিয়ে যাবার ভয়ে ইমাম গাযালী রহ. মাসয়ালাগুলো মুখস্থ করা শুরু করলেন। তিন বছরে মুখস্থও করে ফেললেন।
— ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন, ইমাম শাতিবী রহ. কাসিদায়ে শাতিবিয়া লেখার পর তা নিয়ে বার হাজার বার বাইতুল্লাহর তাওয়াফ করেছিলেন। প্রতিটি তাওয়াফে ছিল সাত চক্কর এবং দুই রাকাত তাওয়াফের ওয়াজিব নামাজ। যখন তিনি দোয়া কবুল হওয়ার স্থানগুলোতে যেতেন, তখন বলতেন-

اللَّهُمَّ فَاطِرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ عَالِمَ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِرَبَّ هَٰذَا الْبَيْتِ الْعَظِيمِ انفع لها كل من قرأها

‘হে আল্লাহ! আসমানসমূহ ও জমিনের স্রষ্টা। দৃশ্যমান ও অদৃশ্য বিষয়সমূহের জ্ঞানী। এই মহান ঘরের মালিক। যে ব্যক্তিই এটি পাঠ করবে, তাকেই এর দ্বারা উপকৃত করুন।’

বিজ্ঞানীদের সাধনা

নিউটন
পৃথিবীর সকল বিখ্যাতজনরাই মেহনত করেছেন। সাধনা করেছেন। ধর্মীয় কিংবা জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে সকল খ্যাতিমানরাই পরিশ্রম করেছেন। বিজ্ঞানী নিউটনের জীবনীতে আছে। দুর্দান্ত গবেষণার পর একটি পান্ডুলিপি তৈরি করেন তিনি। পান্ডুলিপিটা টেবিলে রেখে টয়লেটে যান। পাশেই বাতি জ্বলছিল। তিনি একটি কুকুর পালতেন। কুকুরটাকে ‘টুনি’ বলে ডাকতেন। ইত্যবসরে টুনি ভেতরে লাফ দেয়। এতে জ্বলন্ত বাতি কাগজের ওপর পড়ে ছাই হয়ে গেল। নিউটন এসে শুধু বললেন, তুই আমার কাজ বাড়িয়ে দিলি। এরপর তিনি পান্ডুলিপি পুনরায় সম্পন্ন করেন। সাধনা সত্যি বিশাল নেয়ামত। সৌভাগ্যবানরাই এই নেয়ামত লাভ করে।

আইনস্টাইন
আইনস্টাইন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী ছিলেন। তার জীবনীতে আছে, তিনি যখন স্কুলে পড়তেন, টাকার হিসাব জানতেন না। এ কারণে প্রায় বাসের হেল্পারের সাথে ভাড়া নিয়ে তার ঝগড়া হত। কিন্তু প্রায় দেখা যেত, তার হিসাব ভুল, হেল্পারের হিসাব ঠিক। একদিন হেল্পার বলে বসল, তুমি হিসাব করতে জান না। জীবন চলবে কিভাবে? কথাটা তার গায়ে লাগে। প্রতিজ্ঞা করে এখন থেকে গণিত ভালোভাবে পড়বে। এরপর তিনি ম্যাথমেটিক্স (Mathematics) নিয়ে মেহনত শুরু করেন। মেহনত করতে করতে এক সময় তিনি Theory of relativity সূত্র আবিস্কার করে ফেলেন। যার ফলে গোটা বৈজ্ঞানিক জগতে এক বিপ্লব সাধিত হয়। বাস্তবেই সাধনার ফল অবশ্যই পাওয়া যায়।

ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতা
এক তরুণ মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে ভালো রেজাল্ট করে। তার বাবা-মা ছিলেন বৃদ্ধ। বাবা ছিলেন অসুস্থ। কাজকর্ম করতে পারতেন না। ছেলে বলল, কলেজে ভর্তি হব। বাবা বললেন, নুন আনতে পান্তা পুরায় কলেজে ভর্তি হবে কিভাবে? এক কাজ কর, দোকান খোল, এতে আমাদের কিছু রুটি-রুজির ব্যবস্থা হবে। বাবা তিন হাজার টাকা খরচ করে একটি দোকান খুলে দেয়। স্কুলের ফাস্ট বয় ভাড়া দোকান চালাতে থাকে। কিন্তু তার শিরায় শোণিতে ছিল পড়া লেখার প্রতি অদম্য স্পৃহা। এফ, এস সি এর বইপত্র জোগাড় করে গোপনে পড়তে থাকে। বাবা কিছুই জানে না। ছেলেটি দোকাদারির ফাঁকে ফাঁকে পড়ালেখা চালিয়ে যায়। এভাবে সে এফ এস সি এর ফিজিক্স, ক্যামেস্টি ও ম্যাথের সবগুলো বই নিজে নিজে পড়ে ফেলে। কোথাও সমস্যা দেখা দিলে এক প্রফেসর থেকে বুঝে নিত। প্রফেসর ছেলেটিকে প্র্যাকটিক্যাল করানোর আশ্বাস দেয়। দেখুন! কতটা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিত যে, যেদিন প্র্যাকটিক্যাল হত তার চারদনি আগেই সে তার বাবাকে বলত, অমুক দিন দোকানের মালপত্র আনতে হবে। যাহোক, নির্ধারিত দিন ছেলেটি বাজারে যেত এবং বিশ্বস্ত ধার্মিক কোন ব্যক্তিকে সদাই রেড করার জন্য বলে সে প্র্যাকটিক্যাল করার জন্য চলে যেত। এরই মধ্যে সে ক্লাস করে চলে আসত। ছেলে শুধু সদাই নিয়ে এসেছে, না আরো কিছু করেছে বাবা কিছুই টর পেত না। এভাবে পরীক্ষা চলে আসল। পরীক্ষাটাও সে সদাই আনার আড়ালেই দিয়ে দিল। এফ এস সি সে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়েছিল। বিশ্বাস করুন, ছেলেটি প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়েও লাহোর বোর্ডে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করল। পত্রিকায় সংবাদ আসল। মহল্লাবাসী তার বাবাকে মোবারকবাদ দেয়ার জন্য আসলো। বাবা বলে , আমার ছেলে তো পড়া লেখাই করে নি। সে তো দোকানদারি করে। অবশেষে কিছু লোক তার বাবাকে আসল ঘটনাটা খুলে বলে। তারপর কিছু লোক গিয়ে এক ধনী ব্যক্তিকে ঘটনাটা বলে এবং তার থেকে দুই-তিন হাজার টাকার প্রাইভেট স্কলারশীপের ব্যবস্থা করে দেয়। এভাবে ছেলেটি পরিবারকে কিছু দিত এবং নিজেরও চলত। অবশেষে সে লাহোর ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে সেখান থেকেও ভালো রেজাল্ট নিয়ে বের হয়। এখন সে ইঞ্জিনিয়ার। গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়েছে। ঘটনাটা একেবারে সত্য। এ থেকে বোঝা গেল, যদি কোন মানুষ কোন কাজ করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করে যে, কাজটি আমি করবই, তাহলে আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন। সত্য কথা হল, যে ব্যক্তি নিজেকে সাহায্য করে, আল্লাহও তাকে সাহায্য করেন।

মহিলা ডাক্তার
আমাদের কলেজে ইসলামিয়াতের একজন প্রফেসর ছিলেন। তার মেয়ে মেট্রিকে ভাল নাম্বারে পাশ করে। মেয়ের বড় আশা ডাক্তার হবে। বাবা বললেন, কলেজে সহশিক্ষা চলে। আমি চাই না আমার মেয়ে এরকম পরিবেশে পড়ালেখা করুক। এইসময় ‘জঙ্গ’-এ মেয়েদের জন্য আর্টসের কলেজ ছিল। সায়েন্সের কলেজ ছিল না। মেয়ে বলল, আমার পড়ার বড় শখ। বাবা বললেন, প্রাইভেটভাবে পড়লে আমার আপত্তি নেই। অবশেষে বাবা মেয়েকে মেডিকেলের বইপত্র কিনে দিলেন। মেয়ে প্রাইভেট পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগল। মাঝে মধ্যে কোনো সমস্যা হলে বাবাকে বলত। বাবা মেডিকেলের একজন প্রফেসর থেকে তা বুঝে নিত এবং বাসায় এসে মেয়েকে বুঝিয়ে দিত। এভাবে অবশেষে মেয়ে প্রাইভেট পরীক্ষা দেয়। দেখুন, বাবা ছিলেন ইসলামিয়াতের প্রফেসর। সুতরাং তিনি মেয়ের প্রবলেম্জ কী বুঝবেন! কিন্তু মেয়ের সাধনা দেখে তিনি মেডিকেলে প্রফেসরের কাছ থেকে কিছু Hints (ইশারা-ইঙ্গিত) নিয়ে আসতেন। মেয়ে তা পিকআপ করে নিত। এভাবেই সে প্রস্তুতি সম্পন্ন করে প্রইভেটভাবে পরীক্ষা দেয়। এমনকি সে এত ভালো রেজালট করে যে, সে লাহোরে ফাতেমা জিন্নাহ মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়ে যায়। সেখানে ভর্তি হয়। কলেজটি ছিল মেয়েদের। সেখানে লেখাপড়া করে সে ডাক্তার বনে যায়।

নোবেলবিজয়ী ড. আবদুস সালাম
আমি আপনাদের একটি গল্প শোনাব। গল্পটি ইতোপূর্বে আপনারা শুনেন নি। একবার কলেজের প্রিন্সিপালের পক্ষ থেকে চিঠি পেলাম, অমুক তারিখে আমরা কলেজে অনুষ্ঠান করব। সেখানে তোমাকে রুল অফ অনার পেশ করা হবে। এই লক্ষে আমরা বিখ্যাত বিজ্ঞানী আবদুস সালাম খোরশেদকে দাওয়াত করেছি। আমি তখন ইউনিভার্সিটি থেকে ছুটি নিয়ে কলেজে যাই। অনেক বড় অনুষ্ঠান ছিল। প্রিন্সিপাল বললেন, এই ছেলে আমাদের কলেজের অনেক বড় রেকর্ড করেছে। সুতরাং আমি তার জন্য অনুষ্ঠানও করব খুব জাঁকালোভাবে। যাহোক, অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি করা হয় ড. আবদুস সালাম খোরশেদকে। তিনি নিজেও একসময় এই কলেজের ছাত্র ছিলেন। তিনি আমাকে রুল অফ অনার প্রদান করেন। এরপর চায়ের টেবিলে একত্র হওয়ার এবং কথাবার্তা বলার পরিবেশ হয়। তখন আমাদের এক প্রফেসর তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি নোবেল প্রাইজ অনার কিভাবে হলেন?’ ডক্টর সাহেব উত্তর দিলেন, ‘আমি নেহায়েত পরিশ্রমী।’ প্রফেসর সাহেব বললেন, ‘সায়েন্সের ছাত্ররা তো এমনিতেই প্ররিশ্রমী হয়। সবাই খুব পড়ুয়া হয়। বইপোকা হয়।’  ডক্টর সাহেব বললেন, ‘তবে আমি আরো বেশি পরিশ্রমী।’ প্রফেসর সাহেব বললেন, ‘এমনকি পরিশ্রম যা আপনি করেছেন, অন্যরা করেনি? সায়েন্সের ছাত্ররা সবাই তো এননিতেই মেধাবী ও পরিশ্রমী হয়। কিন্তু তারা নোবেলবিজয়ী হলেন না, আপনি হয়ে গেলেন!’ ডক্টর সাহেব বললেন, ‘আমি ততটা মেধাবী নই, তবে পরিশ্রমী।’ প্রফেরস সাহেব বললেন, ‘না, আপনি প্রচন্ড মেধাবীও।’  তখন ডক্টর সাহেব বললেন, ‘আমি সত্যি বলছি, আমি মেধাবী ততটা নয়, তবে খুব পরিশ্রমী।’ এরপর তিনি আজব এক ঘটনা শোনালেন। বললেন, ‘আমি কেমিস্ট্রির একটা বই পড়ছিলাম। কিন্তু বুঝছিলাম না। একবার পড়লাম। দুইবার পড়লাম। তিনবার পড়লাম। তবু বুঝে আসছিল না। এভঅবে বইটি আমি তেষট্রিবার পর্যন্ত পড়ি। এমনকি বইটি আমার প্রায় মুখস্থ হয়ে যায়।’ ডক্টর আবদুস সালামের পল্প শুনে আমি বিস্মিত হলাম। একবার- দু’বার- তিন বার নয়, তেষট্রিবার! তখন মনে মনে বললাম, যার মাঝে শ্রম ও সাধনার এমন সম্পদ আছে, সে-ই তো যোগ্য। সে-ই তো নোবেল-পুরুস্কার পাবে।

শ্রোতাবন্ধুগণ! পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত তেলাওয়াত করেছিলাম

وَأَنْ لَيْسَ لِلْإِنْسَانِ إِلَّا مَا سَعَى  وَأَنَّ سَعْيَهُ سَوْفَ يُرَى
‘মানুষ তা পাবে, যার জন্য সে পরিশ্রম করবে।’

আপনারা সব ছাত্র। জীবনগড়ার প্রথম সিঁড়িতে আছেন। এখানে যে পরিশ্রম করবেন, সমাজে সে ষ্ট্যাটাস ও সম্মান পাবেন। যদি এই সোনালী সুযোগকে পেছনে ঠেলে দেন, তাহলে বন্ধুগণ! মনে রাখবেন, সারাজীবন তার গ্লানি টানতে হবে। এজন্য সুযোগ পেয়ে ‘শ্রম ও সাধনা’ শিরোনামে কিছু কথা বাস্তব কিছু অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টান্তসহ আপনাদের সামনে পেশ করলাম। যাতে আপনারা অনুপ্রাণিত হন। একথা অন্তরে গেঁথে নিন, আমিই পারি নিজ হাতে নিজের জীবন গড়ে তুলতে। আবার আমিই নিজের হাতে নিজের জীবন এলোমেলো করে দিতে পারি।

عمل سے زندگی بنتی ہے جنت بھی جہنم بھی

یہ خاکی اپنی فطرت میں نہ نوری ہے نہ ناری ہے

‘জীবনের গড়া-ভাঙ্গা আমল দ্বারা হয়,

মাটির তৈরি মানুষ সৃষ্টিগতভাবে জান্নাতি নয়, জাহান্নামিও নয়।’

আপনার শ্রম যেমন হবে, আল্লাহ আপনাকে তেমন প্রতিদান দান করবেন। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে কর্মব্যস্ত জীবন অতিবাহিত করার তাওফিক দান করুন। নিজের জন্য সমাজের জন্য, মুসলিম উম্মাহর জন্য, গোটা বিশ্বের জন্য কিছু করে যাওয়ার তাওফিক দান করুন। আমীন।

ভাবুন!
আমাদের দ্বারা যেন মানুষ উপকৃত হয়। যাতে এটা আমাদের আখেরাতের নাজাতের উসিলা হয়। কত বিস্ময়কর কথা যে, পায়খানা, ময়লা,বর্জ্য, খড়কুটো, আবর্জনা শুকিয়ে গেলে গ্রামের লোকেরা তা ক্ষেতে ফেলে আসে। বলে, এগুলো ক্ষেতে দিলে জমিন উর্বর হয়, ফসল ভালো হয়। আমি মাঝে মাঝে ভাবি যে, মানুষ! একটু দেখো, আমরা যেগুলোকে ময়লা- আবর্জনা বলি, সেগুলো ক্ষেতে দিলে মাটি উপকৃত হয়। আর আমরা যদি না পারি আমাদের পাশের মানুষগুলোকে উপকৃত করতে তাহলে এই জীবন কিসের জন্য!! তাই আসুন, নিজের জন্য, বন্ধুবান্ধবের জন কিছু একটা করি। লঙ ফেলভ চমৎকার বলেছেন,

Lives of Great man all remaind us, We can our life sublime, And depering leave behind us, foot prints of the sands of time.

‘বড়দের জীবন আমাদেরকে মনে করিয়ে দিয়, আমরাও পারি আমাদের জীবনকে আলোকিত করতে, পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার সময় আমরাও পারি সময়ের বালিতে আমাদের পদচি‎হ্ণ রেখে যেতে।’

وأخردعوانا ان الحمد لله رب العالمين