শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী
اَلْحَمْدُ لِلّهِ وَكَفَى وَسَلَامٌ عَلَى عِبَادِهِ الَّذِيْن َاصْطَفَى اَمَّا بَعْدُ! عَن أَبي جُرَيٍّ جَابِرِ بنِ سُلَيْمٍ رضي الله عنه، قَالَ: رَأَيْتُ رَجُلاً يَصْدُرُ النَّاسُ عَنْ رَأْيهِ، لا يَقُولُ شَيْئاً إِلاَّ صَدَرُوا عَنْهُ، قُلْتُ: مَنْ هَذَا ؟ قَالُوا: رَسُولُ اللهِ ﷺ . قُلْتُ: عَلَيْكَ السَّلامُ يَا رَسُولَ اللهِ ﷺ– مَرَّتَينِ – قَالَ: لاَ تَقُلْ: عَلَيْكَ السَّلامُ، عَلَيْكَ السَّلامُ تَحِيَّةُ المَوْتَى، قُلْ: السَّلامُ عَلَيْكَ . قَالَ: قُلْتُ: أنْتَ رَسُولُ اللهِ ﷺ؟ قَالَ: أنَا رَسُولُ اللهِ ﷺ الَّذِي إِذَا أَصَابَكَ ضُرٌّ فَدَعَوْتَهُ كَشَفَهُ عَنْكَ، وَإِذَا أَصَابَكَ عَامُ سَنَةٍ فَدَعَوْتَهُ أَنْبَتَهَا لَكَ، وَإِذَا كُنْتَ بِأَرْضٍ قَفْرٍ أَوْ فَلاَةٍ فَضَلَّتْ رَاحِلَتُكَ، فَدَعَوْتَهُ رَدَّهَا عَلَيْكَ . قَالَ: قُلْتُ: اِعْهَدْ إِلَيَّ. قَالَ: لاَ تَسُبَّنَ أحَداً . قَالَ: فَمَا سَبَبْتُ بَعْدَهُ حُرّاً، وَلاَ عَبْداً، وَلاَ بَعِيراً، وَلاَ شَاةً، وَلاَ تَحْقِرَنَّ مِنَ المَعْرُوفِ شَيْئاً، وَأَنْ تُكَلِّمَ أخَاكَ وَأنْتَ مُنْبَسِطٌ إِلَيْهِ وَجْهُكَ، إنَّ ذَلِكَ مِنَ المَعْرُوفِ، وَارْفَعْ إزَارَكَ إِلَى نِصْفِ السَّاقِ، فَإنْ أبَيْتَ فَإلَى الكَعْبَينِ، وَإيَّاكَ وَإسْبَالَ الإِزَارِ فَإنَّهَا مِنَ المَخِيلَةِ. وَإنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ المَخِيلَةَ ؛ وَإِنِ امْرُؤٌ شَتَمَكَ وَعَيَّرَكَ بِمَا يَعْلَمُ فِيكَ فَلاَ تُعَيِّرْهُ بِمَا تَعْلَمُ فِيهِ، فَإنَّمَا وَبَالُ ذَلِكَ عَلَيْهِ. أو كما قال رسول الله ﷺ أقول قولي هذا أستغفر الله لي ولكم فاستغفروه إنه هو الغفور الرحيم. اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّعَلَى الِ سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّبَارِكْ وَسَلِّمْ
হামদ ও সালাতের পর!
হাদিস শোনা ও শোনানোর মাঝেও সাওয়াব আছে
হাদিস থেকে বরকত নেয়ার উদ্দেশ্যে আজ দীর্ঘ হাদিস শোনালাম। হাদিস শুনে অর্থ বুঝে না আসলেও সাওয়াব পাওয়া যায়। কেননা, হাদিসও মূলত অহি। কোরআন মজিদ অহি মাতলু; কথা আল্লাহ তাআলার, ভাষাও আল্লাহ তাআলার। হাদিস অহিয়ে গায়রে মাতলু; কথা আল্লাহ তাআলার, ভাষা নবীজী ﷺ-এর। নবীজী ﷺ তো নিজ থেকে কিছু বলতেন না। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَا يَنطِقُ عَنِ الْهَوَىٰ. إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَىٰ
প্রবৃত্তির তাড়নায় কথা বলেন না। এটি অহি, যা প্রত্যাদেশ হয়। (সূরা নাজম ৩,৪)
তাই হাদিস শোনা ও শোনানোর মাঝেও সাওয়াব আছে। হাদিসটিতে কিছু নসিহত আছে। আজকের এই রমজানের প্রথম ইসলাহী মজলিসে নবীজী ﷺ-এর সেই নসিহতগুলো শুনব, যেগুলো তিনি তাঁর একজন প্রিয় সাহাবীকে করেছিলেন। আমরাও ‘ইনশাআল্লাহ’ এই নসিহতগুলোর উপর প্রত্যেকেই আমল করব। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফিক দান করুন। আমীন।
নবীজী ﷺ-এর সঙ্গে জাবির রাযি.-এর প্রথম সাক্ষাত
হাদিসটি বর্ণনা করেছেন আবূ জুরাই জাবির ইবনে সুলাইম রাযি.। সংক্ষেপে জাবির রাযি.। শুরুতে তিনি নবীজী ﷺ-এর সঙ্গে নিজের প্রথম সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। ইতিপূর্বে তিনি নবীজিকে দেখেন নি। তিনি বলেন,
‘আমি এমন এক ব্যক্তিকে দেখলাম, যাঁর মতানুযায়ী লোকে কাজ করছে, তাঁর কথা তারা মেনে নিচ্ছে। অর্থাৎ, তাঁর মুখ থেকে কোন কথা বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই তা পালন করে। তাই আমি লোকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এ লোকটি কে?’ লোকেরা বলল, ‘ইনি আল্লাহর রাসূল ﷺ।’ আমি তাঁকে ‘আলাইকাস সালাম ইয়া রাসূলাল্লাহ’ দু’বার বললাম। তিনি বললেন, ‘আলাইকাস সালাম’ বলো না। ‘আলাইকাস সালাম’ তো মৃতদের জন্য অভিবাদন বাণী। তুমি বলো ‘আসসালামু আলাইকা।’ (আবূ দাউদ ৪০৮৪, তিরমিযী ২৭২১, আহমাদ ১৫৫২৫)
ইসলাম সামান্য শব্দের পরিবর্তনও মেনে নেয় না
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হল, ‘আলাইকাস সালাম’ এবং ‘আসসালামু আলাইকা’ বা ‘আসসালামু আলাইকুম’-এর অর্থ অভিন্ন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ ﷺ জাবির রাযি.-কে বললেন, তুমি ‘আলাইকাস সালাম’ না বলে বরং বলো, ‘আসসালামু আলাইকা’ বা ‘আসসালামু আলাইকুম’। আসলে এর মাধ্যমে ইসলামের এক মহান বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। ইসলাম সামান্য শব্দের পরিবর্তনও মেনে নেয় না। একারণেই ইসলাম চিরন্তন; যার মাঝে পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের কোন সুযোগ নেই। সুতরাং যারা শিরক ও বেদআতের মাধ্যমে গোটা ইসলামকেই ওলট-পালট করে দেয়, তাদের এই জঘন্য কাজ ইসলাম মেনে নিবে কিভাবে!
এক সাহাবীর ঘটনা
হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এক সাহাবীকে ঘুম যাওয়ার আগের একটি দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন। দোয়াটির একটি অংশ ছিল এই–
آمَنْتُ بِكِتَابِكَ الَّذِي أَنْزَلْتَ وَبِنَبِيِّكَ الَّذِي أَرْسَلْتَ
আমি ঈমান এনেছি ওই কিতাবের উপর যা আপনি নাযিল করেছেন এবং ওই নবীর উপর যাকে আপনি পাঠিয়েছেন।
কিছু দিন পর ওই সাহাবী নবীজীকে দোয়াটি শুনাচ্ছিলেন। তখন তিনি কিছুটা পরিবর্তন করে এভাবে বললেন যে,
آمَنْتُ بِكِتَابِكَ الَّذِي أَنْزَلْتَ وَبِرَسُولِكَ الَّذِي أَرْسَلْتَ
অর্থাৎ সাহাবী ‘নবী’ শব্দের স্থলে ‘রাসুল’ বলে ফেলেছেন। দেখুন, নবী এবং রাসূল তো এক কথা। বরং পারিভাষিক দৃষ্টিকোণ থেকে রসূলের মর্যাদা আরো বেশি। কেননা, সকল নবী রাসুল নন। কিন্তু সকল রাসূল নবী। কিন্তু রাসুলুল্লাহ ﷺ এই পরিবর্তনটুকুও মেনে নেন নি। বরং সাহাবীকে শুধরে দিয়ে বললেন, আমি তো তোমাকে بِنَبِيِّكَ বলেছি; بِرَسُولِكَ বলি নি। সুতরাং بِنَبِيِّكَ বল; بِرَسُولِكَ বলো না। (বুখারী ২৪৪)
আসলে এটাই হল, ইসলাম। অপরিবর্তনীয় ও অনন্য ধর্ম। এর মাঝে হাত চালানোর কোন সুযোগ নেই। সুতরাং শিরক ও বেদআতের মাধ্যমে যদি গোটা ইসলামের মধ্যেই পরিবর্তন নিয়ে আসা হয়–সেটা ইসলাম সহ্য করবে কী করে!
হেকমতের সঙ্গে ঈমানের দাওয়াত
যাই হোক, জাবির রাযি. নবীজী ﷺ-কে সালাম দিলেন, নবীজী তাঁকে শুধরে দিয়ে বললেন, এটা ইসলামের সালামের রীতি নয়। ইসলামের রীতি হল, সালাম দিবে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে। এরপর জাবির রাযি. নবীজী ﷺ-কে প্রশ্ন করলেন, أنْتَ رَسُولُ اللهِ ﷺ ؟ আপনি কি আল্লাহর রাসূল? এই প্রশ্নের উত্তরে নবীজী ﷺ এতটুকু বললেই যথেষ্ট হত যে, হ্যাঁ, আমি আল্লাহর রাসুল। কিন্তু তিনি এভাবে উত্তর দেন নি। বরং তিনি উত্তরের মধ্য দিয়ে আল্লাহ তাআলার মারেফতও তুলে ধরলেন এবং তাঁকে হেকমতের সঙ্গে ইমানের দাওয়াতও দিয়ে দিলেন। বললেন,
أنَا رَسُولُ اللهِ ﷺ الَّذِي إِذَا أَصَابَكَ ضُرٌّ فَدَعَوْتَهُ كَشَفَهُ عَنْكَ
‘আমি সেই আল্লাহর রাসূল, যে আল্লাহকে যদি তুমি কোনো বিপদের সময় ডাকো, তাহলে তিনি তোমার বিপদ দূর করে দেন।’
যেথায় পেরেশানি সেথায় শান্তনা তোমারি কাছে পেয়েছি
এমনিতে আরবরাও আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করত। কিন্তু তাঁর সঙ্গে শরিক করত। বিপদে পড়লে তারাও আল্লাহ তাআলাকে খালেস অন্তরে ডাকত। আবার বিপদ কেটে গেলে ভুলে যেত। আল্লাহ তাআলা তাদের এই চরিত্র কোরআন মজিদে তুলে ধরেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَإِذَا رَكِبُوا فِي الْفُلْكِ دَعَوُا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ فَلَمَّا نَجَّاهُمْ إِلَى الْبَرِّ إِذَا هُمْ يُشْرِكُونَ
তারা যখন সামুদ্রিক জাহাজে আরোহণ করে তখন (ঝড়ের কবলে পড়লে) একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে ডাকে। অতঃপর তিনি যখন স্থলে এনে তাদেরকে উদ্ধার করেন, তখনই তারা শরীক করতে থাকে। (সূরা আনকাবুত ৬৫)
আমরা যারা মুসলিম তাদের মধ্য থেকে অনেকের চরিত্র কিন্তু এরকমই। মুসিবত আসার আগে আল্লাহকে ভুলে থাকি, মাখলুকের উপর তাওয়াককুল করি। আর মুসিবতে পড়লে তখন আল্লাহর উপর তাওয়াককুল করি। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর উপর সর্বাবস্থায় তাওয়াককুল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
আল্লাহর আরেফ বলেন,
ہر مر حلہ غم پہ ملی تجھ سے تسلّی
ہر موڑپہ گھبراکے ترانام لیا ہے
‘যেথায় পেরেশানি সেথায় শান্তনা তোমারি কাছে পেয়েছি,
প্রতিটি মোড়ে ঘাবড়ে গিয়ে-তোমারি নাম জপেছি।’
আল্লাহর মারেফত ও কুদরত
যাই হোক, নবীজী ﷺ জাবির রাযি.-কে বললেন, ‘আমি সেই আল্লাহর রাসূল, যে আল্লাহকে যদি তুমি কোনো বিপদের সময় ডাকো, তাহলে তিনি তোমার বিপদ দূর করে দেন।’ তারপর আরো বললেন, কেবল এতটুকু নয়; বরং–
وَإِذَا أَصَابَكَ عَامُ سَنَةٍ فَدَعَوْتَهُ أَنْبَتَهَا لَكَ
‘আমি সেই আল্লাহর রাসূল, যদি তুমি দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হয়ে তাঁর কাছে প্রার্থনা কর, তাহলে তিনি তোমার জন্য জমিন থেকে ফসল উৎপাদন করেন।’
এটাকে বলা হয়, আল্লাহর মারেফত ও কুদরত। আল্লামা ইকবাল বলেন,
پالتا ہے بیج کو مٹی کی تاریکی میں کون؟
کون دریاؤں کی موجوں سے اٹھاتا ہے سحاب؟
শস্যদানার মত একটি অতি ক্ষুদ্র বীজ অন্ধকার মাটির নীচ থেকে বের হয়ে এসে চারাগাছের রূপ ধারণ করে। এই কিশলয় তখন এতটাই দুর্বল থাকে যে, একটি মুরগির ছানাও এক ঠোকরে একে গিলে ফেলতে পারে। সামান্য বাতাসেও এটি ভেঙ্গে যেতে পারে। কিন্তু এমনটি হয় না। বরং ছোট্র চারাগাছটি এক সময় বিশাল মহীরুহের রূপ ধারণ করে। তখন তাকে সামাল দেয়ার ট্রাক ঠেলাগাড়ির প্রয়োজন হয়। অন্ধকার মাটির নীচ থেকে বের করে এনে একটি অতি ক্ষুদ্র বীজকে এত বিশাল বৃক্ষে পরিণত করেন কে? কে সমুদ্রের ঊর্মিমালা থেকে মেঘমালা সৃষ্টি করেন। নিশ্চয় আমাদের আল্লাহ। এসব তাঁর কুদরত। তাঁকে চেনার নিদর্শন।
এরপর রাসূলুল্লাহ ﷺ জাবির রাযি.-কে বললেন,
وَإِذَا كُنْتَ بِأَرْضٍ قَفْرٍ أَوْ فَلاَةٍ فَضَلَّتْ رَاحِلَتُكَ، فَدَعَوْتَهُ رَدَّهَا عَلَيْكَ
‘আমি ওই আল্লাহর রাসূল, কোন গাছপালা বিহীন জনশূন্য মরুভূমিতে তোমার বাহন হারিয়ে গেলে তুমি যখন তাঁর নিকট দো‘আ কর, তাহলে তিনি তোমার বাহন তোমার কাছে ফিরিয়ে দেন।’
বড় মানুষের সঙ্গে সাক্ষাত হলে নসিহত কামনা করা
যাই হোক, এটা ছিল রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সঙ্গে জাবির রাযি.-এর ছিল প্রথম সাক্ষাত। উক্ত কথোপকথনের মাধ্যমে জাবির রাযি. যা বুঝার তা বুঝে নিলেন এবং তিনি ঈমান নিয়ে আসলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বললেন, اِعْهَدْ إِلَيَّ আপনি আমাকে বিশেষ উপদেশ দান করুন।
এখান থেকে বুঝা যায়, বড় মানুষের সঙ্গে সাক্ষাত হলে নসিহত কামনা করতে হয়। সাহাবায়ে কেরাম এটা করতেন। যেমন, আরেক সাহাবী নবীজী ﷺ-এর কাছে সংক্ষিপ্ত নসিহত কামনা করেছিলেন। তখন নবীজীও তাঁকে একেবারে সংক্ষিপ্ত নসিহত করেছিলেন যে, لاَ تَغْضَبْ রাগ করো না। এরকম ঘটনা হাদিসের কিতাবে আরো আছে। এখানেও জাবির রাযি. নবীজী ﷺ-এর কাছে বিশেষ নসিহত চাইলেন। তখন নবীজী তাঁকে পাঁচটি নসিহত করেছিলেন। প্রত্যেকেই নিয়ত করে নেই যে, আমরাও ইনশাল্লাহ এই পাঁচটি নসিহতের উপর আমল করব। আল্লাহ তাআলা তাওফিক দান করুন। আমীন।
প্রথম নসিহত
রাসূলুল্লাহ ﷺ প্রথম নসিহত করলেন,
لاَ تَسُبَّنَ أحَداً
তুমি কাউকে কখনো গালি-গালাজ করো না।
বেকুব, মূর্খ, মুনাফিক, জাহেল, প্রতারক, কাফের এসবই গালিগালাজের শব্দ। আরো কত শব্দ আছে, যেগুলো অশ্লীল হওয়ার কারণে মুখে আনা কঠিন। মোটকথা, কোনো মানুষকে কোনো প্রকারের গালি দেয়া যাবে না। এমনকি কোনো অমুসলিমকেও নয়। আমরা অনেক সময়, কোনো হিন্দুর সঙ্গে ঝগড়া লাগলে বলি, মালাউনের বাচ্চা। এটা ঠিক নয়। হ্যাঁ, এটা বলা যাবে যে, হিন্দুরা কাফের, খ্রিস্টানরা অমুসলিম, ইহুদীদেরকে আল্লাহ লানত করেছেন। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো অমুসলিমকে গালি দেয়ার উদ্দেশ্য ‘মালাউনের বাচ্চা’, ‘কাফেরের বাচ্চা’ বলা যাবে না। এটা কবিরা গুনাহ।
গালি কেন দেয়া যাবে না?
গালি কেন দেয়া যাবে না? কারণ, মনে করুন, যাকে আমি এখন মূর্খ বলে গালি দিলাম। এমনও তো হতে পারে যে, সে মউতের আগে ইলম শিখে আলেম হয়ে যাবে। যাকে মিথ্যুক বলে গালি দেয়া হল, এমনও তো হতে পারে সে তাওবা করে সত্যবাদী হয়ে যাবে। যাকে কাফের বলা হল, এমনও তো হতে পারে যে, সে মৃত্যুর আগে ঈমান এনে গালিদাতার চাইতে বড় মুমিন হয়ে যাবে। আর রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, العبرة بالخواتيم বিবেবচনা করা হবে শেষ অবস্থা। মৃত্যুর সময় সে আল্লাহর কাছে কেমন ছিল–এটা দেখা হবে।
এক বুজুর্গের ঘটনা
এক বুজুর্গ একবার রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তখন তাঁর সঙ্গে আলেম-বিদ্বেষী এক মডার্ন লোকের দেখা। লোকটির সঙ্গে ছিল একটি কুকুর। আশরাফুল মাখলুকাত যখন তথাকথিত মডার্ন হয়ে যায় তখন পায়খানা খায় এমন জন্তু কুকুরের সেবা করা শুরু করে! রুচি কী পরিমাণ নষ্ট হলে এমনটি করে! তো এই মডার্ন লোকটা উক্ত বুজুর্গকে দেখে তাঁকে হেয় করার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে বসল, আচ্ছা, বলুন তো, আপনি শ্রেষ্ঠ না আমার এই কুকুরটি শ্রেষ্ঠ? বুজুর্গ চমৎকার উত্তর দিলেন। বললেন, ভাই, আসলে আমি তা এখনও জানি না। যদি আমার মৃত্যু ঈমানের সঙ্গে হয় তাহলে শুধু এই কুকুর কেন, আমি তো তখন সারা দুনিয়া থেকে শ্রেষ্ঠ। আর যদি ‘আল্লাহ না করুন’ যদি ঈমানের হালতে আমার মৃত্যু না হয় তাহলে এই কুকুর কেন; বরং আমি এর চাইতেও অধম। সুতরাং কে উত্তম–এই ফয়সালা এখন নয়; বরং আমার মৃত্যুর পরে হবে।
আল্লাহর বান্দারা! এইজন্যই আমাদের বুজুর্গ মুজাহিদে মিল্লাত শামসুল হক ফরিদপুরী রহ বলতেন, তুমি বাড়ি গাড়ি সম্মান প্রতিপত্তি সবই পেয়েছ কিন্তু আল্লাহকে পাও নাই তাহলে এসবই মিছে। কেননা, মূলত তখন তুমি কিছুই পাও নাই। আর তুমি আল্লাহকে পেয়েছ আর কিছুই পাও নাই তাহলে মূলত তুমি সব কিছু পেয়েছ। সুতরাং মূল বিষয় হল, আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা। আমরা আল্লাহকে খুশি রাখার জন্যই গালি-গালাজের ভাষা পরিহার করব। আল্লাহ আতাওফীক দান করুন। আমীন।
আবু বকর সিদ্দীক রাযি.-এর ঘটনা
একবার আবু বকর সিদ্দীক রাযি. কোনো কারণে তাঁর গোলামকে লানত দিয়ে বসলেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ এটা দেখে তাঁকে খুব শক্ত ভাষায় বললেন,
لَعَّانِينَ وَصِدِّيقِينَ ؟ كَلا وَرَبِّ الْكَعْبَةِ
মানুষ লানত দিবে আবার সিদ্দীকও হবে! কা’বার রবের কসম! এমনটি কক্ষনও হতে পারে না। কেননা, সিদ্দীক কখনও কাউকে লানত দিতে পারে না।
এটা শোনামাত্র আবু বকর সিদ্দীক রাযি. সঙ্গে সঙ্গে লজ্জিত হলেন এবং ওই গোলামটিকে আজাদ করে দিলেন। (বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান ৪৭৭৬)
আমরা কি পারবো?
আবু বকর সিদ্দীক রাযি. এটা কেন করেছিলেন? আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। অনুরূপভাবে জাবির রাযি.ও নবীজী ﷺ-এর যবান থেকে উক্ত নসিহত শোনার পর সারা জীবন কেমন চলেছেন, দেখুন। তিনি বলেন,
فَمَا سَبَبْتُ بَعْدَهُ حُرّاً، وَلاَ عَبْداً، وَلاَ بَعِيراً، وَلاَ شَاةً
সুতরাং এরপর থেকে আমি না কোন স্বাধীন ব্যক্তিকে না কোনো গোলামকে না কোনো উটকে এমনকি আর না কোনো ছাগলকে গালি দিয়েছি।
আল্লাহু আকাবার! একেই বলে সাহাবা! নবীজী ﷺ-এর একেকটি কথার উপর তাঁরা আমল করে দেখিয়ে দিয়েছেন। আমরা কি পারবো? বেশি দূর নয়, এখন এখান থেকে বের হয়ে রিক্সায় ওঠেন। তারপর রিক্সাওয়ালা ১০ টাকার বিশ টাকা চাইলেই বুঝা যাবে যে, আসলে আমরা কতটুকু পারব?
দ্বিতীয় নসিহত
উক্ত হাদিসে নবীজী ﷺ জাবির রাযি.-কে দ্বিতীয় যে নসিহত করেছিলেন তাহল,
وَلاَ تَحْقِرَنَّ مِنَ المَعْرُوفِ شَيْئاً
নেককাজ যত ছোট হোক না কেন, তুমি তাকে তুচ্ছ মনে করো না।
যেমন আপনি টেবিলের উপর থেকে পানির বোতল নিলেন। মুখের কাছে বোতল আনলেন পান করার জন্য। ওই মুহূর্তে আপনার মনে আসল যে, পানি বসে পান করা সুন্নত। তাহলে সঙ্গে সঙ্গে বসে যান। জুতা পায়ে দিতে যাবেন, ওই মুহূর্তে মনে পড়ল যে, ডান পা আগে প্রবেশ করানো সুন্নাত। তো সঙ্গে সঙ্গে আমল করে ফেলুন। ইশরাকের সময় মনে পড়ল যে, এখন তো ইশরাকের সময়। তো ইশরাক পড়ে নিন। নফলই তো, মুস্তাহাবই তো, সুন্নাতই তো, না করলে তো আর গুনাহ নেই–এজাতীয় চিন্তা মনে এনে নেক আমলকে হালকা বা তুচ্ছ করে দিবেন না।
নেককাজ ছোট মনে করা–এটা ইবলিসের ধোঁকা
নেককাজ ছোট মনে করা–এটা ইবলিসের একটা বড় ধরণের ধোঁকা। সে আপনার মনের মধ্যে এটা ঢুকাবে যে, নফল কিংবা মুস্তাহাবই তো, ছেড়ে দিলে তো গুনাহ নেই। সুতরাং ছেড়ে দিলে সমস্যা কী! এভাবে একদিকে সে আপনাকে নেককাজ থেকে দূরে সরিয়ে দিবে। অপরদিকে বেদআতকে সে খুব হালকা করে আপনার সামনে পেশ করবে। যেমন সে বলবে, কী এমন হয় যদি দরুদ পড়ার সময় নবীজীর সম্মানে দাঁড়ানো হয়। অন্য কারো সম্মানার্থে তো দাঁড়ায় নি। সুতরাং সমস্যা কোথায়? অর্থাৎ ইবলিস এভাবেই ‘বেদআত করলে সমস্যা নেই এবং সুন্নাত ছাড়লে অসুবিধা নাই’-জাতীয় চিন্তা মানুষের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়।
সুতরাং শয়তানের ধোঁকায় পড়বেন না এবং আজ থেকে নেককাজ যত ছোট হোক না কেন, সাধারণ বা তুচ্ছ মনে করবেন না। কারণ, আমরা তো জানিনা যে, কোন নেক আমলের উসিলায় আল্লাহ কাকে মাফ করে দেন! আল্লাহর রহমত তো বাহানা খুঁজে। জানা নেই, তিনি কাকে কোন বাহানায় মাফ করবেন! হাদিস শরিফে এর বহু প্রমাণ আছে।
বনী ঈস্রাঈলের এক বেশ্যা মহিলা
হাদিস শরিফে এসেছে, বনী ঈস্রাঈলের এক বেশ্যা মহিলা একটি কুকুরকে দেখল যে, পিপাসায় তার জিহ্বা বের হয়ে গেছে। পিপাসায় কাতর হয়ে সে হাঁপাচ্ছিল। মহিলার দয়া হল। তাই সে কুপ থেকে পানি তুলে এনে তাকে পান করাতে চাইল। কিন্তু কিছু পেল না। অতঃপর সে নিজের চামড়ার মোজা খুলে কূপ থেকে পানি উঠিয়ে কুকুরটিকে পান করাল। নবীজী ﷺ বলেন, এই আমলের কারণে আল্লাহ তাআলা উক্ত মহিলাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। ( বুখারী ২৩৬৩)
একজন বিখ্যাত মুহাদ্দিসের ঘটনা
শাইখুল ইসলাম মুফতি তাকী উসমানী দা. বা. আব্দুর রহমান সুক্কারী রহ. নামক একজন বিখ্যাত মহুাদ্দিসের ঘটনা লিখেছেন। তাঁর ইন্তেকালের পর এক ব্যক্তি তাকে স্বপ্নে দেখেছেন এবং জিজ্ঞেস করেছেন যে, আল্লাহ আপনার সঙ্গে কেমন আচরণ করেছেন? তিনি উত্তর দিলেন, আল্লাহ আমাকে মাফ করে দিয়েছেন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল এই, আল্লাহ তাআলা আমার এত বড় বড় খেদমতের কথা কিছুই বলেন নি। বরং তিনি আমাকে বললেন, আব্দুর রহমান! এক দিনের ঘটনা। তুমি বসে বসে হাদিস লিখছিলে। তোমার কলমটা তুমি দোয়াতে চুবিয়ে যখন উঠিয়েছ তখন তোমার কলমের আগায় এক ফোঁটা কালি জমে ছিল। ঠিক ওই মুহূর্তে একটা পিপাসার্ত মাছি তোমার কলমের আগায় বসেছিল। আর তুমিও এই চিন্তা করে কিছুক্ষণের জন্য হাদিস লেখা বন্ধ রেখেছিলে যে, আমার একটা মাখলুক যেন তার পিপাসার কষ্ট নির্বিঘ্নে দূর করতে পারে। আমার মাখলুকের প্রতি তোমার এই দয়ার আচরণ এতটাই ভালো লেগেছে যে, এর উসিলায় আমি তোমাকে মাফ করে দিয়েছি।
আল্লাহর রহমত বাহানা খুঁজে
সুতরাং বোঝা গেল, আল্লাহর রহমত বাহানা খুঁজে। একমাত্র তিনি জানেন, কোন আমল তাঁর রহমতকে আকর্ষণ করবে এবং কোন আমল তিনি কবুল করে নিবেন এবং মাফ করে দিবেন। এমনও তো হতে পারে যে, কেয়ামতের দিন একটা ছোট নেক আমলের অভাবে নাজাত কঠিন হয়ে যাবে। আবার এমনও হতে পারে যে, একটা ক্ষুদ্র আমলই নাজাতের জন্য বড় উসিলা হয়ে যাবে। যেটাকে আমি ছোট মনে করেছিলাম, সেটাই আমার নাজাতের কারণ হবে। এজন্যই রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, নেককাজ যত ছোট হোক না কেন, তুমি তাকে তুচ্ছ মনে করো না।
তাছাড়া নেককাজ যত ছোট হোক না কেন, তুমি তাকে তুচ্ছ মনে করবে না একারণে যে, হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি রহ. বলেন, নেক আমল নেক আমলকে টানে। অর্থাৎ একটা নেক আমল করলে আরেকটা নেক আমল করার তাওফিক হয়ে যায়। যেমন গুনাহ গুনাহকে টানে। এক গুনাহর কারণে আরেক গুনাহর দরজা খুলে।
তৃতীয় নসিহত
এরপর রাসূলুল্লাহ ﷺ জাবির রাযি.-কে বিশেষভাবে নসিহত করেন যে,
وَأَنْ تُكَلِّمَ أخَاكَ وَأنْتَ مُنْبَسِطٌ إِلَيْهِ وَجْهُكَ، إنَّ ذَلِكَ مِنَ المَعْرُوفِ
তুমি তোমার মুসলিম ভাইয়ের সঙ্গে হাসি মুখে কথা বলবে। এটাও নেকীর কাজ।
অপর হাদিসে এটাকে সদকা বলা হয়েছে। বর্তমানে তো এই সুন্নাত আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিচ্ছে। বিশেষ করে যাকে দেখতে পারি না, তার সঙ্গে হাসি মুখে কথা বলা তো অনেক কঠিন ব্যাপার! আবার অনেকে এমনও আছে যে, বাইরে খুব হাসি-খুশি থাকে। কিন্তু স্ত্রীর কাছে গেলে বাঘ সেজে বসে। আরেফ বিল্লাহ ডা. আব্দুল হাই আরেফী রহ.-এর কাছে এক লোক এসে বলল, আমি বাসায় ঢুকলে আমার স্ত্রী আমাকে খুব ভয় পায়। আরেফী রহ. উত্তর দিলেন, ভাই, তবে তো তুমি তোমার স্ত্রীর কাছে স্বামী হতে পার নি; বরং বাঘ কিংবা কুকুর হয়েছ!
জারীর ইবনু আব্দুল্লাহ রাযি. বলেন, আমি নবীজী ﷺ-এর দিকে যত বার তাকিয়েছি তত বার তিনি মুসকি হাসি দিয়েছেন। সুতরাং আমরাও সহাস্য বদনে, হাসি মুখে কথা বলার সুন্নাত জিন্দা করব–ইনশাআল্লাহ।
চতুর্থ নসিহত
রাসূলুল্লাহ ﷺ জাবির রাযি.-কে চতুর্থ নসিহত করেন যে,
وَارْفَعْ إزَارَكَ إِلَى نِصْفِ السَّاقِ، فَإنْ أبَيْتَ فَإلَى الكَعْبَينِ، وَإيَّاكَ وَإسْبَالَ الإِزَارِ فَإنَّهَا مِنَ المَخِيلَةِ. وَإنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ المَخِيلَةَ
নিজ লুঙ্গি বা পায়জামা পায়ের নিসফে সাক তথা অর্ধ নলা পর্যন্ত উঁচু রেখো। তা যদি মানতে না চাও, তাহলে টাখনু পর্যন্ত ঝুলাতে পার। টাখনুর নীচে লুঙ্গি ঝুলিয়ে পরা থেকে দূরে থেকো। কেননা, এতে অহংকার জন্মায়। আর নিশ্চয় আল্লাহ অহংকারকে পছন্দ করেন না।
বর্তমানে তো উল্টোটা চলছে। মেয়েরা পরে টাখনুর উপরে আর ছেলেরা পরে টাখনুর নীচে। আবার অনেক পুরুষ বলে, আমি টাখনুর নীচে প্যান্ট পরি ঠিক; কিন্তু আমার মনে কোনো অহঙ্কার নেই। আমি এমনিতে টাখনুর নীচে পরি। মনে রাখবেন, সারা দুনিয়ার লোকও যদি এজাতীয় কথা বলে তবুও আমরা বিশ্বাস করব না। কেননা, আমাদের নবী ﷺ যা বলেছেন, তা-ই সত্য। এটা আমাদের ঈমান। আর নবীজী ﷺ বলেছেন, টাখনুর নীচে কাপড় ঝুলিয়ে পরা পুরুষের জন্য অহংকারের আলামত। সুতরাং এটা অহংকারের আলামত। আর আল্লাহ তাআলা বিনয় পসন্দ করেন। তিনি অহংকার পছন্দ করেন না।
পঞ্চম নসিহত
জাবির রাযি.-এর প্রতি নবীজীর পঞ্চম নসিহত ছিল,
وَإِنِ امْرُؤٌ شَتَمَكَ وَعَيَّرَكَ بِمَا يَعْلَمُ فِيكَ فَلاَ تُعَيِّرْهُ بِمَا تَعْلَمُ فِيهِ، فَإنَّمَا وَبَالُ ذَلِكَ عَلَيْهِ
যদি কেউ তোমাকে গালি দেয় অথবা এমন দোষ ধরে তোমাকে লজ্জা দেয়, যা তোমার মধ্যে বাস্তবেই আছে এবং সে ওটা জানে, তাহলে তুমি তার এমন দোষ ধরে তাকে লজ্জা দিয়ো না, যা তার মধ্যে বাস্তবে আছে এবং তুমি তা জানো। যেহেতু তার কুফল তার উপরই বর্তাবে।
আমাদের অবস্থা
আমাদের অবস্থা হল, (আরবী প্রবাদ) أنفٌ في السَّماءِ وإستٌ في الماءِ. ‘নাক আকাশে আর পাছা পানিতে’ এর মত। অর্থাৎ, এক লোক টয়লেটের ভেতরে পড়ে গেছে। আরেক লোক তাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে গেল। উদ্ধারকারী লোকটির তখন সর্দি ছিল বিধায় বার বার নাকের আগায় ময়লা পানি চলে আসত। যখন সে টয়লেটে পড়ে যাওয়া লোকটির দিকে হাত বাড়িয়ে দিল, যেন সে তার হাত ধরে উঠে আসতে পারে। তখন তার নাকের আগায় ময়লা দেখে টয়লেটের লোকটি বলল, তোমার নাক পরিষ্কার করে আসো। তারপর আমাকে উদ্ধার কর।
এই হল আমাদের অবস্থা। চালুনি সুঁইকে বলে তোমার পেছনে ছিদ্র কেন! নিজে টয়লেটে পড়ে আছি, খবর নেই। আর আরেকজনের নাকের আগার ময়লা দেখে ঘেন্না করি! অথচ আল্লাহর অলিরা কেমন চিন্তা করতেন, দেখুন–
তিনজন আল্লাহওয়ালা
মুফতী মুহাম্মাদ হাসান রহ. ছিলেন হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী রহ.-এর অন্যতম খলিফা। তিনি বলেন, আমরা যখন থানবীর দরবারে বসতাম, তখন আমাদের প্রত্যেকেই নিজেকে সবার চাইতে ছোট মনে করতাম। এরপর তিনি ঘটনা শোনালেন যে, এক বারের ঘটনা। আমার কাছে যখন এমনটি মনে হল তখন আমি বিষয়টা মাওলানা খায়ের মুহাম্মদের সঙ্গে শেয়ার করলাম। ইনিও থানবী রহ.-এর অন্যতম খলিফা ছিলেন। তাঁকে বললাম, ‘ভাই, হযরতের দরবারে যতক্ষণ থাকি, ততক্ষণ নিজের কাছে নিজেকে ছোট মনে হয়। মনে হয়, আমার জাহের ও বাতেন তথা ভেতর ও বাহির সমান নয়। নিজের কাছে নিজেকে সবার চাইতে নিৎকৃষ্ট মনে হয়। মনে হয়, আমি সবার থেকে পিছিয়ে আছি এবং অন্যরা সবাই আমার থেকে এগিয়ে আছেন।’ আমার একথা শুনে মাওলানা খায়ের মুহাম্মদ উত্তর দিলেন, ‘বাস্তবতা হল, আমারও তো একই অনুভূতি আসে। এই দরবারের অন্যান্যদের দিকে তাকালে নিজেকে খুব তুচ্ছ ও গুনাহগার মনে হয়। তাহলে এক কাজ করুন, দু’জনই হযরতের কাছে যাই এবং এটা ভালো না মন্দ তাঁকে জিজ্ঞেস করে আসি।’
এই চিন্তা করে তাঁরা উভয়ই আসলেন থানবী রহ.-এর কাছে এবং তাঁকে সব খুলে বললেন। তখন থানবী রহ. আজব উত্তর দিলেন। তিনি বললেন, ‘প্রকৃত সত্য হল এই যে, আমাকেও আমার নিজের কাছে সকলের চাইতে অধম মনে হয়। মনে হয় যেন আমি সবার চাইতে বড় গুনাহগার।’
যার কবরে সে যাবে
আল্লাহু আকবর! চিন্তা করে দেখুন, শত বছরের অন্যতম সেরা আলেম ও বুজুর্গ, যুগের মুজাদ্দিদ নিজের ব্যাপারে কেমন ধারণা রাখতেন আর আমরা নিজের ব্যাপারে কেমন ধারণা রাখি! এজন্য আজ থেকে নিজেকে ছোট মনে করব। যে ব্যক্তি নিজেকে গুনাহগার মনে করে সে অন্যের দোষ ধরার অবকাশ পায় না। এটাই নিয়ম। একারণে আলোচ্য হাদিসে রাসূলুল্লাহ ﷺ জাবির রাযি.-কে নসিহত করেন যে,
وَإِنِ امْرُؤٌ شَتَمَكَ وَعَيَّرَكَ بِمَا يَعْلَمُ فِيكَ فَلاَ تُعَيِّرْهُ بِمَا تَعْلَمُ فِيهِ
যদি কেউ তোমাকে গালি দেয় অথবা এমন দোষ ধরে তোমাকে লজ্জা দেয়, যা তোমার মধ্যে বাস্তবেই আছে এবং সে ওটা জানে, তাহলে তুমি তার এমন দোষ ধরে তাকে লজ্জা দিয়ো না, যা তার মধ্যে বাস্তবে আছে এবং তুমি তা জানো। অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ানো নিষেধ কেন? রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, এর কারণ হল, فَإنَّمَا وَبَالُ ذَلِكَ عَلَيْهِ যেহেতু তার কুফল তার উপরই বর্তাবে। এটাকে আমরা বলি, তোমার কবরে তুমি যাবে এবং তার কবরে সে যাবে। কেয়ামতের দিন তোমার দোষের কারণে সে জিজ্ঞাসিত হবে না এবং তার দোষের জবাবদিহিতা তোমাকে করতে হবে না।
হাজ্জাজ ইবন ইউসুফ
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাযি.-এর সামনে এক ব্যক্তি হাজ্জাজ ইবন ইউসুফকে গালি দিল। হাজ্জাজ ইবন ইউসুফ কে? যার হাত সাহাবায়ে কেরামের রক্ত দ্বারা রঞ্জিত হয়েছে। জালেম মুসলিম শাসক হিসেবে যিনি ইতিহাসে খুব পরিচিত। কিন্তু অপরদিকে ইতিহাস এটাও সাক্ষ্য দেয় যে, এই হাজ্জাজ বিন ইউসুফের দ্বারা আল্লাহ দীনের অনেক বড় বড় খেদমতও নিয়েছেন। আজ আমরা তাঁর তাঁর উসিলায় মুসলমান। মাত্র একজন মুসলিম নারীর আর্তনাদ যখন তাঁর কানে পৌঁছল যাকে সিন্ধু রাজা দাহির তাকে বন্দি করে রেখেছিল। ওই মুসলিম নারী হাজ্জাজের উদ্দেশ্যে লিখেছিল,
‘হাজ্জাজের রক্ত যদি শীতল হয়ে গিয়ে থাকে তবে এ পত্রও বিফল প্রমানিত হবে। যে জাতির যুবকেরা ঝড়-ঝঞ্ঝার বেগে তুর্কিস্তান আর আফ্রিকার উপকূলে ঘা দিয়ে যাচ্ছে, তা কি স্বজাতির অসহায় নারী-শিশুর ক্রন্দনধ্বনি শুনতে পায় না? এ কী করে সম্ভব যে, যে জাতির তলোয়ারের সামনে একদিন কায়সার ও কিসরা মাথা ঝুঁকিয়ে দিয়েছিল, আজ অত্যাচারী সিন্ধু রাজার সামনে তা ভোঁতা প্রমাণিত হবে?’
এই চিঠি পেয়ে হাজ্জাজের ঈমান জেগে ওঠল। সঙ্গে সঙ্গে নিজের জামাতা ও ভাতিজা মুহাম্মদ ইবন কাসিম রহ.-কে এই অঞ্চলে পাঠান। সেদিন যদি হাজ্জাজ এই মহান তরুণ মুজাহিদকে এই অঞ্চলে না পাঠাতেন তাহলে না জানি, আমরা কী থাকতাম। আবার এই হাজ্জাজেরই উসিলায় আমরা আজ কোরআন মজিদ সহজে পড়তে পারি। কেননা এই লোকটিই সর্বপ্রথম কোরআনে যবর যের পেশ তথা হরকত সংযোজনের ব্যবস্থা করেন। মরণকালে সে আল্লাহর কাছে বলেছিল,
اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي ، فَإِنَّ النَّاسَ يَزْعُمُونَ أَنَّكَ لا تَفْعَلُ
হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করে দাও! কারণ, জনগণ ধারণা করে তুমি আমাকে ক্ষমা করবে না। জনগণ আমার আশা কেড়ে নিতে চায়, কিন্তু তোমার প্রতি আমার আশা কখনোই হারাবে না।
একারণে ওলামায়ে কেরাম তার সমালোচনা করার ক্ষেত্রে একটু সতর্ক থাকেন।
তো বলছিলাম, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাযি.-এর সামনে এক ব্যক্তি এই হাজ্জাজ ইবন ইউসুফকে গালি দিল। তখন তিনি উত্তর দিলেন, শোনো, যে আল্লাহ হাজ্জাজের জুলুমের বিচার করবেন সে-ই আল্লাহ তুমি যে তার গীবত করেছ; এর বিচারও করবেন।
মানসিকতা পাল্টান
এজন্যই বলি, মানসিকতা পাল্টান। নিজের দোষ নিজে দেখার অভ্যাস করি। অপরের দোষের পেছনে পড়ে না থাকি। তাসাওউফের পরিভাষায় এটাকে বলা হয়, দীদে কসুর তথা নিজের দোষ নিজে দেখা। ই’তেরাফে কসুর বা নিজের দোষ স্বীকার করে নেয়া। এটা করতে পারলে বিনয় আসবে। নম্রতা আসবে।
সবর করুন
যে পাঁচটি নসিহতের কথা আজকের মজলিসে আলোচনা করা হয়েছে, এর উপর আমল করা তখন সহজ হবে যখন আমরা নিজেদের মাঝে একটি গুণ আসতে পারব। ওই গুণটির নাম হল, সবর। আমাদের মাশায়েখগণ বলেন, জান্নাতে যাওয়ার দুটি রাস্তা। সবর এবং শোকর। এর মধ্যে সবরের রাস্তা সঙ্কীর্ণ তবে স্ংক্ষিপ্ত। কিন্তু সঙ্কীর্ণ হলেও অসাধ্য নয়। অর্থাৎ সবর করা অবশ্যই কষ্টজনক কিন্তু সবর বেশি দিন ধরতে হয় না। কেননা আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আমাদের সাধ্যের বাইরে কোনো কিছু চাপিয়ে দেন না। আল্লাহ তাআলা বলেন,
لاَ يُكَلِّفُ اللّهُ نَفْسًا إِلاَّ وُسْعَهَا
আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোন কাজের ভার দেন না। (সূরা বাকারা ২৮৬)
সবরের পুরস্কার
সব আমলের পুরস্কারের পরিমাণ নির্ধারিত। কিন্তু সবর সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُونَ أَجْرَهُم بِغَيْرِ حِسَابٍ
যারা সবরকারী, তারাই তাদের পুরস্কার পায় অগণিত। (সূরা যুমার ১০)
আম্বিয়ায়ে কেরাম তাঁদেরকে কেউ কোনো গালি দিলে তাঁরা সবর করতেন। কেউ তাঁদেরকে মূর্খ বা বেকুব বললে তাঁরা ইটের জবাব পাটকেল দিয়ে দিতেন না। বরং সবরের আচরণ দেখাতেন। বড় জোর এতটুকু বলতেন,
لَيْسَ بِي سَفَاهَةٌ وَلَكِنِّي رَسُولٌ مِّن رَّبِّ الْعَالَمِينَ
আমি মোটেই নির্বোধ নই, বরং আমি বিশ্ব প্রতিপালকের প্রেরিত রাসূল। (সূরা আ’রাফ ৬৭)
শাহ ইসমাইল শহীদ রহ.
শাহ ইসমাইল শহীদ রহ. দিল্লির শাহী খান্দানের লোক ছিলেন। একবার এক ব্যক্তি তাঁকে ‘হারামজাদা’ বলে গালি দিল। তিনি তখন দিল্লির জামে মসজিদে খুতবা দিচ্ছিলেন। একটু ভেবে দেখুন, যদি কেউ এভাবে জনসন্মুখে আমাদেরকে গালি দিত তাহলে আমরা কী করতাম! আমরা তো তার চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধার করে ছাড়তাম! কিন্তু তিনি কী করলেন? সবর করলেন। শুধু এতটুকু বললেন, ভাই, আপনি যা বলেছেন তা ঠিক নয়। কেননা আমার মা-বাবার বিয়ের সাক্ষী এখনও জীবিত আছে এবং এই মসজিদেই আছে।
আল্লাহ আমাদেরকে এভাবেই সবর করার তাওফিক দান করুন এবং উক্ত পাঁচটি নসিহতের উপর আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
وَآخِرُ دَعْوَانَا اَنِ الْحَمْدُ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ
অনুলিখন–ইসলাহী বয়ান, ৬ রমজান ১৪৪০ হি .