মাতা-পিতার খেদমত

শাইখুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী

অনুবাদ
শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী

হামদ ও সালাতের পর!
‘আর ইবাদত কর আল্লাহর, শরীক করো না তাঁর সাথে অপর কাউকে। পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর এবং নিকটাত্মীয়, এতিম, মিসকিন, প্রতিবেশী, অসহায় মুসাফির এবং নিজের দাস-দাসীর প্রতিও।’ (সূরা নিসা 36)

বান্দার হকের আলোচনা
‌আল্লামা নববী রহ. এখানে একটি নতুন পরিচ্ছেদের সূচনা করেছেন। বাবা-মায়ের সঙ্গে সদাচরণ এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা প্রসঙ্গে এই পরিচ্ছেদে আলোকপাত করেছেন। যেমন আমি আগেও বলেছি, চলতি পরিচ্ছেদগুলোর বিষয়বস্তু হল, বান্দার হক। কিছু আলোচনা পূর্বে করা হয়েছে। এই নতুন পরিচ্ছেদের আলোচ্য বিষয় মাতাপিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার এবং আত্মীয়স্বজনের হক। এ সুবাদে তিনি কোরআনের আয়াতের পর সর্বপ্রথম যে হাদীসটি এনেছেন, তা হল,

عَنْ عَبْدِ اللّه بن مَسْعُودٍ رضي اللّه عنه قال: سَأَلْتُ رَسُولَ اللَّهِ : أَيُّ الْأَعْمَالِ أَحَبُّ إِلَى اللَّهِ ؟ قَالَ : الصَّلَاةُ عَلَى وَقْتِهَا قُلْتُ : ثُمَّ أَيٌّ ؟ قَالَ : ثُمَّ بِرُّ الْوَالِدَيْنِ قُلْتُ : ثُمَّ أَيٌّ ؟ قَالَ : ثُمَّ الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ

হযরত আবু আব্দুর রহমান আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ কে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহ তাআলার নিকট সবচেয়ে প্রিয় আমল কোনটি? তিনি বললেন, যথাসময়ে নামাজ আদায় করা । তারপর আমি জিজ্ঞেস করলাম, নামাজের পর কোন আমলটি তার কাছে সবচেয়ে প্রিয়? উত্তর দিলেন, মাতা পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করা । আমি পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কোনটি? প্রতিউত্তরে নবীজী বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। (বুখারী শরীফ)
‌হাদীসটিতে দীনের কাজ বিন্যাস করা হয়েছে যথাক্রমে– এক. নামাজ আদায় করা। দুই. মাতা-পিতার সাথে উত্তম ব্যবহার করা। তিন. আল্লাহর রাহে জিহাদ করা।

নেক কাজের প্রতি স্পৃহা
এ প্রসঙ্গে আমাদেরকে দুটি বিষয় জানতে হবে। এক. হাদীসের প্রতি দৃষ্টি দিলে বুঝা যায়, সাহাবায়েকেরাম বিভিন্ন সময়ে রাসূলুল্লাহ -এর নিকট এ জাতীয় প্রশ্ন করেছেন। এতে সাহাবায়েকেরামের জানার স্পৃহা ও আমলের জযবা ফুটে উঠে। আল্লাহ ও তাঁর রাসুল -এর নিকট যে আমলটি বেশি প্রিয়, সেই আমলটি করার জন্য তারা উদগ্রীব থাকতেন, চেষ্টা করতেন। তাই তাদের হৃদয়ে সবসময় আখেরাতের ভাবনা থাকতো। তাদের একান্ত কামনা ছিল একটাই; আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে রাজি-খুশি করা। এ উদ্দেশ্যে, তারা সর্বোত্তম আমল খুঁজে বেড়াতেন। আজকাল আমরা ফাজায়েলে হাদিসে বিভিন্ন আমলের তাৎপর্য শুনি ও পড়াশোনা করি। তবুও আমল করার প্রতি জযবা সৃষ্টি হয় না। অথচ সাহাবায়েকেরাম ক্ষুদ্র একটি আমলের খবর জানার সঙ্গে সঙ্গে আমল করার জন্য সক্রিয় হয়ে উঠতেন।

হায়, আমি অনেক কিরাত খুইয়ে ফেলেছি!
একবারের ঘটনা। হযরত আবু হুরায়রা রাযি. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাযি.-এর সামনে একটি হাদিস পড়লেন যে, রাসূলুল্লাহ বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলমান ভাইয়ের জানাজায় শরিক হবে, সে এক কিরাত সাওয়াবের অধিকারী হবে। যে ব্যক্তি জানাযার নামাজের পর জানা যায় পেছন পেছন যাবে সে দুই কিরাত সাওয়াব লাভ করবে। আর যে দাফনেও অংশগ্রহণ করবে সে তিন কিরাত সাওয়াব পাবে।’ অন্য এক হাদীসে এসেছে, ‘এক কিরাত ওহুদ পাহাড়ের চেয়েও পরিমাণে বেশি।’ হযরত আবু হুরায়রা রাযি.-এর মুখে হাদীসটি যখন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাযি. শুনলেন, তিনি আফসোস করে উঠলেন, ‘হায়, আমি ইতোপূর্বে হাদীসটি শুনি নি! আমার অনেক কিরাত সাওয়াব ছুটে গেছে।’ অর্থাৎ আমার জানা ছিল না, জানাজার নামাজে শরিক হলে, জানাজার পিছনে পিছনে গেলে এবং দাফনে অংশগ্রহণ করলে এত বেশি সাওয়াব পাওয়া যায়। আমার জানা না থাকার কারণে বহু কিরাত সাওয়াব থেকে আমি বঞ্চিত হয়ে গেছি।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাযি. ছিলেন একজন সাহাবী, তার জীবনের একমাত্র কর্মসূচি ছিল, সুন্নতের উপর আমল করা এবং রাসূলুল্লাহ -এর নির্দেশ মোতাবেক চলা। যারা আমলনামায় নেকির পাহাড় খাড়া, শিশু তবু তিনি একটি নতুন আমলের খোঁজ পেয়ে আফসোসে ফেটে পড়েন। হায়, আমি কেন এ পর্যন্ত আমলটি করি নি… কেন এর যথাযথ গুরুত্ব দেই নি!

প্রশ্ন একটি উত্তর কয়েকটি
এজন্য সাহাবায়েকেরাম রসুলুল্লাহ জিজ্ঞেস করতেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! সবচেয়ে উত্তম আমল কোনটি?’ হাদীসশাস্ত্র মন্থন করলে পাওয়া যাবে প্রশ্নটির উত্তর রাসুল বিভিন্নভাবে দিয়েছেন। একেক সময় একেকভাবে দিয়েছেন। যেমন, এই হাদীসে রাসূলুল্লাহ বলেছেন, সবচেয়ে উত্তম আমল হলো, সময় মত নামাজ আদায় করা। এর আগে একটা হাদীসে বলা হয়েছে, এক সাহাবীর প্রশ্নের উত্তরে রাসূলুল্লাহ বলেছেন, সবচেয়ে উত্তম আমল হলো, আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমে জিহ্বাকে সিক্ত রাখা। অর্থাৎ, চলাফেরায় উঠা বসায় সর্বদায় আল্লাহর জিকির করা। এটা আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় আমল।
অপর এক হাদীসে এসেছে, সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! সর্বোত্তম আমল কোনটি? রাসূল বললেন, সর্বোত্তম আমল পিতা-মাতার খেদমত করা। আরেক সাহাবী প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! সর্বোত্তম আমল কোনটি? নবীজি জবাব দিলেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা সবচেয়ে উত্তম আমল।
মোটকথা প্রশ্ন ছিল একটি কিন্তু রাসূলুল্লাহ এক এক সাহাবীকে একেকটি উত্তর দিলেন। সাধারণ দৃষ্টিতে মনে হবে উত্তরগুলো পারস্পরিক সাংঘর্ষিক। আসলে কিন্তু সাংঘর্ষিক নয়। মূলত রাসুলুল্লাহ উত্তর দেওয়ার সময় লক্ষ্য রেখেছেন প্রশ্নকারী সাহাবীর মন ও মানসিকতার প্রতি।

সকলের বেলায় উত্তম আমল এক নয়
প্রকৃত কথা হল, অবস্থার প্রেক্ষাপটে আমল বিভিন্ন হয়। কারো জন্য সময় মত নামাজ পড়া সর্বোত্তম আমল। কারো ক্ষেত্রে মাতা পিতার সেবা করা সর্বোত্তম আমল। কারো বেলায় জিহাদ করা সর্বোত্তম আমল। কারো ক্ষেত্রে আল্লাহর জিকির সর্বোত্তম আমল। সর্বোত্তম আমলের এই বিভিন্নতা অবস্থার আলোকে ও মানুষ অনুপাতে হয়। যেমন, হয়তো প্রশ্নকারী সাহাবী নামাজের খুব পাবন্দী করতেন কিন্তু মা বাবার খেদমতের উদাসীনতা দেখাতেন। রাসুলুল্লাহ তার বেলায় বললেন, সর্বোত্তম আমল মাতা-পিতার খেদমত করা। কারণ নামাযের পাবন্দী তার তো আছেই। সুতরাং তার জন্য যথোপযুক্ত উত্তর ছিল এটাই।
আবার দেখা গেল, এক সাহাবী জিহাদ ও ইবাদতে কাজ করে খুব উদ্দীপনার সাথে। কিন্তু আল্লাহর যিকির করে নিতান্ত অনাগ্রহের সাথে। সুতরাং তার ক্ষেত্রে সঠিক ও যথার্থ উত্তর হবে এটাই যে, সর্বোত্তম আমল হলো আল্লাহর জিকির করা।
এভাবে রাসূলুল্লাহ হেকমতপূর্ণ উত্তর দিয়েছেন। অবস্থার আলোকে এবং প্রশ্নকারীর মন মানসিকতা বিবেচনা করে বিজ্ঞোচিত জবাব দিয়েছেন।
বিষয়টিকে সংক্ষেপে এভাবেও বলা যায় যে, সময় মত নামাজ পড়া, মাতা পিতার সেবা করা, সব সময় আল্লাহর জিকির করা, জিহাদ করা–এসবই সর্বোত্তম আমল। তবে প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলে বিবেচনা অভিন্ন হবে।

নামাজের ফজিলত
আলোচ্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ উত্তর সময়ের মধ্যে ক্রমবিন্যাস করেছেন। বলেছেন, সর্বোত্তম আমল সময় মত নামাজ পড়া। শুধু নামাজ পড়া নয় বরং সময়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে নামাজ পড়া। অনেক সময় মানুষ নামাজের সময়ের প্রতি গুরুত্ব দেয় না। ওয়াক্ত পার হয়ে যায়, নামাজি মনে করে, এতে কী হয়েছে! কাযা হচ্ছে তো হতে দাও! এটা কোন নামাজির জন্য একেবারেই উচিত নয়। নামাজ সর্বদা সময় মত আদায় করার অভ্যাস করবে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন,

‏فَوَيْلٌ لِّلْمُصَلِّينَ، الَّذِينَ هُمْ عَن صَلاتِهِمْ سَاهُونَ

ঐ সকল নামাজিদের জন্য আফসোস, যারা নিজেদের নামাজের ব্যাপারে থাকে বেহুঁশ। ওয়াক্ত চলে যায় অথচ নামাজের খেয়াল থাকে না। অবশেষে নামাজ কাজা হলে পরে হুঁশ আসে।
এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ বলেছেন,

الَّذِي تَفُوتُهُ صَلاَةُ العَصْرِ، كَأَنَّمَا وُتِرَ أَهْلَهُ وَمَالَهُ

যার আসল নামাজ ছুটে গেল তার যেন অর্থবৈভব এবং পরিজন-পরিবার লুট হয়ে গেল। সে যেন একেবারে নিঃস্ব রিক্তহস্ত হয়ে গেল।
সুতরাং নামাজ কাজা করা খুবই জঘন্য কাজ। এর জন্য কঠিন সতর্কবাণী এসেছে। তাই নামাজের খেয়াল রাখা প্রয়োজন। যথাসময়ে নামাজ আদায়ের পুরোপুরি চেষ্টা করা আবশ্যক।

জিহাদের ফজিলত
আলোচ্য হাদীসের ক্রমধারামতে দ্বিতীয় স্তরের উত্তম কাজ হলো, বাবা-মায়ের খেদমত করা। তৃতীয়তে উল্লেখ করা হয়েছে, আল্লাহর রাহে জেহাদ করা। মাতাপিতার সেবার সূচিবিন্যাস জিহাদের মতো মহান আমলেরও উপরে। অথচ জিহাদ এত বড় আমল যে, হাদীস শরীফে এসেছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে জিহাদ করে শহীদ হয়ে যায় আল্লাহ তাকে সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুর মত পবিত্র করে তোলেন। অপর হাদীসে এসেছে, মুমিন বান্দা মৃত্যুর পর আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্য লাভে ধন্য হবে, আল্লাহর দিদার লাভে দীপ্ত হবে, জান্নাতে তার দর্শন পাবে। তখন তার অন্তরে দুনিয়ায় পুনরায় আসার কোনো আকাঙ্ক্ষা জাগবে না। কারণ তখন তার সামনে দুনিয়ার স্বরূপ উন্মোচিত হয়ে যাবে, জান্নাতের তুলনায় দুনিয়ার তুচ্ছতা প্রতিভাত হবে। দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী, দুনিয়ার সুখশান্তি স্বল্পমেয়াদী; জান্নাত চিরস্থায়ী, জান্নাতের সুখ শান্তি দীর্ঘমেয়াদী–এসব বিষয়ে তার সামনে স্পষ্ট হয়ে যাবে। তাই সে দুনিয়াতে ফিরে আসার কামনা করবে না। কিন্তু যে ব্যক্তি জিহাদ করেছে এবং শহীদ হয়েছে সে তামান্না জানাবে, আহা! দুনিয়াতে যদি আবার যাওয়া যেত তাহলে ফের আল্লাহর রাহে জিহাদ করতাম । পুনরায় শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করতাম। এজন্য রসুলুল্লাহ বলেছেন, আমার হৃদয়ের তামান্না হল, আমি আল্লাহর পথে জিহাদ করে জীবন বিলিয়ে দেই। তারপর পুনরায় জীবিত হয়ে শহীদ হয়ে যাই আবার জীবিত হই এবং শহীদ হয়ে যাই।
মোটকথা, জান্নাতের ঠিকানায় পৌঁছে মানুষ দুনিয়ায় ফিরে আসার কামনা করবে না। কিন্তু শুধুই শহীদগণ ফিরে আসার বাসনা করবে। এই হলো, জিহাদের মর্যাদা।

মাতা পিতার হক
পার্থিব জগতে রয়েছে হাজারো ভালোবাসা। রয়েছে বহু ধরনের সম্পর্ক। এসব সম্পর্ক ও ভালোবাসার মাঝে লুকিয়ে থাকে কোনো না কোনো স্বার্থ। কোনো না কোনো আশা। ভালবাসার বিচিত্র এই ভুবনে নির্ভেজাল শুধু একটাই তাহলো, সন্তানের প্রতি মাতা-পিতার মায়া-মমতা। এটা তাদের স্বভাবজাত। এর মাঝে থাকে না কোনো স্বার্থ । থাকে না কোনো উদ্দেশ্য। এছাড়া অন্য কোনো মহব্বত বেগরজ নয়। নিঃস্বার্থ নয়। যেমন স্বামীস্ত্রীর ভালবাসা এর মধ্যে লুকিয়ে থাকে অনেক আশা-ভরসা। ভাইয়ের সঙ্গে মহব্বত। তাতেও থাকে আদান-প্রদান।
মোটকথা, দুনিয়ার সমূহ সম্পর্ক উদ্দেশ্যমুক্ত দাবি করা যাবে না। কেবল একটি মহব্বত একটি স্নেহ ও মায়া সকল স্বার্থ থেকে মুক্ত। তাহলো মাতা-পিতার মায়া ও করুণা। মাতা-পিতার মহব্বত একেবারে নির্ভেজাল। সম্পূর্ণ নিখাঁদ। এমনকি সন্তানের জন্য তাদের আবেগ এত বেশি থাকে যে, প্রয়োজনে নিজেকে বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত থাকে। এজন্য আল্লাহ তাআলা তাদের হকসমুহের মূল্যায়ন করেছেন। এমনকি তাঁর পথে জিহাদ করার চেয়েও মাতা-পিতার হককে অধিক প্রাধান্য দিয়েছেন।

মাতা-পিতার সেবা
‌হাদীস শরীফে এসেছে, এক সাহাবী নবীজী -এর দরবারে এসে আরজ করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার আন্তরিক ইচ্ছা হলো, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবো। উদ্দেশ্য, শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং সওয়াব প্রাপ্তি। শুধু এই উদ্দেশ্যে আমি জিহাদে যেতে চাই। রাসূল বললেন, তুমি কি সত্যিই সাওয়াবের নিয়তে জিহাদে যেতে চাও? উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, আল্লাহ রাসুল! এটাই আমার উদ্দেশ্য। রাসূলুল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন, তোমার পিতা-মাতা কি বেঁচে আছেন? সাহাবী উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, তারা জীবিত আছেন। রাসূলুল্লাহ বললেন, যাও বাড়িতে ফিরে যাও। পিতা-মাতার খেদমত করো। তুমি মাতা-পিতার খেদমতে যে সব পাবে জিহাদ করে সেসব পাবে না।
‌ এক বর্ণনায় এসেছে,

فَفِيهِمَا فَجَاهِدْ

যাও, তাদের খেদমতে আত্মনিয়োগ করার মাধ্যমে জিহাদ করো।

এ হাদিসে মাতা-পিতার খেদমত কে জিহাদের চেয়েও অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। (বুখারী শরীফ)

নিজের কামনা পূর্ণ করার নাম দীন নয়
আমাদের শায়েখ ডা. আব্দুল হাই রহ. একটি কথা বলতেন। হৃদয়পটে যত্ন করে রাখার মত কথা। তিনি বলতেন, ভাই, নিজের কামনা পূর্ণ করার নাম দীন নয় বরং দীন হল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করার নাম। প্রথমে লক্ষ্য রাখবে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কী চান। সেটা পূর্ণ করো। এটাই দীন। নিজ আগ্রহ, আবেগ, কামনাবাসনা পূর্ণ করার নাম দীন নয়। যেমন কারো আগ্রহ সৃষ্টি হল, প্রথম কাতারে নামাজ পড়ার প্রতি। কারো মনে জাগলো জিহাদ করবো। কারো মনে চাইল দাওয়াত তাবলীগের সময় দিব। এসব তো অবশ্যই সওয়াবের কাজ। নিঃসন্দেহে এগুলোও দীনের কাজ। তবে তোমাকে দেখতে হবে, এই মুহূর্তে দীনের চাহিদা কী। যেমন তোমার মন চাইলো জামাতের প্রথম কাতারের শরিক হওয়ার অথচ ঘরে তোমার মাতাপিতা খুবই অসুস্থ, নড়াচড়া পর্যন্ত করতে পারছেন না। তাহলে এই মুহূর্তে জামাতে শরিক হওয়ার চেয়েও মাতাপিতার খেদমত করার গুরুত্ব অধিক। এই মুহূর্তে আল্লাহ তোমার থেকে এটাই চান। তাই এই মুহূর্তে তোমার কর্তব্য হবে, ঘরে একাকী নামাজ সেরে নেওয়া এবং মা-বাবার-খেদমতে পরিপূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করা। এই মুহূর্তে যদি মা-বাবার-খেদমত রেখে তুমি চলে যাও মসজিদে জামাতে শরিক হতে তাহলে এটার নাম দীন নয়। বরং এটা হবে নিজের কামনাকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
অবশ্য শরীয়তের এ বিধান তখন প্রযোজ্য হবে যখন মসজিদ হবে দূরবর্তী অবস্থানে। যদি মসজিদ নিকটেই হয় সেখানে গেলে মা-বাবার-খেদমতে অসুবিধা হবে না তখন মসজিদে যাওয়াই শ্রেয়।

এটা দীন নয়
আমাদের শায়খ হযরত মাসিহ উল্লাহ খান রহ. এ সম্পর্কে একটি উপমা পেশ করেছেন। তা হলো যেমন, জনমানবহীন কোনো এক প্রান্তরে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই থাকে। ইত্যবকাশে নামাজের সময় হয়ে গেল। তাদের অবস্থান থেকে মসজিদ অনেক দূরে। স্বামী তার স্ত্রীকে বলল, নামাজের সময় হয়ে গেছে, আমি মসজিদে যাব, নামাজ পড়বো। স্ত্রী এটা শুনে ভয় পেয়ে গেল, বলল, তুমি আমাকে একা রেখে কোথায় যাবে? এখানে তো কেউ নেই। তুমি এভাবে চলে গেলে ভয় আমার প্রাণ বের হয়ে যাবে। তুমি যেওনা। স্বামী উত্তর দিল, জামাতের প্রথম কাতারে শরিক হওয়ার ফজিলত অনেক। আমাকে যেতেই হবে। ফজিলত অর্জন করতেই হবে। যা হবার তা হবে। আমি যাবোই।
হযরত মাসিক উল্লাহ খান রহ. বলেন, এটার নাম দীন নয়। এটা দীনের কাজ নয়। এটা হবে প্রথম কাতারে নামাজ আদায় করার আশা পূর্ণ করা। কারণ এই মুহূর্তে দীনের দাবি হলো, স্ত্রীকে একা ছেড়ে না যাওয়া এবং মসজিদের পরিবর্তে ঘরে একাকী নামাজ পড়ে নেওয়া। দীনের এদাবি যেহেতু উপেক্ষিত হল তাই এটা দীন হবে না। আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য হবে না।
অনুরূপভাবে বাড়িতে যদি মা-বাবা অসুস্থ থাকেন বিবি-বাচ্চা পীড়িত থাকে, যদি তাদের জন্য প্রয়োজন হয় আপনার খেদমত। অথচ আপনার মনে সৃষ্টি হলো তাবলিগে যাওয়ার সাধ। তাই আপনি বলে দিলেন যে, আমি তাবলীগে গেলাম তাহলে এটা দীন হল না। তাবলীগে যাওয়া অবশ্যই দীনের কাজ। সাওয়াবের কাজ। কিন্তু এই মুহূর্তের দাবি আপনার তাবলীগ নয় বরং এই মুহুর্তের দাবি হলো, খেদমত। এঅবস্থায় মা-বাবা কিংবা পরিবারের খেদমত আপনার জন্য তাবলীগের চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ । আল্লাহ ও তাঁর রাসূল -এর হুকুমও এটাই। তাই আপনাকে অবস্থার আলোকে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলেই হবে দীন। তাহলেই হবে ইতাআত তথা আনুগত্য। নিজের মনোবাসনা পূরণ করার নাম তো দীন নয়। আলোচ্য হাদিসে আপনি লক্ষ্য করেছেন, সাহাবী এসে আরজ করেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি জিহাদে যেতে চাই । নবীজি তাকে বাধা দিলেন এবং বললেন, তোমার জন্য নির্দেশ হলো, বাড়িতে যাও এবং মা বাবার খেদমত করো।

হযরত ওয়াইস করনী রহ.
হযরত ওয়াইস করনী রহ. নবীজির জামানায় জীবিত ছিলেন এবং মুসলমান ছিলেন। তার একান্ত বাসনা ছিল, নবীজির দরবারে গিয়ে সরাসরি তার সঙ্গে মোলাকাত করবেন, যার মোলাকাত ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে বড় নেয়ামত। তিনি যখন দুনিয়া থেকে বিদায় নিবেন তখন এমন সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে। হযরত ওয়াইস করনী নবীজিকে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার একান্ত চাওয়া-পাওয়া আপনার দরবারে হাজির হওয়া। কিন্তু আমার আম্মা অসুস্থ তার খেদমত প্রয়োজন। রাসুলুল্লাহ তাকে নিষেধ করে দিলেন এবং বললেন, তুমি আমার সাক্ষাতের জন্য এসো না বরং বাড়িতে থাকো এবং মায়ের খেদমত করো।
যার ঈমান ছিল ইস্পাতের মত মজবুত, যার অন্তরে তড়ফ ছিল। রাসূলুল্লাহ -এর প্রতি ভালোবাসায় যার হৃদয় বিগলিত ছিল। রাসুলুল্লাহ -কে একনজর দেখার জন্য যিনি ছিলেন মাতোয়ারা। সুতরাং তার হৃদয়ের অবস্থা কতটা পাগলপারা তা কি কল্পনা করা যায়! আজকের উম্মতের হৃদয়ের ব্যাকুলতার প্রতিই দেখুন না! নবীজির একজন উম্মত! কিভাবে কামনা করে রওজা শরীফের জিয়ারত! অথচ ওয়াইস করনী তখন জীবিত ছিলেন। তাহলে তার মনের অবস্থা না জানি কেমন ছিল! কিন্তু তিনি নিজের মনের বাসনাকে মনেই পুষে রাখলেন। রসুলুল্লাহ -এর হুকুমের সামনে নিজের কামনাকে কোরবান করে দিলেন। মায়ের খেদমতের জন্য এই মহান সৌভাগ্য ছেড়ে দিলেন। ফলে তিনি সাহাবী উপাধিতে ভূষিত হতে পারলেন না। অথচ একজন সাধারণ সাহাবীর মর্যাদাও এত বেশি যে, একজন অলি যত বড় অলি হোন না কেন, কিন্তু তিনি একজন সাধারণ সাহাবির মর্যাদার কাছেও যেতে পারেন না।

সাহাবায়েকেরামের মর্যাদা
অখ্যাত তাবেতাবেয়িন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ.। একজন প্রসিদ্ধ বুজুর্গ ফকিহ ও মুহাদ্দিস ছিলেন। একবার এক ব্যক্তি তাকে এক বিস্ময়কর প্রশ্ন করে বসলো যে, হযরত মুয়াবিয়া উত্তম নাকি হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ উত্তম?
প্রশ্নকর্তার প্রশ্নটি বিন্যাস ধারা ছিল এমন যে, তার প্রশ্নের ফুটে উঠেছে ওই সাহাবীর মর্যাদার কথা যে সাহাবীর সম্পর্কে কিছু লোক সমালোচনার ঝড় তোলে। আহলে সুন্নাতের আকিদা হলো, হযরত আলী রাযি. এবং হযরত মুয়াবিয়া রাযি.-এর মাঝে সংঘটিত যুদ্ধে আলী ছিলেন হকের উপর। আর হযরত মুয়াবিয়া রাযি.-এর ভুল ছিল ইজতেহাদী ভুল। এই মতটির উপর প্রায় সকলেই একমত।
যাহোক, প্রশ্নকারীর প্রশ্নের প্রথম দিকটিতে রয়েছেন যার সম্পর্কে অনেকে বিতর্কে লিপ্ত। আর প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশে রয়েছেন ঐ তাবিয়ী যার সততা পবিত্রতা ন্যায়পরায়ণতা এবং তাকওয়া ও পরহেজগারি ছিল সর্বজনবিদিত। যাকে বলা হত ওমরে সানী তথা দ্বিতীয় ওমর। যিনি ছিলেন হিজরী দ্বিতীয় শতকের মুজাদ্দিদ। আল্লাহ তাআলা যাকে অনেক গুণ ও মর্যাদা দান করেছিলেন। কিন্তু লক্ষ্য করুন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক কী উত্তর দিয়েছেন! তিনি উত্তর দিয়েছিলেন,
ভাই, তোমার প্রশ্ন হল, হযরত মুয়াবিয়া এবং আব্দুল আজিজ এর মাঝে কে সর্বাধিক উত্তম? শোনো ভাই, হযরত মুয়াবিয়া এর ব্যক্তিত্ব তো অনেক দূরের কথা; বরং রাসূলুল্লাহ -এর সাথে জিহাদ করতে গিয়ে যেসব ধূলিকণা হযরত মুয়াবিয়ার নাকের ছিদ্রে প্রবেশ করেছিল সেগুলোও হাজার হাজার ওমর বিন আব্দুল আজিজ এর চেয়েও অনেক উত্তম। কারণ আল্লাহ তাআলা হযরত মুয়াবিয়া রাযি.-কে সাহাবী হওয়ার সৌভাগ্য দান করেছেন। এ মহান মর্যাদা লাভ করার চেষ্টা যদি মানুষ সারাজীবনও করে তবুও তার ভাগ্যে জুটবে না। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)

মায়ের খেদমতে নিয়োজিত থাকো
যাহোক রাসুলুল্লাহ উয়াইস কারনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, আমার সঙ্গে সাক্ষাতের প্রয়োজন নেই। সাহাবী হওয়ার মর্যাদা লাভের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন তোমার মায়ের খেদমতে থাকা। তাই তুমি মায়ের খেদমতে থাকো।আমাদের মতো নির্বোধ কেউ হলে তো বলে বসত, সাহাবী হওয়ার সৌভাগ্য তো আর পরে পাওয়া যাবে না। মা অসুস্থ তো কী হয়েছে! এমনিতে বিভিন্ন প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে যেতে হয়। নবীজির সাক্ষাৎ তো একটি বিরাট প্রয়োজন। সুতরাং আমি যাব এবং সাক্ষাৎ করে আবার চলে আসব। কিন্তু ওয়াইস কারনী এমনটি করেন নি।
কারণ নিজের আবেগ কিংবা বাসনা পূরণ করা তার নিকট মুখ্য বিষয় ছিল না। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহ ও তাঁর রসূলের হুকুম পালন করা।তাই তিনি নিজের আবেগকে কোরবান করলেন এবং নিজেকে মায়ের খেদমতে নিয়োজিত রাখলেন। ইতোমধ্যে রাসুলুল্লাহ ইন্তেকাল করলেন। ওয়াইস করনীর নবীজির মোলাকাত আর ভাগ্যে জুটলো না।

মায়ের খেদমতের পুরস্কার
কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাকে মায়ের খেদমতের পুরস্কার দিলেন। রাসূলুল্লাহ হযরত ওমরকে বলে গিয়েছেন, করন নামক স্থান থেকে এক ব্যক্তি মদিনায় আসবে। তার আকৃতি ও গঠন এরকম হবে। যদি তুমি তার দেখা পাও তাহলে তার দ্বারা তোমার জন্য দোয়া করাবে। আল্লাহ তা’আলা তার দোয়া কবুল করবেন।
ইতিহাসে রয়েছে, হযরত ওমর প্রতিদিন ওই মহান ব্যক্তির অপেক্ষায় থাকতেন। ইয়ামানের কোনো কাফেলা মদিনাতে প্রবেশ করামাত্র তিনি সেখানে ছুটে যেতেন এবং জিজ্ঞেস করতেন, কাফেলায় ওয়াইস করনী আছে কি? একবার সত্যি সত্যি এক কাফেলার সঙ্গে তিনি আসলেন। ওমর খুশিতে আন্দোলিত হলেন। তার কাছে নিজেই হাজির হলেন। নাম জিজ্ঞেস করলেন। নবীজি যে গঠনাকৃতি বলেছিলেন তার সাথে হুবহু মিল খুঁজে পেলেন। তারপর তিনি দরখাস্ত করলেন, আমার জন্য দোয়া করুন। ওয়াইস করনী বললেন, আমার দোয়ার জন্য আপনি কেন এত ব্যাকুল হলেন? ওমর উত্তর দিলেন, এটা আমার নবীজি -এর নির্দেশ। তিনি বলেছেন, আল্লাহ আপনার দোয়া কবুল করবেন। ওমর এর কাছে এ তথ্য শুনে ওয়াইস করনী চোখের পানি ছেড়ে দিলেন। তিনি এই বলে অঝোরধারায় কেঁদে চললেন যে, আল্লাহর রাসূল আমাকে এই গৌরব দান করলেন!

মাতা-পিতার খেদমতের ফজিলত
এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ বলেছেন, মাতা-পিতার খেদমত সকল ইবাদতের উপর প্রাধান্য পাবে। কোরআন মজিদেও এই প্রসঙ্গে একাধিক আয়াত রয়েছে,

وَوَصَّيْنَا الْإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ إِحْسَانًا

‘আমি মানবসম্প্রদায়কে উপদেশ দিয়েছি যে, তারা যেন নিজেদের মাতা-পিতার সঙ্গে সদাচরণ করে।’
অন্য আয়াতে এসেছে,

وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا

‘আপনার প্রভূ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত আর কারো ইবাদত করবে না এবং মাতা-পিতার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে।’

এখানে মাতা-পিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করার বিষয়টি তাওহীদের সাথে আলোচিত হয়েছে। তাওহীদের পর সর্বপ্রথম দায়িত্ব ও কর্তব্য কী হবে; তা বলে দেয়া হয়েছে। আর তাহল, মাতা-পিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা।

মাতা-পিতা যখন বৃদ্ধ হবে
তারপর মহান আল্লাহ উপদেশের ভঙ্গিতে বলেন,

إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِندَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلاَهُمَا فَلاَ تَقُل لَّهُمَآ أُفٍّ

‘তোমাদের জীবদ্দশায় মাতা-পিতা যখন বার্ধক্যে উপনীত হবে তখন তাদের ক্ষেত্রে ‘উফ’ শব্দটিও উচ্চারণ করো না।’
বার্ধক্যের আলোচনা সবিশেষ করা হয়েছে। কারণ বার্ধক্যের প্রভাবে অনেক ক্ষেত্রে মানুষ স্বাভাবিক থাকে না। তখন অহেতুক কিংবা ভুল কথা নিয়েও মানুষ বাড়াবাড়ি করতে থাকে। তাই আল্লাহ তাআলা বিশেষভাবে বার্ধক্যের কথা তুলে ধরেছেন যে, তোমার মাতা-পিতা এ বয়সে উপনীত হলে হয়তো ভুল অথবা অন্যায় আচরণও দেখাতে পারে– এটা অসম্ভব কোন কিছু নয়। তবে তোমার কর্তব্য হলো, তাঁদের সাথে কোমল আচরণ করবে। কখনো বিরক্তি কিংবা অনীহা প্রকাশ করবে না। এরপর আল্লাহ তাআলা আরো বলেছেন,

وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُل رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِى صَغِيراً

‘তাদের সামনে বিনয়ের ডানা বিছিয়ে দিবে, দোয়া করতে থাকবে, হে আল্লাহ! তাদের উপর রহম করুন, যেভাবে তারা শিশুকালে আমাকে দয়া করে প্রতিপালন করেছেন।
বৃদ্ধকালে মেজাজে রুক্ষতা চলে আসে তাই বিশেষভাবে বৃদ্ধকালের অবস্থার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। অন্যথায় মাতা-পিতা সর্বাবস্থায়ই ভক্তি-শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র। তাঁদের কার্যকলাপে কখনো অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা উচিত নয়।

শিক্ষনীয় ঘটনা
পড়ছিলাম কোন এক বইয়ে। জানিনা ঘটনাটি সত্য না মিথ্যা। তবে এটি শিক্ষণীয় উপদেশমূলক চমৎকার একটি ঘটনা। এক বৃদ্ধ ছেলেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছিলেন। বৃদ্ধ একদিন ঘরের বারান্দায় বসে ছিলেন। ইতোমধ্যে একটি কাক উড়ে এসে ঘরের দেয়ালে বসলো। বৃদ্ধ নিজের ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, বাবা, এটা কী? ছেলে বলল, আব্বা, এটা একটি কাক। খানিক পর বৃদ্ধ আবার ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, বাবা, এটা কী? ছেলে এবারও উত্তর দিল, আব্বা, এটা একটা কাক। আরো কিছুক্ষণ পর বৃদ্ধ-পিতা ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, বাবা, এটা কী? ছেলে এবার চটে গেল। তার স্বরে পরিবর্তন দেখা দিল। সে ধমকের স্বরে উত্তর দিল, কাক, কাক। বৃদ্ধ এবার একটু সময় নিয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করে বসলেন, বাবা, এটা কী? এবার ছেলের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। সে ধমকের সুরে বলল, একটা কথা বারবার জিজ্ঞেস করছেন কেন! হাজার বার বলছি, এটা একটা কাক! এতবার বলার পরেও আপনার বুঝে আসে না? এভাবে ছেলে বৃদ্ধ-পিতাকে শাসাতে লাগল।

একটু পর বৃদ্ধ সেখান থেকে উঠে গেলেন। ঘরে গিয়ে একটি পুরাতন ডাইরি বের করলেন। ডাইরির একটি পাতা খুলে ছেলের কাছে আসলেন এবং বললেন, বাবা, এই পাতাটি একটু পড়ো। দেখো তো আমি কী লিখেছি।

ছেলে পড়তে লাগলো, লেখা আছে যে, বাবা লিখেছেন, ‘আজ বারান্দায় বসা ছিলাম। সঙ্গে ছিল আমার ছোট ছেলে। ইত্যবসরে একটি কাক আসলো। ছেলে আমাকে পঁয়ত্রিশ বার জিজ্ঞেস করল, আব্বাজান এটা কী? আমি পঁয়ত্রিশ বারই গুরুত্বসহ উত্তর দিয়েছি, বাবা, এটা একটা কাক। ছেলেটা যতবারই প্রশ্ন করেছে, ততবারই আমার কাছে ভালো লেগেছে।’

ছেলে লেখাটা পড়া শেষ করলে বাবা বললেন, বৎস! পিতা আর সন্তানের মধ্যে পার্থক্য এখানেই। তুমি যখন ছোট ছিলে তখন পঁয়ত্রিশ বার আমাকে একই প্রশ্ন করেছিলে। আর আমিও আনন্দচিত্তে শান্তভাবে উত্তর দিয়েছিলাম। অথচ আজ আমি মাত্র পাঁচ বার জিজ্ঞেস করলাম। আর এতে তুমি রেগে গেলে।

মাতা পিতার সঙ্গে সদাচরণ
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন। মনে রেখো, বুড়ো হয়ে গেলে মাতা-পিতার মাঝে খিটখিটে মেজাজ চলে আসে। এটা স্বাভাবিক। তাঁদের অনেক কথা তখন মনে হবে বিরক্তিকর ও অহেতুক। তখন মনে রাখতে হবে, এর চেয়েও বিরক্তিকর ও অহেতুক কথা তোমার ছোট বেলায় তাঁরা সহ্য করেছিলেন। সুতরাং তোমরাও তাঁদের অপ্রাসঙ্গিক কথা-বার্তা সহ্য করতে হবে। এমনকি যদি তাঁরা কাফেরও হয় তবুও। পবিত্র কোরআনের বক্তব্য শুনুন,

وَإِن جَاهَدَاكَ عَلَىٰ أَن تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا ۖ وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا

‘তোমাদের মাতা-পিতার যদি কাফের-মুশরিক হন তাহলে এই গর্হিত কাজে তোমরা তাদের অনুসরণ করবে না। কিন্তু সাধারণ জীবনযাপনে তখনও তোমরা তাদের কথাবার্তা মেনে চলতে হবে। কারণ তারা কাফের হলেও তাঁরা তোমার আব্বা, তোমার আম্মা।
মাতাপিতার আনুগত্য এবং তাঁদের সঙ্গে উত্তম আচরণের জন্য অত্যন্ত জোরালোভাবে বলা হয়েছে। অথচ বর্তমান দুনিয়ার স্রোত চলছে উল্টোদিকে। চলছে নিয়মতান্ত্রিক প্রশিক্ষণ। মাতা-পিতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সন্তানের হৃদয় থেকে মুছে ফেলার প্রশিক্ষণ। বলা হচ্ছে, মাতা-পিতা মানুষ। আমরাও মানুষ। আমাদের মাঝে এবং তাঁদের মাঝে কোনো ব্যবধান নেই। আমাদের উপর তাদের আবার কিসের অধিকার! মানুষ যখন দীন থেকে দূরে সরে যায়, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য যখন মূল্যহীন দেখা দেয়, যখন আখেরাতের ভাবনা মানুষ থেকে উঠে যায় তখনই বের হতে পারে এ জাতীয় জঘন্য কথা!

আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করুন। আমীন।

মাতা-পিতার নাফরমানী
মাতা-পিতার আনুগত্য ওয়াজিব। তাঁদের আদেশ-নিষেধ সন্তানের জন্য অপরিহার্য। এটা শরীয়তের বিধান। নামাজ-রোজার মতই একটি অপরিহার্য বিধান। তবে এখানে একটা শর্ত আছে তা হলো, মাতা-পিতার নির্দেশ হতে হবে ইসলামের গণ্ডির ভেতরে। ইসলামের গন্ডি থেকে যদি মাতা-পিতা কোন নির্দেশ দেন তাহলে তা পালন করা ওয়াজিব। পালন না করলে ঠিক এমন গুনাহ হবে যেমন হয় নামাজ ছেড়ে দিলে। একেই বলা হয় মাতা-পিতার নাফরমানী। বুযুর্গানে দ্বীন বলেন, মাতা-পিতার নাফরমানীর শাস্তি হলো, মৃত্যুকালে কালিমা নসীব হবে না।

উপদেশ মূলক কাহিনী
এক লোক মৃত্যুশয্যায় শায়িত। তখন উপস্থিত লোকজন বার বার চেষ্টা করছিলেন তার মুখ থেকে কালেমা বের করার। সবাই বে-কারার। অথচ তার মুখ থেকে কালিমা বের হচ্ছে না। তাই তারা নিরুপায় হয়ে এক বুজুর্গের কাছে গিয়ে বৃত্তান্ত খুলে বললেন। বুজুর্গ পরামর্শ দিলেন, তার মাতা-পিতাকে জীবিত থাকলে লোকটিকে তাৎদের কাছে নিয়ে যাও এবং তাঁদের মাধ্যমে মুক্তির দোয়া করাও। মনে হয় সে নিজের মাতা-পিতার নাফরমানী করেছে যার ফলে তার ওপর এর শাস্তি নেমে এসেছে। তাদের পক্ষ থেকে মাফ না হওয়া পর্যন্ত মনে হয় এর মুখে কালিমা আসবে না।
বোঝা গেল, মাতা-পিতার নাফরমান্‌ তাদের হৃদয়ে আঘাত দেওয়া জঘন্য ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। নবীজী শিক্ষার প্রতিটি ছত্রে ছত্রে এ ব্যাপারে কঠোর বাণী উচ্চারণ করেছেন। কোনো সাহাবী তাঁর কাছে পরামর্শের জন্য আসলে তিনি মাতা-পিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিতেন।

ইলম শিক্ষার জন্য মাতা-পিতার অনুমতি
আমাদের এখানে (দারুল উলুম) অনেক ছাত্র ভর্তি হতে আসত। ইলমের প্রতি যাদের স্পৃহা থাকত। কিন্তু যখন তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয়, মা-বাবার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে এসেছ কি? তখন জানা যায়, তারা অনুমতি ছাড়াই এসেছে। তারা ওজর পেশ করে বলে, কী করবো; বাবা-মা’র অনুমতি পাওয়া যাচ্ছে না! আমি তাদেরকে বলি, মৌলভী হওয়া কোনো ফরয-ওয়াজিব নয়। মা-বাবাকে মেনে চলা ওয়াজিব। ইলম তোমার জন্য কেবল ততটুকুই ফরয যতটুকু না হলে ইসলামের উপর চলা যাবে না। যেমন নামাজ পড়ার নিয়ম কানুন জানা তোমার জন্য ফরজ। এতোটুকুই ইলম অর্জনে যদি তোমার মাতা-পিতা বাধা দেন তাহলে তখন তাদের কথা না মানলেও চলবে। কিন্তু মৌলভী হওয়া ফরজ নয়। সুতরাং মা-বাবার অনুমতি ছাড়া তোমার মৌলভী হওয়ার খায়েশ পুরা করা জরুরি নয়। আমার হযরতের ভাষ্যমতে, তখন তাহলে খায়েশ পূর্ণ করা হবে। তখন তো দীনের কাজ হবে না। আল্লাহ আমাদের প্রত্যেককে সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন।

জান্নাত লাভের সহজ পথ
মনে রাখবেন, যতদিন মাতা-পিতা জীবিত থাকবেন ততদিন তাঁরা আপনার জন্য মহান নেয়ামত। যার তুলনা দুনিয়াতে আর নেই। যেমন হাদীস শরীফে এসেছে, নবীজি বলেছেন, যদি মহব্বতের সাথে একবার মাতা-পিতার প্রতি তাকাও তাহলে একটি হজ এবং একটি উমরাহর সাওয়াব পাবে।

এজন্য অন্য হাদীসে বলা হয়েছে, দুর্ভাগা ঐ ব্যক্তি যে নিজের মাতা-পিতাকে বৃদ্ধাবস্থায় পেয়েছে অথচ নিজের গুনাহ মাফ করাতে ব্যর্থ হয়েছে।

কারণ সন্তান ইচ্ছা করলে তাদের খেদমত করে সহজে জান্নাতে যেতে পারে। তাঁদের সামান্য খেদমত তোমার আখেরাতকে করে তুলবে নূরান্বিত। তাই মাতা-পিতা জীবিত থাকলে এ নেয়ামতের মূল্যায়ন করো। তাঁরা যখন দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবেন তখন বুঝে আসবে তাঁদের কদর। তখন ‘হায় আফসোস’ করলে কোনো কাজ হবে না। তাঁরা জীবিত থাকাকালে জান্নাত ছিল তোমার জন্য খুবই সহজ। তাঁদের মৃত্যুর পর যা হয়ে পড়বে খুবই কঠিন। তখন শত আফসোস বৃথা যাবে। তাই সময় থাকতে তাঁদের কদর করো।

মাতা-পিতার মৃত্যুর পর ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা
অনেকের ক্ষেত্রে এমন হয় যে, মাতা-পিতার ইন্তিকালের পর অনুভূতি জাগে, হায়! কত বড় নিয়ামত আমরা হারিয়ে ফেললাম! আমরা তাঁর কদর করতে পারলাম না। এমন অনুভূতিসম্পন্ন লোকের জন্য আল্লাহ তাআলা একটা ব্যবস্থা রেখেছেন। ইরশাদ হয়েছে, কেউ যদি মাতা-পিতার হক আদায় না করে থাকে, তাঁদের থেকে লাভবান হওয়ার সুযোগ হারিয়ে ফেলে তবে এর ক্ষতিপূরণের দু’টি পথ আছে।

এক- তাদের জন্য বেশি বেশি ইসালে সওয়াব করবে। দান-খয়রাত করে নফল নামাজ পড়ে সাধ্য অনুযায়ী তাদের জন্য সওয়াব পাঠাতে থাকবে। এর মাধ্যমে পূর্বের ক্ষতি পূরণ হবে।

দুই- মাতা-পিতার আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব ও আপনজনের সাথে সদাচরণ করবে। মা-বাবার সাথে যেমন ব্যবহার করা উচিত ছিল তাদের সাথে তেমন ব্যবহার করবে। এর ফলে আল্লাহ তাআলা পূর্ব ত্রুটির ক্ষতিপূরণ দেবেন। আল্লাহ আমাদেরকে আমল করার তৌফিক দান করুন। আমীন।

মায়ের তিন হক এবং পিতার এক হক

عن أبي هريره رضي الله عنه جَاءَ رَجُلٌ إلى رَسُولِ اللهِ، فَقالَ: مَن أَحَقُّ النَّاسِ بحُسْنِ صَحَابَتِي؟ قالَ: أُمُّكَ قالَ: ثُمَّ مَنْ؟ قالَ: ثُمَّ أُمُّكَ قالَ: ثُمَّ مَنْ؟ قالَ: ثُمَّ أُمُّكَ قالَ: ثُمَّ مَنْ؟ قالَ: ثُمَّ أَبُوكَ

সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, এক ব্যক্তি নবীজি -এর দরবারে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সারা বিশ্বের মানুষের মাঝে আমার সদাচরণ পাওয়ার সবচেয়ে বেশি হকদার কে? নবীজি উত্তর দিলেন, তোমার মা অর্থাৎ সবচেয়ে বেশি হকদার তোমার মা। লোকটি পুনরায় প্রশ্ন করল, তারপর কে? নবীজি উত্তর দিলেন, তোমার মা। লোকটি আবারও প্রশ্ন করল, তারপর কে? নবীজি এবারও উত্তর দিলেন, তোমার মা। সাহাবী চতুর্থবার একই প্রশ্ন করল যে, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তারপর কে? এবার নবীজী বললেন, তোমার পিতা।

রাসূলুল্লাহ তিনবার মায়ের কথা বলেছেন। চতুর্থবারে বাবার কথা বলেছেন। তাই এই হাদিসের আলোকে ওলামায়েকেরাম বলেছেন, বাবার চেয়ে মায়ের হক বেশি। কারণ সন্তান লালন-পালনে মায়ের ভূমিকা এবং কষ্ট পিতার চেয়েও বেশি। পিতা মায়েরর চারভাগের একভাগ কষ্টও করেন না বিধায় মায়ের নাম নেওয়া হয়েছে তিন বার। আর পিতার নাম নেওয়া হয়েছে একবার।

পিতার আজমত, মায়ের খেদমত
এজন্য বুযুর্গানে দ্বীন বলেছে্‌ পিতার তুলনায় মা হাদিয়া পাওয়ার অধিক উপযোগী। বুযুর্গানে দ্বীন আরো বলেছেন, এখানে মূলত দুইটি বিষয়। একটি হলো, আজমত তথা মর্যাদা প্রদর্শন। আর দ্বীতিয়টি হল, খেদমত ও সদাচারণ। প্রথম বিষয়টিকে প্রাধান্য পাবে বাবা। আর দ্বিতীয় বিষয়টির ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবে মা। আজমতের অর্থ হলো, পিতার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা অন্তরে রাখা। যেমন তার দিকে পা ছড়িয়ে বসে না থাকা। তার মাথার নিকট বসবে। এভাবে আদবের জন্য আরও যা করতে হয় সবগুলো করবে। এক্ষেত্রে পিতার হক প্রাধান্য পাবে। আর খেদমতের ব্যাপারে মায়ের হক প্রাধান্য পাবে। এমনকি পিতার চেয়েও তিনগুণ বেশি। এটা আল্লাহর অশেষ কুদরত যে, সন্তান আর মায়ের মাঝে এক বিশেষ গুণ রেখেছেন। যে গুণের কারণে সন্তান মায়ের সাথে যতটুকু ফ্রি থাকে, বাবার সাথে ততটুকু ফ্রি থাকে না। মায়ের সাথে সন্তানের আন্তরিকতা বেশি বিধায় এমন অনেক কথা আছে যা পিতার সামনে বলা যায় না। অথচ তা মায়ের সামনে নির্দ্বিধায় বলা যায়
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি রহ. ফাতহুল বারিতে বুযুর্গানে দীনের মূলনীতি আলোচনা করেছেন যে, পিতার আজমত হবে বেশি। আর মায়ের খেদমত হবে বেশি। উক্ত মূলনীতির মাধ্যমে হাদীস শরীফের সঠিক ব্যাখ্যা ফুটে উঠে।

মায়ের খেদমতের ফল
মায়ের খেদমত অনেক সৌভাগ্যের বিষয়। যার মাধ্যমে মানুষ উঁচু থেকে আরো উঁচু হয়। যেমন হযরত ওয়াইস করনী রহ.-এর ঘটনায় বিষয়টি দীপ্তিময় হয়ে উঠেছে। আরো অনেক বুজুর্গ সম্পর্কেও এজাতীয় ঘটনা আছে। যেমন ইমাম গাজ্জালী রহ. সম্পর্কে প্রসিদ্ধ আছে যে, তিনি দীর্ঘদিন কেবল মায়ের খেদমতের কারণে ইলম অর্জন করতে পারেন নি। কিন্তু যখন মায়ের খেদমত থেকে অবসর হলেন আল্লাহ তাআলা তাকে ইলমি জগতের উজ্জ্বল পুরুষ বানিয়ে দিলেন। তাই মাতা-পিতার খেদমত অবশ্যই এক মহান সম্পদ।

ফিরে যাও, তাঁদের খেদমত করো

عن عبداللَّه بن عمرو بن العاص رضي اللَّه عنهما قَالَ: أَقْبلَ رجُلٌ إِلى نَبِيِّ اللَّه فَقَالَ: أُبايِعُكَ عَلَى الهِجرةِ وَالجِهَادِ أَبْتَغِي الأَجرَ مِنَ اللَّه تعالى، قال: فهَلْ لكَ مِنْ والِدَيْكَ أَحدٌ حَيٌّ؟ قَالَ: نعمْ، بَلْ كِلاهُما، قَالَ: فَتَبْتَغِي الأَجْرَ مِنَ اللَّه تَعَالَى؟ قَالَ: نعمْ، قَالَ: فَارْجِعْ إِلى والِدَيْكَ فَأَحْسِنْ صُحْبَتَهُما

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছে্‌ এক লোক আল্লাহর রাসূল -এর খেতে এসে বলল, আমি আপনার নিকট দু’টি বিষয়ের উপর বাইয়াত গ্রহণ করতে এসেছি। একটি হলো, হিজরত। অপরটি হল জিহাদ। অর্থাৎ আমি নিজের মাতৃভূমি ত্যাগ করে হিজরতের উদ্দেশ্যে মদিনায় বসবাস করার ইচ্ছা পোষণ করেছি। আর উদ্দেশ্য হলো, আপনার সাথে জিহাদে শরীক হওয়ার। এর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাওয়াব লাভের আশা করি। রাসূল তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার পিতা-মাতা কি জীবিত আছেন? লোকটি জানালো, তাঁরা উভয়ই জীবিত আছেন। রাসূল বললেন, আসলেই কি তুমি সাওয়াব চাও? লোকটি  উত্তর দিল, হ্যাঁ, আমি সাওয়াব চাই। নবীজী বললেন, তাহলে তুমি মাতা-পিতার কাছে ফিরে যাও এবং তাদের খেদমত করো।

তাদের মুখে হাসি ফুটাও
মূলত হাদীসটিতে জিহাদের ফজিলতকে মাতা-পিতার খেদমতের কাছে বিসর্জন দেওয়া হয়েছে। লোকটিকে মাতা-পিতার খেদমতে ফেরত দেওয়া হয়েছে। এক বর্ণনায় এসেছে, একবার জিহাদের প্রস্তুতি চলছিল। ইত্যবসরে এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ -এর নিকট আরজ করল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি এসেছি জিহাদে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে। লোকটি গৌরবের সঙ্গে আরও জানালো, জিহাদে শরীক হওয়ার তামান্না আমার মাঝে এত বেশী যে, এর জন্য মাতা-পিতার কান্নাকেও উপেক্ষা করেছী। অর্থাৎ আমার মা-বাবা চান না আমি জিহাদে শরীক হই। তাই তাঁরা আমাকে জিহাদের অনুমতি দিচ্ছেন না। তবুও আমি জিহাদের উদ্দেশ্যে চলে এসেছি।  আমার বিরহ-বেদনায় তাঁরা কান্না জুড়ে দিয়েছিলেন। নবীজী তাকে বললেন,

ارجِع إليهِما فأضْحِكْهُما كما أبكيْتَهُما

ফিরে যাও, তাদের মুখে হাসি ফুটাও। যেমন তাদের কাঁদিয়েছিলে। আমার সঙ্গে তোমার জিহাদে শরীক হওয়ার অনুমতি নেই।

শরীয়তের পরিসীমা চলার নাম দীন
এর নাম হচ্ছে হিফযে হুদূদ তথা সীমানা রক্ষা করা এবং সে মতে চলা। এজন্য আমাদের শায়েখ বলতেন, দীন হল হিফযে হূদুদের নাম। জিহাদের ফজিলতের কথা শুনে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে জিহাদের উদ্দেশ্যে চলে যাওয়ার নাম দীন নয়। বরং আল্লাহ এবং তার রাসুল -এর নির্দেশের প্রতি লক্ষ্য রেখে চলার নাম দীন। আমার মুহতারাম আব্বাজান বলতেন, বর্তমানে মানুষ এক লাগামছাড়া হয়ে গিয়েছে। যেমন ঘোড়ার একটি লাগাম যদি ছিন্ন হয়ে যায় তখন সে কেবল এক দিকে দৌড়ে বেড়ায়। অন্যদিকে তার ভ্রুক্ষেপ থাকে না। অনুরূপভাবে মানুষ আজ এক লাগাম নিয়ে চলছে। যখন কোনো কাজের ফজিলতের কথা শুনে মানুষ শুধু ওই দিকে দৌড় দেয়। অন্যদিকে আর খেয়াল থাকে না। আর তার আরও বড় জিম্মাদারী পড়ে আছে– এটার প্রতি কোনো লক্ষ্য করে না। অথচ একজন মানুষের সব দিক খেয়াল করেই চলা উচিত।

মুত্তাকীদের সুহবত
হিফযে হুদুদ অর্জন হয় কোনো আল্লাহওয়ালার সাথে থাকলে। কোনো আল্লাহওয়ালা শায়খে কামেলের সংশ্রব ছাড়া এই দৌলত অর্জন করা যায় না। অন্যথায় আমি মুখে বলে দিলাম, কিতাবেও লেখা পেলাম, আপনারাও শুনে নিলেন হিফযে হুদূদের কথা। তথা কোন অবস্থায় কিভাবে চলতে হবে, কোন স্থানে কোনটাকে প্রাধান্য দিতে হবে, কোন কাজ কম-বেশি করতে হবে– এগুলোকে বলা হয় হিফযে হুদূদ। এসব কিছু সঠিকভাবে বলতে পারবেন একজন কামেল বুজুর্গ। কামেল শায়েখ ছাড়া এসব বিষয় সঠিকভাবে অনুধাবন করা খুবই কঠিনক। হযরত আশরাফ আলী থানবী রহ.-এর দরবারে আত্মশুদ্ধির জন্য কেউ গেলে অনেক সময় তিনি অজিফা বন্ধ করে অন্য কোনো কাজে লাগিয়ে দিতেন। যেহেতু তিনি বুঝতেন, এই লোককে অজিফা দিয়ে কাজ হবে না, তাকে অন্য কাজে লাগাতে হবে।

শরীয়ত, সুন্নাত, তরিকত
আমাদের হযরত ডাক্তার আব্দুল হাই রহ. বলতেন حقوق হল সম্পূর্ণ শরীয়ত। حدود হলো সকল সুন্নাত। তথা সুন্নতের মাধ্যমে জানা যায়, কোন হকের পরিসীমা কতটুকু। আল্লাহর হক কতটুকু এবং বান্দার হক কতটুকু; কোন হকের জন্য কী পরিমাণ আমল করতে হবে — তা রাসূলুল্লাহ -এর সুন্নাতের মাপকাঠিতে নির্ণয় করতে হবে। আর হিফযে হুদূদ তথা শরীয়তের সীমার হেফাজত হল, মূলত তরিকত। আর তরিকতের অপর নাম তাসাওউফ বা সুলূক। সুলূক বলা হয়, সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত আমলের নাম। সারকথা হলো, শরীয়ত মানে সকল হুকুক। সুন্নত মানে সকল হুদূদ। আর তরিকত মানে হুদূদের হেফাজত। এই তিনটি জিনিস এসে গেলে অন্য কিছুর প্রয়োজন হয় না। কিন্তু এসব বিষয়ে সাধারণত একজন আল্লাহওয়ালার সুহবত ছাড়া অর্জন হয় না। কবির ভাষায়,

قال را بگوار صاحب حال شد
پیش مردے کامل پامال شو د

যতক্ষণ পর্যন্ত নিজেকে কোন কামেল পীরের কাছে সোপর্দ না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত এগুলো হাসিল হবে না

কামেল পীরের কাছে আত্মসমর্পণ না করলে বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির জালে ঘুরপাক খেতে থাকবে। কখনো এদিকে ঝুঁকে যাবে, কখনো ওই দিকে ঝুঁকে যাবে। তাসাউফের মূলকথা হলো, মানুষকে বাড়াবাড়ি কিংবা কমাকমি থেকে রক্ষা করা। স্বাভাবিক অবস্থার উপর নিয়ে আসা। ভারসাম্যপূর্ণ মধ্যপন্থার রাজপথে নিয়ে আসা এবং তাকে এই নির্দেশনা দেওয়া যে, কোন সময়ের দাবি কী? দীনের দাবী এবং চাহিদা মাফিক চলার নামই দ্বীনদারী। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে আমল করার তৌফিক দান করুন। আমীন।

وَآخِرُ دَعْوَانَا اَنِ الْحَمْدُ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ