যবান সামলান!

যবান সামলান

যবান সামলান

الله      الله     الله

মূল

মাহবুবুলওলামা হযরত মাওলানা পীর
জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী মুজাদ্দেদী

অনুবাদ ও সম্পাদনা
শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী

অনুবাদকের কথা

যবান বা জিহ্বা। শব্দশরীরে ছোট্ট কিন্তু তাৎপর্যবিচারে অনেক বড়। কারণ, আমাদের এই ছোট্ট অঙ্গটির সঠিক ব্যবহার যেমনিভাবে আমাদেরকে আমাদের আসল ঠিকানা জান্নাতের আলোকময় পথ দেখাতে পারে, অনুরূপভাবে জাহান্নামের অন্ধকার গলিতেও নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমরা এটির সঠিক ব্যবহার জানি না কিংবা জানলেও করি না। বরং এক্ষেত্রে আমরা এতটাই উদাসীনতা ও মন্দ-উদারতা দেখাই যে, এর কারণে জাহান্নাম আমাদের জন্য কত সহজ হয়ে যাচ্ছে! জান্নাত কত কঠিন হয়ে ওঠছে! এ উদাসীনতা আমাদের রোগ। এ রোগের সম্পর্ক চরিত্রের সঙ্গে, আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে। আমাদের এই চারিত্রিক ও আধ্যাত্মিক ব্যাধিটা নিয়েই কথা বলেছেন বর্তমানবিশ্বের অন্যতম আধ্যাত্মিক চিকিৎসক অধমের শায়েখ ও মুর্শিদ মাহবুবুলওলামা হযরত মাওলানা পীর জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী মুজাদ্দেদী দা. বা.। বরাবরের মত এইব্যাধিটারও যাবতীয় রূপ তিনি নির্ণয় করেছেন। প্রতিকারের ব্যবস্থাপত্রও দিয়েছেন। হযরতজীর ব্যাধি নির্ণয়ের ধরণ অতঃপর প্রতিকারের ব্যবস্থাপত্র বাতলে দেয়ার পদ্ধতি কতটা শক্তিশালী ও উপকারী হয় যারা তাঁর বয়ান বা লেখনীর সঙ্গে পরিচিত তাদেরকে নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। আর যারা পরিচিত নন তাদেরকে বলে বোঝানোর ভাষা অধমের নেই। শুধু বলব, পড়ুন। ইনশাআল্লাহ, উপকৃত হবেন।
ভুল হয়ত আছে, পেলে অধমের ভুল মনে করে ক্ষমা করবেন। ভুলটা জানিয়ে দিলে খুশি হব। দুআও করব; ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সকলকে ক্ষমা করে দিন। আমাদের অন্তরের ব্যাধিগুলো শুধরে দিন। আমীন।

–উমায়ের কোব্বাদী

اَلْحَمْدُ لِلّهِ وَكَفَى وَسَلَامٌ عَلَى عِبَادِهِ الَّذِيْن َاصْطَفَى اَمَّا بَعْدُ! فَاَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ. بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ. مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ. سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّة ِعَمَّا يَصِفُوْنَ. وَسَلَامٌ عَلَى الْمُرْسَلِيْنَ. وَالْحَمْدُ للهِ رَبِّ الْعاَلَمِيْنَ. اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّعَلَى الِ سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّبَارِكْ وَسَلِّمْ

যবানের গুরুত্ব
বেশ কিছু অঙ্গের সমষ্টির নাম মানুষ। অঙ্গগুলো সুন্দর পথে চললে মানুুষও আলোময় পথে চলে। মানুষের একটি ছোট্ট অঙ্গের নাম জিহ্বা। বর্তমানে যার ব্যবহার খুব বাজে পদ্ধতিতে করা হয়। আরবি ভাষায় প্রবাদ আছে- اَلْلِسَانُ جِسْمُهُ صَغِيْرٌ وَجُرْمُهُ كَبِيْر ‘জিহ্বা গঠনাকৃতি যার ছোট, তবে অপরাধ সংঘটনে বেশ বড়।’ মহান আল্লাহ বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُونَ

‘মুমিন সকল! যা কর না তা কেন বল?’

বল একটা আর কর ভিন্নটা-এটা আল্লাহর কাছে একেবারে অপছন্দ। এতে আল্লাহ রাগ করেন। মুমিনের যবান আল্লাহর কাছে খুবই মূল্যবান। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,

مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ

‘মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তার জন্য তৎপরপাহারাদার তার নিকটেই রয়েছে।’

যবান যখন কালিমা বলে
আল্লাহ তাআলার কাছে যবানের গুরুত্ব দেখুন। একজন কাফের। সারা জীবন গুনাহের মধ্যে ডুবে ছিল। চুল সাদা হয়ে গিয়েছে। জীবনের শেষ বেলায় এসে সে ইখলাসের সঙ্গে কালিমা পড়েছে। আল্লাহ তার সারা জীবনের গুনাহ সঙ্গে সঙ্গে মাফ করে দেন। হাদীসে এসেছে, যদি কোনো বান্দা ইখলাসের সঙ্গে অন্তর থেকে কালিমা মুখে উচ্চারণ করে, সঙ্গে সঙ্গে একজন ফেরেশতা আমলটি নিয়ে আসমানের দিকে ছুটে যায়। সে আসমানে পৌঁছার আগেই উপর থেকে অবতরণকারী এক ফেরেশতার সঙ্গে পথিমধ্যে সাক্ষাত হয়। অবতরণকারী ফেরেশতা জানতে চায়, ‘তুমি যাচ্ছ কোথায়?’ উত্তর দেয়, ‘একব্যক্তি কালিমা পড়েছে। তার আমল আল্লাহর দরবারে নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু তুমি কোথায় যাচ্ছ?’ অবতরণকারী ফেরেশতা উত্তর শোনায়, ‘যে লোকটি কালিমা পড়েছে, তার মাগফিরাতের পয়গাম নিয়ে যাচ্ছি।’

দেখুন, যবান থেকে কয়েকটি শব্দ বের হওয়ামাত্র যাপিত জীবনের সকল গুনাহর ক্ষমা পেয়ে যাচ্ছে। দুনিয়ার নিয়ম হল, কোনো ব্যক্তির নামে মিথ্যা মামলা হলে আদালত তাকে সসম্মানে মুক্তি দিয়ে দেয়। তবে আদালতের রেজিস্টারে মামলাটি নথিভুক্ত থেকে যায়। অথচ আল্লাহ তাআলার আচরণ বিস্ময়কর। যদি বান্দা গুনাহ করে। পাহাড়সম গুনাহ করে। তারপর খাঁটি মনে তাওবা করে। সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন। এমনকি তার গুনাহর রেকর্ডটাও আমলনামা থেকে মুছে ফেলেন। হাদীস শরীফে এসেছে, যে ফেরেশতা বান্দার গুনাহটি লিখেছিল, আল্লাহ তাআলা তার স্মৃতি থেকেও গুনাহটি মুছে ফেলেন। যাতে সে কেয়ামতদিবসে সাক্ষ্য দিতে না পারে। সুবহানাল্লাহ্!

অবজ্ঞা করার ক্ষতিসমূহ
এখনতো মানুষ অপরকে খুশি করার জন্যও মিথ্যা বলে। অন্যকে অবজ্ঞা করে। বিদ্রুপ করে। মনোকষ্ট দিয়ে অন্তরটা পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। মনে রাখবেন, তরবারীর আঘাত দেহে পড়ে, যবানের আঘাত পড়ে অন্তরে। এজন্য আল্লাহ তাআলা বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِنْ قَوْمٍ عَسَى أَنْ يَكُونُوا خَيْرًا مِنْهُمْ.

‘হে মুমিনগণ! কেউ যেন কাউকে উপহাস না করে। কেননা যাকে অবজ্ঞা করা হয় সে অবজ্ঞাকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে।’

ঠাট্টা-উপহাস নিষিদ্ধ করার কারণ হল, এ সময় যবান থেকে আজেবাজে কথা বের হয়ে যায়। যবান তখন মুখরাপনা হয়ে ওঠে। খুব সহজেই আরেকজনের অন্তরে আঘাত করে বসে। অথচ কেয়ামতের দিন এসব উচ্চারিত কথা সত্য হিসাবে প্রমাণ করা নিদারুণ কঠিন হবে।

কুফরিকথা
ওলামায়ে কেরাম ‘কুফরি কথাগুলো’ সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। আশ্চর্যের বিষয় হল, এই কুফরি কথাগুলোর মধ্য থেকে কিছু কথা বর্তমানে মুসলমানদের মুখেও শোনা যায়। نقل كفر كفر نہ باشد ‘কুফরি কথা বোঝানোর উদ্দেশে বর্ণনা করা কুফরি নয়।’ তাই কিছু কুফরিকথার কিছু উদাহরণ পেশ করছি। যেমন,

–কেউ জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় থাকেন?’ আপনি উত্তর দিলেন, ‘অমুক জায়গায় থাকি।’ তখন প্রথমোক্ত লোকটি বলে বসল, ‘ওহ! এতদূর! আল্লাহর পেছনে!’ এই কথাটা কুফরি কথা। আমরা তো হাসি-তামাশা করেই বলে বসি, ‘আল্লাহর পেছনে…’। অথচ এটা কুফরি কথা। কুফরি কথার দ্বারা ঈমান চলে যায়, স্ত্রী তালাক হয়ে যায়।

–কেউ বলল, ‘অমুক কাজটি শরিয়ত-মাফিক হয়েছে।’ তখন আরেকজন বলে বসল, ‘আরে রাখো তোমার শরিয়ত।’ এটাও কুফরি বাক্য।

এ জাতীয় কুফরিকথা আমরা প্রতিদিন কমবেশি শুনি। একবারের ঘটনা। আমি এক ফ্যাক্টরির ম্যানেজারের কাছে বসা ছিলাম। তিনি এক ব্যক্তিকে ডাকলেন। যাকে দেখতে-শুনতে ভদ্র, ধার্মিক ও বুদ্ধিমান মনে হচ্ছিল। মুখে খোঁচাখোঁচা ছোট দাঁড়িও আছে। ম্যানেজার সাহেব লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বল তো ভাই! দিনকাল কেমন যাচ্ছে?’ লোকটি উত্তর দিল, ‘আগে তো পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যেই দুআ শুনত। এখন শোনে না। কি-জানি কোথায় যে চলে গেল! তাই আমিও নামায ছেড়ে দিয়েছি।’

আল্লাহর মহত্ব ও বড়ত্ব সামনে রাখুন। লোকটির উক্ত মন্তব্যের প্রতিও দেখুন। আসতাগফিরুল্লাহ… বিশ্বাস করুন, লোকটির মন্তব্যটা শুনে আমার কান গরম হয়ে গেল। যেন আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যেতে লাগল। অথচ দেখলাম লোকটি একেবারে স্বাভাবিক। মনে হচ্ছে যেন হাসি-তামাশার উদ্দেশ্যেই কথাটা বলেছে অথচ এজাতীয় কথা কুফরি।

কথার গুরুত্ব
যবান থেকে বের হওয়া শব্দগুলোর গুরুত্ব এতটাই বেশি যে, একজন পরনারী; যার প্রতি তাকানোও হারাম ছিল তাকে যদি তার সম্মতিতে শরিয়তসম্মত সাক্ষীদের উপস্থিতিতে বলা হয়, আমি তাকে আমার বিবাহ-বন্ধনে কবুল করে নিলাম। তাহলে এই পরনারী হয়ে গেল লোকটির জীবনসঙ্গী। যার দিকে চোখ তুলে তাকানোরও অনুমতি ছিল না, মাত্র দু’টি কথায় সে হয়ে গেল পুরুষটির জীবনসঙ্গী। আবার যে মহিলা জীবনসাথী ছিল, তাকে যদি স্বামী তিনবার ‘তালাক’ শব্দ বলে দেয়, তাহলে সে হয়ে যায় পরনারী। ভেবে দেখুন, বিয়ে করার সময় কিংবা তালাক দেয়ার সময় মাথার ওপর তো কোনো পাথর ওঠাতে হয় না। আগুনের মধ্য দিয়েও যেতে হয় না। পাহাড় থেকে লাফ মারতে হয় না; বরং মাত্র কয়েকটি কথায় একজন পরনারী হয়ে যায় স্ত্রী। আবার সবচেয়ে আপন মানুষটিও ‘তালাক’ শব্দ উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে হয়ে যায় পরনারী। মানুষের মুখ থেকে বের হওয়া কথার গুরুত্ব ও মর্যাদা আল্লাহর কাছে এতটাই বেশি।

প্রতিটি কথা আমাদের আমলনামাতে লিপিবদ্ধ হয়

একযুবক আউলাঝাউলা কথা বলছিল। এক আল্লাহওয়ালা শুনে বললেন, বেটা! ভেবেচিন্তে কথা বলো এবং দেখো, তুমি আল্লাহর নামে কেমন চিঠি পাঠাচ্ছ।

আমাদের প্রতিটি কথা আমাদের আমলনামাতে লিপিবদ্ধ হয়। আমলনামা প্রতিদিন আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়। আল্লাহওয়ালারা কথা বলার সময় এই অনুভূতি জাগরুক রাখেন যে, আমার আমলনামা আল্লাহর দরবারে পেশ করা হবে। কিছু কিছু বুযুর্গের আমল ছিল, তারা যা বলতেন তা কাগজে টুকে রাখতেন। রাতে সেটা যাচিয়ে-খতিয়ে দেখতেন যে, যা কিছু বলা হয়েছে তা ঠিক ঠিক ছিল কি-না? ঠিক না হলে রাতেই আল্লাহর কাছে তাওবাকারী হয়ে যেতেন।

আল্লাহর ভয়ের মুগ্ধতাছড়ানো গল্প
আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক রহ. বলেন, আমি হজের সফর থেকে ফিরছিলাম। ইত্যবসরে একটি সওয়ারি আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলাম। কাছে আসার পর বুঝলাম, সওয়ারিতে যিনি বসে আছেন তিনি একজন মহিলা। তাকে সালাম দিলাম। উত্তরে তিনি তেলাওয়াত করলেন,

سَلَامٌ قَوْلًا مِّن رَّبٍّ رَّحِيمٍ.
‘পরমদয়ালু প্রতিপালকের পক্ষ থেকে ‘সালাম’ বলা হবে।’

বুঝলাম, আয়াতটির মাধ্যমে তিনি সালামের উত্তর দিয়ে দিয়েছেন। জিজ্ঞেস করলাম, আপনি আসছেন কোত্থেকে? উত্তরে তিনি তেলাওয়াত করলেন,

.وَأَتِمُّوا الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ لِلَّهِ
‘আল্লাহর জন্য হজ ও ওমরাসম্পন্ন কর।’

বুঝে নিলাম, তিনি হারামাইন শরিফাইন জেয়ারত করে আসছেন। জিজ্ঞেস করলাম, যাবেন কোথায়? উত্তরে তিনি আয়াতাংশ শোনালেন,

مَنْ يُضْلِلِ اللَّهُ فَلَا هَادِيَ لَهُ.
‘যাকে আল্লাহ পথহারা করে, তাকে পথ দেখানোর মত কেউ থাকে না।’

এবার বুঝে নিলাম, তিনি পথ হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁর গলার স্বর বলে দিচ্ছিল, তিনি বৃদ্ধা। তাই আমি তাঁকে বললাম, মা! আপনি কোথায় যেতে চান? উত্তরে তিনি আয়াত তেলাওয়াত করলেন,

ادْخُلُوا مِصْرَ إِنْ شَاءَ اللَّهُ آمِنِينَ.
‘তোমরা শহরে নিরাপদে প্রবেশ কর।’

বুঝে নিলাম, তিনি শহরে যাবেন। তাঁকে বললাম, আমিও শহরের দিকেই যাচ্ছি। আপনি আমার সঙ্গে চলতে পারেন। আমি আপনাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব। তখন তিনি তেলাওয়াত করলেন,

وَأَحْسِنُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ.
‘আর তোমরা অনুগ্রহ কর। নিশ্চয় আল্লাহ অনুগ্রহকারীদের ভালোবাসেন।’

এরপর আমি তাঁর ঘোড়ার লাগাম হাতে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কিছুদূর গিয়ে আরবী কবিতা শুরু করি। তখন তিনি তেলাওয়াত করে শোনালেন,

فَاقْرَءُوا مَا تَيَسَّرَ مِنَ الْقُرْآنِ.
‘সুতরাং যে পরিমাণ কুরআন পাঠ তোমার জন্য সহজ হয় সে পরিমাণ পাঠ কর।’

তাঁর কথায় আমি চুপসে গেলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, যে এই মহিলা? তাঁর পরিবার সম্পর্কে জানার কৌতুহল আমার মনে জাগল। আর তখনি তিনি তেলাওয়াত করে ওঠলেন,

لَا تَسْأَلُوْا عَنْ اَشْيآءَ اِنْ تُبْدَلَكُمْ تَسُوْءَكُمْ.
‘এমন কিছু জিজ্ঞেস করো না, যা তোমাদের কাছে প্রকাশ পেয়ে গেলে তোমাদের খারাপ লাগবে।’

বুঝে ফেললাম, পারিবারিক বিষয়ে তিনি কথা বলতে চান না। এভাবে আমরা সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। শহরের কাছাকাছি এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, শহরে আপনার কে আছে? কার সঙ্গে দেখা করবেন? এবারও কুরআনের আয়াতের ভাষায় উত্তর দিলেন,

الْمَالُ وَالْبَنُونَ زِينَةُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا.
‘ধন ও সন্তান দুনিয়ার জীবনের জন্য সৌন্দর্য।’

বুঝলাম, আল্লাহতাআলা তাঁকে ধন ও সন্তান দান করেছেন। তিনি তাদের নিকট যাবেন। এভাবে শহরে ঢুকলাম। হজ থেকে যে কাফেলা ফেরত এসেছে আমরা তাদের সঙ্গে মিলিত হলাম। কাফেলা শহরে ছাউনি করল। আমি মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার ছেলেদের নাম কী? তিনি কুরআনের আয়াতের ভাষায় উত্তর দিলেন,

إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ.
‘ইব্রাহিম, ইসমাঈল এবং ইসহাক।’

বুঝে নিলাম, এগুলো তার ছেলেদের নাম। আমি এই নামগুলো ধরে হাঁক দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে ভদ্র মার্জিত বুদ্ধিদীপ্ত সুশ্রী তিন যুবক দৌড়ে আসল। তারাও তাঁর মাকে খুঁজছিল। ছেলেরা মায়ের সাথে দেখা করে খুব খুশি হল। আমি ভাবলাম, এবার আমি ঘরে চলে যাই। ঠিক তখনি মহিলা তেলাওয়াত করে ওঠলো,

وَيُطْعِمُونَ الطَّعَامَ عَلَى حُبِّهِ.
‘খাবারের প্রতি আসক্তি সত্তেও তারা খাবার দান করে।’

এর মাধ্যমে তিনি ছেলেদেরকে ইঙ্গিত দিলেন যেন আমাকে কিছু খাওয়ানো হয়। ছেলেরা সঙ্গে সঙ্গে ফলমূল নিয়ে আসলো আমি ওযর পেশ করলাম। তখন তিনি তেলাওয়াত করলেন,

إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللَّهِ.
‘আমরা তোমাদেরকে খাওয়াই কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায়।’

আমি ভীষণভাবে আভিভূত হলাম। ইয়া আল্লাহ! একী কাণ্ড! যাই হোক, আমি কিছু ফল খেয়ে নিলাম। ছেলেদের জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপার কী? আপনাদের মা আমার প্রতিটি কথার উত্তর কুরআন দ্বারা দিচ্ছেন কেন? তারা উত্তর দিল, আমাদের মা পবিত্র কুরআনের হাফেজা, হাদীসের আলেমা। আল্লাহভীতি তাঁর অন্তরে জেঁকে বসেছে। তাঁর ভয় হল, কেয়ামতের দিন প্রতিটি কথার জবাব তাঁকে দিতে হবে। এ কারণে বিশ বছর পর্যন্ত তাঁর যবান থেকে কুরআনের আয়াত ছাড়া কিছু বের হয় নি। সুবহানল্লাহ! একেই বলে আল্লাহর ভয়।

বিচার দিবসের উপস্থিতি

কেয়ামতের দিন বিচারের মুখোমুখি সবাইকে হতে হবে। সেদিন আল্লাহর সামনে তাঁর এমন বান্দাও উপস্থিত হবেন যাদের জীবনের বিশটি বছর কেটেছে এভাবে; কুরআন তেলাওয়াতের ভাষায় কথা বলে। আর আমাদের মত নির্বোধ মূর্খ চাপাবাজরাও আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবে। জানি না, সেদিন আমাদের কী হবে! যদি আল্লাহ জিজ্ঞেস করেন, বলো, অমুককে অপমান কেন করেছিলে? কেন অমুককে ‘ইতর’ বলে গালি দিয়েছিলে? অমুককে ‘বেঈমান’ বলেছিলে কেন? আজ আমরা যতই কথার খৈ ফুটাই না কেন; সেদিন কী জবাব দিব? ভেবে দেখেছেন কি? সেদিন তো নবীগণও আল্লাহর ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকবেন!

শায়েখ আব্দুলকাদের জিলানী রহ. তাঁর বিশ্বখ্যাত কিতাব ‘গুনিয়াতুততালেবীন’-এ লিখেছেন, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা আপন শানশওকতের সঙ্গে থাকবেন। সেদিন প্রত্যেকেই নিজের মুক্তির চিন্তায় দিশেহারা থাকবে। আল্লাহ তাআলা খৃস্টানদের জিজ্ঞেস করবেন, তোমরা আমার সঙ্গে আমারই সৃষ্টিকে শরিক করলে কেন? তখন তারা নিজেদেরকে বাঁচানোর জন্য ঈসা আলাইহিসসালামের নাম নিয়ে বলবে, তিনি আমাদেরকে বলেছিলেন। তখন আল্লাহ তাআলা ঈসা আলাইহিসসালামকে জিজ্ঞেস করবেন, اَ اَنْتَ قُلْتَ؟ ‘আপনি কি তাদেরকে বলেছিলেন?’ আল্লাহপাক যখন ঈসা আলাইহিসসালামকে প্রশ্নটি করবেন তখন তাঁর দেহের প্রতিটি লোমকূপ থেকে ঘামের পরিবর্তে রক্ত বের হবে।

ভেবে দেখুন, যখন সত্যবাদীদের অবস্থা এত নাজুক হবে, তখন আমাদের মত মিথ্যাবাদীদের অবস্থা কেমন হবে? এখন তো যবান ইচ্ছেমত চালানো যায়, কিন্তু কেয়ামতের দিন এসবের জবাব দিতে পারবেন কি?

জাহান্নামে যাবে কারা?
একবার নবীজী -কে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, হে আল্লাহর নবী! জাহান্নামিদের অধিকাংশ কী কারণে জাহান্নামে যাবে? তিনি উত্তর দিলেন, দু’টি অঙ্গের ব্যবহারের কারণে। অঙ্গ দুটি হল: مَا بَيْنَ لَحْيَيْهُ وَمَا بَيْنَ رِجْلَيْهِ. অর্থাৎ দুই চোয়ালের মাঝখানের যবান এবং দুই পায়ের মাঝখানের লজ্জাস্থান।

জান্নাতের জামানত
হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমাকে নিজের যবান ও লজ্জাস্থানের সঠিক ব্যবহারের জামানত দিবে, আমি তাকে জান্নাতের জামানত দিব।’ এহাদীস থেকেও যবানের সঠিক ব্যবহারের গুরুত্ব অনুমান করা যায়।

প্রথমে মাপুন তারপর বলুন
এজন্য নিজের কথা নিজের কানে শোনার অভ্যাস করতে হবে। যে ব্যক্তির কান নিজের কথা শোনে না, সে কান অন্যের কথা শুনবে কী করে! এ কারণে বলা হয়েছে, প্রথমে মাপুন তারপর বলুন। এখন তো আমরা প্রথমে বলি, তারপর পরিমাপ করি। অনেক সময় তো শুধু বলি, কিন্তু ওজন করে দেখি না যে, কথাটা কতটুকু ঠিক হয়েছে। কবি চমৎকার বলেছেন!

كہے ايك جب سن لے انسان لے دو
خدانے زبان ايك دى كان دو
‘মানুষের উচিত যে, সে বলবে একটি শুনবে দু’টি,
আল্লাহ তো যবান দিয়েছেন একটি, কান দিয়েছেন দু’টি।’

মহান আল্লাহ মানুষকে কান দিয়েছেন দু’টি এবং যবান দিয়েছেন একটি। সুতরাং হে মানুষ! কথা দু’টা শোনার পর জবাব দিবে একটি। অথচ আজকাল তো আমরা কেবল বলতে চাই, শুনতেই চাই না। আপনারা দেখে থাকবেন, মাহফিলে একজন কথা বললে অপরজন তার কথা সম্পন্ন হওয়ার সুযোগ দেয় না। মজলিসে অসম্পন্নকথা শুনেই আরেকজন উত্তর দেয়া শুরু করে দেয়। অনেক সময় দু’জন একই সঙ্গে কথা বলতে থাকে। উভয়ে যেন দেয়ালকে কথা শোনাচ্ছে। অপর পক্ষের কথা শোনার ধৈর্যটুকুও আমাদের নেই।

আবুবকর সিদ্দিক রাযি.-এর আল্লাহভীতি
হযরত আবুবকর সিদ্দিক রাযি.। অনেকসময় তিনি নিজের জিহ্বা টেনে ধরতেন এবং বলতেন, এটা শরীরের সেই অঙ্গ যার কারণে অধিকাংশ লোক জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। সেই ব্যক্তি কতই না মহান যার চুপথাকা হয় ফিকিরের সঙ্গে এবং মুখখোলা হয় যিকিরের সঙ্গে।

যবানের ভুলচুক

মনে রাখবেন, যবানের ভুল-বিচ্যুতি পা পিছলে পড়ে যাওয়া থেকেও জঘন্য। পা পিছলে পড়ে গেলে মানুষ আবার দাঁড়াতে পারে। কিন্তু যবান ভুলচুক করে ফেললে কিছুই করার থাকে না।

হাসান বসরী রহ. তাঁর মজলিসে প্রায় বলতেন, ছোট্ট একটি মেয়ে আমাকে উপদেশ দিয়েছিল। কেউ জিজ্ঞেস করল, হযরত! কী উপদেশ দিয়েছিল? তিনি উত্তর দিলেন, একবার বৃষ্টি হয়েছিল। রাস্তায় কাদা জমে গিয়েছিল। লোকজন খুব সাবধানে চলাফেরা করছিল। আমিও কোথাও যাচ্ছিলাম। ছোট্ট একটি মেয়েকে আসতে দেখলাম। মেয়েটিকে বললাম, সাবধানে চলো, না হয় পড়ে যাবে। মেয়েটি আমার কথার পিঠে ঝটপট উত্তর দিয়ে ওঠল যে, আমি পড়ে গেলে অসুবিধা নেই। আবার ওঠে দাঁড়াব। কিন্তু আপনি নিজের প্রতি একটু লক্ষ্য রাখুন। আপনি পড়ে গেলে উম্মতের তখন কী হবে! আপনি তো উম্মতের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। খেয়াল রাখবেন, আপনি যেন পিছলে না পড়েন।

উক্ত ঘটনা বলে হাসান বসরী রহ. বলতেন, ছোট্টমেয়েটি আমাকে দৃঢ়তার মহান শিক্ষা দান করেছে।

অন্তর হল হাঁড়ির মত এবং জিহ্বা হল চামচের মত

ইয়াহইয়া ইবনু মুআয রহ.। এই বুযুর্গ বলতেন, অন্তর হল হাঁড়ির মত এবং জিহ্বা হল চামচের মত। হাঁড়িতে যা থাকে, চামচ তা বের করে আনে। অনুরূপভাবে অন্তরে যা থাকে যবান দিয়ে তাই বের হয়। অন্তরে অন্ধকার থাকলে যবান মন্দ কথা বলবে। পক্ষান্তরে অন্তরে নূর থাকলে যবান বের করবে পবিত্র ও মার্জিত কথা।

যবানের সঠিক ব্যবহার করুন
যেমননিভাবে ডাক্তাররা জিহ্বার রঙ দেখে শরীরের রোগ নির্ণয় করতে সক্ষম হন, অনুরূপভাবে ওলামায়েকেরাম মুখের ভাষা শুনে অন্তরের রোগ নির্ণয় করতে সক্ষম হন।

আলী রাযি. বলতেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি মুখ খুলবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাকে জ্ঞানী মনে করা হবে। অনেক সময় বলতেন, তুমি কথা বললেই মানুষ তোমাকে চিনে ফেলবে। কখনও কখনও বলতেন, মানুষ লুকিয়ে থাকে তার যবানের আড়ালে। অর্থাৎ মুখ খোলামাত্রই সে খোলস ছাড়িয়ে সামনে এসে পড়ে। সুতরাং খুব সাবধানতার সঙ্গে মুখখোলা উচিত।

যে লোকটির দাবি হল, সে সঠিকভাবে বলে, স্বাভাবিক কথা বলে, সে লোকটি গোস্বার সময় কিভাবে কথা বলে তা দেখলেই বোঝা যাবে যে, তার দাবি আসলে কতটা সত্য। সাধারণ অবস্থায় যখন মানুষ খোশমেজাজে থাকে তখন তো তাকে কুকুর কামড়ায় নি যে, সে আউলফাউল কথা বলবে। যখন কোনো বিষয় বিরক্তিকর লাগবে তখনই বুঝে আসবে তার মুখ ও শরীরের ভাষা কেমন হয়। ঝটকা লাগবে এমন কোনো কথা তাকে বলে দেখেন, সে কিভাবে রিএ্যাক্ট করে; ধৈর্যের পরিচয় দেয় না গোঁয়ারের মত বকবক করে? সুতরাং মূলত মানুষের কথার ঠিক-বেঠিক অনুমান করা যায় তার রাগের সময়। সাধারণত দেখা যায়, রাগের সময় পুরুষের হাত নিয়ন্ত্রণে থাকে না এবং মহিলাদের যবান নিয়ন্ত্রণে থাকে না। অনেক মহিলার যবান তো এমন তরবারি যা কখনও মরিচা ধরে না। সব সময় চলতে থাকে। অথচ লোহার তরবারি যে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারে না, মুখের তরবারি তা ছিন্ন করে দেয়।

একটু সতর্ক থাকুন
বন্ধুগণ! অনুষ্ঠান-আসরে বসে নিজের সম্পর্কে যবান চালাবেন না। আপনি চলে গেলে কাজটা আপনার বন্ধুরাই করবে। অনেকে মজলিসে নিজেকে বিনয়ী হিসাবে কৃত্রিমভাবে তুলে ধরে। মূলত সে যেন বলে, اَعْرِفُوْنِىْ ‘আমাকে চিনো।’ জ্ঞানীরা বলেছেন, ‘আলেমদের মজলিসে বসলে জিহ্বা সামলে কথা বলবে। বিচারকের মজলিসে বসলে দৃষ্টি অবনত রাখবে। আর আল্লাহওয়ালাদের মজলিসে বসলে অন্তর সামলে রেখো।’ সাধারণত দেখা যায়, মুখরাপনার কারণে মানুষের চুল-দাঁড়ি তাড়াতাড়ি সাদা হয়ে যায়। কারণ, যবান যত চলে, জীবন তত সঙ্কীর্ণ হয়ে আসে।

চমৎকার উপদেশ
খাজা বাকীবিল্লাহ রহ. ছিলেন কম কথার মানুষ। এক ব্যক্তি তাঁকে বললেন, হযরত! আমাকে কিছু উপদেশ দিন, উপকৃত হব। হযরত উত্তরে বললেন, যে ব্যক্তি আমার নিরবতা থেকে উপদেশ গ্রহণ করে নি, সে আমার কথা থেকেও কিছু নিতে পারবে না।’ সুবহানাল্লাহ! কত চমৎকার উপদেশ! কবি বলেছেন’

كہہ رہا ہے شور دريا سے سمندر كا سكوت
جتنا جسكا ظرف ہے اتنا ہى وه خاموس ہے
‘সমুদ্রের ঊর্মিমালাকে সমুদ্রের নিরবতা বলে, যার গভীরতা যতবেশি, সে ততবেশি নিশ্চুপ থাকে।’

এজন্য আল্লাহওয়ালাদের স্বভাব হল, তাঁরা চুপ থাকেন বেশি। তবে হ্যাঁ, ইলমি-কথা কিংবা মাসআলাগত আলোচনা তাঁরা সবিস্তারে করেন।

 নির্বোধরা প্রথমে বলে তারপর ভাবে

যবানের অপব্যবহারের কারণে মানুষ পাহাড়সম গুনাহ মাথায় নিয়ে বসে। বলা হয়, নির্বোধকে পরিচয় করে দেয়ার জন্য গলায় ঘণ্টা বেঁধে দেয়ার প্রয়োজন হয় না। তার মুখ চালানোই বলে দেয় সে একজন নির্বোধ। জ্ঞানীরা বলে থাকে, বুদ্ধিমান কথা বেল ভেবে-চিন্তে। পক্ষান্তরে নির্বোধরা প্রথমে বলে তারপর ভাবে। এটাই পার্থক্য বুদ্ধিমান ও নির্বোধের মাঝে। যাদের ভাষাব্যবহার ভালো নয় তাদের সাথে কম কথা বলুন। কারণ, তাদের খারাপকথার উত্তর দিতে গেলে তাদের কাছে আরো জঘন্যভাষার মজুদ আছে যা তারা আপনার বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে।

গালি দিবেন না
রাসূলুল্লাহ বলেন, তোমরা নিজের মা-বাবাকে গালি দিয়ো না। সাহাবায়েকেরাম বললেন, মা-বাবাকে গালি দেয়; এটাও হয় না-কি? রাসূলুল্লাহ উত্তর দিলেন, তোমরা কারো মা-বাকে গালি দিলে উত্তরে সেও তোমার মা-বাবাকে গালি দিবে। প্রকারন্তরে তুমি নিজেই তোমার মা-বাবাকে গালি দিলে।

মামলায় হারলো মুসলমান জিতলো ইসলাম
ভারতের ঘটনা। একটি জমি নিয়ে লড়াই হয়। মুসলমানদের দাবি হল, জমিটা তাদের। হিন্দুরাও একই দাবি করছিল। মুসলমানদের ইচ্ছা ছিল, জমিটিতে মসজিদ হবে। হিন্দুরা চাচ্ছিল সেখানে মন্দির বানাবে। এ নিয়ে খুনাখুনি হওয়ার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়। তখন বিচারক ছিল ইংরেজ। মামলাটি ছিল বেশ জটিল। বিচারকও টেনশনে পড়ে গেলেন। কী করা যায়, কীভাবে সমাধানে পৌঁছা যায়–এ নিয়ে তিনি চিন্তিত ছিলেন। মামলার শুনানির সময় ইংরেজ বিচারক জানতে চাইলেন, বিষয়টি নিস্পত্তির কোনো উপায় আছে কি? তখন হিন্দুরা বলল, আমরা একটা উপায় বলে দিচ্ছি। এতে আদালতের মামলা ছাড়াও বিষয়টির সুরাহা হতে পারে। বিচারক জিজ্ঞেস করলেন, কী সেটা? হিন্দুরা বলল, আমরা একজন মুসলমানের নাম বলছি। যিনি আলেম। আপনি তাঁকে এখানে ডেকে পাঠান। তিনি যা রায় দিবেন আমরা তা মেনে নিব। তিনি যদি বলেন, জমিটি হিন্দুদের তাহলে আমরা পেয়ে যাব। আর যদি বলেন, জমিটি মুসলমানদের, তাহলে তারা তা নিয়ে নিবে। কিন্তু ওই আলেমের নাম আমরা কেবল আপনাকে বলব। সবাইকে বলব না। যাহোক, বিচারক একথার ওপর মালমার শুনানি মওকুফ করেন এবং শুনানির জন্য পরবর্তী একটি তারিখ নির্দিষ্ট করেন। আদালতকক্ষ থেকে সবাই যখন বের হল তখন সাধারণ হিন্দুরা তাদের নেতাদের ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করে। বলে, তোমরা সব নষ্ট করে দিলে। এমন একজন লোককে সালিশ বানালে যে লোকটি শুধু মুসলমানই নয়; বরং তাদের ধর্মের একজন গুরুও। সেতো মুসলমানদের পক্ষেই কথা বলবে। অপরদিকে মুসলমানরা তো দারুণ খুশি। একজন মুসলমানকে ঠিক করা হয়েছে। তিনি তো অবশ্যই মসজিদ বানানোর পক্ষে কথা বলবেন। সুতরাং আমাদেরকে আর হারায় কে! অবশেষে নির্ধারিত দিনে আদালতপাড়া কানায় কানায় ভরে ওঠলো। হিন্দুরা সেখানে এক আল্লাহওয়ালাকে নিয়ে আসে এবং জজ সাহেবের উদ্দেশ্যে বলে, আপনি এ লোকটিকে জিজ্ঞেস করুন। জমিটি কাদের; হিন্দুদের না মুসলমানদের? তিনি যা বলবেন, আমরা তাই মেনে নিব। বিচারক ওই আল্লাহওয়ালাকে বিষয়টি জিজ্ঞেস করেন। তখন তিনি পরিষ্কার ভাষায় উত্তর দিলেন, জমিটি হিন্দুদের। বিচারক জিজ্ঞেস করলেন, এখানে হিন্দুরা মন্দির তৈরি করতে পারবে কি? আল্লাহওয়ালা উত্তর দিলেন, জমির মালিক হিন্দুরা। সেখানে তারা কী বানাবে– এটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। এরপর জজ সাহেব একটি ঐতিহাসিক ফয়সালা লিখে দেন যে, ‘আজ মামলায় হারলো মুসলমান জিতলো ইসলাম।’ জজ যখন এটা পড়ে শোনালেন তখন হিন্দুরা বলে বলে ওঠল, জজ সাহেব! আপনি ফয়সালা তো আমাদের পক্ষেই দিয়েছেন। তবে আমরা কালিমা পড়ে মুসলমান হচ্ছি। মুসলমান হয়ে এখানে আমরা মসজিদ নির্মাণ করব। সুবহানাল্লাহ! সত্য বলার বরকতে হিন্দুরা মুসলমান হয়ে গেল। জমিটিতে মসজিদও হল। সত্যের জয়জয়কার হল। কবি চমৎকার বলেছেন,

ہزارخوف ہو ليكن زبان ہو دل كى رفيق
يہى ر ہا ہے ازل سے قلندرو ں كا طريق
‘হাজার ভয়ের ভীড়েও যবান হোক অন্তরের সঙ্গী,
অনন্তকাল থেকে আল্লাহপ্রেমিকদের পথ ছিল এটাই।’

ক্ষমা পেতে হলে
বর্তমানে অনেক বন্ধু-বান্ধব অভিযোগ করে বলে থাকেন, কেন যেন লতিফাগুলো তাজা হচ্ছে না। সুলূক তথা আত্মশুদ্ধির স্তরগুলো অতিক্রম করতে পারছি না। কী কারণে যেন সামনে অগ্রসর হওয়া যাচ্ছে না। এমনটি কেন হয়? আসলে এর কারণ হল, মানুষ নিজের অঙ্গসমূহের সঠিক ব্যবহার করছে না। অসুস্থ ব্যক্তি ওষুধ ব্যবহার করল, কিন্তু সাবধানতা অবলম্বন করল না, তাহলে তার রোগ ভালো হবে কিভাবে! অনুরূপভাবে আমাদের অন্তরে যেহেতু গুনাহ বাসা বেঁধেছে, সুতরাং হাতে তাসবিহ ঘোরানোর ফায়দা পুরোপুরি পাওয়া যাবে না। এজন্য বন্ধুগণ! গুনাহ ছাড়ুন। যবানের সঠিক ব্যবহার শিখুন। ‘ইনশাআল্লাহ’ ক্ষমা পেয়ে যাবেন। আল্লাহ আমাদেরকে যবান সঠিকভাবে ব্যবহার করার তাওফীক দান করুন। এ পর্যন্ত যবান দ্বারা যত গুনাহ করেছি, হে আল্লাহ! সবগুলো মাফ করে দিন। আমীন।

وَآخِرُ دَعْوَانَا اَنِ الْحَمْدُ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ.