শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী
এক. সন্তান-সন্তুতি দানের ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ তাআলার। আল্লাহ যাকে সন্তান দান করেন, কোন রোগ, কোন দুর্বলতা বা কোন সমস্যাই তার জন্য বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না । আর আল্লাহ যাকে সন্তান দান করেন না, অতি তুচ্ছ কারণেই সে সন্তান লাভ করতে ব্যর্থ হয় । আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَهَبُ لِمَن يَشَآءُ إِنَٰثٗا وَيَهَبُ لِمَن يَشَآءُ ٱلذُّكُورَ أَوۡ يُزَوِّجُهُمۡ ذُكۡرَانٗا وَإِنَٰثٗاۖ وَيَجۡعَلُ مَن يَشَآءُ عَقِيمًاۚ
‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন, যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন অথবা ছেলে-মেয়ে উভয়ই দান করেন। আবার যাকে ইচ্ছে বন্ধ্যা করেন।’ (সূরা আশ্শূরা ৫০)
সুতরাং আল্লাহর কাছে চাওয়ার কোন বিকল্প নেই । আপনি নিবিষ্ট মনে আপনার মত করে নিজের ভাষায় তাঁরই কাছে নেক সুস্থ ও সুন্দর সন্তান কামনা করে দোয়া করতে থাকুন। তিনি আপনার ডাকে সাড়া দিলে অবশ্যই আপনি সন্তান লাভ করবেন।
দুই. দেখুন, জাকারিয়া আ. বুড়ো বয়সেও নিঃসন্তান ছিলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, আল্লাহ তাআলা মৌসুম ছাড়াই মারইয়াম আ.-কে ফল দান করে রিজিকের ব্যবস্থা করেন। তখন তাঁর মনে সন্তানের জন্য সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠল। তিনি ভাবলেন যে, যে আল্লাহ বিনা-মৌসুমে ফল দিতে পারেন, সে আল্লাহ বৃদ্ধদম্পতিকেও সন্তান দান করতে পারেন। তাই তিনি আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন– رَبِّ هَبْ لِي مِن لَّدُنْكَ ذُرِّيَّةً طَيِّبَةً إِنَّكَ سَمِيعُ الدُّعَاء হে, আমার পালনকর্তা! আপনার নিকট থেকে আমাকে পুত-পবিত্র সন্তান দান করুন। নিশ্চয়ই আপনি প্রার্থনা শ্রবণকারী। (সূরা আল-ইমরান ৩৮)
সুতরাং আপনিও দোয়াটি করতে পারেন। ইনশা-আল্লাহ আল্লাহ আপনাকে নেক সন্তান দান করবেন।
তিন. সুরা সাফফাতে এসেছে, বৃদ্ধ বয়সে ইবরাহিম আ. আল্লাহ তাআলার নিকট দোয়া করেছিলেন সৎ পুত্র সন্তানের জন্য। আল্লাহ তাআলা তার দোয়া কবুল করলেন। তাঁকে নেক পুত্র সন্তান দান করলেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা শিক্ষা দিয়েছেন, যাতে বান্দা এ দোয়ার মাধ্যমে তাঁর নিকট সন্তান কামনা করতে পারে। দোয়াটি এই- رَبِّ هَبْ لِي مِنَ الصَّالِحِينَ ‘হে আমার পরওয়ারদেগার! আমাকে এক সৎপুত্র দান করুন।’ (সূরা সাফফাত ১০০)
চার. কোরআনে বর্ণিত এ দোয়াটিও করতে পারেন; ইনশা-আল্লাহ আল্লাহ আপনাকে সন্তান দিয়ে সুখী করবেন- رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا’হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের জীবনসঙ্গীর পক্ষ থেকে এবং আমাদের সন্তানের পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে চোখের শীতলতা দান দান করুন এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্যে আদর্শস্বরূপ দান করুন।’ (সূরা ফুরকান ৭৪)
পাঁচ. সূরা আম্বিয়ার ৮৯ নং আয়াতের এ অংশ বেশি করে পড়ুন; ইনশা-আল্লাহ সন্তান হবে- رَبِّ لَا تَذَرْنِي فَرْدًا وَأَنتَ خَيْرُ الْوَارِثِينَ ‘হে আমার পালনকর্তা আমাকে সন্তানহীন ছেড়ে দিবেন না। আর আপনিই তো সর্বোত্তম ওয়ারিস।’
ছয়. হাসান বসরি রহ. থেকে বর্ণিত, তাঁকে এক ব্যক্তি বলল, আমি সম্পদশালী, কিন্তু নিঃসন্তান, আমাকে এমন আমল বলে দিন,যাতে আমার সন্তান হয়। তখন তিনি লোকটিকে বললেন, عليك بالاستغفار ‘তুমি ইস্তেগফারকে আবশ্যক করে নাও।’ ফলে লোকটি নিয়মিত ইস্তেফারের আমল করতে লাগল। এমনকি দৈনিক ৭০০ বার সে আস্তাগফিরুল্লাহ পড়ত। এ আমলের বরকতে আল্লাহ তাকে একে একে দশ সন্তান দান করেছিলেন। তারপর লোকটি একদিন হাসান বসরি রহ.কে এই আমলের রহস্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে উত্তরে তিনি বলেন, তুমি কি হুদ আ.-এর ঘটনায় আল্লাহর বাণী দেখনি? আল্লাহ অধিক ইস্তেফারের ফলাফল বলতে গিয়ে বলেছেন, وَيَزِدْكُمْ قُوَّةً إلى قُوَّتِكُمْ ‘তোমাদের শক্তির উপর শক্তি বৃদ্ধি করবেন।’ (সূরা হুদ ৫২) এবং নূহ আ.-এর ঘটনায় আল্লাহর বাণী দেখনি? সেখানে তিনি বলেছেন, وَيُمْدِدْكُمْ بِأَمْوَالٍ وَبَنِينَ ‘তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ত তি বাড়িয়ে দিবেন।’ (সূরা নূহ ১২)
সুতরাং আপনিও বেশি করে ইস্তেগফার করুন; ইনশা-আল্লাহ আপনার সন্তান না হওয়ার পেরেশানি থাকবে না। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
مَنْ لَزِمَ الاِسْتِغْفَارَ جَعَلَ اللَّهُ لَهُ مِنْ كُلِّ ضِيقٍ مَخْرَجًا وَمِنْ كُلِّ هَمٍّ فَرَجًا وَرَزَقَهُ مِنْ حَيْثُ لاَ يَحْتَسِب
সাত. বাকের রহ.-এর কাছে এক বৃদ্ধ এসে বললেন, আমার বয়স ষাট বছর; কিন্তু এখনও নিঃসন্তান। তখন তিনি তাকে বললেন, ‘প্রত্যেক ফরয-নামাজের পর سبحان الله (সুবহানাল্লাহ) ৭০ বার এবং أستغفر الله ( আস্তাগফিরুল্লাহ) ৭০ বার পড়বেন। তারপর তেলাওয়াত করবেন সূরা নূহ-এর ১০,১১, ১২ নং আয়াত অর্থাৎ,
اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ إِنَّهُ كَانَ غَفَّارًا يُرْسِلِ السَّمَاء عَلَيْكُم مِّدْرَارًا وَيُمْدِدْكُمْ بِأَمْوَالٍ وَبَنِينَ وَيَجْعَل لَّكُمْ جَنَّاتٍ وَيَجْعَل لَّكُمْ أَنْهَارًا
‘তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা প্রার্থনা কর। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের উপর অজস্র বৃষ্টিধারা ছেড়ে দিবেন, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ত তি বাড়িয়ে দিবেন, তোমাদের জন্যে উদ্যান স্থাপন করবেন এবং তোমাদের জন্যে নদীনালা প্রবাহিত করবেন।’
এ আয়াতগুলো তেলাওয়াত করবেন। আমলটি তিন দিন করবেন। তৃতীয় দিনে স্ত্রী-সহবাস করবেন। ইনশা-আল্লাহ আল্লাহ আপনাকে নেক সন্তান দান করবেন।’
লোকটি বলেন, আমি এই আমল করলাম, ফলে এক বছর পূর্ণ না হতেই আল্লাহ আমাকে আমার চোখের শীতলতা পুত্র সন্তান দান করেছেন। (তিব্বুল আইম্মাহ ১৩০)
আট. সহবাসের সময় দোয়া পড়ুন; ইনশা-আল্লাহ এতেও আপনার সন্তান লাভের মনোবাসনা পূরণ হতে পারে। দোয়াটি এই-
بِسْمِ اللَّهِ ، اللَّهُمَّ جَنِّبْنَا الشَّيْطَانَ ، وَجَنِّبْ الشَّيْطَانَ مَا رَزَقْتَنَا
‘হে আল্লাহ! আপনার নামে শুরু করছি, আপনি আমাদের নিকট হতে শয়তানকে দূরে রাখুন। আমাদের এ মিলনের ফলে যে সন্তান দান করবেন, তা হতেও শয়তানকে দূরে রাখুন।’
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যখন তোমাদের কেউ আপন স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার ইচ্ছা করে তখন উক্ত দোয়া পড়ে যেন মিলিত হয়। এ মিলনে যদি তাদের কিসমতে কোনো সন্তান আসে, সে সন্তানকে শয়তান কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। (বুখারি ৬৩৮৮)
নয়. আলেমদের অনেকে বলেছেন, যে ব্যক্তি স্ত্রী সহবাসের পূর্বে আল্লাহ তাআলার পবিত্র গুণবাচক নাম (اَلْمُتَكَبِّرُ) ‘আল-মুতাকাব্বিরু’- ১০ বার পাঠ করবে; আল্লাহ তাআলা তাকে সৎ সন্তান দান করবেন।
আর যে ব্যক্তি স্ত্রী সহবাসের পূর্বে এ পবিত্র গুণবাচক নাম ১০০ বার পাঠ করবে; আল্লাহ তাআলা তাকে ভাগ্যবান সুসন্তান দান করবেন।
আর যে ব্যক্তির ছেলে-মেয়ে না থাকে ওই ব্যক্তি ৪০দিন পর্যন্ত একাধারে ৪০ বার আল্লাহ তাআলার পবিত্র গুণবাচক নাম (اَلْاَوَّلُ) ‘আল-আউয়ালু’ পাঠ করলে তার সন্তান লাভের মনোবাসনা পূর্ণ হবে।
দশ. হযরত আলী রাযি. তাঁর অসিয়তনামায় লিখেছেন যে, সহবাসের ইচ্ছে হলে এই নিয়তে সহবাস করতে হবে যে, আমি ব্যভিচার থেকে দূরে থাকবো। আমার মন এদিক ওদিক ছুটে বেড়াবে না আর জন্ম নেবে নেককার ও ভালো সন্তান। এই নিয়তে সহবাস করলে তাতে সওয়াব তো হবেই সাথে সাথে উদ্যেশ্যও পূরণ হবে, ইনশাআল্লাহ।
পরিশেষে আমরা আপনার জন্য দোয়া করি, আল্লাহ আপনাকে নেক সুস্থ সুন্দর সন্তান দান করুন। আমীন।