সন্তানের শিক্ষা-দীক্ষা

সন্তানের শিক্ষা-দীক্ষা
সন্তানের শিক্ষা-দীক্ষা

সন্তানের শিক্ষা-দীক্ষা

শাইখুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী

অনুবাদ
শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী

হামদ ও সালাতের পর!
আল্লামা নববী রহ. এবিষয়ে রিয়াদুস সালেহীন-এ এবিষয়ে একটি অধ্যায় লিপিবদ্ধ করেছেন। যার সারমর্ম হচ্ছে, শুধু নিজেকে সংশোধন করাই যথেষ্ট নয় বরং স্ত্রী-সন্তান ও অধীনস্থ ও পরিজনকে দ্বীনের পথে আনার চেষ্টা করা। তাদেরকে ফরয-ওয়াজিব পালন এবং গুনাহ থেকে বিরত রাখা ও তার একান্ত কর্তব্য।

অপূর্ব সম্ভাষণ
তেলাওয়াতকৃত আয়াতে আল্লাহ তা’আলা সকল মুসলমানকে সম্বোধন করেছেন। সম্মোধনকালে বলেছেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا

‘হে ঈমানদারগণ।’

কোরআন শরীফের বিভিন্ন স্থানে يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا আল্লাহ তাআলা বাক্য ব্যবহার করেছেন এবং এর মাধ্যমে মুসলমানদেরকে সম্বোধন করেছেন। এ প্রসঙ্গে ডাক্তার আবদুল হাই আরেফী রহ. বলতেন, আল্লাহর সম্মোধন মুসলমানদের জন্য এর মাধ্যমে ভালোবাসা ঝরে পড়েছে। কারণ, সম্বোধনের দু’টি নিয়ম আছে। এক. সম্বোধিত ব্যক্তির নাম ধরে ডাকা। দুই. আত্মীয়তার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে সম্বোধন করা। যেমন পিতা-পুত্রকে ডাকার সময় নাম ধরে ডাকে অথবা শুধু ‘বেটা’ বলে ডাকে। বেটা বলে ডাকার মধ্যে যে স্নেহ ও ভালোবাসা রয়েছে এবং তা শ্রবণে যে মাধুর্য রয়েছে, নাম ধরে ডাকার মধ্যে সেই স্নেহের ছোঁয়া ও ভালোবাসার স্পর্শ নেই।

বেটা শব্দ স্নেহের শব্দ
শাইখুল ইসলাম হযরত শাব্বির আহমদ উসমানী রহ. গভীর জ্ঞান ও গবেষণার অধিকারী ছিলেন। শুধু পাকিস্তানেই নয় বরং গোটা বিশ্বে তাঁর মত আলেম ও গবেষক সমকালে সম্ভবত ছিল না। তাই কেউ তাকে ‘শাইখুল ইসলাম’ বলে সম্বোধন করতেন। কেউ বা ‘আল্লামা’ বলে ডাকতেন। আমার দাদি যখন জীবিত ছিলেন তখন তিনি মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে আসতেন। কারণ পৃথিবীর বুকে তাকে ‘বেটা’ বলে ডাকার মত আমার দাদি ছাড়া আর কেউ জীবিত ছিল না। এই শব্দটি শোনার জন্যই তিনি তাঁর নিকট ছুটে আসতেন। ‘বেটা’ শব্দ শোনার মধ্যে যে পুলক রয়েছে, তার সামান্যতমও ঝলক অন্য শব্দের মাঝে নেই।
আসলে মানুষের এমন মুহূর্তও আসে যখন বেটা শব্দ শোনার জন্য মন উতলা হয়ে উঠে। আবদুল হাই আরেফী রহ. বলেছেন, আল্লাহ তাআলা ঈমানদারকে স্নেহপূর্ণ শব্দে সম্মোধন করেছেন। তিনি সম্পর্কের সূত্র ধরে ডাক দিয়েছেন– يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ‘হে ঈমানদারগণ।’

তিনি বলেছেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ عَلَيْهَا مَلَائِكَةٌ غِلَاظٌ شِدَادٌ لَّا يَعْصُونَ اللَّهَ مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ

‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই অগ্নি থেকে রক্ষা কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও প্রস্তর, যাতে নিয়োজিত আছে পাষাণ হৃদয়, কঠোরস্বভাব ফেরেশতাগণ। তারা আল্লাহ তা’আলা যা আদেশ করেন, তা অমান্য করে না এবং যা করতে আদেশ করা হয়, তাই করে।’ (সূরা তাহরীম ০৬)

আমল নিজের মুক্তির জন্য যথেষ্ট নয়
আয়াতটিতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, কেবল নিজেকে আগুন থেকে বাঁচালাম আর নিশ্চিন্তে বসে থাকলাম এতোটুকু যথেষ্ট নয় বরং পরিবার-পরিজনকেও আগুন থেকে বাঁচাতে হবে। বর্তমানে আমরা দেখি, মানুষ নিজে খুব ধার্মিক,নামাজের গুরুত্ব দেয়, যাকাত আদায় করে, আল্লাহর রাস্তায় অর্থ-সম্পদ খরচ করে এবং শরীয়তের বিধি-বিধানের উপর আমল করার চেষ্টা করে অথচ তার স্ত্রী সন্তানের প্রতি তাকালে মনে হয় পূর্ব-পশ্চিম পরিমাণ ব্যবধান। সে এক পথে তারা অন্য পথে। স্ত্রী-সন্তানের কাছে ফরজ-ওয়াজিবের তোয়াক্কা নেই। গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার ফিকির নেই। তারা গুনাহের জোয়ারে ভাসছে। অথচ সেই ধার্মিক আত্মতৃপ্তিসহ বসে আছে। মনে করে, আমি তো মসজিদের প্রথম কাতারে শামিল হই, জামাতে নামাজ আদায় করি! অথচ পরিবার-পরিজনকে দোযখের আগুন থেকে বাঁচানোর ব্যাকুলতা নেই। সুতরাং এমন ব্যক্তিরও মুক্তি নেই। এ ব্যক্তি আল্লাহর পাকড়াও থেকে রক্ষা পাবে না। শুধু নিজের কৈফিয়ত দিয়ে পার পাবে না। বরং স্ত্রী-সন্তানদেরও কৈফিয়ত দিতে হবে। কারণ তাদেরকে রক্ষা করার দায়িত্বও ছিল তার। সুতরাং কেয়ামতের দিন সেও পাকড়াও হবে এবং জবাবদিহিতার মুখোমুখি হবে।

সন্তান যদি না মানে
আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তোমরা নিজেকে এবং পরিবার-পরিজনকে দোযখের আগুন থেকে বাঁচাও।’ আসলে এখানে একটি সন্দেহের অবসানের প্রতি ইঙ্গিত আছে। যে সন্দেহটি সাধারণত আমাদের অন্তরে জাগে। সন্দেহটি হল, আজকাল যখন কাউকে বলা হয়, নিজের ছেলে মেয়েকে দিন শিখাও এবং গুনাহ থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করো, তখন এর উত্তরে বলা হয়, ছেলে মেয়েকে দ্বীনের পথে আনার যথেষ্ট চেষ্টা করেছি কিন্তু কী করবো? সমাজের পরিবেশ খারাপ, অনেক বুঝানোর পরও তারা মানতে চায় না! পরিবেশের কারণে তারা বিপথে চলে গেছে তাই কী আর করা! তাদের আমল তাদের কাছে আমার আমল আমার কাছে। আরও প্রমাণ হিসেবে পেশ করে, হযরত নূহ আ.-এর ছেলেও তো কাফের ছিল নূহ আ. তাকে প্লাবন থেকে বাঁচাতে পারেন নি। অনুরূপভাবে আমরা চেষ্টা করতে ত্রুটি করি নি। না মানলে তো কিছু করার নেই!

দুনিয়ার আগুন থেকে কিভাবে বাঁচান?
কোরআন মজিদের এ আয়াতটিতে ‘আগুন’ শব্দ উল্লেখ করা রয়েছে। এই শব্দটিতে একটি সন্দেহের নিরসন রয়েছে। তা এভাবে যে, পিতামাতা যদি সন্তানকে ধর্মহীনতা থেকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করে তাহলে তারা দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাবে। সন্তানের দায় তখন সন্তানের উপরই বর্তাবে। কিন্তু দেখতে হবে, পিতা-মাতা কী পরিমাণ চেষ্টা করেছে। কোরআন মজিদে ‘আগুন’ শব্দটি ব্যবহার করে এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, পিতা-মাতা নিজের ছেলেমেয়েকে গুনাহ থেকে বাঁচানোর এমনভাবে চেষ্টা করবে যেমনিভাবে দুনিয়ার আগুন থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। যেমন, একটি লেলিহান অগ্নিকুণ্ড যার সম্পর্কে মানুষ নিশ্চিত যে এই অগ্নিকুন্ডে যে প্রবেশ করবে সে নির্ঘাত মারা যাবে। সুতরাং যদি কোন অবুঝ শিশু সুন্দর মনে করে অগ্নিকুন্ডে প্রবেশ করতে চায় তখন তার পিতামাতা কী করবে ? পিতামাতা কি সন্তানকে শুধু এই উপদেশ দিয়ে নিশ্চিন্ত বসে থাকবে যে, বাবা! ওখানে যেও না।
যদি যাও তাহলে পুড়ে কয়লা হয়ে যাবে, তুমি নির্ঘাত মারা যাবে। এই উপদেশ সত্ত্বেও যদি সন্তান অগ্নিকুন্ডের প্রতি অগ্রসর হয় তখন পিতামাতা কী ভূমিকা পালন করবে? তারা কি মনে করবে যে, উপদেশ দিয়েছি এতেই তো যথেষ্ট হয়েছে! আমাদের দায়িত্ব শেষ করেছি! এবার মানা না মানা তার ব্যাপার! পিতা-মাতা এভাবে দায়মুক্তির চিন্তা করবে নাকি সন্তানকে বাঁচানোর জন্য বিচলিত হবে। বরং সন্তানকে অগ্নিকুণ্ডের পাড় থেকে নিয়ে আসা পর্যন্ত দুনিয়া তাদের কাছে অন্ধকার মনে হবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, হে আমার মুমিন বান্দা! তুমি নিজের সন্তানকে দুনিয়ার সামান্য আগুন থেকে রক্ষা করার জন্য এত ব্যাকুল, এর জন্য শুধু মুখের উপদেশের উপর আস্থা রাখতে পার না। সেখানে জাহান্নামের সেই ভয়াবহ অগ্নিকুণ্ড, যার ভয়াবহতা কল্পনাকেও হার মানায়। সেই অগ্নিকুণ্ড থেকে নিজের পরিবার-পরিজনকে বাঁচানোর জন্য শুধু মুখের উপদেশকে যথেষ্ট মনে কর কীভাবে? সুতরাং পিতামাতা সহজেই বলতে পারবে না দায়মুক্তির কথা। তাদেরকে বুঝিয়েছি, নিজের দায়িত্ব পালন করে ফেলেছি–এসব বলে মুক্তি পাওয়া যাবে না।

সব কিছুর ফিকির আছে শুধু দীনের ফিকির নেই
হযরত নূহ আ.-এর ছেলে সম্পর্কে বলা হয়, সে কাফের ছিল, তাকেও কুফরি থেকে ফেরানো সম্ভব হয় নি। এর দায়ভার হযরত নূহ আ.-এর উপর বর্তায় না। কারণ তিনি ছেলের পেছনে লাগাতার নয় শত বছর মেহনত করেছেন। তাকে দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন। তাই তিনি জবাবদিহিতা থেকে মুক্ত হয়ে গেছেন। অথচ আমাদের অবস্থা হলো, আমরা দু’ একবার বলি। তারপর হাত পা ছেড়ে দেই। অথচ উচিত ছিল সব সময় বিচলিত থাকা যেমনিভাবে দুনিয়ার আগুন থেকে রক্ষার জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকি। অন্তরের ব্যথা যদি এই পর্যায়ের না হয়,তাহলে বুঝতে হবে দায়িত্ব পুরোপুরি পালন হয় নি। আজকাল দেখা যায়, ছেলের প্রতিটি বিষয়ে মা-বাবা নজর রাখে। লেখাপড়া থাকা-খাওয়াসহ সবকিছু ঠিকমতো চলছে কিনা এ নিয়ে পিতা-মাতার কত মাথাব্যথা? কিন্তু দ্বীনের ব্যাপারে কোন মাথা ব্যথা নেই।

কিছুটা বদদীন হয়ে গেছে!
এক তাহাজ্জুদগোজার ব্যক্তি। তার ছেলে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছে। ইংরেজি শিখেছে। তারপর ভালো একটি চাকরি পেয়েছে। একদিন তার বাবা খুশির সঙ্গে বললেন, মা-শাআল্লাহ, আমার ছেলে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেছে। ভালো চাকরি পেয়েছে। এখন সমাজে মাথা উঁচু করে অবস্থান করছে। কিন্তু কিছুটা বদদীন হয়ে গেছে। বাবার কথার ভঙ্গিতে বোঝা যায়, একটু বদদীন হওয়া তেমন কিছু নয়। এটা সাধারণ বিষয়। অথচ ভদ্রলোক বড় দ্বীনদার! নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়েন!

শুধু রূহ নেই
আব্বাজান মুফতি মুহাম্মদ শফী রহ. একটা ঘটনা বলতেন, এক লোক মারা গেছে, লোকেরা জীবিত মনে করে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে এসেছে। ডাক্তার যেন পরীক্ষা করে দেখেন, এ ব্যক্তির কী হয়েছে! সে নড়াচড়া করে না কেন? ডাক্তার পরীক্ষা করে বলেন, লোকটি সম্পূর্ণ ঠিক আছে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত প্রতিটি অঙ্গই ঠিক আছে তবে শুধু রূহটা নেই। রূহটা বের হয়ে গেছে। তেমনিভাবে ভদ্রলোক নিজের ছেলের সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, মা-শা-আল্লাহ সে এখন অনেক বড় হয়েছে কিন্তু শুধু একটু বদদীন হয়ে গেছে। যেন বদদীন হওয়া তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নয়। এর দ্বারা বড় কোনো ক্ষতি হবে এমন কোনো বিষয়ও নয়।

নতুন প্রজন্মের অবস্থা
আজ আমাদের অবস্থা হল, সকল বিষয়ের ফিকির আছে কিন্তু দীনের কোন ফিকির নেই। দীন যদি এতই পরিত্যক্ত বস্তু হয়, তাহলে নামায পড়া, তাহাজ্জুদ পড়া কিংবা মসজিদে যাওয়ার কষ্ট করার দরকার কী! নিজের সন্তানের মতো হয়ে যান না কেন? শিশুকালে সন্তানকে পাঠিয়ে দেয় নার্সারিতে। সেখানে তাকে কুকুর-বিড়াল শেখানো হয়। কিন্তু দ্বীনি শিক্ষা দেওয়া হয় না। ফলে নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যত অন্ধকারে চলে যাচ্ছে। তারাই তো জাতির ভবিষ্যত। জাতির ভবিষ্যত নেতৃত্ব তো তাদের হাতে। অথচ তারা নিজেরাই হারিয়ে যাচ্ছে গোমরাহীর আবর্তে। কোরআন ও হাদিসের শিক্ষা থেকে অনেক দূরে।

বর্তমানের ছেলে-মেয়েরা পিতামাতার মাথায় সওয়ার
আল্লাহ তাআলার একটা নীতি আছে, যার বর্ণনা হাদীস শরীফে প্রদান করা হয়েছে। যে ব্যক্তি মাখলুকের সন্তুষ্টির জন্য আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে, আল্লাহ তাআলা ঐ মাখলুককে তার ওপর চড়াও করে দেন। যেমন, আজকাল তা-ই হচ্ছে। পিতা-মাতা সন্তানকে খুশি করে। তার আয় রুজি ও সামাজিক উন্নতির কথা চিন্তা করে। এসব কিছু করতে গিয়ে আল্লাহকে নারাজ করে। অবশেষে ফল মিলে, ওই সন্তান ঐ পিতা মাথার উপরে উঠে বসে। পিতা-মাতা বার্ধক্যে উপনীত হলে ওই সন্তান তাদেরকে নার্সিংহোমে রেখে আসে। ওখানে পিতা-মাতার জীবন কেমন কাটে, তার খোঁজ-খবরও সন্তান নেয় না।

পিতা-মাতা নার্সিংহোমে
এমন অনেক ঘটনা পশ্চিমাদের দেশে আছে যে, বৃদ্ধ পিতা-মাতা নার্সিংহোমে পড়ে থাকে। এমনই এক পিতা নার্সিংহোমে মারা গেছে। ম্যানেজার ছেলের কাছে ফোন করেছে, আপনার পিতা মারা গেছে, তার দাফনের ব্যবস্থা করুন। ছেলে উত্তর দিল, বাবার মৃত্যুতে আমি আন্তরিকভাবে শোকাহত। কিন্তু দয়া করে আপনি তার কাফন-দাফনের কাজটা সেরে ফেলুন। আমি এসে বিল পরিশোধ করে দিব।
করাচির নার্সিংহোমেও এমন একটি ঘটনা ঘটেছে। ছেলেকে মৃত্যুর সংবাদ জানানো হলে সে প্রথমে আসার ওয়াদা দিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে কাফন দাফনের ব্যবস্থা না করে বলল, জরুরী মিটিং আছে বিধায় আসতে পারবো না।
গভীরভাবে ভাবুন, এই সেই সন্তান যাকে খুশি করার জন্য আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করা হয়েছে।

সন্তানের প্রতি ইয়াকুব আ.-এর উপদেশ
মৃত্যুর সময় সাধারণত মানুষ ছেলে-মেয়েদের একত্র করে। উদ্দেশ্য, তাদেরকে জিজ্ঞেস করবে, আমার মৃত্যুর পর তোমাদের কী হবে? তোমরা কীভাবে আয়-রোজগার করবে? হযরত ইয়াকুব আ.ও মৃত্যুর সময় তার সন্তানদের একত্রিত করলেন। কিন্তু তিনি তাদের কাছে আয়-রোজগারের কথা জিজ্ঞেস করেন নি। জিজ্ঞেস করলেন, বলো, মৃত্যুর পর তোমরা কার ইবাদত করবে? বোঝা গেল, সন্তান ও পরিবার-পরিজনের জন্য এ ধরনের চিন্তাই করতে হবে।

শিশুদের সঙ্গেও মিথ্যা না বলা
হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সামনে এক মহিলা নিজের শিশুকে কোলে নেওয়ার জন্য ডাকছিল। শিশুটি আসতে চাচ্ছিল না। মহিলা শিশুটিকে বলল, আসো, তোমাকে একটা জিনিস দিব। একথা শুনে শিশুটি কোলে এসে পড়ল। রাসূলুল্লাহ মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি যে বলেছিলে তাকে কিছু দিবে, সত্যিই কি তাকে কিছু দেয়ার ইচ্ছা তোমার আছে? মহিলা বললো, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার কাছে একটা খেজুর আছে। ওই খেজুরটি তাকে দেওয়ার ইচ্ছা আছে। রাসূলুল্লাহ বললেন, যদি তোমার এই ইচ্ছা না থাকতো, তাহলে তোমার দ্বারা অনেক বড় গুনাহ হয়ে যেত। কারণ তখন তোমার অঙ্গীকারকে মিথ্যা হত। তখন তার কচি মনে তুমি এই কথা বসিয়ে দিতে যে, মিথ্যা ওয়াদা ভঙ্গ তেমন কোনো খারাপ কাজ নয়।

কচি বয়স থেকেই সন্তানকে শিক্ষা দেওয়া
এ হাদীসটি এ কথার প্রতি ইঙ্গিত করে যে, কচি বয়স থেকেই শিক্ষা শুরু হয়। বিন্দু বিন্দু বিষয় থেকেই সে চরিত্র শেখে। বর্তমানে দেখা যায়, বাবা মা ছেলে-মেয়ের ভুলত্রুটি ধরে না। মনে করে, অবুঝ শিশু, তাকে মুক্ত মনে বড় হতে দেওয়া উচিত। সব ব্যাপারে ধরাধরি করা অনুচিত।
প্রকৃতপক্ষে শিশু অবুঝ হতে পারে, কিন্তু বাবা-মা তো অবুঝ নয়। তাদের উচিত সন্তানের ছোটখাটো বিষয়েও লক্ষ্য রাখা। অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ বলেছেন,

عَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ عَنْ أَبِيهِ عَنْ جَدِّهِ قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ : مُرُوا أَوْلَادَكُمْ بِالصَّلَاةِ وَهُمْ أَبْنَاءُ سَبْعِ سِنِينَ ، وَاضْرِبُوهُمْ عَلَيْهَا وَهُمْ أَبْنَاءُ عَشْرٍ ، وَفَرِّقُوا بَيْنَهُمْ فِي الْمَضَاجِعِ

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ বলেছেন, ‘নিজের সন্তানদেরকে সাত বছর বয়সে নামাজের নির্দেশ দাও।’ যদিও তখনো নামাজ ফরজ হয় নি।কিন্তু অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য এই বয়স থেকেই নামাজের আদেশ দিতে হবে। ‘দশ বছর বয়সে নামাজ না পড়লে তাকে মারধর কর এবং ঘুমের বিছানা আলাদা করে দাও।’
এ হাদিসের আলোকে হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানবী রহ. বলেছেন, শিশুকে সাত বছরের পূর্বে নামাজ, রোজা ইত্যাদির জন্য চাপ সৃষ্টি করা যাবে না। তাই বলা হয়, সাত বছরের পূর্বে কোন শিশুকে মসজিদে আনা উচিত হবে না। মসজিদের পবিত্রতা নষ্ট না করার শর্তে কেবল অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য আনা যাবে।

শিশুকে খাবারের পদ্ধতি শিক্ষা দেওয়া

عَنْ عُمَرَ بْنَ أَبِي سَلَمَةَ يَقُوْلُ كُنْتُ غُلاَمًا فِي حَجْرِ رَسُوْلِ اللهِ وَكَانَتْ يَدِي تَطِيشُ فِي الصَّحْفَةِ فَقَالَ لِي رَسُوْلُ اللهِ يَا غُلاَمُ سَمِّ اللهَ وَكُلْ بِيَمِينِكَ وَكُلْ مِمَّا يَلِيكَ فَمَا زَالَتْ تِلْكَ طِعْمَتِي بَعْدُ

হযরত আমর ইবনে সালামা রাযি. বলেছেন,ছোটবেলা আমি নবীজি -এর সাথে খানা খাওয়ার সময় প্লেটের এদিক ওদিক হতে খাচ্ছিলাম। এটা দেখে নবীজী বললেন, প্রিয় বৎস! বিসমিল্লাহ পড়া এবং ডান হাত ধরা খাও আর তোমার সামনের দিক থেকে খাও।
দেখুন, রাসূলুল্লাহ এরকম ছোট বিষয়েও সতর্ক করেছেন। তাদেরকে আদব ও শিষ্টাচার শিখিয়েছেন।

শিশুকে মারধর করার মাত্রা ও নিয়ম
শিক্ষক ও পিতা মাতা শিশুদেরকে প্রহার করতে পারবেন, যে পরিমাণ পরে কোন চিহ্ন না পড়ে। দাগ না পড়লে এতোটুকু প্রহার জায়েজ। আজকাল শিশুদের কেমন ভাবে মারা হয়, যার ফলে রক্ত ঝরে, শরীরে দাগ পড়ে। এমনকি শিশু আহতও হয়ে পড়ে। হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানবী রহ. বলেন, আমার বুঝে আসে না এই গুনাহের ক্ষমা কিভাবে হবে! কারণ ক্ষমা কার নিকট চাইবে! শিশুর নিকট ক্ষমা চাইলে সে তো ক্ষমা করার যোগ্য নয়।
হাকীমুল উম্মত থানভী রহ. বলেন, কোন শিশুকে মারার যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে  গোস্বার সময়ের সাথে সাথে মারা উচিত নয়; বরং রাগ দূর হওয়ার পর কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে প্রহার করা উচিত। যাতে সীমালঙ্ঘন না হয়।

وَآخِرُ دَعْوَانَا اَنِ الْحَمْدُ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ