জিজ্ঞাসা–১৬৭৭: আমি অনেক আলেমকে দেখি, যারা বর্তমানের আহলে হাদিসদের বিরোধিতা করে থাকেন। অনেক সময় আমার কাছে এটা বাড়াবাড়ি মনে হয়। কারণ, তাদের আমলগুলো তো চার মাযহাবের কোনো না কোনোটিতে আছে। সুতরাং এটা তো সেরেফ শাখাগত ইখতেলাফ। আবার আমাদের পরিচিত দুই একজন আহলে হাদিসকে দেখলে মনে হয় যে, না, এটা বাড়াবাড়ি নয়। কারণ, তারা একটু উগ্র টাইপের। গায়ে পড়ে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলে। অনেক আলেমকে তুচ্ছ করে কথা বলে। আমি জানতে চাই, তারা আসলে কী? তাদের ঈমান আছে কি? তাদেরকে আহলে সুন্নাহ গণ্য করা যাবে কি?–আজাদ হুসাইন।
জবাব: প্রিয় প্রশ্নকারী দীনি ভাই, আপনার প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর দেওয়ার আগে দু’টি মৌলিক বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি–
১. বর্তমানে মুসলিম উম্মাহ অস্তিত্বে-সংকটে নিপতিত। বলা বাহুল্য, সংকটময় এই পরিস্থিতি দৃঢ় ঈমানী চেতনার অধিকারী ব্যক্তিবর্গের জন্যই শুধু নয় বরং সামান্য ঈমানী চেতনার অধিকারী সাধারণ মুসলিম জনগণের জন্যও গভীর উদ্বেগ সৃষ্টিকারী। এই মুহূর্তে বিশ্বের সকল মুসলমানের জন্য সর্বপ্রথম ও সর্বাপেক্ষা জরুরী ও কর্তব্য বিষয় হল, পারস্পরিক ইখতেলাফকে এক দিকে রেখে মুসলিম জনসাধারণকে ঈমান বিধ্বংসী ফিতনা সম্পর্কে সচেতন করার চেষ্টা করা। নতুন প্রজন্মকে দ্বীনের জরুরী বিষয় সম্পর্কে অবহিত করা। তাদের মন ও মস্তিষ্কে এ কথা বদ্ধমূল করে দেওয়া যে, মানবজীবনের জন্য কল্যাণকর আদর্শ একমাত্র ইসলামী আদর্শ, ইসলাম ব্যতীত অন্য যে কোন আদর্শের শ্লোগান-তা যতই চিত্তাকর্ষক হোক, ফাঁকা বুলিসর্বস্ব বৈ কিছু নয়।
২. আহ্লুসসুন্নাহ ওয়াল জামাআ’হ-এর নাম থেকেই একথা স্পষ্ট যে, কুরআন, সুন্নাহ ও উম্মাতের বিশেষ করে সাহাবায়ে কেরামের ইজমা’কে তাঁরা শরীয়তের দলিল হিসেবে গ্রহণ করে। এদের বিপরীত যত ফেরকা আছে তারা যে নামই ধারণ করুক না কেন; মূলত তারা আহলে বিদআ’ত। যদিও এই আহলে বিদআ’ত পরিভাষাটি সর্ব প্রথম মুতাজিলাদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছিল। এর প্রধান কারণ ছিল, তারা উম্মতের ইজমা’কে দলিল মানতো না। (শরহুল আকায়িদ, নাসাফী ১৬)
প্রিয় প্রশ্নকারী দীনি ভাই, এবার আসা যাক আপনার প্রশ্নের উত্তরে–
এক. যে দল বা ফেরকা সাহবায়ে কেরামের ইজমা’-কে দলিল মানে না; তারাই আহ্লুসসুন্নাহ ওয়াল জামাআ’হ-এর দৃষ্টিতে আহলে বিদআ’ত। সে হিসেবে প্রচলিত আহলে হাদিস সম্প্রদায়ও আহলে বিদআত। তাছাড়া প্রচলিত আহলে হাদিস ফেরকার লিটারেচার ও বক্তব্য থেকে একথা স্পষ্ট যে, এরা নিজেদের ব্যাপারে এমন কিছু স্বতন্ত্র মত ধারণ করে যার দৃষ্টান্ত মুসলিম উম্মাহর সোনালী অতীতে খুঁজে পাওয়া যায় না। অতীতে ‘আহলুল হাদিস’ উপাধি কোনো শাখাগত মাসলাক বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হতো না। বরং যারা হাদিসশাস্ত্র নিয়ে চর্চা করতেন, তাদেরকে বলা হত, আহলুল হাদিস বা আসহাবুল হাদীস। অর্থাৎ অতীতে এটা ছিল কেবলই শাস্ত্রীয় পরিভাষা। কিন্তু অতীতের সম্পূর্ণ বিপরীতে হাদিস অনুসরণ করে আহলে হাদিস নাম ধারণ করা এবং সেটাকে দলীয় ও সাম্প্রদায়িক রূপ দেয়ার প্রবণতা এটা বর্তমানের কথিত আহলে হাদিসের মাঝেই পাওয়া যায় এবং তাও কেবল এ ভারত উপমহাদেশেই লক্ষ করা যায়। ভারত উপমহাদেশেও এদের অস্তিত্ব ১৮৫৭ ঈ. এর পরে হয়। এই কথাগুলোর প্রমাণ তাদের বিভিন্ন লেখায় স্পষ্টভাবেই আছে।
হ্যাঁ, এদের চিন্তাধারা অতীতের কিছু ইমামদের সঙ্গে কখনো কখনো মিলে যায় বটে; কিন্তু এটাও বুঝতে হবে যে, ওই সকল ইমামদের সঙ্গে চার ইমামের মতপার্থক্য ছিল ফুরুঈ তথা শাখাগত। আর তাকলিদ ও উম্মতের ইজমা’-বিরোধিতা ফুরুঈ কোনো বিষয় নয়; বরং এটা উসুলী ইখতেলাফ। সুতরাং প্রচলিত কথিত আহলে হাদিসের সঙ্গে আহ্লুসসুন্নাহ ওয়াল জামাআ’হর ইখতেলাফ উসুলী তথা মোলিক–ফুরুঈ বা শাখাগত নয়।
পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে যে, যদিও ইখতেলাফটা উসুলী; কিন্তু ইখতেলাফটা এই পর্যায়েরও নয় যে, তাদেরকে কাফের বলা হবে। এ কারণেই এ পর্যন্ত আহ্লুসসুন্নাহ ওয়াল জামাআ’হর কোনো নির্ভরযোগ্য মুফতী তাদেরকে কাফের বলতে শোনা যায় নি।
আমাদের একটা ভুল হল, আমরা চার ইমামের পারস্পরিক ইখতেলাফ আর কথিত ও প্রচলিত আহলে হাদিসের ইখতেলাফকে এক দৃষ্টিতে দেখি। অথচ চার ইমামের মাঝে পারস্পরিক ইখতেলাফ থাকা সত্ত্বেও তাঁরা অনুসরণীয় ও বরেণ্য হয়েছেনই এ কারণে যে, তাঁদের ইখতেলাফ ছিল ‘ফুরুঈ’। আর চিন্তাগতভাবে ও উসূলের দিক থেকে তাঁদের মাঝে কোনো ইখতেলাফ ছিলনা; বরং তাঁরা সকলেই সাহাবায়ে কেরাম ও উম্মতের ইজমা’-কে শরীয়তের দলিল মানতেন।
দুই. আলেমগণ নবীদের ওয়ারিশ। তাদেরকে গালি দেয়া উপহাস করা কেবল গুনাহই নয়; বরং ফকিহগণ বলেন,
كفى المرء شرًّا ألا يكون صالحًا، ويقع في الصالحين