জিহাদের একক অর্থ এবং ব্যাপক অর্থ

জিজ্ঞাসা–৭২৪: ফি-সাবিলিল্লাহ বা আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে জিহাদ বলতে কী বোঝানো হয়েছে এবং কোন কোন বিষয় এর অন্তর্ভুক্ত। ধন্যবাদ। উত্তর দিয়ে বাধিত করবেন।– রহমত উল্লাহ।

জবাব:

জিহাদের দুই অর্থ

ইবন রুশদ রহ. বলেন,

 فكل من أتعب نفسه في ذات الله فقد جاهد في سبيله إلا أن الجهاد في سبيل الله إذا أطلق فلا يقع بإطلاقه إلا على مجاهد الكفار بالسيف حتى يدخلوا في الإسلام أو يعطوا الجزية عن يد وهم صاغرون

যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে কষ্ট-ক্লেশ করেছে, সেই আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছে। তবে ‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ’ শব্দকে যখন শর্তমুক্ত রাখা হয় তখন এর দ্বারা উদ্দেশ্য হয়, ওই মুজাহিদ যে কাফেরদের বিরুদ্ধে তরবারি দ্বারা যুদ্ধ করে, যাতে তারা ইসলামে প্রবেশ করে কিংবা লাঞ্ছিত হয়ে জিযিয়া প্রদানে বাধ্য হয়। (মুকাদ্দামাতু ইবন রুশদ ১/৩৬৯)

উক্ত বক্তব্য থেকে বুঝা যায়, জিহাদের একটি একক অর্থ রয়েছে এবং আরেকটি ব্যাপক অর্থ রয়েছে।

এক. জিহাদের একক অর্থ

১. আল্লমা কাসানি হানাফি রহ. বলেন,

وفي عرف الشرع يستعمل في بذل الوسع والطاقة بالقتال في سبيل الله عز وجل بالنفس والمال واللسان أو غير ذلك

শরিয়তের পরিভাষায় জিহাদ; জান, মাল, জবান অথবা অন্যান্য মাধ্যমে চেষ্টা ও শক্তি ব্যয় করে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করা। (বাদায়ে’ ৭/৯৭)

২. ইবনু আরাফা মালেকি রহ. বলেন,

 قتال مسلم كافراً غير ذي عهد لإعلاء كلمة الله تعالى

যে কাফেরের সঙ্গে সন্ধিচুক্তি নেই, তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নাম জিহাদ। (আলফাওয়াকিহুদদাওয়ানি ২/ ৮৭৯)

৩. ইবনু হাজার আসকালানি শাফিঈ রহ. বলেন,

شرعاً بذل الجهد في قتال الكفار

শরিয়তের পরিভাষায় জিহাদ; কাফেরদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রচেষ্টা ব্যয় করা। (ফাতহুল বারী ৬/ ৩)

৪. আল্লামা বাহুতি হাম্বলি রহ. বলেন,

وشرعاً قتال الكفار خاصة

শরিয়তের পরিভাষায় জিহাদ; বিশেষত কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। (দাকায়েকু উলিননুহা ১/৭১৬)

দুই. জিহাদের ব্যাপক অর্থ

১. ইমাম রাগিব ইসফাহানি রহ. বলেন,

“والجهاد ثلاثة أضرب: مجاهدة العدو الظاهر، ومجاهدة الشيطان، ومجاهدة النَّفس، وتدخل ثلاثتها في قوله تعالى:{وَجَاهِدُوا فِي اللَّهِ حَقَّ جِهَادِهِ}[الحج: 78]، {وَجاهِدُوا بِأَمْوالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ}[التوبة: 41]، {إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَهاجَرُوا وَجاهَدُوا بِأَمْوالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ}[الأنفال: 72]… والمجاهدة تكون باليد واللسان، قال : جَاهِدُوا الْمُشْرِكِينَ بِأَيْدِيكُمْ، وَأَلْسِنَتِكُمْ

জিহাদ তিন প্রকার। প্রকাশ্য শ্ত্রুর বিরদ্ধে জিহাদ করা, শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদ করা, নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করা। এই তিন প্রকারের জিহাদের উল্লেখ রয়েছে আল্লাহ তাআলার এই বাণীগুলোতে: তোমরা আল্লাহর জন্যে শ্রম স্বীকার কর যেভাবে শ্রম স্বীকার করা উচিত। –সূরা হজ্জ ৭৮। তোমরা জিহাদ কর আল্লাহর পথে নিজেদের মাল ও জান দিয়ে।–সূরা তাওবা ৪১। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, যারা ঈমান এনেছে, দেশ ত্যাগ করেছে, স্বীয় জান ও মাল দ্বারা আল্লাহর রাহে জিহাদ করেছে…।–সূরা আনফাল ৭২। আর জিহাদ হাত ও যবান দ্বারা হয়। রাসূলুল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা মুশরিকদের বিরুদ্ধে নিজেদের হাত ও যবান দ্বারা জিহাদ কর।’ (আল মুফরাদাত ফী গারীবিল কুরআন ২০৮)

২. ইবন রুশদ রহ. বলেন,

الجهاد المبالغة في إتعاب الأنفس في ذات الله وهو على أربعة أقسام: جهاد بالقلب أن يجاهد الشيطان والنفس عن الشهوات المحرمات، وجهاد باللسان أن يأمر بالمعروف وينهى عن المنكر. وجهاد باليد أن يزجر ذوو الأمر أهل المناكر عن المنكر بالأدب…، ومن ذلك إقامتهم الحدود، وجهاد بالسيف قتال المشركين على الدين

জিহাদ হচ্ছে, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে প্রানপণ কষ্ট করা। এটি চার প্রকার। অন্তর দ্বারা জিহাদ: শয়তানের বিরদ্ধে ও অবৈধ কামনা থেকে বিরত থাকার লক্ষে নফসের জিহাদ। যবান দ্বারা জিহাদ: সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা। হাত দ্বারা জিহাদ: দায়িত্বশীল ব্যক্তি গুনাহগারকে গুনাহ থেকে শিষ্টাচারের সঙ্গে বাঁধা দেয়া এবং দণ্ডবিধি কায়েম করাও এর অন্তর্ভুক্ত। তরবারি দ্বারা জিহাদ: দীনের জন্য মুশরিকদের বিরুদ্ধে লড়াই করা। (আততাজ ওয়াল ইকলীল (৪/৫৩৬)

৩. ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন,

الجهاد أربع مراتب: جهاد النَّفس، وجهاد الشيطان، وجهاد الكفار، وجهاد المنافقين

জিহাদের চারটি স্তর রয়েছে। নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ, শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদ, কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদ, মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ। (যাদুল মাআ’দ ৩/৯)

তিনি আরো বলেন,

الجهاد نوعان: جهاد بالسيف والسنان، وهو جهاد العامة، وأنصاره كثير، وجهاد بالحجة والبيان وهو جهاد الخاصة من أتباع الرسل وهو جهاد الأئمة، وأنصاره قليل، وهو أفضل النوعين، لعظم منفعته، وشدة مؤنته، وكثرة أعدائه

জিহাদ দুই প্রকার। তরবারি ও হাতিয়ার দ্বারা জিহাদ: এটি সাধারণ শ্রেণীর জিহাদ, এর সাহায্যকারীগণ সংখ্যায় অনেক। প্রমাণ ও বয়ান দ্বারা জিহাদ: এটি রাসুলগণের মধ্য থেকে বিশেষ শ্রেণীর জিহাদ। এটি ইমামদের জিহাদ। এর সাহায্যকারীগণ সংখ্যায় কম। এই দুই শ্রেণীর মধ্যে এরা অধিক উত্তম। কেননা, এর উপকারিতা বেশি, খোরাক সংকট ও শত্রু প্রচুর। (মিফতাহু দারিসসা’দাহ ১/৭০)

সার কথা

সার কথা হল, জিহাদের একক অর্থ একটাই। তাহল, কাফেরদের বিরুদ্ধে সশস্র যুদ্ধ। পক্ষান্তের ব্যাপক অর্থে জিহাদ পাঁচ শ্রেণীর বিরুদ্ধে হতে পারে। ১. কাফেরদের বিরদ্ধে ২. শয়তানের বিরুদ্ধে ৩. নফসের বিরদ্ধে ৪. মুনাফিকদের বিরুদ্ধে ৫. বিভিন্ন শ্রেণীর পাপিষ্ঠদের বিরুদ্ধে। অনুরূপভাবে জিহাদের একক অর্থ কেবল অস্ত্র বা হাতিয়ার দ্বারা জিহাদ। পক্ষান্তের ব্যাপক অর্থে জিহাদ যেমনিভাবে অস্র দ্বারা হতে পারে, তেমনিভাবে হাত দ্বারাও হতে পারে, যবান দ্বারাও হতে পারে এমনকি অন্তর দ্বারাও হতে পারে।

والله اعلم بالصواب
উত্তর দিয়েছেন
শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × 1 =