জিজ্ঞাসা–১৮৭: জীবন বীমা (Life Insurance) জায়েয আছে কিনা?– ফারহান: [email protected]
জবাব: জীবন বীমা (Life Insurance, تامين الحياة) : মানুষের স্বাভাবিক বা আকষ্মিক মৃত্যুতে পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার নিশ্চয়তা প্রদানে প্রতিষ্ঠিত জীবন বীমা। এতে ব্যক্তি একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য বীমা করে। এর মধ্যে কিস্তিতে সে একটি নির্দিষ্ট হারে প্রিমিয়াম পরিশোধ করে। এর দুই অবস্থা :
ক. ব্যক্তি নির্দিষ্ট মেয়াদের পরও জীবিত থাকে : এ ক্ষেত্রে তার জমাকৃত সমুদয় টাকা সুদসহ ফেরত দেয়া হয়।
খ. নির্দিষ্ট মেয়াদের পূর্বেই তার মৃত্যু হয় : এ ক্ষেত্রে পূর্ণ মেয়াদে সে যত টাকা জমা করার চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল, তত টাকা তৎকর্তৃক নিযুক্ত নমিনীকে প্রদান করা হয়।
বিধান :
সর্বসম্মতিক্রমেই এটি জায়েয নেই। কারণ :
প্রথমত: জীবন বীমায় তাৎক্ষণিক ও বিলম্বে সুদের ব্যবস্থা আছে। কেননা বীমা কোম্পানি গ্রাহককে বা তার উত্তরাধিকারকে বা অনুমোদিত ব্যক্তিকে জমা কৃত অর্থের চেয়ে বেশী প্রদান করবে, ফলে তা তাৎক্ষণিক সুদের পর্যায়ভুক্ত গণ্য হবে। আর এই প্রদানটি নির্দিষ্ট একটি সময় অতিবাহিত হওয়ার পর দেয়ার কারণে তা বিলম্ব সুদেরও অন্তর্ভুক্ত হবে। আর উভয় প্রকার সুদ হারাম। আল্লাহ বলেন,
وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا
“অথচ আল্লাহ তাআলা ক্রয়-বিক্রয় বৈধ করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন।” (সূরা বাকারাহ ২৭৫)
দ্বিতীয়ত: জীবন বীমা হচ্ছে এমন একটি চুক্তি যাতে অর্থের বিনিময় হয়ে থাকে। কিন্তু তাতে আছে কঠিন ধোঁকার সম্ভাবনা। কেননা বীমাকারীর পক্ষে চুক্তির সময় একথা জানা সম্ভব নয় যে, কি পরিমাণ অর্থ সে প্রদান করবে এবং কি পরিমাণ গ্রহণ করবে। এমনও হতে পারে যে, সে হয়তো এক বা দু কিস্তি অর্থ প্রদান করল এবং তারপরেই কোন দুর্ঘটনা ঘটল। তখন বীমা কর্তৃপক্ষ শর্ত অনুযায়ী বিরাট পরিমাণ অর্থ দিতে বাধ্য থাকবে। হতে পারে কোন দুর্ঘটনাই ঘটল না। তখন বীমাকারী সকল কিস্তি পরিশোধ করতেই থাকবে। অথচ বেঁচে থাকতে সে শেষে কিছুই পাবে না; তার মৃত্যুর পর তার ওয়ারিছগণ পাবে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘বাই গারার’বা প্রতারণা ও ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা থেকে নিষেধ করেছেন।(মুসলিম)
তৃতীয়ত: এই প্রকার বীমায় জুয়া বিদ্যমান। কেননা, ব্যক্তি কখন মৃত্যুবরণ করবে আর কত টাকা পাবে, তা অনিশ্চিত। এ ক্ষেত্রে সম্পদের মালিকানাকে অনিশ্চিত সম্ভাবনাময় বিষয়ের সাথে যুক্ত করা হয়, যা জুয়া বলে গণ্য। (تعليق الملك مع الخطر باطل) আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ. إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَعَنِ الصَّلَاةِ ۖ فَهَلْ أَنْتُمْ مُنْتَهُونَ
“হে মুমিনগণ, এই যে মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য-নির্ধারক শরসমূহ -এসব শয়তানের অপবিত্র কার্য বৈ তো নয়। অতএব, এগুলো থেকে বেঁচে থাক -যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও। শয়তান তো চায়, মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মাঝে শুত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত করে দিতে এবং আল্লাহর স্মরণ ও নামায থেকে তোমাদেরকে বিরত রাখতে। অতএব, এখনও কি তোমরা নিবৃত্ত হবে?” (সূরা মায়েদা ৯০-৯১)
চতুর্থত: মানুষের প্রাণ বা অঙ্গ শরীয়তের দৃষ্টিতে মূল্যমান সমৃদ্ধ কোনো পণ্য নয়। কাজেই তার মূল্য নির্ধারণ শরিয়ত সম্মত নয়।
পঞ্চমত: প্রিমিয়ামের টাকা কোম্পানির কাছে ঋণ হিসেবে থাকে। যা নির্দিষ্ট শর্তে শর্তযুক্ত করা হয়। আর ঋণকে শর্তযুক্ত করা অবৈধ।
ষষ্ঠত:এই প্রকার বীমায় প্রিমিয়াম কিছুদিন পরিশোধ করার পর বন্ধ করে দিলে তা আর ফেরত দেয়া হয় না। যা শরিয়ত পরিপন্থী ও অমানবিক।
সপ্তমত: এই প্রকার বীমায় এমন কিছু নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য করা হয়, শরিয়তে যা বাধ্য করা হয় নি। এই চুক্তিতে বীমা কর্তৃপক্ষ থেকে কোন দুর্ঘটনা আসে নি বা দুর্ঘটনার কোন কারণও হয়নি, তবু শুধু বীমাকারীর সাথে চুক্তির কারণে ‘দুর্ঘটনা হতে পারে’এমন অনুমানের ভিত্তিতে বীমাকারীর কিছু অর্থের বিনিময়ে তাকে অর্থ দিতে বাধ্য থাকবে। এই জন্য এটা হারাম লেনদেন।
সবচে’ বড় কথা হল মানুষ মৃত্যুবরণ করার পর তার পরিবার কিভাবে চলবে-তার সিদ্ধান্ত আল্লাহ রব্বুল আলামিন নিজেই করে রেখেছেন। সুতরাং মৃত্যুবরণ করার পর লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি যে কয়টি টাকা তার পাওয়ার কথা, তা দিলেই সেই পরিবারের সকল প্রকার সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে-এই কথা বিশ্বাস করা একেবারেই শিরকি গুনাহ এবং লাইফ ইনস্যুরেন্স কর্মীদের কর্তৃক একপ্রকার বিশেষ রকমের প্রতারণা মাত্র। তাছাড়া সকল নীতিমালা ইংরেজি ভাষায় লিখা থাকাতে আসল সর্ত সম্বন্ধে কোন গ্রাহকই তেমন কিছুই জানে না যে, সে কোন বিধানের উপর স্বাক্ষর করল। তাই এই ধরনের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এবং বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক ফিকহ একাডেমি (ওআইসির একটি শাখা সংস্থা) এবং সউদী আরবের উচ্চ উলামা পরিষদ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, সব ধরণের বাণিজ্যিক বীমা হারাম। চাই তা জীবন বীমা হোক বা সম্পদের বীমা হোক।
শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী