দাড়ির বিধান ও পরিমাপ কি?

জিজ্ঞাসা১৪২: আসসালামু আলাইকুম। হযরত, আমার দাড়ি আল্লাহ্‌র রহমতে এক মুষ্ঠি হয়েছে। এখন আমার প্রশ্ন হল, দাড়ি রাখা সুন্নত কতটুকু এবং  কতটুকু রাখা ফরয? আর আমি কি এখন দাড়িগুলোকে সাইজ করে হালকা কাটতে পারবো?–মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান।

জবাব: ওয়ালাইকুমুসসালাম।

প্রিয় দ্বীনি ভাই, দাড়িআল্লাহর একটি মহান ও বড় নি‘আমত। ইসলামের নিদর্শন বলে বিবেচিত। দাড়ি মানেই পুরুষত্ব, এটি পুরুষত্বের পরিচয়, মুসলিমের সৌন্দর্য। এটি মহান আল্লাহর প্রকাশ্য নিদর্শনসমূহের অন্যতম নিদর্শন। এর দ্বারা আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ذَٰلِكَۖ وَمَن يُعَظِّمۡ شَعَٰٓئِرَ ٱللَّهِ فَإِنَّهَا مِن تَقۡوَى ٱلۡقُلُوبِ  “আর কেউ আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে সম্মান করলে এটা তার হৃদয়ের তাকওয়া হতে উদ্ভূত বা আল্লাহ সচেতনতার লক্ষণ।” (সূরা আল-হাজ, আয়াত: ৩২)

তাছাড়া দাড়ি রাখার মাধ্যমে আপনি অন্তত কয়েকটি গোনাহ থেকে বেঁচে গেছেন- আলহামদুলিল্লাহ। যেসব গোনাহ থেকে বেঁচে গেছেন তন্মধ্যে অন্যতম হল, যথা-

(১) অবাধ্যতা থেকে বেঁচে গেছেন। ইমাম ইবনে জারীর তবারী রাহ. যায়েদ ইবনে আবী হাবীব রাহ.-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন। ইয়েমেনের শাসকের পক্ষ থেকে দু’জন লোক আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এল। তাদের দাড়ি মুন্ডানো ছিল এবং মোচ লম্বা ছিল। তাদের চেহারার দিকে তাকাতেও আল্লাহর রাসূলের কষ্ট হচ্ছিল। তিনি তাদেরকে বললেন, তোমাদের মরণ হোক! এ কাজ করতে কে তোমাদেরকে বলেছে? তারা বলল, আমাদের প্রভু (কিসরা) আমাদেরকে আদেশ করেছেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ولكن ربي أمرني بإعفاء لحيتي وقص شاربي কিন্তু আমার রব আমাকে আদেশ করেছেন, দাড়ি লম্বা রাখার ও মোচ খাটো করার।(আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া ৩/৪৫৯-৪৬০)

(২) হেদায়েতের পথ হারিয়ে ফেলা থেকে বেঁচে গেছেন। যেহেতু রাসুলুল্লাহর সুন্নাহ (আদেশ, কাজ এবং গুণগতভাবে) বলেছে দাড়ি বড় করার কথা, সেহেতু এটা কামিয়ে ফেলা হচ্ছে তাঁর সম্মানিত সুন্নাহ তথা জীবনাচরণের প্রতি একটি চরম অপমান। তিনি বলেছেন, مَن رغِب عن سُنتي فليس مِنِّي “যে আমার সুন্নাহর বিরাগভাজন হয় সে আমার দলভুক্ত নয়”। (মুসলিম, ৩২৩৬)

(৩) আল্লাহর সৃষ্টির পরিবর্তন-বিকৃতি ঘটানোর গোনাহ থেকে বেঁচে গেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, مَنْ مَثَّلَ بِالشَّعْرِ، فَلَيْسَ لَهُ عِنْدَ اللهِ خَلَاقٌ. “যে ব্যক্তি চুল-দাড়ি উঠিয়ে বা কেটে অথবা কালো করে নিজেকে বিকৃত করল, আল্লাহর নিকট তার কোনও অংশ নেই।” (আল্লাহর নিকট সে কিছুই পাবে না)।(আত-ত্বাবরানী, হাদীস নং ১০৯৭৭)

(৪) অবিশ্বাসীদের সাথে সাদৃশ্য গ্রহণের গোনাহ থেকে বেঁচে গেছেন। ইবনে উমর  রাযি.-এর সূত্রে অন্য হাদীসে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন خالفوا المشركين اوفروا اللحي وأحفوا الشوارب তোমরা গোঁফ ছোট কর এবং দাড়ি লম্বা রাখো।( বুখারী, ৫৮৯৩ , মুসলিম ৬০০)

(৫) নারীদের সাদৃশ্য গ্রহণের গোনাহ থেকে বেঁচে গেছেন। ইবন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ المُتَشَبِّهِينَ مِنَ الرِّجَالِ بِالنِّسَاءِ، وَالمُتَشَبِّهَاتِ مِنَ النِّسَاءِ بِالرِّجَالِ“যেসব পুরুষ নারীর সাথে এবং যেসব নারী পুরুষের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ বেশভূষা গ্রহণ করে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত হওয়ার বদ দো‘আ করেছেন”। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৮৮৫, ৭/১৫৯; আবু দাউদ, হাদীস নং ৪০৯৮, ৪/৬০; তিরমিযী, হাদীস নং ২৭৮৪)

বিখ্যাত আলেম ইবন আবদুল বার রাহিমাহুল্লাহ বলেন, দাড়ি কামানো হারাম, শুধুমাত্র মেয়েলি স্বভাবজাত পুরুষেরাই তা করতে পারে।

(৬) গোনাহকে সবার সামনে প্রকাশ করা যা অতি কঠিন হারাম কাজ-তা থেকে বেঁচে গেছেন। । সহীহ বুখারীর হাদীসে রয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,كُلُّ أُمَّتِي مُعَافًى إِلَّا المُجَاهِرِينَ “আমার উম্মতের সবাইকে আল্লাহর রহমতে মাফ করা হবে, তবে তারা ব্যতীত যারা গোনাহ ও নাফরমানীকে সকলের কাছে প্রকাশ করে বেড়ায়……”।(বুখারী, ৬০৬৯)

প্রিয় দ্বীনি ভাই, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের সকল মুজতাহিদ-ইমাম বলেন, দাড়ি লম্বা রাখা ওয়াজিব এবং তা কমপক্ষে এক মুষ্ঠি পরিমাণ হতে হবে । এ ব্যাপারে চার মাযহাবের সকল ইমামের ইজমা প্রতিষ্ঠিত। এক মুষ্ঠির অতিরিক্ত অংশ কাটার সুযোগ শরীয়তে রয়েছে। এক মুষ্ঠির কম রাখা বা একেবারে তা মুন্ডানো সর্বসম্মতিক্রমে হারাম এবং কবীরা গোনাহ। কেননা হাদীসের কিতাবে পাওয়া যায়, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাযি. ও হযরত আবু হুরায়রা রাযি. এক মুষ্ঠির অতিরিক্ত অংশ কেটেছেন। যেমন-

আবু যুরআ রাহ. বলেন, আবু হুরায়রা রাযি. তাঁর দাড়ি মুঠ করে ধরতেন। এরপর এক মুষ্ঠির অতিরিক্ত অংশ কেটে ফেলতেন।(মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ১৩/১১২, হাদীস : ২৫৯৯২; ২৫৯৯৯)

নাফে রাহ. বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. মুষ্ঠির অতিরিক্ত দাড়ি কেটে ফেলতেন।(প্রাগুক্ত হাদীস : ২৫৯৯৭)

হাসান বসরী রাহ. বলেন, তাঁরা (সাহাবা-তাবেয়ীগণ) মুষ্ঠির অতিরিক্ত দাড়ি কাটার অবকাশ দিতেন।(প্রাগুক্ত ১৩/১১২, হাদীস : ২৫৯৯৫)

কিন্তু কোনো সহীহ বর্ণনায় এক মুষ্ঠির ভিতরে দাড়ি কাটার কোনো অবকাশ পাওয়া যায় না।

সাহাবা-তাবেয়ীনের এই আমলকে  এসম্পর্কিত মারফূ-হাদীসগুলোর ব্যাখ্যা হিসেবে গ্রহণ করা যায়। সুতরাং এ বিষয়ের হাদীস ও আছার থেকে প্রতীয়মান হয় যে, দাড়ি লম্বা রাখা ওয়াজিব, কেটে বা ছেটে এক মুষ্ঠির চেয়ে কম রাখার অবকাশ শরীয়তে নেই।

সবশেষে একটি আফসোসের কথা বলি। বর্তমানে দাঁড়ি নিয়ে খেল-তামাসা চলছে। কেউ কেউ এটাকে কেটে ছেটে থুতনির উপর নিয়ে রেখেছে, কেউ কেউ দাড়িকে হালকা সরল কালো রেখা, আবার কেউ বক্র রেখার মতো এঁকেছে। কেউ কেউ দাঁড়ি মোচ এক করে ফ্রেন্চ কার্টিন করে বৃত্ত অংকন করে রেখেছে।

আবার অনেক যুবক কোনো খেলোয়াড় বা নায়কের নতুন ধরনের চুল বা দাড়ির কাটে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের চেহারাতেও সেরকম করার অযথা চেষ্টা চালায়। আবার কেউ কেউ ষ্টাইল করে কেটে-ছেটে খুব ছোট ছোট করে গালের সাথে মিলিয়ে রেখেছে। অনেকে ক‘দিন রাখে আবার ক‘দিন শেষ করে দেয়। এসব দাঁড়ি যে উদ্দেশ্যে রাখা হয়েছে, সেটাই হবে, সাওয়াব কখনও হবে না। আল্লাহ সহিহ বুঝ দান করুন। আমীন।

والله اعلم بالصواب

আরো পড়ুন: চুল রাখার সুন্নত তরিকা

��ন্তব্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

fourteen − 2 =