গুরুজন যদি বিদ‘আতি হয় তাহলে কিভাবে বোঝাবেন?

জিজ্ঞাসা৭৬:

মুহতারাম,

আসসালামু আলাইকুম।

আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আমার নানা এবং তাদের এলাকার সকলে বেদআ’ত করে  তারা দাঁড়িয়ে কিয়াম করাসহ নবীজি (সা.)কে নূরের  নূরের তৈরি মনে করে। তারা বলে, তিনি আমাদের মতো মানুষ নন। আযানে মুয়াজ্জিন যখন ‘আশহাআন্না মুহাম্মাদার রাসূল্লাহ’ বলে তখন চোখে আঙ্গুল মোছা ইত্যাদি করে থাকে। আর মাঝে-মধ্যে আমাকে কোন অনুষ্ঠান বা ইফতার আয়োজনে দাওয়াত করে। তখন তাদের মসজিদের ইমাম সাহেবও থাকেন। উনি ‘ইয়া নবী সালামুআলাইকা’ বলে দাঁড়িয়ে যান। সকলে দাঁড়িয়ে যায়।  ইমাম সাহেবের ভক্ত সবাই।  উনিও বেদ’আত করেন।এখন হযরতের কাছে আমার জানার বিষয় হলো, যেহেতু আপন নানা মামাদের অনুষ্ঠান ও দোয়ার আয়োজন।  সেখানে থাকতে হয়। না গেলে অনেক কিছু মনে করে। এখন সেখানে উপস্থিত হলে আমার কি করণীয়? আর আমি যে তাদেরকে বুঝাবো আমি মাত্র অল্প ইলম অর্জন করেছি। এ বিষয়ে এত বেশি কিছু জানিওনা।  মাত্র নাহবেমীর শেষ হলো। আর নানাজির সাথে এবিষয়ে বেশি কথা বলাই যায় না।  বললেই বলে ওহাবী।  আরো অনেক কথা।  এখন এতটা সামনে বলেনা।  তবে সে মানতে রাজি না।  তারটাই ঠিক। তাকে বুঝানোর মতো কেউ আল্লাহর দুনিয়ায় কেউ আছে কিনা আল্লাহই ভালো জানেন। হযরত সমাধান দিয়ে বাধিত করবেন।–সাইফুল।

জবাব: ওয়ালাইকুমুসসালাম।

প্রথমত : জানা প্রয়োজন যে,আখেরি নবী ও শ্রেষ্ঠ রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর  প্রতি ভালবাসা ও গভীর মহব্বত রাখা কোন সাধারণ বিষয় নয়; বরং এটি ঈমানের অপরিহার্য অংশ এবং গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতও বটে। একজন বান্দা পরিপূর্ণ ঈমানের স্বাদ পাবে তখনই, যখন তার মাঝে রাসূলের প্রতি ভালবাসা বিদ্যমান থাকবে। তবে উক্ত ইবাদত অবশ্যই সে পদ্ধতিতে করতে হবে, যে পদ্ধতি স্বয়ং নবীজী (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে শিক্ষা দিয়েছেন। তারপর সাহাবায়ে কেরাম (রা.) তাবেঈনদের শিক্ষা দিয়েছেন এবং তাবেঈনগণ পরবর্তীদের শিখিয়ে গেছেন। মনগড়া বা ভিত্তিহীন কোনো তরীকায় করলে তা ইবাদত বলে গণ্য হয়না। ইমাম মালেক(রহ.) এজন্য  বলতেন: “সে যুগে যা দ্বীন বা ধর্ম ছিল না, এ যুগেও তা দ্বীন বলে গণ্য হবে না।” অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে যা দ্বীন ছিল না, সে যুগে যার মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদাত করা হয়নি, তার পরবর্তী যুগে তা দ্বীন ও ধর্মের অংশ হিসেবে গণ্য হবে না; বরং বিদ‘আত হবে।

যে বিদ‘আত থেকে রাসূল (সা.) নিজেই উম্মতকে সাবধান করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :

وشر الأمور محدثاتها ، وكل بدعة ضلالة

“আর সবচেয়ে খারাপ বস্তু হচ্ছে বিদআত, আর প্রত্যেক বিদআত গোমরাহী।” (সহীহ মুসলিম: ১৪৪১)

অথচ দেখা যায়, অনেক লোক আমাদের সমাজে উক্ত ইবাদাতের নামে নানাবিধ বিদ‘আত চালু করেছে ।   এদেরকে যখন বিদ‘আত ছেড়ে দেয়ার আহবান জানানো হয়, তখন তারা বিদ‘আতকে আরো শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে।

সহীহ বুখারীর এক বর্ণনায় নবীজী (সা.) নিজেই বলেন,

لَا تُطْرُونِي كَمَا أَطْرَتْ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ فَقُولُوا عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ

‘‘তোমরা আমার সম্পর্কে অতিরঞ্জন করো না, যেমন নাসারাগণ অতিরঞ্জন করেছে ইবনু মারইয়াম সম্পর্কে। আমি তো শুধূ আল্লাহর বান্দা। বরং তোমরা বলো – (আমি) আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল।’’

প্রচলিত মিলাদ, কিয়ামসহ উল্লেখিত বিষয়গুলো  নবীজী (সা.) সম্পর্কে অতিরঞ্জন, তাঁর প্রতি মহব্বতের অন্যায় ব্যবহার, নাজায়েজ ও বিদ’আতের অন্তর্ভুক্ত বলেই সকল হক্কানী ওলামায়ে কেরাম একবাক্যে ফতওয়া দিয়ে থাকেন। কারণ,কুরআন-হাদীসে, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন ও তাবে তাবেঈনের সোনালী যুগে এগুলো পাওয়া যায় না। অথচ সর্বস্বীকৃত সত্য হলো, তারাই ছিলেন প্রকৃত নবীপ্রেমী খাঁটি আশেকে রাসূল এবং নবীজী সা. এর আদর্শের পরিপূর্ণ অনুসারী ও বাস্তব নমুনা।

দ্বিতীয়ত : প্রশ্নকারী ভাই, তোমার কথা থেকে বোঝা যাচ্ছে, উপরোক্ত বিদ‘আতগুলোর সঙ্গে যারা জড়িত তারা  তোমার একান্ত আপনজন ও গুরুজনও বটে। সুতরাং তুমি যা করবে তাহল—

১. তাদের সাথে ঝগড়া, বাদানুবাদ ও বেআদবিসদৃশ আচরণ কখনই করবেনা। বরং তাদের সাথে সুন্দর কথা-কর্ম ও আদর্শ প্রকাশ কর, আর তুমি তোমার চরিত্র ও সু্ন্নাত পালনের মধ্য দিয়ে তাদের মাঝে তোমার ‘ব্যাক্তিত্ব’ তৈরি কর। পাশাপাশি ধৈর্যের সাথে নম্র ভদ্র-ভাবে তাদেরকে অল্প-অল্প করে বোঝানোটা অব্যাহত রাখ। মনে রাখবে, তারা হেদায়েত যদি নাও পায়; তুমি দাওয়াতের সাওয়াবতো অবশ্যই পাবে।

২. যদি তাদের মধ্যে কাউকে বুদ্ধিমান দেখ, যে শ্রবণ করবে ও উপকৃত হবে, তাহলে বোঝানোর ক্ষেত্রে তাদেরকে তুমি আগে বাছাই কর এবং প্রয়োজনে তদেরকে কোনো মহাক্কিক আলেমের কাছে নিয়ে যাও কিংবা তাঁর বয়ান শোনাও। সুন্নাতের উপকারিতা ও বিদ‘আতের ভয়াবহত বিষয়ক কিতাব তাদেরকে পড়তে দাও। এটাও ফলপ্রসূ হবে, ইনশাআল্লাহ।

৩. তুমি বলেছ, ‘নানা মামাদের অনুষ্ঠান ও দোয়ার আয়োজন।  সেখানে থাকতে হয়। না গেলে অনেক কিছু মনে করে। এখন সেখানে উপস্থিত হলে তোমার কি করণীয়?’ এক্ষেত্রে আমি তোমাকে উপদেশ দিব, প্রথমত,এজাতীয় অনুষ্ঠান হেকমতের সাথে ভদ্র উপায়ে এড়িয়ে চলার পুরা চেষ্টা করবে। একান্ত যদি উপস্থিত থাকতে বাধ্য হও তাহলে তুমি বসে থাকার ‘জিহাদ(?)’ করোনা; এতে তুমি ‘ওহাবি’ তকমা নিয়ে তাদের চোখ থেকে পড়ে যাবে। যা তোমার ভবিষ্যত-দাওয়াতি কাজে বড় দেয়াল হয়ে দাঁড়াবে। বরং এ অবস্থায় তুমিও দাঁড়িয়ে যাবে এবং তাদের বানোয়াট দুরুদ না পড়ে নিম্নস্বরে দুরুদে-ইবরাহিমি পড়বে। কারণ দুরুদও একপ্রকার জিকির। আর জিকির দাঁড়িয়ে বসে শোয়ে—সব অবস্থায় করা যায়।

৪. পরিশেষে তুমি যেহেতু একজন তালিবে ইলম আর আমি মাদরাসার উসতাদ, তাই তোমাকে ইলম অর্জন ও গুনাহ পরিত্যাগ করার উপদেশ দিচ্ছি। এ দু’টির উপর যদি তুমি পুরোপুরিভাবে চলতে পার তাহলে তোমাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, ‘ইনশাআল্লাহ’ তুমি একদিন শুধু তোমার পরিবারের জন্য নয়; বরং জাতির  জন্য  হেদায়াতের ‘বাতিঘর’ হতে পারবে। মনে রাখবে, সব কিছুর একটা উপযুক্ত সময় থাকে। এসবের পেছনে পড়ার মত উপযুক্ত সময় এখনো তোমার হয় নি। এখন তোমার তিনটি কাজ—১. ইলম শেখা ২. ইলম শেখা এবং ৩. ইলম শেখা ।

দোয়া করি,আল্লাহ যেন তোমাকে জাতির জন্য উপকারী আলেম বানায়। আমীন।

والله اعلم بالصواب
উত্তর দিয়েছেন
শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

8 − three =