গোপন বিয়ে: শরিয়ত কী বলে?

জিজ্ঞাসা–১১১৮: আসসালামু আলাইকুম। দু’জন যুবক, যুবতী যদি নিজেদের চরিত্র রক্ষার্থে একে অপরকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু পড়ালেখা শেষ না হওয়ায় অভিভাবকগণ যদি মেনে না নেয় তাহলে তারা অভিভাবকদের অজ্ঞাতে কাজী অফিসে গিয়ে বাকি সব শর্ত, সাক্ষী সব মেনে বিয়ে করে, তাদের বিয়ে কি হালাল হবে নাকি হারাম? আর এমতাবস্থায় অভিভাবকগণ মেনে না নিলে তাদের অজ্ঞাতে বিয়ে করা ছাড়া চরিত্র রক্ষার আর কোনো উপায় আছে কি?–নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক।

জবাব: وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

এক. প্রিয় ভাই, আপনি কি আমাদের কাছে এজন্য মেইল করেছেন যে, প্রশ্নোক্ত যুবক-যুবতীকে গোপনে বিয়ে করার অনুমতি দিব?! অথচ অভিভাবকশূন্য এমন অসামাজিক ও অমানবিক বিয়ের অনুমতি দেয়ার অধিকার তো আমাদের নেই। কেননা, ইসলামের নির্দেশনা হলো,أعلنوا النكاح ‘বিয়ে করবে ঘোষণা দিয়ে।’ (মুসনাদে আহমাদ ৪/৫) 

নাকি আপনি চাচ্ছেন যে, আমরা উক্ত যুবক-যুবতীকে বিবাহ-বহির্ভূত প্রেম বৈধ বলে ফতোয়া দিব?! অথচ কোনো আলেমের পক্ষে এ ফতোয়া দেয়া সম্ভব নয়। কেননা, রাসূলুল্লাহ ﷺ এটাকে যেনা বা ব্যভিচার বলেছেন-

اَلْعَيْنَانِ زِنَاهُمَا النَّظْرُ وَالْاُذُنَانِ زِنَاهُمَا الْاِسْتِمَاعُ وَاللِّسَانُ زِنَاهُمَا الْككَلَامُ وَالْيَدُ زِنَاهُمَا الْبَطْشُ وَالرِّجْلُ زِنَاهُمَا الخُطَا وَالْقَلْبُ يَهْوِىْ وَيَتَمَنَّى وَيُصَدِّقُ ذَالِكَ الْفَرْجُ اَوْ يُكَذِّبُه

দুই চোখের ব্যভিচার হল হারাম দৃষ্টি দেয়া, দুই কানের ব্যভিচার হল পরনারীর কণ্ঠস্বর শোনা, জিহবার ব্যভিচার হল, [পরনারীর সাথে সুড়সুড়িমূলক] কথোপকথন। হাতের ব্যভিচার হল পরনারী স্পর্শ করা, পায়ের ব্যভিচার হল গুনাহর কাজের দিকে পা বাড়ান, অন্তরের ব্যভিচার হল কামনা-বাসনা আর গুপ্তাঙ্গঁ তা সত্য অথবা মিথ্যায় পরিণত করে। (সহীহ মুসলিম ২৬৫৭, মুসনাদে আহমাদ ৮৯৩২)

দুই. প্রিয় ভাই, আপনি হয়ত ভাবছেন, গোপনে বিয়ে করার মাধ্যমে উক্ত যুবক-যুবতী প্রশান্তি পাবে?! আল্লাহ আপনাকে এমন ভাবনা থেকে দূরে রাখুন ও পবিত্র রাখুন। যদি আপনি এমনটি ভেবে থাকেন তাহলে মহা ভুলের মধ্যে আছেন। বরং ‘অভিভাবকশূন্য বিয়ে’ মানে পারিবারিক মর্যাদা, সামাজিক অবস্থান, চরিত্রের পবিত্রতা, নারীত্বের আমানতদারিতা, অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ সর্বোপরি  দ্বীনদারির উপর কালো ও অতি বিশ্রি দাগ স্থায়ীভাবে বসে যাওয়া এবং এমন কিছু পরিণামের দুয়ার খোলা, যা পরবর্তীতে তাদের বৈবাহিক-জীবনে অশান্তির বড় কারণ হবে।

সুতরাং আপনি কিভাবে প্রত্যাশা করেন যে, আমরা উক্ত যুবক-যুবতীকে ইজ্জত কলঙ্কিত করার অনুমতি দিব এবং বলব, ঠিক আছে গোপনে বিয়ে করে ফেলুক; অসুবিধা নেই!!

তিন. প্রিয় ভাই, আপনাকে কষ্ট দেয়া কিংবা উক্ত যুবক-যুবতীকে ফেতনায় ফেলে রাখা আমাদের উদ্দেশ্যে নয়; আমরা শুধু এ ব্যাপারে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছি যে, উক্ত যুবক-যুবতী যা করছেন এবং করতে চাচ্ছেন সেটা কত বড় জঘন্য! আপনারা হয়তো ভুলে গেছেন যে, ইসলামে ধৈর্য বা সবর নামক এক মহান ইবাদত আছে; যার বিনিময়ে রয়েছে রবের সন্তুষ্টি এবং রয়েছে জান্নাত। এজন্য দেরীতে বিয়ের যে পরীক্ষার মধ্যে উক্ত যুবক-যুবতী আছে এ অবস্থায় আমরা তাদেরকে ধৈর্য রাখার উপদেশ দিচ্ছি। উক্ত যুবক-যুবতীর এ ভালবাসা যদি তাদেরকে আল্লাহর ভালবাসা থেকে বিমুখ না করে এবং কোন প্রকার হারাম কথা ও কাজের দিকে নিয়ে না যায় তাহলে নিশ্চিত থাকুন, আল্লাহ তাদেরকে এমনভাবে পুষিয়ে দিবেন; যার কল্পনাও বান্দা করতে সক্ষম নয়। إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُونَ أَجْرَهُم بِغَيْرِ حِسَابٍ যারা সবরকারী, তারাই নিজেদের পুরস্কার পায় অগণিত। (সূরা যুমার ১০)

চার. পরিশেষে আমরা উক্ত যুবক-যুবতীকে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হওয়ার উপদেশ দিচ্ছি এবং পারিবারিকভাবে তাড়াতাড়ি বিয়ে হওয়ার জোর প্রচেষ্টা ও দোয়া হেকমত, বুদ্ধিমত্তা ও শালীনতার সাথে চালাবার পরামর্শ দিচ্ছি এবং গুনাহ ত্যাগ, নেক আমলের মাধ্যমে রবের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার আহ্বান জানাচ্ছি।

আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন ঈমানকে তাদের কাছে প্রিয় করে দেন, সুশোভিত করে দেন। তাদেরকে সুপথপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত করে নিন।

আমরা আশা করব, রবের সন্তুষ্টির জন্য তারা ফিতনার গলিপথ চিহ্নিত করে সেটা বন্ধ করে দিবে। শয়তানের রাস্তা বন্ধ করে দিবে। অবৈধ সম্পর্ক ও অবৈধ যোগাযোগ অটুট  রাখা থেকে বিরত থেকে আমাদের আলোচ্য পরামর্শ ও উপদেশগুলো মেনে চলবে।

পাঁচ. এতদসত্ত্বেও যদি উক্ত যুবক-যুবতী আমাদের আলোচ্য উপদেশ ও পরামর্শকে উপেক্ষা করে এবং প্রশ্নোক্ত নেক সূরতের অন্যায় লালসায় তাড়িত হয়ে কমপক্ষে দু’জন সাক্ষীর উপস্থিতিতে বিয়ে করেই ফেলে, তাহলে যদিও শরিয়তের দৃষ্টিতে বিশেষ বিবেচনায় বিয়ে শুদ্ধ হয়ে যাবে। তবে এই অসামাজিক অকৃতজ্ঞতাপূর্ণ ঘৃনিত কাজের জন্য তাদের লজ্জিত হওয়া এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিৎ।

।فى الدر المختار- ( و ) شرط ( حضور ) شاهدين ( حرين ) أو حر وحرتين ( مكلفين سامعين قولهما معا ) (الدر المختار ، كتاب النكاح،-3/9)

অর্থাৎ, বিবাহ সহীহ হওয়ার শর্ত হল শরীয়তের মুকাল্লাফ [যাদের উপর শরীয়তের বিধান আরোপিত হয়] এমন দুইজন আযাদ পুরুষ সাক্ষি বা একজন আযাদ পুরুষ ও দুইজন মহিলা সাক্ষী হতে হবে, যারা প্রস্তাবনা ও কবুল  বলার উভয় বক্তব্য স্বকর্ণে উপস্থিত থেকে শুনতে পায়। (আদ দুররুল মুখতার-৩/৯, ফাতওয়ায়ে হিন্দিয়া-১/২৬৮)

আরব বিশ্বের বর্তমান সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম শায়খ মুহাম্মাদ সালেহ আলমুনাজ্জিদ অভিবাবক ছাড়া মেয়েদের বিবাহের ক্ষেত্রে বলেছেন,

المسألة اجتهادية .. . .فإنه إذا كان أهل بلد يعتمدون المذهب الحنفي كبلادكم وبلاد الهند وباكستان وغيرها ، فيصححون النكاح بلا ولي ، ويتناكحون على هذا،فإنهم يقرّون على أنكحتهم ، ولا يطالبون بفسخها

অর্থাৎ, এটি একটি ইজতিহাদি মাসআলা..সুতরাং যে সব দেশের মানুষেরা হানাফী মাজহাবের উপর নির্ভর করে, ওলী (অভিবাবক) ছাড়া বিবাহবে বৈধ মনে করে এবং এভাবে তাদের বিয়ে হয় যেমন, ভারত, (বাংলাদেশ) পাকিস্তান ইত্যাদি, তাহলে তাদের বিবাহের স্বীকৃতি দেয়া হবে । বাতিল করতে বলা হবে না।

والله اعلم بالصواب
উত্তর দিয়েছেন
শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three × two =