জারজ সন্তান কাকে বলে এবং তার সামাজিক মর্যাদা কী হবে?

জিজ্ঞাসা–৭৫৪: অবৈধ মেলামেশার কারণে যদি সন্তান এসে যায় তার বিধান কী? যদি এর পর বিয়ে করে সে (বিবাহপূর্ব মিলনের) সন্তানের বৈধতার বিধান কী? আর সে যদি অবৈধ ই হয়, তার সামাজিক মর্যাদা কী হবে? বর্তমান প্রেক্ষাপটে, তার মর্যাদা ও অধিকার কি ক্ষুণ্ণ হবে? এ বিষয়ে বিস্তারিত সমাধান চাচ্ছি। উত্তর পেয়ে যেন প্রশ্নের খুঁটিনাটি সহ অন্যান্য সব তথ্য পেতে সমর্থ হই। –হোসাইন।

জবাব:

এক. অবৈধ মেলামেশার কারণে যদি সন্তান এসে যায় তাহলে রূহ আসার পর গর্ভপাত করা সম্পূর্ণ হারাম। কেননা, যদি বৈধ বিয়ের মাধ্যমে আসা গর্ভস্থ সন্তানের মধ্যে রূহ এসে যায় তাহলে গর্ভপাত ঘটানোর ফলে যদি বাচ্চাটি মারা যায় তাহলে এটা অন্যায় হত্যার শামিল, যা আল্লাহ হারাম করেছেন। সুতরাং অবৈধ মেলামেশার মাধ্যমে আসা গর্ভস্থ সন্তান হত্যা যে আরো শক্ত হারাম তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

হাদিস শরিফে এসেছে, গামিদিয়া মহিলা যে নবী কারীম -এর খেদমতে হাজির হয়ে ব্যভিচারের স্বীকৃতি দিয়েছিল। তখন নবী কারীম  ওই মহিলাকে এই বলে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন যে, যেন সে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর আসে। তারপর যখন সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মহিলাটি আসল তখন এই বলে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন যে, যেন সে সন্তানকে দুধ পান করানোর মেয়াদ পূর্ণ করে আসে। তারপর দুধ পান করানোর মেয়াদ পূর্ণ করার পর যখন মহিলাটি আসল, তখন ওই সন্তানের হাতে ছিল রুটির একটি টুকরো। এরপর এই মহিলাকে প্রস্তরাঘাত করা হয়েছিল। (মুসলিম ১৬৯৫)

লক্ষণীয় বিষয় হল, রাসুলুল্লাহ উক্ত মহিলাকে গর্ভপাত করার অনুমতি দেন নি এবং এই অবস্থায় তার উপর ইসালামের দণ্ডবিধি প্রস্তরাঘাতও প্রয়োগ করেন নি; বরং তার সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর যখন শিশুটি দুগ্ধ পান থেকে বিরত হয়েছিল তখন তাকে প্রস্তরাঘাত করা হয়েছিল। এতে প্রমাণিত হল, অবৈধ মেলামেশার কারণে যদি সন্তান এসে যায় তাহলে রূহ আসার পর গর্ভপাত করা সম্পূর্ণ হারাম। আসলে এভাবে অবৈধ গর্ভ নষ্ট করার সুযোগ দেয়া হলে মানুষের মাঝে ব্যভিচার আরো বেড়ে যাবে। তা ছাড়া গর্ভস্থ সন্তানের কী দোষ যে, তাকে হত্যা করে দেয়া হবে? আল্লাহ তাআলা বলেন,وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَىٰ কেউ অপরের বোঝা বহন করবে না। (সূরা ইসরা ১৫)

দুই. এরপর উক্ত সন্তানের জন্মগ্রহণ দুই অবস্থায় হতে পারে।

১- সন্তানটি জন্ম নেয়ার আগেই ব্যভিচারী ব্যভিচারিনীকে বিয়ে করে নিয়েছে।

যদি এমনটি হয় তাহলে বিয়ের কমপক্ষে ছয় মাস পর বাচ্চা জন্ম নিলেই উক্ত সন্তান স্বামী-স্ত্রীর বৈধ সন্তান হিসেবে গণ্য হবে। তখন স্বামী একে নিজের সন্তান না বলে অস্বীকার করতে পারবে না। (মাবসুত সারাখসি ১৭/১৫৫)

আলী ইবন আসিম ইমাম আবু হানিফা রহ থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন,

 لا أرى بأسا إذا زنى الرجل بالمرأة فحملت منه , أن يتزوجها مع حملها , ويستر عليها , والولد ولد له

অবৈধ মেলামেশার কারণে যদি সন্তান এসে যায় তারপর তারা যদি একে অপরকে বিয়ে করে নেয় তাহলে বিষয়টি গোপন রাখার ও সন্তানটির পিতা উক্ত স্বামী; একথা বলার মাঝে আমি মন্দ কিছু দেখি না। (আলমুগনি ৯/১২২)

২- আর যদি ব্যভিচারী ব্যভিচারিনীকে বিয়ে না করে থাকে অথবা বিয়ে করলেও বিয়ের আগেই ব্যভিচারিনী সন্তান প্রসব করে দেয় তাহলে তখন উক্ত সন্তান বৈধ সন্তান বলে বিবেচিত হবে না; বরং তখন সে উক্ত মহিলার জারজ সন্তান হিসেবে বিবেচিত হবে। এমনকি এই অবস্থায় ব্যভিচারী-পুরুষটি নিজের সন্তান দাবী করলেও সে তার সন্তান হবে না। কেননা রাসুলুল্লাহ বলেছেন, الْوَلَدُ لِلْفِرَاشِ وَلِلْعَاهِرِ الْحَجَرُ সন্তান বৈধ স্বামীরই গণ্য হবে আর ব্যভিচারীর জন্য পাথর অর্থাৎ, সে সন্তানের দাবী থেকে বঞ্চিত হবে। (বুখারি ২০৫৩ মুসলিম ২০৫৭)

প্রিয় প্রশ্নকারী ভাই, আশা করি এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, ইসলাম অবৈধ মেলামেশার কারণে জন্ম নেয়া যে কোন সন্তানকে ‘জারজ’ বলে দেয় নি; বরং ইসলাম মানবসন্তানের বংশ সংরক্ষণে ও তাকে অসম্মানের আঁচড় থেকে বাঁচাতে সর্বাধিক চেষ্টা করে থাকে বিধায় যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো সম্ভাবনায় বৈধতা দেওয়া যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত তার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে।

তিন. বাকি রইল, ইসলামের দৃষ্টিতে যে সন্তান জারজ বলে সাব্যস্ত হবে, তার পারিবারিক ও সামাজিক মর্যাদা বা অধিকার কী হবে? এর সংক্ষিপ্ত উত্তর হল, তার রক্ষণাবেক্ষণ, প্রতিপালনসহ ধর্মীয় প্রায় সকল বিধান বৈধ সন্তানের অনুরূপ। কেননা, এখানে সন্তানের কোনো দোষ নেই; বরং দোষ তার মা-বাবার, তাই তার বৈধ অধিকার ইসলামে সাব্যস্ত রয়েছে। তবে কিছু কিছু বিধানে সবার চেয়ে পার্থক্যও রয়েছে। যেমন,

—তার বংশ মায়ের থেকে সাব্যস্ত হবে। যেহেতু বাবা অবৈধ, তাই অবৈধ বাবার সঙ্গে সম্পর্কিত হবে না। কেননা রাসুলুল্লাহ বলেছেন, الْوَلَدُ لِلْفِرَاشِ সন্তান বৈধ স্বামীরই হয়। (বুখারি ২০৫৩)

—তার ভরণ-পোষণ ও লালন-পালনের অধিকারী হবে তার মা। মায়ের পক্ষ সন্তানের ভরণ-পোষণ বহন করবে। অর্থাৎ তার মায়ের ভরণ-পোষণ যাঁর দায়িত্বে, তার ভরণ-পোষণও তিনিই দেবেন।

—মায়ের পক্ষ তার আকিকা করবে। অর্থাৎ তার মায়ের ভরণ-পোষণ যাঁর দায়িত্বে, তার আকিকা তিনিই করবেন। তবে এসব সন্তানের আকিকার ক্ষেত্রে গোপনীয়তা উত্তম, যাতে সন্তানের মর্যাদা ক্ষুণ্ন না হয়। (হাশিয়াতুশ শারবিনি আলা তুহফাতিল মুহতাজ ৩/৩১১)

— এই সন্তানের বংশ যেহেতু মায়ের থেকে সাব্যস্ত, তাই সে মা ও মায়ের নিকটাত্মীয়দের উত্তরাধিকারী হবে। (রদ্দুল মুহতার ৬/৭৭৬)

—তাকে মুয়াজ্জিন বানানো বৈধ, তবে উপযুক্ত অন্য কেউ থাকা অবস্থায় তাকে মুয়াজ্জিন বানানো অনুত্তম। এর দুটি কারণ রয়েছে—এক. স্বাভাবিকভাবে সবার দৃষ্টিতে পবিত্র ও সম্মানিত ব্যক্তিকে মুয়াজ্জিন বানানো হয়। মানুষের দৃষ্টিতে ওই সব সন্তান যেহেতু একটু অন্য রকম মনে হয়, তাই এমন সন্তানকে মুয়াজ্জিন বানানো বৈধ হলেও মাকরুহ। দ্বিতীয়ত, তাদের অভিভাবকত্বের ত্রুটির কারণে তারা বেশির ভাগই সুশিক্ষিত হয় না, তাই তাদের চেয়ে অন্যরা এ ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবে। (মাবসুতে সারাখসি  ১/১৩৭-১৩৮, বাদায়েউস সানায়ে ১/১৫০)

— ইমামতির উপযুক্ত অন্য কেউ থাকা অবস্থায় তাকে ইমাম বানানো মাকরুহ, এ ক্ষেত্রে আগে উল্লিখিত দুটি কারণেই তাদের ইমাতি মাকরুহ। তবে যদি সে আলেম ও উপযুক্ত হয়, তখন তাকে ইমাম বানানো মাকরুহ নয়। (রদ্দুল মুহতার ১/৫৬২)

—তাকে ব্যভিচারী বা জারজ বলে গালি দেওয়া যাবে না। এমনকি কেউ যদি তাকে ব্যভিচারী বলে গালি দেয়, তাকে অপবাদ দেওয়ার শাস্তি প্রয়োগ করা হবে। কেননা তার মা-বাবা অন্যায়কারী হলেও সে ওই অন্যায়ে অংশীদার নয়। (মাবসুতে সারাখসি ৯/১২৭)

والله اعلم بالصواب
উত্তর দিয়েছেন
শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী
আরো পড়ুন–

��ন্তব্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × five =