তালাকের ওয়াসওয়াসায় আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতি পরামর্শ

জিজ্ঞাসা–১১০১: আসসালামু আলাইকুম। আমি একটা দীর্ঘ প্রশ্ন করেছিলাম, যেটা আপনার বুঝতে একটু সমস্যা হয়েছে,আমাকে ফোন করতে বলেছিলেন। কিন্তু আমার ফোনে কথা বলতে একটু সমস্যা আছে। আমি কারো সাথে এগুলো শেয়ারও করতে পারছি না। তাই আমি আবার যতটা পারি বুঝিয়ে প্রশ্ন করছি। আপনার ওয়াসওয়াসা সম্পর্কিত লেকচার শুনে আমি যা বুঝতে পারছি যে, এর আলামতের প্রায় সবগুলোই আমার মধ্যে আছে। পাক নাপাক গোছল ওযু নামাজ সবগুলোইতেই আগে অনেক ওয়াসওয়াসা কাজ করত। আল্লাহর অশেষ রহমতে এখন অনেকটাই সুস্থ আছি। ইদানিং আমার বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম হয়ে গেল কিনা, আমরা স্বামী স্ত্রীর হিসাবে এখনো বৈধ আছি কিনা–এ ধরনের সন্দেহ হচ্ছে। আল্লাহ মাফ করুন। তো আমার সমস্যাটা এমন যে, আমার মনে মনে কথায় কথায় শর্ত চলে আসে, যেসব শর্ত একজন পুরুষ তার স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললে এবং বাস্তবে ওই শর্ত পাওয়া গেলে তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম হয়ে যাবে। যেমন কোন পুরুষ যদি তার স্ত্রীকে এভাবে বলে–১. অমুক কাজ করলে……২. তুমি যদি অমুক জায়গায় যাও তাহলে……..(প্লিজ বুঝে নিবেন। আমি ওই কথা বলতে লিখতে এমনকি কারো মুখে শুনলেও এখন ভয় পাই)। এ শর্তগুলো আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আসে। প্রায় সব কাজের সাথেই চলে আসে। আমি চাইলেও এ ধরনের ভাবনা থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। যখন শর্তগুলো আসে তখন আমি চেষ্টা করি যাতে মুখ দিয়ে ওই কথাগুলো উচ্চারিত না হয়। কিন্তু মনে এমন ভাবনা আসার প্রায় সাথে সাথেই আমি কনফিউজড হয়ে যাই যে, শুধু মনে মনেই বললাম নাকি মুখেও বলে ফেললাম..। এরকম বেশ কয়েকটা কাজের উপর শর্ত দেওয়া নিয়ে আমার মনে শুধু সন্দেহ হচ্ছে যে, আমি হয়ত মুখেও বলেছিলাম কিনা; যার ফলে এটা ভেবে ভয় হচ্ছে যে, যদি কোনদিন এ কাজটা করা হয়ে যায় তাহলে কি হবে? তখন কি আমাদের স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক হারাম হয়ে যাবে? আল্লাহ হেফাজত করুন। কিন্তু আমি অনেক ভেবেও নিশ্চিত হতে পারলাম না যে আসলেই কি আমি যে সকল কাজের উপর শর্ত নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে ওগুলো মুখে বলেছিলাম নাকি শুধু মনে মনেই বলেছি!  এরকম আরেকটা বিষয় নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে যে, ওই কাজের সাথেও হয়ত আমি এরকম শর্তযুক্ত করে বলেছিলাম। কিন্তু ওই কাজটা এমন যে আমি কোনদিন ওই কাজ নিজ থেকে না করলেও আমার অজান্তেই করা হয়ে যেতে পারে। এজন্য আমি বিষয়টা নিয়ে সব সময় ভয়ে থাকি। অনেক বার অনেকভাবে ভেবে বের করতে চেষ্টা করেছি যে, আসলেই ওই কথাটা আমি ঠিক কিভাবে বলেছিলাম, মুখে বলেছিলাম নাকি মনে মনেই বলেছিলাম? কোন শর্তযুক্ত করে বলেছিলাম নাকি এমনি বলেছিলাম? তবে তীব্র ধারণা হয়, আমি কথাটা কোন প্রকার শর্ত দেওয়া ছাড়াই বলেছিলাম। কোন বিষয়ে এরকম সন্দেহ হতে থাকলে কিন্তু মুখে বলেছিলাম নাকি মনে মনেই বলছিলাম কোনটাই অনেক চেষ্টা করে ভেবেও নিশ্চিত হতে না পারলে ওই কাজটা যদি করা হয়ে যায় তাহলে বৈবাহিক সম্পর্কে কোন সমস্যা হবে কিনা? এরকম সন্দেহ নিয়ে ইসলামে কী বলে? সন্দেহ দ্বারা কি কোন কিছু কার্যকর হয়? নাকি আমি আল্লাহ ভরসা করে কাজগুলো করে ফেলব যাতে করে আমার মনের ভয় দূর হয়ে যায়।–নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক।

জবাব: وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

প্রিয় প্রশ্নকারী ভাই, আপনার প্রতি আমাদের পরামর্শ হল,

এক. অহেতুক পেরেশানী করে নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করবেন না। আপনি কাজগুলো করে ফেলুন এবং মনের তীব্র কনফিউশন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিন। এতে আপনার বৈবাহিক সম্পর্কে কোনো ধরণের ক্ষতি হবে না। কেননা, আপনি তালাক নিয়ে যতই চিন্তা করুন না কেন, কিংবা মনে মনে কথা বলুন না কেন, কিংবা মনে মনে যতই উল্লেখিত শর্ত আওড়ান না কেন, কিংবা নিয়ত ও সংকল্প করুন না কেন– যতক্ষণ পর্যন্ত মুখে উচ্চারণের বিষয়টি পরিপূর্ণ নিশ্চিত হবেন না ততক্ষণ পর্যন্ত তালাক হবে না। এর দলিল হল, রাসুলুল্লাহ বলেছেন,

إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ تَجَاوَزَ لأُمَّتِي مَا وَسْوَسَتْ بِهِ وَحَدَّثَتْ بِهِ أَنْفُسَهَا مَا لَمْ تَعْمَلْ أَوْ تَتَكَلَّمْ بِهِ

‘নিশ্চয় আল্লাহ্‌ তাআলা আমার উম্মতের ওয়াসওয়াসা, মনে মনে কথা বলা ক্ষমা করে দিয়েছেন; যতক্ষণ না সে কর্ম করে কিংবা কথা বলে।’ (সহিহ বুখারী ৬৬৬৪ সহিহ মুসলিম ১২৭)

উকবাহ ইবনু আ’মির রাযি. বলেন,

لاَ يَجُوزُ طَلاَقُ الْمُوَسْوِسِ

‘ওয়াসওয়াসা সম্পন্ন (সন্দেহের বাতিকগ্রস্ত) ব্যক্তির তালাক কার্যকর হয় না।’ (সহিহ বুখারী, অধ্যায় ৬৮)

দুই. তালাক সংক্রান্ত কোন মাসআলা পড়বেন না। কাউকে জিজ্ঞাসা করতেও যাবেন না। কারো সাথে এ সংক্রান্ত আলাপ ও আলোচনাও করবেন না। মনের মাঝে এ বিষয়ক কোন কিছু আসতে দিবেন না। আসলেই অন্য বিষয় নিয়ে মগ্ন হয়ে যাবেন, প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলবেন। ইবনে হাজার আল-হাইতামি রহ. বলেন,

له دواء نافع وهو الإعراض عنها جملة كافية ، وإن كان في النفس من التردد ما كان

‘ওয়াসওয়াসার কার্যকরী চিকিৎসা হল, একে সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে যাওয়া; এমনকি মনের মধ্যে কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকা সত্ত্বেও।’ (আল-ফাতাওয়া আল-ফিকহিয়্যা আল-কুবরা ১/১৪৯)

তিন. ইয্‌য ইবনে আব্দুস সালাম রহ. বলেন, ওয়াসওয়াসার প্রতিষেধক হচ্ছে- ব্যক্তি এ বিশ্বাস করা যে, এটি শয়তানী কুমন্ত্রণা। ইবলিস এটি তার অন্তরে আরোপ করছে এবং তার সাথে লড়াই করছে। এতে করে সে ব্যক্তি জিহাদ করার সওয়াব পাবে। কেননা সে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র শত্রুর সাথে লড়াই করছে। যদি কেউ এভাবে অনুভব করতে পারে তাহলে শয়তান তার থেকে পালিয়ে যাবে।

চার. সকাল ও সন্ধ্যায় পড়ুন-–أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّةِ، مِنْ غَضَبِهِ وَشَرِّ عِبَادِهِ، وَمِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ وَأَنْ يَحْضُرُونِ (আমি আল্লাহর পরিপূর্ণ কালেমার আশ্রয় প্রার্থনা করি তার অসম্ভষ্টি ও শাস্তি থেকে এবং তার বান্দার অনিষ্ট থেকে এবং শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে ও শয়তানের সংস্পর্শ থেকে।)

পাঁচ. ফজর ও মাগরিবের পর এবং ঘুমানোর আগে সূরা ফালাক ও নাস পড়ুন। হাদিসে এসেছে, উকবা ইবনে আমের রাযি. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ বলেছেন,

أَلَمْ تَرَ آيَاتٍ أُنْزِلَتِ اللَّيْلَةَ ، لَمْ يُرَ مِثْلُهُنَّ قَطُّ ؟ قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ ، وَقُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ

তোমার কি জানা নেই আজ রাতে আমার ওপর যে আয়াতগুলো নাজিল হয়েছে এগুলোর মতো কোনো আয়াত দেখা যায় নি। আর তা হলো কুল আয়ুজু বি রাব্বিল ফালাক ও কুল আয়ুজু বি রাব্বিন নাস। (মুসলিম ৮১৪)

বিস্তারিত জানার জন্য পড়ুন জিজ্ঞাসা নং–১০২০, জিজ্ঞাসা নং–৮৬৩।

আমরা আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন যে ওয়াসওয়াসায় আপনি আক্রান্ত তা দূর করে দেন। আমাদের ও আপনার ঈমান, দ্বীনদারি ও তাকওয়া বাড়িয়ে দেন।

والله اعلم بالصواب
উত্তর দিয়েছেন
শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

one × five =