নারী-পুরুষের নামাজের ভিন্নতা প্রসঙ্গে

জিজ্ঞাসা৮৪: আমি কিছুদিন আগে মুফতী দেলোয়ার হুসাইন সাহেবের বয়ান থেকে একটি হাদীসের ব্যাখ্যা শুনেছি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা আমাকে যেভাবে নামাজ পড়তে দেখেছ, সেভাবেই নামাজ পড়ো।’ তিনি বলেন, এই হাদীসে ‘সাল্লূূ’ শব্দটি পুুংলিঙ্গ। তথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই হাদীসে পুরুষদেরকে সম্বোধন করে বলেছেন। এখন প্রশ্ন হল, আমার সহকমী সাইদুররহমান জানতে চেয়েছেন, মহিলাদের নামাজ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিভাবে শিক্ষা দিয়েছেন–এর কোনো দলিল আছে কিনা? তার বক্তব্য অনুযায়ী নারীদের জন্যে নামাজ আদায়ের ভিন্ন পদ্ধতি নেই। পুরুষ ও নারী একই পদ্ধতিতে নামাজ  আদায় করতে হবে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানালে উপকৃত হব।–নাবিল হাসান

জবাব: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র হাদীসে স্পষ্টভাবেই নারী-পুরুষের নামাজের কয়েকটি ভিন্নতার কথা বর্ণিত হয়েছে। এ ভিন্নতার কথা বর্ণিত হয়েছে  সাহাবায়ে কেরামের পবিত্র ফতোয়া ও বাণীতেও। দীর্ঘ প্রায় দেড় হাজার বছরের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, তা এমনই শক্তিশালী দলীলসমৃদ্ধ যে,সাহাবীযুগ থেকে শুরু করে প্রত্যেক যুগেরই বরেণ্য ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণ এবং মুজতাহিদ ইমামগণ এ ভিন্নতার পক্ষেই তাদের মত ব্যক্ত করেছেন। তাঁদের সংকলিত ও রচিত বিভিন্ন হাদীসের কিতাব, হাদীসের কিতাবের ব্যাখ্যাগ্রন্থ, ফিকহী রচনা—এসবই এর প্রমাণ বহন করে। যার কারণে পৃথিবীর দেশে দেশে মুসলিম নারীগণ তাদের নামাজে পুরুষদের সাথে যুগ যুগ ধরে যে ভিন্নতা রক্ষা করে চলছেন।
ইসলামী শরিয়তে যে সকল বিষয়ে নারী-পুরুষের মাঝে পার্থক্য বিধান করা হয়েছে, এর অন্যতম হচ্ছে সতর। সবকিছুর ক্ষেত্রেই নারীদেরকে এমন নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যাতে তাদের সতর বেশি রক্ষিত থাকে।  একজন নারীর জন্যে সার্বিক বিবেচনায় এমনটি হওয়াই স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকতার ধারাবাহিকতায় নারীদের নামাজ আদায়ের পদ্ধতিও এমন, যা তাদের সতর রক্ষায় বেশি উপযোগী।

নারী-পুরুষের নামাজের পার্থক্য নির্দেশ করে এমন কয়েকটি হাদীস :

১. তাবেয়ী ইয়াযীদ ইবনে আবী হাবীব (রহ.) বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাজরত দুই মহিলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তাদেরকে (সংশোধনের উদ্দেশ্যে ) বললেন,
إِذَا سَجَدْتُمَا فَضُمَّا بَعْضَ اللَّحْمِ إِلَى الأَرْضِ ، فَإِنَّ الْمَرْأَةَ لَيْسَتْ فِي ذَلِكَ كَالرَّجُلِ(سنن الكبرى للبيهقى، كتاب الحيض، باب ما يستحب للمرأة من ترك التجافي في الركوع والسجود، رقم الحديث-3016)
অর্থাৎ, যখন সেজদা করবে তখন শরীর জমিনের সাথে মিলিয়ে রাখবে। কেননা মহিলারা এ ক্ষেত্রে পুরুষদের মতো নয়। (কিতাবুল মারাসীল, ইমাম আবু দাউদ, হাদীস : ৮০ সুুনানুলকুবরা, বাইহাকী,হাদীস নং ৩০১৬)

প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘আওনুল বারী’ (১/৫২০)তে লিখেছেন, উল্লিখিত হাদীসটি সকল ইমামের উসূল অনুযায়ী দলীল হিসেবে উপস্থাপনযোগ্য। মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল আমীর ইয়ামানী ‘সুবুলুস সালাম শরহু বুলুগিল মারাম’ গ্রন্থে (১/৩৫১,৩৫২)এই হাদীসকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করে পুরুষ ও মহিলার সিজদার পার্থক্য বর্ণনা করেছেন। প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস শায়েখ শুয়াইব আরনাউত (রহ.) হাদিসটির সুত্র সম্পর্কে বলেন, বণর্নাকারী প্রত্যেক রাবী সর্ব্বোচ্চ গ্রহনযোগ্য রাবীদের অন্তর্ভুক্ত সুতরাং হাদিসটি সহীহ। (তালীক আলা মারাসিলে আবী দাউদ পৃঃ ১১৭)

২. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إِذَا جَلَسْتِ الْمَرْأَةُ فِى الصَّلاَةِ وَضَعَتْ فَخِذَهَا عَلَى فَخِذِهَا الأُخْرَى ، وَإِذَا سَجَدْتْ أَلْصَقَتْ بَطْنَهَا فِى فَخِذَيْهَا كَأَسْتَرِ مَا يَكُونُ لَهَا ، وَإِنَّ اللَّهَ تَعَالَى يَنْظُرُ إِلَيْهَا وَيَقُولُ : يَا مَلاَئِكَتِى أُشْهِدُكُمْ أَنِّى قَدْ غَفَرْتُ لَهَا (السنن الكبرى، كتاب الصلاة، باب مَا يُسْتَحَبُّ لِلْمَرْأَةِ مِنْ تَرْكِ التَّجَافِى فِى الرُّكُوعِ وَالسُّجُودِ، رقم الحديث-3324) 

কোনো নারী যখন নামাজে বসে তখন যেন সে তার (ডান) উরু অপর উরুর উপর রাখে। আর যখন সে সেজদা করে তখন যেন পেট উরুর সাথে মিলি রাখে; যা তার সতরের জন্যে অধিক উপযোগী। আল্লাহ তায়ালা তাকে দেখে (ফেরেশতাদের সম্বোধন করে) বলেন, হে আমার ফেরেশতারা! তোমরা সাক্ষী থেকো, আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। (সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদীস নং ৩৩২৪) হাদীসটি হাসান।

৩. হযরত ওয়াইল ইবনে হুজর (রা.) বলেন, একদিন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামে দরবারে হাজির হলাম। তখন তিনি আমাকে (অনেক কথার সাথে একথাও) বলেছিলেন:
يا وائل بن حجر إذا صليت فاجعل يديك حذاء أذنيك والمرأة تجعل يديها حذاء ثدييها (المعجم الكبير، باب الواو، وائل بن حجر الحضرمي القيل، رقم الحديث-28)
হে ওয়াইল ইবনে হুজর! যখন তুমি নামাজ শুরু করবে তখন কান বরাবর হাত উঠাবে। আর মেয়েরা হাত উঠাবে বুক বরাবর। (আলমুজামুল কাবীর, তাবারানী, হাদীস নং ২৮) এই হাদীসটিও হাসান।

উল্লেখিত হাদীসগুলো থেকে একথা স্পষ্ট হয়ে যায়, কিছু কিছু হুকুমের ক্ষেত্রে নারীদের নামাজ আদায়ের পদ্ধতি পুরুষের নামাজ আদায়ের পদ্ধতি থেকে ভিন্ন। বিশেষত ২নং হাদীসটি একথারও ইঙ্গিত করে—নারীদেরকে এমন পদ্ধতিতেই নামাজ পড়তে বলা হচ্ছে যা তার সতর ও পর্দার জন্যে সর্বাাধিক উপযোগী।
নারীদের নামাজের ভিন্ন পদ্ধতির বিষয়টি এমনই অকাট্য ও স্পষ্ট যে এর বিপরীতে কোনো একটি হাদীসও এমন পাওয়া যাবে না যাতে বলা হয়েছে, পুরুষ ও মহিলার নামাজের পদ্ধতিতে কোনো পার্থক্য নেই; বরং উভয়ের নামাজই এক ও অভিন্ন। সাহাবায়ে কেরামের সুবিশাল জামাতের একজনকেও এমন পাওয়া যাবে না, যিনি এই পার্থক্যকে অস্বীকার করেছেন। আমরা এখানে সাহাবায়ে কেরামের কয়েকটি ফতোয়াও উল্লেখ করছি —

সাহাবায়ে কেরামের কয়েকটি ফতোয়া:

১. হযরত আলী রা. বলেছেন,

عن علي قال إذا سجدت المرأة فلتحتفز ولتلصق فخذيها ببطنها (مصنف عبد الرزاق، كتاب الصلاة، باب تكبير المرأة بيديها وقيام المرأة و ركوعها وسجودها، رقم الحيث-5072)

মহিলা যখন সেজদা করবে তখন সে যেন খুব জড়সড় ও সংকুচিত হয়ে সেজদা করে এবং উভয় উরু পেটের সাথে মিলিয়ে রাখে। (মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক ৩/১৩৮ হাদিস নং-৫০৭২, মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ২/৩০৮, সুনানে কুবরা, বায়হাকী ২/২২২)

২. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, মহিলা কীভাবে নামায আদায় করবে? তিনি বলেছেন,

تَجْتَمِعُ وَتَحْتَفِزُ. (مصنف ابن ابى شيبة، كتاب الصلاة، في المرأة كَيْفَ تَجْلِسُ فِي الصَّلاَةِ، رقم الحديث-2794)
অর্থ  খুব জড়সড় হয়ে এক অঙ্গের সাথে আরেক অঙ্গ মিলিয়ে নামায় আদায় করবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-১/৩০২, হাদিস নং-২৭৯৪)

উপরে মহিলাদের নামাজ সম্পর্কে দু’জন সাহাবীর যে মত বর্ণিত হল, আমাদের জানা মতে কোন হাদীসগন্থের কোথাও একজন সাহাবী থেকেও এর বিপরীত কিছু বিদ্যমান নেই। অথচ নামাজ মুসলমানের জীবনের একটি প্রাত্যাহিক স্বাভাবিক আমল। প্রত্যেক মুসলমানের জন্যেই দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা ফরজ। নারী-পুরুষের নামাজ আদায়ের পদ্ধতি যদি একই হতো, তাহলে একজন সাহাবী থেকেও এ বিষয়ে কোনো বর্ণনা পাওয়া যাবে না—তা কি ভাবা যায়?
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সাহাবায়ে কেরাম যে দীন শিখেছেন, তাঁদের কাছ থেকে তা শিখেছেন তাবেয়ীগণ। তাঁদের ফতোয়া থেকেও এ কথাই প্রতীয়মান হয়—নারীদের নামাজ পুরুষের নামাজ থেকে ভিন্ন। ইমাম বুখারী রহ.এর শায়েখ ইমাম ইবনে আবী শায়বা রহ. তাঁর প্রসিদ্ধ হাদীস সংকলন ‘আলমুসান্নাফ’-এ তাবেয়ী হযরত আতা ইবনে আবী রাবাহ, ইবনে জুরাইজ, ইবরাহীম নাখায়ী, মুজাহিদ, যুহরী, হাসান বসরী, কাতাদা রাহিমাহুমুল্লাহু তায়ালা প্রমুখের ফতোয়া উল্লেখ করেছেন। তাঁরা সকলেই নারীদের জন্যে পুরুষের চেয়ে ভিন্ন নামাজ আদায়ের পদ্ধতির ফতোয়া দিয়েছেন। (বিস্তারিত দেখুন–মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১/২৭০,৩০২,৩০৩)

সাহাবী ও তাবেয়ীযুগের সোনালী যুগের পর আসে মুজতাহিদ ইমামগণের যুগ। শত শত বছর ধরে বিশ্বব্যাপী প্রায় সকল মুসলমান মাসআলা-মাসায়েলের ক্ষেত্রে চারটি ফিকহী মাযহাবের অনুসরণ করে আসছে—হানাফী, মালেকী, শাফেয়ী ও হাম্বলী। এ চার মাযহাবের মধ্যে হানাফী মাযহাব সবচেয়ে পুরনো এবং এর অনুসারীর সংখ্যাও সর্বাধিক। এ মাযহাবের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব ইমাম আজম হযরত আবু হানীফা (রহ.) তাবেয়ী হওয়ারও সৌভাগ্য অর্জন করেন। অন্য মাযহাবের কোনো ইমাম অবশ্য তাবেয়ী ছিলেন না। এ চার মাযহাবেরই এক স্বতঃসিদ্ধ মাসআলা—নারীদের নামাজ আদায়ের পদ্ধতি পুরুষের মতো নয়। (বিস্তারিত দেখুন–হানাফী ফিকহ: কিতাবুল আসার ১/৬০৯, জামিউল মাসানীদ ১/৪০০, সিআয়া ২/১৫৬,হিদায়া ১/১০০,১১০,১১১,বাদায়িউস সানায়ে ১/৪৬৬,আল মাবসূত ১/২৫ ফাতাওয়ায়ে শামী ১/৫০৪ ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী ১/৭৩,৭৫; মালেকী ফিকহ:আয যাখীরা ২/১৯৩; শাফেয়ী ফিকহ:কিতাবুল উম্ম-১/১৩৮; হাম্বলী ফিকহ: আল মুগনী-২/১৩৯ )।

আলবানী সাহেবের অসার বক্তব্য

আশ্চর্যের কথা হল, উপরোল্লিখিত দলীলসমূহ এবং উম্মতের মাঝে নববী যুগ থেকে পর্যায়ক্রমে চলে আসা এই সর্বসম্মত আমলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আলবানী সাহেব তাঁর ‘সিফাতুস সালাতে’ ঘোষণা দিয়ে দিলেন যে, ‘পুরুষ ও মহিলার নামাযের পদ্ধতি এক।’

কিন্তু এই দাবির পক্ষে তিনি না কোন আয়াত পেশ করেছেন, না কোন হাদিস। আর কোন সাহাবী বা তাবেয়ীর ফাতওয়া। এহেন বক্তব্যের ভিত্তি তিনি শুধু এটাকেই বানিয়েছেন যে, পুরুষ ও মহিলার নামাযের পদ্ধতিগত পার্থক্যের ব্যাপারে কোন সহীহ হাদিস নাই। অথচ তার এই দাবি প্রমাণ করার জন্য উচিত ছিল উপরোল্লিখিত দলিলসমূহ বিশ্লেষণ করা। কিন্তু তিনি তা না করে কেবল পার্থক্য সম্বলিত একটি হাদীসকে –যা বক্ষ্যমান নিবন্ধে উল্লেখিত হয়েছে–শুধু এ কথা বলে যয়ীফ বলে আখ্যা দিয়েছেন যে, হাদীসটি ‘মুরসাল’। আর মুরসাল হওয়ায় এটি দুর্বল। এ ছাড়া অন্য কোন আলোচনাই তিনি দলীল সম্পর্কে করেননি।

কিন্তু তার এই কথাটি একগুঁয়েমি ছাড়া কিছু নয়। কারণ মুহাদ্দীসীনে কিরামের নিকট হাদিস মুরসাল হলেই তা অগ্রহণীয় হয়ে যায়না। কেননা প্রথমত আয়িম্মায়ে দ্বীনের অধিকাংশের মতে বিশেষত স্বর্ণযুগের ইমামগণের নিকট যদি প্রয়োজনীয় শর্তাবলী উপস্থিত থাকে। তাহলে মুরসাল হাদিসও সহীহ হাদিসের মত গ্রহণযোগ্য।

দ্বিতীয়ত: যে ইমামগণের নিকট ‘মুরসাল” হাদীসকে সহীহ বলার ব্যাপারে দ্বিধা রয়েছে তারাও মূলত কিছু শর্তের সাথে মুরসাল হাদীসকে দলীল হিসেবে পেশ করার উপযোগী মনে করেন। প্রবন্ধের শুরুতে বর্ণিত মুরসাল বর্ণনাটিতেও সেসব শর্ত বিদ্যমান রয়েছে। যার কারণে গায়রে মুকাল্লিদদের বিখ্যাত আলেম ও মুহাদ্দিস নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান ‘আউনুল বারী’ (১/৫২০ দারুর রাশীদ, হালাব সিরিয়া) তে লিখেছেন-‘হাদীসটি সকল ইমামের উসূল অনুযায়ী দলীল হিসেবে উপস্থাপনযোগ্য।’

পুরুষ মহিলার নামাযের পার্থক্য নেই প্রমাণ করতে আলবানী দ্বিতীয় যে কাজটি করেছেন তা খুবই গর্হিত। সেটা হল তিনি ইবরাহীম নাখয়ী (রহ.) নাকি বলেছেন-‘মহিলা পুরুষের মতই নামায আদায় করবে।’ এই কথাটি নাকি মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাতে আছে। অথচ সেই কিতাবের কোথাও এই উক্তিটি নাই। আল্লাহই ভাল জানেন তিনি কি করে এই কথা বলতে পারলেন!! বরং মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবার বর্ণনা সহীহ সনদে ইবরাহীম নাখয়ী থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। যেখানে ইবরাহীম নাখয়ী (রহ.) স্পষ্টই মহিলা পুরুষের নামাযের পার্থক্যের কথা বলেছেন।(দেখুন–মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১/২৭০,৩০২,৩০৩,)

আলবানী সাহেব তার নিজের দাবী প্রমাণ করার জন্য তৃতীয় আরেকটি কাজ করেছেন। সেটা হল-ইমাম বুখারী (রহ.)এর রিজালশাস্ত্রের একটি কিতাব ‘তারীখে সগীর’ থেকে নিম্নোক্ত বর্ণনাটি পেশ করেছেন-

عن ام الدرداء انها كانت تجلس فى الصلاة جلسة الرجل

 ‘উম্মে দারদা থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি নামাযে পুরুষের মত বসতেন। ‘

আলবানী সাহেব খেয়াল করতে পারেননি যে, এই বর্ণনাটি দ্বারা নামাযে পুরুষ ও মহিলার বসার ভিন্নতাই প্রমাণ হয়। এক হওয়া নয়। যদি উভয় বসার পদ্ধতি এক হত, তাহলে ‘পুরুষের মত বসা’ কথাটির কোন অর্থ থাকেনা। তাই এই কথা থেকে এটি বুঝা যায় যে, সেই যমানায় পুরুষদের মত মহিলারা বসতনা। কিন্তু তিনি যেহেতো ভিন্নভাবে বসতেন তাই এটি ইতিহাসের বর্ণনায় চলে এসেছে।

আরেকটি মজার ব্যাপার হল। উম্মে দারদা হলেন একজন তাবেয়ী। তিনি ৮০ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। তাবেয়ীর বক্তব্য দ্বারা আলবানী সাহেব দলীল পেশ করলেন। অথচ তিনিই আমাদের বর্ণিত প্রথম হাদিসটি মুরসাল বলে প্রত্যাখ্যান করলেন। আশ্চর্য ব্যাপার!!

প্রশ্নেল্লিখিত বিভ্রান্তির নিরসন

আরেকটি আশ্চর্যের বিষয় হল, কেউ কেউ বিভ্রান্তি ছড়াতে চেষ্টা করছেন এই বলে, ‘হাদীসে তো নারী-পুরুষ সকলকে আদেশ করা হয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মতো নামাজ পড়তে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা আমাকে যেভাবে নামাজ পড়তে দেখেছ, সেভাবেই নামাজ পড়ো।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬৩১, ৬০০৮, ৭২৪৬) এই হাদীসে নারী-পুরুষ সকলেই সমানভাবে আদিষ্ট। তাহলে নারীদের জন্যে নামাজ আদায়ের ভিন্ন পদ্ধতি এল কোত্থেকে?

আমরা বলব, এমন প্রসিদ্ধ ও পরিচিত একটি হাদীস নিয়ে নতুন করে বিভ্রান্তি সৃষ্টির সুযোগ নেই। কারণ এই হাদীসখানার প্রকৃত ব্যাখ্যা কী হতে পারে তা তো হাদীসবিশারদগণ আমাদেরকে জানিয়ে গেছেন বহু শতাব্দি আগেই। সঠিক মর্ম জানতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই তাঁদের সেই সব ব্যাখ্যারই শরণাপন্ন হতে হবে। সে ব্যাখ্যাগুলো সামনে রাখলে প্রতীয়মান হয়, এ হাদীসটি হয়ত কেবল পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য– যেমনটি মুফতী দেলোয়ার হুসাইন সাহেব থেকে আপনি শুনেছিলেন।  অথবা হাদীসটি নারী-পুরুষ সকলের জন্যেই প্রজোয্য; তবে সেটা পদ্ধতিগত বিষয়ে নয়, বরং হুকুম-আহকামের ক্ষেত্রে। যেমন, কিয়াম রুকু সিজদা কওমা জলসা সালাম—এ সবগুলো হুকুম আদায় করতে হবে একাগ্রতার সাথে, শান্ত ও ধীরতার সাথে। কোনো প্রকার তাড়াহুড়ো করা যাবে না। অর্থাৎ যেখানে যখন যা প্রযোজ্য সেখানে তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুকরণেই আমল করতে হবে। যেমন, প্রখ্যাত হাদীসবিশারদ হযরত মোল্লা আলী কারী (রহ.)  ‘মিরকাতুল মাফাতীহ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘তোমরা যেভাবে আমাকে নামাজ আদায় করতে দেখেছ সেভাবে নামাজ আদায় করবে’—হুকুমটি আরোপিত হবে নামাজের শর্ত ও রুকুন অর্থাৎ যাবতীয় ফরজ আমলগুলো যথাযথ আদায়ের ক্ষেত্রে। হাদীসে আল্লাহর রাসূল এ কথা বলেন নি, পুরুষ-নারীর নামাজ আদায়ের পদ্ধতি এক। তবে তারা ফরজ আমলগুলোর যথাযথ প্রয়োগের ক্ষেত্রে সমান। এ ব্যাখ্যাটিই অধিকতর সঠিক। নারী-পুরুষের নামাজ আদায়ের পদ্ধতি অবশ্যই ভিন্ন। বিষয়টি প্রমাণিত অসংখ্য হাদীস ও আছারের মাধ্যমে।’ (মিরকাতুল মাফাতীহ, ৩৫১/২)
কেউ কেউ ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে—উক্ত হাদীসে নামাজের মৌলিক বিষয়গুলোর দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ কিয়াম থেকে সালাম পর্যন্ত সব বিধানের ক্ষেত্রেই নারী-পুরুষ সকলে সমান। সবাইকেই এ বিধানগুলো সমানভাবে আদায় করতে হবে। তবে এ বিধানগুলো কে কীভাবে আদায় করবে, তা এই হাদীসে বলা হয় নি। বরং আকৃতিগত ভিন্নতার কারণে তাদের জন্যে অন্য হাদীসে স্পষ্টভাবেই ভিন্ন পদ্ধতির নির্দেশনা রয়েছে। হাদীসে বলা হয়েছে, ‘এ ক্ষেত্রে তোমরা পুরুষের মতো নও।’
বুখারী শরীফের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুল বারীতেও বলা হয়েছে, হাদীসটি দিয়ে নারী-পুরুষের নামাজ আদায়ের পদ্ধতির অভিন্নতার বিধান দেয়া যায় না।

মোট কথা, ইসলামের শুরু থেকেই নারীদের নামাজ আদায়ের পদ্ধতি ছিল ভিন্ন। হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই নারীদেরকে এ ভিন্নতার শিক্ষা দিয়ে গেছেন। তাঁর পরবর্তীতে সাহাবায়ে কেরামও এ ভিন্নতার ওপরই ফতোয়া দিয়েছেন। একই পথ অনুসরণ করেছেন তাবেয়ী ও মুজতাহিদ ইমামগণ। হাদীস সংকলকদের অনেকেই নারীদের নামাজ আদায়ের পদ্ধতি নিয়ে স্বতন্ত্র অধ্যায়ও রচনা করেছেন। প্রায় পুরো মুসলিম বিশ্বের অনুসৃত ফিকহী মাযহাবগুলোও এ ভিন্নতার সাথেই নারীদেরকে নামাজ আদায় করার কথা বলে থাকে। শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে মুসলমানদের মাঝে এ পদ্ধতি চলে আসছে অবিচ্ছিন্নভাবে। তাই নারীদেরকে যদি পবিত্র হাদীসের নির্দেশনা মোতাবেক নামাজ পড়তে হয়, যদি তারা অনুসরণ করতে চায় তাদের পূর্বসূরি সাহাবী, তাবেয়ী, ফকীহ, মুজতাহিদ, মুহাদ্দিস ও গবেষক আলেমগণের দেখানো পথ, তাহলে অবশ্যই তাদেরকে পুরুষের সাথে এসব ভিন্নতা রেখেই নামাজ আদায় করতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলে, হুবহু পুরুষের মতো নামাজ আদায় করলে, তা হাদীস ও সুন্নত মোতাবেক হবে না; বরং তা হবে হাদীস মানার নামে হাদীস অস্বীকারের শামিল।

আল্লাহ যেন আমাদের সবাই সঠিক বুঝ দান করেন।
আমীন।

والله اعلم بالصواب
উত্তর দিয়েছেন
শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 + 10 =