ফাতেহা দোয়াজ দাহম ও ফাতেহা ইয়াজদাহম কি?

জিজ্ঞাসা–১৯৩: ফাতেহা দোয়াজ দাহম ও ফাতেহা ইয়াজ দাহম কি?— ইয়ার মহম্মদ মোল্লা: ymmolla@gmail.com

জবাব: ফাতেহা দোয়াজ দাহম : রবিউল আউয়ালের বারো তারিখটি ফাতেহা দোয়াজ দাহম নামে বিশেষভাবে পরিচিত। ফাতেহা  এর অর্থ দোয়া করা, সাওয়াব রেসানী করা, মোনাজাত করা ইত্যাদি। আর দোয়াজ দাহম এর অর্থ হচ্ছে বারো। সুতরাং ফাতেহা দোয়াজ দাহম এর সম্মিলিত অর্থ হচ্ছে, বার তারিখের দোয়া, মোনাজাত বা সাওয়াব রেসানী। প্রকাশ থাকে যে, এখানে বারো বলতে রবিউল আউয়াল মাসের বারো তারিখকে বুঝানো হয়েছে।

আরবি ভাষায় ‘রবিউন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে বসন্ত, সঞ্জীবনী, সবুজের সমারোহ। রবিউল আউয়াল বলতে প্রথম সঞ্জীবনের মাস বুঝায়। কারণ মক্কার কাফের কোরাইশ সম্প্রদায় অনাবৃষ্টি ও অভাবের কালে কঠিন বিপদের মধ্য দিয়ে জীবন যাপন করছিল। যে বছর রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  মা আমেনার গর্ভে তাশরীফ আনয়ন করলেন, সেই বছর মক্কার উষ্ক শুষ্ক মরুভূমি সঞ্জীবিত হয়ে উঠল। শুষ্কবৃক্ষ তরতাজা ও ফুল-ফলে ভরে গেল। চতুর্দিকে একটা শান্তির অমীয় বাণী ও আনন্দের ধারা বয়ে যেতে লাগল। মক্কার কোরাইশেরা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে এ বছরকে নাম দিয়েছিল খুশি, আনন্দ এবং সঞ্জীবনের বছর। সর্বোপরি রবিউল আউয়ালের সে সঞ্জীবনের ধারা নিয়ে পৃথিবীর বক্ষে আবির্ভূত হয়েছিলেন আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম । সঙ্গত কারণেই মুসলমানদের নিকট ফাতেহা দোয়াজ দাহম  প্রিয় ও সম্মানিত দিন। এ দিবসটি সম্মানিত ঠিক, কিন্তু এটাকে ইবাদাত বলে এ উপলক্ষে বিশেষ মাহফিলের আয়োজন করা কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। তাছাড়া তাঁর জন্ম তারিখ নিয়ে ইতিহাসবিদদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। অনেকে রবিউল আউয়ালের বারো তারিখকে অস্বীকার করেন। আর জন্ম তারিখ নিয়ে মতবিরোধ না থাকলেও ‘জন্মদিবস’ পালন করা শরীয়ত কর্তৃক অনুমোদিত নয়; বরং বছরের যেকোনো দিন নবীজির জীবনী আলোচনা করা যায়।

ফাতেহা ইয়াজদাহম: রবিউস সানীর এগার তারিখে অনেককে ফাতেহা ইয়াজদহম (এগার তারিখের ফাতেহা) বা শায়খ আবদুল কাদের জীলানী রাহ.-এর ওফাত দিবস পালন করতে দেখা যায়। এটিকে ‘গিয়ারবি শরিফ’ বা ‘এগার শরিফ’ও বলা হয়।  এ উপলক্ষে মসজিদে আলোকসজ্জা করা হয় এবং মাহফিল-মজলিসের আয়োজন করা হয়।

এটা একটা কু-রসম। ইসলামী শরীয়তে জন্মদিবস ও মৃত্যুদিবস পালনের নিয়ম নেই। নবী-রাসূল, খোলাফায়ে রাশেদীন ও   সাহাবায়ে কেরাম আমাদের জন্য আদর্শ। তাঁদের কারোরই জন্মদিবস-মৃত্যুদিবস পালন করার কথা শরীয়তে নেই। তাদের জন্ম বা মৃত্যুদিবস পালন করতে হলে তো বছরের প্রতিদিনই পালন করতে হবে। অথচ নবী-রাসূল ও সাহাবায়ে কেরাম তো সকল ওলি-বুযুর্গেরও আদর্শ। আর এজন্যই বুযুর্গানে দ্বীন নিজেদের জন্মদিবস পালন করেননি বা অনুসারীদেরকে জন্মদিবস ও মৃত্যুদিবস পালনের আদেশ করেননি। পরবর্তী যুগের লোকেরা তা উদ্ভাবন করেছে।

ফাতিহা ইয়াজদাহম সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যে তারিখে ‘ফাতেহায়ে ইয়াজদাহম’পালন করা হয় অর্থাৎ এগার রবিউস সানী তা ঐতিহাসিকভাবে শায়খ আবদুল কাদের জীলানী রাহ.-এর মৃত্যুদিবস হিসেবে প্রমাণিতও নয়।

কারণ তাঁর মৃত্যুর তারিখ নিয়ে ইতিহাসবিদদের মাঝে মতভেদ রয়েছে।

তাঁর জীবনীগ্রন্থ ‘তাফরীহুল খাতির ফী মানাকিবিশ শায়খ আবদুল কাদির’-এ এ সম্পর্কে কয়েকটি মত উল্লেখ করা হয়েছে : রবিউস সানীর নয় তারিখ, দশ তারিখ, সতের তারিখ, আঠার তারিখ, তের তারিখ, সাত তারিখ ও এগার তারিখ। আবার কারো কারো মতে রবিউল আউয়ালের দশ তারিখ। এই আটটি মত উল্লেখ করার পর গ্রন্থকার দশই রবিউস সানীকে প্রাধান্য দিয়েছেন। (দেখুন : ফাতাওয়া রহীমিয়া ২/৭৬-৭৭)

বিখ্যাত ইতিহাসবিদ আল্লামা হাফেয যাহাবী রাহ. (৭৪৮ হি.)ও বলেছেন-

توفي في عاشر ربيع الآخر سنة إحدى وستين، وله تسعون سنة

‘তিনি নববই বছর বয়সে ৫৬১ হিজরীর রবিউস সানীর দশ তারিখে ইন্তেকাল করেন।’ (তারীখুল ইসলাম ২৯/৬০)

এছাড়া ইতিহাস ও আসমাউর রিজালের অন্যান্য কিতাবেও আট, নয় ও দশ তারিখের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, এগার তারিখ নয়।

আর মৃত্যুর তারিখ নিয়ে মতবিরোধ না থাকলেও ‘মৃত্যুদিবস’ পালন করা শরীয়ত কর্তৃক অনুমোদিত নয়; বরং বছরের যেকোনো দিন নেককার বুযুর্গদের জীবনী আলোচনা করা যায় এবং তাঁদের জন্য ঈসালে ছওয়াব করা যায়। তা না করে নির্দিষ্ট একটি দিনে জায়েয-নাজায়েয বিভিন্ন রকমের কাজকর্মের মাধ্যমে দিবস উৎযাপন করা রসম ও বিদআত ছাড়া আর কিছু নয়।

এই ধরনের বিদআত ও রসম পালনের মাধ্যমে খোদ শায়খ আবদুল কাদের জীলানী রহ.-এর মতো বুযুর্গ ওলিদের অবমাননাই করা হয়। আর আল্লাহ তাআলার অসন্তুষ্টিসহ বিদআতের অন্যান্য শাস্তি তো রয়েছেই।

والله اعلم بالصواب

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

14 − 1 =