রক্ত হারাম; তাহলে সাহাবী নবীজী ﷺ-এর রক্ত পান করলেন কেন?

জিজ্ঞাসা–৬১২: প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা:) এর রক্ত খাওয়া কি হালাল ছিল যেখানে মহান আল্লাহ সুবানাল্লাহ তায়ালা বলছেন যে, সকল মানুষের জন্য রক্ত খাওয়া হারাম? সেখানে একটি একটি হাদিসে এসেছে যে, কোন একজন সাহাবি ( রা:) না-কি রাসুল্লাহ (সা:) এর রক্ত পান করেছেন? হাদিস টি কি সত্যি সহিহ নাকি জাল? অনুগ্রহ করে আমাকে জানালে খুব উপকৃত হতাম।– ফুরকানুল হক।

জবাব:

এক. প্রবাহিত রক্ত হারাম এবং নাপাক; এ ব্যপারে কোরআন সুন্নাহ ও ইজমার দলিল পাওয়া যায়। যেমন, আল্লাহ তাআলা বলেন,

قُل لاَّ أَجِدُ فِي مَا أُوْحِيَ إِلَيَّ مُحَرَّماً عَلَى طَاعِمٍ يَطْعَمُهُ إِلاَّ أَن يَكُونَ مَيْتَةً أَوْ دَماً مَّسْفُوحاً أَوْ لَحْمَ خِنزِيرٍ فَإِنَّهُ رِجْسٌ أَوْ فِسْقاً أُهِلَّ لِغَيْرِ اللّهِ بِهِ فَمَنِ اضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍ وَلاَ عَادٍ فَإِنَّ رَبَّكَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ

আপনি বলে দিন, যা কিছু বিধান ওহীর মাধ্যমে আমার কাছে পৌঁছেছে, তন্মধ্যে আমি কোন হারাম খাদ্য পাই না কোন ভক্ষণকারীর জন্যে, যা সে ভক্ষণ করে; কিন্তু মৃত অথবা প্রবাহিত রক্ত অথবা শুকরের মাংস এটা অপবিত্র অথবা অবৈধ; যবেহ করা জন্তু যা আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে উৎসর্গ করা হয়। অতপর যে ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়ে এমতাবস্থায় যে অবাধ্যতা করে না এবং সীমালঙ্গন করে না, নিশ্চয় আপনার পালনকর্তা ক্ষমাশীল দয়ালু। (সূরা আল-আনআ’ম ১৪১)

এজন্য ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন, اتفق العلماء على أن الدم حرام نجس আলেমগণ এব্যাপারে একমত যে, নিশ্চয় রক্ত হারাম-অপবিত্র। (তাফসিরে কুরতুবী ২/২২২)

দুই. কিছু হাদিসে পাওয়া যায় যে, কিছু সাহাবী নবীজী -এর রক্ত পান করেছিলেন। তবে এ মর্মে একটি ছাড়া সকল হাদিসই সনদের বিবচনায় দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য। যেমন, ড. সালিহ আল মুনাজ্জিদ বলেন,

الخلاصة أن أصح ما ورد في شرب الصحابة بعض دم النبي ﷺ ، هو ما جاء من شرب عبد الله بن الزبير رضي الله عنه ، ولم يصح عن أحد غيره

সার কথা হল,কিছু সাহাবী নবীজী -এর রক্ত পান করেছিলেন মর্মে যে বর্ণনাগুলো পাওয়া যায়, এর মধ্যে তুলনামূলকভাবে  সহিহ আব্দুল্লাহ ইবন যুবাইর রাযি.এর পান করার বর্ণনাটি। এছাড়া অন্য কোনো বর্ণনা সহিহ নয়। (https://islamqa.info)

আর আব্দুল্লাহ ইবন যুবাইর রাযি.এর পান করার বর্ণনাটি নিম্নরূপ-

أَنَّهُ أَتَى النَّبِيَّ ﷺ وَهُوَ يَحْتَجِمُ، فَلَمَّا فَرَغَ قَالَ: يَا عَبْدَ اللَّهِ، اذْهَبْ بِهَذَا الدَّمِ فَأَهْرِقْهُ حَيْثُ لَا يَرَاكَ أَحَدٌ ، فَلَمَّا بَرَزْتُ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ عَمَدْتُ إِلَى الدَّمِ فَحَسَوْتُهُ، فَلَمَّا رَجَعْتُ إِلَى النَّبِيِّ ﷺ قَالَ: مَا صَنَعْتَ يَا عَبْدَ اللَّهِ؟ قَالَ: جَعَلْتُهُ فِي مَكَانٍ ظَنَنْتُ أَنَّهُ خَافٍ عَلَى النَّاسِ، قَالَ: فَلَعَلَّكَ شَرِبْتَهُ؟ قُلْتُ: نَعَمْ، قَالَ: وَمَنْ أَمَرَكَ أَنْ تَشْرَبَ الدَّمَ؟ وَيْلٌ لَكَ مِنَ النَّاسِ، وَوَيْلٌ لِلنَّاسِ مِنْكَ

আব্দুল্লাহ ইবন যুবাইর রাযি. বর্ণনা করেন যে, তিনি রাসুলুল্লাহ -এর কাছে এসেছেন, তখন রাসুলুল্লাহ শিঙ্গা দিচ্ছিলেন। যখন তিনি অবসর হলেন, তখন বললেন, হে আব্দুল্লাহ! রক্তগুলো নিয়ে যাও এবং এমনভাবে ঢেলে দাও, যাতে করে কেউ দেখতে না পায়। তারপর তিনি যখন রাসুলুল্লাহ থেকে দূরে আসলেন তখন ওই রক্তগুলো পান করে নিলেন। রাসুলুল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আব্দুল্লাহ! তুমি রক্তগুলো কী করেছ? তিনি উত্তর দিলেন, আমি সেখানেই লুকিয়ে রেখেছি, আমার ধারণা মতে, লোকেরা যেখানে তা দেখবে না। তখন রাসুলুল্লাহ বললেন, মনে হয়, তুমি রক্তগুলো পান করে নিয়েছ? তিনি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ। তখন রাসুলুল্লাহ  বললেন, তোমাকে কে বলেছে রক্ত পান করতে? তোমার পক্ষ মানুষের জন্য আফসোস এবং মানুষের পক্ষ থেকে তোমার জন্য আফসোস।

হাদিসটি বর্ণনা করেছেন, ইবন আসিম ‘আল আ-হাদ ওয়ালমাছানী (১/৪১৪)-তে, বাযযার তাঁর মুসনাদ (৬/১৬৯)-এ, হাকিম তাঁর মুসতাদরাক (৩/৬৩৮)-এ, বাইহাকী তাঁর সুনানুল কুবরা (৭/৬৭)-তে এবং ইবন আসাকির তাঁর তারিখে দামিশক (২৮/১৬৩)-এ। আর সকলেরই সনদে আছে, ‘হুনাইদ ইবনুল কাসিম আমির ইবন আব্দুল্লাহ ইবন যুবাইর থেকে, তিনি তাঁর বাবা থেকে…।’

হুনাইদ ইবনুল কাসিম সম্পর্কে তারিখে কবীর (৮/২৪৯) এবং আল জারহ ওয়াততা’দীল (৯/১২১) এসেছে, সেখানে তাঁর সমালোচনা কিংবা প্রশংসা কোনোটাই করা হয় নি। আর ইবন হিব্বান আসসিকাত গ্রন্থে (৫/৫১৫) উল্লেখ করেছেন যে, তাঁর থেকে মুসা ইবন ইসমাইল ছাড়া কেউ কোনো বর্ণনা করেন নি। আর এই ধরণের বর্ণনাকারীকে ‘মাজহুল’ বা অজ্ঞাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

যাই হোক, নবীজী -এর রক্ত পান সম্পর্কিত এই একটি নির্ভরযোগ্য হাদিস আছে, তবে তার মাঝেও আছে একজন অজ্ঞাত রাবী, তবে হাদিসটির উল্লেখিত সনদ ছাড়াও আরেকটি আছে যা দারাকুতনী (১/২২৮)-এ এবং ইবন আসাকির তারিখে দামিশক (২৮/১৬২)-এ উল্লেখ করেছেন বিধায় হাদিসটির দুর্বলতা কেটে গিয়েছে।

তিন. প্রিয় প্রশ্নকারী ভাই, এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়-যেমনটি আপনারও প্রশ্ন যে, রক্ত হারাম-অপবিত্র হলে আব্দুল্লাহ ইবন যুবাইর রাযি. তা পান করলেন কিভাবে?

এর জবাবে ওলামায়ে কেরাম বলেন, নবীজী -এর রক্ত পবিত্র; অন্যদের রক্ত নয়। আর এটা কেবল তাঁরই বৈশিষ্ট্য; অন্যদের নয়। কবির ভাষায়-

محمد بشر وليس كالبشر: بل هو ياقوتة والناس كالحجر

‘মুহাম্মাদ একজন মানুষ; তবে আমাদের মত নয়।

ইয়াকুত একটি পাথর; তবে অন্য পাথরের মত নয়।’

ইবন আবেদীন রহ. বলেন,  فضلاته عليه الصلاة والسلام طاهرة নবীজী -এর ‘ফুযুলাত’ (সৃষ্টিগতভাবে মানবদেহ থেকে যা বের হয় যেমন ঘাম, থুথু, রক্ত, পেশাব, পায়খানা ইত্যাদি) পবিত্র। (তানকীহুল ফাতাওয়া ২/৩৩১)

উল্লেখ্য,নবীজী -এর এরকম আরো বহু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেগুলোর বিবরণে ওলামায়ে কেরাম বহু কিতাব কয়েক ভলিউমেও লিখেছেন। এক্ষেত্রে আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ুতী রহ.-এর আলখাসায়েসুল কুবরা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

والله اعلم بالصواب
উত্তর দিয়েছেন
শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী
আরো পড়ুন–

��ন্তব্য

    • وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
      ‘শিঙ্গা’-এর আরবী নাম হিজামা (حِجَامَة )। এটি একটি নববী চিকিৎসা ব্যবস্থা। এটি আরবী শব্দ ‘আল-হাজম’ থেকে এসেছে। যার অর্থ চোষা বা টেনে নেওয়া। আধুনিক পরিভাষায় Cupping (কাপিং)। হিজামার মাধ্যমে দূষিত রক্ত (Toxin) বের করা হয়। এতে শরীরের মাংসপেশীসমূহের রক্ত প্রবাহ দ্রুততর হয়। পেশী, চামড়া, ত্বক ও শরীরের ভিতরের অরগাতসমূহের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। ফলে শরীর সতেজ ও শক্তিশালী হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eleven + fifteen =