স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য

জিজ্ঞাসা–১৫৩৭: শরীয়ত অনুযায়ী স্ত্রীর কি কি হক অবশ্য পূরণীয়?–মোঃ মিজানুর রহমান।

জবাব: প্রিয় প্রশ্নকারী দীনি ভাই, সুখকর দাম্পত্য জীবন, সুশৃঙ্খল পরিবার, পরার্থপরতায় ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন অটুট রাখার স্বার্থে ইসলাম জীবন সঙ্গী স্বামীর উপর কতিপয় অধিকার আরোপ করেছে। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি এখানে প্রদত্ত হল।

১. স্ত্রীর মোহর পরিশোধ করা। এক্ষেত্রে টালবাহানা না করা। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَآتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً

এবং তোমরা নারীদেরকে দাও তাদের মোহর খুশিমনে। (সূরা নিসা ৪)

২. বাসস্থানের ব্যবস্থা করা। আল্লাহ তাআলা বলেন,

أَسْكِنُوهُنَّ مِنْ حَيْثُ سَكَنتُم مِّن وُجْدِكُمْ

তোমরা তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী যেরূপ ঘরে তোমরা বাস কর তাদেরকেও সেরূপ ঘরে বাস করতে দেবে। (সূরা তালাক ০৬)

৩. স্বামী যে মানের খায়, স্ত্রীকেও সেই মানের খাওয়ানো এবং স্বামী যে মানের কাপড় পরিধান করে স্ত্রীকেও সে মানের কাপড়চোপড় দয়া। হাদিস শরিফে এসেছে, মু’আবিয়াহ আল-কুশাইরী রাযি. বলেন, একবার আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নিকট এসে বললাম, আমাদের স্ত্রীদের (হক) সম্পর্কে আপনি কি বলেন? রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন,

أطعِمُوهن ممَّا تأكلونَ، واكسوهنَّ ممَّا تكتَسُونَ، ولا تَضرِبوهنَّ ولا تُقَبِّحوهنَّ

তোমরা যা খাবে তাদেরকেও তা খাওয়াবে এবং তোমরা যা পরবে, তাদেরকেও তা পরিধান করাবে। তাদেরকে প্রহার করবে না এবং গালিগালাজ করবে না। (আবু দাউদ ২১৪৪)

৪. স্ত্রীর সামনে নিজেকে পরিপাটি রাখা। কেননা, পুরুষরা তাদের সঙ্গিনীকে সুন্দরভাবে দেখতে পছন্দ করে। ঠিক একইভাবে তারা তাদের সঙ্গীকেও সুন্দরভাবে দেখতে পছন্দ করে। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. বলতেন,

إِنِّي أُحِبُّ أَنْ أَتَزَيَّنَ لِلْمَرْأَةِ ، كَمَا أُحِبُّ أَنْ تَتَزَيَّنَ لِي الْمَرْأَةُ ، لِأَنَّ اللَّهَ تَعَالَى يَقُولُ : { وَلَهُنَّ مِثْلُ الَّذِي عَلَيْهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ } ، وَمَا أُحِبُّ أَنْ أَسْتَنْظِفَ جَمِيعَ حَقِّي عَلَيْهَا ، لِأَنَّ اللَّهَ تَعَالَى يَقُولُ : { وَلِلرِّجَالِ عَلَيْهِنَّ دَرَجَةٌ }

আমি আমার স্ত্রীর জন্য পরিপাটি থাকা পছন্দ করি, যেমন পছন্দ করি আমার স্ত্রী আমার জন্য পরিপাটি থাকাকে। কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর পুরুষদের যেমন স্ত্রীদের ওপর অধিকার রয়েছে, তেমনিভাবে স্ত্রীদেরও অধিকার রয়েছে পুরুষদের ওপর, নিয়ম অনুযায়ী।’ আর আমি আমার অধিকার স্ত্রীর কাছ থেকে কড়ায়গণ্ডায় আদায় করে নেয়া পছন্দ করি না। কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর নারীদের ওপর পুরুষদের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে।’ (মুসান্নাফ ইবনু আবী শাইবা ১৫৭১২)

তবে উক্ত অধিকার নিশ্চিত করার জন্য উভয়কেই হারাম ও নিষিদ্ধ বস্তু হতে বিরত থাকতে হবে।

৫. স্ত্রীর সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা। কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ আর তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে সদাচারণ কর। (সূরা নিসা ১৯)

৬. স্ত্রীর প্রতি সব সময় আন্তরিক থাকা এবং তার ভুলচুকে ধৈর্যধারণ করা। কেননা, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

واسْتَوْصُوا بالنِّساءِ خَيْرًا؛ فإنَّهُنَّ خُلِقْنَ مِن ضِلَعٍ، وإنَّ أعْوَجَ شَيءٍ في الضِّلَعِ أعْلاهُ، فإنْ ذَهَبْتَ تُقِيمُهُ كَسَرْتَهُ، وإنْ تَرَكْتَهُ لَمْ يَزَلْ أعْوَجَ، فاسْتَوْصُوا بالنِّساءِ خَيْرًا

তোমরা নারীদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। কেননা, তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে পাঁজরের হাড় থেকে এবং সবচেয়ে বাঁকা হচ্ছে পাঁজরের ওপরের হাড়। যদি তুমি তা সোজা করতে যাও, তাহলে ভেঙে যাবে। আর যদি তুমি তা যেভাবে আছে সে ভাবে রেখে দাও তাহলে বাঁকাই থাকবে। কাজেই নারীদের সাথে কল্যাণমূলক কাজ করার উপদেশ গ্রহণ কর। (বুখারী ৫১৮৫)

উক্ত হাদিস থেকে বোঝা যায়, নারীর মধ্যে বক্রতার বিষয়টি মৌলিকভাবেই সৃষ্টিগত; অতএব, আবশ্যক হলো সহজসুলভ আচরণ করা এবং ধৈর্য ধারণ করা।

৭. স্ত্রীর বিশেষ চাহিদা পূরণ করার ব্যাপারে সচেষ্ট থাকা। আল মাউসুয়া’তুল ফিকহিয়্যা (৩০/১২৭)-তে এসেছে,

 من حقّ الزّوجة على زوجها أن يقوم بإعفافها ، وذلك بأن يطأها ، وقد ذهب جمهور الفقهاء – الحنفيّة والمالكيّة والحنابلة – إلى أنّه يجب على الزّوج أن يطأ زوجته

‘স্বামীর ওপর স্ত্রীর অধিকারের মধ্যে অন্যতম হল, স্বামী স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গমের মাধ্যমে তার পবিত্র জীবন যাপনের প্রতি যত্নশীল হবে। হানাফি, মালেকি ও হাম্বলি মাযহাবের অধিকাংশ ফকিহর মতে স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হওয়া স্বামীর জন্য ওয়াজিব।’

৮. স্ত্রীর কাজে সহযোগিতা করা। হাদিস শরিফে এসেছে, আসওয়াদ রাযি. থেকে বর্ণিত, আয়েশা রাযি.-কে রাসূলুল্লাহ ﷺ ঘরে তাঁর স্ত্রীদের সাথে কী কী করতেন তা জিজ্ঞেস করা হলো। তিনি বললেন,

كانَ يَكونُ في مِهْنَةِ أهْلِهِ – تَعْنِي خِدْمَةَ أهْلِهِ – فَإِذَا حَضَرَتِ الصَّلَاةُ خَرَجَ إلى الصَّلَاةِ

রাসূলুল্লাহ ﷺ স্ত্রীদের কাজে সহযোগিতা করতেন, আর যখন নামাযের সময় হতো তখন তিনি নামাযে যেতেন। (বুখারী ৬৭৬)

৯. স্ত্রীর ধর্ম, দেহ, যৌবন ও মর্যাদায় ঈর্ষাবান ও আত্মমর্যাদাবোধ-সম্পন্ন হওয়া এবং এ সবে কোন প্রকার কলঙ্ক লাগতে না দেওয়া। কেননা,  স্ত্রী উত্তম সংরক্ষণীয় ও হিফাজতের জিনিস। লোকের মুখে-মুখে, পরপুরুষদের চোখে-চোখে ও যুবকদের মনে-মনে বিচরণ করতে না দেওয়া; যাকে দেখা দেওয়া তার স্ত্রীর পক্ষে হারাম তাকে সাধারণ অনুমতি দিয়ে বাড়ি আসতে-যেতে না দেওয়া সুপুরুষের কর্ম এবং স্ত্রীর অধিকার। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

إنَّ اللَّهَ يَغَارُ، وإنَّ المُؤْمِنَ يَغَارُ، وَغَيْرَةُ اللهِ أَنْ يَأْتِيَ المُؤْمِنُ ما حَرَّمَ عليه

আল্লাহ তায়আলা তার আত্নমর্যাদাবোধ প্রকাশ করেন এবং মুমিনগণও আত্নমর্যাদাবোধ প্রকাশ করে। আল্লাহর আত্নমর্যাদাবোধ উজ্জীবিত হয় যখন মুমিন তা করে যা তিনি হারাম করেছেন। (মুসলিম ২৭৬১)

অপর হাদিসে রাসূলুল্লাহ বলেছেন,

اَلدَّيُّوْثُ هُوَ الَّذِيْ لَا يُبَالِيْ مَنْ دَخَلَ عَلٰى أَهْلِهِ

দাইয়ুস হলো সে ব্যক্তি যে, তার পরিবারের নিকট কে প্রবেশ করল এ ব্যাপারে ভ্রুক্ষেপ করে না। (তাবরানি ১৩১৮০ আততারগিব ওয়াততারহিব ৩৪৭৬)

১০. স্ত্রীকে দ্বীনদারি শিক্ষা দেওয়া। কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেন,

يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ قُوٓاْ أَنفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا وَقُودُهَا ٱلنَّاسُ وَٱلْحِجَارَةُ

হে ঈমানদাররা, তোমরা নিজেদের ও তোমাদের পরিবার-পরিজনকে রক্ষা করো (জাহান্নামের) আগুন থেকে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর…। (সূরা তাহরীম ০৬)

১১. স্ত্রীর পরিবার ও বান্ধবীদের প্রতি বদান্যতা ও সুন্দর আচরণ দেখানো। আয়েশা রাযি. বলেন, রাসুলুল্লাহ ﷺ যখন বকরী যবেহ করতেন তখন বলতেন,

أَرْسِلُوا بِهَا إِلَى أَصْدِقَاءِ خَدِيجَةَ

এর গোশত খাদীজার বান্ধবীদের পাঠিয়ে দাও। (মুসলিম ২৪৩৫)

১২. ইসলামী শরিয়তের সীমার মধ্যে থেকে স্ত্রীর মন জয় করা। রাসুলুল্লাহ ﷺ আপন স্ত্রীদের সঙ্গে বিনোদনমূলক আচরণ করেছেন। যেমন, হাদিস শরিফে এসেছে, আয়েশা রাযি. এক সফরে রাসুলুল্লাহ ﷺ -এর সঙ্গে ছিলেন। তিনি বলেন, আমি তাঁর সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতা করে তার আগে চলে গেলাম। অতঃপর আমি মোটা হয়ে যাওয়ার পর (অন্য আরেক সফরে) তাঁর সঙ্গে আবারও দৌড় প্রতিযোগিতা করলাম, এবার তিনি আমাকে পেছনে ফেলে দিয়ে বিজয়ী হলেন। তিনি বলেন, هَذِهِ بِتِلْكَ এ বিজয় সেই বিজয়ের বদলা। (আবু দাউদ ২৫৭৮)

১৩. স্ত্রীর গোপন বিষয় বিশেষ করে মিলনসংক্রান্ত বিষয়গুলো কাউকে না জানানো। হাদিস শরিফে এসেছে, আসমা বিনতে ইয়াযিদ রাযি. বলেন, একদা আমি রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে ছিলাম, আর তাঁর সেখানে অনেক পুরুষ ও মহিলাও বসেছিল। তিনি বললেন, সম্ভবতঃ কোন পুরুষ নিজ স্ত্রীর সাথে যা করে তা (অপরের কাছে) বলে থাকে এবং সম্ভবতঃ কোন মহিলা নিজ স্বামীর সাথে যা করে তা (অপরের নিকট) বলে থাকে? এ কথা শুনে মজলিসের সবাই কোন উত্তর না দিয়ে চুপ থেকে গেল। আমি বললাম, ’জী হ্যাঁ। আল্লাহর কসম, হে আল্লাহর রসূল! মহিলারা তা বলে থাকে এবং পুরুষরাও তা বলে থাকে।’ অতঃপর তিনি বললেন,

فَلَا تَفْعَلُوا فَإِنَّمَا مِثْلُ ذَلِكَ مِثْلُ الشَّيْطَانُ لَقِيَ شَيْطَانَةً فِي طَرِيقٍ فَغَشِيَهَا وَالنَّاسُ يَنْظُرُونَ

তোমরা এরূপ করো না। যেহেতু এমন ব্যক্তি তো সেই শয়তানের মত, যে কোন নারী-শয়তানকে রাস্তায় পেয়ে সঙ্গম করতে লাগে, আর লোকেরা তার দিকে চেয়ে চেয়ে দেখে। (আবু দাউদ ২১৩৩)

১৪. একাধিক স্ত্রী থাকলে তাদের মধ্যে সমতা বজায় রাখা। রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

مَنْ كَانَتْ لَهُ امْرَأَتَانِ فَمَالَ إِلَى إِحْدَاهُمَا جَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَشِقُّهُ مَائِلٌ

যার দু’জন স্ত্রী আছে আর সে তার মধ্যে একজনের প্রতি অধিক ঝুঁকে পড়ে, সে ব্যক্তি কিয়ামতের দিন অর্ধাঙ্গ অবস্থায় আসবে। (আহমাদ ২৭৫৮৩)

১৫. শাসন ও সংশোধনের ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখা। রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

اتَّقُوا اللَّهَ في النِّسَاءِ فَإِنَّكُمْ أَخَذْتُمُوهُنَّ بِأَمَانِ اللَّهِ وَاسْتَحْلَلْتُمْ فُرُوجَهُنَّ بِكَلِمَةِ اللَّهِ وَلَكُمْ عَلَيْهِنَّ أَنْ لَا يُوطِئْنَ فُرُشَكُمْ أَحَدًا تَكْرَهُونَهُ فَإِنْ فَعَلْنَ ذلك فَاضْرِبُوهُنَّ ضَرْبًا غير مُبَرِّحٍ وَلَهُنَّ عَلَيْكُمْ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ

তোমরা স্ত্রীলোকদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা তাদের আল্লাহর আমানত হিসেবে গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহর কালেমার মাধ্যমে তাদের লজ্জাস্থান নিজেদের জন্য হালাল করেছ। তাদের উপরে তোমাদের অধিকার এই যে, তারা যেন তোমাদের শয্যায় এমন কোন লোককে স্থান না দেয় যাকে তোমরা অপছন্দ কর। যদি তারা এরূপ করে তবে হালকাভাবে প্রহার কর। আর তোমাদের উপর তাদের ন্যায়সঙ্গত ভরণ-পোষণের ও পোশাক-পরিচ্ছেদের হুকুম রয়েছে। (মুসলিম ১২১৮)

১৬. আল্লাহর কাছে দোয়া করা। কীভাবে দোয়া করতে হবে আল্লাহ আমাদের তা শিখিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন,

رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَٰجِنَا وَذُرِّيَّٰتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍۢ وَٱجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا

‘হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের স্ত্রীদের পক্ষ থেকে এবং আমাদের সন্তানের পক্ষ থেকে আমাদের জন্য চোখের শীতলতা দান করো এবং আমাদের মুত্তাকিদের জন্য আদর্শস্বরূপ করো (সূরা ফুরকান ৭৪)

আল্লাহ তাওফীকদাতা।

والله أعلم بالصواب

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 × four =